বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা পর্ব-১৯+২০

0
241

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ১৩

বিন্নীরা গ্রাম ছেড়েছে আজ পুরো একদিন হলো। প্রকৃতিতে তখন বিরহের সুর। দুঃখী, দুঃখী মেঘ যেন আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতিও যে মানুষ হারিয়ে অসহায় হয়েছে। পত্র আজ আর স্কুল যায় নি। রান্নাঘরের বাসি থালাবাসন নিয়ে সে পুকুর পাড়ে চলে গেলো। পুষ্প শুয়ে আছে নিজের ঘরে। ছায়া তৈরী হচ্ছেন সদরে যাওয়া উদ্দেশ্যে। গতকাল যাওয়ার কথা থাকলেও বিন্নীদের অনাকাঙ্খিত প্রস্থানের জন্য আর যাওয়া হয় নি। তাই দ্রুত তৈরী হয়ে নিচ্ছেন সে।

পুকুরপাড়ের নিরবতা ঠেলে পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে। পত্র এক মনে থালাবাসন ধুচ্ছে। হুট করেই অনুভব করলো সে- তার পিছনে কেউ উপস্থিত। পত্র ঘুরে তাকালো না, কিন্তু আন্দাজ করতে পারলো কে এসেছে। পিছনের পদচারণের শব্দ থেমে গেলো। তারপর কেটে গেলো মিনিট দুই। চারপাশের নিরবতা তখন ঘন হয়ে এলো। পত্র এবার পেছন ফিরে তাকালো কিন্তু কাঙ্খিত মানুষটাকে না দেখে তার কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে এলো। সে আবার ঘুরে নিজের কাজে মনযোগ দিলো। সেকেন্ড ঘুরতেই উপস্থিত ব্যাক্তি মুখ খুললো, গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“আমি তোমায় কিছু বলতে চাই পত্রলেখা।”

পত্র একমনে থালাবাসন ধুয়ে উঠে এলো। মুখ চোখ গম্ভীর করে বললো,
“কী বলতে চান?”

সামনে দারুণ সুদর্শন পুরুষের আজ চোখ মুখে আগের মতন উৎফুল্ল ভাবটা নেই। সে আজ বেশ গম্ভীর। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“তুমি হয়তো এটা শুনে আমাকে ঘৃণা করবে জানি কিন্তু আমি নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে পারছি না। তাই তোমাকেই সব বলে যেতে চাই।”

আতসের হেয়ালি কথায় ভ্রু কুঁচকালো পত্র। লোকটাকে আজ বেশ উসকোখুসকো দেখাচ্ছে। পত্র মনযোগ দিলো আতসের সারা অঙ্গে। লোকটার ভেতর কেমন এলোমেলো ভাব! পত্র ভ্রু যুগল আরও খানিকটা কুঁচকে বললো,
“হ্যাঁ বলুন।”

আতস কথা বলতে গিয়েও কেমন যেন বার বার থেমে যাচ্ছে। অস্বস্তি বোধ করছে। পত্র সময় দিলো আতসকে। ছেলেটা নিজেকে সামলে নিলো অনেকটা সময় নিয়ে। হুট করেই আচমকা বলে উঠলো,
“পত্র, প্রথম দেখায় তোমার চুল ভীষণ ভালো লেগেছিল। সাথে তোমার ভীতু ভীতু ভাবটাও। চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব আছে তোমার। কিন্তু সত্যি বলতে তোমাকে আমার ভালো লেগেছে কেবল। বন্ধু হিসেবে তুমি দারুণ মানুষ হবে। সেই হিসেবেই হয়তো আমার তোমাকে ভালো লেগেছে। কিন্তু আমার প্রকাম ভঙ্গী ছিলো অন্যরকম। সে যাই হোক, কেন জানি তোমাকে আমার ভীষণ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে, আর সেই ভীষণ বিশ্বাস থেকেই আজ একটা কথা বলতে এসেছি। আমি খুব শীগ্রই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবো। আমার বন্ধু-বান্ধব কাউকে জানাই নি আমি। তোমাকেই জানালাম।”

পত্র আতসের কথায় চরম বিস্মিত হলো যা তার চোখ-মুখে প্রকাশ পেলো। কিছুক্ষণের জন্য কী বলতে হবে তা-ই যেন সে ভুলে গেলো। বিস্মিত হয়ে বললো,
“তার মানে! আপনি শহরে চলে যাবেন মানে? আর কাউকে জানাবেনই না কেন?”

“পত্র, আমি বিন্নীকে ভালোবাসি, অনেক বেশিই ভালোবাসি। কিন্তু বিন্নী তা জানেনা। সে মনে প্রাণে মানে তুমি আমাকে পছন্দ করো। সে হিসেবেই সে আমার সাথে কথা বলতো। তাই আমিও তাকে বলতে পারি নি আমার মনের কথা। কিন্তু আর নিজেকে আটকে রাখতে পারছি না। বিন্নীকে ছাড়া এ গ্রামে আমার ভালো লাগছে না। আমি চলে যাবো শহরে। আমিও ঢাকা থাকি, যেখানে বিন্নী গিয়েছে। আমি পারবো না ঐ মেয়েটাকে ছাড়া থাকতে। তাই আমাকে যেতে হবে। আমি চলে যাবো পত্র। তুমি বন্ধু হিসেবে থেকো। খুব বিশ্বাস করেছি আমি। রেখো আমার বিশ্বাস টুকু।”

পত্র চমকালো। বিশ্বাস! সে আদৌও বিশ্বাস রাখতে পারবে! কারো বিশ্বাস সে রাখে নি। রাখতে পারে নি। সে আদৌও পারবে রাখতে বিশ্বাস! আতস ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে ফেললো নাতো!

পত্রকে চুপ থাকতে দেখে আতসই বললো,
“ভালো থেকো পত্রলেখা। ভালো থাকুক তোমার চা বাগান। সুস্থ হয়ে উঠুক তোমার চা বাগান। আমি আসছি।”

পত্র কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। সব কেমন গোলমেলে লাগলো তার। ভীষণ গোলমেলে। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আতস ছেলেটা যেতে যেতেও ফিরে তাকালো, কেমন অদ্ভুত স্বরে বললো,
“ভালোবাসার অভিনয়ে তুমি দারুণভাবে জিতেছো। তুমি আমায় কখনোই ভালোবাসো নি পত্র, তা দেখে অবশ্য আজ স্বস্তি মিললো। তোমার চোখের কোথাও আমাকে হারানোর ভয় ছিলো না। তুমি ভালোবাসায় হয় বড্ড জয়ী নাহয় একদম কাঁচা।”

পত্র নিরুত্তর চেয়ে রইলো। তার অনেক কিছু বলার থেকেও যেন কিছু বলার রইলো না। সত্যিই কি সে ভালোবাসায় বড্ড কাঁচা! অথচ ভালোবাসার জন্য ই তো আজ কতো বলিদান!

_

থালাবাসন গুলো রান্নাঘরে রাখতেই ছায়ার মুখোমুখি হলো পত্র। ছায়া একদম তৈরী হয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়েছে। পত্রকে দেখে সে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“শহরের ঐ ছেলেটার সাথে কিসের এত কথা বললে, পত্র?”

মায়ের প্রশ্ন মুহূর্তেই ভয় জাগালো পত্রের মনে। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো সে। আমতা-আমতা করে উত্তর দিলো,
“ঐ তো মা, উনি বাবার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। কেমন আছে বাবা এসব।”

ছায়া পত্রের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। পত্র তার বিনিময়ে কেবল মাথাটা নিচু করে রাখলো। ছায়া আর কিছু না বলে রান্নাঘর থেকে খাবারের বাক্সটা নিয়ে নিলেন বড়ো ব্যাগটাতে। ঘরের দিকে তাকিয়ে পুষ্পকে ডেকে বললো,
“আমি গেলাম পুষ্প। সাবধানে থেকো দুজনেই। আর হ্যাঁ, আজ কেউ বাড়ি থেকে বের হইও না।”

মায়ের কণ্ঠ পেয়ে খাট ছেড়ে উঠে এলো পুষ্প। মাথা নাড়িয়ে বললো,
“সাবধানে যেও।”

ছায়া ঘাড় কাঁত করে তাকালো পত্রের দিকে, আগের ন্যায় গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“তুমিও বের হইও না। দু’বোন সুন্দর মতন থাকবে। আমি সন্ধ্যা হতে হতে ফিরে আসবো।”

পত্র নিঃশব্দে ঘাঁড় নাড়াতেই ছায়া বিদায় নিলো। মা বেরুতেই স্বস্তির শ্বাস ফেললো পত্র। আচমকাই তার মনে হলো, মা কীভাবে জানলো পুকুর পাড়ে আতসের সাথে যে সে কথা বলেছে! মা তো বাড়িতেই ছিলো! এই প্রশ্নটা বার বার ঘুরপাক খেলো পত্রের মাথায়। তন্মধ্যেই পুষ্প ছুটে গিয়ে ঘর থেকে একটা লাল টকটকে শাড়ি আনলো। বাড়িয়ে দিলো পত্রের দিকে, ক্ষীণ স্বরে বললো,
“পত্র, এটা বিন্নী তোকে দিতে বলেছিল।”

পত্র এমন লাল টকটকে শাড়ি দেখে কিছুটা চমকে উঠলো। ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,
“বিন্নী! কখন দিলো!”

“এই তো তিন চারদিন আগে। ওদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় লুকিয়ে দিলো একটা ব্যাগে করে। আর বলেছিল, তোর যখন উদাস লাগবে চারপাশ, তখন যেন এটা খুলে দেখিস।”

পুষ্পের কথায় ভ্রু কুঁচকালো পত্র। কপালে তিন ভাঁজ ফেলে শাড়িটা হাতে নিতে নিতে বললো,
“নতুন শাড়ি! এই শাড়ি দিলো কী জন্য! নাকি চলে যাবে বলেই দিয়ে গেলো!”

“কি জানি।”

ছোট্টো জবাব দিয়ে পুষ্প আবার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতে নিলেই পেছন থেকে পত্রের ডাক ভেসে এলো। ভাবুক স্বরে বললো,
“এটা আপাতত রাখ তোর কাছে। আমি স্নান করে আসি পুকুর থেকে।”

বোনের কথা অনুযায়ী শাড়িটা নিলো পুষ্প। আবার নিঃশব্দে চলে গেলো সেখান থেকে। পত্রের পেটে তখন হাজারও রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে। কেমন আধা আধা, ঝাপসা ঝাপসা লাগছে রহস্যের এই বেরি বাঁধ।

_

চা বাগানে আরেকটি বিভৎস সকাল হলো। চারপাশের চঞ্চল মানুষ ছুটে গেলো সেই বিভৎসতা দেখতে। পুকুর পাড়ের বিরাট ছায়া দেওয়া উপকারী বটগাছটা কিছুদিনের বিবর্তনেই হয়ে উঠলো মানুষ খেকো। আজও গিলে নিলো তাজা এক প্রাণ। গতকালকের জীবিত যুবকটা আজ কেবল নিথর দেহ হয়ে ঝু/লে আছে গাছের সাথে। সবার ছুটোছুটি দেখে পত্র, ছায়া, পুষ্পও এলো কৌতূহল মেটানোর জন্য সে দেহখানা দেখতে। কিন্তু দেহটা দেখার পর তারা জমে বরফ হয়ে গেলো। পত্র কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আতস!”

#চলবে

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ১৪

অন্ধকার আচ্ছন্ন ঘরটাতে গুটিশুটি মেরে বসে আছে পত্র। তার চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বারংবার একটা বাক্য “তোমায় আমি বিশ্বাস করেছি, পত্র”। পত্র আরও গুটিয়ে নেয় নিজেকে। পোড়া ঘরের নেতানো গন্ধটাও তার নাকে লাগছে না। তার ভীত আত্মা কিছুক্ষণ পর পর লাফিয়ে উঠছে। সময়টা তখন রাতের মাঝামাঝি। পত্রের ভয়ে শরীর জমে আসে, দুরুদুরু করে কাঁপে অন্তরাত্মা। ভয়টা অন্য কিছুর জন্য না, পত্রের ভয়টা নিজেকে নিয়ে। সে ধীরে ধীরে এতো বেশি স্বার্থপর হয়ে গেছে যে সে এতো বড়ো বড়ো অন্যায়ও এতদিন চোখে দেখে উড়িয়ে দিয়েছে। কখনো বা স্বার্থপরতায় ভুলে গিয়েছে। কিছু অন্যায়ের সাথে সে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে তা সে টের পায় নি। আতসের মৃত্যুর দ্বিতীয় দিন আজ। আতসের দেহটা নিয়ে তার বন্ধু গৌরব চলে যায় শহরে। সকলেই বলছে এটা আ ত্ম হ ত্যা। কিন্তু পত্রের কোথাও যেন একটা গোলমেলে লাগছে। যে ছেলেটা সুখের আশায় শহরে চলে যাবে বলেছিল, লাখ লাখ টাকার প্রজেক্টের কথা না ভেবেই শহরে যাবে বলেছিল, সে ছেলেটা কিনা শেষমেশ আ/ত্ম/হ/ত্যা করেছে! বেঁচে থাকার কারণ আছে স্বত্তেও কেউ নিশ্চয় মরতে যাবে না। কিন্তু তবে আতস কেন এ পথ বেছে নিলেন! যদি বিন্নীর জন্য হয় তবে তো ছেলেটা নিজেই বলেছিল শহরে গিয়ে সে বিন্নীকে খুঁজবে। তাহলে হুট করে এ সিদ্ধান্ত কেন! আতসের শহরে যাওয়ার খবরটা আতস আর পত্র বাদে একজন জানতো। তবে কী সে একজনই দিতে পারবে এই মৃত্যুর উত্তর!

পত্রের মুখ দিয়ে বের হয়ে যায় অপ্রত্যাশিত ভাবে গোঙানির শব্দ। সাথে সাথে সে দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। বাবাকে আজ সদর থেকে আনা হয়েছে। মা সহ গ্রামের কয়েকজন নিয়ে আসছে। পরেশ মামা সকল খরচ বহন করেছেন। মামাও এসে ছিলেন বাবাকে দিতে কিন্তু বেশিক্ষণ থাকেন নি। তার দরকারী কাজের জন্য সে চলে গিয়েছে। পুষ্প, মা-বাবা সবাই আপাতত ঘুমে ব্যস্ত। ঘুম আসছে না কেবল পত্রের। গত দু’দিন যাবত তার জীবনটা নরক হয়ে উঠেছে। চারপাশে সে কেবল আতসের একটক কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পায়। নিজের সাথে নিজে লড়ায় করছে দু’দিন যাবত। হাজারটা প্রশ্নের ছড়াছড়ি অথচ কূল-কিনারা পাচ্ছে না উত্তরের। পত্র উঠে দাঁড়ালো, হুট করেই তার মনে পড়লো প্রথম অদ্ভুত কান্ড শুরু হওয়ার দিনটার কথা। ঘটনাটির সূচনা পত্রই ছিলো। সে-ই তো প্রথম পুকুর পাড়ে দেখেছিল অভ্রদা আর পিসির প্রতিচ্ছবি। তারপর থেকে সব কেমন ঘেটে গিয়েছে। তাহলে এর উত্তর একমাত্র সে-ই খুঁজতে পারবে। পর্বের মাথায় ঝাপসা হয়ে ভেসে উঠলো বিন্নীর দিয়ে যাওয়া শাড়িটার কথা। যখন খুব হতাশ হবে তখন শাড়িটা খুলে দেখতে বলেছিল না বিন্নী! এমন কিছুই তো বলে গিয়েছিল পুষ্পকে! পত্র ছুটে গেলো মায়ের ঘরটাতে। একদম নিশ্চুপ, নীরবতার সাথে মায়ের আলমারিটা খুললো। আঁধারে দেখা যাচ্ছে না কিছুই। হারিকেনের আলো মাত্রাতিরিক্ত কোমল ও ক্ষীণ। পত্র আশপাশ খোঁজা শুরু করলো। মায়ের ঘরে তো টর্চ লাইট থাকে সবসময়। বাবা রাতে আসতেন বলে টর্চ লাইট ব্যবহার করতেন। টর্চ লাইট টা কোথায়!

চারপাশে অন্ধের ন্যায় কিছুটা হাতড়ে মায়ের বালিশের পাশ থেকে টর্চ লাইটটা ধীর গতিতে তুলে নিলো পত্র। লাইটটা জ্বালিয়ে আলমারিতে খোঁজ করলো টকটকে লাল রঙের সেই শাড়িটার। আর মিনিট দুইয়ের মাঝেই আলমারির এক কোণায় বড্ড অবহেলার সাথে পড়ে থাকতে দেখলো শাড়িটা। পত্র যেমন নিশ্চুপে ঘরে প্রবেশ ঠিক তেমন নিশ্চুপেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আকাশে অবাক জ্যোৎস্না তখন রহস্য করে হাসছে। চারদিকে গা ছমছমে ভাব। দূর হতে থেকে থেকে শেয়াল ডেকে উঠছে। শিরশিরে বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে শরীরকে নিবিড় আলিঙ্গনে। পত্র এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই আধপোড়া ঘরটাতে চলে গেলো। ভাঙা ও আধাপোড়া চৌকিটার ওপর টর্চ লাইনটা লম্বালম্বিভাবে রেখে পুরো ঘরটাকে আলোকিত করলো। আচমকা সে খেয়াল করলো আশ্চর্যজনক ভাবে তার হাত কাঁপছে। সে তো আজ অন্যায় করতে যাচ্ছে না, কেবল অন্যায়ের কোনো প্রতিরোধ পাবে কিনা সেটাই খুঁজছে তবে হাত কাঁপছে কেন! পত্র শাড়িটাকে আরেকটু নিজের সামনে আনতেই খেয়াল করলো একটা মিষ্টি সুগন্ধে ভরে গেছে তার আশপাশ৷ অভ্রদা’র সুগন্ধিটার এমন ঘ্রাণ ছিলো। পত্র শাড়িটায় হাত বুলিয়ে দিলো। কোমল, তুলতুলে, মখমলের শাড়ি। বড্ড দামি হবে নিশ্চয়। পত্র শাড়িটার ভাঁজ খুললো, মোহনীয় ঘ্রাণে কিছুটা মাতোয়ারাও হলো। লাল শাড়িটা আসলে পুরোপুরি লাল না। কেবল আঁচল টুকু লাল। আর ভেতরটা শুভ্র রাঙা। পত্র অবাক হয়ে চেয়ে রইলো শাড়িটার দিকে। শাড়িটা সুন্দর তবে আশানুরূপ কিছু না পাওয়ায় পত্রের মন খারাপ হলো। বিন্নী যে বলেছিল শাড়ির মাঝে তার হতাশা দূর করার কিছু আছে! কই? কিছুই তো নেই। পত্র যেই না শাড়িটা চৌকির উপর রাখতে যাবে, টর্চ লাইটের স্বচ্ছ আলোয় শাড়িটার মাঝে কিছু একটা অস্বচ্ছ ভাবে ফুটে উঠতে দেখলো। পত্র অবাক হলো, তৎক্ষনাৎ শাড়িটা আবার মেলে ধরলো, টর্চ লাইটার স্বচ্ছ আলো ফেললো শাড়িটার সাদা অংশে। এবার পরিষ্কার হয়ে উঠলো অস্বচ্ছ জিনিসটা। পেনসিল দিয়ে কি যেন লিখা! বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে তবে ছোটো ছোটো অক্ষরে। পত্র টর্চটা একদম লিখা গুলোর উপর ধরতেই অস্বচ্ছ লাইন গুলো ভেসে উঠলো পরিষ্কার অক্ষরে-
“প্রিয় পাতা,
জানিনা এমন জায়গায় লিখে যাচ্ছি আদৌও তা তুই দেখবি কিনা। তাও শাড়ির উলটো পিঠে লেখা এই অযত্নের অক্ষর গুলো আদৌও তোকে ধরা দিবে কিনা, তবুও বলে যেতে চাই অনেক কথা।

চা বাগানে অনেক বছর আগে এক অত্যন্ত রূপসী মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিল চা বাগানেরই এক প্রাপ্ত বয়স্ক যুবক। তাদের প্রেম নৈতিক থেকে অনৈতিকতাও ছুঁয়ে ফেলে। বয়সের উচ্ছলতায়, প্রেমের উত্তেজনায় তারা করে ফেলে অনেক ভুল। কিন্তু তা জানেনি কেউ। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তাদের ভাগ্য ভালো থাকলেও বেলাশেষে তাদের ভাগ্য তাদের সাথ দেয় নি। মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। সুন্দরী মেয়ের তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক আর তখন সময়টাও ছিলো তেমন। মেয়েটার বিয়ে হওয়ার পর ছেলেটাও বিয়ে করে ফেলে তাও বাবা-মায়ের ইচ্ছেতে। কিন্তু গল্পটা এখানে শেষ হলেই হয়তো আমরা বেঁচে যেতাম সবাই। গল্প শেষ হলো না এখানে। মেয়েটা প্রেমিকের মতন স্বামী পায় নি বলে তার স্বামীর প্রতি ছিল অনীহা। কোনোমতে সংসার টা বছর খানেক টিকিয়ে রেখেছিল কিন্তু বছর ঘুরতেই অপ্রত্যাশিত ভাবেই মারা গেলো তার স্বামী। তার জায়গা হলো আবার নিজের বাবার বাড়ি। ওদিকে ছেলেটা কিন্তু চুটিয়ে সংসার করেছে। নিজের স্ত্রীর সব অধিকার পূরণ করেছে। মেয়েটার বাবার বাড়িতে তখন ছিলো নিজের ভাই যার ততদিনে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। ভাইয়ের বৌয়ের সাথে ছিলো তার গলায় গলায় ভাব। সারাটা দিন ঘুরে বেড়াতো, সংসারের হাল ধরে রাখতো শক্ত হাতে। ভাইয়ের বৌ ননাস বলতে পাগল ছিলো। বয়সেও ছিলো ছোটো অনেক। কিন্তু সবার চোখের দৃষ্টি সীমানার বাহিরে একটা অনৈতিক সম্পর্ক বয়ে বেড়াতে লাগলো চা বাগান। স্বামীর মৃত্যুর কোনো ছাপ ছিলো না সেই নারীর ভেতর। তার রূপ যৌবন কেবল বয়সের তোপে বাড়ছিল আর গভীর হচ্ছিল প্রেমিকের সাথে সম্পর্ক। ওদিকে প্রেমিকের ঘরে ফুটফুটে দুটো সন্তান হেসে খেলে বড়ো হচ্ছে। আর সাথে বড়ো হচ্ছে একটা বিশ্রী সম্পর্কের বীজ। হুট করেই খারাপ হয়ে যায় সে বিধবা নারী এবং তার ভাইয়ের বৌয়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কেন খারাপ হয় তা হয়তো ভিন্ন কোনো গল্পে রচিত আছে, আমাদের জানার বাহিরে। প্রিয় দু’জন মহিলা হয়ে গেলো একজন আরেকজনের বিপরীত প্রতিদ্বন্দ্বী। স্বামী বিহীন অল্প বয়স্কা নারী যৌবনের তাড়নায় করে ফেলে কত অপ্রীতিকর ঘটনা। সবই চা-বাগান তার গভীরতায় খুব গোপনে লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সত্যি যে চাপা থাকা না। একদিন সেই প্রেমিক প্রেমিকা অপ্রীতিকর ঘটনার সাক্ষী হয় প্রেমিকের ছেলে। ততদিনে অবশ্য প্রেমিক প্রেমিকার বয়সে মধ্য বয়স্কার ছাপ পড়ে গেলোও তাদের প্রেম ছিলো প্রথম দিনের মতনই সতেজ ও রমরমা। নিজের ছেলের চোখে নিচু হয়ে যায় তার বাবা। ছেলে কথা গোপনে রাখে কিন্তু বাবাকে বারবার ফিরে আসতে বললেও তার বাবা আগের মতনই নিজের প্রেম চালিয়ে যেতে লাগে। এরপর লন্ডভন্ড হয়ে যায় সব। অপ্রত্যাশিত ভাবে মারা যায় ছেলেটা। কিন্তু তার মৃত্যুর অনেকদিন পর পাওয়া যায় তার লাশ। মৃত্যুর কারণ জানা যাওয়ার আগেই তাকে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়। ততদিনে সে গোপন প্রেমের গল্প রচনা করা প্রেমিকাও মারা যায়। তারপর চা বাগানে ঘটে অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা আর একদিন অবশেষে প্রেমিকের মৃত্যুর মাধ্যমে সে ঘটনার সমাপ্তি ঘটে।,,,,,,,,, ”

পত্র এত বিশাল লেখা পড়ে মুখ তুলে তাকায়। যদিও চিঠির শেষ এখানে না কিন্তু পত্রের সহ্য ক্ষমতার শেষ যেন এখানেই। এত ভয়ঙ্কর গল্পের মালা বিন্নী বুনে দিয়ে গেছে! এত নিষ্ঠুর গল্পের অতীত! পত্র মানতে পারছে না। চেনা মানুষ জনের যেই অপরিচিত রূপ বিন্নী বর্ণনা করেছে তা মানতে পত্রের কষ্ট হচ্ছে। গল্পের চরিত্র গুলোর নাম নেই অথচ পত্র বোধহয় তাদের চেনে, খুব ভালো করে চেনে। কিন্তু এমন ভয়ানক তাদের গভীরের রহস্য! শাড়ির কোল ঘেষে বাক্য গুলো উঁকিঝুঁকি মারছে, মনের কোণে কৌতূহলও ঝড় তুলেছে অথচ পত্র নিশ্চুপ। সত্যিই যদি বিন্নীর গাঁথা বাক্য গুলো নেহাৎই গল্প হতো তাহলে কী কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো!

#চলবে