প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব-৪+৫

0
471

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ৪ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
আয়মান এক আকাশ অবাক বিস্ময় নিয়ে নির্বাক চোখে চেয়ে রইলো। যেন পৃথিবীতে এইমাত্র ঘটে যাওয়া কোন অত্যাশ্চর্য জিনিস তার দৃষ্টিগোচর হলো। সে যেন নিজের চোখ দুটোকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।

আয়মান রিকশাওয়ালাকে বলল,
চাচা রিকশাটা একটু পিছনে নিয়ে রাস্তার একপাশে একটু রাখুন।

রিকশাওয়ালা আয়মানের নির্দেশনামতে রিকশাটি থামালো। আয়মান রিকশার হুড় টেনে দিল। পকেট থেকে কালো বড় সানগ্লাসটি হাতে নিলো। টিস্যু দিয়ে মুছে চোখে দিলো। মাথায় ক্যাপ পরে নিল। শিকারির ন্যায় স্থির চোখে রায়হান ও পিয়াসার গতিবিধি লক্ষ্য করছে। তারা কিন্তু আয়মানকে দেখছেনা।

সে দেখছে রায়হান রিকশা দরদাম করে ছেড়ে দিচ্ছে। একটুপর রায়হান চলে গেল একা একটি রিকশায় চড়ে। পিয়াসার দিকে হাত বাড়িয়ে কিছু দিল মনে হচ্ছে। পিয়াসা তাদের বাসার গেটের ভিতরে চলে গেল।

প্রগাঢ় বিস্ময় আর রাশিরাশি কৌতুহলের সীমা অতিক্রম করে এবার আয়মান দোটানায় পড়ে গেল৷ একবার ভাবছে পিয়াসাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে তার দেখা বিষয়টা। আবার ভাবছে না জানার মত করে সে যা বলতে এসেছে তাই বলবে। আবার ভাবছে অন্যকিছু বলবে। অবশেষে স্থির হলো সে ফিরে যাবে পিয়াসার সাথে দেখা না করেই। কাল কলেজে যায় কিনা দেখবে।

রিকশার হুড ফেলে দিলো আয়মান নিজেই। মাথা তুলে গগনপানে চাইলো। গোধূলির হরিদ্রাভ আকাশ ধীরে ধীরে নিকষ কালোয় রূপ নিচ্ছে। একটু পরই চারপাশজুড়ে সন্ধ্যার আলো আঁধার খেলা করবে। ঠোঁটের কোনে দেখা দিলো চওড়া তির্যক হাসি। মনে মনে বলল আমরা মানব জাতি এত ঈর্ষাপরায়ণ কেন? এত হিংসুটে কেন? হায় সেলুকাস! কি বিচিত্র!

ঘড়ির কাটা দুটোর ঘরে ছুইঁ ছুইঁ। তবুও আয়মানের দুচোখে ঘুম আসছেনা। বিনিদ্ররজনী পার করছে। ঘুমেরা যেন তার থেকে ছুটি নিয়েছে এই রাতে। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে একটা সিগারেট ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরল। লাইটার দিয়ে জ্বালাতেই কি ভেবে আবার সিগারেটটা প্যাকেটে ভরে রেখে দিল।

পরেরদিন কলেজে ক্লাসে গিয়েই আয়মানের চোখ দুটো পিয়াসাকে খুঁজলো। পিয়াসাকে দেখতে পেয়ে দ্বিতীয়দফায় অবাক হয়ে গেল সে।

নিজেকেই গোপনে প্রস্ন করলো, কি আশ্চর্য! যেখানে এই মেয়ের ঘনিষ্ঠবন্ধুরাও স্বশরীরে গিয়ে তাকে কলেজে আনতে পারেনি। পরে আসার জন্য রাজী করাতেও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হল।

সেখানে রায়হান দেখা করায়, কথা বলায় মেয়েটা বুঝ নিয়ে নিল? কি মারাত্মক পাওয়ার রায়হানের।

চাপা স্বভাবের আয়মান হৃদ্যতাপূর্ণ কণ্ঠে পিয়াসার দিকে চেয়ে,
পিয়াসা মন খারাপ করোনা। সব শুনেছি ওদের কাছ থেকে। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, কারো হাতে নেই। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছ দেখে ভালো লাগল। ক্লাস শেষে কোচিং এ এসো।

পিয়াসা কিছুই বললনা। আবার অবাক ও হলনা আয়মানের আন্তরিকতায়। কারণ এমন সময়ে শত্রুর মুখ দিয়েও মধুর বুলি বের হয়। সজল দুটি চোখে আয়মানের দিকে চাইলো পিয়াসা।

বিকেলে কোচিং শেষে আয়মান পিয়াসাকে জিজ্ঞেস করলো,
পিয়াসা তুমি আগের মতই পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। আমার কোচিং এর টাকা দিতে হবেনা। আর কলেজের বেতন ও তোমার মওকুফ করা হয়েছে।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার। কৃতজ্ঞতাপূর্ণ চাহনিতে বলল পিয়াসা।

নাহিদ,তুলি,জেবা,হিরন পিয়াসার দিকে চেয়ে, স্যার কি বলল শুনলিতো। আচ্ছা থাকার কি বন্দোবস্ত হলোরে?

আপাতত মিনা আণ্টির বাসায় থাকব। উনার মেয়ের সাথে ঘুমাব রাতে।

বন্ধুরা বলল তাহলে থাকার ব্যবস্থা হলো। পড়াও কন্টিনিউ চলবে। বাকি রইলো তোর খাওয়া খরচ , ব্যক্তিগত হাতখরচ এসব৷।

পিয়াসা বলল তার ব্যবস্থা ও হয়েছে।

তুলি বলল কে করল সেটা? তুই না বললি তিনকূলে তোর তেমন কেউই নেই?

যার কেউ নেই। তার জন্য আল্লাহ ফেরেস্তাস্বরূপ কাউকে পাঠিয়ে দেয়।

আলহামদুলিল্লাহ। শুনে স্বস্তি পেলাম দোস্ত। তো তোর সেই ফেরেস্তাটা কে পিয়াসা? অতি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো বন্ধুরা।

পিয়াসা কৌশলে এড়িয়ে গেল৷ কারণ রায়হান না করে দিয়েছে তার কথা যেন লুকিয়ে রাখে।

এতসময় টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে ওদের সব কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করল আয়মান। বলল, যাইহোক তাহলে খুবি ভালো। তবুও তোমার যে কোন প্রয়োজনে ওদের জানাবে। আমাকেও মন চাইলে জানাতে পার। পিয়াসার উপরে আয়মানের আর কোন রাগ বা বিরক্তি নেই। আছে শুধু দূর্বার কৌতুহল।

হিরন বলল তোর এখন একটা মোবাইল থাকা জরুরি। আমি রাতে ফ্রি হয়ে বিক্রয় ডট কমে সেকেন্ড হ্যান্ড সেট দেখব। আর টাকা আমরা সব বন্ধুরা ভাগ করে দিয়ে দিব। তুই চিন্তা করিসনা।

আয়মান বলল,হিরন একদম ঠিক বলছ। সেট ভালো দেখেই নিও। আমিও শরিক হতে চাই তোমাদের সাথে।

পিয়াসা ছাড়া ওদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তারা স্যারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানালো।

পিয়াসা না বলেও পারছেনা। পরে শুধু শুধু সবার টাকা যাবে। মোবাইল একটার ব্যবস্থা আছে। তোদের কিনতে হবেনা। আব্বুর সেটটা আমিই ইউজ করব। পিয়াসা তার বাবার ব্যবহারকারী নাম্বার সব বন্ধুদের দিল। রায়হানকে পিয়াসা মোবাইল ফেরৎ দিয়ে দিয়েছে।

জেবা বলল, তাহলে এবার স্যারের নাম্বারটাও নিয়ে নে। সেট আছে সাথে?

হুম আছে বলে ব্যাগের ভিতর থেকে মোবাইল বের করল পিয়াসা। অমনি আয়মান পিয়াসার মোবাইলটা হাতে নিল। টাইপ করতে হবেনা। কল দিচ্ছি আমার সেটে তাহলে নাম্বার দু’ সেটেই চলে যাবে।

স্যার ফোনে ব্যালেন্স নেই।

ওহ আচ্ছা। তাহলে আমার সেট থেকে কল দিচ্ছি। এই ভিতরে আয়মান ডায়ালের অজুহাতে টুক করে দেখে নিল পিয়াসার রিসিভ লিস্টে রায়হানের মোবাইল নাম্বার। একচোট ভেবে নিল,তলে তলে এতকিছু? তার মানে জল বহুদূর গড়িয়েছে। রায়হান লুকাচ্ছে কেন আমার কাছ থেকে। কিসের ভয়? কিসের এত সংকোচ। আমি না তার বন্ধু?

নাম্বার বল তোমার।

পিয়াসা নাম্বার বলল। আয়মান তার সেট থেকে কল দিয়ে আয়মান স্যার লিখে সেভ করে পিয়াসার হাতে দিল। নিজেও সেভ করে নিল পিয়াসা লিখে।
কোচিং শেষ হলে সবাই চলে যায়।

আয়মান ভাবে দূর কি ফালতু চিন্তাভাবনা করছি। রায়হান হয়তো পিয়াসার দুরাবস্থা দেখে সহানুভূতির হাত বাড়িয়েছে একজন শিক্ষক হিসেবে। একজন মানুষ হিসেবে। অন্যকিছু হলে রায়হান আমাকে না জানিয়ে হজম করতেই পারতোনা।

কোচিং শেষে পিয়াসা হেঁটে হেঁটে বাসার পথ ধরে। আয়মান একটু অপেক্ষা করে একটা রিকশায় উঠে। রিকশার হুড় ফেলে দেয়। পিয়াসার কাছাকাছি গিয়ে রিকশা থামায়।

এই পিয়াসা এই..
পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে পিয়াসা হাঁটার গতি ধীর করে দাঁড়ায়। ঘাড় ঘুরিয়ে চায়। আয়মানকে দেখে রিতীমত ভড়কে যায় সে। স্যার.. আপনি? কি হয়েছে?

আয়মান স্মিত হেসে আমি এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। সামনে একটু কাজ আছে। তোমার বাসা কোথায়? হেঁটে যাচ্ছ যে? রিকশায় আসো পৌঁছে দিই।

পিয়াসার দুকান লাল হয়ে গেল শুনে। যে মানুষ নিজের বইয়ের ভাঁজে একটি সিনেমার নাম দেখে আমাকে ভুল বুঝেছে। চরম অপমান করেছে। ধিক্কার দিয়েছে। অথচ আজ নিজেই তার পাশে রিকসায় বসাতে চায়। সমীকরণটা কিছুতেই মিলাতে পারছেনা পিয়াসা। থম মেরে দাঁড়িয়ে বলল,
না স্যার আপনি যান প্লিজ। আমি যেতে পারব। এভাবে অভ্যস্ত আছি আগে থেকেই।

তুমি মনে হয় আগের বিষয়গুলো নিয়ে আমার উপর অভিমান পুষে রেখেছ?

নাহ স্যার নাহ। অভিমান কি সবার উপর করা যায়। অভিমান কারো তার উপরেই আসে,যার উপরে পাওয়ার অধিকার আছে । ভার কন্ঠে জানাল পিয়াসা।

আচ্ছা তাহলে তোমাকে একটা রিকশা ডেকে ভাড়া দিয়ে দিই? তুমি একা চলে যাও।

একদম নাহ স্যার। এসবের দরকার নেই। দৃঢ়তার সাথে বলল পিয়াসা।

ওকে। সাবধানে যেও বলে আয়মান রিকশা নিয়ে সামনে চলে গেল৷ পিয়াসা পিছনে পড়ে রইলো।
রাস্তার পাশ ঘেঁষে একটি হোটেলে ঢুকে বসলো। তীক্ষ্ণ নজর রাখল পথের উপরে। এক পলক দেখল। রায়হানের বাইকে চড়ে পিয়াসা বাসায় যাচ্ছে। কিন্তু রায়হান তো আরো আগেই কলেজ থেকে চলে গেল। তারমানে ফোনে যোগাযোগ করেই এলো পৌঁছে দিতে।

লম্বা স্বাস ছেড়ে আয়মান হোটেল থেকে বেরিয়ে গেল। নিজের দোষেই আজ সে দোষী। কারো ঘাড়ে দোষ চাপাবার সামান্যতম সুযোগ নেই।

_______
ঝিমিয়ে পড়া শরতের স্নিগ্ধ বিকেল। শরতের নীলাকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা। এদিক ওদিক নীল, সাদা,পুঞ্জ মেঘদলের ভেসে ভেসে ওড়াওড়ি।

রায়হান শিহরিত। তার অনভূতিগুলো অন্যভাবে নাড়া দিচ্ছে পিয়াসাকে নিয়ে। পিয়াসা পড়ে যাওয়ার ভয়ে একহাত দিয়ে রায়হানের পেট পেঁচিয়ে ধরে বসেছে। রায়হান নিজের শুকিয়ে আসা ঠোঁট দুটিকে জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল।

রায়হান বাতাসের বেগে বাইক নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

আরেহ স্যার কোথায় যাচ্ছেন? আমার বাসার পথ ভুলে গেলেন নাকি? জোরগলায় বলল পিয়াসা।

রায়হান কোন রিপ্লাই দিলনা। বেশ কিছুদূর চলে গেল। বাইক থামালো। পিয়াসা পাশেই দৃষ্টি মেলে তাকালো। চমৎকার একটি উদ্যান। যার পুরোটা জুড়ে রয়েছে সবুজের বিশাল সমারোহ। পিয়াসা মুগ্ধ নয়নে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে।

আমাকে এখানে কেন এনেছেন স্যার? গোল গোল চোখে জানতে চাইলো পিয়াসা।

সুন্দর কোন কথা সুন্দর জায়গাতেই বলতে হয় পিয়াসা। তোমার বাসায় সেই উপযুক্ত পরিবেশ নেই। আসো উদ্যানের ভিতরে গিয়ে যেকোন একটি বৃক্ষদ্বারে বসি। তারপর বলছি ।

দুজনে হেঁটে গেল একটু ভিতরে। দাঁড়িয়ে রইলো পিয়াসা। রায়হান দু’ পা এগিয়ে গিয়ে ফুল গাছ থেকে একটা নাম না জানা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে এলো।
বলতো ফুলটা কেন নিলাম?

পিয়াসা জিজ্ঞাসু চোখে ভ্রু কুঁচকে চাইলো রায়হানের দিকে।

ভনিতা না করেই সারকথাটা বলে ফেলি প্রারম্ভে । সূচনা, বিস্তারিত, উপকারিতা,অপকারিতা, উপসংহার না হয় পরেই বলছি।

আচ্ছা পিয়াসা, আমি যদি তোমার আস্ত জীবনের দায়িত্ব নিতে চাই, তোমার কি কোন আপত্তি আছে ?

চলবেঃ ৪

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ৫ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
ভনিতা না করেই সারকথাটা বলে ফেলি প্রারম্ভে । সূচনা, বিস্তারিত, উপকারিতা,অপকারিতা, উপসংহার না হয় পরেই বলছি।
আচ্ছা পিয়াসা, আমি যদি তোমার আস্ত জীবনের দায়িত্ব নিতে চাই, তোমার কি কোন আপত্তি আছে ?

পিয়াসা শুকনো মাটিতে উষ্ঠা খাওয়ার মতো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল শুনে। চোখ কপালে তুলল। আড়ষ্ট হয়ে এদিক ওদিক চাইলো অচেনা আগুন্তকের মতো। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। লুকিয়ে নিজের হাতে চিমটি কাটলো। বুঝে নিল সে স্বপ্ন দেখছেনা। যা শুনেছে সত্যি শুনেছে।

রায়হানের মুখশ্রীতে নিরব চাহনিতে চাইলো৷ মিলানো ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে বলল, আপনি ঠিকাছেন তো স্যার?

রায়হান হেসে ফেলল। নিজের কপালের দিকে এগিয়ে আসা চুলগুলোকে পাঁচ আঙ্গুল গলিয়ে পিছনে ঠেলে দিল। রসপূর্ণ কন্ঠে বলল,
তোমার জায়গায় আমি হলেও এমন ভীষম খেতাম। যেদিন বৃষ্টির মধ্যে তোমাকে তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিলাম। তুমি ভিতরে চলে যাওয়ার পর আমার ফোন আসাতে একটু থামতে হয়। তখন তোমার উপর সৎ মায়ের অমানবিক আচরণ দেখতে পাই।

ঠিক ওই মুহুর্তেই কোন এক অজ্ঞাত কারণে তোমাকে ভালোলেগে যায়। ইচ্ছে ছিলো তোমার সাথে অল্পস্বল্প কথার মাঝে মাঝে তোমার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানব। যে জন্য মোবাইল ও দিলাম তোমাকে। এভাবে সখ্যতা হলে তা বন্ধুত্বে গড়াবে। তারপর প্রেমের প্রপোজাল দিব। কিন্তু তোমার বাবার অকাল মৃত্যুতে সব ওলট-পালট হয়ে গেলো।

তাই ডিসিশন নিতে হলো একবারে তোমাকে বিয়ে করে ফেলার। কিন্তু তোমার ফাইনাল পরিক্ষার পরে তা। তখন তুমিও উপযুক্ত হবে।

কেননা তুমি যার বাসায় এখন থাক, সেখানে কতদিন থাকতে পারবে। আর এই শহরে একজন তরুণী মেয়ে একা টিকে থাকা ভারি মুশকিল। একজন নির্ভরতার মানুষ থাকা চাই। যে ছায়ার মতো তাকে সাথে রাখবে। আগলে রাখবে যতনে। আমি তোমার সেই মানুষটি হতে চাই পিয়াসা। অকপটে কথাগুলো বলে রায়হান একটু থামলো। বোতলের ছিপি খুলে তিন কুলি পানি খেয়ে নিলো পিপাসার্ত হয়ে।

পিয়াসা নরম গলায় বলল, আমিতো আপনাকে স্যার হিসেবেই জানি আর শ্রদ্ধা করি। এই ভিতরে আমার পাশে আপনার সহমর্মিতার হাত বাড়ানোকে আমি নিতান্তই স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই দেখেছি স্যার।

তোমার ভাবনাটাও রাইট পিয়াসা। আর স্যার হলে, বন্ধু হলে, বিয়ে হলে, কি শ্রদ্ধা করা যায়না?

আর শুন সবার থেকে সব সময় শ্রদ্ধা, বিনম্রতা পেতে ভালোওলাগেনা। বিশেষ করে তোমার মতো কারো কাছ থেকে। আশাকরি বুঝতে পেরেছে আমার ইঙ্গিত। তুমি আমাকে একটু এসব কম দেখাবে। বন্ধুর দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করো প্লিজ।

পিয়াসা আহত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
স্যার আমি যদি আপনার প্রপোজাল রিফিউজড করি তাহলে কি আপনি আমার কোন ক্ষতি করবেন?

রায়হান খুক করে হেসে ফেলল,
এই চিনলে মোরে? এটা তোমার ব্যক্তি স্বাধীনতা। আমি হার্ট হব। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পডব। তাই বলে ভালোবাসার মানুষটার ক্ষতি করব। ইম্পসিবল। আমরা মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব। আর সেরা জীব মানুষ হয়ে মানুষের ক্ষতি করাতো অমানুষের কাজ। আমাকে কি তোমার অমানুষ মনে হচ্ছে?

ছিঃ ছিঃ। একদম না স্যার। আপনাকে আমিও খুব পছন্দ করি। খুব ভালো জানি। কিন্তু তা আপনার মতো করে নয়।

যেহেতু পছন্দ করো। ভালো ও লাগে। তাহলে বলনা আমার সাথে জীবন সমুদ্র পাড়ি দিতে আগ্রহী?

রায়হান ব্যাকুল হয়ে আছে পিয়াসার মুখে হ্যাঁ সূচক ছোট্ট একটা শব্দ শোনার জন্য। তার হার্টবিট ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।

ক্ষমা করবেন স্যার। আমি প্রায় গরীব ঘরের সন্তান বলতে গেলে। এসব বর্ণিলতা আমাকে মানায়না। আমি পারবনা।

রায়হান কল্পনাও করেনি পিয়াসার জবাবটা এমন হবে। হজম হচ্ছেনা পিয়াসার কথা। অনুযোগমিশ্রিত কন্ঠে বলল,
কি ছেলেমানুষী করছ পিয়াসা? পারবনা মানে কি? আমি কি প্রেম করতে বলছি আমার সাথে? তা না হয় আমরা বিয়ের পরেই করব। আমিতো বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি তোমাকে। তোমার বাবা থাকলে হয়তো উনার কাছেই যেতাম তোমাকে চাইতে। তোমার পাত্র পছন্দ না হওয়ার কারণ?

কোন কারণ নেই স্যার।

তাহলে ফিরিয়ে দিচ্ছ কেন আমাকে? হাতে থাকা ফুলটা পিয়াসার হাতের দিকে বাড়িয়ে দিল রায়হান।

সর‍্যি স্যার আমি এ ফুল নিতে পারবনা।

রায়হান ফুলটাকে মুঠোয় পুরে কচলে ফেলে দিল মাটিতে ছুঁড়ে। পিয়াসার একহাত টেনে নিজের বুকের সাথে মিশে ধরল। টের পাচ্ছ কিছু? একবার যদি তোমার মাথাটা আমার বুকে রাখতে, শুনতে পেতে এ হৃদয় ভাঙ্গার গর্জন। তুমি সময় নাও প্রয়োজনে। আমি অপেক্ষা করব। তবুও ফিরিয়ে দিওনা। আমার সমস্তটা উজাড় করে দিয়ে জনমভর তোমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করব৷ তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি পিয়াসা।

পিয়াসা জোর করে নিজের হাতকে মুক্ত করে নিল রায়হানের হাতের ভিতর থেকে। বেজায় মন খারাপ হয়ে গেল। বুঝতেছেনা রায়হানকে কি বলবে বা কি বলা উচিত। কিভাবে এখন কলেজে সামনের দিনগুলোতে চোখ মেলাবে।

একটু মজবুত হয়ে মাথা নিচু করে বলল, স্যার আপনার মাঝে আমাকে নিয়ে এত অনুরাগ এর আগে প্রকাশ করেননি। হুট করে আজ একেবারে বিয়ের কথা বলে ফেললেন। কেমন যেন লাগছে। আমি উঠি। খুব ক্ষুধা পেয়েছে।

ওহ শিট! এক্সট্রেমলি সরি। আমার আগেই উচিত ছিল তোমাকে লাঞ্চ করানোর। একচুয়েলি আবেগে বিবেক হারিয়ে ফেলেছি বলে হেসে উঠে দাঁড়িয়ে গেল ।

পিয়াসাকে নিয়ে উদ্যানের ভিতর থেকে বের হয়ে গেল। পিয়াসা বাসায় গিয়ে খাব বলল। কিন্তু রায়হান নাছোড়বান্দা। একটা নিকটস্থ রেস্টুরেন্টে ঢুকল পিয়াসাকে নিয়ে। পছন্দের মেন্যু দিয়ে পিয়াসা পেটপুরে ভাত খেলো। পিয়াসা তৃপ্তির ঢেকুর তুলল বহুদিন পর তার প্রিয় কইমাছ ভাজা খেত পারল বলে। বাসায় ভাজলে একটা পুরো মাছ কখনোই প্লেটে জুটতোনা। হয় অর্ধেক নয় শুধু মাথার অংশ ভাগে পেত।

পিয়াসাকে বাইকে চড়িয়ে বাসার গেটে নামিয়ে দিল রায়হান । নিবেদিত চোখে চেয়ে বলল, আমাকে ভুল বুঝে ভুলে যেওনা।

পিয়াসা নিরব থেকে গেটের ভিতরে চলে গেল। রায়হানের খুব একটা মন খারাপ হলনা। তার বিশ্বাস এখন পিয়াসা পিতৃশোকে আচ্ছন্ন রয়েছে। শোক কাটিয়ে উঠুক। সময় গড়িয়ে যাক। এ ভিতরে চলতে চলতে ভালো না বেসে যাবে কই।

এদিকে আয়মান কথা প্রসংগে মা বোনকে পিয়াসার দুরাবস্থার কথা জানালো।

তার মা বলল,
তুই মেয়েটাকে কালকেই আমাদের বাসায় নিয়ে আয়।

মা ও আমাদের বাসায় আসবেইনা। আমাকে ভয় পায়। একদিন বেত দিয়ে মেরেছি তাই। আরেকদিন অনেক ঝেড়েছি। অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা ভাব পারলে।

ঢাকা শহরে মানুষ নিজে থাকতে জায়গা পায়না আবার এমন একটা বিবাহযোগ্যা মেয়ে রাখবে? তোর ও যা কথা বেক্কলের মতো। আমাদের বাসায় জায়গা আছে। ও আলিশার সাথে ঘুমাবে।

পাশ থেকে আয়মানের ছোটবোন আলিশা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। বলল আম্মু আমি একটা বন্ধু পাব। আপু পাব। আর বোর হবনা এই একলা বাসায়। ভাইয়া না আনতে পারলে তুমি আমি মিলে আপুটাকে বুঝিয়ে নিয়ে আসব।

আয়মান বলল,আচ্ছা আগে আমি ওকে বলে রাজি করাতে পারি কিনা দেখি। ওর আবার টনটনে মর্যাদাবোধ।

পিয়াসাকে নিয়ে আয়মান সারাদিন অনেক ভাবল। বললে যদি হিতে বিপরীত কিছু ঘটে, তারচেয়ে ও ওর মতো থাকাই ঢের। তবুও পরের দিন রাতে পিয়াসাকে ফোন দিল।

পিয়াসা মোবাইল স্কিনে চেয়ে দেখল আয়মান স্যার লিখা। অবাক হয়ে চোখের পাতা ভাঁজ করলো পিয়াসা। পড়ার কোন প্রয়োজনে সম্ভবত ফোন দিয়েছে স্যার। এই ভেবে রিসিভ করলো।

হ্যালো আসসালামু আলাইকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছ তুমি?

আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি স্যার। আপনি কেমন আছেন?

হুম ভালো আছি। তোমার সাথে একটু কথা ছিল। এখন বলব নাকি কাল দেখা করবে পরে? তোমার সুবিধা যেভাবে হয়?

স্যার পড়ার বিষয়ে হলেতো এখনই বলতে পারেনা।

না অন্য বিষয়ে।

তাহলে কাল আমি সময় সুযোগ করে দেখা করব স্যার। এখন কথা বলতে আমার সমস্যা। শুয়ে গিয়েছি।

ওকে। ঘুম ভালো হোক। আয়মান ফোন রাখল। পিয়াসার ফোনের কন্ঠ এত মিষ্টি। ওহ মাই গড! ভেবেই রোমাঞ্চিত হলো আয়মান।

পিয়াসার মাথা চরকির মত ঘুরছে। কি হচ্ছে তার সাথে এসব। কোন অশুভ হাতছানি নয়তো?

পরেরদিন পিয়াসা ক্লাস ও কোচিং শেষে অফিসে যায়। আয়মান অফিসে কাজের বাহানায় থেকে যায়। সবাই চলে গিয়েছে দু একজন অধস্তন কর্মচারী বাদে।

পিয়াসার দিকে মুখ তুলে চাইলো একবার৷ চেয়ারে বস।

না স্যার সমস্যা নেই বলেন।

পিয়াসা তোমার কি কোথাও থাকার ব্যবস্থা হয়েছে?

না স্যার হয়নি। তার আর দরকার ও নেই। ফাইনাল পরিক্ষা পর্যন্ত পাশের আন্টিদের বাসায় থাকব। তারপর গ্রামে চলে যাব। গ্রামের ভার্সিটিতে এডমিট হব। টিউশনি করাব। তাতেই চলে যাবে কোনরকম। ঢাকায় কোনভাবেই থাকা সম্ভব নয়।

আয়মান শান্তসুরে বলল,আমি যদি
তোমার থাকার ব্যবস্থা করি থাকবে?

কোথায় স্যার?
আমাদের বাসায়। জানি কি ভাবছ তুমি এখন?

চলবেঃ ৫