প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব-১০+১১

0
422

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ১০ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
কুয়াশাঘেরা শীতল ভোরের স্নিগ্ধতার রেশ ফুরিয়ে গেল। উৎসবমুখর পরিবেশে রসের ক্ষীরের ভোজন হলো। রাত ভরে ঘাসের বুকে টুপ টুপ করে ঝরে পড়া শিশিরগুলো শুকিয়ে গেল। সারা আঙিনাজুড়ে মাখো মাখো নরম রোদ্দুর তার তাপ ছড়িয়ে দিল। এমন ঝলমলে মিঠে রোদের উত্তাপ গায়ে মেখেও পিয়াসা ভাবলেশহীন হয়ে বসে আছে।

আপু চল ঘাটে রোদ থাকতে গোসল সেরে নিই। বসে বসে কি করছ গাছতলায়? বলল আলিশা।

দেখিস না উঠানে কুয়া বানাচ্ছে সে। দেখ বাঁশের ছড়ি দিয়ে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে কিভাবে গর্ত করে ফেলছে। বলল আয়মান।

পিয়াসা উঠে দাঁড়িয়ে গেল৷ জামাকাপড় নিয়ে গোসল করতে পুকুরে নামল। আলিশার সাথে পালা বদল করে পুকুরের এপাশ থেকে ওপাশে সাঁতরে গেল। দাদীর সাথেও তারা অনেক মজা করলো।

রায়হানের আজকের ফোন কলটা আয়মানকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। হৃদয়টাকে বিরানভূমি মনে হচ্ছে। অপার শূন্যতা বিরাজ করছে তার মনে। রায়হান যেন নিজ হাতেই বন্ধুর হৃৎপিণ্ডটা খামচে ধরেছে। কারণটা এখন তার কাছে স্পষ্ট শুভ্র মেঘের ন্যায়। সে দুপুরে ভাত খায়নি। সবাই কারণ জানতে চাইলে হাসিমুখে বলল খিদে নেই।

পরের দিন শেষ বিকেলের মাথায় কথা প্রসঙ্গে আয়মানের দাদী তার মাকে বলল,
বউ একটা কথা কইবার চাই।
জ্বি আম্মা বলেন। নমনীয় সুরে বলল আয়মানের মা।

তোমরা শহরে থাক মানলাম। এই যে তোমার কোন দূর সম্পর্কের বোনের ঘরের ভাগনীরে লেখাপড়ার সুবিধার জন্য কাছে রাখতাছো। এটা বেশী ভালা নজরে দেখা যায়না। তুমি কইলা এই মাইয়ার মা বাপ নাই। তোমরাই অভিভাবক। তাইলে কই কি আয়মানের লগে ওর সাদী দিয়া দাও। বাসার ভিতরে দুইটা জোয়ান পোলা মাইয়া ঘুরাঘুরি করলে কখন কি আকাম কইরা ফালায় আল্লায় জানে। যুবতী নারী হইলো আগুন। পুরুষ তার অল্প তাপ পাইলেই মোমের মতন গইলা যাইব। তখন মান ইজ্জত নিয়া টানাটানি হইবো।

এক টানে কথা বলেই পানের ফিক ফেলল আয়মানের দাদী।

তার মা একটুক্ষন চুপ করে রইলো। পরে বলল আম্মা ভালো বলছেন। এমন কিছু মাথায় আসেনাই। আচ্ছা আগে ঢাকা যাই। তার পর চিন্তা ভাবনা করে দেখি কি করা যায়।

হ তাই করো। হয় হ্যারে দূরে রাখ। আর নইলে ঘরের বউ করে ফেল। এর পর আর কোন ঝামেলা নাই। যতদূর দেখছি মাইয়া ভালোই আছে। পড়াশোনা করতাছে। চেহারা আরো ফুটব বিয়ার পানি গায়ে পড়লে। গায়ে গতরেও ফুইলা উঠবো তখন। আয়মানের লগে পুরাই মানায়া যাইব।

সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলে আয়মান চা খেয়ে তার রুমে বসে মোবাইলে কলেজের বিভিন্ন কাজ দেখছে পেইজ ও গ্রুপে ।
আলিশা হন্তদন্ত হয়ে তার সামনে এসে পড়ল। ভাইয়া এদিকে আস। পিয়াসাপু কেমন যেন করছে।

আয়মান উঠে গেল দাদীর রুমে। কি হয়েছে দাদী?

আরেহ এই মাইয়া আস্ত একটা পান খাইছে শখ কইরা। লগে দিছে চুন,সুপারি,হাকিমপুরি জর্দা,সাদা পাতা,খয়ের।
হ্যাঁ তাই ভাইয়া। এর পর হতেই বিছানায় গা এলিয়ে পড়ে আছে। চোখ ও মেলতে পারছেনা।

এই মাইয়ারে আমার পানের নেশায় ধরছে। পইড়া থাক। সময় বাদে হুঁশ ফিরা আইবো।

ওকে পান খেতে দিল কে? জেদি কণ্ঠে জানতে চাইলো আয়মান।

শুনো কথা নাতীর। হেই কি শিশু কেউ দিব? নিজেই আউশ কইরা খাইলো। কইলো, দাদী সকালে যে কইলেন পান পাতায় নেশা। এখন এট্টু খাইয়া দেহি ক্যামুন নেশা। জনমেও খাইনাই। এই বইলা আমার পানের বাটা নিয়া নিজেই প্যাঁচাইয়া খিলি বানাইলো আর গালে ঢুকাইলো।

আয়মান খাটের এক পাশে বসে আছে। আলিশা পিয়াসাপু বলে ডেকেই যাচ্ছে। তাকানোর নাম নেই।
পিয়াসা পাশের ঘরে তার মাকে ডাকতে গিয়েছে। দাদী উঠে তার নামাজ পড়ার ছোট চৌকিটাতে চলে গেল তসবিহ হাতে নিয়ে।

আয়মান চোখ বন্ধ পিয়াসাকে বারবার দেখছে। পিয়াসার অনুভূতিহীন চুল, নখ ধরার ও তার ইচ্ছে নেই। এভাবে আরো কিছু সময় কেটে গেল।

কিন্তু পরক্ষণেই নিরুপায় হয়ে পিয়াসার হাত ধরে টানল। কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিল। হাতের তালুতে হালকা করে চিমটি কাটল। চুল ধরে টেনে দেখল। চিবুক ধরে নাড়ল। চোখে মুখে পানির ঝাপটা মারল। পায়ের তালুতে সুড়সুড়ি দিল। নাহ কোন কাজ হচ্ছেনা। বেহুঁশের মতো পড়ে আছে বিছানায় আগোছালোভাবে।

একপাশে পড়ে থাকা ওড়না নিয়ে বুক ঢেকে দিল আয়মান। এভাবে আর কতক্ষণ। পরে আয়মান পিয়াসার সরু গোলাপি দুটি ঠোঁটের উপর নিজের বলিষ্ঠ দুটি আঙুলের মাথা বসালো। একপাশ থেকে আরেকপাশে তার আঙুলের দুটি মাথা বোলাতে লাগল। তবুও কাজ হচ্ছেনা। এরপর আয়মান সাহস করে পিয়াসার অধরে নিজের অধর দুটি চেপে ধরল। অধর একটু ফাঁক করে ধরল। নিজের মুখের হাওয়া পিয়াসার মুখের ভিতর জোরে জোরে দিতে লাগল। এবার কাজ হলো। পিয়াসা উহু! আহ! করে কোঁকাতে কোঁকাতে নড়ে চড়ে উঠলো। চোখ মেলেই খালি রুমে তার পাশে আয়মানকে দেখে চিৎকার দিতে যাচ্ছিল।

অমনি আয়মান পিয়াসার মুখ চেপে ধরল। কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, সো ডিজগাস্টিং! আর কিছুর নেশা হতে পারেনা? পানের নেশা করে বুঁদ হয়ে পড়ে ছিলে এতক্ষণ। আমার কতগুলো সময় গেল। ফিরিয়ে দিও সে সময়গুলো। যত্তসব উটকো ঝামেলা। বউ হবে একজনের। সামলাতে হয় আরেকজনের।

পিয়াসা হতভম্ব হয়ে ড্যাবড্যাব চোখে আয়মানের দিকে চেয়ে রইলো। আয়মান উঠে গেল তাতানো মেজাজ নিয়ে।

খুব ভোরে উঠানের একপাশে আগুন জ্বালানো হলো। আগেই শুকনো পাতাগুলোকে শুকিয়ে জড়ো করে প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে আগুন পোহানোর জন্য। নয়তো কুয়াশায় ভিজে চুপসে যেত।

আগুনের কুন্ডুলির চারপাশে কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এ ঘর ও ঘরের ছোট বড় অনেকেই এলো। ছোট ছোট বাচ্চারা মজা করছে আর দুহাত সামনের দিকে মেলে ধরে আগুন পোহাচ্ছে।

” হিম হিম শীত শীত। শীত বুড়ি এলরে
কনকনে ঠান্ডায় দম বুঝি গেলরে। ”

বারো বছরের একটি ছেলে এমন ছড়া কাটল। শুনে আলিশা ও বলল,

” শীত মিত ভাই। আমার কাঁথাকাপড় নাই
শীতেরে কইয়ো গিয়ে, আগুন আমার ভাই। ”

ধোঁয়ার গন্ধ পেয়ে আয়মান হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে গেল। সে তার ছোটবেলায় ফিরে গেল। কত যে এমন করে আগুন পোহাল। ভাবতেই নষ্টালজিক হয়ে গেল।

যাই আলিশাকে মজা দেখাব বলে পা টিপে টিপে গেল আগুনের কাছে। দুহাতকে ভাল করে গরম করে নিল। পিছন থেকে চাদর মুড়ি দেওয়া মুখে দুপাশ থেকে তার বলিষ্ঠ দুহাত চেপে ধরলো। পিয়াসা আয়মানের হাত সরিয়ে মাথা ঘুরিয়ে চাইল।

আয়মান কপাল ভাঁজ করে,
আলিশার চাদর তোমার গায়ে কেন? আলিশার গাল ভেবেই দিয়েছি।

পিয়াসা নিজের একহাতের তালু দিয়ে আয়মানের হাতের স্পর্শ লাগা স্থানে পরশ বুলাতে লাগল। দুচোখ বুঁজে এল তার। ভালইতো লাগল শীতের মধ্যে উষ্ণ দুটি হাত । বলল গোপনে।

আগুন পোহানো শেষ হলে পিয়াসা, আলিশা ও তার সমবয়সী দুই কাজিন মিলে হাত ধরাধরি করে তাদের উত্তর পুকুর পাড়ের দিকে হাঁটতে গেল৷
চারপাশে ভোরের আমেজ এখনো দৃশ্যমান।

এই আলিশাপু বাগানের ভিতরে চাও।
বলল মুক্তি।

কি চাইব?
আম গাছের গোড়ায় বসে একজন সিগারেট খাচ্ছে দেখ। ধোঁয়া উড়ছে দেখতে পাচ্ছনা?

ওমা কি বলিস। তাই নাকি? এ যে নারী।

পাশ থেকে পিয়াসা বলল,
মুক্তি ঠিকই বলছে। চলো আমরা তার সামনে যাই। মেয়ে মানুষ হয়ে কেন সিগারেট ফুঁকছে। জিজ্ঞেস করি।

তারা বাগানের ভিতরে ঢুকলো। পিছনে কারো পায়ের আওয়াজ পেয়েও সে সিগারেট টেনেই যাচ্ছে। কোন বিশেষ হেলদোল দেখা গেলনা তার মাঝে।

ভাবি তুমি এই সাতসকালে পুরুষের মতো সিগারেট খাচ্ছ কেন? হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করল মুক্তি।

এক গাল হেসে রমিজের বউ বলল,
পুরুষ জাতি কেন সিগারেট খায়? জানতে চাইলো আলিশাদের কাছে।

পিয়াসু বলল, এর কারণ তো একাধিক। কেউ খায় পরিবারে বাবা,চাচা, দাদা,বড় ভাই, বন্ধুদের খেতে দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে তাই। আবার কেউ খায় জীবনের নানা হতাশা,দুঃশ্চিন্তা,যন্ত্রণা সাময়িক ভুলে থাকার জন্য। কেউ খাওয়া শুরু করে প্রেমে ছ্যাঁকা খেলে প্রেমিকাকে ভুলে থাকার জন্য। কিন্তু আপনি একজন মেয়ে মানুষ হয়ে কেন এমন একটা অশোভনীয় কাজ করছেন?
গ্রামের এক গৃহবধূ দিনের আলোতে বসে বসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। এটা দেখতেও বেশ দৃষ্টি কটু লাগে ভাবি।

উঠে দাঁড়িয়ে গেল রমিজের বউ। একদম রাইট কইলা তুমি। তাইলে বল পুরুষের দুঃখ বেদনা আছে মেয়ে মানুষের নেই? জীবনের নানা রকম হতাশা পুরুষকে খাবলাইয়া খাবলাইয়া মারে। মেয়ে মানুষকে মারেনা? পুরুষ ছ্যাঁকা খায় মেয়েরা খায়না? পুরুষের মন আছে মেয়েদের মন নেই। পুরুষ যে যে কারণে সিগারেট ধরে। ঠিক সেই সেই কারণে মেয়ে মানুষদেরও সিগারেট ধরা উচিত।

আর কইলা যে গ্রাম। কে কি ভাবল,কোন নজরে দেখল আমি তফুরা এগুলার ধার ধারিনা। আমার কলিজায় অনেক হিম্মত। এই হিম্মত এমনি এমনি হয়নাই।

নিশি রাইতে এক পুরুষের সামনে পুরা নগ্ন হইতে হইছে আমার। সারাগায়ে একটা সুতা থাকলেও কাজ হতনা তখন ।

তারা একে অপরের দিকে চোখ বড় বড় করে চাইলে। তফুরা বলল,
আরেহ যা ভাবছ তা নয়।

হে আমার নখ ও ধরেনাই। কবর থেকে লাশের গায়ের কাপড় টাইনা উঠাইয়া তারে দিতাম। কবরে নামতে হইলে এভাবেই নামতে হইতো। সেই পুরুষ কবরস্থানের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকতো আমার পরনের কাপড় হাতে নিয়া। উইঠা আবার তার সামনেই পইরা ফেলতাম কাপড়। সে সেটা দিয়ে কি জানি কি বড় কারবার করতো। আমিও অভাবে রাজি হইতে বাধ্য হইছি। বাদ দাও। এটা বিশাল ইতিহাস।

আলিশা বলল,সিগারেট কোন দুঃখে খান?

তোমার ভাই আমার মতো বউ থাকতে গোপনে এক বেডিরে বিয়া করছে প্রেম কইরা। এবার তোমারাই বল আমার সিগারেট একসাথে কয়টা খাওয়া উচিত বুকের কষ্ট কমানোর জন্য?

আচ্ছা যা মন চায় খাবেন। তবে জেনে রাখুন, সিগারেট খাওয়া খুব বেশী ক্ষতিকর শরীরের জন্য। জ্ঞানীর মতো বলল পিয়াসা।

তাদের ডাক পড়ল নাস্তা খাওয়ার জন্য। পিয়াসা ও আলিশা নানা ফুসুরফাসুর করতে করতে গিয়ে নিজেদের রান্না ঘরে ঢুকল।

কিরে কোথায় গেলি তোরা। মা জিজ্ঞেস করলো চুলোর আগুন দিতে দিতে।

দুজনে দুটো পিঁড়ি টেনে বসল। একটু হাঁটতে গেলাম মা। ভোরের মাটির সোঁদা গন্ধ ও কি যে ভালো লাগে মা। বলল আলিশা।

তাহলে তোকে গ্রামেই বিয়ে দিব। বলল আয়মান।

নো। ওভাবে থাকতে পারবোনা ভাই।

ওয়াও চিতই? কি দিয়ে খাব মা?

গুড় আর কুরানো নারকেল মিশিয়ে নিয়েছি। এটা দিয়ে খাবি। অনেক স্বাদ। মাটির খোলায় চিতই পিঠার গোলা দিতে দিতে জানালো মা। পাশে বসা দাদী ভাতের দুটো প্লেট নিলো। একপাশ করে মাখানো নারকেল গুড় দিলো। একপাশে খোলা থেকে নামানো গরম গরম চিতই পিঠা দিল।

আয়মান বলল দাদী ওদের জুড়ানোটা দেন। কাল দেখলন না জুড়ানো ক্ষীর নিয়ে কি করল।

চুপ বাঁদর। চিতই পিঠা গরম গরম খেতে হয়। যে খাবার যেভাবে খেলে মুখে বেশী সোয়াদ লাগবে সে খাবার সেভাবেই খেতে হয়।

আলিশা গাল ভেংচি দিয়ে, এটা কাকে বললা আমি বুঝেছি। পাশ থেকে পিয়াসা বলল আমিও বুঝেছি।

আয়মান জল চৌকি ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। বের হতে হতে আস্তে করে বলল, এভাবে যদি তোরা মেয়ে মানুষেরা সব বুঝতি আর কোন কথাই থাকতোনা।

এদিকে পিয়াসাকে একটু নিরালায় পাওয়ার অপেক্ষায় আছে আয়মান। দুপুরে সারা ঘর খালি। পিয়াসা বাইরে থেকে ঘরে এলেই, ডাক দিল আয়মান। পিয়াসা একটু শুনে যাও।

পিয়াসা নিঃসংকোচে, নিদ্বিধায় গেল আয়মানের রুমে। আর যাই হোক আয়মান স্যারকে সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। এই কয়দিনে পিয়াসার মনে আয়মানকে নিয়ে বিশ্বাসটা পাকাপোক্ত হওয়ায় আয়মান ও বেশ স্বস্তি অনুভব করে। এর আগে যতবারই আয়মান স্যার তাকে ধরেছে। তা নিতান্তই ডাক্তারের মতো প্রয়োজনেই ধরতে হয়েছে। ভুল বোঝার এতটুকু অবকাশ নেই।

একটা মেয়ের মনে একটা ছেলের চরিত্র নিয়ে সন্দেহর বীজ একবার বপন হয়ে গেলে সেটা কিছুতেই নিংড়ে ফেলা যায়না। বরং সময়ের সাথে সাথে সেই সন্দেহ, অবিশ্বাস ডালপালা মেলে মহীরুহ হয়ে উঠে।

বলেন স্যার।
স্যার?
থুক্কু ভাইয়া বলেন।

রায়হান বলল তুমি নাকি তাকে বিয়ে করতে রাজি। নাহ আমার তো কোন সমস্যা নেই এতে। যেখানে তুমি প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে মানা করে দিলে। সেখানে হঠাৎ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হওয়ার কারণটা জানতে আগ্রহবোধ হলো মনে। জাস্ট এইই আর কি। ইচ্ছে হলে বলবে। না ইচ্ছে হলে না বলবে। এজ ইউর উইশ। এমন গুরুত্বহীনভাবে স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো আয়মান।

পিয়াসা উদাস গলায় জানালো,
আমি মুখে কিছুই বলিনি উনাকে। শুধুই চুপ ছিলাম। সব সময় নিরব থাকা মানেই কি সম্মতি মিন করে?

তবে তুমি কি মিন করেছ তাকে সেটা জানতে চাই?

আমি ভাবনায় পড়ে গিয়েছি স্যার। কারণ আমার তিনকূলে কেউ নেই। আমাদের সমাজে একটা এতিম মেয়েকে কে বিয়ে করতে চাইবে। আপনাদের আশ্রয়ে বেঁচে আছি। এইতো স্রস্টার নিকট লাখো কোটি শুকরিয়া । কিন্তু চিরদিনের জন্যতো পথচলায় কারো উপর একজন মেয়েকে নির্ভর করতেই হয় নানাভাবে নানাসময়ে।

আমার যে বন্ধু গ্রুপ গ্লু বাহিনী, তাদেরকে রায়হান স্যারের বিষয়টা জানালাম। তারা অনেক যুক্তি দিয়ে আমাকে বোঝাল এটা আমার জন্য আশির্বাদ স্বরূপ।

আয়মান সহাস্য হেসে, যাহাই লাউ তাহাই কদু। ঘুরেফিরে রেজাল্ট এই দাঁড়ায় তুমি রাজী।

পিয়াসা চুপ হয়ে আছে।

ওকে বেস্ট অফ লাক। তোমার বিয়েতে কি উপহার দিব। বল তুমি। তুমি যেটা চাইবে সেটাই দিব।

হেসে বলল পিয়াসা,আপনার কাছে আমার চাওয়ার কিছুই নেই। আপনি খুশি হয়ে যা দিবেন তাই হবে আমার পরম পাওয়া।

আচ্ছা তাই হবে যাও।

পিয়াসা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আয়মান বুক ভরে দীর্ঘস্বাস ছাড়ল। দরজা বন্ধ করে দিল। এখানে ডায়েরি নেই তাই মোবাইলের নোটপ্যাডে লিখল,

” তুমি হারিয়ে গিয়েছ যে পথে
সে পথ আমার হলো জানা।

এ হৃদয় পথ রয়েছে খোলা
কভু ফিরে আসতে নেই মানা।

নিজের দোষে তোমায় হারালাম
তাই সকল ব্যথা ভুলে গেলাম।”

আবার লিখল,

” রাতের কুমুদ যেভাবে চেয়ে থাকে নভোনীল পেতে।
ঠিক তেমনিই আমিও অপেক্ষায় রবো কভু তোমায় পেতে। ”

চলবে ঃ ১০

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ১১ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
” রাতের কুমুদ যেভাবে চেয়ে থাকে নভোনীল পেতে।
ঠিক তেমনিই আমিও অপেক্ষায় রবো কভু তোমায় পেতে। ”

কুয়াশার চাদরে মোড়ানো গ্রামের শীতকে বিদায় জানিয়ে আর একদিন পরই ওরা ফিরে যাবে শহরে ওদের অস্থায়ী গন্তব্যে। পরিযায়ী পাখির মতো দুদিনের অতিথি হয়ে এলো যেন। ওদের সবার মন সঙ্গী হারা একলা পাখিটির মতন বিষন্ন।

আয়মানের মন মাঝ সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়া জাহাজের নাবিকের মত বিপন্ন । কারণটা কোন এক রহস্যময়ী নারী। যার হাসি মোনালিসার হাসির চেয়েও মোহনীয়। যার হাঁটা যেন চপল ছন্দ। নুপুরের ধ্বনি। যার ব্যক্তিত্ব পাহাড়ের মতো মজবুত। যার ছায়া দেখেও তার হৃদয়ে কাঁপন ধরে। সে তার নাগালেই। সে তার চোখের সামনেই ছোট্ট হাঁসের ছানার মত তিরতির করে হেলেদুলে চলে। এত কাছে থেকেও সে যোজন যোজন দূরে। সে যেন দূর আকাশের শুকতারা। নয়তো কোন ছায়া মানবি। শুধু বক্ষ জুড়ে তৃষিত চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়েই থাকা যায়। চাইলেও ছোঁয়া যায়না। চাইলেও কাছে যাওয়া যায়না। একটা অদৃশ্য শিকল দিয়ে তার হৃদয়টাকে কেউ যেন বেঁধে রেখেছে। প্রকাশ করার কোন সামর্থ্য নেই তার।

তার মায়ের মন ও খারাপ গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে বলে। বালিকা বয়সে তার বধু জীবন শুরু হয়েছে এই বাড়িতেই। চার বেহারা পালকি করে তাকে নিয়ে এসেছে এই শ্বশুর বাড়িতে। কত অল্প বয়স ছিল। ভারী ভারী পা ফেলে গানের তালে তালে তারা গাঁয়ের এবড়ো থেবড়ো মেঠো পথ মাড়িয়ে গ্রামের পর গ্রাম পার করলো। সেই মধুময় দিনের কথা স্মরণ করে তার দুচোখ আদ্র হয়ে উঠল। কোথায় আজ সেই মানুষটা। কেন হাত ছেড়ে চলে গেল। এই বুঝি জীবনের নিষ্ঠুর নিয়ম।

আলিশার ও ভীষণ মন খারাপ চারদেয়ালের বন্ধী নাগরিক জীবনের কথা ভেবে। গ্রামের মুক্ত হাওয়া,নির্মল সবুজের সমারোহ, আকাশের বিশালতা, গাছে গাছে পাখিদের মুখরিত কলরব, পদ্ম পুকুরে পানকৌড়ির ডুব সাঁতার, বিকেলে সাথীরা মিলে দল বেঁধে খেলা করা, এই উচ্ছ্বলতার দিনগুলো আবার কবে ফিরে পাবে তা কে জানে।

দাদীর ও মনটা খুব বেজায় ভার, এতদিন ঘর ভরা মানুষ ছিল। তাই মনটাও বেশ প্রফুল্ল ছিল। সবাই চলে যাবে তাকে ছেড়ে। সে হয়ে যাবে রাত জাগা দুঃখীনি মায়ের মতো।

পিয়াসার সুপ্ত অন্তরটাও বড্ড ছন্নছাড়া হয়ে আছে। মা বাবা ছাড়া কে তুলে দিবে তাকে বরের হাতে। সে যে বড় অনাথ। সে কি সত্যিই ঢাকায় গেলে কারো বউ হয়ে যাবে৷ শত বিক্ষিপ্ত ভাবনা তাকে আষ্ঠে পৃষ্ঠে ধরেছে স্বর্ণলতিকার ন্যায়।

অলস দুপুরের সাথে পাল্লা দিয়ে পিয়াসার মাঝেও অলসতা এলো। আয়মানদের ঘরের পাশ ঘেঁষেই একটি পুকুর। পিয়াসা হেঁটে গেল সেদিকে। চারদিক থেকে রোদ্দুর তার তেজ কমিয়ে নেমে এলো পুকুর পাড়ে। পাড়ের এক পাশে একটি আম গাছের গোড়ায় পিয়াসা বসল। দুপুরের খাওয়ার পর সবাই ভাতঘুম দিচ্ছে। পিয়াসা অনেক চেষ্টা করেও তন্দ্রাঘোরে যেতে পারেনি। তাই নিরবে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।

পুকুরের দিকে ঝুঁকে আছে একটি বরই গাছের ডাল। একটি মাছরাঙা পাখি পুকুরের মাঝ বরাবর উপর দিয়ে ওপাড় থেকে উড়ে এসে সে ডালে বসল। পিয়াসার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সেদিকে। পাখি তার খুব প্রিয়। কত চড়ুই ধরেছে গ্রামে থাকতে। আবার ফুরুৎ করে দুহাত মেলে ছেড়েও দিত।

স্বচ্ছ পানির নিচে স্থির চোখে মাছরাঙাটি ওৎ পেতে আছে মাছ শিকারের জন্য। একটু পরেই ঝুপ করে পানিতে ডুব দিল। চোখের পলকেই ছোট একটি পুঁটি মাছ ধরে ফেলল। ঠোঁটের মাঝ বরাবর কামড়ে ধরে ডালে উঠে বসল। মাথা এপাশ ওপাশ করে খেয়ে ফেলল। পিয়াসা আপন মনে কিটকিটিয়ে হাসল। পাখিটি উড়ে গেল।

পিয়াসাও পাখিটির মতো পাড়ে বসে পানির নিচে তাকালো। ওমা! তার চোখ চকচক করে উঠলো রুপোলী থালার মতো। পুকুর পাড়ে রোপণ করা অনেক গুলো পাটি গাছের সবুজ গোড়া আকঁড়ে আছে ছোট ছোট চিংড়ি। কি মন ভালো করা দৃশ্য। কি অদ্ভুত সুন্দর। মনে হচ্ছে কেউ নিজ হাতে রক্তশূণ্য সাদা চিংড়ি গুলোকে সিরিয়াল করে প্রতিটি গাছের গোড়ায় সাজিয়ে রেখেছে। নিজেকে দমাতে পারছেনা সে।

পিয়াসা সেলোয়ারের দুই পা ভাঁজ করে হাঁটুর কাছাকাছি তুলে ভিড়িয়ে দিল। স্যান্ডেল রেখে আস্তে করে পানিতে নামলো। আয়মান বাইরে ছিল। এখন পুকুরের বিপরীত পাড় দিয়ে বাড়ির দিকে আসছিল। হঠাৎ ঘাটের দিকে চোখ পড়তেই দেখে পিয়াসা নিচের দিকে ঝুঁকে কি যেন করছে। আয়মান নিরবে চুপিচুপি ঘাটের কাছাকাছি এলো। একটি মোটা আমগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে গেল। উদ্দেশ্য পিয়াসা কি করছে পানিতে তা অবলোকন ও অনুধাবন করা।

না চাইলেও আয়মানের চোখ গেল পিয়াসার উদাম পায়ে। ডুবো পানিতে পিয়াসার ফর্সা ভেজা পা দুটি ভারী কমনীয় লাগছে। তার উপরে পাতলা কালো কুচকুচে লোম। যেন সাদা কাগজের বুকে শিল্পীর আঁকা কালো তুলির শৈল্পিক আঁচড়। যুবতী মেয়ের পা যুগলে যে দুর্নিবার আকর্ষণ থাকতে পারে তা এইমাত্র আয়মান টের পেল।

কিন্তু পিয়াসা দুইহাত দিয়ে মাটিতে কি খুঁজছে? কিছু হারিয়ে গেল নাকি? তার কানের ইমিটেশন দুল বা হাতের আংটি? যাই জিজ্ঞেস করি বলে আয়মান এগিয়ে পাড় বরাবর দাঁড়াল। পিয়াসা তাকে দেখিনি। সে চিংড়ি মাছ ধরার চেষ্টা করছে।

পিয়াসা কি খুঁজছ?

অপত্যাশিতভাবে আয়মানের কন্ঠ শুনেই পিয়াসা চমকে গেল। ওমা আপনি এখানে কেন? এই বলতেই অসাবধানতাবশত কাত হয়ে পড়ে গেল পানিতে।

আঃ পড়ে গেলে কেন?
আপনার জন্যইতো।
আমিতো তোমার উপকার করতে আসলাম।
উপকার না অপকার করেছেন এই ঠান্ডায় তাতো দেখতেই পেলেন,পানি থেকে উঠতে উঠতে বলল। জুবুথুবু হয়ে কাঁপছে শীতে।

পানিতে কি পড়েছে তোমার?

উফফস! আমি চিংড়ি মাছ ধরতে নামলাম।
হোয়াট! বলে আয়মান উদ্দাম হাসি হেসে ফেলল।

কই চিংড়ি মাছ দেখি? রাতে তাহলে ভেজে খাব।

আমার হাতেই ছিলমুঠোবন্দি। পড়ার সাথে সাথেইতো ওরাও পানিতে পড়ে গেল।

বেশ হয়েছে। তাদের জলেই মানায়। মানুষের হাতে নয়। যাই। তোমার জামা কাপড় তো আমি চিনিনা আলিশাকে ডেকে দিচ্ছি। আয়মান চলে গেল।

পিয়াসা ভ্যাঁ করে পিছন দিয়ে ভেংচি কাটলো আয়মানকে। কারণ সে জানে আয়মান শুনতে পাবেনা। বেশ খানিকটা এগিয়ে ঘরের দিকে চলে গিয়েছে।

আলিশা জামা সেলোয়ার এনে দিল।পিয়াসা চেঞ্জ করে ঘরে চলে গেল। রোদে দিয়ে এনে রাখা লেপের গরম ভাঁজে পা ঢুকিয়ে বসলো। তারপর লেপের উষ্ণতায় নিজেকে ঢেকে ফেলল।

আয়মান তার খাটে লেপ না পেয়ে অন্য রুমে খুঁজলো। বুঝল লেপ মুড়ি দিয়ে আছে পিয়াসা। শব্দ করে বলল,
আলিশা আমার গরম লেপ কই?
আমি পিয়াসা আপুকে এনে দিয়েছি। কারণ রোদ থেকে সব শেষে তোমার লেপ আনা হয়েছে। তোমার লেপে উম বেশী। এক্কেবারে টাটকা গরম। তাই।

পিয়াসা শুনেই লেপের নিচ থেকে বের হয়ে উঠে বসলো। ধলাই মলাই করে আয়মানের খাটে গিয়ে লেপটি রেখে দিল। আয়মান পিছন দিয়েই দু কদম লম্বা পা ফেলে তার রুমে চলে গেল।

আজব তো পিয়াসা। আমি তোমাকে কিছু বলছি? এমন করে এনে দিলে যে?
অনুযোগের সুরে জিজ্ঞেস করলো আয়মান।

মৃদু হেসে পিয়াসা জানাল,
আরেহ তা নয়। আমি যদি জানতাম এটা আপনার লেপ তাহলে গায়েই জড়াতাম না। সত্যিই বলছি।

নাও বলছি। ঠান্ডা লাগবে যে। আমার জন্যইতো পানিতে পড়ে গেলে এই অবেলায়।
লাগুক ঠান্ডা। হোক অসুখ। কেন যে বেঁচে আছে এই দুই পয়সার প্রাণটা। অভিমানী গলায় বলল পিয়াসা।

আয়মান খুব দুঃখ পেল পিয়াসার এমন কথায়। আর পারছেনা সহ্য করতে। পিয়াসার হাত চেপে ধরলো।

জিজ্ঞেস করল, তোমার ধারণা আমি জেনেও লেপ কই জিজ্ঞেস করলাম?

শুধু ধারণা নয় এটা আমার বিশ্বাস। বলেই পিয়াসা জ্বলজ্বল চোখে আয়মানের হাতের দিকে চাইলো। আয়মান এক ঝটকায় তার হাত ছেড়ে দিল। মোটা গলায়, আচ্ছা ঠিকাছে । যাও তুমি ।

পিয়াসা চলে গেল আয়মানের সামনে থেকে। আয়মান ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অনেক রাত করে ঘরে এলো।

গভীর আফসোসের সাথে চিন্তা করল, কেন এমন হচ্ছে আমার সাথে। বলি একটা ভেবে। ঘটে যায় বিপরীত কিছু। শুরু থেকেই এই মেয়েটার সাথে আমার এমন হয়ে আসছে।

না খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। তার আগে ইউটিউবে বেস্ট অফ অবসিকিউর লিখে সার্চ দিল। লো ভলিউমে গান বেজে যাচ্ছে।
” মাঝ রাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায়/বুঝে নিব তুমি আজ চাঁদ দেখনি।”

” ছাইড়া গেলাম মাটির পৃথিবী/
জীবন খেলায় হারাইলাম সবই/বুকে জমাট বাঁধা অভিমান/
কী নিঠুর এই নিয়তির বিধান।”

গ্রাঁয়ের মাটিকে বিদায় জানিয়ে নির্ধারিত দিনে তারা ফিরে এলো ঢাকায়। তাদেরকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আয়মান কলেজে চলে গেল। আলিশা ফ্রেস হয়েই বিছানায় গিয়ে গা ছেড়ে দিল। পিয়াসা আয়মানের মায়ের সাথে বাসা ঝাড়া মোছার কাজে হাত লাগালো কোমরে ওড়না বেঁধে। তা দেখে আয়মানের মা মনে মনে ভেবে উঠলো। ইসস! রায়হান পছন্দ করে পিয়াসাকে। নইলে এই সংসারি মেয়েটাকে আমিই রেখে দিতাম।

রাতে রায়হান আয়মানদের বাসায় গেল। সবার সাথে দেখা করে কুশলাদি জানলো। পিয়াসার কাছে গেল।
কেমন আছ তুমি?

এইতো ভালো। আপনি কেমন আছেন স্যার?

জানিনা কেমন আছি।

আপনাকে কেমন বিদীর্ণ দেখাচ্ছে স্যার ?

ঠিক ধরেছ তুমি। শুরুতেই বলি আমার খুব ইচ্ছে ছিল তোমার জন্য একটা উপহার নিয়ে আসি। কিন্তু তুমি তা নিবেনা। তাই আনিনি।

খুব ভালো করেছেন।

মানুষ চা চায় তা পায়না। আর যা পায় তা চায়না।

এই ধ্রুব সত্যিটাই আজ আমার জীবনে ঘটতে যাচ্ছে। রায়হান রিক্তার বিষয়ে ডিটেইলস জানালো পিয়াসাকে। বলল, কার্ড ছাপাতে দিয়েছে বাবা। বিয়েতে তুমি আসলে আমার খুব ভালো লাগবে।

বলতে বলতে রায়হানের গলা ধরে এলো। উঠে দাঁড়িয়ে গেল। পিয়াসার দুগাল চেপে ধরলো।
কপালে বেশ কয়েকটি এলোপাতাড়ি চুমু দিলো পাগলের মতো। বলল,খুব খুব সর‍্যি এ সুখটুকু ছিনিয়ে নিলাম বলে। এইতো শেষ পিয়াসা। হনহন পায়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল রায়হান।

কোন এক অদ্ভুত কারণে পিয়াসার মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল। আঁখি কোন ছলছল করে উঠল। রায়হান তাকে চেয়েও পায়নি। এ দোষ কারোই নয়। রায়হান পিয়াসাকে ভালোবাসে এটা তার ভুল নয়।
আবার তার পরিবার ম্যাচ না হওয়া মেয়েকে ঘরে তুলবেনা। এটাও তাদের দোষ নয়। সমাজে চলতে গেলে কিছুটা হলেও লেভেল ম্যাচ করতে হয়। বেশী উঁচুনিচু হয়ে গেলে এডজাস্ট করা মুশকিল।

পিয়াসা রায়হানকে ভিন্ন চোখে দেখেনা। এটাও তার দোষ নয়। মনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেশীক্ষণ ভালো থাকা যায়না। এই পৃথিবীতে কিছু কিছু দূর্ঘটনা ও ঘটনার জন্য কেউই দায়ী নয়।

পিয়াসা আলিশার সাথে রায়হানের বিষয়টি শেয়ার করল। আলিশা ছুটে গিয়ে তার মাকে জানাল। তার মা তাকে নিয়ে আয়মানের রুমে গেল।
আয়মানকে জিজ্ঞেস করল,
পিয়াসাকে তোর কেমন লাগে?

হঠাৎ একথা কেন বলছ মা? রহস্যভরা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো আয়মান।

রায়হানের পরিবার পিয়াসাকে কিছুতেই মেনে নিবেনা।

হুম শুনলাম। রায়হান বলছে সব।

তাই বলছি কি, অনাথ মেয়েটা কেমন লোকের ভাগ্যে পড়ে খোদায় জানে। তুই বিয়ে করে ফেল বাবা।

হ্যাঁ ভাইয়া। সব দিক দিয়ে খুব ভালো পিয়াসাপু। তুমি রাজী হও। চনমনিয়ে বলল আলিশা।

আয়মান সংকোচপূর্ণ গলায় বলল,
মা ধরো আমার দিক থেকে ইয়েস। বাট তার মতামত নিবেনা?

হুম। এভাবেতো চিন্তা করিনি। আচ্ছা আমরা চলে যাই। ওকে ডেকে পাঠাই। তুই সরাসরি প্রপোজ কর। ইনশাআল্লাহ রাজী হবেই।

তারা মা মেয়ে উঠে গেল। আয়মান পিছন দিয়ে ডাকল,এই মা…আলিশা..কি আশ্চর্য কাণ্ডতো। তোমরা জিজ্ঞেস করলেইতো হয়।

সামান্য পরেই পিয়াসা আয়মানের রুমের ভিতরে ঢুকল। মেঘমুখে জিজ্ঞেস করল,
স্যার আলিশা বলল আমাকে ডেকেছেন আপনি?

আয়মান যেন বাক্যহারা হয়ে পড়লো। গুছিয়ে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা।

অতিরিক্ত আবেগের সময় এবং প্রিয়জনের সামনে মানুষ গুছিয়ে কথা বলতে পারেনা।

স্যার বলেন কেন ডেকেছেন?

বসনা একটু। জানি তোমার মন খারাপ এখন।
তাই বুঝি শান্তনার বুলি ছুঁড়তে ডেকেছেন?

একদম না।

তো বলেন বলছি। নইলে চলে যাব বলছি।

আয়মান পিয়াসার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিবেদিত সুরে,
মা আর আলিশা একান্তই চায় তোমাকে আমাদের বাসার বউ বানাতে।

পিয়াসার কান লাল হয়ে গেল শুনে। কেউ যেন তাকে হঠাৎ করে বিদুৎ শক দিল। উত্তেজিত হয়ে গেল তড়িতেই। কন্ঠকে চড়ায় নিয়ে তাতানো চোখে,
তারা চায় আর আপনি?

আমি মায়ের কথার অবাধ্য হই কিভাবে।

কিন্তু আমি চাইনা। চাইনা। চাইনা। বলে পিয়াসা দৌড়ে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ফুঁফিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

চলবেঃ১১