সেই মেয়েটার উপাখ্যান পর্ব-২৭+২৮

0
205

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ২৭
সুমন ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই সোমা কে ফোনে কথা বলতে দেখলো, ওকে দেখেই সোমা হাতের ইশারায় ভেতরে ডাকলো। ওই ইশারার মানে সুমন জানে, ফোনটা অদ্বিতীয়ার, সে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে ফোনের দিকে এগিয়ে গেলো।

হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই অদ্বিতীয়ার চাপা গলা ভেসে এলো,

তুমি এখন কিছুদিন আর আমার সঙ্গে দেখা করতে এসো না!

সুমন বিস্মিত হলো,

কেনো? কি হলো আবার?

ওই জলখাবার রেষ্টুরেন্ট, যেখানে কাল আমরা বসে ছিলাম বৃষ্টির সময়ে, ওর মালিক দাদুভাই এর মক্কেল! ও দাদুভাই কে ফোন করে সব বলে দিয়েছে, ও তোমাকেও দেখেছে! জানিনা চিনতে পেরেছে কিনা!

অদ্বিতীয়ার কথায় সুমন চমকে গেলো, সকালের মালীর সঙ্গে কথা বলা লোকটার চেহারাটা এক সেকেন্ডের মধ্যে ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ওই লোকটাই তো! ওই লোকটাকে সেদিন ও রেষ্টুরেন্টে দেখেছিলো, ক্যাশ কাউন্টারে বসে ছিলো, এখন মনে পড়লো! ওই তাহলে মালিক! ও কি তারমানে ওর ব্যাপারেই খোঁজ নিতে গিয়েছিলো ক্লাবে!

মাথাটা এক মুহূর্তে গরম হয়ে গেলো সুমনের,

শালা বুড়োটা কে হাতের সামনে পাই একদিন! খোচর গিরি বার করছি ওর!!

অদ্বিতীয়া ফোনের ওপারে গম্ভীর হলো,

আবার বাজে বাজে কথা! কতো বার বলেছি এইসব বুড়ো টুড়ো বলবে না!

সুমন আরো বিরক্ত হলো,

আরে ধুর! তোমার দাদু কে বলবো না বলেছি! তাই বলে পৃথিবীর সবাই কে বলবো না এমন কোনো কথা হয় নি তোমার সঙ্গে! ওসব ফালতু কথা ছাড়ো, আসল কথা বলো! তোমার দাদু শুনে কি করলো?

এখনো তেমন কিছু করে নি! মনে হয় লোকটা তোমাকে চিনতে পারে নি!

আজ বাড়ি যাও বুঝতে পারবে! সাধে লোকটা কে গালাগালি করতে ইচ্ছে করছে! আজ সকালেই লোকটা আমার ক্লাবে এসেছিলো! তখন শালা কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কে, না হলে তখনই কেলিয়ে দিতাম! হাত পা ভেঙে বাড়িতে পড়ে থাকতো, তোমার দাদু অবধি আর যাবার সাহস করতো না!

অদ্বিতীয়া সুমনের কথায় প্রায় আঁতকে উঠলো, ভয়ার্ত গলায় বললো,

লোকটা তোমার ক্লাবে খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলো! তার মানে তো ও তোমাকে চিনে ফেলেছে! সর্বনাশ! এবার কি হবে!

কি আবার হবে! তুমি বনেদী পাত্রের গলায় ঝুলে পড়বে দাদুর কথায়! আর কি!

সুমনের কথায় অদ্বিতীয়া বিরক্ত হলো,

সব সময় ইয়ার্কি মেরো না তো! আর এখন আমি না ফোন করা পর্যন্ত দেখা তো দূরের কথা ফোনও করবে না আমাকে! ছোটো মাও এটাই বলতে বলেছে তোমাকে!

এবার সুমন একটু গম্ভীর হলো, সরলার মতামত কে সে যথেষ্টই গুরুত্ব দিতো, সেও এই কথা বলেছে শুনে সে রাজি হলো,

ঠিক আছে! কাকিমা বোধহয় ঠিকই বলেছেন, তুমি পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে ফোন কোরো আমায়। আমি আপাতত যোগাযোগ করবো না আর।

অদ্বিতীয়া ফোন নামিয়ে রাখার পরে সুমন নিজের ঘরে ঢুকে এলো, ঘরটা যদিও তার একার নয়, দাদার সঙ্গে একসাথে থাকে সে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে থাকার জায়গার তাদের বেশ অভাব, ঘর মাত্র দুটো, একটায় সে আর দাদা, অন্য ঘরে বাবা মার সঙ্গে বোন। দাদার বিয়ে অনেকটা ঘরের অভাবেই আটকে ছিলো এতদিন, সামান্য চাকরি করা দাদার পক্ষে আলাদা ঘর তৈরি করে নেওয়াটা কষ্ট সাপেক্ষ ছিলো বেশ। ইদানিং সুমনের হাত ধরে তাদের পরিবারের হাল ফিরতে শুরু করেছিলো, পুরনো বাড়ি মেরামতের সঙ্গে সঙ্গেই দোতলা তৈরির কাজও শুরু হয়েছিলো।

যে পাড়ায় সুমনের বসবাস সেটা মূলত মধ্যবিত্তের, উচ্চবিত্তের সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। এতকাল খেলাধুলা নিয়ে পড়ে থাকা সুমন তাদের কাছে খুব সাধারণ হলেও ইদানিং তার বড়ো ক্লাবে সুযোগ পাওয়া এবং খবরের কাগজে তার মাঝে মধ্যেই ছবি বেরোনো তাকে হটাৎ করেই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিলো। অনেকটা সেই কারণেই ইদানিং সে পাত্র হিসেবেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিলো ক্রমশ। তাদের হটাৎ ওঠা দোতলা বাড়ি, ক্লাবের পাঠানো গাড়ি থেকে নেমে আসা সুমন ইত্যাদি, কিছুটা হলেও পাড়ায় সমাদর বাড়াচ্ছিলো তাদের।

অনেকটা এই কারণেই আজকাল ছেলের সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠছিলেন তার বাবা মাও। ছেলে কে তার বোনের বান্ধবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দেখে আজ পেছনে পেছনে সুমনের মাও ঘরে ঢুকে এলেন, একটু রাগের গলায় বললেন,

এই, তোর সোমার বন্ধুর সঙ্গে কি কথা থাকে রে? প্রায় দিন দেখি ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে তুই কথা বলিস!

সুমন বিরক্তি নিয়ে তাকালো, সে কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই সোমা ঘরে ঢুকে এলো, মায়ের ওপরে তার বরাবরের রাগ, মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

তাতে তোমার কি? ছোড়দা কার সঙ্গে কথা বলবে সেটাও তুমি ঠিক করবে নাকি? ও অদ্বিতীয়া কে চেনে, আগে হোস্টেলে দেখেছে তাই কথা বলে! তাতে তোমার অসুবিধাটা কোথায়?

সোমার মা বিরক্ত হলেন, যে অদ্বিতীয়া কে তিনি নিজেও আগে মেয়ের বড়লোক বন্ধু হিসেবে পছন্দ করতেন ইদানিং তাকে ছেলের সঙ্গে কথা বলতে দেখে তাঁর সন্দেহ জাগছিলো। ইদানিং তাঁরা কর্তা গিন্নিতে ছেলের বিয়ে নিয়ে অনেক পাওনা গন্ডার আশা করতে লেগেছিলেন। পাছে তাঁর পাত্র হিসেবে লোভনীয় ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করে ফেলে তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায় সেই চিন্তায় তিনি চিন্তিত ছিলেন, রাগের গলায় ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

চেনে তো কি হয়েছে! চিনলেই কথা বলতে হবে নাকি! যত্ত সব ছেলে ধরা মেয়ে! যেই নামডাক হয়েছে দেখেছে, অমনি গলায় ঝুলে পড়তে চাইছে!আর কোনোদিনও তোকে ওর সঙ্গে কথা বলতে যেনো না দেখি!

সুমন ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকালো, জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে বললো,

কাকে ছেলে ধরা মেয়ে বললে? অদ্বিতীয়া কে? তোমার কোনো ধারণা আছে ওদের বাড়ি সম্পর্কে? আমাদের এক হাটে কিনে অন্য হাটে বেচতে পারে ওরা! জানো সেটা? ও তোমার ছেলের গলায় ঝুলে পড়তে চাইছে না, ওর গলায় ঝুলে পড়ার জন্যে অনেক ছেলে রেডি হয়ে আছে! যত্ত সব ফালতু কথা! যাও তো এখান থেকে! বিরক্ত কোরো না এখন!

সুমনের মা ক্ষিপ্ত হলো, মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

হ্যাঁ, আমি তো ফালতু কথাই বলি! তোমরা যা খুশি করে বেড়াবে, আর আমি বললেই দোষ! একজন ফুটবল খেলে ধরা কে সরা জ্ঞান করছেন, আর একজন কলেজের নামে অন্য কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছেন! কালই তরুণের মা কতো কথা শোনালো! ওই তো ছেলে, বুড়ো ভাম! দু পয়সা রোজগারের মুরোদ নাই, তার পেছনে নাকি আমি আমার মেয়ে কে লাগিয়ে রেখেছি।

সুমন ধপ করে খাটে বসে পড়লো, মা কে শুনিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,

তরুণ কি একটা চাকরি পেয়েছে শুনলাম! গৌর বলছিলো কাল বিকেলে, ও নাকি গৌর কে বলেছে!

সোমা মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো, পেছন থেকে মায়ের রাগত গলা শোনা গেলো,

ঝাঁটা মারি ওই চাকরির মুখে! কালই তো শুনলাম, কোন কারখানায় নাকি পেয়েছে! কতো পয়সা ওতে? বিয়ে করে বউ কে খাওয়াতে পারবে? তাতেই মায়ের কতো বড়ো বড়ো কথা! যেনো আমার মেয়ে ওর ছেলের গলায় ঝুলতে গেছে!

সুমন মুচকি হাসলো,

তোমার বড়ো ছেলে কতো রোজগার করে? তরুণের মতোই তো! তাহলে তার বিয়ে দিচ্ছ কেনো? বউ কে খাওয়াতে পারবে?

ছেলের দিকে রাগের চোখে তাকিয়ে মা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সোমা ভেতরে ঢুকে এলো,

ছোড়দা! কি দিলি!

সুমন চোখ বড়ো করলো, বোনের দিকে তাকিয়ে দাদা সুলভ গাম্ভীর্যে বললো,

তাই বলে তরুণ কে কিন্তু আমার একটুও পছন্দ নয়! গৌর বলছিলো শালা ইদানিং মদের ঠেকে বসছে! কথাটা কিন্তু সত্যি! আমি খবর নিয়েছি, ওর থেকে দূরে থাক! আগেও তোকে বলেছিলাম, তুই শুনিস নি কিন্তু!

সোমা ঘাড় নাড়লো,

মনে আছে! বড়দাও বলেছে! আমি ওর সঙ্গে মিশিনা আর! কোথাও গেলে তো পয়সা লাগতো! হেঁটে কলেজ বলে মা এক পয়সাও হাতে ঠেকায় না! পয়সা তো তোর কাছেই চাইতাম, তুই জানতেই পারতিস তাহলে!

সুমন উঠে গেলো, বোনের দিকে তাকিয়ে বলে গেলো,

মনে রাখিস সেটা!

দাদা বেরিয়ে যেতেই সোমা মুচকি হাসলো, টাকা পয়সা ইদানিং ও অদ্বিতীয়ার কাছ থেকেই নেয়, বাড়ির কারোর কাছে চাইতে হয় না!

অদ্বিতীয়া আজ ভয়ে ভয়েই বাড়িতে ঢুকলো, লোকটা সুমনের ক্লাবে গিয়েছিলো এটা জানার পর থেকেই তার বুকের ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে ছিলো। পা টিপে টিপে সে যখন দাদুর ঘরের পাশ দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলো, তখন সরযূ তাকে লক্ষ্য করলেন, নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে স্বামী কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

এই যে তোমার নাতনি এলো! তুমি যেনো খেলা নিয়ে তার সঙ্গে কি কথা বলবে বলছিলে?

খেলা নিয়ে কথা! অদ্বিতীয়া থমকে দাঁড়ালো, ভেতরে ভেতরেই নিজের কাঁপুনি টের পেতে লাগলো সে। প্রতাপ সান্যাল ঘরের ভেতর থেকে ডাক দিলেন,

দিদিভাই! ঘরে এসো!

কাঁচুমাচু মুখে পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো অদ্বিতীয়া, একগুচ্ছ ধেয়ে আসা প্রশ্নবাণ কি ভাবে সে সামলাবে মনে মনে ভেবে ওঠার আগেই দাদুভাই এর নরম গলার স্বরে চমকে গেলো সে,

তুমি ফুটবল খেলা ভালোবাসো বুঝি? কোনোদিনও বলো নি তো আমাকে!

আক্রমণ ঠিক কোন দিক থেকে আসতে পারে বুঝতে না পেরে অদ্বিতীয়া ঘাড় নাড়লো,

না তো দাদুভাই!

প্রতাপ সান্যাল মৃদু হাসলেন, নাতনির দিকে বরাভয়ের দৃষ্টিতে তাকালেন,

আহা! ভয়ের কি আছে! আমি কি তোমাকে খেলা শুনতে বারণ করেছি নাকি! খেলার খবর রাখা তো খুব ভালো! আমি, তোমার কাকা দুজনেই তো মেম্বার আমাদের ক্লাবের। আমরা তো মাঠে যাই, রেডিও তে শুনি। তুমি ইচ্ছে করলে আমার ঘরে যে ছোটো রেডিওটা আছে ওটা তোমার ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখতে পারো, খেলা যখন হবে তখন চালিয়ে শুনবে! শুধু একটাই কথা মাঠে যেও না কখনো, ওটা আমাদের বাড়ির মেয়েদের শোভা পায় না!

অদ্বিতীয়া হতবুদ্ধি হয়ে গেলো,

আমি খেলা শুনলে তোমার আপত্তি নেই দাদুভাই!

সান্যাল মশাই মাথা নাড়লেন,

না, না, আমাদের গর্বের ক্লাব! কতদিনের পুরনো! কতো ঐতিহ্য তার! খেলা তো শুনবেই! ইদানিং তো ভালোই খেলছে, একটা নতুন ছেলে সই করেছে! আজ তো ওই জলখাবারের মালিক মনোজই বলছিলো! তবে ওর মুখে একটা কথা শুনলাম দিদিভাই! ওই ছেলেটার নাকি তুমি ভক্ত! ওর সঙ্গেই কাল মনোজের রেষ্টুরেন্টে গিয়েছিলে! এটা ঠিক আমাদের বাড়ির মেয়েদের মতো আচরণ হলো না! তোমার ওর খেলা ভালো লাগতে পারে, তবে ওই জন্যে গিয়ে হামলে পড়লে ভালো দেখায় না! ভবিষ্যতে আর কোনোদিনও এটা কোরো না!

ওকে দাদুভাই সুমনের ফ্যান ভেবেছেন! উফফ! কি শান্তি! অদ্বিতীয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ভাই ঝির পেছন পেছন সুকান্তও উঠে এসেছিলেন ওপরে, এতক্ষন ধরে বাবার কথা শুনছিলেন তিনিও, এবার মুচকি হেসে বললেন,

তোর খেলা দেখতে ভালো লাগে? আগে বলিস নি কেনো আমাকে? এখন তো শুনি টেলিভিশনে খেলা সম্প্রচার হয়! অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম একটা টিভি কিনবো! ভালোই তো! আমারও ইদানিং আর মাঠে যাওয়া হয়ে ওঠে না, দুজনে মিলে বাড়িতে বসেই দেখবো না হয়।

সান্যাল মশাইও সম্মতি দিলেন,

কেনো, কেনো! নতুন ছেলেটা ভালো খেলছে শুনলাম! মনোজ বললো ওরা নিয়ে নেবে! তার আগে একবার আমাদের হয়ে খেলতে দেখে নি তাকে!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ২৮
দেখতে দেখতে অদ্বিতীয়ার কলেজের প্রথম বছর শেষ হয়ে গেলো, ইতিমধ্যে সুমনের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট হচ্ছিলো। প্রতাপ সান্যালের কড়া নজর কে এড়িয়ে কি করে যোগাযোগ রাখা যায়, তার বিভিন্ন রকম পদ্ধতি বার করতে করতে ক্রমশ পোক্ত হচ্ছিলো অদ্বিতীয়া এবং সুমন দুজনেই। সুমনদের নতুন বাড়ি তৈরি শেষ হয়েছিলো বেশ কিছুদিন আগেই, ছোটো ভাইয়ের খেলোয়াড় পরিচয়ের সূত্রে তার দাদার পাত্রীও জুটে গিয়েছিলো খুব শীঘ্রই। সেই বিয়ে উপলক্ষ্যে কি করে অদ্বিতীয়া কে তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা যায়, সেই নিয়েই সোমা এবং সুমনের মধ্যে বিভিন্ন শলা পরামর্শ চলছিলো বেশ কিছুদিন ধরেই।

অদ্বিতীয়া নিজেও ইচ্ছুক ছিলো এই বিয়ে বাড়ীতে আসতে, কিন্তু দাদুর নজর এড়িয়ে দিনের বেলায় কলেজ থেকে সুমনের সঙ্গে দেখা করা আর রাতে বাড়ি থেকে লুকিয়ে বিয়ে বাড়িতে আসা দুটো এক ছিলো না। অগত্যা শেষ উপায় হিসেবে সে তার ছোটো মায়ের দ্বারস্থ হলো, বিকেলে যখন ছোটো মার খোঁজ করতে করতে অদ্বিতীয়া ছাদে এসে পৌঁছালো তখন সরলা শুকনো জামা কাপড় ছাদ থেকে তুলছিলো, অদ্বিতীয়া মিনতির গলায় বললো,

ছোটো মা! প্লিজ কিছু ব্যবস্থা করে দাও! সোমার দাদার বিয়েতে যাবো আমি!

সরলা চমকে তাকালো,

সুমনদের বাড়ি! ওরে বাবা! আমি পারবো না! বাবা জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবেন!

অদ্বিতীয়া হতাশ হলো, এই প্রথম বার ছোটো মার কাছ থেকেও কোনো সাহায্য না পেয়ে তার বন্ধুর দাদার বিয়েতে যাওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো। অদ্বিতীয়ার করুন মুখ সরলাকেও দুঃখ দিলো, কিছুক্ষন ভাবার পর বললো,

তুমি বরং একটা কাজ করো পিয়া, ছোড়দার কাছে বলো, তিনি বললে বাবা না বলতে পারবেন না।

অদ্বিতীয়ার আর দেরি সই ছিলো না, সন্ধ্যেয় সুকান্ত বাড়ি ফেরার কিছুক্ষনের মধ্যেই সে কাকার ঘরে উপস্থিত হলো,

ছোট কা! একটা কথা বলি?

সুকান্ত হাত মুখ ধুয়ে খাটে হেলান দিয়ে আরাম করে বসেছিলেন, ভাই ঝির কথায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালেন,

আমার সেই হোস্টেলে একটা সোমা নামে বন্ধু ছিলো, মনে আছে তোমার? তার দাদার বিয়ে! আমাকে অনেকবার করে যেতে বলেছে, যাবো ছোট কা?

কাকা কে তার দিকে তাকাতে দেখেই তড়িঘড়ি বললো অদ্বিতীয়া, সুকান্ত একটু অন্য মনস্ক হলেন,

সোমা! সেই মেয়েটি না, যাকে আমরা গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম? সঙ্গে তো দাদাও ছিলো বোধহয়?

অদ্বিতীয়া ঢোক গিললো, ছোট কার সুমনের কথা মনে আছে! একটু ইতস্তত করে বললো,

হ্যাঁ, সেই সোমা! ওরই দাদার বিয়ে!

সুকান্ত অবাক হলেন একটু,

তোর সঙ্গে যোগাযোগ আছে নাকি? জানতাম না তো! ও তো অন্য কলেজে পড়ে, তাই না?

অদ্বিতীয়া ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো, মুখে বেশি কথা না বলাই ভালো, তাতে যে কোনো সময় সুমনের প্রসঙ্গ উঠতে পারে। ইতিমধ্যে হাতে জলখাবারের থালা নিয়ে সরলা পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলো, তাকে দেখেই অদ্বিতীয়া তাড়াতাড়ি আঙুল তুলে ছোটো মায়ের দিকে দেখালো,

আমি ছোটো মা কে বলেছিলাম, ছোটো মা বললো তোমাকে বলতে, দাদুভাই যেতে দেবেন না!

সুকান্ত কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন,

ঠিক আছে! আমি বাবার সঙ্গে কথা বলে দেখি! তুই যা এখন, পড়তে বোস!

একটু হতাশ হয়েই ঘর ছাড়লো অদ্বিতীয়া, স্মৃতি শক্তি যে ছোট কার যথেষ্টই প্রখর, তা তার জানা ছিলো, তিনি সুমন কে মনে রেখেছেন নিশ্চয়ই! সোমার বড়দার বিয়েতে তার যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ক্ষীণ হয়ে আসছিলো। ভাই ঝি বেরিয়ে যাওয়ার পরে সুকান্ত সরলার দিকে তাকালেন,

সোমার দাদাই তো সম্ভবত সেই ছেলেটি তাই না বৌদি? এর সঙ্গেই তো পিয়া জড়িয়ে পড়েছিলো হোস্টেলে? তার বিয়েতেই যেতে চাইছে!

সরলা তাড়াতাড়ি ঘাড় নাড়লো,

না, না, ছোড়দা! এ সে নয়! এটা সোমার বড় দাদা! তারই বিয়ে!

সুকান্ত ঘাড় কাত করলেন,

ওহ! আচ্ছা! আমি তো অবাক হচ্ছিলাম! ওই ছোট দাদা তো তারমানে ওখানেই থাকবে! যেতে দেওয়া উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছি না বৌদি!

সরলা মৃদু হাসলো,

এই ভাবে কিছু আটকানো যায় না ছোড়দা! এখন তো পিয়া বড়ো হয়েছে, নিজের ভালো, মন্দ বোঝার ক্ষমতাও হয়েছে! শুধু ওই ছেলেটির সঙ্গে দেখা হওয়া না হয় বিয়েতে না যেতে দিলে আটকে যাবে, কিন্তু কলেজেও তো কতো ছেলে আছে! কতো লোক কে আটকাবেন? তার চেয়ে ওকে নিজেকেই নিজের ভালো বুঝতে দিন! দশটা মানুষের সঙ্গে মিশবে, তবেই তো ভালো মন্দের ফারাক করতে পারবে!

সুকান্ত সম্মত হলেন,

হ্যাঁ, এটা আপনি ঠিকই বলেছেন বৌদি! যাক তাহলে, ঘুরেই আসুক একটু!

সেদিন রাতেই খেতে বসে সুকান্ত বাবার কাছে ভাইঝির বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুললেন, শুধু সযতনে সুমনের কথা এড়িয়ে গেলেন। প্রতাপ সান্যাল যথারীতি অবাক হলেন,

বন্ধুর দাদার বিয়েতে যাবে! আমার বাড়ির মেয়ে! কি যে বলো! কলেজে তো প্রতিদিন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়, আবার তার বাড়িতে যাওয়ার কি আছে!

সুকান্ত বুঝলেন বাবা ভুল বুঝছেন, তিনি সম্ভবত পিয়ার কলেজের কোনো বন্ধুর দাদার বিয়ে বলে ভেবেছেন। তিনি বাবার ভুল ভাঙানোর কোনো চেষ্টা করলেন না, বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,

আহা! কলেজে দেখা হওয়া, আর বিয়ে বাড়ি এক হলো? যাক না! ঘুরে আসুক একটু!

সান্যাল মশাই বিরক্ত হলেন,

তোমার আর বোধ হবে না কখনো! লোকে কি বলবে! ওখানে দশটা লোক আসবে, হুল্লোড় হবে, কি না কি তাদের পরিবার, তাও জানা নেই! এরকম জায়গায় আমাদের বাড়ির মেয়েরা একা যায় নাকি!

সুকান্ত খেতে খেতেই মাথা নাড়লেন,

না, না, একা যাবে কেনো? আমিই পৌঁছে দেবো, আবার গিয়ে নিয়ে আসবো। কতক্ষনই বা থাকবে, খুব বেশি হলে ঘণ্টা দুয়েক! আর পরিবার কেমন সে জেনে কি আর বন্ধুত্ব হয় নাকি! ওখানে সব বন্ধুরা যাবে, ও ও যাবে! কতো নিমন্ত্রিত আসবে, সবাই কি আর এক রকম হয়!

প্রতাপ বাবু নিমরাজি হলেন,

এসব আমার পছন্দ নয়! তোমরা যে কি আধুনিক হচ্ছ! যাক গে! কি আর করা! তোমার দায়িত্বে ছাড়লাম, পরে যেনো কোনো সমস্যা না হয়! অবিবাহিতা বনেদি বাড়ির মেয়েরা এরকম কোনো বিয়ে বাড়িতে একা যায় নাকি!

সরযূ পাশ থেকে ফুট কাটলেন,

সবে তো কলির সন্ধ্যে! এই তো বন্ধুর দাদার বিয়ে দিয়ে শুরু হলো, এবার এক এক করে সব বন্ধুদের বিয়ে আসবে! বাঁধা গরু ছাড়া পেলো এইবার, আর বেঁধে রাখতে পারবে না তুমি!

সরলা শাশুড়ি কে থামালো,

মেয়ে যখন কলেজে পড়ছে তখন বন্ধু তো হবেই! তাদের আত্মীয় স্বজনও থাকবে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণও থাকবে! এগুলো তো মেনে নিতেই হবে!

সরযূ কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সান্যাল মশাই ঘাড় নাড়লেন,

না, বৌমা! এই কথাটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়! আমার মামার বাড়ি, মাসীর বাড়ির দিকের আত্মীয় স্বজনদের মেয়ে তো কম নেই, তারাও কলেজে গিয়েছে, তাই বলে তারা কেউ বন্ধুদের বাড়ি বিয়ের নিমন্ত্রিত হয়ে যায় নি! সব সময় মেলা মেশায় একটা সমতা বজায় রাখতে হয়! সেটা ওকে বুঝতে হবে! সবাই যদি এক হয় তাহলে সান্যাল বাড়ির মেয়ের সঙ্গে আর তাদের পার্থক্য কোথায়? এবারের মতো যাচ্ছে যাক, কিন্তু ভবিষ্যতে আর কোনো দিনও যেনো না যায়!

যেহেতু বিরক্ত হলেও অনুমতি দিলেন প্রতাপ সান্যাল, তাই এতো কথার উত্তরেও উপস্থিত সবাই নীরবতা বজায় রাখলো, অদ্বিতীয়ার মনের মধ্যে আনন্দ হলেও মুখে প্রকাশ করলো না সেও। সরযূ খুশি হলেন, স্বামী তাঁর হয়ে কথা বলেছেন অনেক দিন পরে!

বড়ো বড়ো কালো কালো একসার ছাতা সরু গলিটার সামনে ঝুলিয়ে রাখা থাকে সব সময়, তাই নাম ছাতা গলি। ছাতা তৈরির কারখানাটা গলিটার প্রায় পুরোটা জুড়েই, একে অন্ধকার সরু গলি, তায় ছাতায় ঢাকা, ইদানিং এই পথটাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে হচ্ছে রতনের।

পিসির বাড়ি থেকে চলে এসেছে প্রায় বছর ঘুরতে চললো, কিন্তু প্রতাপ সান্যালের লোক যে তাকে এক দিনের জন্যেও চোখের আড়াল করেনি, সেটা মাঝে মধ্যেই টের পায় রতন। পথে ঘাটে মাঝে মধ্যেই চেনা, অচেনা মানুষজন তার সাথে যেচে আলাপ করতে আসে। মনের মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কা কাজ করে সব সময়, এখন কে যে পিসেমশাই এর লোক আর কে সাধারণ, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা রতন।

বেশ কিছুদিন যাবৎ তাই একটু ঘুরপথ হলেও এই গলিটাই যাতায়াতের জন্যে ব্যবহার করছে রতন, গলিটা দিয়ে বেরিয়ে মাঝের চওড়া রাস্তাটা পেরোতে পারলেই উল্টোদিকের আরেকটা সরু গলি সোজা শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে যায়। ঠিক স্টেশনের পেছন দিকের একটা ঘুপচি এলাকায় আশার খোঁজ পেয়েছে রতন, খোঁজটা মদের ঠেকের এক বন্ধুই দিয়েছিলো। সেই বন্ধুদেরও সান্যাল বাড়ির ওপরে রাগ কম নেই, তাদের রাগ অবশ্য সরলার ওপরেই, সেই তাদের সান্যাল বাড়ির মদের সান্ধ্য আড্ডা বন্ধ করেছে।

বেশ বছর খানেক ধরেই ঘুঁটি সাজাচ্ছিলো রতন, নেহাত তারা মা ব্যাটায় সান্যাল বাড়িতে ঘরবন্দী ছিলো তাই, নাহলে এতদিনে প্রতাপ সান্যালের সর্বনাশ সে করে ফেলতো কবেই! ও বাড়ি থেকে বেরিয়েই সে আশার খোঁজ খবর শুরু করেছিলো, আশাই তার তুরুপের তাস, সান্যালদের সমস্ত অপকর্মের একমাত্র জীবিত সাক্ষী! এর আগের সবাইকেই মোটামুটি প্রতাপ সান্যাল সরিয়ে ফেলেছিলেন, নেহাৎ বউয়ের মূর্খামির জন্যেই আশা হাত ফস্কে বেরিয়ে গিয়েছে। ছেলের বউ কে জব্দ করতে গিয়ে সরযূ আশা কে ঘর থেকে হটাৎ না বার করে দিলে সে আজ সান্যাল বাড়ির চোখের সামনেই থাকতো। যেমন রতন কে প্রতি মুহূর্তে চোখে চোখে রেখেই প্রায় আধমরা করে দিয়েছেন প্রতাপ সান্যাল, রাতে ঘুমের মধ্যেও চমকে চমকে ওঠে সে, ঠিক তেমনই আশার ক্ষেত্রেও ঘটতো। নেহাত বরাত জোরে ওই বাড়ি থেকে বেরোতে পেরেছিলো আশা, সেই থেকেই ওই পাড়ার ধারে পাশেও দেখা যায়না তাকে।

প্রতাপ সান্যাল তার খোঁজ চালাচ্ছিলেন, সঙ্গে রতনও, কিন্তু সান্যাল মশাইয়ের থেকে রতনের সুবিধাটা ছিলো অনেকটাই আলাদা। রতন তার মদের ঠেকের সৌজন্যে যাদের কাছে পৌঁছে যেতে পারতো, তাদের কাছে পৌঁছানোর লোক প্রতাপ সান্যালের একটু কমই ছিলো। সেই সূত্রেই আশার খোঁজ পেয়েছিলো রতন, দুদিন এই রাস্তা ধরেই সে ইতিমধ্যেই আশার বাড়িতে ঘুরে এসেছে। প্রথম দিন বাড়ি তালা বন্ধ পেলেও দ্বিতীয় দিন সে আশার সন্ধান পেয়েছিলো, কিন্তু ধুরন্ধর আশা মুখ খোলে নি। যদিও রতন হাল ছাড়ে নি, আজ আবার সেই উদ্দেশ্যেই তার আশার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া!

গলিগুলো দ্রুত পায়ে হেঁটে হেঁটে শিয়ালদহ স্টেশনের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রোগা মতো লোকটা কে দেখতে পেলো রতন, আগের দিনের মতোই একটা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গত দুদিন ধরে লোকটা কে একই জায়গায় লক্ষ্য করার সঙ্গে সঙ্গেই আজ রতন সতর্ক হলো, গত কয়েক বছর ধরে প্রতাপ সান্যালের কাজকর্ম দেখার পরে এসব বিষয়ে এখন যথেষ্টই সতর্ক হয়েছে সে। এদিক ওদিক তাকিয়ে উল্টো দিকের একটা ছোটো গলি তে অহেতুক খানিকক্ষন ঘুরপাক খেয়ে সে যখন আশার বাড়ির সামনে পৌঁছলো তখন সূর্য অস্ত গিয়েছে। প্রায় অন্ধকার গলিতে এদিক ওদিক কুপি জ্বলছে দু একটা, ঘুপচি ঘরগুলোর একটাতে গিয়ে দাঁড়ালো রতন, দরজার বাইরে থেকে নিচু গলায় আশার নাম ধরে ডাকার কিছুক্ষন পরে হাতে একটা কুপি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো আশা, রতন কে সামনে দেখেই তার মুখ গম্ভীর হলো,

আপনি আবার এয়েচেন দাদাবাবু! আমি তো বলেছি আমি কিছু জানি না!

রতন একটু হাসলো, গলার স্বর যতটা সম্ভব মোলায়েম করে বললো,

তুই কি জানিস আর কি জানিস না, সেসব আমি জানি আশা! মায়ার মরার সব খবর আমার কাছে আছে! আগের বউয়ের বাচ্চা খসানোর জন্যে তুই কি করেছিলি সেও আমি জানি!

আশা নির্বিকার মুখে রতনের দিকে তাকালো, কুপিটা তুলে ধরে মুচকি হেসে বললো,

তা ভালো তো! জানেন যখন, তখন পুলিশের কাচে যান! একেনে কেনো? আসেন একন দাদাবাবু, রাত হচ্ছে, আমার রাজ্যের কাজ বাকি পড়ে আছে!

রতন দমলো না, গলাটা আশার প্রায় মুখের কাছে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বললো,

কিন্তু তুই এমন অনেক কিছু জানিস না, যা আমি জানি, তোর চলে আসার পরেও আমি অনেকদিন ও বাড়িতে ছিলাম! প্রতাপ সান্যাল তোকে গরু খোঁজা করছে আশা! মুখ বন্ধ রেখেও কিন্তু তুই বাঁচতে পারবি না! তোর চেনা জানা অনেক লোক এখনও ও পাড়ায় আছে আমি জানি, খোঁজ নিয়ে দ্যাখ তাদের কাছে! জনে জনে খবর নিচ্ছে সান্যাল বুড়ো, সব্বাই জানে! আমার কথা তোকে বিশ্বাস করতে হবে না, তুই নিজে খবর নে! যদি সত্যি বলেছি বলে জানতে পারিস, তখন না হয় আমার সঙ্গে দেখা করিস!

এবার আশা একটু থমকালো, কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে রতনের দিকে তাকিয়ে বললো,

এতে আপনার লাভ কি দাদাবাবু? আপনি আমাকে বাঁচাতে চাইছেন কেনো?

রতন মাথা নাড়লো,

তোর লাভেই আমার লাভ আশা! শত্রুর শত্রু যে বন্ধু হয় জানিস না সেটা? তুই, আমি দুজনেই অনেক কিছু জানি, তাই মরলে দুজনেই মরবো আর বাঁচলে দুজনেই বাঁচবো! দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আশা, আর সারাক্ষন মরার ভয় নিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে না। এবার হয় এসপার না হয় ওসপার!

কি করবেন দাদাবাবু? পুলিশের কাছে যাবেন? ওতে কিছু হবে না! আপনি বড়ো লোক পয়সার অভাব নেই, আপনার কিছু হবে না, কিন্তু আমি বিপদে পড়ে যাবো দাদা বাবু! তাছাড়া সান্যাল দের নুন খেয়েছি, বেইমানি করতে পারবো না!

নুন খেয়েছিস!! তা তারা সেটা মনে রেখেছে? প্রতাপ সান্যাল তো তোকে মারবে বলে উঠে পড়ে লেগেছে রে!

আশার কথার উত্তরে বিদ্রুপের গলায় বললো রতন, আশা মাথা নাড়লো,

না, দাদাবাবু, আপনি বাড়ি যান, আর কখনো আসবেন না!

রতন মাথা নাড়লো, হতাশ গলায় বললো,

তোর মরাটা আর ঠেকাতে পারলাম না রে আশা! কি আর করা! চেষ্টা করেছিলাম, হলো না! পরে বলিস না, তোকে সাবধান করিনি! আসি!

রতন দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে আশা ভেঙে পড়া বাড়িটার ভাঙা দরজাটাই শক্ত করে বন্ধ করার চেষ্টা করলো। কুপিটা কাঁপা কাঁপা হাতে নিচে নামিয়ে রেখে মাটিতে বসে পড়ে দু হাতে মুখ ঢাকলো, সান্যাল মশাই কে আশা চেনে! দিন কি তবে ঘনিয়ে এলো তার!
ক্রমশ