#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৩৮
কারখানার কাজের শেষে সন্ধ্যে নাগাদ ক্লাবের পাশের রাস্তাটায় পৌঁছতেই তরুণ কে ঘিরে ধরলো গোটা চারেক ছেলে, এদের সবাইকেই তরুণ চেনে। প্রত্যেকেই ক্লাবের মেম্বার এবং সোমার দাদা সুমনের বন্ধু, ওদের মধ্যে থেকে গৌর এগিয়ে এলো,
ওই! এদিকে শোন! বহুত বাড় বেড়েছে তোর তাই না? কতোদিন বলেছি তোকে সুমনের বোনের পেছনে ঘুরবি না?
তরুণ কোনো উত্তর দিলো না, এই মুহূর্তে চারটে ছেলের সঙ্গে তর্কে জড়াতে যাওয়া যে বৃথা এটা বুঝেই সে চুপ করে গৌরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তরুণকে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে গৌরের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। বন্ধুমহলে গৌরের রগচটা বলে একটা দুর্নাম আছে বরাবরই, সে ধৈর্য্য রাখতে না পেরে ফুল হাতা শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে তরুণের দিকে এগিয়ে গেলো,
শালা! মালটা তাকিয়ে আছে দেখো, ভাজা মাছ উলটে খেতে জানেনা! মাতাল কোথাকার! অনেকদিন তোকে ভালো মুখে বলেছি, তবু ওর কলেজের গেটে ঘুর ঘুর করিস কেনো? আজ তোকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম মনে রাখিস! এরপরের দিন কিন্তু মুখে কোনো কথা বলবো না, যা করবো সব হাতে!
গৌর তরুণের থেকে বেশ খানিকটা ছোটো, তার মুখ থেকে এতো কথা শুনতে শুনতে তরুণও এবার ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললো,
কি করবি? মারবি নাকি? বলে দিস সুমন কে, ওর বোন কে আমি ভালোবাসি, ক্ষমতা থাকলে আটকে দেখাক!
কি বললি? ভা.. লো..বা.. সিস? এমন ক্যালাবো না, ওই ভালোবাসা পেছনের জানলা দিয়ে পালিয়ে যাবে!
বলতে বলতেই সজোরে তরুণের মুখে একটা ঘুষি চালিয়ে দিলো মারার অজুহাত খুঁজতে থাকা গৌর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাকি তিনজন এগিয়ে এলো, বেশ কিছুক্ষন এলোপাথাড়ি চড় ঘুষি চলার পরে আরেক প্রস্থ তরুণ কে শাসিয়ে গৌর তার দলবল নিয়ে চলে যাবার পরে তরুণ ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে আসা রক্ত মুছতে মুছতে দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়ালো। হাতের মুঠো শক্ত করে মনে মনে বলল,
তোর বোন কে নিয়ে পালাবোই শালা! দেখি তুই কি করতে পারিস!
রাত প্রায় নটা, রথীন সান্যালের এটা খাওয়ার সময়, এসব ব্যাপারে তিনি একদম সাহেবি আদব কায়দা মেনে চলেন। তাঁর সব কিছুই সময় মেপে, ঘড়ির কাঁটার একচুলও এদিক ওদিক হয় না। যতদিন পর্যন্ত বাবা, মা বেঁচেছিলেন, জ্যেঠু প্রতাপ সান্যালের বাড়ির মতোই তাঁদেরও রান্নাঘরের দাওয়ায় পিঁড়ি পেতে বসে খাওয়ার চল ছিল, শ্বশুর, শাশুড়ির মৃত্যুর পরে সুমনা সেসব পাট চুকিয়ে দিয়েছেন। এখন তাঁদের দোতলায় ডিনার টেবিল হয়েছে, বাড়ির চাকর বাকররা একদম ঘড়ির কাঁটা মেপে ঠিক নটায় সেখানে খাবার সাজিয়ে দেয়।
আজ প্রথম বার সেই নিয়মের অন্যথা হলো, নটা পেরিয়ে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষন পরেও যখন সাহেব বেরিয়ে এলেন না, তখন সাহেবের খাস চাকর বৈরাগী, রথীন সান্যালের ঘরের দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো। দু এক মিনিট অপেক্ষার পরে সে সবে মাত্র বন্ধ দরজায় টোকা মারতেই যাচ্ছিলো তখন সুমনা দরজা খুলে বেরিয়ে এলো, তাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই বললো,
টেবিলে আর একটা প্লেট সাজা, আরেকজন সাহেব ডিনারে আসবেন।
কে আসবে জিজ্ঞেস করার সাহস বৈরাগীর ছিলো না, সে তাড়াতাড়ি টেবিল সাজাতে চলে গেলো। কিছুক্ষন পরেই একটা কালো রঙের অ্যাম্বাসেডর রথীন সান্যালের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো, বৈরাগী এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। রথীন সান্যাল আগন্তুক কে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সাদর সম্ভাষণ জানালেন,
ওপরে উঠে আয় শুভঙ্কর, তোর জন্যেই অপেক্ষা করছি!
বহুল প্রচলিত এক নামকরা খবরের কাগজের সম্পাদক শুভঙ্কর, রথীন সান্যালের সহপাঠী এবং ভীষণ কাছের মানুষ। তিনি সোজা দোতলায় উঠে এলেন, চেয়ার টেনে টেবিলে বসতে বসতে সুমনার দিকে তাকিয়ে হাসলেন,
আগে খেয়ে নিই বুঝলে, তারপরে ডিটেইলস দিচ্ছি!
সুমনা মুচকি হাসল,
তোমার খবরের জন্যেই তো বসে আছি শুভঙ্কর দা! আজ পর্যন্ত তোমার বন্ধু কোনোদিনও খাওয়ার সময়ের নড়চড় করেনি! আজ এমন সারপ্রাইজ দিলে যে খেতেও ভুলে গেলো!
খাওয়া শেষ হয়ে গেলো, বৈরাগীর রান্নার উচ্ছসিত প্রশংসা করতে করতে শুভঙ্কর ঘরে ঢুকে এলেন, চেয়ার টেনে আরাম করে গুছিয়ে বসে বন্ধুকে বললেন,
বল এবার কি করতে চাস?
রথীন সান্যাল গম্ভীর হলেন,
তোর ফোন পাওয়া থেকেই ভেবে চলেছি বুঝলি! নতুন রিপোর্টারটা কতোটা ঠিক খবর দিয়েছে বলে তোর মনে হচ্ছে, সেটা আগে বল!
শুভঙ্কর মাথা নাড়লেন,
খবর একদম সঠিক! ছেলেটা নতুন, এখনও পার্মানেন্ট হয়নি, এটা তাই ওর কাছে একটা চ্যালেঞ্জ বলতে পারিস! অনেকদিন ধরেই পেছনে লেগে ছিলো, বেশ বছর খানেক ধরেই তোর জ্যেঠিমার ওই ভাইপোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেছে ভালোই! ভাইপোটা অবশ্য খুব সেয়ানা, কিছুতেই সোর্স বলছে না, সোর্স ছাড়া কিছু করা মুশকিল!
রথীন সান্যাল চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন,
তুই ওই ছেলেটা কে দিয়ে রতন কে চাপ দে, বল সোর্স না বললে কোনো খবর ছাপা সম্ভব নয়, তাতে পরে তোদের কাগজের সমস্যা হতে পারে।
অলরেডি করেছি সেটা, দু একদিনের মধ্যেই খবর দিচ্ছি তোকে, তুই কি করতে চাস সেটা আমি জানতে চাই। আমার কাছে এটা দারুন খবর, কিন্তু তোকে না জানিয়ে ছেপে দিতে চাই না।
বন্ধুর হাতটা দু হাতে চেপে ধরলেন রথীন সান্যাল, গলায় আবেগ এনে বললেন,
জানি সেটা! এই খবরটা যে তোর কাছে কতটা জরুরি সেটাও বুঝি! তবু তোকে বলেই অনুরোধ করছি, অন্য কেউ হলে পারতাম না! এটা আমাদের সান্যাল বংশের সম্মানের ব্যাপার, জ্যেঠু আমাদের বংশের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, কলকাতা শহরের প্রথম সারির কয়েকজন উকিলের মধ্যে একজন, এগুলো একটু ভেবে দেখিস! শুধু জ্যেঠু নন, এতে আমাদের বংশ মর্যাদা জড়িয়ে আছে! আমাদের সম্মান একেবারে মাটিতে মিশে যাবে, ভবিষ্যতে কোনোদিনও আর কারোর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না! তাছাড়া আমার ভাইঝির কথাটাও ভাব একটু, ও যদি জানতে পারে ওর দাদু খুনি, এমনকি ওকেও মারার চেষ্টা করেছেন তিনি, তাহলে ওর মনের মধ্যে কি হবে সেটা বুঝতে নিশ্চয়ই তোর অসুবিধা হচ্ছে না! তোর মেয়েরই বয়সী একটা মেয়ে, ওর জীবনটাও নষ্ট হয়ে যাবে রে!
শুভঙ্কর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
এতো বড়ো বংশ তোদের, এসব কি নোংরামি প্রকাশ্যে আসছে বলতো! নিজের নাতনিকে কেউ মারার চেষ্টা করে! যত শুনছি ততোই অবাক হচ্ছি! কি মানসিকতা এসব!
রথীন তাড়াতাড়ি বন্ধুকে থামিয়ে দিলেন,
না, না, ব্যাপারটা ঠিক তাই নয়! আসলে আমার ভাই মানে জ্যেঠুর বড়ো ছেলে রতিকান্ত কোনোদিনই ভালো ছিলো না, বরাবরের অবাধ্য! জ্যেঠু কম চেষ্টা করেন নি সুপথে ফেরাতে, কিন্তু সেসব বিফলেই গেছে বলতে প্যারিস। প্রথম দিকে অবশ্য চরিত্রের দোষ ছিলো না, ওই বাপের টাকা ওড়ানোতেই ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ ছিলো। তারপরে কিছু মোসাহেব বন্ধু বান্ধব জুটলো, তারাই ওই মদ ধরালো.….
শুধু মদ ধরালো, আর কিছু না? লুকিয়ে রাখতে চাইছিস নিজের বংশের কেচ্ছা?
বিদ্রুপের সুরে বন্ধু কে থামিয়ে দিয়ে বললেন শুভঙ্কর, রথীন ঘাড় নাড়লেন, হতাশ গলায় বললেন,
তোর কাছ থেকে কি আর লুকিয়ে রাখবো বল! এই মুহুর্তে তুই বোধহয় আমার থেকেও বেশি জানিস! তবে এটা সত্যি বলছি বিশ্বাস কর, নিষিদ্ধ পল্লীতে যাওয়ার কথাগুলো রটনাই, ওসব শুধু আমাদের বংশের মান সম্মান ডুবিয়ে নিজের বাবা কে অপমান করার জন্যে ওর নিজেরই রটনা! জ্যেঠু কে ছোটো করে ও যে কি পেয়েছে সারাজীবন, কে জানে!
শুভঙ্কর মুচকি হাসলেন,
তোর আগের ভাই বউ তাহলে সতীলক্ষী মহিলা ছিলেন বলতে চাস?
রথীন মাথা নিচু করলেন, গলায় গাম্ভীর্য এনে বললেন,
তিনি যে কি ছিলেন, সেটা আমরা জানি না বলেই তো অনেকটা বাধ্য হয়েই হয়ত জ্যেঠু কে মেয়েটিকে সরানোর চেষ্টা করতে হয়েছিলো। সেসব অনেক পুরনো কথা, আজ সে বড়ো হয়েছে, জ্যেঠুও সেসব বৈরীতা সরিয়ে রেখে তাকে কাছে টেনে নিয়েছেন! এখন এসব আর আলোচনা করার বা টেনে বার করে আনার কোনো মানে হয় না। তিনি আমার ভাইয়ের স্ত্রী, তাঁকে নিয়ে কুরুচিকর আলোচনা করতে আমার বাধবে শুভঙ্কর। তাছাড়া বহুযুগ আগে মৃত একজন ভদ্রমহিলার চরিত্র বিশ্লেষণ করতে এই মুহূর্তে আমি রাজি নই!
শুভঙ্কর অস্বস্তিতে পড়লেন, তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
আরে না, না! আমারও তোকে অস্বস্তিতে ফেলার কোনো ইচ্ছে ছিলো না! আসলে আমরা সাংবাদিক তো, এসব কেচ্ছা নিয়েই তো কাজ, তাই যেকোনো জিনিসের বড্ড ভেতরে পৌঁছে যাই। আমি সত্যিই লজ্জিত!
রথীন সান্যাল প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললেন, কয়েক মিনিটের মধ্যেই শুভঙ্কর তাঁকে কথা দিলেন যে এসব বিষয় নিয়ে তিনি বেশি দূর এগোবেন না। সোর্সের খবর পেলেই তিনি রথীন কে জানাবেন এই কথা দিয়ে তিনি চলে যাওয়ার পরে সুমনা অবাক গলায় বললো,
কি সাংঘাতিক তোমার জ্যেঠু! দেখলে বোঝা যায় না গো! তুমি জানতে এসব?
রথীন মাথা নাড়লেন, গলায় বিরক্তি এনে বললেন,
জানলে কি আজ এসব আর শুভঙ্কর পর্যন্ত পৌঁছায়? সত্যিই ওই বউ কোথাকার মেয়ে আমার জানা নেই, তাই জ্যেঠুর আমি দোষ দিইনা! যে কেউ তো আর সান্যাল বাড়ির রক্ত হতে পারে না! বাবার রক্ত গায়ে থাকলেই কি সাতখুন মাফ? তাই যদি হয়, তাহলে গোটা সান্যালদের কয়েক পুরুষে এরকম অনেক বংশধর আছে! রতি চিরকালই কেমন যেনো উন্নাসিক ধরনের, কারোর কথার ধার ধারে না! তবে এটা কিন্তু সত্যিই রটনা যে ও ওসব জায়গায় যেত, যদি যেতো তাহলে জ্যেঠুর কাছে ঠিক খবর থাকতো, দু একদিন যাওয়ার পরেই ও ধরা পড়তো। কিন্তু সেসব কিছু না করেই হটাৎ ওই মেয়েটাকে কোথা থেকে যে নিয়ে এলো কে জানে!
সুমনা বিদ্রুপের হাসি হাসলো,
ন্যাকা! তোমার জ্যেঠুর নাকি চারদিকে এতো সোর্স, আর তিনি ছেলে কি করে, কোথায় যায় তার খবর রাখেন নি! এটাও বিশ্বাস করতে হবে?
রথীন বিরক্ত হলেন,
তুমি অহেতুক জটিলতা তৈরি করো সুমনা, এই নেচারটা বদলাও এবার! জ্যেঠু কেনো আমার বাবারও সোর্স কম ছিলো না, আমারও নেই! তারাও তখন খবর দিয়েছিলো যে রতি কখনো ওসব নোংরা পরিবেশে যায়নি, ওর একটাই নেশা ছিলো মদ! তাও ওই বন্ধু বান্ধবদের পাল্লায় পড়ে! শুধু মাত্র বাবা কে অপমানিত করার জন্যেই ও এসব করতো, এমনকি ওই মেয়েটাকেও শুধু ওই কারণেই বিয়ে করেছিলো। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই চূড়ান্ত অশান্তি, অসভ্যতা শুরু করেছিলো ও, এমনকি নিজে বাইরে গিয়ে পড়ে থাকত দিনের পর দিন! বাড়িতে আসতো না! বউটা সত্যি বলতে কি মরে বেঁচেছে!
তাই নাকি! তা কোথায় গিয়ে পড়ে থাকতো? কোনো আশ্রমের সাধু সঙ্গে নাকি?
এবার রথীন সজোরে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন,
বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে মদের আড্ডা বসাতো! দিনের পর দিন মাতলামি করতো! আর কিছু জানার আছে? না থাকলে শুয়ে পড়, অনেক রাত হয়েছে!
সুমনা মুখ বেঁকালো, ঘরের আলো নেভাতে নেভাতে বললো,
এই জ্যেঠুর নাম আমার ছেলের পৈতের কার্ডে আছে ভাবতেই আমার ঘেন্না হচ্ছে!
অন্ধকারের মধ্যেই রথীন এর গলা শোনা গেলো,
তুমি যে জ্যেঠুর নাম কার্ডে ছাপানো নিয়ে এতো কথা বলছো, তাঁর হাত থেকে নেওয়া জমির দলিলটার কথা তো বলছো না একবারও? তুমি তোমার ওই রতির বউয়ের কুড়ি বছর আগের করা অপমান কে ধরে নিয়ে বসে থাকো! এই জন্যেই বলে মেয়েলি বুদ্ধি, তোমার কথা শুনে চলতে গেলে আমার ব্যবসা লাটে উঠবে! এই খবরটা জ্যেঠু কে দিয়ে সাহায্য করতে পারলে আরো কিছু সম্পত্তি তোমার ছেলের হাতে আসবে, বোঝো সেটা?
খবর দিয়ে দিলেই তোমার জ্যেঠু ছেলের নামে আরো কিছু লিখে দেবে? তুমি সেই আনন্দেই বসে থাকো! উনি যা ধুরন্ধর, এক পয়সাও ঠেকাবেন না!
সুমনার বিদ্রুপের উত্তরে রথীন এর গলা কড়া হলো,
শুধু খবর দেবো কেনো? এরপরে যা করতে হয় সেটাও করবো! দরকার হলে ওই সোর্স কে সরানোর চেষ্টাও করতে হবে! এটা শুধু জ্যেঠুর জন্যে নয়, এটা আমার বংশের সম্মানের ব্যাপার! আর জ্যেঠু ভালো করেই জানেন, শুভঙ্করের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কতোটা ঘনিষ্ঠ! এই মুহূর্তে যে ওর কাগজ বাংলায় সবচেয়ে বেশি চলে সেটাও জ্যেঠু জানেন! তাই শুভঙ্কর কে হাতে রাখার জন্যেও ওনাকে আমাকে হাতে রাখতে হবে! তার জন্যে উনি সম্পত্তি ছাড়তেও পিছপা হবেন না! জীবনে সম্মানই যদি না থাকে, তাহলে সম্পত্তি নিয়ে কি ধুয়ে খাবেন?
বাবাহ! ওই তো তোমাদের বংশ! মাতাল, খুনি কোনো কিছু আর বাকি নেই! তাও কতো বড়ো বড়ো কথা!
অন্ধকারের মধ্যেই স্ত্রীর বিদ্রুপের গলা রথীন এর মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলো, তিনি কেটে কেটে বললেন,
আর তোমাদের বংশ? তোমার দিদির ছেলে ঝাড়গ্রামে থাকতে কি করেছিলো? আমি না থাকলে তো ওই আদিবাসী মেয়েটার গ্রামের লোক ওকে পিটিয়ে মেরে দিতো সেদিন! কম পয়সা খরচা করতে হয়েছে ওকে রেপ কেস থেকে বাঁচাতে?
নিজের বংশের আরো কিছু কীর্তিকলাপ বেরিয়ে আসার ভয়ে সুমনা মুখ বন্ধ করল, আর তার কাছ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর এলো না।
ক্রমশ
#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৩৯
পিয়া দিদি তোমার ফোন, বাবু তোমাকে ওনার ঘরে ডাকছেন,
স্নান করতে নিচের স্নানঘরে ঢুকতে ঢুকতে বামুন ঠাকুরকে দেখে তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়ালো অদ্বিতীয়া, দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। সুমন চলে গেছে দিন সাতেক হলো, তাই আপাতত ফোন বাজলেও গুরুত্ব দেয়নি অদ্বিতীয়া, সুমন কে বলা আছে ওকে ফোন না করতে, তাই ফোনটা যে সোমার এটা বুঝতে ওর অসুবিধা হলো না।
হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই সোমার চাপা গলা ভেসে এলো,
অদ্বিতীয়া প্লিজ একটু হেল্প কর! মাকে একটু বলনা তোর সঙ্গে সিনেমায় যাবো! আর শোন না, আমার কিছু টাকা লাগবে, ওই পাঁচশো মতো, একটু কলেজে আসার সময় নিয়ে আসবি প্লিজ!
অদ্বিতীয়া কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই ফোনের ওপারে সোমার গলা শোনা গেলো সে মাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
মা! অদ্বিতীয়া তোমার সঙ্গে কথা বলবে! আজ বিকেলে ও আর আমি সিনেমায় যাবো!
সোমার মা এগিয়ে এলো, মেয়ের কাছ থেকে ফোন নিয়ে বিরক্ত গলায় বললো,
হ্যাঁ, বলো! কি বলবে? সিনেমা? তোমরা দুজনে যাবে নাকি আরো কেউ?
অদ্বিতীয়া পাশেই খাটে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা দাদুর দিকে তাকালো, তারপরে ফোনের রিসিভারের কাছে মুখ নিয়ে গেলো,
না, না কাকিমা আমরাই শুধু!
তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু! বেশি রাত করোনা!
সুমনের কলকাতায় না থাকা মাকে নিশ্চিন্ত করছিলো, তার ছেলে যে সঙ্গে যাবে না এটা জানা থাকায় সে অনুমতি দিতে আপত্তি করলো না। মেয়ের হাতে ফোনের রিসিভার দিয়ে চলে যাবার পরে সোমা নিচু গলায় বলল,
দুটো নাগাদ তোর কলেজের গেটে দাঁড়াবো, টাকাটা নিয়ে আসিস প্লিজ!
ফোন রেখেই দাদুর ঘরের দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালো অদ্বিতীয়া, তার কলেজে বেরোনোর সময় হয়ে আসছিলো। বারান্দায় বেরোতেই সুকান্তর মুখোমুখি হলো সে, সুকান্ত তাকে দেখে অবাক হলেন,
তুই এখনও তৈরি হোস নি! আমার আজ তাড়া আছে! কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলি?
অদ্বিতীয়া ঘাড় হেলাল,
এক্ষুনি হয়ে যাবে ছোট কা, তুমি তৈরি হও না! সোমা ফোন করেছিলো, তাই একটু দেরি হয়ে গেলো।
আজ বেরোতে বেরোতে সত্যিই একটু দেরি হয়ে গেলো, ভাই ঝি যতক্ষনে তৈরি হয়ে নিচে নামলো, ততোক্ষনে সুকান্ত গাড়ি গ্যারেজ থেকে বার করে ফেলেছেন। তাঁর ক্রমাগত হর্নের আওয়াজে প্রতাপ সান্যালও বিরক্ত হলেন, নাতনি কে হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখে গম্ভীর গলায় বললেন,
নিয়মানুবর্তিতা মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস! বন্ধু কে বলবে, ভবিষ্যতে কলেজে বেরোনোর সময় যেনো ফোন না করে!
কলেজের গেটে পৌঁছে অন্য দিনগুলোতে ভাইঝির গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন সুকান্ত, আজ তাঁর সময় ছিলো না। তিনি গাড়ি ঘোরাতে যাবার আগেই অদ্বিতীয়া গাড়ির জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল,
ছোট কা! পাঁচশ টাকা দাওনা প্লিজ! আমার দরকার আছে!
সুকান্ত বিরক্ত হলেন,
পাঁচশ টাকা! এতো টাকা কি করবি? এতক্ষন ধরে গাড়িতে বসে থাকলি তখন বলতে পারলি না? জানিস আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে!
অদ্বিতীয়া ইচ্ছে করেই উত্তর দিলোনা, উত্তর শোনার মতো সময় সুকান্তরও ছিলো না, বিরক্ত মুখে ভাইঝির হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে সুকান্ত বেরিয়ে যাওয়ার পরে অদ্বিতীয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। এতো টাকা কি হবে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে জানা ছিলো বলেই ও গাড়িতে বসে টাকা চায়নি, জানতোই নেমে যাওয়ার পরে আর কাকার এসব বিস্তারিত জানার সময় থাকবে না। দুপুরে দুটো নাগাদ সোমা কলেজের গেটে এসে বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নিলো, দূরে দাঁড়ানো তরুণ অদ্বিতীয়ার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো। অদ্বিতীয়া হেসে সোমার দিকে তাকালো,
আমার নাম করে বেরিয়ে আমাকে ফেলে রেখেই দুজনে সিনেমা দেখতে যাচ্ছিস!
সোমা মুচকি হাসলো,
তুই যখন দাদার সঙ্গে যাস, আমাকে নিয়ে যাস বুঝি!
রাত তখন প্রায় দশটা, সান্যাল বাড়িতে খাওয়ার পাট চুকে গেছে বেশ কিছুক্ষন আগেই, এমন সময় প্রতাপ সান্যালের ঘরে ফোন বাজার আওয়াজ হলো। সরযূ উঠে দাঁড়িয়ে ফোন তুললেন, হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই উল্টোদিক থেকে পুরুষ গলা ভেসে এলো,
এটা কি অদ্বিতীয়ার বাড়ি? অদ্বিতীয়া বাড়ি ফিরেছে? আমি ওর বন্ধু সোমার দাদা বলছি
সরযূ অবাক হলেন,
ওমা! সে আবার কোথায় যাবে? বাড়িতেই তো আছে! দাঁড়ান দিচ্ছি তাকে!
সরযূ চিৎকার করে ডাকলেন, এতো রাতে ফোন শুনে অদ্বিতীয়া অবাক হলো, তাকে চিন্তিত মুখে এগিয়ে আসতে দেখে সরলা এবং সুকান্তও পেছন পেছন ফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, অদ্বিতীয়া হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই সোমার দাদা চিৎকার করলো,
আমার বোন তোমার সঙ্গে সিনেমায় গিয়েছিলো না? সে কোথায়? তুমি তো বাড়িতেই ছিলে শুনলাম!
অদ্বিতীয়ার রিসিভার ধরা হাত থরথর করে কাঁপতে লাগলো, সোমা বাড়ি ফেরেনি! ও এখন কি বলবে! ভাইঝির শুকিয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে সুকান্ত হাত থেকে রিসিভার নিয়ে নিলেন, তিনি কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় একই কথা আবার বললো সোমার দাদা, সুকান্ত ফিরে তাকালেন,
তুই সোমার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলি?
অদ্বিতীয়া ফ্যাকাসে মুখে ঘাড় নাড়লো, সুকান্ত অবাক হলেন, কড়া গলায় বললেন,
ওরা বলছে তুই নাকি সকালেই ফোনে ওর মা কে সিনেমা যাওয়ার কথা বলেছিস? সোমা তো তোকে ফোন করেছিলো সকালে! তুই তো নিজেই বললি তখন! সত্যি কথা বল!
অদ্বিতীয়া ভীত চোখে কাকার দিকে তাকালো,
ও আমাকে বলতে বলেছিলো, আমি যাইনি! ও আমার কাছে পাঁচশো টাকা নিয়ে তরুণ নামে একটা ছেলের সঙ্গে সিনেমা গিয়েছিলো! ওদের বাড়ির সবাই তরুণ কে চেনে!
ভাইঝির কথা গুলো ঠান্ডা গলায় ফোনে পুনরাবৃত্তি করলেন সুকান্ত, তাঁর ভাইঝি কিছু জানে না এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সোমার মা ছেলের হাত থেকে ফোন টেনে নিলো,
কি বলছে আপনার ভাইঝি? সে কিছু জানে না! সেই তো সব জানে! মাথাটা খেয়েছে আমার মেয়ের! আমার শান্ত মেয়েটা কে শুধু নিজের ধান্দার জন্যে ব্যবহার করে! আসলে ও আমার ছেলের পেছনে পড়ে আছে! তাকে বিয়ে করার জন্যে এই সব করে আমার মেয়ের মাথাটা খাচ্ছে! বিরাট বড়োলোক না আপনারা? দেখুন কি করি এবার! আমার মেয়ের যদি কিছু হয় আপনাদের ছাড়বো না!
সুকান্ত অপমানিত মুখে ফোন নামিয়ে রাখলেন, উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে ভাইঝি কে কড়া গলায় বললেন,
এই জন্যেই তুই সকালে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলি? ছি ছি! তোর এতো অধঃপতন হয়েছে! তুই মিথ্যে বলেছিস ওর বাড়িতে!
অদ্বিতীয়া স্তব্ধ হয়ে দাদুর দেওয়াল আলমারির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তির যে তার হাত থেকে বেরিয়ে গেছে মনে মনেই বুঝতে পারছিলো সে। সোমা যে এরকম করতে পারে এটা এক মুহূর্তের জন্যেও তার কল্পনায় আসেনি। মনে মনে নিজেকেই ধিক্কার দিচ্ছিলো অদ্বিতীয়া, সে একটা সাংঘাতিক বোকামি করে ফেলেছে!
এমন সময় দ্বিতীয় ফোনটা বাজলো, সুকান্ত এগিয়ে গেলেন, ফোন ধরতেই অন্য এক পুরুষ কণ্ঠ অদ্বিতীয়া কে চাইলো, সুকান্তর জিজ্ঞাসার উত্তরে সে জানালো,
আমি সুমন, সোমার দাদা!
সুকান্ত ইশারা করলেন, অদ্বিতীয়া কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন ধরতেই, সুমনের উত্তেজিত গলা ভেসে এলো,
তুমি সকালে মাকে সোমার সঙ্গে সিনেমা যাওয়ার কথা বলেছিলে?
অদ্বিতীয়া উত্তর দিলো না, সুমন আরও জোরে চিৎকার করলো,
এটা কি করলে? সোমা বাড়ি ফেরেনি, গৌর আমাকে বললো, তরুণও বাড়িতে নেই! তোমার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিলো আজ?
হয়েছিলো! ও তরুণকে নিয়ে কলেজে এসেছিলো দুটো নাগাদ, আমার কাছ থেকে পাঁচশো টাকা নিয়েছিলো!
মৃদু গলায় বলা অদ্বিতীয়ার কথাগুলো সুমনের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলো,
বাহ! দারুন! তোমার কাছ থেকে টাকা নিলো, তোমাকে দিয়ে বাড়িতে মিথ্যে বলালো, তোমার একটুও সন্দেহ হলো না?
এর আগেও তো অনেকবার টাকা নিয়েছে! আমি আগেও কাকিমা কে বলেছি ওর হয়ে! কোনোদিন তো এরকম করেনি, ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরে এসেছে! আজ তাই কি করে সন্দেহ করবো বলো?
সুমন নিস্ফল আক্রোশে হাত মুঠো করলো, চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
আগেও নিয়েছে! আগেও তুমি ওর হয়ে মিথ্যে বলেছো তারমানে? কিন্তু একবারও আমাকে জানাও নি? অথচ আজ পর্যন্ত তো তোমার সঙ্গে কম বার দেখা করিনি আমি! বলো তো, কতবার তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে অদ্বিতীয়া! এমনকি এখানে আসার আগের দিনও আমি তোমার সঙ্গে দেখা করেছিলাম! এর আগে একবার সোমাকে টাকা দেওয়া নিয়ে ঝগড়ার কথা যখন বলেছিলাম তোমাকে, তখন একথাও বলেছিলাম যে এবার ওকে কে টাকা দেয় দেখি! তখনও তুমি কিন্তু সব শুনেও চুপ করে ছিলে, একবারের জন্যেও আমাকে জানতে দাওনি যে তুমিও ওকে টাকা দাও! তোমার কি মনে হয়নি এগুলো তোমার আমাকে বলা উচিত?
আমি বুঝতে পারিনি ও এমন করবে! তুমি প্লিজ আস্তে কথা বলো, বাড়ির সবাই এখানে দাঁড়িয়ে আছে!
প্রায় ফোনের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে নিচু গলায় বললো অদ্বিতীয়া, সুমন আরো জোরে চিৎকার করে উঠলো,
তাতে কি! আমি কাউকে ভয় পাই নাকি! আমি ভাবতেই পারছি না, তুমি এটা করেছো!এতদূর থেকে আমি কি করি বলো এখন? কোথায় খুঁজব ওকে? তরুণ কতো বাজে ছেলে তুমি সবটাই জানো অদ্বিতীয়া, আমিও তোমাকে কতোবার বলেছি! সব জেনেশুনে সোমার এতো বড়ো ক্ষতি করে দিলে তুমি? তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম, কোনোদিনও ভাবিনি তুমি আমাদের এতো বড়ো ক্ষতি করবে! তোমার সঙ্গে আর একটাও কথা বলতে আমার ইচ্ছে করছে না! তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে বলে বাড়িতে সবাই আমাকেই দোষারোপ করছে! বলছে আমি ইচ্ছে করে তোমার হেল্প নিয়ে ওকে পালাতে সাহায্য করেছি!
অদ্বিতীয়া কে একটাও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সুমন ফোনটা সজোরে নামিয়ে রাখলো, দাঁতে দাঁত চেপে তরুণের উদ্দেশ্যে বললো,
শালা! একবার হাতে পাই তোকে!
অদ্বিতীয়া ওখানেই বসে পড়লো, প্রতাপ সান্যাল হাত মুঠো করে বাইরের বারান্দায় পায়চারি করতে থাকলেন। সরযূ এই সুযোগে নাতনির গুষ্টির তুষ্টি করতে থাকলেও সুকান্ত বা সরলা কারোরই প্রতিবাদ করার মতো ভাষা ছিলো না।
রাত তখন প্রায় বারোটা, বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়ানোর আওয়াজে সুকান্ত বারান্দায় গেলেন, বামুন ঠাকুর দরজা খুলতে পুলিশের পোশাকে দুজন সরাসরি দোতলায় উঠে এলেন, সুকান্ত এগিয়ে এলেন, চেয়ারের দিকে ইশারা করে বললেন,
বসুন!
বারান্দার চেয়ারে বসে ইন্সপেক্টর প্রতাপ সান্যালের দিকে তাকিয়ে নমস্কারের ভঙ্গি করলেন,
স্যার! অদ্বিতীয়া সান্যাল আপনারই নাতনি তো? ওর নামে একটা অভিযোগ জমা পড়েছে! সোমা নামের একটি মেয়ে ওর সঙ্গে সিনেমায় যাওয়ার নাম করে আর বাড়ি ফেরেনি!
প্রতাপ সান্যাল প্রতিনমস্কার জানালেন, গম্ভীর গলায় বললেন,
হ্যাঁ, কিছুক্ষন আগেই মেয়েটির বাড়ি থেকে ফোন এসেছিলো! শুনেছি সবটা! আমার নাতনি ওর সঙ্গে কোথাও যায়নি, মেয়েটি একাই গিয়েছে! উল্টে যাওয়ার সময় ওর কাছ থেকে পাঁচশো টাকা ধার করে নিয়ে গিয়েছে!
ইন্সপেক্টর একটু চুপ করে থাকলেন,
হ্যাঁ, স্যার আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আপনার নাতনিই ওদের বাড়ি ফোন করে ওকে সিনেমা যাওয়ার কথা বলেছিলো! এটা মিথ্যে নয়! আর তাছাড়া মেয়েটির দাদা খুব বড়ো ফুটবলার স্যার, একদম ওপর মহলে কথা বলেছে সে! আমার ওপর ভীষন চাপ আছে, আপনার নাতনি কে আজই অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো, শুধু আপনি বলে আমি পিছিয়ে এলাম, কাল সকালেই কিন্তু ওকে থানায় যেতে হবে!
ও খুব বড়ো ভুল করেছে, মনে মনে জানলেও অদ্বিতীয়ার চোখ জলে ভরে এলো, সুমন ওকে থানায় নিয়ে যেতে চাইছে! এই সুমন ওকে ভালোবাসে! সোমার কোনো দোষ নেই, সব দোষ ওর হয়ে গেলো!! ও তো ভুল করেছে, ওর সুমনকে জানানো হয়তো সত্যিই উচিত ছিলো, কিন্তু ওতো জানায়নি সুমনের সঙ্গে ওর সম্পর্কে জটিলতা আসতে পারে ভেবেই! সেটা সুমন একটুও বুঝলো না! আজ সবার সামনে ওকে ফোন করে অপমান করে তো ও দাদুভাই এর সামনেও ওদের সম্পর্কটা কে প্রকাশ্যে এনে ফেললো! ওর একবারও কি মনে হলো না এতে দাদুভাই সব জেনে যাবেন, ওদের সম্পর্কটা আর থাকবেই না! নাকি তাতে সত্যিই সুমনের আর কিছুই যায় আসে না! ওর বোনের ক্ষতি হয়েছে বলে ও অদ্বিতীয়ার সঙ্গে সম্পর্কও শেষ করে ফেলতে চায়! অদ্বিতীয়া কে থানায় ডেকে নিয়ে যাওয়া মানে যে ওদের পরিবারের সম্মানহানি, এটা ওর একবারও মনে হলো না!
এইসব ভাবনার মধ্যেই যে কখন ইন্সপেক্টর চলে গেছেন অদ্বিতীয়ার খেয়ালও ছিলো না, চমক ভাঙলো সরলার ডাকে,
ওঠো! অনেক রাত হয়েছে, নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো! যা হবে সেসব কাল সকালে দেখা যাবে!
অদ্বিতীয়া শুন্য দৃষ্টিতে তাকালো, অন্য মনস্ক গলায় বললো,
দাদুভাই এর মানসম্মান সব শেষ করে ফেললাম ছোটো মা! আমার জন্যেই এই বাড়িতে আজ পুলিশ ঢুকলো!
সরযূ মুখ বেঁকিয়ে নাতনির দিকে তাকালেন,
ঢং! এতোদিন এসব কথা মনে ছিলো না!
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে প্রতাপ সান্যাল নাতনির দিকে তাকালেন,
মেয়েটির দাদা বড়ো ফুটবলার শুনলাম, নাম কি তার?
ভাইঝির জবাবের আগেই সুকান্ত বিরক্ত গলায় উত্তর দিলেন,
সুমন! সুমন ব্যানার্জি! আমাদের ক্লাবেই খেলে!
সান্যাল মশাই এর মুখ গম্ভীর হলো,
এর সঙ্গেই তুমি মনোজের রেষ্টুরেন্টে গিয়েছিলে, তাই তো? আর ছেলেটি কি বলছিলো ফোনে তখন, ওর সঙ্গে তোমার যাবার আগের দিনও দেখা হয়েছিলো! তোমার সঙ্গে ওর কিসের সম্পর্কের কথা বলছিলো ও? ওই একটা থার্ড ক্লাস ফ্যামিলির ছেলের সঙ্গে কি সম্পর্ক থাকতে পারে তোমার!
অদ্বিতীয়া মাথা নিচু করলো, নাতনির নিচু মাথার দিকে তাকিয়ে প্রতাপ সান্যাল বিদ্রুপের গলায় বললেন,
আর মাথা নিচু করে কি হবে? ওতো এমনিতেই নিচু হয়ে গেছে! যাও, ঘরে যাও, এখানে সারারাত বসে থাকলে তোমার সমস্যার সমাধান হবে না!
পরের দিন সকালে ভাইঝি কে নিয়ে থানায় পৌঁছলেন সুকান্ত, দরকার হলে যাতে থানা থেকেই জামিনের ব্যবস্থা করা যায়, সে বিষয়ে বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে গেলেন। তারা যখন থানায় পৌঁছালো তখন সেখানে সুমনের বাড়ির লোকেরাও উপস্থিত ছিলো। কিছুক্ষন আগেই তরুণ সোমা কে বিয়ে করে নিজের বাড়ি ফিরে এসেছিলো, তাদের কেও থানায় ধরে আনা হয়েছিলো। সোমার মা অদ্বিতীয়া কে দেখেই চিৎকার করলেন,
এই মেয়েটার জন্যেই আজ আমার মেয়ের এই দুরবস্থা, একে ছাড়বেন না স্যার! আমি কালই আপনাকে ওর নাম বলেছিলাম, আপনি তাও ওকে ধরেন নি! ওরা অনেক বড়োলোক জানি, কিন্তু আমার ছেলেরও অনেক চেনাশোনা আছে!
ইন্সপেক্টর বিরক্ত হলেন,
আপনার মেয়ের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, অন্য কাউকে দোষারোপ করবেন না! অ্যাডাল্ট মেয়ে বিয়ে করে ফেলেছে আর আমাদের কিছু করার নেই! যান বাড়ি যান, এবার বাকিটা নিজেরা মিটমাট করুন! আপনি হারিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছিলেন অদ্বিতীয়া সান্যালের বিরুদ্ধে, তাই ওকে থানায় ডেকে এনেছিলাম, এখন যখন মেয়ে ফিরে এসেছে আর ওকে আমি আটকে রাখতে পারি না।
খুব অল্পেই এ যাত্রা ছাড়া পেলো অদ্বিতীয়া, সুকান্ত স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও, ভাইঝির সঙ্গে একটা কথাও বললেন না। তাঁরা বাড়িতে ফিরে আসার পরে সান্যাল মশাই নাতনির মুখোমুখি দাঁড়ালেন,
সান্যাল বাড়িতে আজ প্রথম পুলিশ ঢুকলো , শুধু তাই নয়, এই প্রথম সান্যাল বংশের কাউকে থানায় গিয়ে হাজিরা দিতে হলো। জানিনা ওই ইন্সপেক্টর কতটা কি গোপন রাখবে, তবে ফুটবল খেলোয়াড়ের বোনের পালানোর গল্প খবরের কাগজগুলো ঠিকই ছাপবে! কাল থেকে আর কলেজে যাওয়ার দরকার নেই! আমি তোমার জন্যে ছেলে দেখছি! বিয়ে একবার ঠিক হয়ে গেলে তারপরে তুমি বাড়ি থেকে কলেজে বেরোবে!
ক্রমশ
#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৪০
পরের দিন সকালেই রথীন জ্যেঠুর বাড়িতে উপস্থিত হলেন, শুভঙ্কর তাঁকে সুমনের বোনের পালানোর সঙ্গে অদ্বিতীয়ার জড়িয়ে যাওয়ার গল্প শুনিয়েছিল। প্রতাপ সান্যাল ভাইপোকে দেখে হাতে চাঁদ পেলেন, ঘরের দরজা বন্ধ করে শলা পরামর্শ করতে বসলেন। রথীন তাঁকে আশ্বস্ত করলেন,
আপনি কিছু চিন্তা করবেন না জ্যেঠু বাবু, শুভঙ্কর আমার ছোটো বেলার বন্ধু, ওর প্রচুর জানাশোনা আছে। আমি ওকে বলে দিচ্ছি, ওই মেয়েটির পালানোর খবর কাগজে ছাপা হলেও আমাদের পিয়ার নাম তাতে আসবে না! আমার আপনাকে আরো একটা খবর দেওয়ার ছিলো জ্যেঠু বাবু, রতন দা আপনার সম্বন্ধে কিছু খবর দিয়েছে শুভঙ্কর কে! ও এখনো সোর্সের নাম বলছে না, কিন্তু শুভঙ্কর ওকে চাপে রেখেছে! আমি সামলে নিয়েছি, আপনি চিন্তা করবেন না!
প্রতাপ সান্যাল মনে মনে মুচকি হাসলেন, শুভঙ্কর যে রথীন এর পুরনো বন্ধু তা তিনি জানেন অনেক আগে থেকেই। শুভঙ্কর যে রথীন কে না জানিয়ে কিছু করবে না সেটাও তিনি আন্দাজ করেছিলেন। নবীনের লোক অনেকদিন থেকেই রতনকে লক্ষ্য রাখছিলো, তাঁর কাছে খবর ছিলো রতন শুভঙ্করের কাগজের সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। রথীন কে কাছে পেতেই তাই তিনি সম্পত্তির দলিল ছেড়ে দিয়েছিলেন। রথীন তাঁর দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে প্রতাপ সান্যাল নিজেকে সামলে নিলেন, গলায় গাম্ভীর্য এনে বললেন,
সোর্স টা কে সেটা জানতে পারলে আমায় জানিও রথীন!
রথীন সম্মতি জানালেন,
নিশ্চয়ই জ্যেঠু বাবু!
রথীন শুভঙ্করের সঙ্গে কথা বলে অদ্বিতীয়া কে যাতে জড়ানো না হয় সে কথা জানানোর পর সান্যাল মশাই নিশ্চিন্ত হলেন, ভাইপোর হাত জড়িয়ে ধরে বিগলিত হয়ে বললেন,
তুমি আজ যা উপকার করলে রথীন, কখনো ভুলবো না! ওই মেয়ে নিয়ে ছোটো থেকে কম ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে না, এবার একটা বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে আমি নিশ্চিন্ত হই। পড়াশুনা করে আর দরকার নেই, তোমার বড়ো মাও তাই বলছিলেন। শ্বশুরবাড়ি যদি চায়, তাহলে তারা না হয় পড়াবে!
রথীন এরও এখানে এসে জ্যেঠু কে অযাচিত ভাবে সাহায্য করার পেছনে বড়োসড়ো উদ্দেশ্য ছিলো। তাঁর ভায়রা ভাই এবং শ্যালিকা তাঁর বাড়ির পৈতের অনুষ্ঠানে অদ্বিতীয়া কে দেখেছিলেন। অর্ধেক রাজত্ব এবং রাজকন্যা একসঙ্গে পাওয়ার লোভ তাঁদের ছিলো, এমনকি তাঁদের ছেলে শুভরও অদ্বিতীয়া কে যথেষ্টই পছন্দ হয়েছিলো। তিনি তাড়াতাড়ি জ্যেঠু কে বললেন,
খুব ভালো ভেবেছেন জ্যেঠু বাবু, আমার হাতে একটা খুব ভালো ছেলে আছে। আমার শ্যালিকার ছেলে শুভ, ইঞ্জিনিয়ার, খুব বড়ো পোস্টে চাকরি করে, এখন ধানবাদে পোস্টিং। ওরা আমার ছেলের পৈতে তে পিয়া কে দেখেছে, ওদের ওকে খুব পছন্দ হয়েছে!
তাই নাকি! এতো খুব ভালো কথা! তবে আমার তো একটা খুঁত আছে রথীন, রতির বিষয়ে আর তোমাকে নতুন করে কি বলবো!
তাড়াতাড়ি জ্যেঠু কে হাত ধরে থামিয়ে দিলেন রথীন সান্যাল,
আহা! আবার ওসব কথা কেনো! বনেদী বাড়ির ছেলেদের ওসব একটু আধটু থাকেই, কেউ অতো মাথা ঘামায় না! ওসব আমি আমার ভায়রা ভাই কে আগেই জানিয়েছি, ওদেরও তো বনেদি রক্ত, এসব ছোটখাটো ব্যাপারে কিছু যায় আসে না! সেদিক থেকে ধরতে গেলে শুভরও একবার একটা সমস্যা হয়েছিলো, ওর বাড়িতে যে মেয়েটি কাজ করতো, সে ওকে টাকা আদায়ের জন্যে ফাঁসাতে চেয়েছিলো। সেসব অবশ্য মিটে গেছে, আমি সব মিটিয়ে দিয়েছি!
প্রতাপ সান্যাল তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন,
ওসব মিটে গেছে যখন তখন পুরনো প্রসঙ্গ আর টেনে না আনাই ভালো! শুধু একটা কথা এসব সুকান্তর সঙ্গে আলোচনা করার দরকার নেই! ছেলে কে তাহলে কবে নিয়ে আসছো আমার বাড়িতে?
রথীন হাসলেন,
আজকালকার ছেলে মেয়ে সব! ওরা কি আর আমাদের নিয়ে আসার জন্যে অপেক্ষা করে, সে তারা নিজেরাই আলাপ করে নিয়েছে! শুভর তো পিয়া কে খুব পছন্দ হয়েছে, অনেকটা সেই তার বাবা কে বলেছে গিয়ে এসব!
প্রতাপ সান্যাল উচ্ছসিত হলেন,
বাহ! বাহ! বেশ! বেশ! তাহলে এই শ্রাবণেই একটা দিন দেখো দেখি! শুভ কাজে আর দেরি কিসের! আমি কবে যাবো তাদের বাড়ি, সেটা বলো!
রথীন সঙ্গে সঙ্গেই ভায়রা ভাইয়ের সঙ্গে জ্যেঠু র ফোনে আলাপ করিয়ে দিলেন, কয়েক মিনিটের কথায় অদ্বিতীয়ার ভবিষ্যত ঠিক হয়ে গেলো। দেনা, পাওনা সম্বন্ধে আগেই তাদের জানা ছিলো তাও রথীন জ্যেঠুর মুখ দিয়ে দ্বিতীয়বার সেই কথা ফোনে বলিয়ে দিলেন। অর্ধেক রাজত্বের বিনিময়ে অদ্বিতীয়া সুমনের কথা মতোই পণ্য হলো।
রথীন সান্যাল নিজের কাজ হাসিল করে ফিরে যাওয়ার পরে প্রতাপ সান্যাল গোল টেবিল বৈঠকে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন,
ছেলেটির সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিয়েছো?
সুকান্তর প্রশ্নের উত্তরে প্রতাপ সান্যাল তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন,
খোঁজ খবর আবার কি? রথীন এর শ্যালিকার ছেলে, ইঞ্জিনিয়ার, বনেদি বংশ! এদের আবার আলাদা করে খোঁজ নিতে হয় নাকি!
ভাইঝি কে শুকনো মুখে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুকান্ত একটু গলা খাঁকারি দিলেন,
বাবা! পিয়ার মতামতটাও তো নিতে হবে! আজকালকার মেয়ে, ওরও তো পছন্দ অপছন্দের একটা ব্যাপার আছে!
সান্যাল মশাই অবাক হলেন,
দিদিভাই এর মতামত নিতে হবে! আমি কি ওর খারাপ চাইবো? আমি বেঁচে থাকতে ওর মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই! আর তাছাড়া শুনলাম তার তো নাকি ছেলের সঙ্গে ইতিমধ্যেই আলাপ হয়েছে!
ওমা! কখন? মেয়ের পেটে পেটে অ্যাত!
হাত তুলে মা কে থামিয়ে দিয়ে নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইঝির দিকে তাকালেন সুকান্ত,
তোর সঙ্গে ছেলের আলাপ হয়েছে!
অদ্বিতীয়া শূন্য দৃষ্টিতে কাকার মুখের দিকে তাকালো, তাকে ওই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সান্যাল মশাই অবাক হলেন,
হয়নি? রথীন বললো শুভর সঙ্গে তোমার নাকি ওর বাড়িতে পৈতে তে গিয়ে আলাপ হয়েছিলো?
শুভ! নামটা খুব চেনা চেনা লাগছিলো অদ্বিতীয়ার, কোথায় যেনো শুনেছে সে! কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বাস্তবের মাটিতে পা দিলো অদ্বিতীয়া, হ্যাঁ, এর সঙ্গেই তো রথীন জ্যেঠুর বাড়িতে গিয়ে আলাপ হয়েছিলো তার! সে ঘাড় নাড়লো ধীরে ধীরে,
হ্যাঁ হয়েছে!
যাক! তাই বলো! আমি তো ভাবছিলাম রথীন এতো বড়ো ভুল বললো!
এরপরেই সান্যাল মশাই গিন্নীর দিকে ঘুরে বসলেন,
বুঝলে গিন্নী, ওদের শ্রাবণেই দিন দেখতে বলেছি! আর দেরি করে লাভ কি? তুমি এবার তাহলে বৌমা কে সঙ্গে নিয়ে একটু হাত চালিয়ে লেগে পড়ো!
সরযূ মুখ গম্ভীর করলেন, রথীনকে তাঁর কোনোদিনই পছন্দ ছিলো না, তাঁর সব কাজের পেছনেই যে উদ্দেশ্য কাজ করে সেটা তিনি মনে মনে বিশ্বাস করেন। স্বামীর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
তা কতোয় রফা হলো? রথীন যা ছেলে, অর্ধেক নিয়েই ছাড়লো তো?
ছেলে, বৌমার সামনে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে প্রতাপ সান্যালের ছিলো না, তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে সুকান্ত অবাক হলেন,
কতোয় রফা হলো মানে? তুমি কি পাত্র পক্ষকে কিছু দেবে বলেছো নাকি? এসব আবার কি?
সরযূ বিরক্ত হলেন,
দেবে বলেছে মানে! অর্ধেক সম্পত্তি দেবে বলেছে তোমার বাবা! এই মেয়ে তো জন্মে থেকেই আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে এক্কেরে! এখন পার করতে গিয়ে যা খরচ হবে, এরপরে বাটি হাতে না পথে বসতে হয় আমাদের!
সুকান্ত বাবার দিকে তাকিয়ে রাগের গলায় বললেন,
পিয়া কি আমাদের ফ্যালনা নাকি? যা খুশি তাই করছো তুমি! এক পয়সাও দেবো না আমরা, রথীন দা কে বলে দিও! তাতে যদি বিয়ে না হয়, হবেনা! ওর জন্যে আমরা অনেক ভালো ছেলে পাবো!
প্রতাপ সান্যাল বিরক্ত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন,
তাই নাকি! তা নিয়ে এসো তো গোটা দুয়েক ছেলে! দেখি তোমার ক্ষমতা! বনেদি বাড়ির শিক্ষিত, ভদ্র, ভালো ছেলে পেতে গেলে খরচ তো করতেই হবে! আর তোমার দাদার যা কীর্তি!
ওই বনেদি ধুয়ে খাও! একটা শিক্ষিত ছেলে সেই বা কি রকম? পণ নিয়ে বিয়ে করবে? এই শিক্ষার কি দাম আছে? এক্ষুনি রাজি হয়ো না, আগে আমি ছেলের সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়ে দেখি!
প্রতাপ সান্যাল সুকান্তর দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালেন,
আমি তোমার মতামত চাই নি, শুধু আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। আর তোমার পছন্দ সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই! তোমার কাছে কে ভালো কে খারাপ তার কোনো ধারণাই নেই সেটা তোমার ব্যক্তিগত পছন্দ দেখে আমি অনেক আগেই বুঝেছি!
সুকান্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন,
তোমার বোঝাবুঝি তে আমার কিছু এসে যায়না! আমি শুধু এইটুকু বলে দিলাম, এবার তোমার ইচ্ছেতেই সব কিছু হবে না! আমি আলাদা করে পিয়ার সঙ্গে কথা বলবো, তার মতামত জানবো, যদি তার আপত্তি না থাকে তাহলে ছেলের সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেবো, তবেই তুমি এগোবে! আর এটুকু পরিষ্কার করে এখনই বলে দিলাম এক পয়সাও পণ দেবো না ছেলে কে, এটা জেনে যদি সে বিয়ে করতে রাজি থাকে তাহলে কথা এগোবে!
সরযূ পুলকিত হলেন, নাতনির বিয়েতে এক পয়সাও খরচ করার ইচ্ছে তাঁর ছিলো না। যিনি কোনোদিনও ছোটো ছেলের সঙ্গে সহমত পোষণ করেনি নি আজ পর্যন্ত, সেই সরযূ আজ ছেলের সুরে সুর মেলালেন,
ও তো ঠিকই বলেছে! আজকাল ওসব আবার কেউ দেয় নাকি! যতো বয়স বাড়ছে ততোই বুদ্ধি কমছে! তুমি এসবে আর মাথা ঘামিও না তো! যে তাকে এতো বছর ধরে বাপের মতো মানুষ করেছে, তাকেই ঠিক করতে দাও!
সুকান্ত নিজের ঘরে চলে গেলেন, অদ্বিতীয়া আস্তে আস্তে নিজের ঘরে এসে টেবিলে মাথা রেখে বসে পড়লো, আজ তার কলেজে যাওয়া ছিলো না। দাদু যে তাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেবেন না জানা থাকায় সে তৈরি হলো না। কিছুক্ষন পরে সুকান্ত তৈরি হয়ে ভাই ঝির ঘরের সামনে এলেন, তাকে টেবিলে মাথা রেখে বসে থাকতে দেখে অবাক গলায় বললেন,
কি রে! তুই তৈরি হোসনি এখনও? আজ ক্লাস নেই?
যাবো না ছোট কা, তুমি চলে যাও! আমার শরীর ভালো লাগছে না!
উদ্বিগ্ন সুকান্ত ভেতরে ঢুকে এসে ভাই ঝির কপালে হাত রাখলেন,
জ্বর তো নেই! তাহলে! অবশ্য দু দিন ধরে একটু ধকল যাচ্ছে তোর! ঠিক আছে একটু রেস্ট নে আজকের দিনটা! রাতে ফিরে তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার!
সুকান্ত, প্রতাপ সান্যাল এক এক করে কোর্টে বেরিয়ে গেলেন, একটু বেলার দিকে সরযূ নিচে স্নান করতে চলে যাবার পরে সরলা অদ্বিতীয়ার ঘরে ঢুকে এলো। অদ্বিতীয়া তখন জানলার গরাদে মুখ ঠেকিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার আওয়াজে পেছন ফিরে তাকালো,
কলেজে গেলে না?
অদ্বিতীয়া মাথা নাড়লো,
নাহ! জানোই তো দাদুভাই এখন জোর করে কলেজ যেতে চাইলে রাগারাগি করবেন!
সরলা ম্লান হাসলো,
আর করবেন না! বলেছিলেন তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে যেতে দেবেন! পিয়া একটা কথা বলি তোমাকে?
অদ্বিতীয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো,
তুমি কিন্তু সুমনের কথা বলতে একটুও ভয় পাবে না ছোড়দাকে! ছোড়দা যখন তোমার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলবেন, তখন তুমি সত্যিটা বলে দিও, এর থেকে বড়ো সুযোগ আর তুমি পাবে না!
অদ্বিতীয়া দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চাপলো, শক্ত গলায় বললো,
আমার ছোট কা কে কিছু বলার নেই ছোটো মা! আমার এই ছেলের সঙ্গে বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই!
সরলা অধৈর্য্য হলো, হাত দিয়ে অদ্বিতীয়া কে থামিয়ে দিয়ে বললো,
আহ্ পিয়া! এটা মান অভিমানের সময় নয়! এটা তোমার সারাজীবনের প্রশ্ন! ওসব মান অভিমান তুমি সুমনের সঙ্গে পরে দেখিও!
অদ্বিতীয়া ঠান্ডা চোখে তাকালো,
কিসের মান অভিমান! কার সঙ্গে! ও আমাদের বাড়ির সম্মান নষ্ট করে দিয়েছে ছোটো মা, বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়েছে! আমাকে থানায় টেনে নিয়ে গিয়েছে! এতো কিছুর পরেও তোমার মনে হচ্ছে আমি অভিমান করছি? আমি সত্যিই ওর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না আর! ওর কথা শুনে মনে হলো সব দোষ আমার, ওর বোন কিছুই করে নি!
সরলা অদ্বিতীয়া কে খাটে টেনে এনে বসলো, পাশে বসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো,
শান্ত হও! জানি ও একদম ঠিক কাজ করেনি, তবে ওর ওই ব্যবহারটাও স্বাভাবিক পিয়া! তুমি যে সোমাকে টাকা দিতে, ওর মাকে মিথ্যে বলে তরুণের সঙ্গে দেখা করতে সাহায্য করতে সেটা সত্যিই তোমার সুমন কে বলা উচিত ছিলো! নিজেকে ওর জায়গায় বসিয়ে দেখো, তোমারও আমার কথাই ঠিক মনে হবে!
অদ্বিতীয়া উঠে দাঁড়ালো,
জানি না ছোটো মা! কে ঠিক কে ভুল, এইসব তর্ক বিতর্কে যেতে আর ইচ্ছে করছে না! আমি এটা আগেও জানতাম ওর মা আমাকে পছন্দ করে না! কিন্তু সুমনও যে সব দোষ আমার ঘাড়েই ঠেলে দেবে এটা আমার ধারণা ছিলো না! ওর নিজেরও এই সম্পর্কটা থাকা না থাকায় কিছু যায় আসে না, যদি আসতো তাহলে ও দাদুভাই এর সামনে, বাড়ির সবার সামনে আমাকে ফোন করে দেখা হওয়া, কথা হওয়ার কথা বলে দিয়ে অপমান করতে পারতো না! এতো কাল আমি ওর মেকি ব্যবহারকেই আসল বলে ভাবতাম, এখন বুঝলাম যে এটাই ওর আসল ব্যবহার যেটা একদম ওদের বাড়ির সবার মতোই! ও একটুও ওর বাড়ির অন্য দের থেকে আলাদা নয়!
সরলা চুপ করে শুনলো সবটা, তারপরে বললো,
দ্যাখো, তুমি আইন নিয়ে পড়াশোনা করছো! এমন একটা পরিবেশে মানুষ হচ্ছো যেখানে দু দুজন আইনের লোক বাস করেন। তারপরেও তুমি কিছুই যুক্তি দিয়ে বিচার করনি, সবটাই আবেগ দিয়ে ভেবেছো সব সময়! এখন সেই ভুল আবারও করতে যাচ্ছো! একটা ফোনে বলা কিছু কথা, এতদিনের চেনা একটা ছেলে সম্পর্কে তোমার ধারণা এক মুহূর্তে বদলে দিলো! তুমি কিন্তু একটুও যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলে না! যে ছেলেটার বোন একটা বাজে ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে অনেকটা তোমার বোকামির জন্যেই, তার বাড়িতে তাকে দোষারোপ করা হচ্ছে যে সে তোমার সাহায্যে তার বোন কে পালাতে সাহায্য করেছে, তারপরে তার এই রাগ একদম স্বাভাবিক নয় কি?
অদ্বিতীয়া মাথা নাড়লো,
আমি জানিনা! ছোটো বেলার বন্ধু যে কিনা ক্লাস এইট থেকে আমার সঙ্গে পড়েছে, একসঙ্গে থেকেছে প্রায় পাঁচ বছর, তার ক্ষেত্রেও আমি যুক্তির কথা ভাববো ছোটো মা! সব কিছুই যদি উকিলের মতো ভাবি, তাহলে তো কোনোদিনও কাউকেও বিশ্বাস করতেই পারবো না। এরপরে তো তোমাকে, ছোটকাকে, দাদুভাইকেও আমাকে সন্দেহ করতে হবে তাহলে! জীবনে বিশ্বাস না থাকলে আর কি থাকলো বলো? এতো সন্দেহ নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়!
সরলা ম্লান হাসলো,
জীবন বড়ো জটিল পিয়া, আঘাত কখন কার কাছ থেকে আসে, কেউ জানেনা! খুব চেনা মানুষগুলো যে কখন অচেনা হয়ে যায় আমরা জানতেও পারিনা! তাই জীবনে সব কিছুর জন্যে প্রতি মুহূর্তে প্রস্তুত থাকতে হয়, সবে তো শুরু তোমার! জীবনে এখনও অনেক কিছু জানা, শোনা বাকি রয়ে গেছে!
অদ্বিতীয়া জল ভরা চোখে তাকালো,
ছোটো থেকে শুধু নিয়মের বেড়াজালে আটকে থেকে থেকে কেমন যেনো গুটিয়ে গিয়েছিলাম ছোটো মা! বিভিন্ন রকমের না শুনতে শুনতে সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম! নিজেরও যে কোনো বক্তব্য থাকতে পারে সেটা কখনো মনেই হয়নি! শুধু মনে হতো যদি আপত্তি করি, নিজের ইচ্ছার কথা বলি, তার কথায় সায় না দিই, তাহলে হয়ত আমাকে যে দুয়েকজন ভালো বাসে বলে আমার মনে হয়, তারা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে! স্কুলে পড়ার সময় যখন সুমনের সঙ্গে সম্পর্কের কথা দাদুভাই জেনে গিয়েছিলেন বলে আমি সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম তখনও এগুলোই মনে হতো। মনে হতো যদি সোমাকে হেল্প না করি, আমার হাত খরচের টাকা থেকে ওকে না খাওয়াই তাহলে যদি ও আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট করে ফেলে রাগে, তাহলে তো আমি আর সুমনের খবর জানতেই পারবো না কখনো! সেই ভয়টাই আজও থেকে গিয়েছে জানো! যদি সুমনকে ওর বোনের কথাগুলো জানিয়ে দিতাম, তাহলে ও নিশ্চয়ই বাড়িতে জানিয়ে বোনের সঙ্গে অশান্তি করতো! ওর মা আমাকে পছন্দ করেন না, আমি জানি সেটা, এবার যদি সোমার সঙ্গে সম্পর্কটাও নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সুমনের সঙ্গে কি আর সম্পর্ক থাকবে আমার! কাকে বোঝাবো এই কথাগুলো? আসলে আমি খুব ভীতু ছোটো মা, দাদুভাই এর কড়া শাসন আমার ব্যক্তিত্ব তৈরি হতেই দেয়নি কখনো! আমি সব সময় ভয়ে ভয়ে থেকেছি, চেষ্টা করেছি যাতে আমার কোনো ভুলের জন্যে আমার প্রিয় মানুষরা আমাকে ছেড়ে চলে না যায়! অথচ দ্যাখো, আমি যাদের প্রিয় মনে করেছি, তারা কিন্তু আমার কথা ভাবেনি কখনো, কারণ তারা আমাকে সব সময় সহজলভ্য মনে করেছে, আমাকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করেছে! কিন্তু আর না! সুমনের বোনের পালানোর দায় আমি নিজের ঘাড়ে নিতে রাজি নই, ওকে সেটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে চাই!
সরলা মাথা নাড়লো, হতাশ গলায় বললো,
আবারও তুমি আর একটা ভুল করছো পিয়া! ভবিষ্যতে আফসোস করতে না হয়!
ক্রমশ