#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_১৬
#তাশরিন_মোহেরা
মুগ্ধের জন্মদিন উপলক্ষে আজ বিকেলে তার বাসায় যাচ্ছি, তবে শিক্ষিকা হিসেবে নয় বরং মুগ্ধের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে! হাতে আছে রিমোট কন্ট্রোল একটা গাড়ি। কথার ছলে অনেকবারই মুগ্ধ আমায় এমন গাড়ির কথা বলেছে। তাই তাকে খুশি করার ক্ষুদ্র প্রয়াস!
তবে মুগ্ধের বাসায় ঢুকতেই চোখের সামনে পড়লো রূপন্তী। মেয়েটাও এসেছে তবে! পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসে আছে সে। একটা পার্টি গাউন পড়ে এসেছে আজ সাথে লাল টুকটুকে লিপস্টিকে সত্যিই মেয়েটাকে দারুণ লাগছে। পরক্ষণেই নিজের দিকে দেখলাম আমি। ছাইরঙা মোটামুটি হালকা ধরণের একটা থ্রি-পিস আর মেকাপ বলতে চোখে কাজল এঁটে, হালকা বাদামী ধাঁচের একটা লিপস্টিক লাগিয়ে এলাম। কাজলটা লাগিয়েছি নামমাত্র! কেননা কাজলে আমায় মোটেও মানায় না। চোখের নিচে লেপ্টে ভুতের মতো দেখায়!
রূপন্তীর পাশে আমার এই সাদামাটা পরিচ্ছদ একবিন্দুও মানালো না। কেমন একটা অস্বস্তি বিরাজ করলো সারা মন জুড়ে। যতটা উৎফুল্ল চিত্তে এখানে এসেছি তার সবটা-ই প্রায় হারিয়ে যেতে চলেছে!
ভেতরে ঢুকে গিফটটা টেবিলে রেখে দিলাম। টেবিলে আরও গিফট সাজানো আছে দেখলাম। গতকাল মুখর সাহেব গুণে গুণে ১০ টা গিফট নিয়েছে। কারণ, মুগ্ধ আজ ১০ বছরে পা দিয়েছে তাই এই উপলক্ষে তাকে ১০ টা গিফট দেবে মুখর। আইডিয়াটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।
কিছুক্ষণ পর মুখর ভেতরের রুম থেকে এগিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
‘আপনারা সবাই রেডি থাকুন। আমি অর্কের বাসা হতে এখনি মুগ্ধকে নিয়ে আসবো। সে জানে না আমি তার জন্য এতো কিছু এরেঞ্জ করেছি।’
আমি আর রূপন্তী একথায় নড়েচড়ে বসলাম। মুখর সেকেন্ড খানেক পর দরজা ঠেলে মুগ্ধকে নিয়ে বাসায় ঢুকলেই আমি আর রূপন্তী চিৎকার করে তাদের দিকে স্নো স্প্রে ছুঁড়ে বলে উঠলাম,
‘হ্যাপি বার্থডে, মুগ্ধ!’
এতে মুগ্ধ একটু নয় অনেকখানিই চমকে গেল। স্নো স্প্রেগুলো তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সে এসবের তোয়াক্কা করলো না। তার চোখ চিকচিক করছে খুশিতে। সে আমার দিকে তেড়ে এসে বলতে থাকে,
‘থ্যাংক ইউ, ম্যাম!’
আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে বললাম,
‘জীবনে অনেক বড় হও আমার ছাত্র!’
মুগ্ধ তার ভাইয়ের দিকে ফিরে বললো,
‘ভাইয়া আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আজ আমার জন্মদিন। হিহি!’
মুখর হালকা হাসলো।
রূপন্তী এবার সামনে এসে মুগ্ধকে সাধুবাদ জানালো। মুগ্ধ শুষ্ক মুখে আমার দিকে দেখলো। তার মানে রূপন্তীকে দেখে মুগ্ধের মোটেও ভালো লাগেনি। আমি চোখ পাকিয়ে তাকে শান্ত থাকতে বললাম। সে আমার ইশারা বুঝতে পেরে হালকা হেসে রূপন্তীকে ধন্যবাদ জানালো।
মাঝে অনেক আড্ডা আর মজা হলো। এতো সারপ্রাইজ আর গিফটে মুগ্ধের অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। হালকা খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে আমরা সবাই কেক কাটলাম। কেক খাওয়ার পর্ব শেষ হলেই আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। হাতে সামান্য কেকের ক্রিম নিয়ে মুখরের সামনে গিয়ে তার নাকে ডগায় ঢলে দিলাম আমি। এতে মুখর ভীষণভাবে চমকালো। আয়না দেখতে মুখর ভেতরে গেলে আমিও গেলাম তার পিছু পিছু। ডাইনিং টেবিলে বেসিনের উপর যে আয়নাটা আছে, তাতে নিজের ক্রিম লাগানো নাকটা দেখে ফুঁসে উঠলো মুখর। আমার দিকে ঘুরে একগ্লাস পানি নিলো সে। আমি বুঝেছি ব্যাটা কি করতে চলেছে। আমি তার সামনে এসে যথারীতি কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়িয়েছি। সাহস নিয়ে বললাম,
‘পানি ছুঁড়ে মারবেন, তাই তো? দেখি, ছুঁড়ে মারুন। মারুন! আমি আর ওসবে ভয় পায় না।’
চোখ জোড়া বন্ধ করে মুখরের পানি ছোড়ার অপেক্ষা করছি। সেকেন্ড কয়েক পরও কিছুর স্পর্শ না পেয়ে এক চোখ খুললাম হালকা করে। দেখি মুখর মুখে হাত দিয়ে হাসছে মিটিমিটি। আমি চোখ দুটো খুলে ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকালাম। সে তার নাকের ডগার কিছুর ক্রিম নিয়ে আমার নাকের ডগায় লাগিয়ে দিলো। ক্ষণিকের মধ্যে এসব ঘটে যাওয়ায় আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। গাল দুটো তখনি লাল টুকটুকে হয়ে উঠলো বোধহয়। আমাকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে মুখর আরও কিছুক্ষণ হাসলো। আমার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠে,
‘আপনি তো পুরো টমেটো হয়ে গেছেন, মিস.তিথিয়া!’
হঠাৎ ফিসফিস করায় আমি কেঁপে উঠলাম কিছুটা। আমার কানটাও মুহুর্তে গরম হয়ে উঠলো। কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছে সবকিছুই। ছেলেটা কি আমায় লজ্জা পাওয়ার সময়টুকুও দেবে না? আমি দু’হাতে আমার মুখটা চেপে ধরলাম। এ মুহুর্তে খুব করে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে আমার। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো,
‘আমায় এমন হুটহাট চমকে দেওয়া কবে বন্ধ করবেন, মুখর সাহেব?’
এর মাঝে টেবিলে রাখা মুখরের ফোনটা শব্দ করেই বেজে উঠলো। সাথে আমার ধ্যানভঙ্গ হলো। মুখর ফোনটা হাতে নিয়ে চওড়া এক হাসিতে মেতে উঠলো। ফোনটা রিসিভ করে কোমল সুরে বললো,
‘আসসালামু আলাইকুম মা, কেমন আছো?’
মুখরের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস। যা দেখে আমার মনটাও জুড়ে গেল সাথে সাথে। মুগ্ধ হুল্লোড় করে ভাইয়ের পাশে এসে বললো,
‘আম্মু ফোন করেছে? ভাইয়া, আমাকে দাও! দাও না।’
মুখর ফোনটা লাউডস্পিকারে দিয়েছে। তার ফোনে কিছুদিন যাবৎ সমস্যা হওয়ায় লাউডস্পিকারেই কথা বলতে হয়। ওপাশ থেকে মিষ্টি এক স্বর ভেসে উঠে বললো,
‘মুগ্ধ আব্বা! কেমন আছে আমার বাবা টা? কেমন গিয়েছে আজকের জন্মদিন তার?’
আমার মনটা ভেতর থেকে বলে উঠলো,
‘আহা! শাশুড়ী মা দেখছি বেশ অমায়িক! কি সুন্দর করেই না কথা বলছে।’
মুগ্ধ অভিযোগের সুরে বললো,
‘তুমি এবারেও আসলে না এখানে। আমি রাগ করেছি, আম্মু!’
ওপাশ থেকে অমায়িক মানুষটা আবারো বললো,
‘রাগ করেনা, আব্বা! আমি পরেরবার সত্যিই আসবো, প্রমিস করলাম!’
এভাবে মুগ্ধ তার মায়ের সাথে প্রায় পাঁচ মিনিট কথা বললো। আজকের সব গিফটের বিবরণ দিলো সে এক এক করে। তার চোখ জুড়েও ঝরছে আনন্দের ঝিলিক। মুগ্ধের সাথে কথা বলা শেষে মুখর ফোনটা নিয়ে মায়ের সাথে কথা বলতে তার রুমে চলে গেল। এদিকে আমি, রূপন্তী আর মুগ্ধ লুডু খেলতে বসলাম। খেলাটা প্রায় ৪০ মিনিট চললো। যথারীতিই হারলো মুগ্ধ। ছোট বলে গুটিদের ঠিকভাবে বসাতে পারেনি। তাই হেরে গেছে। পরের কয়েক মিনিট হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চললো আমার আর রূপন্তীর। মেয়েটাকে দেখে আলালের ঘরে দুলালি মনে হলেও খেলাধুলায় মোটামুটি দক্ষ মনে হলো। এক-এক ব্যবধানে হেরে গেলাম আমি। মুগ্ধ আমার হেরে যাওয়াতে প্রথমে হো করে চিৎকার পেড়ে উঠলো। আমি কান্নামাখা কণ্ঠে তাকে বললাম,
‘আমি হেরেছি তাই তুমি খুশি হয়েছো,মুগ্ধ?’
মুগ্ধ তৎক্ষণাৎ জিভ কাটলো। সাথে সাথে নিজেকে শুধরে গোমড়ামুখে বললো,
‘একদমই না। আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি, ম্যাম! চলুন আরেক রাউন্ড খেলি।’
তার একথায় আমি ঘড়ি দেখলাম। কিছুক্ষণ পরই মাগরিবের আজান দিয়ে দেবে। এখনই যদি না বেরোয় তবে কপালে শনি আছে আমার! মুগ্ধকে আশ্বস্ত করে বললাম,
‘পরে একদিন খেলবো বাবা! আজ দেরি হয়ে যাচ্ছে ম্যামের!’
মুগ্ধ ভাব দেখিয়ে বললো,
‘ভাইয়ার সাথে এক ম্যাচ খেলবেন। কেউই আমার ভাইয়ার মতো লুডু খেলতে পারে না।’
আমিও তার হাতের সাথে হাত মিলিয়ে বললাম,
‘ওকে, চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড!’
বেরিয়ে পড়বো তাই মুখরকে জানাতে ভেতরে গেলাম। তার রুমের দরজাটা হাট করে খোলা। সেদিকে উঁকি দিয়ে দেখলাম মুখর এখনো তার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছে। আমি চলে যেতে নিয়ে আবারো দাঁড়িয়ে পড়লাম। কেননা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু আমার কর্ণকুহরে ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে।
‘ঠিক আজকের দিনেই তোর বাবাটা আমাদের ছেড়ে চলে গেল রে, আব্বা! এ কথাটা আমি এখনো মানতে পারছি না রে।’
ওপাশ থেকে মুখরের মা ফুঁপিয়ে বলে উঠলেন। মুখর এক গাঢ় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘মা, আজ গোটা সাত বছর হলো বাবার এক্সিডেন্টের। তুমি এখনো এই ঘটনা ভুলতে পারছো না?’
‘তুই কি ভুলতে পেরেছিস? যারা এই কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয়েছে তারা কি ভুলতে পেরেছে? কখনোই কি ভুলতে পারবে? বললেই কি ভুলে থাকা যায়?’
‘আমি ভুলে গিয়েছি, মা। ভুলে গিয়েছি সবকিছু!’
‘সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও তুই আমাকে ফাঁকি দিতে পারবি না, আব্বা। তোদের সাথে না থাকি, কিন্তু মায়ের মন সবই বোঝে। আমি জানি এখনো তুই সাত বছর ধরে প্রতিটা দিন রাত জেগে কেঁদে যাচ্ছিস। আমি জানি রে, তুই এখনো সেদিনের নিষ্ঠুর দূর্ঘটনাটা ভুলতে পারিসনি।’
মুখর নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।
‘ঐ রূপন্তী মেয়েটা আজও এসেছে তাই না?’
‘হ্যাঁ!’
‘কেন আসতে দিস মেয়েটাকে? এতো বড় একটা ক্ষতি করে গেল আমাদের, তারপরও তুই কেন মেয়েটাকে লাই দিচ্ছিস?’
মুখর এবারো কিছু বললো না। সে চুপচাপ তার মায়ের প্রত্যেকটা শব্দ শুনলো। আমি এটুকু কথোপকথন শুনে আর দাঁড়াতে পারলাম না। মনের কোথাও সুক্ষ্ম ব্যাথা অনুভূত হলো। এই ছেলেটা মনের মাঝে এতো কিছু দেবে কিভাবে বসে আছে? ঠিক কতোটা শক্ত তার এই খোলস? এই খোলস ভেদ করে দুঃখেরা বেরিয়ে আসতে চাইছে না? মুখর কি পারছে না কেঁদেকেটে সবটাই বের করে দিতে?
আর রূপন্তী? মুখরের মা কেন মেয়েটার নাম নিলো? রূপন্তী কি জড়িত তার বাবার এক্সিডেন্টে?
(চলবে)
#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_১৭
#তাশরিন_মোহেরা
বিরসমুখে ড্রয়িংরুমে এসে হাজির হলাম আমি। কিছুক্ষণ আগে মা-ছেলের কথোপকথন আমায় ভীষণ ভাবাচ্ছে। রূপন্তীর দিকে আড়চোখে একবার দেখলাম। কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে সে। যাওয়ার জন্য সেও একদম প্রস্তুত। মুগ্ধ এর মাঝে বলে উঠে,
‘আপনারা একটু দাঁড়ান। আমি ভাইয়াকে ডেকে আসি।’
পরপরই সে মুখরকে ভেতরের রুম হতে ডেকে আনলো। তবে মুখরকে দেখে বোঝার উপায় নেই খানিকক্ষণ আগে সে হাজার দুঃখে জর্জরিত ছিলো। ছেলেটা এতো ভালো অভিনয় কিভাবে পারে? তবে মুখরকে একটু ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝলাম ছেলেটার চোখে এখনো দুঃখ ঝরছে। মানুষ যতই অভিনয় করুক, যতই নিজেকে মিথ্যা হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলুক, নিজের চোখ কখনো মিথ্যা দিয়ে ঢাকতে পারে না!
মুখর রূপন্তীকে বললো,
‘গাড়ি কি চলে এসেছে তোমার জন্য?’
‘হ্যাঁ, এখনই এসে পড়বে। এইতো এসে গেছে!’
রূপন্তী ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো। মুখর বলে,
‘আচ্ছা চলো, তোমাকে এগিয়ে দেই।’
পরক্ষণেই আমার দিকে ফিরে বলে,
‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন, মিস.তিথিয়া!’
আমার ইহজগতের কিছুতেই যেন খেয়াল নেই। মাথায় গুঁজে থাকা একগুচ্ছ ভাবনা সবটা এলোমেলো করে দিচ্ছে আমার। আমি ভাবনায় বুদ হয়ে মাথা দুলালাম শুধু।
মুখর এসে আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আমি একবার ক্ষীণ স্বরে বললাম,
‘আমি একা-ই যেতে পারবো, মুখর সাহেব।’
মুখর প্রত্যুত্তরে বলে,
‘কতক্ষণই বা লাগবে? আর এই সন্ধ্যেবেলা আপনাকে একা যেতে দেওয়াটা কি ঠিক হবে, বলুন?’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। মন মেজাজ একদমই ঠিক নেই! যতই চিন্তা করি পাশের মানুষটাকে কষ্ট দেবো না ততই যেন তার উপর দায়িত্ব আরো বেশি পরিমাণে ফেলে দেই। ছেলেটা বাবার শোকটাও ঠিক মতোন পালন করতে পারলো না!
সন্ধ্যের আলোতে চারপাশ একটু অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। খোলা রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে আমার। আজ সেদিনের মতো অস্বস্তি কাজ করছে না। হালকা হিমেল হাওয়ায় মন প্রাণ ছুঁয়ে যাচ্ছে ভালোলাগায়।
মুখর পকেটে দু’হাত গুঁজে সামনে এগোচ্ছে। তার দৃষ্টি সামনেই নিবদ্ধ। আর আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ তার দিকেই। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমি নিজের অজান্তেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম,
‘মুখর সাহেব, আপনার এই কঠিন ব্যক্তিত্বের পেছনে কোনো দুঃখজনক কাহিনী নেই?’
মুখরকে যেচে দেখলাম সে আমায় তার দুঃখের কাহিনী বলে কিনা! তবে মুখর মুখরই! যত কিছুই হোক, নিজের শক্ত খোলস এতো সহজে সে খুলছে না। সে যথারীতি বললো,
‘আছে! সবার জীবনেই দুঃখজনক কিছু না কিছু আছে।’
চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার কথা শুনলাম। কিছু সময় নীরবতা পালন করে মুখর আমায় অবাক করে দিয়ে মুখ খুললো,
‘জানেন, মিস.তিথিয়া? আমার মন খোলা আকাশের মতো স্বচ্ছ নয়, বরং এই মন জালের মতো কঠিন, হযবরল! মাঝে মাঝে নিজের মনকেই আমি যেন বুঝে উঠতে পারি না।’
মুখে একটা মলিন হাসি এঁটে আমাকে দেখলো মুখর। হঠাৎই বুক ভেঙে কান্না এলো আমার। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে আমার! ছেলেটাকে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, মুখর সাহেব।’
কিন্তু এমনটা করার সাধ্যি নেই আমার। জানি না কখনো সাধ্যি হবে কিনা! কেননা আমার ভালোবাসাটা অনিশ্চিত! কাউকে পাবো না ভেবেও তার প্রতি টান অনুভব করাটাই বোধহয় ভালোবাসার প্রকৃত সত্য!
একটা পার্কের কাছাকাছি এসেছি আমরা। কিছুদূর হেঁটে গেলেই আমার বাসা। আমি অনুরোধের সুরে মুখরকে বললাম,
‘আপনি এবার ফিরে যান, মুখর সাহেব। এটুকু পথ আমি নিজেই যেতে পারবো।’
ক্ষীণ সুরে বললো মুখর,
‘খোলা হাওয়ায় হাঁটতে ভালোই লাগছে। তাছাড়া আপনার বাসার গলি পর্যন্ত না হয় আপনাকে এগিয়ে দিয়ে এলাম। সমস্যা তো নেই, তাই না?’
ব্যাগটা হালকা তুলে বললাম,
‘তা তো নেই।’
তবে আমি জানতাম না আমার জন্য ভবিষ্যতে এতোবড় একটা সমস্যা অপেক্ষা করছে। হাঁটার মাঝপথে আজ আবারো আব্বাকে চোখে পড়লো আমার। ভ্রুটা কুঁচকে ভালোভাবে দেখলাম। আব্বা আমার দু’হাট মুট করে পেছনের দিকে নিয়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। আমি উপায় না পেয়ে আবারো মুখরকে টান মেরে বসিয়ে দিলাম। তবে আজ তার হাত নয় বরং তার কলার ধরে টান মেরেছি আমি। কলারের টান খাওয়ায় বেচারা ভীষণ চমকে উঠলো। একটা গাছের কোণায় মুখরকে নিয়ে বসে পড়লাম। মুখটা বিকৃত করে বলে উঠলাম,
‘খোদা, বারবার আমার সাথেই কেন এসব হয়?’
কিছুক্ষণ যেতেই খেয়াল করলাম আমি আর মুখর মুখোমুখি বসে আছি তবে খুব কাছে। আমার মাথা তার বুক ছুঁইছে। মুহুর্তেই লজ্জায় মাথা কাটা গেল আমার। মুখর বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘মিস.তিথিয়া? আমরা হঠাৎ এভাবে বসে পড়লাম কেন?’
আমি তার ঠোঁটে তর্জনী চেপে বলে উঠলাম,
‘চুপ! কোনো কথা বলবেন না এখন।’
ফিসফিসিয়ে ধমকালাম আমি। মুখর এই ধমকে নিঃশব্দ হয়ে গেল। মনে মনে আয়াতুল কুরসী পাঠ করছি। আর দোয়া করছি আব্বা যাতে এদিকটায় না আসে! আমায় বিড়বিড় করে দোয়া পড়তে দেখে মুখর ঠোঁট টিপে হাসছে। আমার খুব রাগ হলো। একে তো আমি জীবন-মরণ অবস্থায় আছি, আর লোকটা হাসছে?
‘কিরে? তিথি মা না?’
এ কথায় দুজনেই শিউরে উঠলাম। গাছের অপর পাশে কিছুদূরেই দাঁড়িয়ে আছেন আব্বা। ভয়ে আঁতকে দুজন দুজনের দিকে তাকালাম। এদিকটা সামান্য অন্ধকার, কিন্তু আব্বা কিভাবে টের পেল আমাকে? আমি তৎক্ষণাৎ সাতপাঁচ না ভেবে মুখরকে ধাক্কা মেরে চট করে উঠে দাঁড়াই। আব্বা যখন আমায় চিনেই ফেলেছে তাই এখন লুকিয়ে আর লাভ নেই! আব্বার দিকে ফিরে অপ্রস্তুত হাসলাম আমি। আব্বা আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘আরে, তিথি-ই তো! কিরে মা, এখানে কি করছিস?’
আব্বাকে দেখে পুরো হাত-পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। কি করবো, কি বলবো কিছুই বুঝে উঠছি না। আমতা আমতা করে কোনোরকমে বললাম,
‘আব্বা আমার ফোনটা এদিকে পড়ে গিয়েছিলো তাই এটাই নিচ্ছিলাম আরকি! হাহা।’
আব্বাও বুঝতে পারার মতো ভান করে বললো,
‘আচ্ছা, আচ্ছা!’
আমি পেছন ফিরে একবার দেখলাম। কিন্তু অন্ধকারে মুখর সাহেবকে ঠিক বোঝা গেল না। আব্বা সামনের দিকে এগিয়ে বললো,
‘চল তাহলে একসাথে যাই।’
আমি অন্যমনস্ক হয়ে পেছন ফিরে বারবার দেখছি। মুখর সাহেবকে ধাক্কা মেরে তাকে ছাড়া যেতেও মন সায় দিলো না। পা টা অবশ হয়ে এসেছে আমার। আব্বা আবার আমার দিকে ফিরে বললো,
‘কি হলো চল!’
অগত্যা আব্বার পিছু পিছু চলে গেলাম। লোকটাকে কাল সকালবেলা গিয়েই সরি বলতে হবে! একটা সরিতে কি হবে তার? আচ্ছা, সাথে একটা চকলেটও নিয়ে যাবো প্রয়োজন হলে।
মুখরের কথা ভাবতেই দেখি ফোনে ভাইব্রেট হলো। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এসেছে। মেসেজ দেওয়া ব্যক্তিটি মুখর। সে লিখেছে,
‘আব্বার ভয়ে যে এমন এক ধাক্কা দিলেন, ঠোঁটের একপাশ থেকে রক্ত পড়ছে।’
মুখর সাহেব রক্তাক্ত হয়েছে শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম আমি। ধাক্কাটা একটু জোরেই দিয়ে দিয়েছি বোধহয়। হায় হায়! কি হবে এখন?
আমি ঘাবড়ে প্রশ্ন ছুড়লাম,
‘মুখর সাহেব, আপনি বাঁচবেন তো?’
ওপাশ থেকে এবার মেসেজ এলো,
‘জানিনা, তবে আপাতত আইসিইউতে রাখা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
মেসেজ দেখে আপনাআপনি হেসে দিলাম। লোকটা এই অবস্থায়ও মজা করছে! অপর পাশ থেকে আবারো মেসেজ এলো,
‘আমার এই ক্ষতের জন্য কিন্তু আপনার জরিমানা দিতে হবে!’
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম,
‘জরিমানা? কিন্তু কেন?’
‘কেন আবার? এই যে বিনা কারণে আমায় আহত করলেন!’
‘তা জরিমানা হিসেবে কি দিতে হবে?’
‘তা তো কাল এলেই জানতে পারবেন।’
ছেলেটা তো আস্ত এক বদমাইশ! এভাবে আমায় অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিলো? জরিমানাটা যে কি তা না জানা অবধি কি আমার আজ রাতে ঘুম হবে?
(চলবে)