অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব-২৭+২৮

0
333

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২৭
#তাশরিন_মোহেরা

রাস্তায় আমার পাশে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছে মাহদী। আর সামনেই এগিয়ে যাচ্ছে তানজীব, রাদিফ আর সরব। কিছুদূর যেতেই তানজীবের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল। মাহদীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে চলে গেল ডানপাশে!
রাস্তায় এখন চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছি আমরা চারজন। সুনশান নিরবতা ভাঙতেই মাহদী হঠাৎ আমায় বলে উঠলো,

‘তিথিয়া, রাইট?’

আমি হালকা হেসে মাথা দুলালাম। সে বললো,

‘তুমি করে বলতে পারি?’

আমি প্রত্যুত্তরে বললাম,

‘হ্যাঁ, অবশ্যই ভাইয়া!’

মাহদী আমার বড় হিসেবে তাকে ভাইয়া ডাকাটা স্বাভাবিক। মাহদী এবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘মুখরের সাথে তোমার সম্পর্কটা কতোদিনের?’

আমি একটু ভেবে বললাম,

‘এই যে ধরুন, প্রায় সাত-আট মাস তো হবেই!’

মাহদী খানিকক্ষণ চুপ থাকলো। রাদিফ আর সরব আমাদের সামনেই হাঁটছে। রাদিফ কিছুক্ষণ পর পর পিছু ফিরে আমার দিকে চাইছে বারবার। আমি নিজেকে বারবার বলে যাচ্ছি, এসব নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার! কেননা মুখরের বন্ধুদের পূর্বপরিচিত আমি নই। নতুন কাউকে দেখে তাদের আগ্রহ জন্মানোটা আসলেই স্বাভাবিক ব্যাপার!

হঠাৎই মাহদী বেশ উৎসুক হয়ে উঠলো। মনভোলানো এক হাসি হেসে বললো,

‘আমি কখনো দেখিনি মুখর কোনো মেয়েকে এতোটা প্রায়োরিটি দিচ্ছে!’

আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘মানে?’

সেও প্রত্যুত্তরে ফিসফিসিয়ে বললো,

‘তার মানে মুখরের কাছে তুমি অনেক স্পেশাল। আমাদের স্যার কিন্তু কোনো মেয়েকেই তার পাশ ঘেঁষতে দেয় না এতো সহজে!’

মাহদীর কথা শুনে চমকালাম আমি। সাথে শরীর জুড়ে ছেয়ে গেল অন্যরকম কিছু। মাহদীর দিকে আড়চোখে তাকাতেই দেখলাম সে রাদিফের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে! রাদিফও সরবের কাঁধে হাত দিয়ে ইশারায় হাসলো মনে হলো। কিন্তু আমার মন মেজাজ এখন অন্যদিকে। কানে বাজছে বারবার এটাই, ‘মুখরের কাছে তুমি অনেক স্পেশাল।’

আমিও খেয়াল করেছি আজ, মুখর কথা বলার মাঝে অধিকাংশ সময়েই আমার দিকে আড়চোখে চেয়েছে, হেসেছে! তাকে অনেকদিন পর দেখেছি বলে চোখ সরাতে পারছিলাম না আমি। এতোদিনে মুখরকে দেখার তৃষ্ণাটা তরতর করে বেড়েছে বৈকি! তাই যতবারই মুখর আমার দিকে তাকিয়েছে ঠিক ততবারই তার সাথে চোখাচোখি হয়েছে আমার! তবে ব্যাপারটাকে অতোটা গুরুত্ব দেইনি। নিজে নিজেই কোনো কিছু আশা করাটা বোকামি, তাও মুখরের কাছ থেকে, যা অসম্ভব! কেননা এর আগেও অনেকবার ধোঁকা দিয়েছে এ ছেলে আমায়!
কিন্তু এখন মাহদীর কথা শুনে মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হলো। খুশিতে মনটা নেচে উঠলো! মন মাঝারে বললাম, ‘আপনার উদ্দেশ্যটা কি, সাহেব?’

পরক্ষণেই আবার রূপন্তীর কথাটা মাথায় খেলে গেল। রূপন্তীকেও মুখর প্রায়োরিটি দিয়েছে খুব! প্রথমদিকে তো আমি একপ্রকার ভেবেই নিয়েছি যে, এই মেয়ে-ই ছেলেটার প্রেমিকা। তাই মাহদীকে একরাশ অভিমানী সুরে বললাম,

‘আমি কখনোই মুখর সাহেবের কাছে স্পেশাল ছিলাম না। রূপন্তী মেয়েটাকেও তিনি একইভাবে ট্রিট করতেন, হু!’

এ কথায় তড়িৎ ফিরলো তিনজনই। যেন এরা কিংকর্তব্যবিমুঢ় আমায় কথায়! আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে, একে অপরের সাথে ইশারায় কিছু বললো। তারপরই হো হো করে হেসে উঠলো মাহদী আর রাদিফ। সরবও মিটিমিটি হাসছে। আমি তাদের হাসি দেখে বোকা বনে গেলাম মুহূর্তেই। এদের অট্টহাসিতে কেমন অপমান বোধ করলাম। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই রাদিফ হাসি থামিয়ে বললো,

‘আরে! এ তো সবটা নাটক ছিল। রূপন্তীর বাবা যাতে মুখরকে সন্দেহ না করে এজন্যেই মুখর ঐ পেইনফুল মেয়েটাকে সহ্য করেছে!’

কথাটা আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই বারবার বাজলো কানে। কি শুনছি আমি? মুখর নাটক করেছে মানে? রূপন্তীর সাথে অভিনয় করেছে মানে? সত্যি? উত্তেজনায় দেহটা গরম হয়ে উঠেছে। উত্তেজনাটুকু ঢাকতে না পেরে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে বললাম,

‘সত্যিই?’

আমার চোখ দুটো টলমল করছে খুশিতে। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো খুশির খবর শুনলে বোধহয় এমনি হয়। ঠিক তখনি হঠাৎ নিরবতা নামিয়ে মাহদী বলে উঠে,

‘এই বাবা-মেয়ে খুব জ্বালিয়েছে মুখরকে। ছেলেটা তিলতিল করে গড়ে তুলেছে এরশাদ মুত্তাকীর বিরুদ্ধে হাতিয়ার! আর এজন্য তাকে কতো কি সইতে হয়েছে। আজ অনেকদিন পর তোমার দিকে তাকিয়ে মুখরকে হাসতে দেখলাম, তিথিয়া। সত্যিই খুব খুশি হয়েছি আমরা!’

মাহদীর কথায় আমার মুখরের জন্য বুকটা মুচড়ে উঠলো। ছেলেটা আসলেই নিজেকে শক্ত খোলসে বন্দী করে রেখেছিল এতোদিন। কাউকেই জানতে দেয়নি তার কষ্টের কথা! মানুষটা এমন কেন?

যেতে যেতে অনেক কিছুই বললো মাহদী আমায়। যা আমি কখনোই মুখরের কাছ থেকে জানতে পারতাম না। এই যেমন,

সুলেমান শাহ্ এর সাথে মুখরের কাটানো সব মুহূর্তই মুখরকে আবারো নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। লোকটার সাথে মিশে সে নিজের বাবা হারানোর কষ্টটা দমাতে পেরেছে। সুলেমান শাহ্ও একসময় এরশাদ মুত্তাকীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তার একমাত্র মেয়েকে এভাবেই এরশাদ মুত্তাকীর হাতে মরতে দেখেছিলেন তিনি। এ বেদনায় ব্যাথাতুর হয়েই তিনি মুখরের সাথে প্রতিশোধের অনলে জ্বলে উঠেন আবার! মুখরের মাঝে এরশাদ মুত্তাকীর জন্য তীব্র রাগই সুলেমান শাহ্কে প্রেরণা জুগিয়েছে উল্টো! মুখরের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জোরেই এরশাদ মুত্তাকীর দূর্বলতাগুলো খুঁজে পেয়েছিলো এজেন্সির সবাই। আর এই দূর্বলতার একটি হলো তার মেয়ে, রূপন্তী। তাই-ই মুখরকে রূপন্তীর ভালোলাগাটার সুযোগ নিয়ে তার সাথে অভিনয় চালিয়ে যেতে হয়েছে।

আর আমি কিনা ভেবেছি রূপন্তীর সাথে.. ছিঃ ছিঃ! কি ভুলটাই না বুঝলাম ছেলেটাকে আমি! নিজের উপরই ভীষণ রাগ হলো।

চলতে চলতে একসময় বাসার কাছে এসে পড়লাম। বাসার গলিতে ঢুকতে গেলেই ডাক পড়লো আমার। সরব ডেকেছে! আমি তার সামনে এলেই সে আমতা আমতা করতে থাকে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলছে না সে! আমার অবাক লাগলো। এমন গম্ভীর ছেলেটার আমার সাথেই বা কি কথা আছে! অনেকক্ষণ পর সে মাথাটা তুললো। আমায় খানিক ইতস্তত করে বললো,

‘আমি খুবই দুঃখিত, তিথিয়া! সেদিন আপনার পিছু দৌঁড়ানোর জন্য।’

আমি তার কথায় কিছুক্ষণ ভাবলাম। এই ছেলে কি বলছে এসব? কখনই বা সে আমার পিছু দৌঁড়ালো। আমি মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘বুঝতে পারিনি!’

সে আমায় পুরো ঘটনা খুলে বলার পর আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেন। আমি এতোদিন যেটাকে স্বপ্ন বলে চালিয়ে দিয়েছিলাম তা আসলে সত্যি! মুখরের পিছু নেওয়ার জন্য এরশাদ সাহেব একজন গুপ্তচর লাগিয়ে দিয়েছিলো, যাকে মারতেই সরবের সেদিন ঐ চিপা গলিটায় ঢোকা! আর আমি তার পিছু নিতে গিয়ে দিগবিদিক হারিয়ে দৌঁড়াতে থাকলে মুখর আমায় বাঁচায়। অজ্ঞান আমাকে কোলে নিয়ে সে ভার্সিটি দিয়ে আসে। রূপক ভাইকেও সবটা খুলে বলে মুখর! সেখান থেকেই রূপক ভাইয়ের মুখরকে চেনা! আমি হতভম্ব হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজের স্বপ্ন বলে সবার কথাকেই আমি এড়িয়ে গিয়েছি। কিন্তু তখনি ভাবলাম, মুখর যে আমায় কোলো নিলো, তা নিশ্চয়ই কোনো হিরো-হিরোইনের মতো নেয়নি! কেননা এর আগে মুগ্ধের মুখে মুখরের আমায় কোলে নেওয়ার সংজ্ঞা শুনে অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে আমার!
সরবকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আচ্ছা? মুখর সাহেব আমায় কিভাবে কোলে নিয়েছে?’

সরব, রাদিফ আর মাহদী তিনজনই এ প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে! যেন মহাপাপের কিছু বলে ফেলেছি আমি! সরব আমার দিকে চেয়ে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো,

‘একটা ছেলে একটা মেয়েকে নরমালি কিভাবে কোলে নেয়? এইভাবেই তো?’

সে ইশারায় পাজাকোলে নেওয়ার মতো করেই বোঝালো আমায়। কিন্তু আমার তা বিশ্বাস হলো না! মুখর সাহেব কিছুতেই আমাকে সিনেমার নায়িকাদের মতো কোলে নিতে পারেন না। তিনি নিশ্চয়ই আমাকে সিনেমার ভিলেনদের মতো কোলে তুলেছে! ঠিক যেমনটা মুগ্ধ বলেছিলো!

প্রচুর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে বাড়ি পৌঁছালাম আমি। নিজেকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছি না আসলে মুখর আমাকে ঠিকভাবে কোলে নিয়েছে। এতো ভাবাভাবিতে কাহিল হয়ে পড়লাম। রুমে ব্যাগটা রেখে কোনোমতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি, এমন সময় বাবা দরজা ধাক্কালো। দরজা খুলেই বিরক্ত হয়ে বললাম,

‘সবেমাত্র এলাম, আব্বা! একটু রেস্ট দরকার।’

আব্বার উল্টো রাগ নিয়ে বললো,

‘তুই এখন এসেছিস? ক’টা বাজে?’

ক্লান্ত ঠোঁটটা কোনোরকম নাড়িয়ে বললাম,

‘কাজ ছিলো তো, আব্বা!’

আব্বা দরজায় সজোরে আঘাত করে ফেটে পড়লো হঠাৎ। চিৎকার করে বললো,

‘কি এমন কাজ ছিল যে তোর এতোক্ষণে বাড়ি ফিরতে হলো, হ্যাঁ? আমায় চিন্তায় রেখে খুব শান্তি পাস তুই, তাই না?’

আব্বার এমন অতিরিক্ত চিন্তা দেখে মেজাজটাই বিগড়ে উঠলো। কিন্তু কিছু বললাম না! কেননা মানুষটাকে এখন কিছু বললেই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আব্বা এবার অনেকটা শান্ত অথচ গম্ভীর স্বরে বললেন,

‘কাল থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ তোর! মনে রাখিস!’

(চলবে)

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২৮
#তাশরিন_মোহেরা

‘কাল থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ তোর! মনে রাখিস!’

আব্বার এ প্রশ্নে ভীষণ চমকে উঠলাম আমি। বাইশ বৎসরের এক যুবতী মেয়েকে কিনা ইনি বলছেন বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ! এমনিতেই ক্লান্তিতে শরীরটা নুইয়ে এসেছে, তার উপর মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার মতো একটা কথা বলে দিলেন আব্বা। রাগে ফেটে পড়ে বললাম,

‘আপনার কি বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে, আব্বা? এসব কি আবোল তাবোল বলছেন? পাগল হয়ে গেছেন আপনি?’

আমার কথায় আব্বা দ্বিগুণ ফেটে পড়ে বললেন,

‘হ্যাঁ, আমি তো পাগলই! বুদ্ধিসুদ্ধি শুধু তোর আর তোর মায়েরই আছে। তাই তো তোর মা আমার মতো পাগলকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আর তুই? তুইও তোর মায়ের পথে চলছিস, তাই না? তাই তো, এখন রাত বিরেতে ঘরে ফেরা হয় তোর! একা মানুষটার প্রতি কোনো খেয়ালই নেই তোর। পাগল বলেই আজ এসব করছিস!’

আব্বার কথায় হঠাৎ ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলাম আমি। যা আমি কখনো ভেবেই দেখিনি আব্বা তা নিয়ে আমায় কথা শোনাচ্ছেন। হ্যাঁ, মাঝে মধ্যেই আমার আব্বার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে মন চায়। কিন্তু কখনোই তো পালায়নি তাই না? সবসময়ই একটা পিছুটান কাজ করেছে আব্বার জন্যে! তারপরও আব্বা এমন কথা কি করে বললেন?

আব্বা বকবক করতে করতে আমার রুম ছাড়লেন। নিজের রুমে আজ বেশ খানিকক্ষণই বকবক করবেন তিনি। আমি দরজার কাছেই বসে পড়ি। আব্বার কাছে এমন খারাপ কবে হলাম আমি? কিই বা এমন করলাম যার কারণে লোকটা আমায় এভাবে কথা শোনাচ্ছে? মুখরকে ভালোবেসেছি বলে, আব্বার পরে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে তাকে ঠাঁই দিয়েছি বলে আব্বা আমায় এতো কিছু বললেন? এই হিংসে নিয়ে আব্বা বাঁচবেন কি করে দুনিয়ায়? আমিই বা পাগলের মতো কি করে ভাবছি মুখরকে নিজের জীবনসঙ্গী বানানোর?

কান্নার মাঝপথে ফোনটা হঠাৎ শব্দ করে বেজে উঠলো। ফোনের রিংটোনে বাজছে মুগ্ধের কচি আওয়াজ! সে আদো আদো কণ্ঠে বলছে ‘আতা গাছে তোতাপাখি’ কবিতাটি। চার বছর বয়সে মুগ্ধের কবিতা বলাটা রেকর্ড করে রাখে মুখর। আমার রেকর্ডিংটা খুবই পছন্দ হওয়ায় মুখরের কাছ থেকে তা নিয়ে রিংটোনে লাগিয়ে দেই।
কান্নার মাঝেও মুগ্ধের আদুরে সুরটা শুনে আমার কিছুটা হাসি পেয়ে গেল। ফোনটা বিছানার উপর থেকে তুলতেই দেখি মুখর ফোন দিয়েছে। ভেজা চোখে স্ত্রিনটা ঝাপসা লাগছে। তাই ভুল দেখেছি কি না তা নিশ্চিত হতে চোখের পানিগুলো মুছে নিলাম। ভালো করে তাকাতেই দেখলাম আসলেই মুখর ফোন দিয়েছে। মুখরের কথা-ই মনে মনে ভাবছিলাম বলে, ফোনের স্ত্রিনে মুখরের নামটা ভেসে উঠায় আবারো ডুকরে কান্না পেয়ে গেল আমার। কিন্তু ফোনটা রিসিভ করলেই কান্নামাখা ভাঙা স্বরটা শুনতে মুখরের মোটেও ভালো লাগবে না। এই ভেবে ঢোক গিলে কান্নাটুকু থামালাম। গলাটা খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নিলাম কিছুটা। পরপর নিজে নিজে ‘হ্যালো, হ্যালো’ বলে দেখলাম গলাটা পরিষ্কার হয়েছে কিনা! মুখরের সাথে কথা বলার এতো আয়োজনের মাঝে রিং আসাটা বন্ধ হয়ে গেল। মিসড কল হয়ে গিয়েছে! দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। মুখরের সাথে যখন কথাটাই বলা হলো না তখন এতো আয়োজন করেই বা কি হবে? বালিশে মুখ গুঁজে আরেক দফা কান্নাকাটি করার প্রস্তুতি নিতেই দেখলাম আবারো রিং হচ্ছে ফোনে। তড়িৎ ফোন তুলেই দেখলাম মুখর আবারো ফোন করছে! উত্তেজনার বসে সাথে সাথেই ফোন রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে ভরাট কণ্ঠে মুখর বলে উঠলো,

‘হ্যালো, মিস.তিথিয়া?’

আওয়াজটুকু শুনেই আমার মনটা ভরে উঠলো কিছুটা। জর্জরিত ঠোঁটে ক্ষীণ এক হাসি ফুটলো। আমিও প্রত্যুত্তরে তাকে বললাম,

‘হ্যালো, মুখর সাহেব!’

কিন্তু মুহুর্তেই লজ্জায় পড়তে হলো। গলাটা ফাটল ধরে ভীষণ কর্কশ শোনালো। ঠিক কাকের মতোই! যে ভয়টা পাচ্ছিলাম ঠিক তা-ই হতে হলো। ফোনটা সাথে সাথে লজ্জায় চেপে ধরলাম বুকে।
আবারো কানে দিয়ে দেখলাম মুখর বলছে,

‘কি হলো, মিস.তিথিয়া? আপনি ঠিক আছেন? কণ্ঠটা এমন শোনালো কেন?’

আমি চোখ খিঁচে বসে রইলাম চুপচাপ। গলাটা বসেছে ভীষণ! কান্নাও পাচ্ছে হালকা। এ মুহুর্তে কোনো শব্দ বের কর‍তে গেলেই গলাটা বাঁশের মতো শোনাবে। ওপাশেও কিছুক্ষণ নিরবতা চললো। কিছু সময় পর, মুখর বলে উঠলো,

‘আপনি শুনছেন তো, মিস.তিথিয়া? কাল থেকে মুগ্ধকে নিয়মিত পড়াতে আসতে পারবেন। সামনেই তো বার্ষিক পরীক্ষা! কাল থেকে আসবেন, কেমন?’

আমার হঠাৎ কি হলো বুঝলাম না! ডুকরে কেঁদে উঠলাম। কান্নার মাঝেই হেঁচকি তুলে মুখরকে বললাম,

‘মুখর সাহেব, আমাকে আব্বা বাসা থেকে বেরোতে দিচ্ছেন না।’

এই বলে ভ্যাঁ করে আবারো কেঁদে দিলাম। কান্নার ঝাপটায় কথা বেরোচ্ছে না তবুও গুঙিয়ে বললাম। মুখর কোনোরকমে বুঝলো কি বলেছি। সে বেশ অবাক হয়েছে! এরপর বললো,

‘সত্যিই বেরোতে দিচ্ছে না?’

আমি কান্নার মাঝেই বললাম,

‘হ্যাঁ, আমি কি আপনাকে মিথ্যা বলবো?’

মুখর বললো,

‘আচ্ছা, আচ্ছা বুঝেছি! থাক চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

এটুকু বলেই মুখর ফোনটা কেটে দিলো। এভাবে মুখের উপর ফোনটা কেটে দিলো মুখর? কান্নাটাও ঠিকভাবে করা হয়নি আমার! এমন ধারা অপমানটা করতে পারলো মুখর? সব ঠিক হয়ে যাবে না ছাঁই! কি ঠিক হবে? আব্বা আমাকে বেরোতে দেবে না মানে দেবেই না! এটাই তার শেষ কথা! আমাকেও শেষমেশ তিনি মায়ের মতো আটকে রাখবেন। এর মাঝে কি ঠিক হবে?

মুখরের উপর মনে মনে ভীষণ রাগ হলো। রাগের চাপে আরো শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছি! জীবনে কেউ আপন নয়! সবার কাছ থেকে শুনেছি জীবনের সবচেয়ে আপনজন হলেন মা-বাবা। আমার তো মা-ই নেই আর বাবা? বাবা তো থেকেও নেই! কি দূর্ভাগা কপাল নিয়ে জন্মালাম আমি!

.

সকালবেলা আজ একটু দেরিতে উঠেছি। ভার্সিটি না থাকলে সচারাচর আব্বা-ই আমায় ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। কিন্তু কাল রাতের ঘটনার জন্য তিনি আমায় আজ ডাকলেন না। আজ তো মুগ্ধকে পড়াতেও যেতে পারলাম না। আব্বার কথার অমান্য করলে আমার শাস্তি আরো বাড়বে।

আড়মোড়া ভেঙে আয়নার সামনে নিজেকে দেখলাম। চোখ দুটো ফুলে ডিমের মতো হয়ে গেছে। কি বাজেই না দেখাচ্ছে আমায়! এমন রাতভর শেষ কবে কেঁদেছি মনে নেই! মনটা একটু হালকা লাগছে যদিও। ফোনে টাইম দেখে অবাক হলাম। দশটা বেজে পনেরো মিনিট! এতো দেরিতে উঠেছি আজ? আব্বাকে নাস্তা দেওয়ার সময়ও তো পার হয়ে গেছে। লোকটা তবে ক্ষুধার্ত থেকেছে এতোক্ষণ?
দৌঁড়ে রান্নাঘরে ছুটলাম। দেখলাম সুমি এসে পড়েছে। আব্বা পেপার খুলে রেখে টিভি দেখছেন। সুমি আমাকে দেখে বললো,

‘আফামনি, উঠছেন নি? আপনে বহেন, আমি টেবিলে নাস্তা দিতাছি।’

সুমির কথায় আব্বা আমার দিকে আড়চোখে দেখলেন, আমিও দেখলাম। আব্বার আমাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। অতঃপর সুমির দিকে তাকাতেই সে আমার চাহনি বুঝলো। বললো,

‘আপনার আব্বায় নাস্তা খাইছে। আমি দিছি নাস্তা!’

বুকে পানি পড়লো আমার। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ফ্রেশ হতে ভেতরে গেলাম।
ভাবছি আমি কেনই বা আব্বার জন্য এতো চিন্তা করছি? আব্বা তো ঠিকই আমায় ফেলে নাস্তা খেয়ে ফেলেছেন। এমন কোনো ছুটির দিন নেই যেদিন তিনি আমায় ছাড়া নাস্তা খেয়েছেন। কিন্তু আজ? উল্টো আমার উপর রাগ দেখিয়ে মুখও ফিরিয়ে নিয়েছেন। যাক! কেন শুধু শুধু আমি নিজের আত্মসম্মানটা খোয়াচ্ছি? আর চিন্তা করবো না কখনো আব্বার জন্য! কখনো না!
ব্রাশ করার এক ফাঁকে খেয়াল করলাম কলিংবেল বাজছে। কয়েকবার বেল বাজার পর আব্বা দরজা খুললেন। এই সময়ে আবার কে এলো? কৌতুহলটা মাথায় চাপতেই ব্রাশ নিয়ে রুমের বাইরে উঁকি দিলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে সাথে সাথেই আঁতকে উঠলাম আমি। অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটাও আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত নাড়িয়ে আমায় ‘হাই’ জানালো। বুকটা লাফিয়ে উঠলো প্রচণ্ড! পেস্টে ভরা মুখেই অস্ফুটে বলে উঠলাম,

‘মুখর সাহেব?’

(চলবে)