পৌষের কোন এক বিকেলে পর্ব-১০

0
272

#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ১০
অপরাজিতা অপু

দুপুর হতে না হতেই রুপমের পরিবারের লোকজন চলে এসেছে। তার বাবা মা বোন সহ আরো কয়েকজন। এতো লোকজন দেখে আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। আমি ঘরেই থেকে গেলাম। সেখান থেকে বের হওয়ার সাহস পাইনি। বাইরে কাজের ধুম পড়ে গেছে। এর ফাঁকে ফাঁকেই ভাবী আমাকে এসে দেখে যাচ্ছে। দুপুরে সবার খাওয়ার আয়োজন চলছে। মা ওনাদের যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন। এদিকে ভাবী এক প্লেট ভর্তি ভাত নিয়ে এলো ঘরে। এসেই দরজা চাপিয়ে ফিসফিস করে বললো
” এটা খেয়ে নাও। আর খাওয়ার সময় পাবে না।”

আমি মলিন মুখে বললাম
” খেতে ইচ্ছা করছে না ভাবী। পরে খুদা পেলে খাবো।”

ভাবী প্লেটটা টেবিলে রেখে আমার একদম কাছে এসে বসলো। তারপর বলল
” ঠিক আছে জোর করবো না। তবে তুমি রেডি হয়ে নাও। নিজে নিজে তো শাড়ী পড়তে পারো। তাড়াতাড়ি পরে নাও। খাওয়া শেষ হলেই তোমাকে বাইরে ডাকবে।”

আমি কোন কথা বললাম না। শুধু মাথা নাড়লাম। ভাবী আলমারি খুলে প্রতিটা শাড়ী খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে একটা খয়েরী রঙের শাড়ি এনে আমার ঘাড়ে রাখলো। একটু দূর থেকে দেখে বলল
” এটাই ঠিক আছে। এটা পরো।”

আমি দিরুক্তি করলাম না। মেনে নিলাম। ভাবী আবারো বাইরে চলে গেলো। আমি একা একা শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। হালকা সাজলাম। সাজলে নাকি মানুষের মন ভালো হয়। আমার আসলে কেনো মন খারাপ সেটা জানা নেই। তবে মন ভালো করার সব চেষ্টাই করলাম আমি। ভালো হলো কিনা বুঝলাম না। সব শেষ করে ঘরে বসে থাকলাম। বাইরের আওয়াজটা কানে এলেও স্পষ্ট কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমিও গুরুত্ব দিলাম না। যখন ডাকবে তখনই যাবো। আমি বিছানায় হেলানী দিয়ে অপেক্ষা করছি। কিন্তু অনেক্ষণ হয়ে গেলো আমাকে ডাকছে না। ভাবী যে বলেছিল খাওয়া শেষ হলেই আমাকে ডাকবে। তবে কেনো আমাকে ডাকছে না এখনো। আমি স্থির হয়ে বসে আছি। বাইরে থেকে শোরগোলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কোন ঝামেলা হলো নাতো? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। ভেতরে বসে থেকে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। কাউকে ডাকতেও পারছি না কি হচ্ছে। প্রায় আধ ঘন্টা পর আরো কয়েকজন লোক এলো। আমি দরজায় গিয়ে আড়ালে দাড়ালাম। বাইরে চোখ রাখতেই প্রথম চোখে পড়লো রুপমের দিকে। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। চেহারা দেখে তার মনের অবস্থা আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিছুক্ষণ তাকে দেখেই আমি ভেতরে এসে আবার বসলাম। তাহলে সবাই হয়তো রুপমের জন্য অপেক্ষা করছিল। যত সময় বাড়ছে আমার বুকের ভেতরে ধুকধুকানি ততই বাড়ছে। লম্বা একটা শ্বাস টেনে স্থির হয়ে বসতেই আমার ঘরের দরজায় টোকা পড়লো। আমি কাপা কাপা কণ্ঠে বললাম
” ভাবী? ভেতরে আসো। আমি রেডি।”

ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো না। তবে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো বাবা। আমি কিছুটা অবাক হলাম। বাবাকে এই মুহূর্তে আমি একদমই এক্সপেক্ট করিনি। বাবার মাথা নিচু। আমি ভালোভাবে খেয়াল করেই বললাম
” কিছু বলবে বাবা?”

বাবা এসে আমার পাশে বসলো। মাথা নিচু রেখেই বলল
” আজ তোমাকে আংটি পরানোর কথা থাকলেও সেটা হচ্ছে না।”

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। কোন প্রশ্ন করার আগেই আবার বাবা বলল
“ওনারা চাচ্ছেন একেবারে বিয়েটা পড়িয়ে দিতে। বিয়ে পড়ালে ওনারা নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। আর অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা নাহয় পরে আলোচনা সাপেক্ষে করা যাবে। রুপম কে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে সে পুরোটাই তোমার উপরে ছেড়ে দিয়েছে। তুমি যা বলবে তাই হবে। তার কোন আলাদা মতামত নেই।”

আমার বুকের ভেতরটা কেপে উঠলো। আংটি পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু বিয়ে? ভাবী যে বলল আমার হাতে অনেক সময় আছে। রুপম এর সাথে আলোচনা করতে পারবো। কিন্তু এখন তো সেরকম কোন সুযোগ পাচ্ছি না আমি। বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কিছুই বলতে পারছি না। বাবা নরম কণ্ঠে বললেন
” ওনারা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। অনেক লোক এসেছে বাইরে। শুধু তোমার একটা কথা শুনেই কাজীকে আনা হবে।”

বাবার এমন অসহায়ের মতো কথাটাও আমার বুকে বিধলো। পারলামনা না করতে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই বাবা উৎফুল্ল হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো
” তাহলে কি আমি তাদেরকে কাজী ডাকার অনুমতি দিয়ে দেবো?”

আমি মাথা নাড়িয়ে আবার সম্মতি জানিয়ে দিলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম মমতায়। তার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হলনা আমার। বেশ বুঝতে পারছি তার চোখে পানি টলমল করছে। আমারও একই অবস্থা। বাবা বাইরে যেতেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল। আটকে রাখার চেষ্টা করলাম না। মন ভরে কাদতে চাই এখন। কে জানে পরে এই সুযোগটাও হয়তো পাবো না। কিছুক্ষণ পরেই ভাবী আর পাশের বাড়ির এক ছোট বোন এলো ঘরে। আমার লাল চোখ দেখেই ভাবী বুঝে গেলো আমি কাদছিলাম। তবুও মুখে কিছু বলল না। ভাবী আমার পাশে বসে মাথায় হাত রাখলো। আমার কান্না বাঁধ মানলো না। ফুপিয়ে কেঁদে উঠতেই ভাবীও নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলো। এই অবস্থায় রুপমের বোন একটা ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকলো। আমাদের এই অবস্থায় দেখে কি বলবে বুঝতে না পেরে উনি দাড়িয়ে আছেন। ভাবী চোখ মুছে ওনাকে বসতে বললেন। উনি আমার পাশে বসে আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন
” শাড়ি টা চেঞ্জ করার দরকার নেই। শুধু গয়না গুলো পরিয়ে দিলেই হবে। কাজী অপেক্ষা করছেন।”

ভাবীর দিকে গয়নার ব্যাগটা এগিয়ে দিলেন। ভাবী এক এক করে সব গয়না আমাকে পরিয়ে দিলো। তারপর ভাইয়া দরজা থেকেই মাথা ঢুকিয়ে বলল
” কাজী সাহেব আসবেন। সবাই একটু রেডি হয়ে নাও।”

যে যার মতো রেডি হয়ে গেলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজী ভেতরে প্রবেশ করলো। নিজের আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে আমাকে কবুল বলতে বলল। বিষয়টা যে কতটা কঠিন সেটা এই মাত্র আন্দাজ করতে পারলাম। গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। সমস্ত কথা যেনো পেটের ভেতরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার। এমন সময় পাশ থেকে মায়ের চাপা কান্নার আওয়াজ পেলাম। বুকের ভেতরটা আরো দুমড়ে মুচড়ে গেলো। চোখ দিয়ে পানি অনবরত গড়িয়ে পড়ছে। আমি কোনভাবেই সামলাতে পারছি না। এদিকে কাজী বারবার তাড়া দিচ্ছে। এক সময় হাতের মুঠো শক্ত করে চোখ বন্ধ করে বড়ো একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে দিলাম। অবশেষে সবাই খুশী হয়ে গেলো। এবার রুপমের পালা। বাইরে কি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। তবে আমার মাথা ঘুরছে। আমি এই শীতেও ঘামছি। অবশেষে জানতে পারলাম রুপম নাকি কবুল বলেছে। জানিনা কেনো মনে অদ্ভুত রকমের একটা প্রশান্তি অনুভব করলাম। কেনো এমন হলো সেটা আমি বুঝতেও পারলাম না। সবাই আমাকে রেখে বাইরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ভাবী চুপিচুপি ঘরে এসে রজনীগন্ধার তাজা একটা মালা এনে আমার নাকের কাছে ধরে বলল
” এটা রুপম এনেছে তোমার জন্য। দেখো কি সুন্দর ঘ্রাণ।”

আমি ভাবীর দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। ভাবী মুচকি হেসে বলল
” একবার দেখবে না। চলে যাচ্ছে তো।”

আমি কোন কথা বললাম না। ভাবী আবারো বলল
” রুপম বলেছে ওর কাজ আছে। চলে যাবে। সবাই অবশ্য থাকতে বলেছে। ও না করেছে। একবার দেখা করো।”

আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম। ভাবী আর কথা বাড়ালো না। আমার হাতে মালাটা দিয়ে চলে গেলো। হুট করেই আমার মনে কেনো জানি এক আকাশ সমান অভিমান জমে গেলো। কারণটা অজানা। সন্ধ্যা হতেই রুপমরা সবাই চলে গেলো। পুরো বাড়ি এখন ফাঁকা। সারাদিনের এতো ব্যস্ততার কারণে বাড়ির সবাই খুব ক্লান্ত। আর বাইরেও শীত পড়েছে জেকে। তীব্র শীতের প্রকোপে সবাই হুহু করে কাপছে। ৯ টার মধ্যেই সব খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই ঘরে ঘরে শুয়ে পড়লো। আমি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছি। শাড়ীটা এখনো বদলাইনি। নিজেকে খুব একা একা লাগছে। জীবনটা আজ থেকে পরিবর্তন হয়ে গেলো। আরেকজনের সাথে নামটা জড়িয়ে গেলো অবশেষে। কিন্তু সেই মানুষটার কোন গুরুত্ব নেই। একবারও আমার কথা ভাবলো না। আমার সাথে দেখা করলো না একবার। অদ্ভুত একটা মানুষ। হুট করেই পাহাড় সমান অভিমানে বুক ভারী হয়ে গেলো। কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গেলো গলার কাছটায়। হাতের চুড়ি গুলো খুলে বিছানায় ছুড়ে মারলাম। গলা ছেড়ে কাদতে মন চাইছে। অপরিচিত থেকে প্রিয় হয়ে ওঠা সেই মানুষটার উপরে এক পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে ফোন করলাম। কয়েকবার রিং বাজতেই ফোনটা রিসিভ হলো। কোমল কণ্ঠে অতি আপনজনের মত বলল
” বলো।”

চলবে