#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ১২
অপরাজিতা অপু
সবার সামনে দিয়ে এভাবে শাড়ি পরে বেরোতে ভীষণ অসস্তি হচ্ছিলো আমার। সেটা যে রুপম কে বোঝাতেই পারছি না। আর বোঝাবো বা কি করে তার সাথে তো কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি না। ওই তখন টেবিলে বসে যা কথা হয়েছে সেটাই। তারপর সে বাবার সাথে আবারো গল্প জুড়িয়ে দিয়েছে। বেশ অসস্তির মাঝে শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছি আমি। ভাবী এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। আমি তার চোখের দিকে তাকাতেই বলল
” তোমার দেখি সেন্সর খুব একটা কাজ করে না।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ভাবী হাত থেকে শাড়িটা একদম ছিনিয়ে নিয়ে বলল
” এটা পরে বাইরে যেতে চাচ্ছো? বিয়ের পর প্রথম ঘুরতে যাচ্ছো। এমন একটা ফ্যাকাশে রঙের শাড়ি পরবে?”
আমি মুখটা অন্ধকার করে বললাম
” শাড়ি পরবো কিনা সেটাই ভাবছিলাম আর রং নিয়ে তো এখনো ভাবিনি।”
ভাবী নিজের কপালে হাত রাখলো। কিছুক্ষণ ভেবে বলল
” এতো কনফিউশন নিয়ে সংসার কিভাবে করবে বলো তো? তোমাকে দেখে আমারই টেনশন হচ্ছে।”
আমি উত্তর দিলাম না। ভাবী আলমারি খুলে বেশ সময় নিয়ে একটা শাড়ি বের করে বলল
” এটা পরো। দেরি করবে না।”
আমি হাতে নিয়ে বসে পড়লাম বিছানায়। ভাবী বেরিয়ে গেলো। আমিও নিজের মত রেডি হয়ে দরজায় দাড়ালাম। আমার ঘরের দরজার ঠিক সামনা সামনি বসে আছে রুপম। বাবার সাথে গল্পে মত্ব। আমি অনেক্ষণ ধরেই সেখানে দাড়িয়ে আছি। রুপম বেখেয়ালি ভাবে এক পলক তাকাল আমার দিকে। তারপর খুব সহজ ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে নিলো। আমি একটু বিরক্ত হলাম। নিজেই আবদার করেছিলো শাড়ীতে দেখতে চায় আর এখন তাকানোর ফুরসৎ পাচ্ছেন না জনাব। অভিমানে ভারী হয়ে উঠলো বুক। আমি সেখান থেকে চলে এলাম। কিছুক্ষণ পর ভাবী এসে বলল
” বাইরে চলো।”
অভিমানী আমি মান ধরে রেখেই বললাম
” ওনাদের গল্প শেষ হয়েছে?”
” হয়েছে।”
আমি কথা বাড়ালাম না। বাইরে গেলাম। রুপম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যেতেই মাকে বলল
” আমরা আসছি মা।”
রুপম এর মুখে মা ডাক শুনে আমার মায়ের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো মা। রুপম সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমাকে বলল
” চলো।”
আমি মাথা নিচু করে বের হয়ে গেলাম তার সাথে। পাশাপাশি হাঁটছি দুজন রাস্তার ধারে ঘেঁষে। কেউ কোন কথা বলছি না। আমি নাহয় অভিমান করেছি। কিন্তু এই লোকটার কি হয়েছে। কেনো কথা বলছে না আমার সাথে। আমি মনে মনে ভীষণ রাগ করলাম। নিজে থেকে কথা বলবো না একদম। যার কাছে আমার রাগ অভিমান এসবের কোন মূল্য নেই তার সাথে কথা বলার প্রশ্নই উঠে না। রুপম হাত উচিয়ে একটা রিক্সা থামালো। তারপর রিক্সায় উঠে বসলো। আমি দাড়িয়ে রুপমের দিকে তাকিয়ে আছি। একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমি কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে রিক্সায় বসলাম। ঠিক প্রথম দিনের মতই এক পাশ ঘেঁষে বসলাম। রিক্সা চলতে শুরু করেছে। বেশ অনেক্ষণ হল কেউ কোন কথা বলছি না। এবার আমার অসস্তি হচ্ছে। আমি আর চুপ করে থাকতে পারছি না। কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম
” আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
রুপম আমার দিকে তাকালো না। কিছুটা হেয়ালি করে বলল
” কেনো? না জানলে কি যাওয়া যাবে না?”
আমি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালাম। রুপম সামনের দিকে তাকিয়ে নিজের চুল ঠিক করলো। তার মাঝে কোন অভিব্যক্তির পরিবর্তন ঘটলো না। আমি তার আচরণে ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছি। আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম
” জানলেও কি কোন সমস্যা আছে?”
রুপম বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল
” জানতেই হবে কেনো? আমি সাথে আছি সেটাই কি যথেষ্ট নয়? নাকি মনের সন্দেহ আছে যে কিডন্যাপ করে কোথাও নিয়ে যাবো।”
রুপম এর কথা শুনে আমার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। আমিও খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললাম
” হতেও তো পারে। কিভাবে বিশ্বাস করি। আজকাল কার মানুষকে একদম বিশ্বাস নেই। আর কদিনই বা হয়েছে আপনার সাথে ঘুরতে যাওয়া।”
আমার কথাটা যে রুপমের ইগো তে লেগেছে সেটা তার চাহুনি দেখেই বুঝেছি। আর মনে মনে খুব খুশি হয়েছি। এতক্ষণ যা ভাব নিচ্ছিলো এখন একটু হলেও জব্দ হয়েছে। রুপম হুট করেই আমার দিকে ঝুঁকে গেলো। তার উষ্ণ নিশ্বাস আমি আমার মুখের উপরে অনুভব করছি। এভাবে হুট করেই এতো কাছে আসার ব্যাপারটা আমার কাছে অসস্তিকর হয়ে উঠলো। আমি একটু পেছনে হেলতেই সে এক হাতে আমাকে জড়িয়ে নিয়ে বলল
” পড়ে যাবে। শেষে কিনা ঘুরতে যাওয়া বাদ দিয়ে হাসপাতালে হানিমুন করতে হবে।”
আমি স্থির হয়ে গেলাম। অস্থির নিশ্বাস ফেলে ভেংগে ভেংগে বললাম
” হানিমুন মানে?”
রুপম ঠোঁটের কোন প্রশস্ত করে বলল
” স্বামী স্ত্রী বিয়ের পরে হানিমুন করতে যায় এটা জানো না? ঠিক আছে আমি বুঝিয়ে দেবো। ইন ডিটেইল।”
রুপম ঠোঁট টিপে হেসে আমাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসল। আমিও সোজা হয়ে বসলাম কিন্তু দম এখনো বসছে না। আমার সামান্য খোঁচা মারা কথার বিনিময়ে এমন একটা কান্ড ঘটালো সেটা বুঝতে বাকি রইলো না আমার। আমি অবচেতন মনে আবারো জিজ্ঞেস করলাম
” আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
রুপম হেসে ফেলে বলল
” বললাম তো হানিমুনে।”
হঠাৎ ই আমার মনে ভয় গ্রাস করল। কিসের ভয় বুঝতে পারলাম না। তবে আমি এখনই কেঁদে ফেলার জোগাড়। কাদো কাদো কণ্ঠে বললাম
” প্লিজ! সত্যি কথা বলেন না।”
রুপম এবার হেসে উঠলো অদ্ভুতভাবে। আমি তাকালাম। আমাকে এভাবে ভয় পেতে দেখে সে বেশ মজা পাচ্ছে। হাসি থামিয়ে আমার দিকে তাকালো। বেশ আদুরে কণ্ঠে বললো
” ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। অধিকার থাকলেও সেটা জোর করে আদায়ে আমি বিশ্বাসী নই।”
বলেই আমার হাতে হাত রাখলো। আমি রুপমের স্পর্শে মৃদু কেপে উঠলাম। সে বুঝল কিনা জানি না। তবে আলতো করে ধরে থাকা হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল
” এই হাতটা যতক্ষণ তোমার এই হাত ধরে রাখবে ততক্ষণ কোন ভয় নেই আজরা। তুমি আমার কাছে আমার থেকেও দামী। আমার জীবনের সব থেকে মূল্যবান সম্পদ। তবে আমি না থাকলে সে অন্য কথা।”
রুপম এর শেষের বাক্যটা আমার বুকের ভেতরে আঘাত করলো। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। পিটপিট করে পানি আটকাবার চেষ্টা করে বললাম
” আপনি কেনো থাকবেন না?”
রুপম মৃদু হেসে বলল
“মানুষ কি সারাজীবন থাকে? কে জানে এই আছি হয়তো এই থাকবো না।”
আমি প্রায় কেদেই ফেললাম। রুপম এর ফোন বাজলো। আমি কোন রকমে চোখের পানি আটকিয়ে রাখলাম। ওপাশ থেকে কি বলল শুনতে পেলাম না। কিন্তু এপাশে রুপমের অস্থিরতা বেড়ে গেলো। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল
” ফাইল টা তো আমি বাসায় রেখেছি। কাল অফিস থেকে আসার সময় সাথে এনেছিলাম। রাতে চেক করবো বলে।”
থেমে গেলো রুপম। ওদিকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে বলল
” কিন্তু আমি তো আজ ছুটিতে।”
খানিকবাদেই হতাশ সুরে বলল
” আচ্ছা ঠিক আছে। দেখছি।”
ফোনটা কেটে হাতের মুঠোয় ধরে কি একটা ভাবলো। আমি তার ভাবনা দেখে বললাম
” কোন সমস্যা হয়েছে?”
রুপম সামনে তাকিয়েই বলল
” আমাকে একটু অফিসে যেতে হবে। তুমি আমার সাথে বাসায় যাবে আজরা? তোমাকে বাসায় রেখে আমি শুধু অফিসে যাবো আর আসবো। বেশি দেরি করবো না।”
আমি মাথা নাড়লাম। রুপম রিক্সা ঘুরিয়ে ওর বাসার দিকে নিয়ে যেতে বলল। বাসার সামনে এসে রিক্সা থেকে নেমে ভেতরে নিয়ে গেলো আমায়। আমি বেশ ইতস্তত বোধ করছি। রুপম আমার অবস্থা বুঝে বলল
” তোমাকে দেখলে সবাই অনেক খুশি হবে। আগে ভেতরে চলো তারপর বুঝতে পারবে।”
আমি মনে সাহস নিয়ে ভেতরে গেলাম। রুপম এর কথা সত্যি। আমাকে দেখে তার পরিবারের লোকজন বেশ খুশি হলো। আমাকে তো ওর মা পাশে বসিয়ে গল্প জুড়ে দিলো। রুপম এক পর্যায়ে বলল একটা ফাইল দিতে অফিসে যেতে হবে। দিয়েই চলে আসবে। রুপম বিদায় নিয়ে চলে গেলো। রুপম এর মা তো আমাকে দেখে রান্না করতে শুরু করে দিলেন। রাতে না খেয়ে নাকি যেতে দেবে না। নিরুপায় আমি কোন কথা বলার সুযোগ পেলাম না। সময় পেরিয়ে গেলো। দুপুরে আমরা সবাই খেতে বসবো। কিন্তু রুপম এখনো আসেনি। শাশুড়ি মা আমাকে বললেন রুপম কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে। আমি ফোন দিলাম কিন্তু বন্ধ পেলাম। ভাবলাম হয়তো কাজে ব্যস্ত তাই ফোন বন্ধ করে রেখেছে। শাশুড়ি মাকে বললে তিনি কিছুটা ভাবুক হয়ে বললেন
” রুপম তো কখনো ফোন বন্ধ রাখে না। মিটিং এ গেলেও সাইলেন্ট করে রাখে। আমার অভিজ্ঞতা নেই বিধায় তেমন কিছুই বললাম না। শাশুড়ি মা কিন্তু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তার চিন্তা দেখে আমার মনে হলো অযথাই তিনি এমন করছেন। আমি তবুও কিছু বললাম না। রুপম এর বোন টিভি অন করলো। আমাকেও টিভি দেখতে ডাকলো কিন্তু আমি শাশুড়ি মায়ের সাথে গল্প করে সময় কাটাতে চাইলাম। এক সময় আমাদের গল্পের মাঝেই রুপমের বন চিৎকার করে উঠে বলল
” মা এদিকে আসো। দেখো কি হয়েছে?”
আমরা দুজনই সেখানে গেলাম। সে টিভির দিকে ইশারা করে দেখতে বলল। আমরা সেদিকে তাকালাম। তাকাতেই আতকে উঠলাম। টিভির স্ক্রীনে বড়ো করে ব্রেকিং নিউজ চলছে।
” এল সি কোম্পানিতে ভয়াবহ আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৭ টি ইউনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে।”
একজন সাংবাদিক লাইভ রিপোর্ট করছেন।
“৪ তলা এই অফিসে কয়েক হাজার কর্মী কাজ করতেন। তাদের মধ্যে প্রায় সবাই বের হয়ে এসেছেন। তবে তিনতলায় কয়েকজন কর্মী বের হতে পারেন নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা চেষ্টা করেও তাদের কে বের করতে সক্ষম হন নি। ধারণা করা হয় তারা সবাই মৃ ত।”
শাশুড়ি মা সোফায় বসে পড়লেন। তার দৃষ্টি টিভির স্ক্রীনে স্থির। মেয়েকে বললেন
” রুপম এর কলিগ সায়েমকে ফোন কর। রুপম এর খবর নে। অফিসে আগুন লেগেছে। ছেলেটা আমার কেমন আছে।”
বলতে বলতেই তিনি কেঁদে ফেললেন। আমার বুকের ভেতরটা কেপে উঠলো। রুপম এর বোন তার কলিগ কে ফোন দিলো। তার কথা শুধু শুনতে পেলাম। সেটা শুনেই আন্দাজ করলাম রুপম ভেতরে আটকা পড়ে আছে। কি অবস্থায় আছে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আমার পুরো দুনিয়া ঘুরে গেলো। শাশুড়ি মা এক চিৎকার দিলেন। আমার মাথা ঘুরে গেলো। আমি সোফায় বসে পড়লাম। একটা কথা শুধু মাথায় ঘুরছে।
“মানুষ কি সারাজীবন থাকে? কে জানে এই আছি হয়তো এই থাকবো না।”
চলবে