#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
শেষ পর্ব
অপরাজিতা অপু
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে কেটে গেলো শত শত মুহূর্ত। হাসি কান্না দিয়ে জড়ানো সেসব মুহূর্ত জীবনের একেকটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে স্মৃতির পাতায় গাঁথা থাকবে। কেটে গেলো একটা বছর। এক পৌষ পেরিয়ে আরেক পৌষ এলো জীবনে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা শহরে শিরশিরে হাওয়া বইছে। জনজীবন শীতের প্রকোপে অস্থির হয়ে উঠেছে। কেউই জরুরি কাজ ছাড়া তেমন বাইরে বেরোচ্ছে না। ছাদের উপরে দমকা হাওয়ায় কাপড় গুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমি সোয়েটারের উপরে চাদর জড়িয়ে ছাদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই ধোয়ার মতো কুয়াশা ভেসে এসে আমাকে ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। ঠান্ডার দাপট থেকে বাঁচতে চাদরের কিছু অংশ দিয়ে নাক ঢেকে ফেললাম। হুহু করে বাতাসটা শরীর কেপে তুলছে। কাপতে কাপতে কাপড় গুলো তুলে নিয়ে দ্রুত নিচে এলাম। তবুও শরীরের কপুনি গেলো না। আমাকে কাপতে দেখে ভাবী বলল
” আহা রে! এখনই কাপড় আনতে হবে? পরে আনা যেত না? কি অবস্থা হয়েছে।”
বলেই হাত থেকে কাপড় গুলো নিয়ে সোফায় ফিকে দিয়ে আমাকে টেনে ঘরে নিয়ে গেলো। কম্বল দিয়ে আমাকে মুড়ে দিয়ে বলল
” ঠাণ্ডা লাগানো যাবে না তোমার।”
আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমাকে রেখে রান্না ঘরে গেলো। কিছু সময় পরে এক কাপ লাল চা বানিয়ে নিয়ে এলো। আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
” এটা খেয়ে নাও।”
আমিও ভদ্র মেয়ের মতো কোন কথা না বলে চায়ে চুমুক দিলাম। লেবুর গন্ধ টা নাকে লাগতেই মন টা পরিবর্তন হয়ে গেলো। এই লেবু চায়ের সাথে জড়িয়ে আছে আমার অনেক স্মৃতি। আমি ভাবুক হয়ে বললাম
” অনেকদিন পর এমন লেবু চা খেলাম।”
ভাবী আমার পায়ের কাছে বসে ফেসবুক চালাচ্ছিল। আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকালো। আমি তার দিকে তাকাতেই মুচকি হেসে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। ফোন চালাতে চালাতে বলল
” তুমি তো লেবু চা পছন্দ করো না। আমার বিয়ের পর থেকে কখনো খেতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। তবে ইদানিং খেয়াল করছি শীত পড়লেই লেবু চায়ের প্রতি কেমন দুর্বলতা বেড়ে যায়।”
কথাটা শেষ করেই আবার ঠোঁট টিপে হাসলো। আমি বেশ বুঝতে পারলাম আমাকে খোটা দিয়ে কথা টা বলল। আমিও গায়ে মাখিয়ে নিয়ে বললাম
” শীতের দিনে লেবু চা অনেক উপকার। আমি মাঝে মাঝেই খাই। শুধু আমি কেনো এটা সবারই খাওয়া উচিত।”
ভাবী আবারো ঠোঁট টিপে হেসে বলল
” বুঝেছি।”
আমার বেশ রাগ হলো। ইদানিং সামান্য কারণেই মেজাজ হারিয়ে ফেলি। অভিমানটাও কেমন যেনো বেশি হয়ে গেছে। নিজেকে এলোমেলো লাগে। ভাইয়ার গলার আওয়াজ পেলাম। ভাবীকে ডাকছে। ভাবীও দ্রুত চলে গেলো। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলাম। তারপর গ্যালারী তে ঢুকলাম। একের পর এক ছবি স্লাইড করছি। হঠাৎ করেই একটা বিশেষ মানুষের ছবি সামনে এলো। হাস্যজ্বল চেহারা দেখে আমার বুকের ভেতরটা কেমন শীতল হয়ে উঠলো। আচমকাই চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়তে লাগলো। আমি ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এক সময় কান্নার বেগ বাড়তেই আমি ফোনটা ছুড়ে ফেলে মারলাম। তবুও কান্না থামলো না। বাইরে মায়ের গলার আওয়াজ পেলাম। চোখটা মুছে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছি। মা ঘরে ঢুকেই আমাকে বলল
” তোর শাশুড়ি ফোন করেছিলো। তারা দুপুরে আসছে তোকে দেখতে।”
আমি কথার জবাব দিলাম না। উল্টা চোখ বন্ধ করে বললাম
” আসুক। আমার শরীর ভালো লাগছে না। আমি এখন ঘুমাবো। দরজা বন্ধ করে দিয়ে যাও।”
মা কি বুঝে আর দেরি করলো না। দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে গেলো। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে রুপমের নাম্বারটাতে কল দিতে গিয়েও দিলাম না। এক পাহাড় সমান অভিমান জমে আছে এই বুকে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে আমার। শাশুড়ি এসে কি লাভ যার খোঁজ নেয়া দরকার সে তো খোঁজ নেয়না। আর বাকি সবাই খোঁজ নেয়ার দরকার নেই। আমি অভিমানে টইটুম্বুর হয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। অনবরত গড়িয়ে পড়ছে। আজ আমার কান্না থামানোর কোন ইচ্ছা নেই। প্রায় দুইদিন হয়ে গেলো রুপমের কোন খবর নেই। এতো কি কাজে ব্যস্ত যে আমাকে একটা ফোন করার সুযোগ পায়না। আমার জানা মতে এই দুইদিন তার ছুটি ছিলো। তবুও সে আমাকে ফোন দেয়নি। এর কারণ কি হতে পারে? মাথায় নানা রকম চিন্তা ঘুরঘুর করছে। পাশের বাড়ির আনটি এসেছিলো গতকাল। গল্পের এক পর্যায়ে খুব দুঃখ করে বলল তার মেয়ের জামাই নাকি এমনই অফিস থেকে ট্রেইনিং এ ৩ মাসের জন্য গিয়েছিলো। এক সময় ধীরে ধীরে মেয়ের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। জামাইয়ের হাবভাব ভালো বুঝতে না পেরে তারা খোঁজ নেয় গোপনে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে জামাইয়ের নাকি আরো একটা বউ আছে। অফিসের ট্যুরের কথা বলে সেখানে যায়। আমার মাথাটা ঘুরে উঠলো। কি থেকে কি ভাবছি আমি। মন বলছে রুপম এমন কাজ করতেই পারে না। আবার মস্তিষ্ক বলছে মানুষ পরিবর্তন হতে সময় লাগে না। আমার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো। উপায় না দেখে রুপমের নাম্বারে ফোন করলাম। কিন্তু রিং হয়ে কেটে গেলো। ফোনটা তুললো না। আমি আবারো কাদতে শুরু করলাম। রুপম আমার সাথে এমন কেনো করছে। বিছানা ছেড়ে জানালার ধারে দাড়ালাম। বাইরে কুয়াশা ভেদ করে রোদের প্রখরতা বাড়ছে ধীরে। আমি সেদিকে তাকিয়ে ভাবছি। এই একটা বছরে এই মানুষটা আমার জীবনের সবথেকে কাছের একজন হয়ে উঠেছে। এক বছর আগেও যে মানুষটাকে জীবনসঙ্গী বানাতে আমার ছিলো একরাশ সংশয়। সেই মানুষটাই আজ আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এই ব্যাপারটা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগেনি আমার। যেদিন রুপমের অফিসে আগুন লেগেছিল সেদিনই আমি অনুভব করেছিলাম যে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এই মানুষটার প্রতি আমার দুর্বলতা আছে। বিয়ের কালেমা পড়ে যখন স্বামী হিসেবে স্বীকার করেছিলাম তাকে তখনই তার প্রতি এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি হয়েছিল আমার। তবে সেটা উপলব্ধি করতে কিছুটা সময় লেগেছে। সেদিন টিভি তে নিউজ দেখে যখন জানতে পারলাম রুপম অফিসের ভেতরে আর তার কোন খবর পাওয়া যায়নি তখন আমার ভেতরটা কেপে উঠেছিল। দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল আমার। এক মুহূর্তেই যেনো রুপম কে হারিয়ে ফেলার অনুভূতি হলো ভেতরে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। তারপর কতক্ষণ অমন অবস্থায় ছিলাম সেটা জানিনা। তবে যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন চোখের সামনে রুপম কে দেখতে পেয়ে যেনো নিজের নিশ্বাস অনুভব করতে পেরেছিলাম। নিজেকে জীবন্ত অনুভব করেছিলাম। বুকের ভেতরের হৃদপিন্ডটা তার অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল। রুপম আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলেছিল
” এখন কেমন আছো আজরা?”
আমি তখন নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সবার সামনেই রুপম কে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম। চিৎকার করে উঠে বলেছিলাম
” তুমি আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবে না। কোনদিন যাবে না।”
রুপম সেদিন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল
” ঠিক আছে যাবো না। এখন শান্ত হও। আমি এসেছি তো।”
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লাম। কিন্তু সে তার কথা রাখেনি। আমাকে রেখে চলে গেছে অফিসের কাজে। তার নাকি ২ মাসের ট্রেইনিং আছে। একবার ভাবলো না আমার মন খারাপ হতে পারে। আমি ভীষণ অভিমানে জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নিতেই পেটে এক মিষ্টি ব্যাথা অনুভব করলাম। শরীরে নতুন এক অস্তিত্বের অনুভূতি। মায়ের এই একাকিত্ব সময়ে সে যেনো নড়েচড়ে জানান দিচ্ছে আমি একা নই। আমার শরীরের ভেতরে বড়ো হচ্ছে আমাদের অংশ। হ্যা রুপম আর আমার অংশ। দরজায় টোকা পড়তেই আমি চকিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালাম। ভাবী এসে ঘরে ঢুকে বলল
” তোমার শাশুড়ি আর ননদ এসেছে। বাইরে আসো।”
আমি কোন কথা না বলে বাইরে চলে গেলাম। আমার শাশুড়ি মা আমাকে কাছে বসিয়ে বললেন
” তোমার শরীর কেমন মা?”
আমি নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বললাম
” আলহামদুলিল্লাহ! ভালো আছি মা। আপনি কেমন আছেন?”
” ভালো আছি। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করছো তো?”
আমি মাথা নাড়লাম। দুপুরে আমরা সবাই একসাথে খেলাম। মা আর আমার শাশুড়ি মা দুজন এক ঘরে বসে গল্প করছে। আর আমি ভাবী আর আমার ননদ তিনজনে আমার ঘরে বসে গল্প করছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। দরজায় কলিং বেল বাজলো। ভাবী আমাদের বসিয়ে রেখে দরজা খুলতে গেলো। একটু পর দৌড়ে এসে বলল
” রুপম এসেছে। বাইরে আসো।”
আমি অবাক হলাম। হৃদপিণ্ডের ধুকধুকানি আওয়াজটা বেড়ে গেলো। রুপম এসেছে অথচ আমাকে কিছুই জানালো না। মানুষটার সারপ্রাইজ দেয়ার সভাবটা গেলো না। কিন্তু আমি খুশি হলেও সেটা কেনো প্রকাশ করবো। সে তো আমার খবর নেয়নি। তাই নিজের অভিমানটা ধরে রাখলাম। আমার ননদও বাইরে চলে গেলো। আমি গেলাম না। কম্বল জড়িয়ে ভালোভাবে শুয়ে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পর রুপম এলো। আমি নিজেকে শক্ত রাখলাম। দেখেও না দেখার ভান করে থাকলাম। রুপম আমার পায়ের কাছে বসলো। আমি তবুও নড়লাম না। সে এক পর্যায়ে আমার শরীর থেকে কম্বল টা সরিয়ে দিলো। আমি বিরক্ত হলাম। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে আমার পেটে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করে হাত রেখে বলল
” কেমন আছো? মিস করেছো বাবাকে? বাবাও তোমাকে অনেক মিস করেছে। বাবা অনেক সরি। আর কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবে না। প্রমিস।”
আমি হাতটা সরিয়ে দিলাম। রুপম রাগ দেখিয়ে বলল
” বিরক্ত করছো কেনো? আমি তো তোমাকে বিরক্ত করছি না।”
আমি রেগে গিয়ে বললাম
” তো কাকে বিরক্ত করছো? আমার পেটেই তো হাত দিয়েছো।”
” সে তোমার ব্যাড লাক যে আমার সন্তান তোমার পেটে। নাহলে তোমাকে ছোঁয়ার প্রয়োজন ছিলো না।”
আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছি। আমার সমস্ত মন খারাপ একসাথে হানা দিলো। চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তেই রুপম মুচকি হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল
” একদম কাদবে না। চুপ করো। কাদছো কেনো? আমি তো দুষ্টুমি করলাম। তুমি কি কিছুই বোঝনা আজরা?”
আমার অভিযোগের পাহাড় ভেংগে গেলো। আমি ঝেড়ে ফেলে বললাম
” ফোন করো নি কেনো আমাকে? আমি ফোন দিয়েছিলাম তাও ধরনি। কেনো? আমার টেনশন হয়না?”
রুপম আমার কপালে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করে বলল
” সরি! একটা জরুরী মিটিংয়ে ছিলাম। তাই সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম। মিটিং শেষ করেই তোমার কাছে চলে এসেছি। এই যে দেখো। আর কোথাও যাবো না। একদম প্রমিস্।”
আমি কেঁদে ফেললাম। রুপম তার বুকে আমাকে আগলে নিলো। কি অদ্ভুত অনুভূতি। এমনই এক পৌষের বিকেলে এই মানুষটা আমার জীবনে এসেছিলো। আজও সেই পৌষ মাস। আর আমার ভেতরে নতুন এক অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। পৌষের কোন এক বিকেলেই আমার জীবন পরিবর্তন হয়ে গেলো।
সমাপ্ত