তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব-১৪+১৫

0
424

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (১৪)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________

সম্পূর্ণ পৃথিবীটাই যেনো মাথার ওপর ঘুরছে। তীব্র কি তবে আমাকে ঠ’কালো? আমার একটা ভুলের শাস্তি বুঝি এতোটা গভীর! চোখ বন্ধ করে হাত মুঠো করে নিলাম। শব্দ করে কেঁদে উঠলাম৷ সাথে সাথেই মুখ চেপে ধরে বোবা কান্নায় ভেঙে পড়লাম। চোখের কাজল লেপ্টে গিয়ে চোখের নিচে দাগ হয়ে গেছে কালো কালো। সেই মুহুর্তেই বাহির থেকে ডাক ভেসে আসে তিহার। আমি দ্রুত কান্না আটকানোর চেষ্টা করলাম৷ তিহা দরজার অপর পাশ থেকে ব্যস্ত গলায় বললো,

‘ভাবী তুমি কি রুমে আছো?’

আমি কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললাম, ‘হ্যাঁ তিহা৷’

‘আরেহ ভাবী তুমি রুমে কি করো! কখন থেকে খুঁজছি তোমাকে! জলদি বাহিরে আসো। ছোট মামি তোমাকে খুঁজছে।’

আমি নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। পরপর কয়েকবার ঢোক গিললেও কথা বলার সময় অস্পষ্ট হয়ে আসছিলো স্বর। মুখ চেপে ধরলাম। এ অবস্থায় আমার বাহিরে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। তিহা ফের ডাকলো। আমি কোনো রকমে শ্বাস আটকে বললাম,

‘তিহা আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। একটু ভালো লাগলে আসি! তুমি নিচে যাও বরং।’

তিহা তড়িঘড়ি করে বলে, ‘ভাবী খুব বেশি খারাপ লাগছে? দরজা খোলো!’

‘নাহ খুব বেশি খারাপ লাগছে না। তুমি যাও!’

তিহা কিছু বলতে নিয়েও চুপ হয়ে যায়। তারপর ‘আচ্ছা’ বলে চলে যায়। আমি এলোমেলো পায়ে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটলাম। চুলের খোঁপা থেকে রজনীগন্ধার গাজরা খুলে ফেলে দিলাম। হাতে পড়ে থাকা চুড়ি গুলোও খুলে ফ্লোরেই ফেললাম। ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিলাম অনেকটা সময় নিয়ে। চোখ দুটো জ্বালা করছে। আয়নায় নিজের দিকে তাকাতেই আমার হাসি পেলো। হুট করেই হেঁসে দিয়ে বিড়বিড় করে আওড়ালাম,

‘খুব এসেছিলে প্রানেশা তীব্রকে পু’ড়াতে! অকারণে তাকে ভুল বুঝে তাকে শাা’স্তি দিতে উঠে পড়ে লেগেছিলে! যে মানুষটাকে ঘৃ’ণার সর্বোচ্চতে রেখে ‘কবুল’ বলেছিলে আজ তুমি তাকে ভালোবেসে পু’ড়ছো! তীব্রর এই ঝলসানো প্রেমে তুমি আরো পু’ড়বে। তীব্রকে ভালোবেসেই, তার দেওয়া বিরহ নিয়েই তুমি শেষ হবে। ইশশ কেনো যে ঘৃ’ণার জায়গায় ভালোবাসার ঠায় দিলে!’

চোখ বন্ধ করতেই দু ফোঁটা জল গড়ালো চোখের কোণ বেয়ে। চুপচাপ রুমে এসে কাবাড থেকে নরমাল শাড়ি বের করে পড়ে নিলাম। এতো কাজ করা শাড়ি পড়ে ঘুমানো টা কষ্টকর। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লাম ব্ল্যাঙ্কেট মুড়িয়ে। চোখ বন্ধ করে থাকলেও চোখের পানি পড়া তখমও বন্ধ হয়নি। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চোখ মুছে নিলাম। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে দরজা খুললাম। ভেবেছিলাম হয়তো ছোট মামি বা তিহা, মিলি এসেছে কিন্তু ঝাপসা চোখে তীব্রকে দেখে সরে আসলাম। এলোমেলো পায়ে এসে আবার শুয়ে পড়লাম। তীব্র ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বলে,

‘তোমার শরীর খারাপ লাগছে? কি হয়েছে?’

আমি জবাব দিলাম না। ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে পুরো মাথাসহ ঢেকে নিলাম। মুখ চেপে ডুকরে উঠলাম। তীব্র আমার এমন আচরণে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। চুপ হয়ে গেলো। আমি যতটা সম্ভব শব্দ না করে কান্নার চেষ্টা করে গেলাম ক্রমাগত। পুরো রাতটাই কেটে গেলো নিঃশব্দ কান্নায়। পাশে থাকা তীব্র টের পেয়েছে কি না জানা নেই তবে সে একটা শব্দও করেনি আমার সাথে।

সকাল বেলা ফজরের নামাজ পড়ে আবার শুয়েছিলাম বলে উঠতে উঠতে অনেক বেলা হয়ে গেলো। ঘুমের জন্য মাথাটা ভার হয়ে আছে প্রচন্ড রকমের। পাশে তীব্র নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠতেই আয়নায় নিজের দিকে চোখ পড়ে। চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। নিজেকে দেখে নিজেই আঁতকে উঠলাম। বাড়ির বাকিরা প্রশ্ন না করলেও তিহা, মিলি আর ছোট মামি কিছুতেই ছাড় দেবে না। জলদি করে ফ্রেশ হয়ে চোখ ভালো করে ডললাম। কিন্তু চোখের ফোলা তো কমবে না। শেষে ওভাবেই বের হলাম৷ হাত খোঁপা করে মাথায় আঁচল টেনে নিতেই চোখ পড়লো মেঝেতে। কাল যেখানে ফুলের গাজরা, চুড়ি ফেলেছিলাম সেগুলো ওখানে নেই। ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে স্বযত্নে চুড়ি আর গাজরা রাখা। ওগুলো ওখানে কে রাখলো? তীব্র! উনি এগুলো ফ্লোর থেকে উঠালে নিশ্চয় টের পেয়েছে কিছু। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে নামলাম। আশে পাশে তীব্রকে কোথাও নজরে পড়লো না। মানুষটা কিছুদিন পরই আমাকে ছেড়ে দেবে অথচ আমার বেহায়া মন তার সান্নিধ্য পেতে ব্যস্ত। তিহা আর মিলি আমাকে দেখে দৌড়ে আসে। কাছে এসে বলে,

‘ভাবী শরীর কেমন তোমার? কাল তো আর আসলেই না তুমি!’

আমি উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দৃষ্টি এদিক ওদিক করতে থাকলাম। মিলি আমার হাত জড়িয়ে বলে, ‘ভাবী কতকিছু যে মিস করলেন আপনি! আহারে।’

এবারও জবাব দিলাম না। তিহা আমার নীরবতার কারণ বুঝতে না পেরে থুতনীতে হাত দিয়ে মুখ উচু করে। সাথে সাথে আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে নিলাম। বড় করে শ্বাস নিলাম। তিহা বললো,

‘চোখ মুখের এমন দশা কেনো ভাবী? তোমার কি সত্যি শরীর খারাপ ছিলো কাল?’

আমি ফাঁকা ঢোক গিললাম। উত্তর দেওয়ার আগেই ডাক পড়লো আন্টির। আমি তিহা আর মিলিকে পাশ কাটিয়ে আন্টির কাছে আসলাম। আন্টি আমাকে শুধু একটা লিস্ট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন যেনো বড় মামা, ছোট মামা, আঙ্কেল, কাউকে না কাউকে এটা দিয়ে দেই। আমি মাথা নাড়িয়ে লিস্ট নিয়ে চুপচাপ চলে আসলাম৷ মিলিকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,

‘বড় মামা, ছোট মামা বা আঙ্কেল কে কোথাও দেখেছো?’

‘আব্বু রুমে, কাক্কু আর আঙ্কেল বাহিরে। গার্ডেনে।’

বড় মামাকে ভয় লাগে আমার৷ আমার জন্য তার আদরের মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে তাই সে আমাকে তেমন একটা পছন্দ করেন না। তাই তার কাছে না গিয়ে আমি বাড়ি থেকে বের হলাম গার্ডেনের উদ্দেশ্যের। এসে দেখি আঙ্কেল আর ছোট মামা বসে খোশ গল্পতে মেতেছেন। আমি মাথা নিচু করে এসে আঙ্কেলের দিকে লিস্টটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,

‘আঙ্কেল! আন্টি বলেছে এগুলো আনতে।’

আঙ্কেল আমার থেকে লিস্টটা নিলেও ছোট মামা ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কিসের আঙ্কেল আন্টি? কে আঙ্কেল আর কে আন্টি?’

আমি উনার হঠাৎ এমন প্রশ্নে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলাম। আঙ্কেল হেঁসে বললেন, ‘আরেহ আর বলো না! প্রানেশা মা আমাকে আর তোমার আপাকে আঙ্কেল-আন্টিই বলে। আগেকার অভ্যাস কি না!’

‘আগেকার অভ্যাস তো ঠিক আছে কিন্তু এ কথা আব্বাজান জানে?’

আঙ্কেল দুপাশে মাথা নাড়ালেন। ছোট মামা আমার পাশে দাড়িয়ে মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আমার আব্বাজান কতটা কড়া এটাতো তুমি ভালো করেই জানো আম্মু! তাই এখন থেকেই আঙ্কেল-আন্টি ডাকা বন্ধ করো নয়তো ভুল করেও একথা আব্বাজানের কানে গেলে আস্ত রাখবে না কিন্তু। আর শ্বশুর শ্বাশুড়িকে কতদিনই বা আঙ্কেল-আন্টি ডাকবে শুনি! এটা তো আর কয়েকদিনের ব্যাপার না যে আজ আছো কাল নেই তাই এখন থেকেই বাবা-মা ডাকতে শিখো।’

আমি ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নাড়ালাম। তারপর উনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পাশের বড় পুকুরটার দিকে এগোলাম। ছোট মামা তো জানে না যে আসলেই এটা কয়েকদিনের ব্যাপার শুধু এরপর আমাদের বি’চ্ছেদ। আসলেও আমি আজ আছি তো কাল নেই। শুধু শুধু আব্বু-আম্মু ডেকে মায়া বাড়িয়ে কি লাভ! মাথার আঁচল টা ভালো ভাবে টেনে নিয়ে পুকুরপাড়ের সিড়িতে বসলাম। পা পানিতে ডুবিয়ে স্বচ্ছ পানিকে ঘোলাটে হতে দেখলাম। ধীরে ধীরে আবার পানি ঠিক হয়ে গেলো। পানিতে অস্পষ্ট নিজেকে দেখে হাসলাম। বড় করে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। অনুভব করলাম আমার পাশে কেউ আছে। চট করে চোখ মেলতেই তীব্রর গম্ভীর মুখটা চোখে পড়ে। কিয়ৎক্ষণ তার মুখপানে তাকিয়ে আমি দৃষ্টি সরালাম। দুজনের মধ্যকার নীরবতা মিটিয়ে উনি নিজেই বললেন,

‘কিছু হয়েছে?’

আমি জবাব দিলাম না। প্রয়োজনই মনে করলাম না। যদি দূরত্বটাই হয় আমাদের পরিণতি তবে সে দূরত্ব এই মুহুর্ত থেকেই হোক। পাশাপাশি বসেও দুজনের মধ্যকার দূরত্ব যেনো আকাশ সমান। দুজনই টের পেলাম সে দূরত্ব। আমি উনার প্রশ্নের উত্তর না দিলেও নিজে থেকে প্রশ্ন করলাম,

‘আমরা বাড়ি কবে ফিরবো?’

তীব্র কোনোরকম প্রশ্ন ছাড়াই উত্তর দিলো, ‘আজ গায়ে হলুদ শেষ হলে কাল বিয়ে। এরপর নানাভাই যাওয়ার অনুমতি দিলে ২ দিন পরই চলে যাবো। আর না দিলে কিছুদিন থাকতে হবে।’

এরপর আবারও দুজনের মধ্যকার নীরবতা। এতো এতো কথা বলার থাকলেও সবটাই গলায় দলাা পাকিয়ে রয়েছে। আমাদের এখানে থাকাটাই একসাথে থাকার শেষ সময় এরপর দুজনের দূরত্ব বাড়বে, বাড়বে সম্পর্কের জটিলতা। একটা সময় সবশেষে এসে দাঁড়াবে বি’চ্ছেদ। এই মানুষটার চোখের দিকে তাকালে আমি অনুভূতির গভীরতা মাপতে পারতাম না আজ মনে হচ্ছে ওগুলো অনুভূতি নয় শুধুই রহস্যের বোনা জ্বাল ছিলো। যেখানে আমি ফেঁসে গিয়ে দম আটকে ফেলেছি। এখন সময় শুধু কখন সেই দমটা বের হয়! ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত ভাবে হাসি ফুটে উঠলো। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘জিনিয়ার কোনো খোঁজ পেয়েছেন?’

‘তুমি কি করবে?’

‘অনেকদিন বেষ্টির মুখ দেখি না। তাই ভাবছি দেখা করবো।’

তীব্রর মুখে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। রহস্যময় ভাবে হেঁসে বলে, ‘নো প্রবলেম বেইব আমি তোমাকে তোমার বেষ্টির সাথে খুব শীঘ্রই দেখা করাবো কিন্তু কথা হচ্ছে যে বিষয়গুলো তুমি নিতে পারবে তো?’

আমি হাসলাম। ঠোঁট প্রসারিত রেখেই বললাম, ‘এতো বড় ধা’ক্কা সহ্য করে নিলাম আর এটুকু পারবো না? শুধু নিজের প্রতি ঘৃ’ণা গুলো হয়তো বা আকাশ ছুঁবে তবে আমি সহ্য করে নিবো।’

তীব্র মুহুর্তেই গম্ভীর হয়ে গেলো। পাশ থেকে উঠতে উঠতে বললো, ‘বাড়ির ভেতরে যাও। আম্মু আবার তোমাকে খুঁজে না পেলে চেচামেচি শুরু করবে তখন বিয়ে বাড়িকে আর বিয়ে বাড়ি মনে হবে না।’

আমি ছোট করে ‘আচ্ছা’ বললাম। উনি এগোতেই আমি নিজেও উঠে পড়লাম। অন্যমনষ্ক ভাবে উঠতে গিয়ে শাড়িতে পা বেঁধে উল্টে পড়লাম পুকুরে। মুহুর্তেই আর্তনাদ করে উঠলাম৷ উল্টো হয়ে পড়ার কারণে বেশ খানিকটা পানি অলরেডি পেটে চলে গেছে। পুকুরের নিচটা পিচ্ছিল হওয়ায় বেশ খানিকটা পানিতে চলে এসেছি। নাক মুখ দিয়ে হুর হুর করে পানি ঢুকতে থাকে।

চলবে..

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (১৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
___________________

জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে হসপিটালে দেখে বেশ অবাক-ই হলাম। আশে পাশে চোখ বুলাতেই হাতে চলতে থাকা স্যালাইনের দিকে নজর পড়ে। মস্তিষ্ক ফাঁকা। ধীরে ধীরে সবটা মনে পড়তেই আঁতকে উঠলাম। আমি তো পানিতে ছিলাম! দুর্ভাগ্যবশত সাতার না জানায় অনেকটাই পানি পেটে চলে গিয়েছিলো। আতঙ্কে, দমবন্ধ হয়ে কখন জ্ঞান হারিয়েছি মাথায় নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকালাম। এরমধ্যেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন একজন নার্স। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,

‘সেন্স ফিরেছে তবে! এখন কেমন লাগছে শরীর?’

আমি ধীর কন্ঠে বললাম, ‘জ্বি ভালো।’

নার্স এসে স্যালাইন চেক করে মুচকি হেঁসে বললেন, ‘আপনি কিন্তু ভাগ্যবতী বলতে হয় ম্যাম।’

আমি কথাটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। হঠাৎ আমাকে ভাগ্যবতী বলতে হবে কেনো! উনি ঠোঁট দুটো আরো প্রসারিত করে বললেন, ‘আপনার হাজবেন্ড আপনার অবস্থা দেখে এতক্ষণ পুরো পাগল হয়ে গেছিলো। বাহিরেই বসে আছে এখনো।’

আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ থাকলাম। জানি না কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা! আমি বার বার সত্য মিথ্যার মধ্যে ঝুলে থাকি। বুঝি না এরা সবাই আমাকে মনে করেটা কি! ফোঁস করে উঠলাম। নার্স আপুটি আবার বললেন,

‘তবে আপনাকে দেখে কিন্তু আমার সামান্যতম হিংসেও হয়েছে ম্যাম। এতো হ্যান্ডসাম, কেয়ারিং, লাভিং একটা হাজবেন্ড পেয়েছেন। ওয়াও!’

আপনাআপনি ভ্রু কুঁচকে গেলো। মেয়েটার চোখে স্পষ্ট মুগ্ধতা। রাগে গা জ্বলে উঠলো। কত বড় সাহস! আমার বরের দিকে নজর দিচ্ছে তাও আবার আমাকেই এসে বলতেছে! বলি এদের কি লজ্জা শরম কিছু নাই? ফোঁস করে উঠলেও কিছু বললাম না। আপাতত চুপ-ই থাকলাম। আমি তো অসুস্থ তাই না! কিছুক্ষণ পর নার্সটি বের হয়ে যায়। সাথে সাথে কেবিনে আসে তীব্র। চোখ মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই তার এই মুহুর্তে প্রতিক্রিয়া ঠিক কি! তীব্র চুপচাপ টুল টেনে বসে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

‘সাতার না পারলে পুকুরে যাওয়ার কোনো দরকার ছিলো তোমার? পেট পুরে পানি খেয়েছো তো?’

উনার কথা শুনে নড়েচড়ে একটু কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলাম। কোনো জবাব দিলাম না। আসলে উনি কেয়ার করলো নাকি ধমকালো আমি এটাই বুঝলাম না। উনি আমার নীরবতা দেখে কপালে ভাজ ফেললেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

‘মুখে কি এখনো পানি আছে যে জবান দিচ্ছো না!’

‘মুখে পানি কেনো থাকবে?’

‘তাহলে প্রশ্নের উত্তর দাও না কেনো? কষ্ট লাগে উত্তর দিতে!’

‘আপনি আমাকে ধমকাচ্ছেন কেনো? আমি না অসুস্থ! কোথায় একটু আদর করে, মিষ্টি করে কথা বলবেন তা না করে ধমকাচ্ছেন! এই আপনার ভালোবাসা? এই ছিলো আপনার মনে?’

আমার কথায় তীব্র রীতিমতো হা। চোখ পিটপিট করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর আমার দিকে ঝুকে এসে কপাল, গাল চেক করে।আমি ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে বললাম,

‘কি হয়ছে? এতো কাছে আসতেছেন কেন? এটা হসপিটাল তো। থাক আদর করতে বলছি বলে এখানেই করতে হবে এমন না বিষয়টা। বাড়ি গিয়ে করলেও চলবে।’

তীব্র সাথে সাথে গলা ফাটিয়ে নার্সকে ডাকে। উনার চেঁচানোতে আমি ভয়ে কেঁপে উঠেছি। এতো জোড়ে চেচানোর আওয়াজে কানে হাত দিতে গিয়ে হাাতে টান পড়ে স্যালাইনের সূচ দিয়ে রক্ত উঠে যায়। মৃদু আর্তনাদ করে হাতটা ঠিকমতো রাাখতেই নার্স ছুটে আসে। যেনো সে আমার জামাইয়ের ডাকের অপেক্ষাতেই ছিলো। আমি রাগী রাগী চোখে তাকালাম তার দিকে। নার্স ছুটে এসে বলে,

‘জ্বি! কিছু হয়েছে স্যার?’

‘আপনি ওকে ভালো করে দেখে ডক্টরকে ডাকুন তো। আমার মনে হয় পানি খেয়ে ওর মাথার তা’র নড়ে গেছে নয়তো ছি’ড়ে গেছে। ওকে কি পাবনা মেন্টালে নিতে হবে?’

উনার কথাতে নার্স কিছু বলার আগেই ফুঁসে উঠলাম আমি। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, ‘আপনি আমাকে ইনডিরেক্ট পা’গল বললেন! আপনার এতো বড় সাহস!’

‘আমি তোমাকে ইনডিরেক্ট না ডিরেক্টই পাগল বলছি। কারণ তুমি আসলেই পাগল।’

‘আপনার-ই বউ আমি। এতোই পাগল মনে হলে বিয়ে কেনো করেছেন?’

‘কারণ তখন জানতাম না তোমার মাথায় এতো বড় সমস্যা!’

আমি দ্বিগুণ রাগে ফুঁসে উঠলাম। কিন্তু কিছু বলার আগে নার্স থামিয়ে দেয়। কাচুমাচু করতে করতে বলে, ‘স্যার আপনি একটু বাহিরে যান। ম্যামকে এতো উত্তেজিত করবেন না।’

তীব্র একবার তীক্ষ্ণ চাহনী ছুড়ে চলে গেলেন। নার্স আমাকে শান্ত করলেন। স্যালাইনের আর একটু বাকি। তারপরই আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে। মনে মনে পণ করে রেখেছি আজ উনাার পি’ন্ডি চ’টকে তারপর শান্ত হবো। আমাকে পাগল বলা! আমাকে! এই প্রানেশাকে! উনি যদি তাশজিদ শেখ তীব্র হন তাহলে আমি মিসেস তাশজিদ শেখ তীব্র। হুহ!

স্যালাইন শেষ হতেই তীব্র সব বিল পে করে আমাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হলেন। বাড়ির কেউ আসেনি নাকি! আমি আশে পাশে নজর বুলিয়ে ঠোঁট গোল করে বললাম,

‘একি! বাড়ির কেউ নেই কেনো? আমি না রোগী! আমাকে না সবাই দেখতে আসবে!’

তীব্র এবার কপালে ভাজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, ‘এই মেয়ে সত্যি সত্যি কি তোমার মাথা গেছে নাকি? এমন বাচ্চাদের মতো কথা বলছো কেন? কি সমস্যা?’

আমি ভেংচি কেটে বললাাম, ‘আপনার একটা বাচ্চা লাগবে বললেই পারেন আমাকে বাচ্চাদের সাথে তুলনা কেনো দিচ্ছেন!’

তীব্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে নিজের কপাল নিজে চাপড়ালেন। হাত ধরে টেনে গাড়িতে বসাতে বসাতে বললেন, ‘তুমি আজ আমাকে পাগল বানিয়ে তবে ক্ষ্যান্ত হবে দেখছি। চুপচাপ গাড়িতে বসো!’

‘কিন্তু বাড়ি থেকে কেউ এলো না?’

‘নাহ আসেনি। কারণ কেউ জানে না তুমি হসপিটালে। ধপাস করে পানিতে পড়ার পর আমিই তোমাকে তুলেছি। পানি খেয়ে পেট ভরিয়ে তো জ্ঞান হারিয়েছো। বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান তারওপর তোমার শরীর একদম ঠান্ডা হয়ে গেছিলো তাই ভয়ে আমিই হসপিটালে নিয়ে এসেছি। আসার সময় শুধু আব্বু, ছোট মামা আর দারওয়ান চাচা দেখেছিলো তাও ওদের মানিয়ে রেখে এসেছি৷ বলেছি আমাদের কেউ খুঁজলে যেনো বলে আমরা একটু বাহিরে আসছি।’

‘তাহলে আমার শাড়ি?’

‘ওটা ছোট মামা দিয়ে গেছে। ভেজা কাপড় তো বদলানো লাগবে তিনি দিয়ে গেছে আর পাল্টিয়েছে ওই নার্সটা।’

আমি মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললাম, ‘এই এই ভালো কথা! আপনি এই নার্সের সামনে ভিজা শার্টে আসছিলেন?’

ততক্ষণে গাড়ি ড্রাইভ করা শুরু করেছে তীব্র। নিজের কাজে মন দিয়েই বললো, ‘হ্যাঁ। কেনো?’

আমি ফুঁসে উঠলাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘এজন্যই তো বলি মেয়েটা এতো প্রশংসা কেন করলো! নিজের এই হ*ট লুক না দেখাইলে চলছিলো না আপনার? বলি মাস্ক কিনার পয়সা নাই আপনার কাছে? এতো কি’প্টা কেন আপনি? এখন থেকে ঢিলাঢালা কাপড় আর সব সময় মাস্ক পড়ে ঘুরবেন।’

সাথে সাথেই গাড়ি থামিয়ে দিলেন তীব্র। ড্যাবড্যাব করে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি ধমকে বললাম, ‘সমস্যা কি? গাড়ি থামিয়েছেন কেনো?’

তীব্র গোল গোল চোখ নিয়ে বলে, ‘তোমার ব্যাপার স্যাপার আমার ভালো লাগছে না প্রাণ। কি হয়ছে বলো তো! কি সব তো বলতেছোই সাথে আমাকে ধমকাচ্ছোও! তোমার নিশ্চয় মাথার তা’র দুয়েকটা ছি’ড়ে গেছে৷ আ’ম ড্যাম সিউর।’

আমি কিছু বলতে নিয়েও বললাম না। গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে ফিরে বসলাম। তীব্র গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললেন, ‘আমাকে যা বলতেছো বলো সমস্যা নাই কিন্তু বাড়ি গিয়ে উল্টা পাল্টা কিছু বলো না বা করোও না।’

আমি চট করে তার দিকে ফিরলাম। চকচকে চোখ নিয়ে বললাম, ‘ভালো কথা। ভাবছি বাড়ি গিয়ে শ্বাশুড়ি মা আর ননদিনীকে দারুন রকমের সারপ্রাইজড করবো।’

তীব্র একবার আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর আমি নিজের মতো বসে রাস্তা দেখতে দেখতে বাড়ি পৌছলাম। আমাদের দেখে দ্রুত ছুটে আসলেন ছোট মামা আর আঙ্কেল। চিন্তিত সুরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘তুমি পুকুরে পড়লে কিভাবে মা? এখন শরীর ঠিক আছে তো?’

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। তীব্র আমাকে সাথে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই তিহা, মিলি কাছে এগিয়ে আসে। লিভিং রুমের সোফায় তানহা আর শোভা বসে ছিলো। তীব্র আমাকে নিয়ে সরাসরি রুমে যেতে চাইলেও আমি ব্যাগড়া দিলাম। কেনো যাবো রুমে! তিহা কাছে এগিয়ে এসে বলে,

‘ব্যাপার কি ভাইয়া ভাবী? তোমরা এতক্ষণ কোথায় ছিলে? আর ভাবি সেই যে বের হলে আর এতক্ষণ পর আসলে!’

আমি দাঁত বের করে বললাম, ‘আগে তো কখনো এখানে আসা হয়নি আর বিয়ের ঝামেলার জন্য বের হওয়াও হয়নি। কাল তোমার ভাইয়ের সাথে রাগ করেছিলাম। তাই আজ আমার রাগ ভাঙাতে ঘুরতে নিয়ে গেছিলো।’

মুখটা একটু লাজুক লাজুক করে আড়চোখে তানহার দিকে তাকাতেই দেখি খুব রেগে গেছে। ফর্সা চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। এবার তীব্রর দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি হা করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তিহা আর মিলি মিটমিট করে হেঁসে বললো,

‘বাহ বাহ। ভাইয়া! শুধু কি ভাবীকে নিয়ে ঘুরলেই হবে? আমাদেরও কিন্তু ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে।’

‘আচ্ছা নিয়ে যাবো। প্রানেশা রুমে চলো!’

আমি ঠোঁট উল্টে মাথার আঁচল টেনে নিয়ে তীব্রর সাথে রুমের দিকে হাঁটা লাগালাম। পেছন থেকে শব্দ পেলাম কিছু ভাঙার। সাথে সাথেই চেপে ধরলাম তীব্রর হাত। তীব্র আর পিছু না ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকলেন। আমি ঠোঁট চেপে হাসলাম। আমার মন এর থেকেও জোড়ে ভেঙেছে আর তানহার তো কেবল কফির কাপটাই ভেঙেছে। ঠোঁট বাকালাম। রুমে আসতেই তীব্র বললো,

‘মিথ্যা বললে কেনো নিচে?’

‘আমার শখ হয়েছে বলেছি। আরো বলবো! আপনার কি?’

তীব্র আমার মাথায় ছোট্ট করে একটা গাট্টা মে’রে বললো, ‘রেস্ট নাও যাও!’

আমি চুপচাপ বিছানায় হেলান দিয়ে বসলাম। তীব্র বের হয়ে যেতে নিলে পিছন থেকে হুট করেই প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন তীব্র?’

তীব্র থমকে দাঁড়ালেন। কয়েক পল সেভাবেই দাঁড়িয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রইলেন। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। তীব্র কোনো জবাব না দিয়েই চলে গেলেন। আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ঠোটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। উনি বাসে না আমাকে ভালো। বাসে না। সকল অভিনয়ের সমাপ্তি ঘটিয়ে মুখে হাত চেপে ডুকরে উঠলাম।

চলবে..