#প্রীতিলতা ❤️
#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury
#১৪_তম_পর্ব🍂
আপনাকে তো আমি খুব বুদ্ধিমতী আর প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন মেয়ে মনে করেছিলাম প্রীতি। কিন্তু আপনি যে আমাকে ভুল প্রমাণিত করলেন। এত বোকা কবে হয়ে গেলেন?
সায়েম এর কাছ থেকে মলমটা নিয়ে আমি নিজের হাতে লাগাচ্ছিলাম। হঠাৎ কানে তার কথাগুলো আশাতে আমি তার দিকে তাকিয়ে পরলাম।
— মানে?
— মানে এই যে তিন বছর আগে যে প্রীতিকে দেখেছিলাম আমি। চেহারা আদলে একই রকম হলেও প্রখর মেধা সম্পন্নকারী সাহসী ও চমৎকার ব্যক্তিত্বের সেই প্রীতিকে তো খুঁজে পাচ্ছি না।
আমি চমকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি নজর ঘুরিয়ে সায়েমের দিকে তাকালাম। চশমার আড়ালে চোখ জোড়া এবার একটু বেশি পরিচিত মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ এক নজরে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
— ডাক্তার ভাইয়া…!
সায়েম এবার শব্দ করে হেসে উঠলেন। গালে আবারও সেই টোল পড়া।হায় টোল ওয়ালা ভাইয়াকে আমি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলাম কি করে।
হাসি থামিয়ে ভাইয়া বলে উঠলেন,
— যাক ম্যাডামের এতক্ষণে আমাকে তাহলে মনে পড়েছে। তো ম্যাডাম আপনার স্মৃতিশক্তি এত নড়বড়ে হয়ে গেল কি করে?
আমি কপোট রাগ দেখিয়ে বললাম,
— মোটেও আমার স্মৃতিশক্তি নড়বড়ে হয়নি। তুমি বরং গড়বড়ে হয়ে গেছো।
— যেমন?
— আগেতো পাটকাঠির মত চিকন ছিলে এত বডি মাসেল বানালে কি করে?
—আগে হোস্টেলের খাবার খেতাম তাই পাটকাঠি ছিলাম। এখন মায়ের রান্না খাই তাই চেঙ্গিস খান হয়ে গেছি।
আমি ভাইয়ার কথা শুনে এবার হেসে দিলাম। ভাইয়া কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
— এই প্রীতিকেই তো এতোক্ষণ খুজছিলাম। ওইখানকার বারান্দায় দাঁড়ায় থাকা প্রীতিকে তো চিনতেই পারিনি। মিস ভয়ঙ্করী নাকি আবার কাঁদতেও পারে। ভাবা যায়।
যে কিনা আমার সহকারীকে ধরে সারা বিল দৌড় করিয়ে পিটিয়েছিল কি দোষ ছিল কাঁচা আম চুরি করেছে তাই।
তোমার এখনো মনে আছে ভাইয়া।
— না মনে তো থাকবে না। এমন মিস ভয়ঙ্করী পৃথিবীতে কয় পিস আছে যে তোমাকে ভুলে যেতে হবে।
প্রতিউত্তরে আমি শুধু হাসলাম।
ডাক্তার সরফরাজ আহমেদ। খুলনা মেডিকেলের নামকরা নিউরো সার্জন। তিন বছর আগে আমাদের গ্রাম কেশবপুরে গিয়েছিলেন। সেখানেই আলাপ হয়েছিল নাটকীয় ভাবে।
আমাদের বাড়ির পেছনে আমার আব্বুর হাতে লাগানো একটা ফল বাগান ছিল। যেটা আমি নিয়মিত পরিচর্যা করতাম। এই ফল বাগানেরই আম গাছের কাঁচা আম চুরি করছিলেন তার সহকারী।
কত যত্ন আর পরিচর্যার ফল এই কাঁচা আম গুলো। আম্মু আচার তৈরি করবে।আর সে কিনা নির্বিচারে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। ধরেছিলাম ব্যাটাকে আচ্ছা মত গাছের উপরে লম্বা লাঠি দিয়ে পিটিয়েছিলাম।। পরের লাফ দিয়ে পিছনের বিল দিয়ে দৌড়েছিল।
আমিও কম কিসে আমিও লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিলাম তাকে। পুরো বিল দৌড় করিয়ে অবশেষে আমাকে মেডিকেল ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল ওই সহকারি। সেখানেই ডাক্তার ভাইয়ার সাথে দেখা। ডাক্তার ভাইয়াই আমার হাত থেকে ওই সহকারীকে বাঁচিয়ে ছিল না হলে ওটা কে পিটিয়ে আমি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করতাম। আলাপ করে ভালো লেগেছিল বলে আমগুলো ফ্রিতে দিয়ে এসেছিলাম।
তারপর প্রায়ই মেডিকেল ক্যাম্পে যেতাম।ডাক্তারি পেশার উপর আমার খুব কৌতুহল ছিল। ভাইয়া সবার রোগ জিজ্ঞাসা করতো আমি পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতাম। ওষুধ লিখে দিত। সেগুলো দেখতাম। ইনজেকশন কিভাবে পুশ করতে হয় প্রেসার কিভাবে মাপতে হয়। সেগুলো ভাইয়ের সাথে থেকে থেকে শিখে নিয়েছিলাম।
আমি একা যেতাম না। আমার ভাইও সাথে যেত।ধীরে ধীরে আম্মু আব্বুর সাথেও ডাক্তার ভাইয়ার পরিচয় হয়েছিল। উনি যেদিন আমাদের গ্রাম থেকে চলে যাবেন সেদিন আব্বু ওনাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন দুপুরে। উনি এবং ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট দুপুরে খেয়েছিল আমাদের বাড়িতে। সেখানেই হয়েছিল আমাদের শেষ দেখা।
মাঝখানে তিন-তিনটা বছর কেটে গেছে। কতকিছুর পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি ভাবতেই পারিনি তিন বছর আগের সেই মেয়েটা আজ আমার সামনে আমার ভাইয়ের বউ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমিও ভাবতে পারিনি, এত বছর পরে এভাবে আমাদের দেখা হবে আবার।
কথাটা বলে মলমটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,
—থ্যাংকস ফর ইউর ট্রিটমেন্ট।
বলে বেরিয়ে আসছিলাম আমি তখন পেছন থেকে সায়েম বলে উঠলেন,
— মনের অসুখটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলার ব্যবস্থা কর প্রীতি। মানসিক অশান্তি নিয়ে মানুষ বেশিদিন সুস্থভাবে বাঁচতে পারে না।
আমি তাকে কিছু বলতে যাব তার মধ্যে তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন,
— আমি তোমার আর সায়মার কথোপকথন শুনেছি। দেখো সাফওয়ান আমার বন্ধু প্লাস ভাই হলেও ওর ব্যাপারে খুব কম জানি আমি। স্বভাবত ও খুবই চাপা। নিজের মনের কথা নিজের মধ্যে রেখে দিতে পারে অনায়াসে। মুখ দেখে কিছুই বোঝা যায় না ভেতরে কি চলছে।
আর আমার স্টাডি লাইফটা প্রায় বাইরে বাইরেই কেটেছে। ফ্যামিলির সাথে অতটাও কানেক্টেড ছিলাম না আমি। সেজন্য সাফওয়ান সায়মার ব্যাপারে তেমন কিছুই বলতে পারব না। সাইমা যদিও বলে সাফওয়ান কে সে পছন্দ করে। কিন্তু আসলে তাদের মধ্যে কি হয়েছিল সেটা একমাত্র সাফওয়ানই তোমাকে বলতে পারবে।
তাই বলছি হঠকারী কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে ভালোভাবে ভেবেচিন্তে ঠান্ডা মাথায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নাও। ঝোঁকের মাথায় এমন কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিও না যা নিয়ে ভবিষ্যতে পস্তাতে হয়।
যদি কোন দরকার পড়ে তবে আমাকে জানিও আমি তোমাকে যত সম্ভব সাহায্য করবো।
— আচ্ছা।
বলে আমি রুম থেকে বেরিয়ে চলে আসলাম।
হ্যাঁ অনেক হয়েছে। এবার একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
_________🌺🌺______
খালামনির সাথে দেখা করে কাঠের বাক্সটা হাতে নিয়ে নিচে নেমে আসলাম। খালামণিকে সাহস করে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। আর চাইছিলাম না। আমার তো চাই সাফওয়ানের উত্তর। খালামণি কাঠের বাক্স টা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
— শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমি যেন তার সাফুর পাশে থাকি।
আমি কোন প্রতি উত্তর করতে পারিনি। চুপচাপ তার কথা শুনে বাক্সটা নিয়ে চলে এসেছি। এসে দেখি সাফওয়ান সোফা সেটের উপর বসে আছেন। চেহারায় স্পষ্ট গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। আমি নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই পুতুল দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
— বাসায় যাব প্রীতিলতা আমার খুব ঘুম পেয়েছে।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে শুকনো একটা হাসি দিয়ে বললাম,
— এইতো এখনই যাবো।
আমার কথা শুনে সাফওয়ান সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ভাইয়া ভাবীরা আজ এই বাড়িতেই থাকবেন। সবার থেকে বিদায় নিয়ে সাফওয়ান পুতুলের হাত ধরে গাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। আমিও সদর দরজায় পেরিয়ে বেরিয়ে এসেছি। তখন খালামনি পিছন থেকে আমার হাত জড়িয়ে ধরে বললেন,
— অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু আমি তোকে বলতে পারিনি। তার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিস তুই। শেষের শুধু একটা কথাই বলবো। আমার সাফু বাবু কোন অন্যায় করিনি বরং অনেক কষ্ট পেয়েছে। ওকে কখনো কষ্ট পেতে দিস না। সকল মান-অভিমান ভেঙে আমার সাফু বাবুকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু কর। ইনশাল্লাহ আল্লাহ তোদের মঙ্গল করবেন।
আমি বরাবরের মতন নীরব ছিলাম। হ্যাঁ ও বলেনি না ও বলিনি। কারণ আমার অনেক কিছু জানার আছে। সত্যিটা আমাকে আগে জানতে হবে ।
হেঁটে চলে এসে গাড়িতে উঠলাম। পুতুল দেখি গাড়িতে ঘুমিয়ে গেছে ।ওকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে গাড়ির সিটে মাথাটা এলিয়ে দিলাম। সাফওয়ানের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পেরেছি তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভুলেও তার দিকে তাকালাম না। কোন কথাও বললাম না।
সাফওয়ান জোরে একটি নিঃশ্বাস নিয়ে গাড়িটা স্টার্ট করলেন। আমি চোখ বুঝে নিলাম। মনে মনে নিজেকে শক্ত করছি। আজকেই সমস্ত লুকোচুরির সমাপ্তি করব। অনেক হয়েছে আর না। আজ রাত্রে সাফওয়ানকে ফয়সালা করতে হবে। কাল সূর্যোদয়ের সাথে তার আর আমার সম্পর্কের শুভ সূচনা হবে নাকি পরিসমাপ্তি ঘটবে…..!
চলবে….!
[ রিচেক দেওয়ার সময় পাইনি। ]