প্রীতিলতা পর্ব-২০

0
408

#প্রীতিলতা ❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#২০_তম_পর্ব🍂

ড্রয়িং রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে প্রীতমের জন্মদিন উপলক্ষে। ওর কিছু ফ্রেন্ডস কেউ নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আব্বু অফিস থেকে ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। ফ্রেশ হয়ে এসে সোফায় বসে সাফওয়ানের সাথে কথা বলছেন।

টেবিলে সবকিছুই প্রায় সাজানো গোছানো হয়ে গেছে শুধু কেক টাই প্যাকেট থেকে বের করে রাখা বাকি। প্যাকেট খুলে কেকটা টেবিলে রাখতে গিয়ে সাফওয়ানের দিকে নজর চলে গেল। দেখলাম আব্বুর সাথে কথা বলতে বলতে তিনি আর চোখে আমার দিকে তাকালেন। তাড়াতাড়ি আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।

মুহূর্তে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পড়ে গেল।

তার স্পর্শগুলো গভীর থেকে গভীরতার হওয়ার আগেই নিজেকে তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম।

কি দরকার নিজেকে এই মিথ্যা মায়ায় জড়ানো। উনি এটা বললেন ঠিকই যে সে সাইমাকে পছন্দ করেন না। তিনি একবারও বললেন না তিনি আমাকে পছন্দ করেন। বা ভালোবাসেন। দুটো শরীর একত্রে থাকলে আকর্ষণ তো আসবেই কিন্তু মনের আকর্ষণ…!

এটা তো বেশি ইম্পরট্যান্ট তাই না। একটা সময় পড়ে গিয়ে শরীরের উপরে আর কারো আকর্ষণ থাকে না। চামড়া কুঁচকে যায় বয়সের ভারে নুয়ে যেতে হয় কিন্তু মনের আকর্ষণটা সে প্রথমবারের মতোই সতেজ থেকে যায়। যার আকর্ষণে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত সমস্ত ঝর ঝাপটা পেরিয়ে প্রিয় মানুষটার হাত আঁকড়ে ধরে থেকে যাওয়া যায়।

আজ আবারও সেই প্রথম দিনের মত বুকের বা পাশটা খুব যন্ত্রণা করছে। আমি ভেবেছিলাম আজ হয়তো তিনি সবকিছু বলে আমাকে নিজের মনের কথাগুলো বলবেন। আশায় বুক বেঁধেছিলাম আমি। আজি হয়তো বলবেন,

— প্রীতি আনমনে সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি । থেকে যাওনা সারা জীবন আমার পাশে। আমি তোমাকে প্রয়োজন আর মনের প্রয়োজনে

বেহায়া মত বারবার তাকে একই প্রশ্ন করেছি কিন্তু একবারও তিনি বললেন না। উঠে রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখছিলাম। তিনি হয়তো অবাক হয়ে গিয়েছিলেন আমার আচরণে।

এতদিন তো স্বেচ্ছায় তার কাছে ধরা দিতে চেয়েছি। ভগ্ন বিক্ষুব্ধ হৃদয় নিয়ে ফিরে এসেছি। কিন্তু আজ নিজেই নিজেকে তার কাছ থেকে গুটিয়ে নিচ্ছি।

দুটো মানুষকে এক ছাদের নিচে বাধলেই সংসার হয় না। উভয় দিক থেকে ভালোবাসা বরাবর হতে হয়। একজন কাঙালের মত ভালবাসবে আরেকজন তা বসে বসে উপভোগ করবে এমনটা হলে আর যাই হোক সংসার করা যায় না।

এমন একজনকে ভালো না বাসলেই বোধ হয় ভালো করতাম।

_________🌺🌺________

প্রিতমের বন্ধুরা বেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। প্রীতম আজ বেজায় খুশি। তার জন্মদিনটা একদম তার মনের মতো করে পালন করা হয়েছে। এবং এবারের জন্মদিনের সে তার সবথেকে পছন্দনীয় উপহার তার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছে।

রাত আটটা বাজে,

আম্মু ডাইনিং এর খাবার গোছাচ্ছে। আজ সবাই অনেক ক্লান্ত। তাই আগে আগে খেয়ে নেওয়াই ঠিক হবে বলে আমার মায়ের মনে হয়। পুতুলকে দেখলাম সোফায় বসে বসেই ঝিমুচ্ছে। বেচারী আজ দুপুরে আর ঘুম হয়নি। সারাদিন লম্প ঝম্প করে এখন সে খুবই ক্লান্ত। তাকে ডাকতে যাব তখন দেখি কলিং বেল বেজে উঠল।

বাসায় তো সবাই আছে। এখন আবার কে এলো? তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দেখে একটা ছেলে কিছু শপিং ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে সালাম দিয়ে বলল,

— সাফোয়ান স্যারকে একটু ডেকে দিন। এগুলো ওনার পার্সেল।

আমি ভ্রু কুচকে মনে মনে ভাবলাম ওনার পার্সেল এখানে আসবে কেন? লোকটাকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে আমি সাফওয়ানকে যেই ডাকতে যাব।

তখন দেখলাম তিনি রুম থেকে বেরিয়ে মেইন দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। ছেলেটার হাত থেকে প্যাকেট গুলো নিয়ে সালাম বিনিময় করে বিদায় জানালেন। তারপরে দরজা আটকে দিয়ে প্যাকেট গুলো নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলেন।

প্যাকেট গুলো ভালোভাবে চেক করে সোফার এক সাইডে রেখে দিয়ে আমার এসব বললেন রুমে এসো তোমার সাথে কথা আছে।

আমি তাকিয়ে দেখলাম মা রান্নাঘরে। প্রীতম টিভি দেখছে পাশের সোফায় প্রিতমের হাতের উপরে হেলান দিয়ে পুতুল শুয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পরে আমি চলে গেলাম আমার রুমে। গিয়ে দেখলাম তিনি রেডি হয়ে বিছানায় বসে হাতে ঘড়ি পরছেন। আমাকে দেখে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

— তাড়াতাড়ি রেডি হও আমরা কিছুক্ষণ পরে বাড়ি ফিরে যাব।

— আমি দুইদিন পরে যাব।

— তোমার ব্যাগের সাইজ দেখে তো মনে হচ্ছে না তুমি দুই দিনেও ওই বাড়ি আসবে। কালকে সকালে ফ্লাইটে মা বাবা ওমরা পালন করে ফিরছে।

আমি সাফওনের দিকে তাকালাম । তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,

— ও আচ্ছা এবার বুঝেছি। আপনি কেন বারবার আমাকে ওই বাড়ি ফিরে যেতে বলছেন। কাল সকালে যখন মা-বাবা আসছেন তার আগে আমি ওই বাড়ি পৌঁছে যাব। কিন্তু রাতে আমি এই বাড়িতে থাকব।

— কাল সকালে তুমি কার সাথে যাবে?

আমি দায়সারাভাবে উত্তর দিলাম,

— আমি তো আগেও খুলনা থাকতাম। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। আমার একা একা যাতায়াতে অভ্যাস আছে। চিন্তা করবেন না ভোরেই পৌঁছে যাব।

সাফওয়ান আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,

— আমাদের বাড়ির মেয়ে বউরা এমন একা একা যাতায়াত করে না। একা একা এ বাড়িতে এসেছো ঠিক আছে কিন্তু এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে ফিরবে তুমি আমার সাথে।

কথাগুলো বলে দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন সাফওয়ান কিন্তু আমার একটা কথা শুনে তিনি থেমে গেলেন।

—- চিন্তা নেই আপনাদের বাড়ির বউ এর তকমাটা আমার নামের পাশ থেকে কিছুদিনের মধ্যেই মুছে যাবে।

শব্দ করে দরজা আটকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

__________🌺🌺__________

মামনি আমি রাতেই প্রীতিকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে যাচ্ছি।

কেন বাবা এত রাত থেকে যাও আমাদের বাড়িতে এতদিন পর আমার মেয়েটা এসেছে আর তুমিও তো প্রথমবার এসেছ। জামাই মেয়ে প্রথমবার বাড়িতে এলে একরাত থাকতে হয়।

আম্মু খুবই অনুরোধের সুরে কথাটা বললেন। সাফওয়ান আম্মুর হাত জোড়ায় জড়িয়ে ধরে বলল,

কাল সকালে মা বাবা চলে আসছে। প্রীতিকে নিয়ে এয়ারপোর্টে যেতে হবে। না হলে ও আর আমি এক সপ্তাহ থেকে যেতাম এই বাড়িতে।

আমি খাওয়ার টেবিলে বসে মা আর সাফোয়ানের কথাগুলো শুনছি আর খাচ্ছি। নিরবা নির্মিত ভঙ্গিতে। তাদের কথা যেন আমার কোন কিছু যায় আসে না।

পরে অনেক জোরাজুরি শেষে আম্মু আমাদেরকে যেতে দিলে রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত দিলেন সামনের সপ্তাহে এ বাড়িতে দাওয়াত আছে সে সময় আম্মু আমাকে ১০ দিন এ বাড়িতে রেখে দিবেন।সাফওয়ান
বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিলেন।

খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাইকে সাফওয়ান ড্রইং রুমে ডাকলেন। সোফায় বসে এক এক করে মা বাবা আর প্রীতমের দিকে তিনটি শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিলেন।

বাবা সাফোয়ান কে বলে উঠলেন,

— বাবা এসবের আবার কি দরকার ছিল?

সাফওয়ান মুচকি হেসে বাবার পাশে বসে বললেন ,

— মা বলছিল জামাইরা প্রথম শ্বশুরবাড়ি গেলে শ্বশুরবাড়িতে বাজার করে নিয়ে যেতে হয় আরো অনেক উপঢৌকন দিতে হয়। আমিও প্রথমবার আসলাম কিন্তু তাড়াহুড়ায় তেমন কিছুই আনতে পারিনি। এই সামান্য …!

আমরা তোমাকে আমাদের ছেলের মতোই মনে করি। কোন বিষয় নয় তুমি এসেছ এটাই অনেক।

— আমিও সেই ভেবে এইগুলো এনেছি বাবা। তাছাড়া এগুলো দেওয়ার আরও একটা কারণ আছে যেটা এখন বলতে পারছি না পরে সবাইকে বলব ইনশাল্লাহ।

এবার আমাদের বিদায় দিন। আমাদেরকে এখন বেরোতে হবে।

______🌺🌺_______

প্রায় দেড় ঘন্টা জার্নি শেষে বাসায় এসে পৌছালাম আমরা। রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল। তাছাড়া এমনিতে সকালে জার্নি করে যাওয়া তার উপর ভাইয়ের বার্থডে সেলিব্রেশন আবার এই জার্নি সবমিলিয়ে আমি অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

ঘুমে দুচোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে আমার অনেক কষ্টে পা চালিয়ে মেইন রোডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম বেশ কয়েকবার ডোরবল বাজালাম বেশ খানিকটা সময় পড়ে এসে কে জানি দরজাটা খুলে দিল কিন্তু চেহারাটা দেখতে পেলাম না।

আমিও আর অত কিছু না ভেবে নিজের প্রায় অবশ হয়ে যাওয়া পা জোড়া টেনে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিলাম তখন পেছন থেকে কারোর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

— কেমন আছেন মিসেস প্রীতিলতা? এই অধমের দিকে তো একটু দৃষ্টিপাত করুন। তিনি তো আপনার অপেক্ষায় অনেকক্ষণ যাবত আপনার পথ চেয়ে বসে আছে।

পিছনে ফিরে দেখলাম। সুঠাম দেহের টোল ওয়ালা ডাক্তার ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে আমার পিছনে। আমি ক্লান্ত মিশ্রিত হাসি হেসে বললাম,

— আরে কখন এলেন ভাইয়া?

— সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরে। সে শুনলাম আপনারা নাকি সবাই বাইরে গেছেন। এই তো বসে বসে আপনাদের অপেক্ষা করতে লাগলাম। তা এই অধমের সাথে কি দুমুঠো ভাত খাওয়া যায়।

তখনই পেছন থেকে সাফওয়ান বলে উঠলো,

— ওই বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি। তুই খেয়ে নে সায়েম। আমরা অনেক ক্লান্ত আজ। কাল সকালে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া হবে।

কথাগুলো বলে সাফওয়ান আমার বাম হাত টেনে নিয়ে আসলেন রুমে। পুতুলকে রুমে নিয়ে যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেলেন ফ্রেশ হয়ে নিতে।

আমিও বিনা বাক্য ব্যয় ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে দেখি। সাফওয়ান অলরেডি পোশাক চেঞ্জ করে বিছানায় বসে পানি খাচ্ছে। হয়তো পুতুলের রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসেছে।

আমি ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে সাফয়ানের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলেন ‌। আমার হাত ধরে আটকে দিয়ে বললেন,

— কোথায় যাচ্ছ তুমি?

আমি তার দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

— পুতুলের ঘরে।

সাফওয়ান উঠে আমার সরাসরি দাঁড়িয়ে বললেন,

— কেন বিয়ে করে বউ হয়ে কি এ বাড়িতে এসেছিল পুতুলের রুমে থাকার জন্য?

আমি অশ্রুসিক্ত নয়নে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

— এখানে মানুষটাই আমার নয় সেখানে এই রুম দিয়ে আমি কি করবো?

সাফওয়ান কিছুটা চাপা ধমকের সুরে বলে উঠলেন,

— তখন থেকে খালি আজেবাজে কথাবার্তা বলে যাচ্ছ তুমি। কি বলতে চাইছ কি তুমি?

— মুক্তির ঘণ্টা বেজে গেছে সাফোয়ান। আমার মুক্তি চাই সবকিছু থেকে। মুক্তি…..!

তিনি যেন আর রাগ সংবরণ করতে পারলেন না। আমার দুই বাহু সে তার শক্তপাঞ্জা দ্বারা আটকে ধরে ঝাঁকিয়ে উচ্চস্বরে বললেন,

— মুক্তি…! কিসের মুক্তি। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ মৃত্যু ব্যতীত এই ঘর থেকে তোমার কোন মুক্তি নেই…..!

#চলবে……❣️