#My_First_Crush
#পর্ব-১৯
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
(রাইয়ান)
আকাশে একটি পূর্ণ চাঁদ। অন্ধকারের গা জুড়ে জ্বল জ্বল করছে আরো কিছু তারারাজিও। বাতাসে এক অন্যরকম আমেজ। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়েছে অথৈ সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে। চিক চিক করা সেই ঢেউ পৌঁছে যাচ্ছে বীচে থাকা মানুষের কাছে। যার মধ্যে আছি আমি আর হৃদিও। সাগড় পাড়ে জোৎস্নায় চিকচিক করা বালুর মধ্যে পাশাপাশি বসে আছি আমরা। বীচ এর পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পপলার, মেপল, উইপিং উইলো আর ট্রাভেলার্স পাম সহ আরও অসংখ্য গাছ। অদূরেই কিছু বাচ্চারা বালুতে খেলাধুলা করছে। তাদের বাবা মা হাতে হাত রেখে হাঁটছে সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে। দূরে কিছু লোক বসে বসে ফিশিং করছে। জোৎস্না নিয়ে তেমন আগ্রহ আমার কোন কালেই ছিল না। খুবই যান্ত্রিক গোছের মানুষ আমি। প্রকৃতির সাথে আমার সম্পর্ক অনেক দূরের। কিন্তু আজ কেন যেন চোখ আটকে গেলো। পারতপক্ষে এভাবে কখনো জোৎস্না বিলাসও তো করিনি! প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষের মধ্যে একধরনের বিষন্নতার সৃষ্টি করে। মন হয়ে উঠে অন্যরকম। সেই ভাবটা বুঝি আমাকেও ছুঁয়ে গেলো। ঠিক সেই সময় এক ঝাঁক সি গাল পাখি উড়ে গেলো আমাদের মাথার উপর দিয়ে। নিরবতা ভেঙে হৃদি হঠাৎ ডেকে উঠলো,
‘রাইয়ান, রাইয়ান দেখো, কত সুন্দর সি গাল!’
হৃদি ক্যামেরা বের করে ছবি তোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যাগ থেকে ক্যামেরা খুঁজে বের করে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই পাখিগুলো অনেকটা দূরে চলে গেলো। হৃদি ফুস করে চুপসে যাবার মতো মুখে একটা শব্দ করলো। পেছনে ঘুরে বলল, ‘যাহ! তুলতে পারলাম না।’
ক্যামেরা হাতে আবার বসে পড়লো আমার পাশে। আমি বললাম, ‘তোমার ক্যামেরার মেমোরি এখনো ফুল হয়নি? যেই ছবি তুলেছো আজ সারাদিন!’
হৃদি তৃপ্তি মুখে হাসলো। প্রফুল্লিত হয়ে বলল,
‘আচ্ছা, তোমার আজকে সবথেকে কোন সময়টায় বেশি ভালো লেগেছে? আচ্ছা আমিই বলি, আমার আজকে সবথেকে বেশি আনন্দ লেগেছে সমুদ্রের উপর প্যারাসেইলিং এর সময়। কি একটা মুহুর্ত! এই ভয় ভয় লাগে আবার এই আনন্দ লাগে। একদম গুজবাম্প দেওয়ার মতো একটা মুহুর্ত। মনে হলো অনেকদিন পর ছোটবেলায় অ্যামিউজমেন্ট পার্কে রোলার কোস্টারে চড়ার মতো অনুভূতি পেলাম। তাই না?’
আমি স্মিত হাসলাম। বললাম, ‘ভালো তো আমারও লেগেছে কিন্তু রোলার কোস্টারে চড়ার মতো অনুভূতি কিনা সেটা আমি বলতে পারি না।’
‘কেন? তুমি কখনো ছোটবেলায় রোলার কোস্টারে রাইড নাওনি? ভয় পেতে? ছোটরা অনেকেই প্রথমে দেখে ভয় পেয়ে যায় তারপর আর চড়তে চায় না।’
মৃদু হেসে আমি বললাম,
‘আমি কখনো সম্মুখ চোখে রোলার কোস্টার রাইড দেখেইনি।’
হৃদি অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি কখনো অ্যামিউজমেন্ট পার্কে যাওনি?’
আমি মাথা নাড়ালাম। খানিক সময় নিয়ে বললাম, ‘তোমার মনে আছে তুমি একবার আমার বাবাকে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলে? আমার বাবা আর মার লাভ ম্যারেজ ছিল। মা বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা একজন স্টুডেন্ট ছিলেন। সেখান থেকেই আমার বাবার সাথে মার পরিচয়। আমার বাবা আমার মাকে অসম্ভব ভালোবাসতো। আমার জন্মের কিছুকাল পরই মার মৃত্যুটা বাবা মেনে নিতে পারেনি। ডিপ্রেসড হয়ে পড়ে। জীবন, সংসার কোনকিছুতেই আর তার কোন মন থাকে না। তখন থেকেই সে ঘর ছাড়ে। কখনো এই পাহাড়ে কখনো ঐ পর্বতে এভাবেই কাটিয়ে আসছে তার জীবন। বাবার স্মৃতিগুলো আমার মনে অনেক ছোটবেলার। খুব ঝাপসা ঝাপসা চোখে ভাসে। বোধ হবার পর থেকে বাবাকে আমি কখনো আর নিজের চোখের সামনে দেখিনি। শুধু ফোনে কয়েকবার কথা বলেছি। স্কুলে যাবার পর দেখতাম সবার বাবা তাদেরকে স্কুলে ড্রপ করে যায়। যারা ভালো রেজাল্ট করতো তাদেরকে সেদিন অনেক অনেক আদর করতো তাদের বাবা মা। সেটা দেখেই আমি সবসময় শুধু পড়াশোনা করতাম। সবথেকে ভালো রেজাল্ট করার চেষ্টা করতাম। যাতে আমার বাবাও আমার কাছে চলে আসে, আমাকে আদর করে। কখনো কোন দুষ্টমি করতাম না, জেদ, আবদার করে কাউকে বিরক্ত করতাম না। যদি আমার বাবা এগুলো দেখে আমাকে দুষ্ট ছেলে ভেবে আর কখনো না আসে এই ভয়ে! নিজেকে একদম বেস্ট বানাতে চাইতাম। একদম শান্ত, ভদ্র বাচ্চাটির মতো। তাই পড়াশোনা ছাড়া বাইরের পৃথিবীর আনন্দ উল্লাসের সাথে আমার কখনো সংযোগ ঘটেনি। আমি তো ঠিকমতো খেলাধুলা করতেও বের হতাম না। বাকি বাচ্চারা যখন খেলার মাঠে আমি তখন থাকতাম পড়ার টেবিলে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার জীবনে শৈশবের স্তরটা স্কিপ হয়ে গেছে।’
কথাটা বলতে বলতে আমি ফিচেল হেসে ফেললাম। হৃদি আমার দিকে মলিন মুখে তাকিয়ে রইলো৷ আমি কখনো কারো কাছে আমার ভেতরকার লুকায়িত অনুভূতিগুলো গুলো শব্দে প্রকাশ করি না। আজ যখন
সেদিনের সেই সময়টায় ঝাপ দেই তখন বুঝতে পারি, আমার অজান্তেই আমার মন হৃদিকে কতোটা কাছের ভেবে নিয়েছিল। যতোটা কাছের হলে নিজের ভেতরটা নির্দ্বিধায় উন্মুক্ত করে দেয়া যায়। যতোটা কাছের হলে নিজের একান্ত অনুভূতিগুলো নিঃসংকোচে ভাগাভাগি করা যায়। সেদিন সেই রাতেই প্রথম হৃদির সামনে নিজেকে প্রকাশ করি আমি। আর হৃদি হয় আমার ভরসার মনোযোগী শ্রোতা।
___________________________________________________
(হৃদি)
আজ বিকেলের দিকেই আমাদের হোটেল ছেড়ে দেওয়ার কথা। শুনেছি ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ বইয়ের বিখ্যাত লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি নাকি এই কি ওয়েস্টেই। আমার একজন প্রিয় লেখক তিনি। তাই খুব ইচ্ছে হলো সেই বাড়িটা ঘুরে দেখে আসার। সকালে ব্রেকফাস্টের পর তাই সেই উদ্দেশ্যেই বের হলাম আমরা। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়িটাকে এখন হেমিংওয়ে মিউজিয়ামও বলা হয়। সুন্দর সাজানো দেখতে একটা বাড়ি। বাড়ির পাশে একটা পুলও আছে। ভাবতেই অবাক লাগে এই বাড়িটাতে তিনি এককালে সময় কাটিয়েছেন। লেখালেখি করেছেন। একজন ভক্ত হিসেবে এই অনুভূতিটা অন্যরকম। তার অনেক বিখ্যাত গল্প তিনি এই বাড়িতে থাকতে লিখেছিলেন। ‘দ্যা স্নো’স অফ কিলিমাঞ্জারো’ তার মধ্যে একটি। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি ঘুরে দেখে আমরা বাইরে বের হয়ে এলাম। কাছেই একটা লাইটহাউজ ছিল। সেটাও ঘুরে এলাম একটু। খানিক বিশ্রামের জন্য রাস্তার পাশে একটা কাঠের বেঞ্চ দেখে সেখানেই বসে পড়লাম আমি। রাইয়ানের ফোনে একটা কল আসায় সে একটু সাইডে গিয়ে কথা বলতে লাগলো। বেঞ্চে বসে আমি একটা কাপ আইসক্রিম খাচ্ছিলাম। খেতে দেরি হওয়ায় অনেকটাই মেল্ট হয়ে গেছে আইসক্রিম। আমি পাশে ঘুরে রাইয়ানকে দেখলাম একবার। এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে চোখ পড়তেই দেখলাম রাস্তার অপর পাশে একটা অ্যাশ কালারের একটা স্ট্রেট ক্যাট। বিড়াল তো আমার বরাবরই পছন্দ। আমার দিকেই বিড়ালটি তাকিয়ে থাকায় আমি আমার হাতের আইসক্রিমটা ওঁকে দেখিয়ে ইশারা করলাম। বিড়ালটা আসলো না। আমারও দৃষ্টি ঘুরে গেলো অন্য দিকে। রাইয়ান ফোন রেখে আমার দিকে এগিয়ে এলো। তার সাথে কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই হঠাৎ একটা ধাক্কার শব্দ শুনতে পেলাম৷ দ্রুত আমার দৃষ্টি চলে গেলো সামনে। দেখলাম সেই বিড়ালটি রাস্তার মাঝখানে একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম সেখানে। রাইয়ানও এলো আমার সাথে। ততক্ষণে গাড়ি থেকেও লোকটা বের হয়ে এসেছে। লোকটাকে এখানকার স্থানীয়ই মনে হলো। আমি তাকে রিকুয়েষ্ট করলাম আশেপাশে কোন পশু হাসপাতাল থাকলে আমাদের সেখানে নিয়ে যেতে।
হাসপাতালে বিড়ালটিকে নিয়ে যাবার পর ডক্টর বিড়ালটিকে চিকিৎসার জন্য ভেতরে নিয়ে গেলো। আমাদেরও এরপর চলে আসতে হলো হোটেলে। কিন্তু হোটেলে ফিরে আসার পরও আমি কেন যেন আমার মনকে শান্তই করতে পারছিলাম না। আমার শুধু মনে হচ্ছিল বিড়ালটির এক্সিডেন্ট হবার জন্য আমিই দায়ী। আমি যদি বিড়ালটিকে রাস্তার ওপাশ থেকে খাবার দেখিয়ে ইশারা না করতাম তাহলে বিড়ালটা এভাবে রাস্তা পার হতে আসতোও না আর গাড়ির সাথে ধাক্কাও খেতো না। খুব অনুতপ্ত বোধ হতে লাগলো আমার। একসময় আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। রাইয়ান বারান্দায় বসে ছিল। সেখানে গিয়ে আমি হন্তদন্ত হয়ে বললাম,
‘রাইয়ান, আমি আবারো পশু হাসপাতালটিতে যেতে চাই।’
রাইয়ান অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’
‘বিড়ালটার এক্সিডেন্ট আমার জন্যই হয়েছে। আমারই ওর জন্য রেস্পন্সিবল হওয়া উচিত।’
‘হৃদি, তুমি বেশি বেশি ভাবছো। এমন কিছুই না। শুধু শুধু নিজেকে দোষ দিচ্ছো কেন?’
‘না রাইয়ান, তুমি বুঝতে পারছো না। দোষটা আমারই ছিল। এই অনুতপ্ত বোধ নিয়ে আমি এভাবে বসে থাকতে পারবো না। আমি হাসপাতালে যেতে চাই।’
‘এখান থেকে ঐ হাসপাতাল কত দূর সেটা কি তোমার মাথায় আছে? তুমি আবার এইসময় ওখানে যাবার কথা বলছো!’
‘রাইয়ান, আমি জানি অনেক দূর। তবুও আরেকবার কি যাওয়া যায় না?’
রাইয়ান কাঠখোট্টা গলায় বলল, ‘আর গিয়ে এমন কি হয়ে যাবে? তোমার যাওয়াতে কি বিড়ালটা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে?’
আমি মিনমিনিয়ে আমতা আমতা করে বললাম, ‘আমরা কি বিড়ালটাকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারি না?’
রাইয়ান জোর দিয়ে বলল, ‘একদমই না।’
‘প্লিজ রাইয়ান! আমি বলছি বেশিদিন ওকে রাখতে হবে না। আমি শীঘ্রই কিছু একটা ব্যবস্থা করবো। আপাতত বিড়ালটা আমাদের কাছে থাকুক।’
‘না।’
আমার চোখে পানি চলে এলো। আমি বললাম,
‘কেন রাইয়ান? তুমি আমাকে একটু বুঝতে চাইছো না কেন?’
‘কারণ তুমি বেশিই ইমোশনাল হয়ে ভাবছো। এমন হাজার হাজার স্ট্রেট ক্যাট এই পৃথিবীতে আছে। তুমি কি সবার দায়িত্ব নিতে পারবে? এমন অহরহ রাস্তায় ওদের এক্সিডেন্ট হয় তুমি কি এমন সব বিড়ালকেই বাসায় নিয়ে যেতে পারবে? তোমার দ্বারা যতটুকু সম্ভব তুমি করেছো। বিড়ালটাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছো, ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করে দিয়েছো৷ দ্যাটস ইট। এতটুকুই ঠিক আছে। এখন বিড়ালটা মরে গেলেও তোমার কিছু করার নেই।’
আমি ব্যথিত স্বরে বললাম, ‘তুমি এতো স্বার্থপরের মতো এমন নিষ্ঠুর কথা কিভাবে বলতে পারো রাইয়ান?’
‘কারণ আমি স্বার্থপরই। আর এটা আমি স্বীকার করি। মানুষকে বাঁচতে হলে স্বার্থপরই হতে হয়। এতো আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। আমি যা বলছি প্রাকটিক্যালি ভেবেই বলছি। আর এটা নিয়ে আমার কোন দ্বিধা নেই।’
কথাটা বলে রাইয়ান আমাকে এড়িয়ে চলে যেতে লাগলো। আমি পেছনে ঘুরে তার উদ্দেশ্য অশ্রুসিক্ত গলায় বললাম,
‘আর আমার চাওয়া পাওয়া নিয়েও কি তোমার কোন যায় আসে না?’
রাইয়ান থমকে দাঁড়ালো। কিন্তু কিছুই বললো না। আমি আশাহত হয়ে দৃষ্টি সামনে নিয়ে এলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো রাইয়ান বুঝি আমার দিকে ফিরে তাকালো। আশা নিয়ে পেছনে ঘুরে তাকালাম আমি। কিন্তু দেখলাম সে দৃষ্টি সরিয়ে গটগটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলো। আমার প্রশ্নের উত্তর ‘না’ বুঝিয়ে দিয়ে।
আমি মাথা নাড়িয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।
কি ওয়েস্ট থেকে ফেরার পথে আমি চুপচাপ গাড়িতে বসে রইলাম। মায়ামি পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেকটাই গড়িয়ে গেলো বিকেল। আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের সামনে গাড়ি থামলে রাইয়ান কোন কথা না বলেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। চলে গেলো বিল্ডিংয়ের ভেতর। আমি কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম। অগত্যা নিজেই ব্যাগপত্র নেওয়ার জন্য গাড়ি থেকে ভোঁতা মুখে নামলাম। গাড়ির ব্যাকসাইড খুলে দেখতেই চমকে উঠলাম আমি। আমাদের লাগেজের পাশেই একটা ছোট্ট আরামদায়ক ঝুড়িতে ব্যান্ডেজ পায়ে সেই বিড়ালটা রাখা। বিড়ালটা আমাকে দেখেই মিঁয়াও বলে ডেকে উঠলো। খুশি হয়ে বিড়ালটিকে কোলে নিয়েই এক ছুটে সিঁড়ি বেয়ে আমাদের বাসায় ঢুকে পড়লাম আমি। রাইয়ান স্টাডি রুমে বসা ছিল। দরজার বাইরে থেকেই আমি আপ্লুত হয়ে বলে উঠলাম,
‘থ্যাংক ইউ রাইয়ান!’
চলবে,
#My_First_Crush
#পর্ব-২০
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
টেবিলে খাবারগুলো সাজিয়ে রাখছিলো হৃদি। এরপর একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে ব্রেডের গায়ে বাটার লাগাতে লাগলো। এমন সময় একটা জলপাই রঙের ফর্মাল শার্ট গায়ে রেডি হয়ে রাইয়ান এলো বাইরে। শব্দ করে চেয়ার টেনে বসে পড়লো টেবিলে। তার মুখ খানিক গম্ভীর। হৃদি সাবধানতার সাথে আড়চোখে তাকালো একবার রাইয়ানের দিকে। মনে করলো গতকাল রাতের কথা। গতকাল রাতে, হৃদি বসে ছিল সোফার উপর। হাতের একটা ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ ছিল তার। রাইয়ান কবাট থেকে তার শার্ট গুলো নেড়েচেড়ে কি যেন দেখছিল। হঠাৎ একটা মেরুন রঙের শার্ট বের করে রাইয়ান বলল,
‘এই শার্ট টা অনেকদিন ধরে পরা হয় না। কালকে অফিসে যাবার সময় এটাই পড়বো।’
হৃদি ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে রাইয়ানের হাতে ধরে রাখা শার্টের দিকে তাকালো। এরপর সহজ সুরেই বলল, ‘এই শার্টটা….ও, এরকমই একটা শার্ট একবার অ্যালেনকেও পড়তে দেখেছিলাম। একদম সেম, ব্রান্ডও বোধহয় একই।’
কথাটা বলেই হৃদি আবারো ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ দিলো। কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে গেলো রাইয়ানের। আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
‘কেমন লাগছিল?’
হৃদি ম্যাগাজিনে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করলো, ‘কাকে?’
‘যার কথা বললে।’
‘অ্যালেনকে?’
‘হুম।’
‘ভালোই। তোমাকেও ভালো লাগবে। শার্টের রঙটা অনেক সুন্দর।’
রাইয়ান শার্ট টা নিয়ে বিছানায় রাখলো। হৃদির সামনাসামনি বসতে বসতে তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আস্তে কারে ডাকলো,
‘এই!’
হৃদি সামনে তাকালো। রাইয়ান চেপে চেপে থেকে বলল,
‘অ্যালেন আর আমার মধ্যে কাকে বেশি ভালো লাগে?’
‘এই শার্টে?’
‘না, জেনুইনলি।
হৃদি কিছু বলতে গেলো। কিন্তু তার আগেই রাইয়ান জোর গলায় বলল,
‘একদম সত্যি কথা বলবে কিন্তু!’
হৃদি খানিক বিভ্রান্ত বোধ করলো। হঠাৎ এমন অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করছে কেন রাইয়ান? তবুও একবার ভেবে নিলো এই প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিবে। রাইয়ান যুক্তিবাদী মানুষ৷ তার উপর এতো সিরিয়াস হয়ে আছে! যদি তার প্রশংসা করলে মনে করে হৃদি তাকে পাম দিচ্ছে তাই যুক্তির সাথেই যেটা ঠিক মনে হয় হৃদি সেভাবেই রাইয়ানের আঙ্গিকে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
‘তুমি আর অ্যালেন দুজনেই দেখতে সুন্দর। কিন্তু তোমার থেকে অ্যালেন দুই ইঞ্চি বেশি লম্বা আর ফর্সার ক্ষেত্রেও…..ইংরেজরা তো একটু বেশিই ধবধবে হয়। আবার ওর চোখটাও বাদামী, ইউনিক। সেই হিসেব অনুযায়ী বোধ হয় অ্যালেনই…..’
রাইয়ান ঝট করে বিছানা থেকে শার্ট টা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। শক্ত মুখে কবাটের দরজা খুলে হৃদির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দু হাতে ইচ্ছে মতো দলা মোচড়া করতে লাগলো শার্ট টা। হৃদি অবাক মুখে তাকিয়ে রইলো রাইয়ানের দিকে। কবাটের মধ্যে শার্ট টা ছুঁড়ে মেরে রাইয়ান বাইরে চলে গেলো। যাবার আগে জোরে শব্দ করে বেডরুমের দরজাও লাগিয়ে দিলো।
সেই শব্দটা মাথায় বাজতেই আবারো খানিক সচকিত হয়ে উঠলো হৃদি। ফিরে এলো বাস্তবে। দেখলো রাইয়ান কোন কথা না বলে নিজের মতো করে শুধু খেয়ে যাচ্ছে। হৃদি আস্তে করে জুসের গ্লাসটা এগিয়ে দিলো রাইয়ানকে। রাইয়ান একবার ভারী চোখে তাকালো হৃদির দিকে। কোন কিছু বললো না। হৃদির খাওয়া হয়ে গেলে সে উঠে পড়লো। মিঁয়োর খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। দরজার সামনে বসে মিঁয়োকে আদর করে খাওয়াতে লাগলো হৃদি। এমন সময় খাবার শেষে রাইয়ানও এলো সেখানে। চারপাশে তাকিয়ে একবার লক্ষ করে হৃদিকে বলল,
‘ঐ নতুন বিড়ালটাকে দু দিন ধরে দেখছি না যে! ওটা কোথায়?’
হৃদি বলল, ‘ও, ঐ বিড়ালটা তো আমি অ্যালেনকে দিয়ে দিয়েছি।’
রাইয়ান গলার জোর বাড়িয়ে বলল, ‘অ্যালেনকে দিয়ে দিয়েছো!’
‘হুম। আমিও ভেবে দেখলাম দুটো বিড়াল একসাথে থাকলে আরো বেশি ছোটাছুটি করবে। ঝগড়া করবে। বিশৃঙ্খলা হয়ে যাবে। এজন্য অ্যালেনকে দিয়ে দিয়েছি। অ্যালেনও বিড়াল অনেক পছন্দ করে। বিড়ালটাও ভালো থাকবে।’
‘বিড়ালটাকে কি অ্যালেনকে দিয়ে দেওয়ার জন্য আমি নিয়ে এসেছি?’
রাইয়ানের প্রতিক্রিয়া দেখে হৃদি ঈষৎ মুখ ফুলিয়ে বলল, ‘তুমি এতো রাগ হচ্ছো কেন? তুমিই না বিড়াল পছন্দ কর না! তুমি তো চাচ্ছিলেও না বিড়ালটাকে আমরা এখানে নিয়ে আসি। আমি তো তোমার কথা ভেবেই দিয়ে দিলাম।’
রাইয়ান গজগজ করে যেতে যেতে বলল, ‘হ্যাঁ, এখন তোমার প্রিয় অ্যালেনকে সবকিছুই দিয়ে দাও।’
হৃদির মুখ হা হয়ে গেলো। রাইয়ান চলে গেলে সেও ঈষৎ ঠোঁট বেঁকিয়ে দু হাত বুকে গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো।
___________________________________________________
কফিশপে বসে একটা আয়না হাতে ধরে চোখের পাপড়িতে মাশকারা লাগাচ্ছিল জেরিন। হৃদি গজগজ করতে করতে কফিশপে ঢুকলো। জোরে জোরে চেয়ার টেনে বিরক্তি মুখে বসে পড়লো জেরিনের পাশে।
হৃদির মুখের অবস্থা দেখেও জেরিন কিছুই জিজ্ঞেস করছে না দেখে হৃদি এবার নিজ থেকেই বলতে লাগলো, ‘রাইয়ানের মাথা না কিছুদিন ধরে খারাপ হয়ে গেছে। কখন কোন কথায় রিয়্যাক্ট করে কিছুই বোঝা যায় না। এই যেটা করায় তার সমস্যা বোঝায় সেটা আবার না করলেও তার সমস্যা। মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। এমন কনফিউশান তৈরি করে রাখলে আমি করবো টা কি?’
জেরিনের নিরস গলা, ‘ডিভোর্স দিয়ে দে।’
হৃদি থতমত খেয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বলল,
‘ডিভোর্স দেবো মানে?’
‘তুই ই বললি না, রাইয়ান তোর মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। এজন্যই তো বললাম।’
‘আরে….কাপলদের মধ্যে কি ছোটোখাটো ঝগড়াঝাটি হয় না? এতটুকুতেই কি ডিভোর্স দিয়ে দিতে হবে! আজব কথা।’
জেরিন হেসে উঠলো হৃদির মুখের ভাব দেখে। বলল,
‘জানি, মজা করে বলেছি আমি।’
তখন একটা কাস্টমার এসে পড়ায় সেখানেই আলাপের সমাপ্তি ঘটাতে হলো তাদের৷
বিকেল বেলা কফিশপ থেকে তাড়াতাড়িই চলে এলো জেরিন। নিজের বাসায় ঢোকার আগে কিছু একটা ভেবে থেমে গেলো। আস্তে আস্তে গিয়ে দাঁড়ালো জিশানের দরজার সামনে। কলিংবেল দুবার চাপতেই জিশান দরজা খুললো। জেরিনকে দেখেই আবার দরজা লাগাতে গেলো। মাঝখানে পা দিয়ে আটকে ফেললো জেরিন। কিছুক্ষণ এভাবেই চাপাচাপি করে পরাজয় স্বীকার করলো জিশান। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কি?’
জেরিন বলল, ‘তোমাকে আমার হয়ে একটা কাজ করতে হবে।’
জিশান মুখে হেসে ফেলার মতো একটা শব্দ করে বলল, ‘তোমার কি আমাকে সরকারি লোক বলে মনে হয়? মামাবাড়ির আবদার! তোমার হয়ে কোন কাজ করার সময় আমার হাতে নেই। আর থাকলেও আমি করবো না।’
জিশানের প্রশস্ত হাসি মুখের প্রতুত্তরে জেরিনও মুখ প্রশস্ত করে হাসলো। মনে মনে যেন এমন উত্তরের জন্যই প্রস্তুত ছিল সে। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, ‘রাজী তো তুমি এমনিতেও হবে। এখন সিদ্ধান্ত তোমারই হাতে বেশি হাইপার হয়ে রাজী হবে নাকি সহজ ভাবেই রাজী হয়ে যাবে।’
‘আমি রাজী হবোই তোমাকে কে বলেছে?’
জেরিন ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে টিপতে টিপতে বলল, ‘রাজী যদি নাই হতে চাও তাহলে আর কি করার এই ছবিগুলো আমাকে তোমার ফ্রেন্ড’স সার্কেলের গ্রুপে আপলোড করে দিতে হবে।’
এরপর জেরিন এক এক করে ছবিগুলো দেখাতে লাগলো জিশানকে। জিশান দেখলো তার হাঁচি দেবার ছবি, নাক খুটার ছবি, সর্দি পরিষ্কার করার ছবি, মুখ এঁকেবেঁকে যতো বিশ্রী এঙ্গেল করা যায় সব ধরণের ছবি আছে জেরিনের ফোনে। জিশান চোখ বড় বড় করে বলল, ‘এই….এই ছবি তুমি কোথায় পেলে? তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে বারান্দা দিয়ে আমার ছবি তুলেছো?’
জেরিন ভদ্র ভাবে হেসে বলল, ‘কিভাবে পেলাম, কিভাবে তুললাম সেগুলো কোন ব্যাপার না। ব্যাপারটা হলো তুমি যদি আমার কথা মতো কাজটা না করো তাহলে তোমার এই উইয়ার্ড ছবিগুলো তোমার পরিচিত অপরিচিত সবাই দেখতে পাবে। তখন করো আর নিজের হ্যান্ডসাম হবার দাবী!’
জেরিনের কথা শেষ হতে না হতেই জিশান খপ করে জেরিনের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো। জেরিন ব্যগ্র হয়ে ফোনটি পুনরুদ্ধার করার আগেই তার ছবিগুলো ডিলিট করে ফেললো জিশান। এরপর ভাবের সাথে ফোন ধরিয়ে দিলো জেরিনের হাতে। জেরিন এবারও কোন বিচলিত ভাব না দেখিয়ে বলল,
‘তোমার কি মনে হয় এতো গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলো আমি শুধু আমার ফোনেই রেখেছিলাম, যে তুমি ডিলিট করে ফেললেই সেগুলো আমি আর পাবো না!’
জিশানের মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো। একটা দুঃখী এক্সপ্রেশন দিয়ে জেরিনের কথায় রাজী হয়ে গেলো সে। জিশান দরজা আটকে ফেললে জেরিন এতক্ষণে ধরে রাখা মুখের হাসি সরিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কারণ সত্যি বলতে, ছবিগুলো যে আর ছিল না তার কাছে।
___________________________________________________
হলুদ রঙের একটা বাস থেকে নেমে এলো রাইয়ান ও জিশান। জায়গাটা একটা পার্কের মতো। ঢালু ভূমির উপরে। একটু দারুণ ওয়েদার হলেই এখানে পিকনিক করতে চলে আসে লোকজন। এসময় মানুষের ভালোই আনাগোনা। গাছের নিচে সুন্দর স্পট দেখে মাদুর বিছিয়ে বসে আছে একেকজন। সামনে হরেক রকমের খাবার সাজিয়ে রাখা। কেউ কেউ বা নিজেদের মধ্যে কিছু ছোটখাটো মজাদার গেমস খেলছে। রাইয়ান জিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোর বার্থডে না জানুয়ারীতে! তাহলে এখন আবার এগুলো কি?’
জিশান পড়ে গেলো গ্যাড়াকলে। জেরিনের কথা রাখতে বাধ্য হয়ে এসব আয়োজন করতে হয়েছে জিশানকে। এখন এই প্রশ্নের কবল থেকে তাকে উদ্ধার করবে কে?
জিশান বিগলিত হয়ে হেসে বলল,
‘আজকে আমার সার্টিফিকেটের ডেট অনুযায়ী বার্থডে। এখন এটাতেও তো একটু ইনজয় করা দরকার তাই না? তাই একটু আমরা না হয় পিকনিক করলাম।’
রাইয়ান ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘সার্টিফিকেট অনুযায়ী বার্থডে! এই কথা তো আগে কখনো শুনিনি।’
জিশান নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল,
‘আমিও এই প্রথম শুনলাম।’
রাইয়ান বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি?’
জিশান বলল, ‘কিছু না।’
রাইয়ান সন্ধিগ্ধ হয়ে বলল, ‘আমার কিছু গড়মিল লাগছে। তুই মনে হয় মনে মনে কিছু প্যাচাচ্ছিস! আমার প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল। আমি এসবের মধ্যে নেই।’
এই বলে জিশানের ডাক উপেক্ষা করে রাইয়ান পেছনে ঘুরে চলে যেতে লাগলো। হঠাৎ সামনে থেকে সেখানে হৃদি আর অ্যালেনকে আসতে দেখে থমকে গেলো রাইয়ান। ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। সরু চোখে তাকালো পেছনে জিশানের দিকে। জিশান একটা ঢোক গিললো। হৃদি আর অ্যালেন কাছাকাছি চলে এলো। হৃদিকে উদ্দেশ্য করে অ্যালেনের দিকে তাকিয়ে রাইয়ান বলল,
‘তুমি এখানে কেন?’
জিশান এগিয়ে এসে বলল, ‘আমিই আসতে বলেছি। হৃদিকেও আমি মেসেজ করে ইনভাইট করেছি। পিকনিকে যত বেশি মানুষ হবে ততই তো মজা হবে তাই না!’
রাইয়ান সেদিকে খেয়াল করলো না। ওঁ আবারো ওদের একসাথে দেখা প্রসঙ্গে কিছু বলতে যাবে তার আগেই জিশান রাইয়ানের কানে ফিসফিস করে বলল,
‘আরে আলাদা আলাদাই এসেছে। এখানে এসে দেখা হয়েছে।’
রাইয়ান আস্তে করে তাকালো জিশানের দিকে। হৃদি ভেবেছিল তার এখানে আসার কথা বুঝি রাইয়ানই জিশানকে দিয়ে বলিয়েছে। একারণেই এসেছিল সে। যখন দেখলো রাইয়ান এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। আর উল্টো রাইয়ানের এমন রাগ রাগ ভাব দেখে তারও মুখ ফুলে গেলো। এমন কি হয়েছিল যার কারণে রাইয়ানকে এখনো রাগ হয়ে থাকতে হবে?
জিশান বুঝতে পারলো না কিভাবে কি করবে? পরিস্থিতি একদমই স্বাভাবিক ঠেকছে না তার। জেরিন বলেছিল একটা পিকনিকের আয়োজন করে রাইয়ান আর হৃদির মধ্যে ভাব করার জন্য কিছু পরিস্থিতি তৈরি করতে। কিন্তু এদিকে অ্যালেনকে মাঝখানে রেখে রাইয়ান বসে আছে একদিকে মুখ করে। হৃদি বসে আছে আরেকদিকে মুখ করে। জিশান পড়েছে এই একটা ফ্যাসাদে। বিয়ের পরেও রাইয়ানের এমন দূরে দূরে থাকার আসল কারণ বন্ধুত্বের জন্য খুলেও বলতে পারছে না আবার জেরিনের এ ব্যাপারে অদ্ভুত অদ্ভুত অনুমানের শিকার হতে হচ্ছে তাকেই। জিশান গলা খাঁকারি দিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলো। এরপর বলল,
‘কখন থেকে মাদুর বিছিয়ে তোমাদের সামনে খাবার নিয়ে বসে আছি। কেউ দেখি কিছুই খাচ্ছে না। এতো দূর থেকে খাবার টেনে এনেছি, আবার প্লিজ এগুলো আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেখে দিও না।’
এই কথা শুনে সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো। অ্যালেন ক্রিম বানের একটা প্যাকেট নিয়ে ছিঁড়তে শুরু করলো।সামনেই একটা চিপসের প্যাকেট রাখা। হৃদি আর রাইয়ান একসাথেই হাত দিলো সেই প্যাকেটে। দুজন দুজনের দিকে একবার তাকিয়েই আবার সরিয়ে ফেললো হাত। হয়ে গেলো আগের মতো। জিশান মাথা কাত করে আস্তে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বাসায় ফিরে জেরিনকে কি আপডেট দিবে কে জানে! এমন সময় একটা ফোন আসায় সেখান থেকে উঠে খানিক দূরে গেলো রাইয়ান। অ্যালেন হৃদির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
‘এই স্নাক্সটা ট্রাই করো হৃদি। এটা খুবই ভালো।’
হৃদি বলল, ‘আমার এখন ইচ্ছে করছে না। একটু পরে খাবো।’
‘আচ্ছা। ও! আজকে তো তোমার দেওয়া বিড়ালের পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েছি।’
‘তাই! বিড়ালটা কি আতর্নাদ করেছে?’
‘একটু। অতটাও না। আমি ওঁকে এখন তরল তরল খাবারই খেতে দিচ্ছি। ওঁর রিকোভার করতে যেগুলো উপকারী সেগুলোই।’
হৃদি খুশি হয়ে বলল, ‘থ্যাংক ইউ অ্যালেন। আমি জানতাম তুমি ওর খুব ভালো ভাবেই খেয়াল রাখবে।’
এমন সময় রাইয়ান এলো সেখানে। ওদের দুজনের মাঝখানে গিয়ে বসে জায়গা করে নিলো নিজের। হঠাৎ রাইয়ানের এমন আগমনে হৃদি আর অ্যালেন দুজনই অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে। রাইয়ান না দেখার ভাণ করে বলল,
‘এই স্নাক্স টা আসলেই মজা। ট্রাই করেছিস তোরা?’
জিশান পরিবেশ জমজমাট করতে বলল,
‘চল একটা গেম খেলি।’
রাইয়ান বলল, ‘হোয়াই নট।’
ওরা চারজন গোলাকার হয়ে বসলো এরপর। জিশান ফোনে একটা মিউজিক সেট করে বলল,
‘মিউজিক একটু পরপর অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হওয়ার সময় যার হাতে বল থাকবে তাকে যে কেউ
একটা প্রশ্ন করতে পারবে। ঠিকাছে? আচ্ছা এবার শুরু।’
জিশান বলটা রাইয়ানের দিকে ছুঁড়ে মারলো। রাইয়ান মারলো হৃদির দিকে। হৃদি ছুঁড়ে দিলো অ্যালেনের দিকে। ঠিক তখনই মিউজিক বন্ধ হয়ে গেলো। রাইয়ান অ্যালেনকে প্রশ্ন করলো,
‘তুই আজকে এমন খুশি খুশি হয়ে আছিস কেন?’
অ্যালেন থতমত খেয়ে গেলো। তার খুশি থাকার কারণটা যদি এখন বলে দেয় তাহলে তো হৃদিও সব বুঝে যাবে। সে চোখ ইশারা করে রাইয়ানকে প্রশ্ন ঘুরাতে বলল। কিন্তু রাইয়ান নির্লিপ্ত। আমতা আমতা করতে করতে অ্যালেন বলল, ‘সবাই একসাথে আছি এর জন্য। ভালো একটা সময় কাটা হবে।’
রাইয়ান শব্দ করে অবিশ্বাস্যের একটা হাসি হাসলো। হৃদি ভ্রু কুঁচকে তাকালো রাইয়ানের দিকে। খেলা আবার শুরু হলো। এবার বল থামলো হৃদির হাতে। এবারও রাইয়ান সবার আগে প্রশ্ন করে ফেললো,
‘মেরুন কালারের শার্ট তো তোমার ভালোই লাগে তাই না?’
নিঃসন্দেহে একটা সরাসরি খোঁচা। হৃদির মুখ হা হয়ে যাবার উপক্রম হলো। সে চোখ ইশারা করে রাইয়ানকে শাসন করলো। না দেখার ভাণ করলো রাইয়ান। সবাই হৃদির দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সে জোর করে মুখে হাসি টেনে মাথা নাড়িয়ে একটা অস্পষ্ট উত্তর দিলো। এবার খেলায় বল এসে থামলো রাইয়ানের হাতে। অ্যালেন প্রশ্ন করলো,
‘তোর আজকে কি হয়েছে? তুই আজকে এমন করছিস কেন?’
রাইয়ান স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে বলল, ‘কেমন করছি?’
‘তোকে তো দেখে মনে হচ্ছে তোকে পাগলা কুকুর কামড়েছে।’
জিশান ফস করে হেসে ফেললো এই কথা শুনে। রাইয়ান জিশানের দিকে তাকিয়ে উঠে পড়লো সেখান থেকে। হৃদি পেছনে ঘুরে রাইয়ানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।
নিরিবিলি একটা রাস্তা দেখে জঙ্গলের দিকে হেঁটে বেড়াচ্ছিল রাইয়ান। পেছনে ঘুরে একবার তাকিয়ে দেখলো হৃদি তার পেছন পেছন আসছে। রাইয়ান কিছু না বলে হাঁটতে লাগলো। মোড়ের মতো একটা জায়গায় ঘুরে গিয়ে দেখলো এখনও হৃদি তাকে অনুসরণ করছে। রাইয়ান এবার থেমে পেছনে ঘুরে বলল,
‘তুমি আমার পেছন পেছন আসছো কেন?’
হৃদি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে রাইয়ানের সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল,
‘কি হয়েছে রাইয়ান? তুমি এমন করে আছো কেন?’
রাইয়ান কিছুই বলল না। কোমড়ে হাত রেখে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হৃদি আচমকা হেসে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
‘আমি বুঝেছি। সেদিন আমি তোমাকে না বলে অ্যালেনকে সুন্দর বলেছি বলে তুমি জেলাস হয়েছো তাই না?’
ভ্রু কুঁচকে রাইয়ানের মুখ হা হয়ে গেলো। এভাবে কেউ মুখের উপর এই কথা বলে দেয়!
কিছুক্ষণ বাদে জঙ্গলের রাস্তা থেকে একা বেড়িয়ে এলো হৃদি। খানিক এগোতেই সামনে পড়লো অ্যালেন। বলল, ‘কোথায় গিয়েছিলে হৃদি? তোমাকে আশেপাশে না দেখে তো আমি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।’
‘এই তো একটু এদিকেই গিয়েছিলাম।’
হৃদির মুখে ফোটা ফোটা ঘাম দেখে অ্যালেন একটা পানির বোতল এগিয়ে দিলো হৃদির দিকে। হৃদি হাত দিয়ে ধরতেই যাবে তার আগেই রাইয়ান পেছন থেকে আবারো ওদের মাঝখান দিয়ে এসে পানির বোতলটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। বোতলের ছিপি খুলে একটা চুমুক দিয়ে বলল, ‘আজকে একটু বেশিই গরম লাগছে তাই না?’
হৃদি আর অ্যালেন অবাক মুখে রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর, কিছুই হয় নি এমন ভাব নিয়ে বোতল থেকে পানি খেতে লাগলো রাইয়ান।
দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে গেলো। যাওয়ার সময় হয়ে এলো ওদের। রাইয়ান আর হৃদি পাশাপাশিই দাঁড়িয়ে ছিল। অ্যালেন এসে তখন জিজ্ঞেস করলো,
‘রাইয়ান তুই তো গাড়ি নিয়ে আসিসনি তাই না?’ তারপর হৃদির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘হৃদি, আমি যে বলেছিলাম না আমার একটা পরিচিত গ্রোসারি শপের শপকিপারের সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেবো। ওটা এখান থেকে কাছেই। আমরা কিন্তু এখনই যেতে পারি।’
রাইয়ান খপ করে হৃদির হাত ধরে অ্যালেনের কথায় বাঁধা দিয়ে বলল,
‘না, আমরা এখন কিছু কেনাকাটা করতে যাবো।’
অ্যালেন বলল, ‘তুই না বললি তুই অফিসে যাবি?’
‘ভেবেছিলাম, এখন মত পাল্টেছি। আমাদের ওয়াশরুমের লাইট নষ্ট হয়ে গেছে। আমি একা চুজ করতে পারবো না। হৃদিকেও লাগবে। এটা ইম্পর্ট্যান্ট।’
অ্যালেন কিছুক্ষণ সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে চলে গেলো। রাইয়ান আড়চোখে একবার হৃদির দিকে তাকিয়ে দেখলো হৃদি হাসি হাসি মুখ করে রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। রাইয়ান সামনে দৃষ্টি রেখেই জিজ্ঞেস করলো,
‘হাসছো কেন?’
হৃদি মিষ্টি হেসে বলল, ‘তুমি আমার হাত ধরে আছো বলে আমার খুব ভালো লাগছে।’
একটা চাপা সুক্ষ্ম হাসি রাইয়ানের চোখে মুখেও ভেসে উঠলো। হৃদির হাত ধরেই রাখলো সে।
___________________________________________________
(রাইয়ান)
আমাকে একা পেয়েই টেনে একটা ঝোপের আড়ালে নিয়ে এলো অ্যালেন। জিশান আগে থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিজের হাত ছাড়িয়ে কিঞ্চিৎ অবাক মুখে বললাম, ‘কি করছিস অ্যালেন?’
অ্যালেন বলল, ‘তুই কি করছিস রাইয়ান?’
আমি বুঝতে না পেরে বললাম, ‘আমি কি করছি মানে?’
‘আজকে ভেবেছিলাম এই পিকনিকের বাহানায় আমি একটু হৃদির মনে আরো জায়গা করতে পারবো। কিন্তু তুই তো সেই সুযোগই আমাকে দিচ্ছিস না।’
‘হেই অ্যালেন, তোর মনে হয় তুই হৃদির মনে নিজের জায়গা বানাতে পারবি? এমনও তো হতে পারে হৃদিই তোকে কখনো সেই সুযোগ দিবে না।’
‘সেটা আমার ব্যাপার। আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে ওর মন জয় করেই ছাড়বো। একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়বো’
আমি জোর দিয়ে বললাম, ‘এটা কখনো সম্ভব নয়।’
‘কেন সম্ভব নয়?’
‘তোদের সবকিছুই আলাদা। হৃদি বাঙালি, তুই ইংরেজ। ভাষা আলাদা, দুজনের ধর্ম পর্যন্ত ভিন্ন। তোর মনে হয় এগুলো এতো সহজ?’
‘আমার কাছে এসব কোন ম্যাটার করে না। আজকাল আমেরিকায় এরকম ভিন্ন ধর্মের মানুষের বিয়ে অহরহ হচ্ছে। প্রয়োজনে আমি চেঞ্জও করতে পারি। শুধু একবার হৃদির মন পেতে চাই। কিন্তু তুই ই শুধু বাঁধা দিচ্ছিস। তুই কি হৃদিকে ভালোবেসে ফেলেছিস?’
অ্যালেনের এই প্রশ্নটা আমার মনে একটা ধাক্কার মতো লাগলো। কখনো ভাবনাতে না আনা অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন হয়ে সামনে এসে ধরা দিলো। এতদিন আমার সকল অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়ার সম্ভবত প্রশ্ন। যা কখনো এমনও হতে পারে বলে ভাবিওনি আমি। এবং যেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে অ্যালেনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হুট করে কোন শব্দ খুঁজে পেলাম না। একটা ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বললাম, ‘আমি….আমি কেন হৃদিকে ভালোবাসবো!’
অ্যালেন বলে উঠলো, ‘তাহলে! দেখেছিস, তুই শুধু শুধু উইয়ার্ড লাগবে ভেবে এমন বিহেভ করছিস। মানতে চাইছিস না। আস্তে আস্তে সবই মানিয়ে যাবে। কিছুই হবে না। তুই শুধু একটু স্বাভাবিক ভাবে নেওয়ার ট্রাই কর। বাকিটা আমি দেখবো।’
আমার দিকে তাকিয়ে অ্যালেন একটা উৎসাহের হাসি দিয়ে চলে গেলো। আমি দূর্বলরূপে সেখান দাঁড়িয়ে রইলাম। জিশানের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম জিশান সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখে একটা অবিশ্বাস্যের রহস্যজনক হাসি।
চলবে,