My First Crush part-23+24

0
264

#My_First_Crush
#পর্ব-২৩
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

সদ্য ভোর। আলো ফোটার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবে। পাখিরা সকাল হবার বার্তা এই দিবে দিবেই। রাইয়ান ঘুমু ঘুমু চোখ জোড়া মৃদু খুলতেই দেখলো হৃদি তাকে ডাকছে সমানে। রাইয়ান নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে ডাকলো, ‘হৃদি!’ হৃদি তার স্বভাবসুলভ নম্র হাসি মুখে এঁকে আঙ্গুল ঠোঁটে রেখে ইশারা করলো, ‘হুশ!’
গাড়ি ছুটলো রাস্তায়। একটি ক্যাব ভাড়া করে নিয়েছে তারা। রাইয়ান এখনো অজ্ঞাত। কোথায় যাচ্ছে জানে না। প্রশ্নের চাইতেও ভাবুক বেশি সে। ভাবনাটা হৃদিকে নিয়ে। সেই হাস্যজ্জ্বল, প্রাণোচ্ছল হৃদি। রাইয়ানের সাথে হাসছে, কথা বলছে। রাইয়ানের একবার মনে হলো সে বোধহয় স্বপ্ন দেখছে। নয়তো কিভাবে সম্ভব?
হৃদিকে দেখে মনে হচ্ছে বিগত কয়েকদিনের সবকিছু সে ভুলে গেছে। কখনো তাদের মধ্যে নিরবতার দেয়াল এসে দাঁড়িয়েছিল তা এক গল্প ছিল মাত্র। রাইয়ান বেশি কিছু জিজ্ঞেসও করলো না, জানতেও চাইলো না। হৃদি তার সাথে আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ করছে এতেই মন প্রসন্ন হয়ে উঠলো তার। গাড়ি ছুটলো দূরন্তর।

ক্যাব যখন এয়ারপোর্টের সামনে এসে থামলো তখন সত্যি সত্যিই চকিত হলো রাইয়ান। কৌতূহল গাঢ় হলো তার। এয়ারপোর্টে ঢুকতেই সে হৃদিকে টেনে জিজ্ঞেস করলো, ‘হৃদি এবার তো বলো কোথায় যাচ্ছি আমরা? এয়ারপোর্টে এসেছি কেন?’
হৃদি হেসে বলল, ‘জাদুর রাজ্যে।’
রাইয়ান বুঝতে পারলো না। হৃদি এগিয়ে গেলো। বিধায় পিছু যেতে হলো রাইয়ানকেও। চেকিং হবার আগে রাইয়ান হৃদিকে বলল,
‘আমি যাবো কিভাবে? আমি তো পাসপোর্ট টাসপোর্ট কিছুই আনিনি!’
হৃদি বলল, ‘ওহ হো! আমি সব কিছু নিয়েই এসেছি। আমাকে কি এতো বোকা মনে হয় তোমার? এগুলো না নিয়ে এয়ারপোর্টে আসবো।’

সবশেষে অরল্যান্ডোর বিমানে গিয়ে বসলো তারা। রাইয়ান এখনো বুঝতে পারলো না তারা অরল্যান্ডো কেন যাচ্ছে। হৃদি খুবই এক্সাইটেড। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাকে। রাইয়ান কৌতূহল সংযত রাখলো। পৌঁছাবার আগে আর জানার উপায় নেই। একঘন্টা আর কিছু সময় নিয়ে বিমান অরল্যান্ডোতে গিয়ে পৌঁছালো। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আবারো একটা ক্যাব নিলো হৃদি। কোথায় যাবে জানতে চাইলে সে ড্রাইভারকে স্মিত হেসে বলল, ‘ডিজনি ওয়ার্ল্ড।’
রাইয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো হৃদির দিকে। হৃদি দুচোখে পলক ফেলে একটু হাসলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো। পথে ডিজনির থিম নিয়ে বড় একটি সাইনবোর্ড দেখতে পেলো রাইয়ান। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলো সেখানে। শুরুতেই নয়নাভিরাম একটি বৃহৎ হৃদ বা লেক। কৃত্রিমভাবে তৈরি করা। ডিজনিওয়ার্ল্ডকে মাঝখানে রেখে সেটি মাইলের পর মাইল বিস্তৃত। এই হৃদ অতিক্রম করে ডিজনিওয়ার্ল্ডে যাবার উপায় দুটো। একদি ফেরি, অপরটি ট্রেন। হৃদ থেকে একশো ফুট উপর দিয়ে যাওয়া ট্রেনেই হৃদি আর রাইয়ান উঠলো। নিচে থৈ থৈ পানি। তার মাঝে তৈরি করা ছোট ছোট দ্বীপ, ঝোপঝাড়, বন। পাঁচ মিনির পরেই ট্রেন পৌঁছে যায় ডিজনিওয়ার্ল্ডে। বিরাট তোরণে লেখা দেখা যায় ‘ম্যাজিক কিংডম।’

অসংখ্য মানুষ। চারপাশে গিজগিজ করছে। রাইয়ান হৃদিকে সাইডে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আমরা এখানে এসেছি কেন হৃদি?’
হৃদি হেসে বলল, ‘শৈশবে ঝাপ দিতে।’
রাইয়ান বুঝতে পারলো না। হৃদি বলল,
‘তুমি না বলেছিলে তুমি তোমার শৈশব ঠিকমতো উপভোগ করতে পারোনি। তাই আজ আমরা টাইম মেশিনে করে শৈশবে ফেরত যাবো।’
রাইয়ান কনফিউজড হয়ে তাকালো হৃদির দিকে। হৃদি হেসে রাইয়ানকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। রাইয়ান বিস্মিত দৃষ্টিতে চারপাশ দেখতে লাগলো। বাচ্চাদের ভাবনার মতোই এতো এক স্বপ্নপূরী! মিকি মাউজ, মিনি মাউজ, টিংকা বেল, এলসা-আনা, রূপানজেল, স্নো হোয়াইট, সফিয়া, ডনাল্ড, সিন্ডারেলা, ডেইজি প্রভৃতি চরিত্রদের রূপকথার জগৎ। আর ক্যাসলগুলোর সৌন্দর্য তো চোখ ধাঁধানোর মতো। রূপকথার গল্পের বইয়ের পাতায় ঢুকে পড়েছে যেন তারা। সবকিছু একদম সেরকমই। বিস্ময় ভাঙার আগেই শুনতে পেলো এখন প্যারেড শুরু হবে। সবাই একটি যুৎসই জায়গা দেখে দখল করে বসে আছে। হৃদি আর রাইয়ানও গিয়ে দাঁড়ালো। ডিজনি জুনিয়রে দেখানো বিভিন্ন ক্যারেক্টার নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো প্যারেড। নাচে গানে বিভিন্ন অঙ্গিভঙ্গি করে হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা। টিংকার বেল আসতেই হৃদি একটা চিৎকার দিয়ে উঠে। রাইয়ান ঝট করে তাকায় হৃদির দিকে। পরক্ষণেই চোখ নেয় প্যারেডে। এই প্যারেড এক বিস্ময়কর ব্যাপার। না দেখে থাকলে ভাষায় বোঝানো মুশকিল। একে একে বিভিন্ন প্রিন্স প্রিন্সেস সাজ সজ্জা ধারী গান গাইতে লাগলো, নাচতে লাগলো। ফ্লউড এর উপর থেকে হাত ইশারা করে নাড়াতে লাগলো তারা। সবাইকে অভিভূত করে রেখে শেষ হলো প্যারেড। রাইয়ানের দিকে ঘুরে হৃদি জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন?’
রাইয়ান স্মিত হেসে মাথা নেড়ে বলল, ‘হুম।’
‘বলেছিলাম না দারুণ লাগবে। দেখলে, কত সুন্দর সবকিছু। মাত্র তো শুরু। এখনও আরও অনেককিছু বাকি আছে।’

সত্যি বলতেই রাইয়ানের খুব ভালো লাগতে লাগলো। বহুদিন পর মনটা হালকা হয়ে এলো তার। যতোটা না এর জন্য তার চাইতেও বেশি হৃদির জন্য। হৃদি তার সাথে আবারও আগের মতো কথা বলছে এই ব্যাপারটাই সবথেকে প্রশান্তি দিলো রাইয়ানকে। রাইয়ানের মনে হতে লাগলো বিগত মাসটি একটি খারাপ স্বপ্ন ছিল। ঘুম ভাঙতেই এখন সে আবার বাস্তবে ফিরে এসেছে। এই তো এরকমই সব ছিল। কিচ্ছু বদলায়নি। আগের মতোই আছে জীবন। আগের মতোই হৃদি।

কিছুদূর এগোতেই তারা একটি বিল্ডিংয়ের সামনে লম্বা লাইন দেখতে পেলো। একটি কাঁচের বাক্সে করে কাঁচের জুতো রাখা আছে সেখানে। সিন্ডারেলার হারিয়ে যাওয়া জুতো। আরেকটু এগিয়ে একটা কক্ষে ঢুকতেই ওরা দেখতে পেলো সিন্ডারেলা। একদম পুতুলের মতো দেখতে হলেও পুতুল নয় কিন্তু। রক্ত মাংসের মানুষ। সিন্ডারেলার বেশে সেজে আছে। রাইয়ানকে উদ্দেশ্য করে সিন্ডারেলা হৃদিকে বলল,
‘হি মাস্ট বি ইউর প্রিন্স চার্মিং!’
হৃদি ঝট করে রাইয়ানের দিকে তাকালো। সিন্ডারেলার দিকে তাকিয়ে হাসলো মৃদু। ছবি তুললো সিন্ডারেলার সাথে। সিন্ডারেলা রাইয়ানকেও তাদের সাথে জয়েন করতে বলল। হৃদি, রাইয়ান আর সিন্ডারেলা মিলে ছবি তুললো একটা। বাইরে বেরিয়ে এলো। এরপর গেলো মিকি মাউজের সাথে দেখা করতে। এর জন্য লাইনে দাঁড়াতে হলো প্রথমে। অবশেষে মিললো সুযোগ। মিকি মাউজ বাড়ির দরজা খুলে হাত দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করলো। হৃদি তো সেই খুশি! ছোটবেলায় তার খুব পছন্দের একটা ক্যারেক্টার ছিল মিকি মাউজ। হৃদি কাছে যেতেই মিকি মাউজ তাকে হাগ করতে উদ্যত হলো। তার আগেই হৃদিকে ধরে ফেললো রাইয়ান। তাকে পেছনে টেনে কানে কানে বলল,
‘এই, কে না কে! ভেতরে ছেলেও তো হতে পারে।’
হৃদি জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তুমি কি এতক্ষণ ধরে সবকিছু এভাবেই ভাবছো? মানছি এরা সাজানো। কিন্তু এভাবে ভাবলে কি মজা পাবে?’
‘তাহলে কিভাবে ভাববো?’
‘অবশ্যই সত্যি ভাববে। এই যে দেখছো, এখন ভাবতে হবে এটা সত্যি মিকি মাউজই। তাহলেই তো মজাটা পাবে। ট্রাই করো।’
রাইয়ান উসখুস করে এগোলো মিকির দিকে। হঠাৎ মিকি এসে রাইয়ানের হাত ধরে বাচ্চাদের মতো নাচাতে থাকে। হাসতে থাকে হৃদি। কিছুক্ষণ বাদে হৃদিও যোগ দেয় ওদের সাথে। এবার সত্যিই ইনজয় করে রাইয়ান। বিদায় বেলায় মিকি রাইয়ানের গাল টেনে দেয়। সেই ছবিটা ঝট করে ক্যামেরায় তুলে ফেলে হৃদি। রাইয়ান বলতে থাকে, ‘হৃদি ডিলিট করো।’ হৃদি শুনে না।

ডিজনি ওয়ার্ল্ডে ব্যবস্থা করা আছে অনেক মন মাতানো রাইডের। একেকটির সামনে মানুষের বিশাল বিশাল লাইন। তার মধ্যে নৌকার একটি রাইড আছে। গল্পের বইয়ের মতো পাল তোলা ছোট ছোট নৌকা। একেকটিতে আটজন করে বসছে। একটি ইনডোর ঘরের মধ্যে তৈরি করা একটি স্বপ্নীল জগৎ। সেই জগতে বিচরণ করানো হচ্ছে এই নৌকার ভাসিয়ে। হৃদি ফার্স্ট পাস জোগাড় করে নিলো। ফলে তাড়াতাড়িই বসতে পারলো তারা রাইডে। কোন মাঝিমাল্লা ছাড়াই নৌকা আপনাআপনি চলতে শুরু করলো আর্টিফিশিয়াল নদীতে। রাইয়ানের মনে হলো তারা যেন দিন থেকে রাতে প্রবেশ করছে। সবকিছু সেভাবেই সাজানো। ক্যানেলের দু ধারে হাজার হাজার বিভিন্ন আদলে তৈরি পুতুল। নাচছে, গাইছে। অসাধারণ আলোকসজ্জা। চারদিকে বাজছে সুরের ঝংকার। ‘ইট’স এ স্মল ওয়ার্ল্ড’ গানটি বাজতে থাকে। রাইয়ানের চোখে স্পষ্ট বিস্ময়। সামনে যতো এগোতে থাকে ততোই যেন বাড়তে থাকে। এর মধ্যে পাশে উপরে তাকাতেই দেখতে পায় ম্যাজিক কার্পেট। অন্ধকার আকাশে যেন সত্যি সত্যিই ভাসছে। ছোট আরাবিয়ান প্রাসাদও দেখা যায় সেখানে। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে। এতো এতো পুতুল! কোনটা রেখে কোনটা দেখবে! নৌকায় থাকা বাচ্চাগুলো আনন্দে চেঁচাতে থাকে। রাইয়ানের হুট করে মনে হয় সে যেন আসলেই শৈশবে ফিরে গেছে। সেই না পাওয়া অনুভূতিগুলো উপভোগ করছে। আর এই সব কৃতিত্ব একটি মানুষের।

নৌকার রাইড থেকে বের হয়ে তারা আরো একটি রাইডে চড়ে। তার নাম ‘সেভেন ডুয়ার্ফস মাইন ট্রেন।’ সেই সাত বামনের রাজ্যের আদলে তৈরি। রাইডটি একটি রোলার কোস্টার রাইড। রাইয়ান আর হৃদি শক্ত করে বসে থাকে। রোলার কোস্টার চলতে শুরু করে। এই দুম করে স্পিডের সাথে উপরে উঠে পড়ে আবার সাথে সাথেই ঠাস করে নিচে পড়তে থাকে। শরীর থেকে প্রাণ বের হয়ে যায় যায় অবস্থা। কিন্তু বের হয় না। শুরু হয় রাইয়ান আর হৃদির গগনবিদারী চিৎকার। সাথে এক চাপা আনন্দ। দারুণ এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। পাথর বসিয়ে তৈরি পাহাড়ের গায়ে গায়ে আঁকাবাকা রাস্তার উপর দিয়ে চলতে থাকে রোলার কোস্টার। কখনো জঙ্গলে, কখনো ঢুকে যায় পাহাড়ের মধ্যকার গুহার ভেতরে। সেখানে অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করতে থাকে সহস্র হীরা-মানিক, কোহিনূর। দেখা যায় গল্পের বামুনদের। একটি কুড়াল হাতে সেগুলো খোদাই করছে যেন তারা। সুরের সাথে সাথে নড়ছে। তারপর আবারো সেই চড়াই উৎরাই। জীবনে প্রথমবার রাইয়ান আসলেই প্রাণ খুলে হাসে। এতো এতো আনন্দ, বেঁচে থাকার সঠিক অনুভূতি উপলব্ধি করে। আরো অনেক অনেক আনন্দকর মুহুর্ত কাটায় তারা। কালারফুল ক্যান্ডি খাওয়া, তারপর জিভ বের করে দেখা, বাবলস উড়ানো। স্বপ্নের মতো কাটতে থাকে দিনটি। রাইয়ান একটা ক্যামেরা নিয়ে আশেপাশের ছবি তুলতে থাকে। সিন্ডারেলার নয়নাভিরাম নীল ক্যাসলের দিকে ক্যামেরার লেন্স ঘুরিয়ে এনে তাক করে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা হৃদির দিকে। জুম করে। তারপর আস্তে করে একটা ক্লিক। চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে চেক করে ছবিটা। আলতো করে হৃদির দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। যেই হাসিতে ফুটে উঠে এক লুকায়িত আবেগ।

রাত হতেই সেখানকার আলোকসজ্জা দেখার মতো দৃশ্য হয়ে দাঁড়ায়। অন্ধকারের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকা আলো। রাজপ্রাসাদ ধারণ করে আরেক সৌন্দর্য। শোনা যায় একটুপরই ক্যাসলের পেছন থেকে ফায়ারওয়ার্ক্স শুরু হবে। সবাই একটি জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। হৃদি আর রাইয়ানও গিয়ে দাঁড়ায় প্রাসাদের সামনে। ম্যাজিক কিংডমের লাইটগুলো আস্তে আস্তে কমিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে একটা শব্দ তুলে আকাশে ফুটে আতশবাজি। তারপর একের পর এক ফুটতেই থাকে। শুরু হয় রাতের আকাশে রং বদলকারী আলোর কারসাজি। সেই আলোতে মুহুর্তে মুহুর্তে কখনো গোলাপি, কখনো নীল, কখনো সবুজ এভাবে বিভিন্ন রং ধারণ করতে থাকে প্রাসাদটি। সে এক অন্যরকমই দৃশ্য। রাইয়ান বিমোহিত চোখে তাকিয়ে থাকে। জীবনে সে ফায়ারওয়ার্ক্স অনেক দেখেছে। কিন্তু এতো সুন্দর ফায়ারওয়ার্ক্স কখনো দেখেনি। তার চোখ যেন সম্মোহিত হয়ে পড়ে। আজ সারাদিনের সব সুখ মৃদু সুর তুলে মনে। এমন সময় হৃদি পাশ থেকে আস্তে করে ডেকে উঠে, ‘রাইয়ান!’
রাইয়ান অভিভূত দৃষ্টি নিয়ে পাশে তাকায়। হৃদি মিষ্টি হেসে বলে, ‘হ্যাপি বার্থডে!’
রাইয়ান কিছুই বলে না। নির্নিমেষ তাকিয়েই থাকে। আতশবাজির বাহারী আলো আভা ফেলেছে হৃদির চোখেমুখেও। সেই আভার রেশ ধরেই আরো এক অপার্থিব জগতের সন্ধান পায় রাইয়ান। একটা দুটো শব্দ তুলে মাথার উপরে এখনো ফুটছে ফায়ারওয়ার্ক্স। হাজার হাজার লোক হারাতে থাকে রাতের আকাশের আলোকসজ্জায়। আর রাইয়ান হারায় হৃদির চোখের মায়ায়।
___________________________________________________

ডিজনিওয়ার্ল্ড থেকে বেরিয়ে ফ্লাইট নিয়ে মায়ামি ফিরে আসে রাইয়ান ও হৃদি। এরপর সরাসরি বাসায়। আজকের দিনটির কথা ভাবতে ভাবতেই বাসায় ঢুকে লাইট অন করতেই আরেকটি চমক পায় রাইয়ান। ঘরভর্তি মানুষ। সবাই এক যোগে বাঁশি বাজিয়ে, বেলুন ফাটিয়ে হ্যাপি বার্থডে বলে উঠে রাইয়ানকে। রাইয়ান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জীবনে এরকম চমক কখনো পায়নি সে। রাইয়ানের বন্ধু, কলিগ, নেইবার সবাই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। পুরো বাসা বেলুন দিয়ে সাজানো। বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে রাইয়ান পাশে তাকাতেই দেখে হৃদি নেই। এমন সময় ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!’ এর একটা মৃদু সুর ভেসে আসে কানে। সেই অনুসরণে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় একটি তিন তলা কেক হাতে নিয়ে হৃদি হাসিমুখে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে তার দিকে। রাইয়ান অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। হৃদি কেকটি এনে মাঝখানের টেবিলে রাখে। রাইয়ানের এক পুরনো বন্ধু এসে টেনে নিয়ে যায় তাকে। এতক্ষণে হুঁশ ফিরে পায় রাইয়ান। সবার কথার প্রতিউত্তরে হেসে ধন্যবাদ জানাতে থাকে। তবুও বারবার তার চোখ শুধু খুঁজে ফিরে হৃদিকে। এরকম ভাবে বার্থডে সেলিবেট কখনো হয়নি তার। সবসময় সবকিছু খুব ছিমছাম ভাবেই কেটেছে। রাইয়ানের খুব ভালো লাগতে থাকে। পুরো বাড়ি মুখরিত হয়ে আছে মানুষের হাসি কথায়। কতো পুরনো বন্ধুদের সাথেও দেখা। সবাই আজ এসেছে শুধু রাইয়ানের জন্য। অনেক অনেক মজা করতে থাকে সবাই। কম কথা বলা ছেলেটার মুখ থেকে আজ হাসি সরছেই না। সবাই অনেক অনেক গিফট দেয় রাইয়ানকে। দাদীমার পায়ে ব্যাথা থাকায় তিনি আসতে পারেন না। কিন্তু ভিডিও কল দিয়ে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানায় রাইয়ানকে। রাইয়ানের চোখেমুখে আজ নির্মল হাসি। এর মাঝে একজন কেক কাটার কথা তুলতেই রাইয়ানকে নিয়ে দাঁড় করানো হয় মাঝখানে। কিন্তু কেক কাটার জন্য ছুরি খুঁজে পায় না। একটা হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। হৃদি চিন্তিত মুখে বলতে থাকে, ‘একটু আগেও তো হাতে ছিল, কোথায় যে রাখলাম!’
এমন সময় একটা ভারী কন্ঠ শোনা যায়, ‘তোমরা কি সবাই এটা খুঁজছো?’

মুহুর্তের জন্য পিনপতন নিরবতা। সবাই সামনে তাকায়। লং কোর্ট পরিধিত একজন মধ্যবয়স্ক লোককে দেখা যায়। হাত বাড়িয়ে কেক কাটার ছুরিটা দেখাচ্ছে সে। বিস্মিত রাইয়ান নিজের অজান্তেই অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠে, ‘বাবা!’
ভদ্রলোক মৃদু হাসে। অমায়িক সে হাসি। দু হাত বাড়িয়ে রাইয়ানকে ডাকে সে। রাইয়ানের কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়। মনে হয় এই কাছে গেলেই বুঝি ঘুমটা ভেঙে যাবে। তবুও রাইয়ান এগোয়। কিভাবে পা অগ্রসর হতে থাকে সে নিজেও জানে না। নিজের অজান্তেই আস্তে আস্তে তার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাইয়ানের বাবা দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাইয়ানকে। প্রগাঢ় মায়ার সেই বন্ধন। রাইয়ানের চোখের কোনে পানি এসে পড়ে। তার মনে পড়ে না শেষ কবে কেঁদেছিল সে। শক্ত, বুদ্ধিমান, বিবেকী মানুষটাও আজ আবেগী হয়ে উঠে। বাবাকে বহু বছর পর কাছে পেয়ে রাইয়ান আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। ভেতর থেকে উথলে আসে আবেগ। বাবার স্নেহের স্বাদ বুঝি এমনই। সবাই অম্লান নয়নে দেখতে থাকে বাবা ছেলের মিলনের দৃশ্য। রাইয়ানের বাবা রাইয়ানের কাছে ক্ষমা চায়, এতদিন এভাবে দূরে দূরে থাকার জন্য। স্ত্রী বিয়োগের যন্ত্রণা ভোলার চেষ্টায় সে কখনো রাইয়ানের কথা চিন্তাও করেনি। প্রকৃতির মাঝে ধর্না দিয়ে পালিয়ে বেরিয়েছে এই জীবন সংসার থেকে। শেষ যখন সেন্ট এলিয়াস পর্বতে আরোহন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনই একটি খাম পায় সে। যেটি পাঠিয়েছিল হৃদি। মূলত রাইয়ানের অপ্রকাশিত অনুভূতি লেখা কিছু কাগজ একদিন হৃদির হাতে এসে পড়ে। বাবাকে নিয়েও লেখা কিছু কাগজ আলাদা করে রাখতো সে। সেই ছোট বাক্সটাই পেয়ে যায় হৃদি। লেখাগুলো অনেকটা চিঠির মতো। বাবার জন্য রাইয়ানের আকুতিগুলো ফুটে উঠে সেই লেখায়। সেগুলো দেখে হৃদির মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। দাদীমার থেকে ইনফরমেশন নিয়ে এরপর হৃদি সেই ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ করে। তার মাধ্যমেই সেই ছোট বাক্সটি রাইয়ানের বাবার কাছে পাঠায়। নিজের ছেলের এমন আবেগঘন লেখা পড়ে রাইয়ানের বাবা তার ভুল বুঝতে পারেন। এতদিন ছেলেকে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত রাখার জন্য অনুতপ্ত বোধ করেন। যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত একটা মানুষের থেকে নিজের দাদীর কাছে রাইয়ান খুব ভালোভাবেই থাকবে ভেবে যে দূরান্তের পথে তিনি পা দিয়েছিলেন সেখান থেকে এবার বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ফলস্বরূপ আজ তিনি রাইয়ানের সামনে।

বাবাকে ফিরে পাওয়ার পেছনেও কৃতিত্বটা হৃদির জেনে রাইয়ান আবেগি চোখে তাকিয়ে থাকে অদূরে সবার মাঝে দাঁড়ানো হৃদির দিকে। হৃদি স্মিত হাসে। রাইয়ানের চোখের পলক পড়ে না। এ কেমন মানুষ হৃদি? কেউ কারো জন্য এতোটাও করতে পারে! আজ সকাল থেকে একটার পর একটা সারপ্রাইজ দিয়ে যাচ্ছে সে রাইয়ানকে। জীবনের বেস্ট দিন উপহার দিয়েছে। সব না পাওয়া গুলো পূরণ করে দিয়েছে। এতো সব আয়োজন করেছে শুধুমাত্র রাইয়ানের জন্য। এই পর্যন্ত সবথেকে বেস্ট বার্থডে এটা রাইয়ানের। আর এই সবকিছু শুধু হৃদির জন্য। শুধুই হৃদি।

রাইয়ানের বাবা রাইয়ানকে নিয়ে কেকের সামনে আসে। ছেলের হাতে তুলে দেয় কেক কাটার ছুরি। বাবার দিকে তাকিয়ে রাইয়ানের চোখেমুখে খুশি চিকচিক করতে থাকে। আস্তে আস্তে কেক কাটে রাইয়ান। সবাই ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ বলে উইশ করে উঠে। রাইয়ানের কলিগ বেন্থা সবার উপর পার্টি স্প্রে করে দেয়। সবাই ফেনায় ভুত হয়ে উঠে। একটি হাসি ঝংকারের মুহুর্ত সৃষ্টি হয়। হয়ে পরে ক্যামেরায় বন্দি। কিছু মজাদার গেমও খেলে তারা। রাইয়ান আর হৃদির নেইবার মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ডেভিড কাপল ডান্স করতে যায়। কিন্তু সেখানেও তাদের লেগে যায় ঝগড়া। মিস্টার ডেভিড নাকি নাচের সময় অন্য আরেকটা মহিলার দিকে তাকিয়েছিল। সেটা নিয়েই শুরু হয় তাদের খুনসুটি। সবাই হাসতে থাকে তাদের দেখে। অনেক অনেক মজা করতে থাকে সবাই। সবাই যখন নিজেদের মধ্যে ইনজয় করায় ব্যস্ত তখন সুযোগ বুঝে হৃদির সাথে কথা বলতে যায় রাইয়ান। টেবিলের উপর এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা বার্থডে ক্যাপগুলো গুছিয়ে রাখছিল হৃদি। এমন সময় সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ইতস্তত করতে করতে রাইয়ান আসে সেখান। আস্তে করে ডাকে,
‘হৃদি!’
হৃদি পাশ ফিরে বলে,
‘হুম?’
রাইয়ান কিছু বলতে যাবে তার আগেই হৃদি বলে উঠে, ‘থ্যাংক ইউ বলবে তো? খবরদার! থ্যাংক ইউ বললে কিন্তু সত্যি সত্যিই রাগ হবো।’
হৃদি মোলায়েম হাসে। রাইয়ানও মৃদু হাসে সাথে। এরপর আস্তে আস্তে বলে,
‘আরেকটা কথাও বলার ছিল।’
‘বলো।’
‘আসলে আমি…..
এমন সময় রাইয়ানের কথার মাঝে বেন্থা চলে আসে সেখানে। কাটা পড়ে যায় রাইয়ানের কথা। বেন্থা রাইয়ানের পিঠ চাপড়ে বলে,
‘আজকে তো তোমার বাসা একদম গিফটে ভরে গেছে রাইয়ান। তো তোমার ওয়াইফ তোমাকে কি গিফট দিলো?’
রাইয়ান আলতো সুখানুভূতির দৃষ্টিতে হৃদির দিকে তাকায়। হৃদি চোখ নামিয়ে স্মিত হাসে। বেন্থার কথার উত্তর দিতে জিশান এসে বলে,
‘হৃদি তো মনে হয় সকাল থেকেই একটার পর একটা সারপ্রাইজ দিয়ে চলেছে। এটাই কি গিফট নয়!’
হৃদি এবার মৃদু হেসে বলল, ‘তা কি করে হয়! সবাই যখন গিফট দিচ্ছে আমাকেও অবশ্যই দিতে হবে। আমি বাদ থাকবো কেন? আমার গিফটটা আমি দিবো সবার শেষে।’
বেন্থা বলল, ‘সারপ্রাইজটাই যেহেতু এতো দারুণ। গিফট টা তো মনে হয় ধামাকা কিছু হবে।’
হৃদি মৃদু হাসে। রাইয়ানের জন্য এই সারপ্রাইজগুলোর পরিকল্পনা সে অনেক আগে থেকেই করে রেখেছিল। মাঝখানে এই অপ্রত্যাশিত যাই হলো তার জন্য সে এতদিনের প্রস্তুতি মাটি করতে চায়নি৷ তাই আজকের জন্য পেছনের সব কথা ভুলে হৃদি শুধু রাইয়ানের জন্মদিনটাই স্মরণীয় করতে চেয়েছে। দিতে চেয়েছে রাইয়ানকে সবটুকু খুশি।
___________________________________________________

গতরাতে অনেক রাত পর্যন্ত জন্মদিনের আয়োজন চলায় অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে রাইয়ান। তার উপর সারাদিনের ছোটাছুটিও তো ছিলোই। সবাই চলে যাওয়ার পর কখন যে লিভিং রুমের সোফার উপর চোখ লেগে ঘুমিয়ে যায় সে খেয়ালও নেই। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে অনেকটা বেলা হয়ে যায়। চোখ খুলেই নিজেকে আবিষ্কার করে সোফায়। গায়ে একটা চাদর দেওয়া। চাদরটা দেখেই খানিক অবাক হয় রাইয়ান। পুরো বাসায় পিন পতন নিস্তব্ধতা। গতরাতে বার্থডে পার্টির জন্য যে এলোমেলো অবস্থা ছিল তাও নেই। সবকিছু একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পরিপাটি ও গোছানো। রাইয়ান চোখ ডলে উঠে বসে। সামনের টেবিলের উপর একটা কাগজ মোড়ানো দেখতে পায়। রাইয়ান কাগজটা মেলতেই দেখে তার লোন সম্পূর্ণ শোধ হয়ে গেছে এমন একটি রশিদ টাইপের কাগজ। রাইয়ানের ভ্রু সংকুচিত হয়। হুট করেই মানে বুঝতে পারে না। সে দ্রুত যায় রুমে। গিয়ে দেখে হৃদি নেই। ওয়াশরুম, কিচেন পুরো বাসা খুঁজে দেখে কোথাও হৃদি নেই। এমনকি হৃদির কোন জিনিসপত্রও নেই। বুঝতে আর কিছু বাকি থাকে না রাইয়ানের। সে সেই অবস্থাতেই খালি পায়ে দ্রুত চলে যায় বাইরে। লিফট না থাকায় সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে থাকে। বিল্ডিং থেকে বেরোতেই দেখা হয় মি. ডেভিডের সাথে। রাইয়ানকে এভাবে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে দেখে ডাক দেয়। রাইয়ান তাকে জিজ্ঞেস করে হৃদিকে দেখেছে কিনা। সে উত্তর দেয় হৃদিকে লাগেজপত্র নিয়ে একটি ক্যাবে করে যেতে দেখেছিল সে। রাইয়ান আর এক মুহুর্তের জন্যও দাঁড়ায় না। ছুটে যায় হাইওয়ের দিকে। পাগলের মতো ডাকতে থাকে, ‘হৃদি! হৃদি!’ করে।
এলোমেলো বেশে খালি পায়ে ব্যস্ত শহরের রাস্তায় প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে রাইয়ান। তিনমুখী রাস্তার এক মোড়ে এসেই থমকে দাঁড়ায়। চারপাশে অসংখ্য গাড়ি আসছে যাচ্ছে। কোলাহলে রাইয়ানের দম বন্ধের মতো মনে হয়। চোখেমুখে ভয়ানক শঙ্কা। ব্যগ্র হয়ে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে আশেপাশে তাকাতে থাকে সে। সমস্ত শক্তি দিয়ে ডেকে উঠে, ‘হৃদি!’
গাড়ির হর্নের শব্দে ফিকে হয়ে পরে রাইয়ানের ডাক। জলদস্যুর হাতে সর্বস্ব হারানো ধু ধু মরুভূমিতে ছটফট করা একদম নিঃস্ব পথিকের মতো দেখায় তাকে। হৃদি নেই! কোথাও নেই! ভালোবাসার মানুষটির কোন ইচ্ছে অপূর্ণ না রাখার তাগিদে এভাবেই নিজেকে সরিয়ে হৃদি দিয়ে যায় রাইয়ানকে জন্মদিনের শেষ উপহার।

চলবে,

#My_First_Crush
#পর্ব-২৪
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

এরপর রাইয়ান সরাসরি যায় হৃদির কফিশপে। গিয়ে দেখে দরজা লক। কাঁচের গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখা যায় পুরো জায়গাটা খালি। বাইরে ‘Sold Out’ কার্ড ঝুলানো। রাইয়ানের ভ্রু সংকুচিত হয়ে উঠে। ভয় আরও বেড়ে যায়। ডি’সোজাকে ফোন করে একবার হৃদির বাড়িতে গিয়ে চেক করে আসতে বলে। ডি’সোজা ‘ওকে’ বলে ফোন রেখে দেয়। কফিশপের সামনে দিয়েই দুশ্চিন্তার সাথে জোরে জোরে পায়চারি করতে থাকে রাইয়ান। বারবার দেখতে থাকে ফোনের দিকে। কখন ডি’সোজা ফোন করবে? একেকটা সেকেন্ডও ঘন্টার মতো মনে হতে থাকে রাইয়ানের কাছে। অবশেষে বেজে উঠে রাইয়ানের ফোন। একবার বাজতে না বাজতেই রাইয়ান ফোন ধরে ফেলে। এক নিঃশ্বাসেই জিজ্ঞেস করে, ‘হৃদি আছে ওখানে?’
ডি’সোজা জানায়, ‘না। বাড়ি তো তালা মারা।’
নিরাশ হয়ে রাইয়ান চোখ বন্ধ করে ফেলে। ডি’সোজা জিজ্ঞেস করে, ‘হৃদি এসময় এখানে আসবে কেন? কিছু কি হয়েছে রাইয়ান?’
রাইয়ান কিছু না বলে ফোন কেটে দেয়। অস্থির হয়ে দু হাত মাথায় রাখে। কি করবে বুঝতে পারে না। সেখান থেকে যায় জেরিনের বাসায়। জেরিনের বাসার সামনে পৌঁছাতেই দেখা হয় জিশানের সাথে। জিশান দরজা দিয়ে বের হচ্ছিল, সেসময়ে রাইয়ানকে এই অবস্থায় সেখানে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। রাইয়ানকে ধরে চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে, ‘কি হয়েছে রাইয়ান? তোর এমন অবস্থা কেন?’
রাইয়ান কিছু না বলে আগে জেরিনের বাসার দরজায় ঠকঠক করতে থাকে। জেরিন দরজা খুলছে না দেখে শব্দ আরো বাড়িয়ে দেয়। জিশান ওর হাত ধরে টেনে বলে, ‘কি হয়েছে? তুই আগে শান্ত হঁ। জেরিন এখানে নেই। আরো চার পাঁচ দিন আগেই এখান থেকে চলে গেছে। আচ্ছা, কি হয়েছে বলবি তো!’
এই কথা শুনে রাইয়ান সেখানেই বসে পড়ে। অস্ফুট স্বরে বলে, ‘হৃদি চলে গেছে।’
জিশান বলল, ‘চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে?’
‘জানি না।’
জিশান বিভ্রান্তের মতো উঠে দাঁড়ায়। চোখ যায় জেরিনের দরজার দিকে। জেরিনের হুট করে বাসা ছেড়ে দেওয়ার কারণ পরিষ্কার হয় তার কাছে।

রাইয়ান বুঝতে পারে না হৃদি আর কোথায় যেতে পারে। যার সাথে হৃদির বিন্দুমাত্রও পরিচয় ছিল সেসব জায়গাতেও যেতে থাকে রাইয়ান। কিন্তু নেই। হৃদি কোথাও নেই। এ সূত্রেই সে যায় অ্যালেনের কাছেও। সাথে থাকে জিশানও। অ্যালেনের বাসায় গিয়েই অ্যালেনকে ধরে জিজ্ঞেস করে,
‘অ্যালেন, হৃদি কোথায়?’
অ্যালেন হেসে বলে, ‘হৃদি কি আমার ওয়াইফ নাকি যে আমি জানবো হৃদি কোথায়?’
অ্যালেনের ভাবভঙ্গি দেখেই রাইয়ান বুঝতে পারে অ্যালেন কিছু একটা জানে। সে আবারো রুক্ষ হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি এখানে তোর সাথে ফাজলামি করতে আসিনি।’
অ্যালেন খোঁচা দিয়ে বলল, ‘কেন? যে মেয়েকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলি আজ তার জন্য এমন ব্যাকুল হয়ে গেছিস কেন? তোর জন্য তো ভালোই হয়েছে তাই না? বাধা আপনাআপনিই সরে গেছে।’
রাইয়ান অ্যালেনের শার্টের কলার চেপে ধরে। তার চোখে মুখে ফুটে উঠে স্পষ্ট ক্রোধ। জিশান দুজনের মাঝখানে এসে ছাড়ানোর চেষ্টা করে অ্যালেনকে বলে,
‘শুধু শুধু কথা কেন পেঁচাচ্ছিস? দেখছিস তো রাইয়ানের কি অবস্থা। যা জানিস সরাসরি বলে দে না ভাই। হৃদি কোথায় গেছে?’

অ্যালেন নিজের শার্ট টেনে ঠিক করতে থাকে। একপলক তাকায় রাইয়ানের দিকে। রাইয়ানও একনজরে তাকিয়ে থাকে অ্যালেনের দিকে। এরপর অ্যালেন তাদেরকে যা জানায় তার ভাবার্থ হলো এই,
হৃদি অনেক আগে থেকেই এই প্রস্তুতি শুরু করে। রাইয়ানের লোন শোধ করার জন্য সে তার কফিশপ বিক্রি করে দিয়েছে। একা একা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না বলে এই সবকিছু সে করেছে অ্যালেনের সাহায্য নিয়েই। প্রথমে হৃদির এরূপ সিদ্ধান্তে রাজী না হলেও হৃদির অনুরোধে পরে অ্যালেন শেষমেশ আর সাহায্য না করে পারে না। যখন হৃদি জানতে পারে দাদীমার চাপে পরে এই লোনের জন্যই বাধ্য হয়ে রাইয়ানকে বিয়ে করতে হয়েছে আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই লোনের জন্যই রাইয়ান এখনও এই সম্পর্কে বাঁধা পরে আছে তখন রাইয়ানকে সেই সমস্যা থেকে মুক্ত করতে, তার সব ইচ্ছা পূরণ করতে হৃদি তার একটু একটু করে গড়ে তোলা সাধের কফিশপটিই বিক্রি করে রাইয়ানের লোনের টাকা শোধ করে দেয়। যাতে রাইয়ানকে আর কারো কাছেই বাঁধা না থাকতে হয়। কারো চাপে না থাকতে হয়। সে তার যা ইচ্ছা করতে পারে। কাউকে পছন্দ না করা সত্ত্বেও তাকে জীবনে না রাখতে হয়।

মানুষ ভালোবাসে ভালোবাসার মানুষটিকে পাবার জন্য, পুরো পৃথিবী এদিক ওদিক করে হলেও সে শুধু তাকেই পেতে চায়। সারাজীবন তার কাছে থাকতে চায়। তাকে পাশে চায়। অথচ হৃদি! ভালোবাসার মানুষকে ভালো রাখার জন্য নিজেই নিজেকে দূর করার সকল ব্যবস্থা করে দেয়। তার ছেড়ে যাওয়াই যদি তার ভালো থাকা হয় তাহলে সেভাবেই। তাই তো, তুমি এই পৃথিবীর যেকোন বিষয়ের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রাখতে পারো, যেকোন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারো কিন্তু হৃদির ভালোবাসায় কেউ কখনো প্রশ্ন তুলতে পারে এমন সাধ্য কার!
___________________________________________________

(রাইয়ান)
আমি যখন দাদীমার বাড়িতে যাই তখন আমার অবস্থা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। বিশেষ করে অ্যালেনের মুখে ঐ কথাগুলো শোনার পর একেবারেই ভেঙে পড়েছিলাম আমি। অনুতপ্তের আগুনে দগ্ধ ছাই ছাড়া তখন আর আমি কিছুই না। হৃদি আমাকে এতো ভালোবেসেছে আর আমি? হৃদিকেও হারিয়ে ফেললাম। এই পৃথিবীর সবথেকে নিঃস্ব বলে বোধ হতে লাগলো আমার নিজেকে। আর সবথেকে নিকৃষ্টও। কুড়ে কুড়ে যন্ত্রণাগুলো আমাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিতে লাগলো। কোথায় গেলে আবার ফিরে পাবো হৃদিকে? অ্যালেন বলেছিল সে শুধু অতটুকুই জানে। এর বাইরে হৃদি কোথায় গেছে বা আছে সে সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। হৃদি তাকেও কিছু বলেনি। নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হতে লাগলো আমার। আমি পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলাম সোফায়। দাদীমা আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। সবটাই এখন তাকে জানিয়ে দিয়েছি আমি। কিছু যে একটা হয়েছে সেটা ডি’সোজার ফোনের কারণে আগে থেকেই আঁচ করতে পারেন তিনি। বাবা দাদীমার পাশেই দাঁড়ানো। দাদীমা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন,
‘আমি ভেবেছিলাম একবার বিয়েটা হয়ে গেলে তুমি সব মেনে নিবে। হৃদিকে নিয়ে তুমি ভালো থাকবে। একারণেই তোমাকে বিয়ের জন্য জোর করেছিলাম আমি। কিন্তু তুমি যে বিয়ের পরও আলাদা হবার চিন্তা নিয়ে থাকবে তা যদি একটু আঁচ করতে পারতাম তাহলে কখনোই তোমাকে এভাবে বিয়ের জন্য জোর করতাম না আমি৷ আসলে, দোষটা আমারই হয়েছে। সব দোষ আমার। আমার তোমাকে এভাবে বিয়ের জন্য জোর করা ঠিক হয়নি। আমি শুধু তোমার কথাই ভাবছিলাম। তোমার ভালোটাই চিন্তা করছিলাম। হৃদির কথা একটুও ভাবিনি। ভাবিনি তুমি যদি ওকে না মেনে নাও তাহলে ওর কেমন লাগবে? ওঁ কতটা আঘাত পাবে! মন থেকে না করা বিয়েটায় তুমি হৃদির যত্ন ঠিকমতো নিবেও কিনা। কিচ্ছু ভাবিনি। মা বাবা মরা মেয়েটার সাথে আমি এটা কি করলাম! না যেন মেয়েটা কতোটা কষ্ট পেয়েছে।’

দাদীমা আরও বিলাপ করতে লাগলেন। মাথা নিচু করে বসে রইলাম আমি। চোখ থেকে অনর্গল টপ টপ করে পানি পড়তে লাগলো আমার। বুকের মধ্যে কেউ যেন ক্রমাগত ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। আমার শরীর কাঁপতে লাগলো। দাদীমা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। হাত রাখলেন আমার কাঁধে। আমি দু হাত দিয়ে দাদীমাকে পেঁচিয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। কান্নার চোটে শরীর আরও কাঁপতে লাগলো আমার। বাবা চিন্তিত হয়ে উঠলেন। দাদীমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সামলাতে লাগলেন। দাদীমার হাতটি মুখের কাছে নিয়ে আমি অনবরত কাঁদতেই লাগলাম। কাঁদতে কাঁদতেই কোনমতে শুধু বললাম, ‘আমি হৃদিকে চাই দাদীমা। আমি হৃদিকেই চাই। আমার কাছে হৃদিকে এনে দাও। প্লিজ এনে দাও!’

গোটা দিনটা কেটে গেলো। হৃদির কোন খবর পেলাম না আমি। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে একা একা ফিরে যাবার সাহসও হলো না আমার। আমি দূর্বল, ভয়ার্ত, অসহায় বাচ্চাটির মতো দাদীমার কাছে পড়ে রইলাম। রাত গভীর হলে আমি বের হলাম আমাদের নেইবার হুডের রাস্তায়। আকাশে একটা বড় চাঁদ। তার আলোতে আলোকিত হয়ে আছে চারপাশ। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম হৃদির বাড়ির সামনে। ঠায় দাঁড়িয়েই রইলাম। একটা সময় পা আবারো চলতে শুরু করলো। আমার কাছে বাড়ির চাবি ছিল। সেটি নিয়ে দরজা খুললাম আমি। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দরজার পাশের সুইচ টিপতেই আলেকিত হয়ে উঠলো ঘর। অনেকদিন যাবৎ কারো না আসায় ধুলো জমে গেছে আসবাবপত্রে। মাকড়সার জালে ভরে আছে ঘর।আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম একটি দেয়ালের দিকে। সেখানে হৃদির কিশোরী বয়সের একটা ছবি টাঙানো। সম্ভবত তেরো কি চৌদ্দ বছরের। ছবিটিতে হলুদ রঙের ফ্রক পরনে সাইকেলে বসা হাসিমাখা হৃদির কিশোরী মুখটি ফুটে আছে। আমি হাত দিয়ে হৃদির মুখটির উপর থেকে ধুলো মুছে দিলাম। ছবিটা নিজের হাতে নিয়ে গেলাম হৃদির বেডরুমে। দেয়ালে আমার ছবির মেলা এখনো আছে। জানালার ধারে ঝুলছে হৃদির বানানো রঙিন ঝুল। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম আমি। সবকিছুতেই হৃদির ছোঁয়া। হৃদিকেই যেন অনুভব করতে লাগলাম আমি। হৃদির রুম থেকেই একটা পুরনো ডায়েরি পেলাম। আমি ডায়েরিটা নিয়ে চলে এলাম বাড়ির বাইরে। কাঠের সিঁড়িতে বসে ডায়েরির মাঝখানের একটা পৃষ্ঠা খুললাম। সেখানে কালার পেন্সিল দিয়ে লেখা, ‘আজকে রাইয়ান আমার সাথে প্রথম কথা বলেছে। আমি ভাবতেও পারছি না সত্যিই ব্যপারটা হয়েছে। আমি সুপারশপে গিয়েছিলাম। সেখানে যখন আমি কিছু পেন আর পেপার দেখছিলাম তখন পেছন থেকে হঠাৎ একটা সুন্দর কণ্ঠ শুনতে পাই, ‘হ্যালো!’
আমি পেছনে ঘুরতেই দেখি রাইয়ান। কিছুক্ষণের জন্য তো আমার মনেই হচ্ছিল আমি কোন স্বপ্ন দেখছি। পা মাটির সাথে জমে যাবার মতো অবস্থা। রাইয়ান আমার পড়ে যাওয়া রুমালটা আমার দিকে বারিয়ে দিলো। আমি হাত বাড়িয়ে নিলাম। তারপর রাইয়ান চলে গেলো। আর আমি তখনও হা হয়ে দাঁড়িয়ে। নিজের কানকে আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে সত্যিই সেখানে রাইয়ানের কণ্ঠস্বরই পৌঁছেছে। সামান্য একটা ‘হ্যালো’ শব্দও কতোটা সুন্দর শোনায়। আজ থেকে আমার প্রিয় শব্দই ‘হ্যালো।’ হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো! হি হি হি!’
কষ্টের মধ্যেই আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আমি আরো এক জায়গার পৃষ্ঠা মেলে ধরলাম। সেখানে লেখা, ‘আজকে রাইয়ান বাস্কেটবল খেলতে গিয়ে আঘাত পেয়েছে। কত আনন্দ নিয়ে স্টেডিয়ামে রাইয়ানের ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু রাইয়ান যখন মুখ থুবড়ে মাঠে পড়ে গেলো আমার কি যে কষ্ট লাগলো! গোড়ালি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল রাইয়ানের। না জানি রাইয়ানের কতো ব্যাথা লাগছিল! ম্যাচটা যদিও তারা জিতেছে তবুও অন্যদিনের মতো কোন আনন্দ লাগলো না। বারবার রাইয়ানের আঘাতটাই মনে আসছিল। খুবই খারাপ লাগছে আমার। আল্লাহ, প্লিজ তাড়াতাড়ি রাইয়ানের ব্যাথাটা কমিয়ে দিও!’

আমি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলাম। সব জায়গাতেই আমাকে নিয়েই লেখা। লেখাগুলো পড়তে পড়তে কখনো আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো, কখনো চোখ ছলছল করতে লাগলো। প্রতিটা পাতায় পাতায় আমার প্রতি হৃদির প্রগাঢ় ভালোবাসার ছাপ। আমি জানতাম হৃদি আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু সেই পছন্দের মাত্রা অতিক্রম করে হৃদির ভালোবাসার গভীরতা আজ আমি পুরোপুরি উপলব্ধি করলাম। আমাকে তার চৌদ্দ বছর বয়সে প্রথম দেখা, সেখান থেকে ভালোবাসা, আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করা, সাড়ে আট বছর ধরে লুকিয়ে ভালোবেসে যাওয়া… সবকিছু সেই ডায়েরি থেকেই জানতে পারলাম আমি। ডায়েরিটি পড়তে পড়তে আমার চোখে পানি চলে এলো। অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলাম আমি। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো বারবার। তবুও সেভাবেই পড়তে থাকলাম। কখনও না কান্না করা আমি আজ একদিনেই যেন সারা জীবনের অশ্রু ঝরিয়ে দিলাম। হৃদি আমার জন্য এই পর্যন্ত যা যা করেছে সেই সব দৃশ্য আমার চোখে ভাসতে লাগলো। আমার কোন খুশিই সে বাদ রাখেনি। এমনকি শেষ পর্যন্ত আমার বাবাকেও পর্যন্ত এনে দিয়েছে আমার কাছে। কেউ কাউকে এতোটা ভালো কিভাবে বাসতে পারে? এই পৃথিবীর সবথেকে ভাগ্যবান মানুষ হয়েও, এতোটা নিখাদ ভালোবাসা পেয়েও আমি সেটা ধরে রাখতে পারলাম না। আমি কি করে না বুঝে পারলাম! কি করে এতদিন হৃদিকে না ভালোবেসে পারলাম! নিজের অনুভূতি উপলব্ধি করতে আমার এতোটা দেরি কি করে লেগে গেলো! আর যখন উপলব্ধি করতে পারলাম তখন হৃদি আমার পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ উধাও। হৃদিকে হারিয়েই আমি বুঝতে পারলাম হৃদি আমার জন্য আসলে কি ছিল। আমার নিজস্ব জগতের কতটুকু সে দখল করে ছিল। যার চলে যাওয়ায় এখন আমি সম্পূর্ণ শূন্য। সম্পূর্ণ নিঃস্ব। যাকে আমি নিজের জন্য পারফেক্ট না ভেবে এমনটা করেছিলাম আজ আমি উপলব্ধি করলাম আমি নিজেই তার অযোগ্য। আমি পরাজিত। আমি ব্যর্থ!

আমি পুনরায় ধীরে ধীরে হৃদির রুমে ফিরে গেলাম। আমার চোখে যেন ভাসতে লাগলো একটি কিশোরী মেয়ের প্রথম প্রেমে পড়ার প্রতিচ্ছবি। আমি যেন দেখতে লাগলাম কিভাবে হৃদি উৎসুক হয়ে এই জানালা দিয়ে আমার জানালার পানে তাকিয়ে থাকতো। কিভাবে হৃদি আমার ছবিগুলো এখানে লাগাতো। কিভাবে অনুভূতি নিয়ে সে এই ডায়েরিটা লিখতো। আমি বিছানায় বসলাম। সেখানেও যেন হৃদির স্পর্শ। বুকটা হাহাকার করতে লাগলো আমার। হৃদির ছবি বুকে জড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আমি হৃদির ঘরে হৃদির বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝরাতে হঠাৎ চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম হৃদি আমার পাশে বসে আছে। আমি ব্যাকুল হয়ে অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠলাম, ‘হৃদি!’

চলবে,