#My_First_Crush
#পর্ব-৩১
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
(হৃদি)
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম রাইয়ান আমার পাশে মেঝেতে বসে বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার হাতে ধরে রাখা একটা হাত পাখা। আমার জেগে উঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই কারেন্ট চলে এলো। বুঝতে পারলাম এতক্ষণ কারেন্ট ছিল না। আর সময়টা যে খুব কম নয় তা ঠাওর করতেও অসুবিধে হলো না। কারণ এখানে কারেন্ট গেলে সহজে আসে না। এতক্ষণ যে কারেন্ট ছিল না আমি টেরই পাইনি। আর কেন পাইনি সেটাও বুঝলাম। আমি অবাক পানে রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেই সময়টুকুর মধ্যে রাইয়ানের ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ ডলতে ডলতে আমার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি দিয়ে সে বলল,
‘উঠে গেছো তুমি?’
আমি কিছুই বললাম না। রাইয়ান ঘাড়ে হাত রেখে উঠে পড়লো। একটা হাই দিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আমি রাইয়ানের যাওয়ার পানে আস্তে করে তাকালাম।
কিছুক্ষণ পর বিছানা ছেড়ে নামলাম আমি। দাঁত ব্রাশ করে একদম গোসল করেই বেরিয়ে এলাম। অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশি সময় লাগলো আমার। মাথায় টাওয়েল পেঁচিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম রান্না প্রায় শেষ করে ফেলেছে রাইয়ান। আমাকে দেখেই রাইয়ান বলে উঠলো,
‘আরেকটু সময় লাগবে হৃদি। তুমি রেডি হয়ে আসো। ততক্ষণে হয়ে যাবে।’
এবারও আমি কিছু না বলে রুমে চলে গেলাম। একেবারে রেডি হয়ে রুম থেকে বেরোলাম। আমাকে আসতে দেখে রাইয়ান মোলায়েম হেসে প্লেট রাখলো আমার সামনে। আমি হাত ধুয়ে খেতে বসলাম। রাইয়ানও বসলো আমার সামনে। তবে সে নিজের খাবার নিলো না। আমার প্লেটে ভাত বেড়ে দিতে দিতে বলল, ‘আজকে তোমার পছন্দের চিংড়ি মাছ রান্না করেছি। খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।’
এই বলে রাইয়ান তার প্লেটে চিংড়ি মাছ নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে আমার প্লেটে দিতে লাগলো। আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম রাইয়ানের দিকে। একসময় আর না পেরে বলে উঠলাম,
‘তুমি এমন কেন করছো?’
রাইয়ান না বুঝতে পেরে হেসে ফেলে বলল,
‘কি করছি?’
‘রাইয়ান, তোমার কি মনে হয় তুমি এসব করলেই আমি তোমার কাছে ফিরে যাবো?’
রাইয়ান স্মিত হেসে বলল, ‘আমি বিশেষ কিছু ভেবে করছি না হৃদি। আমার ইচ্ছে করেছে তাই করছি। তোমাকে ফিরিয়ে নিতে আমি চাই। কিন্তু এগুলো করে তোমাকে পটিয়ে নেবো বলে করছি না।’
আমি মুখ ঘুরিয়ে আস্তে করে বললাম,
‘তুমি এখান থেকে চলে যাও রাইয়ান।’
রাইয়ান মুখে ফ্যাকাসে হাসি টেনে বলল, ‘কোথায় যাবো?’
আমি বললাম, ‘তোমার নিজের বাড়িতে।’
‘ওটা তো আমার একার না। ওটা আমাদের বাড়ি হৃদি। যেটা তোমাকে ছাড়া আর বাড়ি বলে মনে হয় না। শুধু কিছু ইট পাথরের কক্ষ……
আমি নিজের আবেগটাকে সংযত করার পূর্ণ চেষ্টা করলাম। রাইয়ানের কথার মাঝেই বলে উঠলাম,
‘তোমার যদি মনে হয় আমার কফিশপের টাকায় ঐ বাড়ির লোন শোধ হয়েছে বলে ওটা আমার তাহলে তুমি আস্তে আস্তে আমার টাকা শোধ করে দিতে পারো। তাহকে সেই বাড়িটা সম্পূর্ণ তোমারই থাকবে।’
রাইয়ান ব্যথিত স্বরে বলল,
‘তোমার মনে হয় আমি এই প্রসঙ্গে কথাগুলো বলেছি?’
‘আমি জানি না কি ভেবে বলেছো। এমনিতেও আমি তো আগে থেকেই বুঝতে পারি না তোমার মনে কি চলে। নয়তো সবকিছু আজ এতদূর গড়াতোও না।’
রাইয়ান অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, ‘হৃদি!’
আমি এবার গলার জোর বাড়িয়ে বললাম,
‘তা নয়তো কি রাইয়ান? আমি কেন তোমার সাথে আবার ফিরে যাবো বলো? যাতে আমি আবারো বোকা হতে পারি? নাকি এবার তুমি দাদীমার থেকে আরো বড় কোন প্রেশারে পরে এসেছো! আমি এসব কিছু আর ঘাটতে চাই না। আমাদের সবকিছু…..এখানেই থামিয়ে দেওয়া উচিত।’
কথাটা বলেই আমি অফিসের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। রাইয়ান মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো।
___________________________________________________
(রাইয়ান)
সারাটা দিন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসে কাটলো আমার। অফিসে আমার কাজ ছিলো না বলে আর অফিসেও যাওয়া হলো না। এমনিতেও আর বেশিদিন বাকি নেই আমার এই অফিসে। মিঁয়োকে নিয়ে বাসার মধ্যেই পরে রইলাম। বিকেল হলে মুক্ত বাতাসের জন্য বাইরে বের হলাম আমি। হেঁটে দেখতে লাগলাম ঢাকা শহরের জমজমাট বিকেল। এই বৈচিত্র্যময় শহরের ব্যস্ত অলিগলি ঘুরে একটু হলেও মনটা হালকা হলো আমার। সত্যি বলতে, প্রথম বাংলাদেশে পা রেখে যতোটা না আঁতকে উঠেছিলাম এখন অনেকটাই মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি এই শহরের। এখানকার খাবারগুলো এখন আমার দারুণ লাগে। একটু স্পাইসি আর মশলা ফ্লেভারে মুখের টেস্ট বেড়ে যায় বহুগুণ। সিলেটে থাকাকালীন এক রাতে ভাগ্যক্রমে টিনের ছাদযুক্ত এক রিসোর্টে থাকা হয়েছিল আমার। মাঝরাতে হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো একটা ঘোরে চলে গিয়েছিলাম যেন। এতো শ্রুতিমধুর! আজও কানে বাজে সেই শব্দ। আর দেখেছি চোখ জুড়ানো সবুজ পাহাড়। যার দূর প্রান্ত ঘেঁষে যেন এক অচেনা সুর বাজে। ফেরার পথে একবার একটা নদী পরেছিল পথে। জোয়ারের সাথে তাল মিলিয়ে নৌকায় মাঝিমাল্লাদের টানের দৃশ্য নজর কেড়েছিল। ছোট থাকতেই নিজের পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি সম্পর্কে পড়তে গিয়ে জেনেছিলাম, বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের এক অনুন্নত দেশ। তবুও যখন দাদীমার মুখে সর্বদা ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ বুলি শুনতাম তখন আসলেই বুঝতাম না, এতো উন্নত, সভ্য, নিয়মকানুন সম্বলিত শৃঙ্খলিত দেশে থেকেও দাদীমা কেন নিজের দরিদ্র দেশের কথা ভুলতে পারেন না। আজ যেন একটু হলেও বুঝতে পারলাম সেই কারণ।
এসব ভাবতে ভাবতেই বাসায় ফিরে এলাম। তখন রাত হয়ে গেছে অনেকটাই। বাসায় ফিরে দেখলাম হৃদি অফিস থেকে এখনো ফিরেনি। এমনিতে তো প্রতিদিন বিকেল গড়াতেই ফিরে আসে। আজ হঠাৎ এতো দেরি হচ্ছে কেন? চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়লো আমার।
___________________________________________________
(হৃদি)
আজ অফিসে কাজের চাপ একটু বেশি থাকায় অফিস আওয়ার শেষ হবার পরেও অফিসে থেকে যেতে হলো আমাকে। গাফিলতিটা আমারই ছিল। উদাস হয়ে থাকায় কাজে মন দিতে পারছিলাম না। ফলে কাজ জমে গিয়ে সেগুলো সময় মতো শেষ করতে পারিনি। অফিস আওয়ার শেষ হয়ে এলে একে একে সবাই চলে যায়। থেকে যাই শুধু আমি। সবকটা ফাইল কম্পিউটারে টাইপ করতে করতে সময় লেগে যায় অনেক। একসময় ক্লান্ত হয়ে কিভাবে যেন ঘুমিয়ে পরি আমি। যখন চোখ খুলে আশেপাশে তাকিয়ে চমকে উঠি। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ফোনের টর্চ অন করে তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়েই দেখি দরজা বাইরে থেকে লক। আমার ডেস্ক দরজার বিপরীতে। হয়তো টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ায় দরজা থেকে দেখা যায়নি আমাকে। আর অফিসের পিয়নও অফিসে কেউ নেই ভেবে কারেন্টের সুইচ বন্ধ করে দরজা লাগিয়ে চলে গেছে। মাথায় বাজ ভেঙে পরে আমার। কথায় আছে বিপদ যখন আসে সবদিক দিয়েই আসে। এমন সময় আমার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এবার যেন মাথায় পুরো আকাশ ভেঙে পরে আমার। কাউকে যে ফোন দিয়ে বলবো সেই সুযোগও নেই। দূর্ভাগ্যক্রমে সেই রাতেই আরো একটি দূর্ঘটনার মুখোমুখি পরি আমি। আমি যখন ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাইরে থেকে আসা মৃদু আলোর সাহায্যে হাতড়ে হাতড়ে অফিসের টেলিফোনের কাছে এগোচ্ছিলাম ঠিক তখনই হঠাৎ স্টোর রুমের কাছে আসতেই ভেতর থেকে আলোর মতো উজ্জ্বল কিছু দেখতে পেলাম। আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখি আগুন। আগুনটা কিভাবে লেগেছিল আমি জানি না। সম্ভবত কারেন্টের সুইচ থেকে। আগুন দেখেই ধাক্কার মতো খেলাম আমি। চোখের সামনে দাউ দাউ করে আগুনের লীলায়িত শিখা দেখে আমার চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো আতঙ্ক। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। চোখে ভাসা ভাসা হয়ে উঠলো ফার্মহাউসের সেদিনকার আগুনের ধ্বংসযজ্ঞ দৃশ্য। মাথার মধ্যে বাজতে লাগলো সেই দিনের হাহাকারের শব্দ। আমার বাবা মা…..! আমি দু হাত দিয়ে কান চেপে ধরলাম। আমার মনে হতে লাগলো আমি মরে যাচ্ছি। তলিয়ে যাচ্ছি কোন অজানা অতল গহ্বরে।
___________________________________________________
(রাইয়ান)
বাসায় গিয়ে যখন দেখলাম হৃদি নেই আর তাকে ফোনেও পেলাম না, তখন চিন্তায় একপ্রকার হন্তদন্ত হয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম আমি। রাস্তায় আটকে গেলাম জ্যামে। আমার ফোনের সাথে হৃদির ফোনের লোকেশন ট্রাক করা ছিল। হৃদির ফোনের লাস্ট লোকেশন দেখাচ্ছে তার অফিসেই। আমার মনেই হতে লাগলো কিছু একটা হয়েছে। একসময় আমি গাড়ি থেকে নেমেই পড়লাম। পায়ে হেঁটেই এগোতে লাগলাম হৃদির অফিসের দিকে। অফিসের সামনে এসে দেখি অফিস বন্ধ। বুঝতে পারি না কি করবো। না চেক করে এখান থেকে যেতে মন সায়ও দিচ্ছিল না। একবার মনে হচ্ছিল লাস্ট লোকেশন দেখিয়েছে বলে কি হৃদি এখনও এখানে আছে? আবার মনে হচ্ছিল যদি সত্যিই থেকে থাকে! এমন সময় হঠাৎ উপরে চোখ পড়তেই একটা রুমের জানালার কাছে উজ্জ্বল কম্পমান শিখার মতো কিছু চোখে পড়লো। এবার আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম হৃদি এখানেই আছে। তাড়াতাড়ি পাইপ বেয়ে বহুকষ্টে উপরে উঠলাম আমি। একটা জানালার কাঁচ ভেঙে ভেতর থেকে ছিটকিনি খুলে জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে সক্ষম হলাম। আগুন দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। সবেই আগুন লাগা শুরু হয়েছে। এখনো খুব বেশি ছড়ায়নি। আমি তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে আগুন নেভানোর যন্ত্র এনে গ্যাস স্প্রে করতে লাগলাম। কিছুক্ষণের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে এলো। পুরোপুরি নিভে গেলে আমি ক্লান্ত হয়ে পেছনে ঘুরে দেখলাম সেই রুমেরই এক কোণায় ভয়ে আতঙ্কে গুটিশুটি মেরে বসে আছে হৃদি। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। হিতাহিত জ্ঞান আছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি এক ছুটে এগিয়ে গেলাম তার কাছে। হৃদিকে ধরে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে লাগলাম। কোন কাজ হলো না। জোরে জোরে দম নিতে লাগলো হৃদি। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। তখনই মনে পড়লো হৃদি একবার বলেছিল এরকম প্যানিক অ্যাটাকের মেডিসিন সবসময় তার ব্যাগে থাকে। আমি তাড়াতাড়ি তার কাঁধের ছোট ব্যাগটির চেইন খুলে সবকিছু বাইরে ফেললাম। ভাগ্যগুনে তার মধ্যে পেয়ে গেলাম ওষুধটি। তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিলাম হৃদিকে। কিছু সময় কাটতেই ওষুধের রিয়্যাকশন শুরু হয়ে গেলো। আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে ক্লান্ত মাথাটা আমার বুকে নেতিয়ে দিয়েই ঠান্ডা হয়ে গেলো হৃদি।
একটু মুক্ত বাতাসের জন্য হৃদিকে কোলে নিয়ে আমি ছাদে চলে এলাম। এই অবস্থায় হৃদিকে নিয়ে বাইরে বেরোনোরও উপায় নেই। পাইপ বেয়ে উঠতে গিয়ে আমার ফোনটাও পকেট থেকে পড়ে গেছে নিচে। চারপাশের বিল্ডিংয়ে জ্বলতে থাকা আলোর আভা এসে পরেছে এই ছাদেও। মাথার উপর আকাশে যদিও বা একটি চাঁদ আছে, তবুও এই কৃত্রিম আলোকের বহরে নিজের উজ্জ্বলতা পরিপূর্ণ ভাবে প্রকাশ করতে পারছে না। হৃদির শরীর তখন একদম ক্লান্ত। নিথরের মতো আমার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে সে। যেই ওষুধটা হৃদিকে দেওয়া হয়েছে সেটা খুবই হাই ডোজের। উত্তেজিত মস্তিষ্ককে দ্রুত শান্ত করতে কার্যকরী। তবে এর ফলে ব্যক্তি কিছুটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। হৃদির ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই হলো। আমি খেয়াল করলাম হৃদির শরীর একদম ঠান্ডা হয়ে আসছে। আমার টি শার্টের উপর থেকে বোতাম খোলা শার্ট টা খুলে আমি হৃদির কাঁধের উপর পরিয়ে দিলাম।
এর ফলে কিছুটা নড়ে চড়ে বসলো হৃদি। আস্তে আস্তে চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকালো। আমি একটু দ্বিধান্বিতে পড়ে গেলাম। হৃদিকে বললাম,
‘তুমি উঠো না হৃদি।’
হৃদি শুনলো না। মাথা খাড়া করে আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ আমার হাতের দিকে নজর পড়তেই হৃদির চোখ আটকে গেলো। আমার হাতটি আস্তে আস্তে ধরে আমার হাতে থাকা ক্ষত স্থানে হাত বুলালো। এতক্ষণ আমারও খেয়ালে আসেনি এটি। হয়তো ভাঙা কাঁচের জানালা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে কেটে গেছে। হৃদি বলল,
‘এই ক্ষতটা…..
আমি তাড়াতাড়ি হেসে উড়িয়ে বললাম,
‘ও….কিছু না।’
হৃদি কাতর চোখে সেদিকটায় তাকিয়ে থেকে আমার চোখে চোখ রেখে বলল,
‘সেই আমি তোমার আঘাতের কারণ হয়েই গেলাম রাইয়ান। তুমি এখানে আগুন দেখেও কেন এলে? যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো?’
আমি হৃদির মুখপানে অপলক তাকিয়ে বললাম,
‘তোমাকে আগুনের মধ্যে রেখে আমি চলে যাই কিভাবে? তুমি রাগ করো আর যাই করো আমি তোমাকে ফেলে যেতে পারবো না।’
ক্লান্তি মুখে হৃদি মৃদু হেসে বলল, ‘তোমার কি মনে হয়, আমি তোমার উপর অনেক রাগ? উহুম! আমি তোমার উপর রাগ নই রাইয়ান। আমি চাইলেও তোমার উপর কখনো রেগে থাকতে পারি না। আমার সেই ক্ষমতাই নেই। ভেতরে যতোই রাগ থাকুক না কেন তোমাকে দেখার সাথে সাথেই সব ভ্যানিশ হয়ে যায়। কারণ আমি তোমাকে অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি। তুমি ধারণাও করতে পারবে না কত বেশি।’
আমি মোলায়েম স্বরে বললাম, ‘এতো যখন ভালোবাসো তাহলে আমাকে দূরে সরাতে চাও কেন?’
হৃদি খানিক নাক টেনে বলল, ‘ভালোবাসি বলেই চাই তুমি ভালো থাকো। এই পৃথিবীর সবার চাইতে বেশি ভালো থাকো। তুমি জীবনে যা যা চাও সব পাও। আমি চাই না আমাকে পেয়ে তুমি জীবনে ঠকে থাকো। জীবনের কোন পর্যায়ে গিয়ে তোমার আমাকে নিয়ে আফসোস হোক। তুমিই সঠিক রাইয়ান। তোমার সাথে আমার আসলেই কোন ম্যাচ করে না। কোথায় তুমি আর কোথায় আমি! তুমি একদম পারফেক্ট। আর আমি কিছুই না। আমার মধ্যে বিশেষ বলতে তেমন কিছুই নেই। বাকি মেয়েদের মতো অতো স্মার্ট না। ওমন আহামরি রূপও নেই। পড়ালেখায়ও তেমন ভালো করতে পারিনি। একটা কফিশপ দিয়েছিলাম, সেটাও খুব একটা ভালো চলেনি। আপাদমস্তক একটা ইম্পার্ফেক্ট মানুষ আমি। তোমার সোশ্যাল লাইফে আমি হয়তো কোন কাজেও লাগবো না। তোমাকে হেল্প করার মতোও আমার কাছে কিছুই নেই। আমি খুবই সাধারণ মেয়ে। এমন সাধারণ তোমাকে মানায় না। তুমি অনেক বেশি ডিজার্ভ করো। তুমি তো ঐ আকাশের চাঁদের মতো। যাকে নিজের ভেবে ফেলে ভুলটা আমি করেছিলাম।’
হৃদির কথাগুলো শুনে আমার চোখ লাল হয়ে এলো। কথাগুলো বলতে বলতে হৃদির চেখেও পানি চলে এলো। যা বারবার সংযত করার চেষ্টা করে হৃদি বলতে লাগলো,
‘জানো রাইয়ান, আমি না কোন কিছুই জীবনে পারফেক্ট ভাবে করতে পারিনি। এই এক জীবনে আমি শুধু নিখুঁত ভাবে যেটা করতে পেরেছি সেটা হলো ভালোবেসেছি। আর এই ভালোবাসায় আমি কোন কমতি রাখবো না। এই একটা বিষয়েই আমি প্রাউডলি বলতে পারি যে আমি ভালোবেসেছি। যেই ভালোবাসায় বিন্দুমাত্রও খাদ নেই। কোন খুঁত নেই। আমার নিজের জন্য কিছুই চাওয়ার নেই। আমি শুধু চাই তুমি ভালো থাকো। এই পৃথিবীর সবথেকে বেস্ট মেয়েটা তুমি তোমার জীবনে পাও। যার অনেক যোগ্যতা আছে। একদম পারফেক্ট একটা মেয়ে। যে সত্যিই তোমার যোগ্য।’
আমার বুকে ভেতরটা হু হু করতে লাগলো। হৃদির প্রতিটি শব্দই ছিল একদম স্পর্শকাতর। আমার স্টুপিডিটি একটা ধারনার জন্য কতোটা আঘাত পেয়েছে হৃদি। নিজের বিশেষত্ব নিয়ে নিজে সন্দেহ করছে। আমার ভেতরটা দগ্ধ হতে লাগলো। চোখ উপচে পানি বেরিয়ে আসতে চাইলো। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সংযত করে আমি হৃদির গালে হাত রাখলাম। চোখে চোখ রেখে বললাম,
‘এসব উল্টাপাল্টা কথা কি ভেবে রেখেছো তুমি! একটা কথা মন দিয়ে শুনে রাখো। আমার জন্য এই পৃথিবীর সবথেকে বেস্ট মেয়েটা হলো তুমি। কারণ, আমি তোমাকেই ভালোবাসি।’
হৃদি নয়নাসিক্ত চোখে অপলক আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। হৃদির গালে ধরা আমার হাতটা আরো আঁকড়ে রাখলাম আমি। বুকের অথৈ অনুভূতি নিয়ে এঁকে দিলাম হৃদির ঠোঁটে ভালোবাসার এক গভীর চুম্বন। হৃদির বন্ধ চোখ যুগল থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
চলবে,