তুমি বললে আজ পর্ব-২০+২১

0
988

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২০.

.
বাংলাদেশের অভিনেতা জোভানের বিখ্যাত একটা ডায়লগ আছে, ‘আমি হাত দিয়ে যা ছুঁই, সব দুঃখ হয়ে যায়।’ আমার জীবনটাও ঠিক সে রকমই, কিন্তু কথাটার মাঝে একটু ভিন্নতা আছে। ‘আমি মন দিয়ে যা ভাবি, সব তার উল্টো হয়ে যায়।’ প্রতিটা পদে পদেই সেটা অনুভব করতে পারি। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। গত কয়েক দিনে ভেবেই নিয়েছিলাম তাসফি নামক বজ্জাত লোকটার আশেপাশেও খুব একটা যাবো না, শুধু প্রয়োজন ছাড়া। কিন্তু আজকে সারাদিন ওনার সাথেই কাটাতে হবে। অবশ্য বাইকে করে ঘোরাঘুরিও তো হবে। বাইকে করে ঘোরাঘুরি করার নেশাটা সেই ছোট থেকেই, বাইকে করে কোথাও যাবার কথা শুনলে আর না করতে পারি না। এই অভ্যাসটাও তাসফি ভাইয়ের জন্যই হয়েছে। শুধু গত কয়েকটা বছর-ই তেমন একটা ঘোরাঘুরি করা হয় নি। যেটাও গিয়েছি, সেটা কাজের জন্য রাহাতের সাথে। তাসফি ভাইয়া ছাড়া কেউ সেভাবে বাইকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে নি। তাসফি ভাই ধমকে ধামকে বারণ করলেও আমার বায়নার কাছে একসময় ঠিকই হার মেনে নিয়েছেন, বাইকে করে আমাকে নিয়ে ঘুরিয়েছেন সারা বেলা।

ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা হিজাবটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে চলেছি। এই গরমের মাঝে এতটা জার্নিতে হিজাব বাঁধবো কি না, সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। মিনিট পাঁচেক সেভাবেই ভাবনার মাঝে হঠাৎ দরজা খুলে রুমে ঢুকলেন তাসফি ভাই। আমার দিকে না তাকিয়েই এগিয়ে আসতে আসতে বলে উঠলেন,
“এই কার্ড গুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নে, তাড়াতাড়ি চল। দেরি হয়ে যাবে অনেক।”

হাতের কার্ডগুলো বিছানায় রেখে এবার তাকালেন আমার দিকে। অবাক হয়ে আবারও বলে উঠলেন,
“তুই এখনো রেডি হোস নি রুপু? হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

“না… মানে, আমি তো….”

“কি মানে মানে করছিস? এতক্ষণ রুমে ঢুকে কি করলি? বেয়াদব! আজকেই কি বিয়ে খেতে যাচ্ছিস, এতো সাজগোজের কি আছে?”

বলেই থামলেন উনি। কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বললেন,
“সত্যি করে বল তো রুপু, কার জন্য এত সাজগোছ করছিস? আমার জন্য তো নয়।”

“আজব তো, কার জন্য সাজতে যাবো আমি? আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে, সেজেছি?”

“মাথাতেও আনবি না। কি সব আটা ময়দা দিয়ে সাজগোছ করিস, সব আমার জন্যই করবি। তোর ওই পেতনী সাজ দেখে ছোট খাটো হার্ট অ্যাটাক করলেও সহ্য করে নিবো।”

বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল আমার। বলে উঠলাম,
“উফ্! থামবেন আপনি তাসফি ভাইয়া। এমনিতেই বুঝতে পারছি না কি করবো….”

“কি এমন রাজকার্য ভাবছিস যে, কি করবি বুঝতে পারছিস না?”

“এই গরমে হিজাব বাঁধবো কি না, সেটাই বুঝতে পারছি না। সাথে এতদূরের জার্নি।”

আমার অসহায়ত্বে বলা কথাটা শুনে উনি একটু চুপ হয়ে গেলেন। একটু সময় নিয়ে বললেন,
“চুলগুলো ভালোভাবে কাঠি দিয়ে বেঁধে নে, হিজাব পরতে হবে না আজকে।”

অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকলাম ওনার দিকে। ধমক না দিয়ে এত নরম সুরে হিজাব বাঁধবো বারণ করলেন, সেটা যেন ঠিক হজম হলো না আমার। তবুও মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম, আমার কনফিউশান দূর করে দেবার জন্য।
সময় নষ্ট না করে চুলগুলো আঁচড়ে ঢিলা করে কাঠি দিয়ে বেঁধে নিলাম। ওড়নাটা দু’ কাঁধের পাশ দিয়ে ঝুলিয়ে ভালোভাবে পিন আপ করে নিলাম। বিছানার কাছে এসে কার্ডগুলো ব্যাগে ঢুকতে ঢুকতে তাসফি ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলাম,
“চলেন তাসফি ভাইয়া, আমার হয়ে গেছে….”

ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ওনার দিকে তাকাতেই হঠাৎ বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। এতক্ষণে যেন ভালোভাবে খেয়াল করলাম ওনাকে। গায়ে কালো রঙের শার্ট, কনুই পর্যন্ত শার্টের হাত গুটিয়ে রাখা, ফর্সা হাতের কালো লোমগুলো খুব করে নজর কারছে, ছোট বড় চুলগুলো আঁচড়ে রাখা তবুও কিছু চুল কপালে এসে পরেছে। একদম হিরো লুক অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ওনার এই চাহনিতে প্রতিটি মেয়েই প্রেমে পড়তে বাধ্য। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হলো না, আবারও হয়তো প্রেমে পরে গেলাম ওনার। হয়তো না, সত্যি সত্যিই প্রেমে পরে গেলাম। টিপটিপ শব্দধ্বনি করে উঠলো বুকে, অদ্ভুত বাজে এক ভাবনা মন ও মস্তিষ্কে খেলে গেল। ছুটে গিয়ে ওনার গলা জড়িয়ে টপাটপ কয়েকটা চুমু খাওয়ার বাসনা জাগলো।

চমকে উঠলাম কিছুটা। ছি! কি সব চিন্তা ভাবনা মাথায় আনছি? সকলের সাথে সাথে আমিও মনে হয় অসভ্য হয়ে যাচ্ছি। না… না, বাসায় এসে অজু করে আজকেই তওবা করতে হবে। কিছুটা স্বাভাবিক করে নিলাম নিজেকে। আস্তে করে বলে উঠলাম,
“ক্..কি হলো? চলেন… এখন দেরি হচ্ছে না?”

প্রতিত্তোরে কিছু না বলেই হুট করে এগিয়ে এলেন আমার অতি নিকটে। হাত বারিয়ে আলতো করে জড়িয়ে তাকালেন আমার মুখের দিকে, তারপর টপাটপ কয়েকটা চুমু দিলেন দু’ গালে। বিস্মিত হয়ে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল ওনার কান্ডে। ছটফটিয়ে ওনার থেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে কিছু বলতে চাইলাম। কিন্তু আমাকে কোন সুযোগ না দিয়েই মাথাটা একটু নিচু করে গলার ভাঁজে মুখ নিলেন, ঠোঁট দিয়ে টুকরো টুকরো ভাবে স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠলাম আমি, স্থির হয়ে গেলাম একেবারে। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর মাথা উঠিয়ে নিলেন। চোখ দুটো বন্ধ থাকায় দেখতে পেলাম না ওনার চেহারার ভাবভঙ্গি। আবারও গালে আলতো ভাবে স্পর্শ দিয়ে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“আমি আবার ভালো মানুষ, তাই এতটুকু তেই কন্ট্রোল করে নিলাম, তা না হলে রিফার বিয়ে ছেড়ে আমাদের বিয়ের আয়োজনটাই সবার আগে হতো।”

বলেই ছেড়ে দিলেন আমাকে। চোখ খুলে হাজারো লজ্জা ও অস্বস্তি নিয়ে তাকালাম ওনার দিকে। অদ্ভুত হেঁসে তাকিয়ে আছেন। একটু সময় নিয়ে মাথা ঝুকিয়ে এনে বলে উঠলেন,
“তবে এতটাও ভালো মানুষ নই, যে সবসময় নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো।”

.
একরাশ লজ্জা ও অস্বস্তি নিয়ে নিচে এসে গেইটের কাছে এসে দাঁড়াতেই, বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মি. বজ্জাত তাসফি কে চোখে পড়লো। লোকটা যে এতটা বজ্জাত, সেটা ওনার ইনোসেন্ট ফেস দেখে বোঝা বড়ই কঠিন। ওনার সব অ*সভ্যতা কি আমার সামনেই করতে ইচ্ছে হয় কি না, সেটাও বোঝা দায়।
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমকে উঠলেন উনি, তাড়াতাড়ি করে বাইকে উঠে বসতে বললেন। ধীর পায়ে এগিয়ে যেতেই আবারও ধমকে উঠলেন উনি।

“যেভাবে হাঁটছিস মনে হচ্ছে দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পেটের মধ্যে তিন চারটা লাফালাফি করছে, এনি টাইম ডেলিভারি হয়ে যাবে।”

বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম ওনার দিকে। এই মানুষটার মুখে কি কিছুই আঁটকায় না? কিছু বলার ভাষায় যেন ভুলে গেলাম আমি, ঠিক কি বলবো সেটাই যেন খুঁজে পেলাম না। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও বললেন,
“কি…. দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কোলে উঠবি? অবশ্য আমার কোন সমস্যা নেই, তুই বললে এখুনি কোলে নিচ্ছি….”

“বজ্জাত লোক একটা, সারাদিন এত অ*সভ্য মার্কা কথা কিভাবে বলতে পারেন আপনি?”

“দিন দিন চরম লেভেলের বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস তুই? কত্তো বড় সাহস তোর রুপু, আমাকে ধমক দিস? না জানি আমার বাচ্চা কাচ্চার কি হাল করিস তুই। আমার ভবিষ্যৎ পুরাই অন্ধকার বানিয়ে দিবি তুই।”

“উফ্! থামবেন আপনি?”

ওনাকে আর বলার সুযোগ দিলাম না। এগিয়ে গিয়ে ওনার কাঁধে হাত দিয়ে বাইকে উঠতে লাগলাম। ওনার হিরো মার্কা বাইকে লাফিয়েই উঠে বসলাম। ওড়না ঠিক করতেই উনি বলে উঠলেন,
“তোরা আসলেই মীরজাফরের বংশধর। তোর বাপ চাচা বউয়ের শোকে শুকিয়ে মা*রার প্ল্যান করছে, আর তুই আমার ঘারে উঠে।”

“সেটাই তো করা উচিত আপনার সাথে। বজ্জাত লোক একটা।”

বিরবির করে কথাটা বলেই ঠিক হয়ে বসলাম। তাসফি ভাই কথাটা ঠিকঠাক ভাবে কথাটা না শুনলেও বলে উঠলেন,
“কি…. কি বললি তুই?”

“কি আবার…. বললাম আমার বাবা চাচা আপনার কি হয়? এভাবে বলছেন কেন? ফাজিল লোক!”

“কি হয় জানিস না? বেয়াদব! শ্বশুর হয় শ্বশুর, আর আমার বাচ্চা কাচ্চার নানা। তোর মস্তিষ্ক বিহীন মোটা মাথায় এগুলো কি ঢুকবে? গাধী কোথাকার!”

“উফ্! অ*সহ্য। যাবেন আপনি, নাকি নেমে যাবো আমি?”

“আচ্ছা…. আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আমার ভালো মানুষ, তাই কিছু বললাম না।”

.
দুই ঘন্টার রাস্তায় প্রায় মিনিট পনের আগেই সাদিক ভাইয়ার গ্রামের বাড়ি পৌঁছে গেলাম। এত তাড়াতাড়ি যাবার কারণ ওনার হিরো মার্কা বাইক। আমাকে শক্ত করে ওনাকে ধরে বসতে বলে, সবকিছু উপেক্ষা করে অনেকটা জোরেই চালিয়ে এসেছেন। অবশ্য রাস্তার মাঝে বেশ কয়েকবার থামিয়েছেন আমার জন্য। একভাবে বসে থেকে হাত পা অবশ হয়ে এসেছিলো যেন।

বাড়ির সামনে বাইক থামাতেই লাফিয়ে নেমে গেলাম আমি। ওভাবে বসে থাকা আর যেন সম্ভব হচ্ছিলো না। নেমে দাঁড়াতেই ধমকে উঠলেন তাসফি ভাইয়া। বললেন,
“পেঙ্গুইনের মতো এভাবে লাফাচ্ছিস কেন? বেয়াদব! হাত পা ভেঙে আমার কোলে ওঠার ধান্দা?”

আমি কিছু বলার আগেই একজন মহিলা এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। কোথা থেকে এসেছি সেটা জানতে চাইলেন। তাসফি ভাই বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পরিচয় দিলেন। কিন্তু মহিলার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা গেলো হয়তো চিনতে পারে নি। পরে সাদিক ভাইয়ার শ্বশুর বাড়ির লোক কথাটা বলতে চিৎকার করে উঠলো, কাউকে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। মিনিট দুয়েক পর কাউকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে এলেন মহিলাটি। সাথের মহিলাটি আমাদের দিকে এগিয়ে আসতেই হাসি ফুটে উঠলো মুখে। তাসফি ভাইয়া ওনাকে দেখে সালাম নিলেন, আমার দিকে তাকিয়ে আমাকেও ইশারায় সালাম দিতে বললেন। ওনার কথামতো সালাম দিয়েই চুপ হয়ে গেলাম। তাসফি ভাইয়া কথা বলতে লাগলেন আন্টিটার সাথে। ওনাদের কথার মাঝে যতদূর বুঝতে পারলাম এটাই হলেন সাদিক ভাইয়ার মা এবং রিফাপুর শ্বাশুড়ি। তাসফি ভাইকে এর আগেও দেখেছেন বলে চিনতে অসুবিধা হয় নি। আমাদের সাথে কুশল বিনিময় শেষে ভেতরে নিয়ে যেতে উদ্যোগ হলেন।

.
.
চলবে…..

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২১.

.
“সাদিকের মুখে তোমার অনেক কথা শুনেছি। তোমার আঙ্কেলও তোমার কথা মাঝে মাঝে বলে, সেদিন আসার পর থেকে। তুমি আসলেই অনেক মিষ্টি মেয়ে।”

আন্টির কথায় লজ্জা লাগলেও অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে যাচ্ছি বারংবার। সামনে বসে থাকা মেয়েটাকে দেখে ভীষণ বিরক্ত লাগছে। মেয়েটাকে দেখে বিরক্ত লাগছে বললে ভুল হবে, মূলত মেয়েটার কান্ডকর্ম দেখে বিরক্ত লাগছে। মেয়েটা সাদিক ভাইয়ার ছোট বোন। দেখে মনে হচ্ছে আমার থেকেও বছর দুয়েকের বড় হবে। বাড়ির ভেতরে আসার পরেই নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের কার্ড এবং সাদিক ভাইয়ার জামা কাপড় গুলো দিয়ে দিলেন তাসফি ভাই। আন্টির সাথে দু’ একটা কথা বলতেই মেয়েটা আসলো বসার রুমে। আমাদের সাথে পরিচয় হবার পর সেই যে তাসফি ভাইয়ের দিকে ক্যাবলাকান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। শুধু তাকিয়ে থেকেই খ্যান্ত হয় নি, থেকে থেকে নানার অযুহাতে কথা বলে যাচ্ছে। যেটা মোটেও ভালো লাগছে না আমার। বজ্জাত লোকটাও কেমন দাঁত কেলিয়ে হেঁসে হেঁসে কথা বলে যাচ্ছে। কই আমার সাথেও তো এতটা হেঁসে হেঁসে কথা বলে না। আসলে ছেলে মানুষগুলো এমনি, সুন্দরী মেয়ে দেখলে বাকি সব ভুলে যায়।

“ইস্! আমার যদি আরও একটা ছেলে থাকলে রিফার সাথে সাথে তোমাকেও আমার কাছে নিয়ে আসতাম। কিন্তু সেই ভাগ্যটা তো আমার আর নেই মা, তবে তোমার বাবা চাচার সাথে কথা বলে আমার বোনের ছেলের জন্য তো আনতেই পারি। কি আসবা না?”

আন্টি আমার এক হাত টেনে নিয়েই কথাটা বলে উঠলেন। সাথে সাথে অবাক চোখে আন্টির দিকে তাকালাম। বসার রুমের সবাই কেমন করে জানি তাকিয়ে আছে আমার দিকে, এতে লজ্জা আর অস্বস্তিটা যেন আরও বেড়ে গেছে আমার। তাসফি ভাই এদিকে তাকিয়ে খুকখুক করে কেশে উঠলেন, সাথে বসে থাকা সাদিক ভাইয়াও। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আরেকটা আন্টি এসে আমার কাছে বসলেন। কোন সময় না নিয়েই বলে উঠলেন,
“তুমি একদম আমার মনের কথাটা বলেছো আপা। মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই মনে হচ্ছিলো একে যদি কাছে রাখতে পারতাম। সাদিকের বউয়ের সাথে সাথে একেও নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করো আপা। দুই বোন এক বাড়িতে আসলে ক্ষতি কি?”

তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকালাম আমি। কেমন জানি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন, না রাগ, না ক্ষোভ কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু আন্টিদের কথাগুলো যে ওনার পছন্দ হয় নি, সেটা ঠিকই বুঝতে পারলাম। কিন্তু হঠাৎই মনে মনে ভীষণ হাসি পেল ওনাকে দেখে।
আন্টিরা আবারও কিছু বলতে চাইলে সাদিক ভাইয়া থেমে দিলেন এবার। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,
“তোমাদের কোন কিছুর ব্যাবস্থা করতে হবে না, আমার একমাত্র ছোট শালিকার ব্যাবস্থা অলরেডি হয়ে গেছে। তোমরা না জেনে শুধু শুধু আমার শালিকার সংসারে আগুন লাগাচ্ছো।”

সবাই কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো সাদিক ভাইয়ার দিকে। আন্টি বলে উঠলেন,
“মানে? কিসের সংসার, কিসের আগুন?”

“মানে টা হলো রূপার বিয়ে অনেক আগেই ঠিক হয়ে আছে, আমার বিয়ের পরেই ওর বিয়ের শানাইও বেজে যাবে।”

“কি বলিস এসব? আমরা তো কিছুই জানি না।”

“জানবে কেমনে? এই বিষয়ে কি কথা হয়ছে আগে? কিছু না জেনে অযথা ওদের সংসার শুরু হবার আগেই ভেঙে দিতে চাইছো।”

“ভাইদের বলে যদি ও…..”

“একদমই সেই ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো আম্মু। শালিকা আমার দূরে কোথাও যাচ্ছে না, একদম বাড়ির মানুষের কাছে থাকবে।”

এবার বিষ্ময় নিয়ে তাকালো সবাই। একবার আমার দিকে তো একবার সাদিক ভাইয়ার দিকে। জানতে চাইলে কে সে? কার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে। সবার কথা শুনে হেঁসে উঠলো সাদিক ভাইয়া। বললেন,
“জামাই তো তোমাদের সামনেই বসে আছে। জামাইয়ের সামনেই তার বউয়ের বিয়ে দিতে চাও? এটা কিন্তু ঠিক না আম্মু।”

সাদিক ভাইয়ার কথায় আরেক দফা অবাক হলো সবাই। এবার সবাই আমার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকালো। সকলের দৃষ্টি ওনার উপর পরতেই উনি ফট করে বলে উঠলেন,
“সত্যি আন্টি, আমার সামনেই আমার বউয়ের বিয়ের প্ল্যান করছো, এটা কিন্তু তোমরা মোটেও ঠিক করছো না।”

বলেই একটু থামলেন উনি, আমার দিকে একবার তাকিয়ে হাসলেন। বলে উঠলেন,
“এমনিতেই ওর বাবা, চাচা, ফুপার অত্যাচারে বউটাকে কাছে আনতে পারছি না, এবার তোমারও যুক্ত হচ্ছো? এমন হলে তো দেখা যাচ্ছে সাদিক নাতি নাতনি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমি বাবা-ই হতে পারলাম না।”

চোখ দুটো আপনা আপনিই বড় বড় হয়ে গেল আমার। স্থির হয়ে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। না রাগ, না বিরক্ত, কোন কিছুই যেন আনতে পারলাম না ওনার প্রতি। শুধু ভাবতে থাকলাম, একটা মানুষ ঠিক কতটা নি*র্লজ্জ আর অ*সভ্য হলে এধরণের কথা বলতে পারে? বাসায় বলেন সেটা মানা যায়, কিন্তু এখানে এসেও?
আন্টিরা হেঁসে উঠলো সবাই। আন্টির বলা কথার জন্য আফসোস করতে লাগলো। বাকিরাও এটা ওটা বলতে লাগলো। হঠাৎ কি জানি মনে করে সাদিক ভাইয়ার বোনের দিকে তাকালাম। কেমন জানি মুখটা শুকনো করে আছে। হয়তো তাসফি ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ের কথাটা শুনেই মুখটা শুকনো হয়ে গেছে।

.
একটু পরেই সাদিক ভাইয়াদের বাড়ি থেকে চলে আসতে চাইলেও আসতে দিলো না কেউ আমাদের। জানিয়ে দুুপুরের খাবারের পর তবেই আসতে দিবেন আমাদের। অগত্যা থাকতে হলো আমাদের। তাসফি ভাইয়া বাসায়ও জানিয়ে দিলেন আমাদের ফিরতে দেরি হবে।
দুপুরের খাবারের পর প্রায় এক ঘন্টা পর সকলের থেকে বিদায় নিলাম যাবার জন্য। তাসফি ভাইও আমাকে ভবিষ্যতের জন্য অনেক দোয়া করলেন, আমাকে জড়িয়েও ধরলেন। হঠাৎ ছাড়িয়ে নিয়ে গালে হাত দিলেন। চিন্তিত মুখে বলে উঠলেন,
“রূপা মা, তোমার গা এত গরম কেন? জ্বর-টর আসলো নাকি?”

বলেই কোন সময় নিলেন না আন্টি। কপালে গালে হাত দিয়ে দেখতে লাগলেন। চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
“তাই তো, জ্বর আসছে বলে মনে হচ্ছে। ইস্! এতক্ষণে একদম খেয়াল করি নি।”

“এটা তেমন কিছু না আন্টি, এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। কয়েক সপ্তাহ ধরে এমনি থেকে জ্বর আসছে, আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে। সমস্যা নাই।”

“তা বললে কি হয় মা? নিজের শরীরের যত্ন নিতে হবে তো?”

আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না আন্টি। তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মেয়েটার দিকে একটু যত্ন নিও তাসফি, মনে তো হয় না নিজের কোন যত্ন নেয়?”

“সারাদিন লাফালাফি করে সময় কা*টানোর পর যদি সময় পায়, তবেই তো নিজের যত্ন নিবে, তাই না আন্টি? তাকে তো বাচ্চাদের মতো কোলে তুলে খাওয়াতে পারলে হয়।”

ওনার কথায় উপস্থিত সকলে হেঁসে উঠলো। রাগে কটমট চোখে ওনার দিকে তাকালেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না যেন। আন্টি হাসতে হাসতেই বলে উঠলেন
“সেটা আর বলতে, আজকে ওর খাওয়া দেখেই বুঝতে পেরেছি। তবে তোমাকেই কিন্তু সামলাতে হবে ওকে।”

“বাচ্চা কাচ্চা বউ বিয়ে করলে তা তো একটু হবেই আন্টি। তবে সমস্যা নাই, একদম মানুষ করে ফেলবো।”

আবারও সবাই শব্দ করে হেঁসে উঠলো। মনে কঠিন একটা গালি দিলেও মুখে কিছু বলতে পারলাম না। মনে হচ্ছে এখুনি গাছের একটা ডাল ভেঙে এলে বারি দিয়ে ওনার মাথা ফাটিয়ে দেই। তবুও যেন এই বজ্জাত লোকটার মুখ একটু বন্ধ হয়।
আরও দু’ একটা কথা বলে বাইকে গিয়ে উঠলাম। তাসফি ভাই সবাইকে বিয়ের দিন অবশ্যই যেন যাও সেটা আবারও জানিয়ে দিলেন। আমাকে ভালোভাবে ধরে বসতে বলেই বাইক স্টার্ট দিলে।

.
“আপনার মুখে কি কিছুই আঁটকায় না, তাসফি ভাইয়া? এত অ*সভ্য কেন আপনি?”

সাদিক ভাইয়াদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূর যেই এক প্রকার ধমকে বলে উঠলাম আমি। উনি কিছু না বলে নিরুত্তর হয়েই বাইক চালিয়ে গেলেন। মেইন রোডে উঠেই হঠাৎ বাইক থামিয়ে দিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে হালকা তাকিয়ে বলে উঠলেন,
“গায়ে জ্বর আসছে আমাকে বলিস নি কেন? এতটা জার্নি করে না আসলেই তো হতো।”

“আমি কি আসতে চেয়েছি নাকি? আপনাদের জন্যই তো আসতে হলো।”

“গায়ে জ্বর আসছে আগে বললেই তো হতো, বেয়াদব! তাহলেই তো আর তোকে নিয়ে আসতাম না। তোর মাথায় কি কিচ্ছু নেই? গাধী কোথাকার!”

ওনার ধমকে মিইয়ে গেলাম কিছুটা। ইস্! তখন বললেই তো হতো। কিন্তু তখন তো এতটাও জ্বর ছিলো না। এখন বেশি হলে আমি কি করবো? মিনমিনে গলায় আস্তে করে বললাম,
“কিন্তু তখন তো এতটাও জ্বর ছিলো না, আমার কি দোষ?”

জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লেন উনি। আস্তে করে বলে উঠলেন,
“শরীর কি বেশিই খারাপ লাগছে?”

সাথে সাথে মাথা ঝাঁকালাম আমি। বোঝালাম না, একদমই শরীর খারাপ লাগছে না। উনি আর কিছু না বলে সামনের দিকে ফিরলেন, ওনাকে শক্ত করে ধরতে বলে আবারও বাইক স্টার্ট দিলেন।

.
জুলাইয়ে মাঝামাঝি সময়। হুটহাট কখন ঝড় বৃষ্টি ও ঠান্ডা আবহাওয়ার আগমন ঘটে তা বোঝা মুশকিল। এতক্ষণে রোদের তুখোড় উত্তাপ থাকলেও কিছুটা এগিয়ে যেতেই মৃদু বাতাসের আগমন ঘটলো। আস্তে আস্তে ধূসর মেঘের নিচে সূর্যটাও চাপা পরে গেল। বাসাতের মাত্রা বাড়তেই গা শিরশির অনুভব হতে লাগলো যেন। হালকা কেঁপে তাসফি ভাই কে জড়িয়ে বুকে থাকা হাতে উঠে খামচে ধরলাম ওনার শার্ট। মিনিট দুয়েকের মাঝে বাইকের গতিটা কমিয়ে এনে এক সময় থামিয়ে দিলেন। জানতে চাইলেন শরীর খারাপ লাগছে কি না? আমি মাথা ঝাঁকিয়ে না বোঝালাম। তবুও যে মানলেন না উনি, বাঁকা হয়ে গালে কপালে হাত রেখে আঁতকে উঠলেন যেন। নরম গলায় ধমকের সুরে বললেন,
“শরীর খারাপ লাগছে তবুও মিথ্যা বলছিস কেন? জ্বর তো মনে হচ্ছে আরও বেড়ে গেছে।”

প্রতিত্তোরে কিছু না বলে চুপ করেই রইলাম। শরীরটা সত্যিই কেমন জানি লাগছে, কিন্তু ওনাকে বললেই তো উত্তেজিত হয়ে উঠবেন। এখনো অনেকটা পথ বাকি, মাত্র আধা ঘন্টার পথ পেরিয়ে এসেছি। উনি ভালোভাবে ধরতে বলে আবারও বাইক স্টার্ট দিলেন। ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে ওনার পিঠে মাথা এলিয়ে দিলাম। উনি আগের চেয়েও আরও জোরে বাইক চালাতে লাগলেন।

বাতাসের রেশটা যখন বাড়তে লাগলো, তখন হঠাৎ করেই বাইকটা থেমে গেল। ঝড় বৃষ্টির আগমনী বার্তায় ফাঁকা রাস্তায় কাউকেই নজরে এলো না। তাসফি ভাই দু’ তিন বার বাইক স্টার্ট করার চেষ্টা করতেই যখন হলো না, তখন মাথা তুলে সামনের দিকে তাকালাম। আরও কয়েকবার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন।

“কি হয়েছে? চালু হচ্ছে না কেন?”

বলতেই উনি ঘাড় ঘুরিয়ে হালকা তাকালেন আমার দিকে। চোখে মুখে অসহায়ত্ব এনে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“কি যে? বুঝতে পারছি না, হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল।”

“এখন কি হবে? মনে তো হচ্ছে এখুনি বৃষ্টি নামবে, কত জোরে বাতাস হচ্ছে।”

“সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না? এতক্ষণ তো ভালোই চলছিলো, হঠাৎ কি যে হলো।”

বলেই আরও কয়েকবার চেষ্টা করতে লাগলেন বাইক চালু করার। কিন্তু কোন কাজই হলো না। এর মাঝেই টিপটিপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগে, সাথে বাতাসের মাত্রা। বৃষ্টির ঠান্ডা পানির ফোঁটা গায়ে পড়তেই গা ঝাঁকিয়ে কেঁপে উঠলাম। সাথে সাথে উনি বলে উঠলেন,
“রুপু তাড়াতাড়ি নাম, দেখি আশেপাশে আশ্রয় নেবার কিছু পাই কি না।”

সময় নিলাম না আমি, নেমে দাঁড়াতেই উনিও নেমে দাঁড়ালেন বাইক থেকে। আমাকে সাথে আসতে বলে বাইকটা ঠেলে নিয়ে যেতে লাগলেন।

.
.
চলবে…..