তুমি বললে আজ পর্ব-২২+২৩

0
607

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২২.

.
বাতাসের দাপটে হেলে হেলে পড়ছে গাছ পালার ডালগুলো, দমকা হওয়ার সাথে বৃষ্টির দাপটও অধিকতর বেড়ে যাচ্ছে। বড় একটা গাছের নিচে বৃষ্টির কবল থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নিলেও শেষ রক্ষাটা কিছুতেই হচ্ছে না। বাতাসের দাপটে ঠিকই বৃষ্টির পানিতে গা ভিজিয়ে যাচ্ছে। তাসফি ভাইয়ের হিমশীতল শরীরে জড়িয়ে ধরে, ওনার ভেজা বুকে মুখ গুঁজে থেকে থেকে কেঁপে চলেছি আমি। পানির ঝাপটা শরীরে পরার সাথে সাথে কাটা দিয়ে উঠছে পুরো শরীর, একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছেন উনি আমাকে।
বাইক ঠেলে নিয়ে কিছুদূর আসতেই বাতাসের সাথে সাথে বৃষ্টির মাত্রাটাও বেড়ে যায়। আশেপাশে তাকিয়ে আশ্রয় নেবার মতো কোন জায়গা না পেয়ে আমাকে দ্রুত পা চালিয়ে আসতে বলে বাইক টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। ততক্ষণে অনেকটাই ভিজে গিয়েছিলাম আমার। আরও একটু আসতেই রাস্তার পাশে এই বড় আকারের গাছটা নজরে আসে। বাইকটা রেখে গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে পরেন আমাকে নিয়ে। একটুপর যখন কেঁপে উঠছিলাম তখন ওড়নার পিন দু’ পাশ থেকে খুলে দিয়ে মাথাসহ পুরো শরীর ঢেকে দেন তাসফি ভাই। তারপর জড়িয়ে ধরেন নিজের সাথে। দমকা হওয়ার মাঝেও ওনার আলিঙ্গনে কিছুটা হলেও উষ্ণতা ঘিরে ধরেছে। এভাবে যে কতক্ষণ ছিলাম, ঠিক জানা নেই আমার।
হঠাৎ নিজ থেকে তাসফি ভাই বলে উঠলেন,
“ও শিট! কি করে ভুলে গেলাম এটা আমি?”

হালকা মাথা তুলে তাকালাম ওনার মুখের দিকে। চিন্তিত ভাব স্পষ্ট ফুটে আছে ওনার চোখে মুখে, পুরো মুখ জুড়ে বৃষ্টির ফোঁটায় বিদ্যমান। ওনার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে উঠলাম,
“কি হয়েছে?”

“সকালে…. সকালে রাহার আর সাগর বইকটা নিয়ে বেরিয়েছিলো। বলেছিলাম ট্যাং ফুল করে ডিজেল তুলতে, নিশ্চিত ওরা করে নি। আমারই ভুল, আসার সময় চেক করা উচিত ছিলো।”

বলেই থামলেন উনি, একহাত আমার গালে রেখে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“বেশি খারাপ লাগছে?”

মাথা ঝাঁকালাম আমি, বোঝালাম লাগছে না। এমনিতেই ভীষণ চিন্তিত আছেন উনি, এই মানুষটাকে আর চিন্তায় ফেলতে চাই না আমি। কিছু বললেন না উনি, নিরুত্তর হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। ওনাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম,
“এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তো কিছুই হচ্ছে না, তার চেয়ে বরং একটু এগিয়ে যাই। এখন তো বাতাসের মাত্রাটাও কমে এসেছে।”

সহসায় কিছু বললেন না উনি। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে তাকালেন আমার দিকে। বললেন,
“হাঁটতে পারবি তো?”

সাথে সাথে মাথা ঝাঁকালাম আমি। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজার তো কোন মানে হয় না, তার চেয়ে বরং একটু এগিয়ে যাওয়ায় ভালো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতেও খুব একটা দেরি নাই। এগিয়ে গেলে যদি কোন কিছুর দেখা মিলে।

.
মিনিট বিশেক হাঁটার পর হঠাৎই শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো আমার। দু’ কদম হাঁটাও যে দুরষ্কর হয়ে উঠলো আমার জন্য। জ্বর জ্বর শরীরে এতক্ষণ বৃষ্টির পানিতে ভেজার পর যেন বরফের ন্যায় জমে যেতে লাগলো পুরো শরীর। তাসফি ভাই হওয়া তো বুঝতে পারলেন আমার অবস্থা। বাইকটা রেখে এগিয়ে এসে ধরলেন আমাকে। গালে হাত রেখে বলে উঠলেন,
“এ্যাই রুপু! রুপু, কি হয়েছে? বেশি খারাপ লাগছে? তাকা আমার দিকে….”

জবাব দিতে পারলাম না আমি ওনার কথার, একবার ওনার দিকে তাকিয়ে মাথা এলিয়ে ওনার বুকে রাখলাম। বৃষ্টির মাত্রাটা কমে এলেও বাতাসের মাত্রাটা কমে নি। এতক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, কালো মেঘের ঘনঘটায় রাত নেমেছে বলে মনে হচ্ছে। মিনিট দুয়েক পর আস্তে করে ডাকলেন আমাকে, কথা না বলে মাথা উঠিয়ে তাকালাম। ওনার অসহায়ত্ব মুখটা দেখে ভাবলাম, না এভাবে ওনাকে চিন্তায় ফেলা যাবে না। এমনিতেই অনেকটা চিন্তায় আছে মানুষটা। নিজেকে শক্ত করে সরে এলাম ওনার থেকে, আস্তে করে বললাম ঠিক আছি আমি, হাঁটতে পারবো। কিছু বললেন না উনি, কপালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে ছেড়ে দিলেন, ওনার হাত জড়িয়ে হাঁটতে বললেন। গায়ে কিছুটা শক্তি জমিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম ওনার হাতের বাহু ধরে।
আরও মিনিট দশেক হাঁটার পর সামনে কয়েকটা বাড়ি দেখা গেলো। তাসফি ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ওখানে গিয়ে হয়তো কোন সাহায্য পাওয়া যাবে। আমিও আর দ্বিমত পোষণ করলাম না। এতক্ষণে বৃষ্টির মাত্রাটাও অনেকটা বেরে গেছে, সাথে বাতাসের দাপট।

রাস্তার সাথেই বাড়িটার সামনে বাইকটা এক সাইড করে রাখলেন তাসফি ভাইয়া। এগিয়ে এসে আমাকে আঁকড়ে নিলেন, ওনার বুকে মাথা ঠেকিয়ে কেঁপে উঠলাম বেশ কয়েকবার। উনি কোন রকম দু’হাতে আমাকে আগলে নিয়ে এগিয়ে এলেন দরজার কাছে। এক হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দরজায় ধাক্কাতে লাগলেন। দরজার উপরে খরের চালা দেওয়ায় বৃষ্টি গায়ে পড়া থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেলাম। কিন্তু বাতাসের ঝাপটায় ঠান্ডার রেশটা দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হতে লাগলো।
বার কয়েক ধাক্কা দিলেও দরজা খুললো না কেউ। বৃষ্টির শব্দে হয়তো শুনতে পেল না কেউ। তাসফি ভাই করুন চোখে তাকালেন আমার দিকে। অসহায়ত্ব গলায় বলে উঠলেন,
“এখন কি করবো?”

আমি আস্তে করে বললাম চলে যাই। উনি প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না। মিনিট দুয়েক পর সেখান থেকে চলে আসতে নিতেই হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ এলো, সাথে ভেসে উঠলো অপরিচিত এক কণ্ঠেস্বর।

“কে আপনারা, কাকে চাই?”

দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন এক মাঝ বয়সী লোক। কথাটা শুনেই সময় ব্যায় করলেন না তাসফি ভাইয়া। সাথে সাথে বলে উঠলেন,
“অনেক বিপদে পড়েছি চাচা, মাঝ রাস্তায় বাইকটা বন্ধ হয়ে গেছে, হয়তো তেল নেই। সাথে এই ঝড়বৃষ্টি।”

লোকটা পরখ করে দেখতে লাগলেন আমাদের। হয়তো ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না আমাদের। হুট করে ঝড়বৃষ্টির রাতে এমন অপরিচিত মানুষকে বিশ্বাস না করাটাই স্বাভাবিক। যদিও এখন রাত না বলে সন্ধ্যা রাত বলা চলে। মাঝ বয়সী লোকটা কিছু বলার আগেই তাসফি ভাইয়া বলে উঠলেন,
“যদি একটু সাহায্য করতেন চাচা। ওর অনেকটা জ্বর, এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।”

“কে…. কে আইছে মিনুর বাপ?”

বলতে বলতে মাঝ বয়সী একটি মহিলা এগিয়ে এলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে আবারও লোকটাকে উদ্দেশ্য করে জানতে চাইলে, কে এগুলো। লোকটাও তাসফি ভাইয়ের বলা কথাগুলো বলে গেলেন। যতদূর মনে হলো ওনারা স্বামী স্ত্রী। আমাদের দিকে তাকিয়ে আন্টিটা তাসফি ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
“তা বাপু বিপদে পরছো ভালা কথা, সাহায্য করমু। কিন্তু আজকালকার যে যুগ আইছে বাপু, কাউরেই বিশ্বাস নাই।”

“আপনারা যেমনটা ভাবছেন তেমন না, প্রয়োজনে টাকা দিবো। তবুও একটু সাহায্য করেন চাচী, মেয়েটার গায়ে অনেকটা জ্বর, এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।”

এবার কিছুটা নরম হয়ে এলেন উনি। বললেন,
“তা এই মাইয়া তোমার কি হয়? দেখো বাপু, পরে কিন্তু কোন ঝামেলায় পড়তে পারমু না।”

“ও আমার বউ! আই থিক সমস্যা হওয়ার কোন কথা নয়?”

সময় না নিয়ে ফট করে বলে বলে উঠলেন উনি। চমকে উঠলাম আমি। ‘আমার বউ’ কথাটা যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতে লাগলো আমার কানে। মাঝ বয়সী লোকটা বলে উঠলো,
“সত্যিই অনেক বিপদে পরছে মিনুর মা, দেখো না জিভা কি হয়ছে। ঘরে নিয়া চলো ওদের।”

“হু.. হু আসো ভিতরে। আহারে মাইয়াডা কাঁপতাছে কেমনে। কিছু মনে কইরো না বাবা, গায়ের মানুষ আমরা, থাকি রাস্তার সাথে একলা বাড়িডে দুইডা মানুষ, অচিন মানুষ দেখলে একটু তো ভয়ডর লাগবোই।”

“না… না চাচী কিছু মনে করি নি, এটাই তো স্বাভাবিক।”

বাড়ির ভেতর ঢুকতেই আঙ্কেলটা বললেন বাইকটাও ভেতরে আনতে। তাসফি ভাই তাতে সায় দিতেই আন্টি এসে আমাকে ধরলেন, নিয়ে গেলেন একটা রুমে। ছোটখাটো দুই রুমের মাটির বাড়ি। রুমে নিয়ে গিয়ে মোছার জন্য একটা গামছা এনে দিলেন। জামা কাপড় পাল্টে নিতে বলতেই খেলাল হলো পড়ার মতো তো কিছু নাই, আন্টি কিছু না বলে বেরিয়ে গেলের রুম ছেড়ে। মিনিট দুয়েক পর একটা শাড়ি, ব্লাউজ আর ছায়া এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন শাড়িটা তার নিজের, বর ব্লাউজ আর ছায়া ওনার মেয়ের। মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় জামা কাপড়গুলো এখানে নে, আগের যেটা ছিলো সেটায় নিয়ে এসেছেন। আমাকে পাল্টে নিতে বলে বেরিয়ে গেলেন আন্টি, দূর্বল শরীরে কিছুটা শক্তি জুগিয়ে জামাটা পাল্টে নিতে লাগলাম। শাড়ি পড়াটা শেষ হয়ে এলেই ঘরে ঢুকলেন তাসফি ভাই। সোজা আমার কাছে এসে দাড়ালেন। গায়ে হাত দিয়ে দেখতে লাগলেন শরীরে তাপের মাত্রাটা। বলে উঠলেন,
“জ্বর তো আরও বেরে গেছে, অনেক খারাপ লাগছে? বিছানায় শুয়ে পর, আমি দেখি চাচা চাচীকে বলে ওষুধের ব্যাবস্থা করতে পারি কি না।”

“উহুম…. লাগবে না।”

অস্পষ্ট সুরে বলেই ওনার বুকে মাথা এলিয়ে দিলাম, থেমে থেমে কয়েকবার কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। উনি কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলেন আমাকে, জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে। ওনার বুকে মাথা গুঁজেই অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম,
“তখন ওটা বললেন কেন?”

“কখন? কি বলেছি?”

“তখন কেন বললেন, আমি আপনার বউ?”

সহসায় জবাব দিলেন না উনি। আগের চেয়েও শক্ত করে জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে। আমার কানের কাছে মুখটা এগিয়ে এনে বললেন,
“যেটা সত্যি সেটাই তো বলেছি। তুমি তো আমার বউ। আমার একমাত্র বিয়ে করা বউ।”

টিপটিপ শব্দের প্রতিধ্বনি হয়ে উঠলো আমার বুকে, সেটা টিপটিপ শব্দের ধ্বনিটা হয়তো ওনার কানেও গেল। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ছেয়ে গেল আমার শরীর ও মন জুড়ে। সত্যিই তো আমি ওনার বউ, উনি তো আর মিথ্যে কিছু বলেন নি। অনেক আগেই তো ওনার সাথে বিয়ে নামক সেই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। জুড়ে গিয়েছি একে অপরের সাথে।

.
.
চলবে…..

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২৩.

.
বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধের মানেটাও তখন ঠিকভাবে বুঝতাম না, শুধু জানতাম তাসফি ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হবে। সারাদিন ওনার সঙ্গ পেতে ভালো লাগলেও বিয়ের পর যে একসাথে থাকতে হয় সেটা ভেবেই ভয় কাজ করতো। এতকিছুর মাঝেও অপ্রত্যাশিত ভাবেই বিয়েটা হয়েছিলো আমাদের। কাঁপা কাঁপা শরীরে তাসফি ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেই ভাবতে লাগলাম অপ্রত্যাশিত ভাবে আমাদের বিয়ের সেই ঘটনাগুলো।

অতীত……
.
দাদু পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হবার পর আমাদের বিয়ের কথাটা একেবারে ধামাচাপা পড়ে যায়। কেউ আর কোন কথা উঠায় নি সে বিষয়ে। সময় চলতে থাকে নিজ গতিতে। ততদিনে আমি আরও একটা বছর পেরিয়ে ক্লাস নাইনের গন্ডিতে পা দিয়ে পুরো দমে নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দেই। তাসফি ভাইয়েরও ততদিনে রেজাল্ট দেয়, সাথে স্কলারশিপও পেয়ে যান। বাসার সবাই এত শত বলে ওনাকে বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। নিজের জেদ বজায় রেখে দেশের বাইরে যাবার কথাটা পুরোপুরি ইগনোর করে বিসিএস পরীক্ষা দেবার কথা বলে। তার কিছুদিন পর ওনার ভার্সিটি থেকে জবের লেটারও আসে। তারপর আর ধীরে ধীরে তাসফি ভাইয়ের কথাটা মেনেই সবাই চুপ হয়ে যায়।

.
দু’টো মাস আপন গতিতে চলতে লাগলো সবাই, সাথে সকলের কর্মকাণ্ড। তাসফি ভাই তখন বগুড়া তেই আছেন। ওনার ভার্সিটিতে জয়েন করার কয়েক মাস হাতে সময় আছে বলে।
সেদিন স্কুলে টিফিন পিরিয়ড পর মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করছি। মিনিট পনেরো যেতেই হঠাৎ তাসফি ভাই ক্লাসে ঢুকে পরেন। হঠাৎ ওনার আগমনে অবাক হয়ে গেলাম। উনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে স্যারের সাথে কথা শুরু করলেন। একটু পর ওনার সাথে যেতে বললেই অনেকটা অবাক হয়ে গেলাম। ব্যাগটা নিয়ে উঠে এলাম ওনার কথামতো।
পুরো রাস্তা কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর দেন নি। বাসায় এসে বাসার গুরুগম্ভীর পরিবেশ দেখে অবাক হলাম। এমন শান্ত পরিবেশ কেন জানি মেনে নিতে পারলাম না। তাসফি ভাইয়াকে আবারও জিজ্ঞেস করলে এরিয়ে যান, কোন কথা না বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে যান ভেতরে। ভেতরে এসে সবার কান্নারত চেহারা দেখে আরেক দফা অবাক হলাম যেন। নিশ্চুপ হয়ে সকলের ভীড় ঠেলে সমানে এগিয়ে যেতেই পা দু’টো থমকে গেল আমার। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা দাদীর ঘুমন্ত চেহারা। তাসফি ভাইয়ের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে, হাতের ব্যাগটা সেখানেই ফেলে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। ছুটে যেতে লাগলাম সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা দাদীর কাছে, তার আগেই কেউ একজন ধরে নিলো পিছন থেকে। দাদীর এভাবে হুট করে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারলাম না কিছুতেই। মেনে নিবোই বা কিভাবে? বাসায় থাকার একমাত্র সঙ্গী-ই ছিলেন তিনি, ভালোবাসার একটি মানুষ।

সেদিন বিকেলেই দাদীর লা*শ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়িতে। রাতেই জানাজা করে কবর দেওয়া হয়। সময়ের সাথে সাথে আত্মীয় স্বজনরাও চলে যায় নিজেদের গন্তব্যে। প্রায় এক সপ্তাহ পর আমরাও চলে আসি বাসায়।
দাদী মা*রা যাবার পর দাদু, মানে তাসফি ভাইয়ার দাদুও আবার হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পরেন। কয়েকদিন যাবার পর সুস্থ হবার বদলে আরও অসুস্থ হয়ে পরেন। একদিন সন্ধ্যায় আমাকে কিছু না জানিয়েই নিয়ে যাওয়া হয় ফুপিদের বাসায়। সেখানে গিয়েই বেশকিছু সময় পর যখন রিমি আপু, ফুপিরা ও কাজিন মহলের সবাই আসে, তখন জানতে পারি আজকেই তাসফি ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে।
দাদী হঠাৎ মা*রা যাবার বিষয়টা কেউ মেনে নিতে পারছিলো না। তেমনি দাদুও পারেন নি। অসুস্থ হবার পর থেকেই নাকি তাসফি ভাইও আমার বিয়ের কথাটা বলে গেছেন। বারংবার বলে গেছেন আমাদের বিয়েটা নাকি দেখে যেতে পারবেন না। দাদুর জেদের কারণে সকলেই একসময় সিদ্ধান্ত নেয় আজকেই আমাদের বিয়ে পরিয়ে রাখবে। যেহেতু আমার ১৫ বছর, এখনো আঠারো হয় নি। পরে পড়াশোনা শেষ হলে রেজিস্ট্রিটা করবে।
হঠাৎ দাদী মা*রা যাওয়া, তারপর দাদু অসুস্থ। ভালোবাসার মানুষগুলোকে হারিয়ে যেতে দেখে অনেকটা মুষড়ে পড়েছি। সেই সময় বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনের কোন অনুভূতিই ছুঁতে পারলো না। যন্ত্র মানবের মতো তাসফি ভাইয়ের পাশে বসে, শুধু মাথায় একটা ওড়না দিয়ে তিন বার কবুল বলে দেই।

.
রাতে দাদুর হাত ধরে বসে আছি বিছানায়। পাশেই গা ঘেঁষে বসে আছেন তাসফি ভাই। বাকিরা অপর পাশে ও বিছানার চারদিকে ঘিরে বসে ও দাঁড়িয়ে আছে। অসুস্থ শরীরেও লেগে আছে দাদুর মুখে হাসি। বেশ কিছু সময় যাবার পর দাদু বলে উঠলেন,
“এখন আমার আর কোন আফসোস থাকবে না। ছোট বউকে আমার দাদু ভাইয়ের বউ হয়ে দেখতে পারলাম। এখন ম*রেও আফসোস থাকবে না।”

“কি বলছে তুমি বুড়ো বর? কিছু হবে না তোমার। দাদীও আমাদের ছেড়ে গেল এখন তুমিও এসব কথা বলছো?”

“আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না ছোট বউ। তোমাকে এ বাড়ির বানাতে পেরেছি এতেই আমার শান্তি। নিজের সংসারটা আগলে রেখো ছোট বউ, আমার দাদু ভাইকে দেখে রেখো।”

“তোমার কিছু হবে না বুড়ো বর, আবারও সুস্থ হয়ে যাবে দেখো।”

কাঁদো কাঁদো স্বরে আস্তে করে বললাম। কেন জানি দাদুর কথাগুলো আমার মন সইতে পারলো না। কান্না গুলো গলায় এসে আঁটকে যেতে লাগলো। ফুপা ফুপি সহ বাকিরাও দাদুকে বোঝাতে লাগলো কিছু হবে না বলে, এসব কথা না বলতে। কিন্তু দাদু একই কথা বারবার বলে গেলেন। এবার ফুপিকে কাছে টেনে ফুপির হাত ধরে বললেন,

“বউমা, ছোট বউ কে নিজের মতো করে গড়ে নিও নিজের সংসারে, ওর দ্বায়িত্ব গুলো বুঝে দিও। তোমার ছায়া আর ছোট বউয়ের মাঝে আমি যে তোমার শ্বাশুড়িকে দেখতে পাই। ছোট বউকে এ বাড়ির বউ রুপে দেখে আমার মনে হচ্ছে তোমার শ্বাশুড়ি ফিরে এসেছে মা। তুমি ওকে তোমার শ্বাশুড়ির মতো নিজের মতো করে গড়ে নিও।”

কাউকে বলার সুযোগ না দিয়ে দাদু আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে গেলেন,
“তোমার ফুপির মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেত তোমার দাদী। নিজেই পছন্দ করে এ বাড়ির বউ করে নিয়ে আসে, গড়ে তুলে নিজের মতো করে। কিন্তু বেশিদিন এই সংসারের মায়ায় আঁটকে থাকতে পারে নি। আমাকে একা ফেলে, বউমা কে নিজের দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু তুমি আসার পর আবারও নতুন করে যেন তোমার দাদীকে পেয়েছিলাম। বড় হবার সাথে সাথে দাদু ভাইয়ের চোখেও তোমাকে নিয়ে অন্য কিছু আবিষ্কার করতে লাগলাম। তখনই ভেবে নিয়েছিলাম তোমাকে দাদু ভাইয়ের বউ করে নিয়ে আসবো। যাবার আগে তোমাকে দাদু ভাইয়ের বউ করে দেখে যেতে পেরেছি, এতেই আমার শান্তি।”

“আহ্! দাদুভাই, কিছু হবে না তোমার। একদম সুস্থ হয়ে যাবে, দেখো।”

তাসফি ভাই বললেও ওনার কথার পাত্তা দিলেন না দাদু। আপন মনেই আমাকে বলে গেল নানান কথা।

“আমার দাদু ভাইটা কিন্তু ভীষণ পাগলাটে স্বভাবের ছোট বউ, ওকে তুমি সামলে নিও। তোমাদের দাদীর মতো আমার দাদু ভাইকে একা ফেলে কখনো দূরে চলে যেও না, দাদু ভাইকে ছেড়ে যাবার কথা চিন্তাও করো না। তোমার দাদীকে ছাড়া আমি তো সামলে নিয়েছি নিজেকে, কিন্তু আমার দাদুভাই পারবে না, পারবে না তোমাকে ছাড়া ভালো থাকতে। আমার এই কথাটা রেখো ছোট বউ, আমার এই শেষ কথাটা রেখ।”

ছলছল চোখে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকালাম। বলতে চাইলাম, ‘দাদুকে চুপ করতে বলেন তাসফি ভাইয়া, আমি আর দাদুর কথাগুলো শুনতে পারছি না, দাদীকে হারিয়ে দাদুকেও হারানোর কথা ভাবতে পারছি না।’ উনি হয়তো আমার না বলা কথাগুলো বুঝে গেলেন। একহাত আমার কাঁধে রেখে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। দাদুকে বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করে গেলেন এসব না বলার জন্য, সাথে বাসার সবাইও বোঝানোর চেষ্টা করলো। দাদু কারোর কথা আমলে না এনে নিজ মনেই নানান কিছু বলে যেতে লাগলেন, একসময় শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলেন। দাদু ঘুমিয়ে যেতেই সকলে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো।

বড় বাবা ও আব্বু বাসায় চলে গেলেও বাকিরা সবাই ফুপির বাসাতেই কাটিয়ে দেয়। দু’ দিন সেখানে কাটলেও দু’দিন পর সকালে হঠাৎ করেই দাদু আমাদের ছেড়ে চলে যায়। এক মাসের মাঝেই পর পর দু’টো ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে অনুভূতি শুন্য হয়ে গেলাম যেন। বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো দাদুর সাথে কাটানো সুখের কিছু মুহুর্ত গুলো, কানে বাজতে লাগলো দাদুর বলা শেষ কথাগুলো। দাদুর বলা শেষ কথাগুলো মনে কোণে উকি দিতেই আমার অবুঝ মন আর চোখ দুটো খুঁজতে লাগলো তাসফি ভাইকে। এক সময় পেয়েও গেলাম। কিন্তু ওনাকে ভেঙে পড়তে দেখি নি। নিজেকে শক্ত করেই পুরো পারিবার সহ দাদুর কবর দেওয়া পর্যন্ত সামলে গেলেন। দিন শেষে সবাই চলে যেতে লাগলো নিজেদের গন্তব্যে, শুধু থেকে গেলাম আমরা কয়েকজন।

.
সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই স্বাভাবিক হতে লাগলো। মানুষ গুলোকে মনের মধ্যে দমিয়ে রেখে ব্যস্ত হয়ে গেল সবাই নিজেদের কর্মযোগে। সময় পেরিয়ে গেল আরও দু’টো মাসের মতো। এতদিনে তাসফি ভাইয়াও ঢাকায় চলে গেছেন। বিসিএস এর পিপারেশন সহ ভার্সিটিতে জয়েন হয়েছে গত একমাস ধরে। আজকে ফুপির বাসায় আসার কথা, সেই সাথে রিফাপুর থেকে তাসফি ভাইয়েরও ঢাকা থেকে আসবার কথা জানতে পারলাম। মন খারাপের রেশ ধরে থাকলেও ওনার আসার কথাটা শুনে হঠাৎই মনটা ভালো হয়ে গেল যেন। এতদিন পর মানুষটাকে দেখতে পাবো ভেবেই যেন একটা ভালোলাগা কাজ করছিলো।

বিকেলের দিকে ফুপি আসলেও তাসফি ভাই ঢাকা থেকে আসায় কিছুটা রাত হয়েই যায়। সকলের সাথে কথা বলে চলে যান নিজের রুমে, আমিও আর বিরক্ত করি নি। নিজের রুমে এসে ঘুমিয়ে যায়।
ঘুমটা কিছুটা গভীর হতেই কিছুর স্পর্শে আলগা হয়ে যায়। ভেঙে যায় গাড়ো গভীর ঘুমটা। পুরুষালী অস্তিত্ব পেতেই অনেকটা চমকে উঠি, পরক্ষণেই তাসফি ভাইয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই স্বাভাবিক করে নেই নিজেকে। আস্তে করে বলে বললাম,
“আ..আপনি এখানে? কখন আসলেন তাসফি ভাইয়া?”

“তুই যখন গভীর ঘুমে….”

“এত রাতে আমার রুমে কেন? কিছু দরকার?”

“হুম….”

“কি দরকার? এত রাতে আবার কি প্রয়োজন পরলো আপনার? আম্মু না হয় বড়মা কে বললেও তো দিতো, ফুপিও তো ছিলো বাসায়….”

“তারা কিভাবে দিবে? আমার তো তোকে প্রয়োজন।”

“মানে? এত রাতে আমাকে আবার কেন প্রয়োজন পরলো আপনার? কি লাগ….”

“সেসব তোর এই মস্তিষ্ক বিহীন মোটা মাথায় ঢুকবে না, গাধী কোথাকার। আগে বড় হয়ে নে, তারপর বুঝতে পারবি।”

ওনার বলা কথাগুলো সত্যিই বুঝতে পারলাম না আমি, ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকলাম। উনি বিছানায় বসে হুট করে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলেন। কেঁপে উঠলাম আমি। এই প্রথম এতটা কাছে থেকে, এতটা গভীরভাবে ওনার স্পর্শ পেলাম। স্থির হয়ে থাকতে পারলাম না যেন, থেকে থেকে কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। কাঁপা কাঁপা গলায় ওনাকে ছেড়ে দেবার কথা বললেও আমাকে ছাড়লেন না, আরও শক্ত করে আমার কোমর জড়িয়ে নিয়ে বলতে লাগলেন,
“দাদুভাইকে খুব করে মনে পরছে রুপু, হুটহাট আমার স্বপ্নে চলে আসছে। ভুলে যেতে পারছি না আমি, কিছুতেই ভুলে যেতে পারছি না ওই মানুষটাকে।”

জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিতে লাগলেন। হয়তো কান্নাও করছেন, কিন্তু লুকিয়ে যেতে চাইছেন আমার থেকে। কিন্তু আমার ছোট্ট মনটা কেন জানি ঠিকই ধরে ফেললো ওনাকে। তবুও চুপ করেই শুনে গেলাম ওনার কথাগুলো। উনি একটু থেমে আবারও বললেন,
“তুই আমাকে কখনো ছেড়ে যাস না রুপু, কখনো ছেড়ে যাস না। দাদুভাইয়ের মতো আমাকে একা ফেলে কখনো যাস না যেন।”

“বুড়ো বর কে কথা দিয়েছি না? তাহলে আপনাকে ছেড়ে যাবো কেন আমি? কোথায় যাবো আপনাকে ছেড়ে? আমাদের না বিয়ে হয়েছে, বিয়ের পর তো একসাথেই তো থাকতে হয়। তাহলে আমিও তো আপনার সাথেই থাকবো।”

সময় না নিয়েই চটপট বলে গেলাম। ওনার এই ভেঙে পড়াটা আমার ঠিক সহ্য হলো না। সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেও তখনই মনে মনে ভেবে নিলাম, এই মানুষটাকে কখনোই ছেড়ে যাবো না আমি। আম্মু, বড়মা, ফুপিদের মতো করেই সারাজীবন ওনার পাশে থাকবো। দাদুর শেষ কথাটা মনে প্রাণে রাখার চেষ্টা করবো।

কিন্তু ভাগ্যটা হয়তো ঠিক বিপরীত কিছুই ভেবে রেখেছিলো। পরের দিন বিকেলেই জানতে পারি তাসফি ভাইয়া স্কলারশিপে পারি দিবেন বিদেশের মাটিতে। সেদিন বিকেল থেকে ওনার যাওয়ার দিন পর্যন্ত ওনার সাথে কোন কথা বলার সুযোগ পাই নি। যেটুকুও পেয়েছিলাম কিয়ানা নামক মানুষটার জন্য সেটাও হারিয়ে গেছিলো। কিয়ানা নামক মানুষটার সাথে চলে যান দূর দেশে। আমি আমার কথা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও তাসফি ভাই আমার কথা রাখতে দেন নি।
তারপর হাতে গোনা ছয় মাস ওনার থেকে একটাই কথা জানতে চেয়েছি, কেন চলে গেলেন? কেন কোন উত্তর পাই নি ওনার থেকে।

বর্তমান…..
.
হঠাৎই শরীরের ঝাঁকুনিতে ঘুমটা ভেঙে গেল যেন। ভার ভার মাথা নিয়ে মিটমিট করে চোখ খোলার চেষ্টা করলাম। চোখ খুলো তাসফি ভাইয়ের চিন্তিত মুখটা নজরে এলো। ওনাকে দেখে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণে, মাথায় ঘুরতে লাগলো একটাই কথা। দূর্বল হাতে ওনাকে শক্ত করে ধরার বৃথা চেষ্টা করে অস্পষ্ট সুরে আস্তে করে বললাম,

“সেদিন আমাকে রেখে কেন চলে গিয়েছিলেন তাসফি ভাইয়া? কেন কিয়ানা আপুর সাথে চলে গিয়েছিলেন আমাকে ফেলে। বুড়ো বরকে দেওয়া কথা কেন রাখতে দিলেন না আমাকে? কেন আমার মনে সদ্য জন্ম নেওয়া ভালোবাসা ফেলে চলে গেলেন?”

.
.
চলবে……