তুমি বললে আজ পর্ব-২৪+২৫

0
558

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২৪.

.
দূরত্ব যদি মানুষের আবেগ ভুলে যেতে সাহায্য করে, তাহলে আমি কেন পারি নি? কিশোরী বয়সের সদ্য জন্ম নেওয়া ভালোবাসা নামক আবেগকে কেন ভুলে থাকতে পারি নি। সময় ও বয়সের সাথে সাথে অনুভূতি গুলো কেনই বা এতটা প্রখরতা হয়ে উঠলো। ওনার সাথে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি বলেই কি? একে অপরের সাথে গভীরভাবে জুড়ে গেছি বলেই কি ওনার প্রতি আমার অবাধ্য অনুভূতি গুলো উপচে বেরিয়ে এসেছে?
তাসফি ভাই দু’ গালে আলতো করে হাত রেখে ডেকে যাচ্ছেন আমায়, ওনার কণ্ঠ ভেসে আসতেই বন্ধ চোখ দুটো আবারও খোলার চেষ্টা করে গেলাম। মিটমিট করে চোখ দুটো খুলে ভেসে উঠলো ওনার মুখ। ভালোভাবে দেখতেই খেয়াল করলাম অনেকটা অস্বাভাবিক লাগছে ওনাকে দেখতে। উঠে বসার চেষ্টা করলে বাঁধা দিলেন উনি, শুয়ে থাকতে বললেন। ওনার হাত জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে আস্তে করে বললাম,
“কি হয়েছে? এমন লাগছে কেন আপনাকে?”

আমার কথার কোন জবাব দিলেন না উনি। বললেন,
“তুমি ঠিক আছো তো রুপু? কেমন লাগছে এখন, খুব বেশিই খারাপ লাগছে কি?”

“উহুম! ঠিক আছি তো আমি।”

“তোমার এই ‘আমি ঠিক আছি’ কথাটা বিশ্বাস হয় না আমার, একদম বিশ্বাস হয় না। যখনি বলো ‘আমি ঠিক আছি’ তখনই তুমি অসুস্থ হয়ে যাও। একটু আগেও বলেছিলে ঠিক আছো, তাহলে এতটা অসুস্থ হয়ে গেলে কেন?”

একটু থেমে জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিলেন। কিছুটা সময় নিয়ে আবারও বললেন,
“ইস্! আমারই উচিত হয় নি তোমাকে নিয়ে আসাটা। সাগর রাহাতদের কথায় কেন যে রাজি হলাম? আমার জন্য এতটা অসুস্থ হতে হতো না তোমায়।”

ওনার দিকে তাকিয়ে পরিমাপ করার প্রয়াস চালিয়ে গেলাম ওনার চিন্তিত হবার। কিন্তু ঠিক ধরতে পারলাম না, শুধু বুঝতে পারলাম আমাকে নিয়ে ওনার উদ্বিগ্নতা। কেন জানি অকারণেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। ওনার দিকে তাকিয়ে হালকা হেঁসে উঠলাম, কিছুটা অবাক চোখে তাকালেন তাসফি ভাই। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে দু’ হাত বাড়িয়ে ওনার গলা জড়িয়ে নিলাম, গলার ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। একটু সময় নিয়ে বললাম,
“আপনি আমার সাথে আছেন তো, কি হবে আমার? আপনি আমার পাশে থাকলে কোন ক্ষতিই আমাকে ছুতে পারবে না।”

“দিবো না আমি। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন তোমার কিছু হতে দিবো না। আমি যখন থাকবো না, তখন শুধু নিজেকে প্রটেক্ট করে নিও। আগলে রেখ নিজেকে।”

“কি বলছেন এসব? কি হবে আপনার? পারবো না আমি নিজেকে প্রটেক্ট করতে, নিজেকে আগলে রাখতে পারবো না আপনি ছাড়া। আপনাকেই আমাকে সামলাতে হবে।

“কেন? সারাজীবন তো আর বেঁচে থাকবো না আমি, কোন এক সময় তো দাদুভাই আর নানু মনির মতো তোমাকে ছেড়ে যেতেই হবে। হয়তোবা খুব তারাতাড়িই হবে, তখন তো সামলাতে হবে নিজেকে।”

“না… এসব কথা আর বললেন না আপনি, একদম বলবেন না।”

ধমকের সুরে কথাটা বলতেই হেঁসে উঠলেন উনি। দু’ হাতে নিজেও জড়িয়ে নিয়ে বললেন,
“ইস্! বউটা যে আমাকে এতটা চোখে হারাচ্ছে, সেটা তো জানতামই না। সাথে ভালোবাসতেও শুরু করেছে দেখি।”

“মোটেও না। কে বলেছে, আপনাকে আমি চোখে হারাচ্ছি? আর ভালোবাসা…. সেরা তে একদমই না।”

“ওও… তাই না? তাইলে আমাকে হারানোর এতটা ভয় কেন তোমার?”

ওনার কথার কোন জবাব না দিয়ে নিরুত্তর হয়েই রইলাম। কি জবাব দিবো ওনার কথার? আমি তো নিজেই জানি না ওনাকে ভালোবাসি কি না, কিন্তু হারাতে চাই না ওনাকে। আরও একবার হারাতে চাই না ওনাকে।
হঠাৎ কিছু একটা মাথয় আসতেই তড়িৎ গতিতে তাসফি ভাইয়ের থেকে সরে আসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওনার শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে আঁটকে থাকার ফলে বৃথা গেল আমার চেষ্টাটা। ওনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতেই ধমকে উঠলেন উনি।

“অসুস্থ শরীর নিয়েও পেঙ্গুইনের মতো লাফালাফি না করলে হচ্ছে না?”

“ছ্..ছাড়েন প্লিজ, সরে যান না একটু।”

আমার কথা কানেই নিলেন না উনি। কথাটা না শোনার ভান করে চুপ করে রইলেন। লজ্জা আর অস্বস্তিতে কিছুই বলতে পারছি না ঠিকভাবে। যখন বুঝতে পেরেছি একই চাদরের আড়ালে লেপ্টে রয়েছি ওনার সাথে, ঠিক তখন থেকেই একরাশ লজ্জা আর অস্বস্তিতে ঘিরে রেখেছে আমায়। ওনার এতটা কাছে, এভাবে একই বিছানায়, একই চাদরের নিচে কখনোই আসা হয় নি আমার। এতটা গভীরভাবে ছোঁয়া কখনোই পাই নি। কেমন জানি অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ঘিরে ধরলো আমায়, সাথে বুকের টিপটিপ শব্দের প্রতিধ্বনি।
মাথা সরিয়ে আবারও ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। ওনার এতটা কাছে থাকা দায় হয়ে উঠেছে যেন। এবার উনিও মাথা তুলে তাকালেন আমার দিকে। কপাল কুঁচকে ভুরু উচিয়ে বললেন,
“কি…. একটু শান্ত হয়ে চুপ করে থাকা যায় না?”

“প্লিজ ছাড়েন। কেমন জানি লাগছে আমার, অস্বস্তি হচ্ছে অনেক।”

“কেমন লাগছে? হুম!”

“জানি না আমি, বোঝাতে পারবো না আপনাকে। সরে যান একটু।”

প্রতিত্তোরে কিছু না বলে হাসলেন উনি। গালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বললেন,
“কিন্তু এখন থেকে তো এভাবেই আমাকে তোমার অভ্যাস করে নিতে হবে বউ। আর কিছুদিন পর এভাবেই প্রতিটা রাত কা*টাতে হবে আমার সাথে।”

.
অন্ধকার রুমে হারিকেনের মৃদু হলদেটে আলোতে আবছায়া আলোয় পরিণত হয়ে আছে রুমটা। মাটির ঘুর বাইরে তুমুল ঝড় বৃষ্টির আভাস পরিপূর্ণ ভাবেই বোঝা যাচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা টিনের চালায় তাদের নিজ গতিতে প্রতিধ্বনি তুলছে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সাথে বাজ পড়ার তীব্র শব্দ। হুট করেই ঝড়বৃষ্টির তান্ডবটা প্রখর হয়ে উঠেছে। রাত ঠিক কতটা, জানা নেই আমার। ঘুমহীন চোখে তাসফি ভাইয়া কে জড়িয়ে আছি তখন থেকে। বিদ্যুৎ চকমকানোর তীব্র শব্দে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার সাহসটা আর হয় নি। সেই সাথে শরীরের মৃদু কম্পনে, ওনার শরীরের একটুখানি উষ্ণতা পাওয়ায় আর ছাড়িয়ে নিয়ে ইচ্ছে হয় নি।

হঠাৎই তাসফি ভাইয়ের কাছ থেকে আজ জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, কেন সেদিন হুট করে চলে গিয়েছিলেন উনি। কেন আমার থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। খুব করে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে আজকে। উনি যে ঘুমান নি সেটা বুঝতে পেরে ডেকে উঠলাম ওনাকে। ওনার কোন সারা না পেয়ে আবারও ডাকলাম। উনি আস্তে করে হুম বলতেই আমি বললাম,
“একটা কথা বলবেন?”

“হুম….”

“চার বছর আগে কি এমন হয়েছিলো? হুট করে কেনই বা চলে গিয়েছিলেন আমেরিকায়?”

মাথা তুলে তাকালেন উনি। হারিকেনের মৃদু আলোয় খুব ভালোভাবেই ওনার মুখটা নজরে এলো আমার। বললেন,
“হঠাৎ এই কথা?”

“জানি না। হঠাৎ কেন জানি জানতে ইচ্ছে হলো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

“এসব কথা আজকে থাক রুপু, পরে একসময় নললো। মন ভালো আছে, খারাপ করতে চাইছি না।”

ওনার শক্ত গলায় বলা কথাটা ঠিক পছন্দ হলো না আমার। জানার জন্য জেদ চেপে গেল যেন। কিছুটা জেদ করেই বললাম,
“না… আমি এখুনি জানতে চাই। কেন চলে গিয়েছিলেন হঠাৎ? কি হয়েছিলো আপনার?”

“বললাম না পরে বলবো, এখন মুড খারাপ করতে চাইছি না। চুপচাপ ঘুমানোর চেষ্টা কর।”

“কোন ঘুমানোর চেষ্টা করবো না আমি। আপনাকে বলতেই হবে, কেন সেদিন আপ….”

কথাটা শেষ করার আগেই মুখটা বন্ধ হয়ে গেল আমার, চোখ দুটো বড় বড় আকৃতির ধারণ করলো হঠাৎ নিজের ঠোঁটে ওনার ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে। এক মুহুর্তের জন্য যেন নিজের স্তম্ভিত হারিয়ে ফেলেছি আমি, স্তব্ধ হয়ে মস্তিষ্কে ধারণ করার চেষ্টা করে চলেছি ঠিক কি হচ্ছে আমার সাথে। ব্যাপারটা যতক্ষণে বুঝতে পারলাম ততক্ষণে আমার ঠোঁট দু’টো ছেড়ে দিয়েছেন নিজের ঠোঁটের বাঁধন থেকে। হালকা হেঁসে উঠে বললেন,
“এভাবে কথা বললে কিন্তু আমার-ই লাভ রুপু, তোমার এই ফালতু কথাগুলো বন্ধ করার উছিলায় চুমু তো খেতে পারবো।”

“ছি! অ*সভ্য লোক একটা। কি করলেন এরা আপনি?”

“কেন? কি করেছি বুঝতে পারছো না?”

“না… পারছি না। দেখি ছাড়েন আমায়, অ*সভ্য বজ্জাত লোক একটা।”

“তাহলে মুখে নয়, বরং ঠোঁট দিয়েই দেখিয়ে দেই কি করেছি।”

বলেই একটু থামলেন উনি। হাত দিয়ে আলতো করে আমার ঠোঁটে স্পর্শ করলেন। কিছুটা কেঁপে উঠলাম। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন,

“তুমি বললে আজ শুধু চুমু নয়, অনেক কিছুই হতে পারে রুপু। ইউ নো হোয়াট, আমার কিন্তু সেই অধিকারটা আছে।”

কথাটা বলে একটুও সময় ব্যায় করলেন না। গভীরভাবে ছুঁয়ে দিলেন ওনার শুষ্ক ঠোঁট দু’টো আমার ঠোঁটের ভাঁজে। আবারও কেঁপে উঠলাম আমি। হাত দু’ টো সহসায় চলে গেল ওনার ঘারে। খারাপ নয়, কেন জানি ভালো লাগার অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। চোখ দু’টো বন্ধ করে অনুভব করে গেলাম ওনার স্পর্শগুলো। কিছুটা সময় নিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলেন, মাথা তুলে সরে যেতেই চোখ খুলে তাকালাম ফট করে। ওনার হঠাৎ ছাড়িয়ে নেওয়াটা যেন ঠিক মেনে নিতে পারলাম না আমি। সময় না নিয়ে মাথা উঠিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম ওনার ঠোঁটের স্পর্শ পেতে। উনি চট করে আমার দিকে চোখ দু’টো নিবদ্ধ করতেই থমকে গেলাম আমি। স্তম্ভিত ফিরে পেলাম নিজের। সাথে সাথে ছিটকে সরে এসে বালিশে মাথা দিয়ে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলাম। ইস্! কি করতে গিয়েছিলাম আমি এটা, কিভাবেই বা এমনটা করলাম? উফ্! ওনার দিকে তাকাবো কিভাবে আমি? থাকবো কিভাবে আমি ওনার সামনে?

“রুপু…..”

ওনার ঘোর লাগা কণ্ঠে কেঁপে উঠলাম আমি। ওনার ডাকে৷ সারা দেবার সাহস নেই আমার, আর না আছে ওনার দিকে তাকানোর সাহসটা। একটু সময় নিয়ে আবারও ডেকে উঠলেন উনি। বললেন,
“রুপু…. এই রুপুসোনা, তাকাও আমার দিকে। এ্যাই মেয়ে…. ”

ওনার আবেগী মাখা কণ্ঠস্বরে কেন জানি ফেরাতে পারলাম না ওনাকে। মনে অনেকটা সাহস নিয়ে টিপটিপ করে চোখ খুলে তাকালাম। আস্তে করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
“স…সরি! আর হবে না, আসলে তখন হঠাৎ….”

“আমাকে পাগল বানিয়ে, আর হবে না কেন বলছো বউ? আমি তো সামলাতে পারছি না নিজেকে। তোমার এই ছোট্ট পাগলামিতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি।”

ওনার এই ঘোর লাগা কণ্ঠে ধরে রাখতে পারলাম না নিজেকে। ঈষৎ কেঁপে উঠে অজান্তেই দু’ হাতে খামচে ধরলাম ওনার ঘারে। প্রথম পুরুষের প্রথম ছোঁয়ায় হাজারো অনুভূতিতে ঘিরে ধরলো আমায়। এতদিনের দমিয়ে রাখা সুপ্ত অনুভূতি গুলো ডানা ঝাপটিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। বুকের তীব্র টিপটিপ প্রতিধ্বনির সাথে শ্বাস প্রশ্বাসের আনাগোনাও বেড়ে যেতে লাগলো। তখনই ভেসে আসলো ওনার কণ্ঠস্বর।

“রুপু…. এ্যাই রুপুসোনা!”

“হুম….”

“তুমি বললে আজ আমার এতদিনের যত্ন করা ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসার চাদরে তোমায় মুড়িয়ে নিতে পারি, তোমার সবকিছু নিজের করে পেতে পারি, আমার এত দিনের যত্নে গড়া জিনিস গুলো একান্তই আমার করে নিতে পারি।”
.
.
চলবে…..

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২৫.

.
ঘুমটা গভীর না হতেই তন্দ্রা ভাবটা কে*টে গেল, অনুভব হলো নিজের শরীরের উপর করোর অস্তিত্ব। সেই কেউটা যে কে, সেটা না বোঝার কোন কারণ নেই। পুরো শরীরের ভার আমার উপর ছেড়ে দিয়ে গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে আছেন মি. বজ্জাত তাসফি। থেকে থেকে ভারী নিশ্বাস ফেলছেন, যেটা আমার গলায় আছড়ে পড়ছে। শিরশির করছে পুরো শরীর, তাতে বার কয়েক কেঁপেও উঠলো পুরো শরীর।
ঘুমের ঘোরেই হোক বা জেনে শুনে, পুরো শরীর কেঁপে উঠতেই হুট করেই দু’ হাতে আগের চেয়েও গভীর ভাবে চেপে ধরলেন নিজের সাথে। ব্যাথায় কাতর হওয়া শরীরের সর্বাঙ্গ চিনচিনে ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলাম যেন। অস্পষ্ট সুরে অজান্তেই ‘আহ্!’ করে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো মুখ ফুটে, চোখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পরলো অশ্রুধারা। এবার মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন তাসফি ভাই। একহাতে আমাকে ছেড়ে দিয়ে গালে হাত রাখলেন। ঘুম ঘুম ভারী গলায় বললেন,
“কি হয়েছে রুপু? শরীর খারাপ লাগছে?”

মাথা ঝাকালাম ওনার কথার জবাবে, বোঝালাম না। ব্যাথায় কাতর হওয়া শরীরে কোন কথায় যেন বেরুলো না মুখ ফুটে, শুধু বেরিয়ে আসলো চোখের জলগুলো। ওনার হয়তো এবার খেয়াল হলো আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলের দিকে। হাত দিয়ে মুছে কপালে গালে হাত দিলেন বললেন,
“রুপুসোনা, কি হয়েছে? শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? জ্বরও খুব একটা নেই। বলছিস না কেন?”

“ব্য্… ব্যাথা… প্লিজ সরে যান।”

এবার হয়তো বুঝতে পারলেন উনি। বিছানায় নেমে গিয়ে দু’ হাতে আগলে নিলেন। কপালে আলতে করে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বললেন,
“সরি রুপু! খুব বেশি ব্যাথা হচ্ছে কি?”

“উহুম!”
.
নীরবতায় কে*টে গেল বেশ কিছু সময়, ফজরের আজানের প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারদিকে, দূর দূর থেকে ভেসে আসছে। আজানের ধ্বনি থেমে যেতেই শান্ত হয়ে গেল চারপাশটা। রাতের ঝড় বৃষ্টির তান্ডবের পর শুনশান নীরবতায় ছেয়ে গেছে পরিবেশটা, শীতল ঠান্ডা ভাবটা রয়েই গেছে।
একটু সময় নিয়ে ডেকে উঠলাম ওনাকে। সাথে সাথে ধমকে উঠলেন উনি। অবাক হলাম কিছুটা। বুঝতে পারলাম না ওনার হঠাৎ ধমকে ওঠার কারণ। অনেকটা কৌতুহল নিয়ে বললাম,
“কি হয়েছে? এভাবে ধমকাচ্ছেন কেন?”

“আজকের পর থেকে এই ফালতু ওয়ার্ডটা ভুলে যাবি। একদম আর ভাই বলে ডাকবি না আমাকে।”

“মানে?”

অবাক হলাম আমি। হঠাৎ ভাইয়া ডাকতে বারণ করার মানে বুঝতে পারলাম না। আবারও হালকা ধমকে উঠলেন উনি। বললেন,
“মানেটা তোর এই মস্তিষ্ক বিহীন মোটা মাথায় ঢুকবে না। একবার যখন বলছি ডাকবি না, তখন আজকের পর আর ডাকবি না।”

“আচ্ছা… আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার ছাড়েন আমায় উঠবো আমি, ফ্রেশ হতে হবে।”

“এই জ্বর জ্বর শরীর নিয়ে এত সকালে ফ্রেশ হবি মানে? ঠান্ডা লাগবে তো, আবারও জ্বর আসবে।”

“উফ্! ছাড়েন তো আপনি, কি সব পাগলের মতো কথা বলছেন? ফ্রেশ না হয়ে এভাবে থাকবো আমি?”

চুপ হয়ে গেলেন উনি, হয়তো নিজের বোকামিটা বুঝতে পারলেন। কিছুটা সময় নিয়ে উঠে পরলেন আমাকে ছেড়ে। মোবাইলে সময়টা দেখে নিয়ে খাট থেকে দাঁড়ালেন। বললেন,
“এখানেই থাক, আমি চাচীর থেকে জেনে আসছি বাথরুমটা কোথায়?”

“আন্টির থেকে জেনে আসবেন মানে? কিছু বলতে হবে না, কি মনে করবেন উনি?”

“কি মনে করবে মানে? জেনে না নিলে যাবি কিভাবে? বেয়াদব! চুপচাপ থাক এখানে।”

আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলেন না উনি, দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন রুম ছেড়ে। এতক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছি আমি। চাদর টেনে শরীরটা আবৃত করে বিছানা ছেড়ে নামার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই বাইরের আলো জ্বলে উঠলো। এতক্ষণে হয়তো বিদ্যুৎ চলে আসলো অথবা বাইরের আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছেন আন্টি। একটু পরেই ভেসে আসলো তাসফি ভাইয়ের গলা। জানতে চাইলেন বাথরুমটা কোথায়? আন্টিও হয়তো দেখিয়ে দিলেন ওনাকে, সাথে জিজ্ঞেস করলেন এই ভোর রাতে ফ্রেশ হতে হবে কেন? ওনাদের কথায় লজ্জায় যেন আমার মাথা কা*টা যেতে লাগলো আমার। ইস্! এই বজ্জাত লোকটার না জিজ্ঞেস করলেই কি হতো না। এভাবে ডেকে বলার কি ছিলো।
মনে মনে বজ্জাত লোকটাকে হাজারো গালি দিতে দিতে নামতে নিলাম বিছানা ছেড়ে। মাটিতে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেই শরীরের সর্বাঙ্গ চিনচিনে ব্যাথায় ব্যাথিত হলো। ‘আহ্!’ করে বেরিয়ে এলো মৃদু আর্তনাদ। তবুও ওঠার চেষ্টা করলাম। একধাপ পা বাড়াতেই হুট করে এসে কোলে তুলে নিলেন তাসফি ভাই। অবাক হলাম কিছুটা। বললাম,
“কি করছেন? নামান আমায়, যেতে পারবো তো।”

“সেটা তো দেখতেই পারছি। এক পা ও যে যেতে পারবি না সেটাও জানি।”

“প্লিজ! নামান আমাকে, বাইরে আন্টি আঙ্কেল দেখলে কি মনে করবেন?”

“কেউ কিছু মনে করবে না। আঙ্কেল নামাজে গেছেন, আন্টিও নামাজ পড়বেন রুম বেরুবে বলে মনে হয় না।”

আবারও বাঁধা দিতেই ধমকে উঠলেন উনি, আমার কথার পাত্তা না দিয়ে সোজা রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। বাথরুমে এনে নামিয়ে দিতেই চলে যেতে বললাম ওনাকে। সাথে সাথে অদ্ভুত চোখের ধারণ করে তাকালেন আমার দিকে। ধমকের সুরে বললেন,
“একধাপ পা তুলে হাঁটতে পারছিস না, অথচ চাপ কলে পানি তুলে গোছল করবি? আর এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।”

“পারবো তো আমি, যান না আপনি। প্লিজ!”

“চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক এখানে। একদম লাফালাফি করবি না।”

আমাকে ধমকে ধামকে চুপ করিয়ে দিলেন উনি। উপায় না পেয়ে হাজারো লজ্জা আর অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপ করে।

.
ঘরের এক জায়গায় মেলে দেওয়া নিজের ভেজা জামাকাপড় গুলো না শুকানোর ফলে, আন্টির দেওয়া শাড়িটাই গায়ে জড়িয়ে নিলাম। কাঁপতে কাঁপতে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই তাসফি ভাইয়া ঘরে ঢুকলেন। আমার দিকে একবার তাকিয়ে দরজাটা ভিরিয়ে দিলেন, এগিয়ে এলেন আমার কাছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হুট করে কোলে তুলে নিয়ে খাটে বসিয়ে দিলেন। ফ্যালফ্যাল করে ওনার দিকে তাকালাম, কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই হাতের গামছাটা দিয়ে আমার চুলগুলো মুছে দিতে লাগলেন। বললেন,
“কাঁপা কাপি করছিস, অথচ চুলগুলো থেকে টপটপ করে পানি পরছে সে খেয়াল নেই। আবারও ঠান্ডা লাগাবি?”

“আমাকে দেন, আমি করছি।”

“আর কিছু করতে হবে না আপনার, অনেক করেছেন।”

“ইফ্! এমন করছেন যেন, মনে হচ্ছে কঠিন রোগে রোগাক্রান্ত হয়েছি। হাত পা সব কিছু পঙ্গু হয়ে গেছে। আর আমার সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন আপনি, হু!”

“আমার হাত পা পঙ্গু হলে আপনিও এভাবেই আমার সেবায় নিয়োজিত হয়েন ম্যাডাম।”

“বলছি না, এমন আজেবাজে কথা একদম বলবেন না। আবারও শুরু করছেন?”

কিছুটা ধমকের সুরে কথাটা বলতেই হালকা হেঁসে উঠলেন তাসফি ভাই। কপাল কুঁচকে ওনার দিকে তাকাতেই উনি বললেন,
“আচ্ছা…. আচ্ছা ঠিক আছে, আর বলবো না। আর ঠান্ডা লাগাতে না চাইলে, এবার চুপচাপ কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পর।”

“আর আপনি?”

“রুপু! সারারাত আমাকে জাপটে ধরে বুকে মুখ গুঁজে থেকেও তোর শখ মিটে নি? আবারও কাছে চাইছিস? এক রাতেই ভারী নি*র্লজ্জ হয়ে গেছিস দেখি।”

উনি অবাক হবার ভান করে কথাটা বলতেই চোখ দুটো বড় বড় আকৃতির ধারণ করলো আমার। উফ্! এই বজ্জাত লোকটা এমন কেন? ওনার অ*সভ্য মার্কা কথাবার্তা কি কখনোই শেষ হবে না? আমি কিছু বলার আগেই উনি আমার দিকে একটু ঝুঁকে এলেন। বললেন,
“আমার কিন্তু সমস্যা নেই রুপু। সারারাত কেন, সারাজীবন এই বুকে তোমাকে আগলে রাখতে পারবো।”

চোখ তুলে তাকালাম ওনার দিকে। আমাকে তাকাতে দেখে উনি আবারও বললেন,
“কি? পারবে তো, এই বুকে মাথা রেখে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার সাথে পারি দিতে?”

“হুম! আপনি সাথে থাকলে সবকিছুই পারবো।”

চট করে ওনার বুকে মাথা রাখলাম, দু’ হাতে আগলে নিয়ে বলে উঠলাম। আমার কথায় হাসলেন উনি, জড়িয়ে নিলেন আলতো ভাবে। কিছুটা সময় যেতেই ওনাকে করা রাতের প্রশ্নটা আবারও মাথায় এলো আমার। সময় না নিয়েই বললাম,
“এখনো বলবেন না? চার বছর আগে আমাকে ফেলে হুট করে কেনই বা চলে গিয়েছিলেন?”

সহসায় কিছু বললেন না উনি। কিছুটা সময় নিয়ে বললেন,
“আগেও জানতে চাস নি কথাটা। কাল থেকে কেন এত উদগ্রীব হয়ে উঠেছিস?”

“আগে তো আপনাকে এতাটা কাছে পাই নি, এতটা ভালোবাসা পাই নি আপনার।”

“শোনাটা কি খুব জরুরি?”

“হুম! খুব জরুরি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয় হয়, যখন ফুপি আর রিফাপু হুট করে বলে ফেলে আমার জন্যই আপনি চলে গিয়েছিলেন। জানতে চাই, কি করেছিলাম আমি? কি অপরাধ ছিলো আমার? হুট করে কেনই বা চলে গিয়েছিলেন সেদিন।

দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন উনি। বুক থেকে আমার মাথা উঠিয়ে দু’ হাতে গালে আগলে নিলেন। কপালে আলতে করে ঠোঁটের স্পর্শ ছুঁয়ে আস্তে করে বললেন,
“তোর কোন দোষ নেই রুপু, সেদিন ভুলটা হয়তো আমারই ছিলো। নিজের করা ছোট্ট ভুলে বড় মামা একটু বেশিই ভুল বুঝে গেল আমাকে, সাথে বড়সড় রকমের শাস্তি দিলো। ”

.
.
চলবে…..