#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৪১.
.
আধো অন্ধকার ঘেরায় রাত। চারদিকে শুনশান নীরবতা। মৃদু বাতাসে শিরশির করে উঠছে শরীর। এর মাঝেই কানে ভেসে আসলো কারোর কণ্ঠ। পর পর ডাকার পরেই স্পষ্ট হলো।
“রুপুসোনা!”
হ্যাঁ! ‘রুপুসোনা’ বলেই তো কেউ ডেকে উঠলো। আর এই নামে শুধুমাত্র একজনেরই ডাকার অধিকার আছে। সবচেয়ে কাছের, আমার একান্ত পুরুষটির। হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণে। আবারও ডেকে উঠতেই পিছন ফিরে তাকালাম। আশ্চর্য! অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। কিন্তু ওনার কণ্ঠ ভেসে আসলো।
“এ্যাই রুপুসোনা।”
“ত্..তাসফি কোথায় আপনি? আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন আপনাকে?”
আমার কথার কোন জবাব দিলেন না উনি। উল্টে বলে উঠলেন,
“রুপু! এ্যাই রুপুসোনা, একবার তাকা আমার দিকে, দেখ আমাকে।”
হাজারো চেষ্টা করেও অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। বিচলিত হয়ে পড়লাম মুহুর্তেই। হাত বাড়িয়ে খুঁজে গেলাম, ডাকতে লাগলাম ওনাকে। সারা পেলাম না ওনার। চিৎকার করতে গিয়েও পারলাম না। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরুলো না আমার। এবার যেন ছটফটানির মাত্রা বেড়ে গেল কিছুটা। হাত বাড়িয়ে ওনাকে খোঁজার চেষ্টা করতেই কিঞ্চিৎ ব্যাথা পেলাম হাতে, কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। হঠাৎই চোখের সামনে একফালি আলো এসে ভীর জমালো। কুঁচকে ফেললাম চোখ দুটো। মিটমিট করে চোখ খোলার চেষ্টা করে আবারও টান লাগলো হাতে। ব্যাথায় মৃদুস্বরে আত্মদান বেরিয়ে এলো মুখ ফুটে। মিটমিট করে চোখ খুলে ফেললাম। বুঝতে পারলাম না ঠিক কোথায় আছি। একটু আগেই তো তাসফি ভাইকে নিয়ে কোথাও ছিলাম, কিন্তু কোথায় ছিলাম কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। অপর হাত টেনে নেবার চেষ্টা করে সেখানেও বাঁধা পেলাম। কানে ভেসে আসলো কারোর কণ্ঠস্বর।
“এ্যাই রুপু….”
হালকা মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম সেদিকে। ভেসে উঠলো তাসফি ভাইয়ের ক্লান্তি মাখা মুখটা, লাল হয়ে যাওয়া চোখ দুটো। সেই চোখে রাগ নেই, যা আছে শুধু একরাশ ভয়। ঠিক বুঝতে পারলাম না এই ভয়টা কিসের জন্য। অনেকটা কাছে বসে আছেন উনি। আবারও নড়ে উঠতেই ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। ধরে রাখা হাতটা অধিক শক্ত করে চেপে ধরলেন, অপর হাত আমার গালে রাখলেন। আস্তে করে বললেন,
“রুপু, কেমন লাগছে এখন?”
উত্তর দিলাম না। চুপ করে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম ওনাকে। মনে হচ্ছে, ঠিক কতদিন পর ওনাকে দেখলাম। কেমন জানি বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে ওনার চোখে মুখে। আমার উত্তর না পেয়ে আরও ঝুঁকে এলেন, ঘুচিয়ে দিলেন মাঝের দূরত্ব। আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ ছুয়ে দিলেন কপালে। কেঁপে উঠলো আমার পুরো শরীর। হঠাৎ এতদিন পর ওনার এই স্পর্শ মোটেও আসা করি নি আমি। পুরো শরীর কেঁপে ওঠায় হাতে আবারও টান লাগলো, আত্মদান বেরিয়ে এলো মুখ ফুটে। সাথে সাথে কিছুটা সরে গেলেন তাসফি ভাই। বলে উঠলেন,
“অসুস্থ শরীর নিয়েও কি একটু চুপ থাকা যায় না? এত ছুটাছুটির কি আছে?”
অসুস্থ শরীর বলতেই যেন টনক নড়লো আমার। হাতের দিকে তাকাতেই দেখলাম লাল নল ঝুলছে হাতের সাথে। উপরদিকে তাকিয়ে র*ক্তের ব্যাগ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে বুঝতে পারলাম র*ক্ত চলছে। এর মাঝেই কানে আসলো সাদিক ভাইয়ার কণ্ঠ। বলে উঠলো,
“অবশেষে জ্ঞান ফিরলো আমার শালিকার?”
মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম সাদিক ভাইয়ার দিকে। চারদিকে ভালোভাবে নজর বুলিয়ে বুঝতে পারলাম হাসপাতালের বের্ডে শুয়ে আছি। মনে পড়লো তাসফি ভাইয়ের সাথে রাগারাগি করে হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে, চোখের সামনে অন্ধকার নেমে নিচে পড়ে যাওয়াটা। তারপর এখানে। কিন্তু কখন, কিভাবে এখানে আনা হলো? কতটা সময় নিয়েই বা এখানে আছি? তার কোন কিছুই জানা নেই আমার।
সাদিক ভাইয়ার আগমনে কিছুটা সরে গেলেও একই ভাবে হাতটা ধরে রাখলেন উনি। সাদিক ভাইয়া বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দেখলেন আমাকে। তারপর বলে উঠলো,
“কালকে তো সেই লেভেলের ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে শালিকা। এভাবে কি কেউ ভয় পাইয়ে দেয়, বলো?”
তেমন বুঝতে পারলাম না সাদিক ভাইয়ার কথা। হয়তো হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছি বলে, কিন্তু এতটাও তো অসুস্থ হই নি। তাহলে? চুপ করে দেখতে লাগলাম তাদের কর্মকাণ্ড। ভীষণ ভাবে দূর্বল লাগছে শরীর, সাথে পুরো শরীর কিঞ্চিৎ ব্যাথা। সাদিক ভাইয়া অপর পাশে এসে দাঁড়াতেই সাথে নার্সটা কিছু একটা এগিয়ে দিলো। হাতে নিয়ে তাসফি ভাইয়ের দিকে তাকালেন। বলে উঠলো,
“এবার তো ওকে একটু ছাড় তাসফি, পেশারটা একটু দেখতে দে। এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকবি?”
আমার দিকে একবার তাকিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকালেন উনি। একই ভাবে বসে থাকতে দেখে আবারও ওনাকে উঠতে বললো সাদিক ভাইয়া। এবার উঠে দাঁড়াতেই পেশার চেক করলো সাদিক ভাইয়া। কিছুটা হতাশ হলো হয়তো। তাসফি ভাই জানতে চাইলেন আমার অবস্থা। হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে সাদিক ভাইয়া বলে উঠলো,
“নতুন করে আর কি বলবো তাসফি, এখন কিছুটা উন্নত হলেও খুব একটা না। র*ক্ত দুই ব্যাগ যাক, তারপর বলতে পারবো। এই সময়টা শরীররে ব্লাড না থাকাটা ওর আর বাচ্চার দুজনের জন্যই মারাত্মক ক্ষতির।”
বলেই একটু থামলো ভাইয়া। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললো,
“ড. নফসী তো এক সপ্তাহের সময় দিয়েছিলো, তবে এক দিনেই শরীরে ব্লাড হঠাৎ কমে গেল কেন? তুই ওর খেয়াল রাখতে পারিস নি তাসফি? অন্তত খাওয়া দাওয়ার প্রতি একটু নজর রাখতি।”
“সে কি আমার কথা শুনে? যখন যেটা ইচ্ছে হয় তখন সেটাই করে চলে। মাঝ রাতে দুনিয়ার আজেবাজে জিনিস খেতে ইচ্ছে হয় তার। অসুস্থ হয়ে পরে, আর আমার….”
রাগী গলায় কথাগুলো বলে আমার দিকে তাকালেন উনি। সাদিক ভাইয়া বললেন,
“এই সময়টা একটু খেয়াল রাখার চেষ্টা কর। এমনিতেই ওর বয়সটা কম, খাওয়া দাওয়া ও ঠিক ভাবে করে না, এখন শরীরে ব্লাড নাই। ডেলিভারির সময়টার কথা ভেবেই আমার ভয় লাগছে। আপাতত ব্লাড যাক, পরের সপ্তাহে আরও দু’ ব্যাগ র*ক্তের ব্যাবস্থা করতে হবে।”
আরও নানান কথা বলতে লাগলো আমাকে নিয়ে, আমি নীরব শ্রোতার মতে শুনে গেলাম শুধু। এর মাঝেই ফুপি আসলো কেবিনে। এসেই আদুরে মাখা বকাঝকা শুরু করে দিলো। ফুপির আদুরে মাখা বকা শুনেই বুঝতে পারলাম ঠিক কতটা টেনশনে ছিলো সবাই। এটাও জানতে পারলাম গত রাত থেকে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে ছন্নছাড়া হয়ে আমার কাছে একই ভাবে রয়ে গেছেন তাসফি ভাই।
.
তিন দিন পর বাসায় আনা হয় আমাকে। হসপিটালে কাটানো এই তিন দিন নিজেকে প্রোপার রোগী বলে মনে হলেও বাসায় আসার পর কিছুটা স্বস্তি মিলছে। হঠাৎ এতটা অসুস্থ হওয়ার কারণ অতিরিক্ত টক খাওয়া। টক আচার খাওয়ার জন্যই হঠাৎ র*ক্ত কমে গেছে শরীরে। এটা জানার পর সবাই আমাকে বকাঝকা করলেও তাসফি ভাইকে একটু বেশিই বকেছে সবাই।
আমার অসুস্থ কথা শুনে আব্বু আম্মু, বড় বাবা, বড়মাও চলে এসেছে। সবাই আমার খেয়াল রাখলেও তাসফি ভাইয়ের খেয়াল রাখাটা ছিলো চোখে পড়ার মতো। ওনার এই আমার প্রতি খেয়াল রাখা দেখে খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো,
“এই যত্নটা কি আমার জন্য তাসফি? না-কি শুধুই আমাদের বাচ্চার জন্য?” পরমুহূর্তেই দমিয়ে রাখলাম নিজের ইচ্ছের কথাটা, শুধু দেখে গেলাম ওনার কার্যক্রম।
.
সবার সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে বেশ রাত হয়ে গেল। তাসফি ভাই রুমে ঢুকতেই ছোটখাটো আড্ডার আসর ভঙ্গ হলো। আমাকে ঘুমাতে বলে একে একে রুম ত্যাগ করলো আম্মু বড়মা ও ফুপি। সবাই চলে যেতেই দরজা আঁটকে দিলেন। টেবিলে রাখা ওষুধ গুলোর সাথে দুধের গ্লাস নিয়ে এগিয়ে এলেন। এগিয়ে দিয়ে বললেন খেয়ে নিতে। ওষুধ গুলো হাতে নিলেও গ্লাসটা কিছুতেই হাতে নিলাম না। দুধের গ্লাস দেখেই কেমন জানি গা গুলিয়ে উঠলো। পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিতে গেলেই এগিয়ে দিলেন উনি। ওষুধ গুলো খেয়ে শুয়ে পরার চেষ্টা করতেই উনি বলে উঠলেন,
“দুধটা খেয়ে নে, তারপর ঘুমা।”
বিরক্ত হলাম কিছুটা। আস্তে করে বললাম,
“খাবো না।”
“খাবি না মানে? খেয়ে তারপর শুয়ে পর, বারণ করবো না।”
“বললাম তো খাবো না।”
“সবসময় এতটা জেদ কিন্তু ভালো নয় রুপু, নিজের জন্য যেগুলো খারাপ হয় সেটা কেন করতে চাস?”
“জেদ দেখাচ্ছি না আমি, সুন্দর ভাবেই বলেছি আমি। খাওয়ার হলে অনেক আগেই খেতাম।”
বলেই শুয়ে পড়লাম। ওনার এই অতিরিক্ত কেয়ার করা অনেক বেশিই রাগ লাগছে আমার। এবার বেশ জোরে করে বলে উঠলেন,
“এবার সুন্দর ভাবেই খেয়ে নে। আমার প্রতি জেদ দেখিয়ে নিজের ক্ষতি কেন করছিস? শুধু নিজের কেন, সাথে বাচ্চারও ক্ষতি করে চলেছিস।”
ওনার এই কথাটায় যেন আমার রাগের মাত্রাটা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। আবারও সেই একই কথা। হ্যাঁ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার প্রতি ওনার এই সব কিছু দেখানো, সবকিছু তো শুধু মাত্র বাচ্চার জন্য। আমি মা হয়ে ওর ক্ষতি চাই, এটাই তো বারবার বোঝাতে চান উনি। উঠে বসলাম বিছানায়। ওনার থেকেও জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
“কি বোঝাতে চান আপনি? আমি মা হয়ে ওর ক্ষতি চাই? সেই প্রথম থেকে আপনার মুখে এই কথা শুনে চলেছি, বলেন আমি মা হয়ে কি ক্ষতি চাই ওর?”
“এতটা উত্তেজিত হওয়ার মতো কি বললাম আমি? শান্ত হয়ে কথা বলা যাচ্ছে না? এতো উত্তেজিত হওয়ার কি আছে? বেয়াদব!”
“কেন শান্ত হবো? বলেন আপনি, মা হয়ে কেন ক্ষতি চাইবো আমি ওর? ও আমার সন্তান, আমার মাঝে বেড়ে উঠছে, তাহলে কেন ক্ষতি চাইবো ওর?”
“বললাম না শান্ত হতে, শুনতে পারছিস না আমার কথা?”
জানি না কি হলো হঠাৎ। শান্ত হলাম না, বরং আগের চেয়ে ব্যাপক উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কিছুতেই সহ্য করতে পারলাম না ওনাকে। আগের চেয়ে অধিক চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
“না… পারছি না আপনার কথা শুনতে। বেরিয়ে যান এখান থেকে, থাকবো না আমি আপনার সাথে। আম্মু, ফুপি….”
বলেই চিৎকার করে উঠলাম। উনি গ্লাসটা রেখে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে উঠলেন,
“রুপু, শান্ত হ বলছি। শোন আমার কথা।”
“কেন শুনবো আপনার কথা? কেন হন আপনি আমার? শুধুমাত্র বাচ্চার বাবা আপনি, আমার কেউ নয়। থাকবো না আমি আপনার সাথে। আম্মু, ফুপিকে ডাক দেন, ওদের সাথে থাকবো আমি। ওরা আমায় ভালোবেসে যত্ন নিবে, আপনার করা এই দ্বায়িত্বের কোন প্রয়োজন নেই….”
কথার মাঝেই অনেকটা এগিয়ে এলেন, হঠাৎ জড়িয়ে ধরলেন আমায়। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে উঠলেন,
“ভালোবাসি! অনেক বেশিই ভালোবাসি জান। তোমার প্রতি আমার দ্বায়িত্ব নয়, ভালোবাসাটায় সবার আগে।”
কথাটা কানে আসলেও কেন জানি বিশ্বাস করতে পারলাম না। এই মুহুর্তে ওনার বলা কথাটা মিথ্যে বলেই মনে হলো। ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম ওনাকে। বলে উঠলাম,
“ছাড়েন আমাকে, বিশ্বাস করি না আমি আপনার কথা। আপনার সবটাই শুধুমাত্র বাচ্চার জন্য, আমার জন্য জাস্ট দেখানো।”
“কে বলেছে তোমাকে? সবটা কি শুধু বাচ্চার জন্য? না-কি বাচ্চার মায়ের….”
“জানি আমি, আপনার অবহেলা তেই আমি বুঝে যাই। এত এত অবহেলা নিয়ে থাকবো না আমি আমি আপনার সাথে। চলে যাবো এখান থেকে, অনেক দূরে চলে যাবো। আপনাকে মুক্তি দিয়ে চলে যাবো আমি।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেই আগের চেয়ে অধিক শক্ত করে জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে। একটু ছাড় পেলেই হয়তো হারিয়ে যাবো। বললেন,
“তোমাকে অবহেলা করার সাধ্য আমার নেই রুপু। আমার রুপুসোনা কে অবহেলা নয়, শুধুই ভালোবাসা যায়। যে ভালোবাসার কোন সীমা নেই, সীমাহীন আকাশর মতোই শুধু ভালোবাসা যায় আমার রুপু কে।”
.
.
চলবে…..
#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৪২.
.
একটা রাতের ব্যাবধানেই ব্যাপক পরিবর্তন উপলব্ধি করলাম নিজের মধ্যে। বারংবার মনের কোণে উঁকি দিতো তাসফি ভাইয়ের কেয়ার, ভালোবাসা সবটাই শুধুমাত্র বাচ্চার জন্য, আমার জন্য জাস্ট দেখানো, সবকিছু সাজানো। ওনার হঠাৎ জড়িয়ে ধরায়, ওনার আদুরে মাখা কথাগুলোই রাতে ঠিকই শান্ত হয়েছিলাম। কিছু সকাল হওয়ার পর থেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না নিজেকে। ওনাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। মাথায় শুধু একটা কথায় গেঁথে গেছে যেন, চলে যেতে হবে আমাকে। ওনার থেকে নিজেকে মুক্তি করে বহু দূর চলে যেতে হবে। ওনার এই ভালোবাসা বিহীন দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি করে নিতে চাই নিজেকে।
শরীরে র*ক্ত না থাকায় প্রোপার বের্ড রেস্টে দিয়েছে ডাক্তার। আর এই বের্ড রেস্টে নিজেকে বন্দী দশায় মনে হচ্ছে। খাওয়া দাওয়ার সবটার পরিচালনায় করছে আম্মু, ফুপি ও বড়মা মিলে। ভার্সিটি থেকে কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে তাসফি ভাইও পুরোটা সময় আমাকে দিচ্ছেন। যদিও এখন আর ওনার এই কেয়ার করাটা আমার কিছু যায় আসে না। সবটাই কেমন জানি ধোঁয়াশায় ঘেরা বলে মনে হয়।
রুমে কাউকে না পেয়ে উঠে বসলাম বিছানা ছেড়ে। ফ্লোরে পা ফেলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই সামনে এসে কেউ দাঁড়ালো। পা থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত দেখেই বুঝতে পারলাম মানুষটা ঠিক কে হতে পারে। বিরক্ত হলাম কিছুটা। উঠে দাঁড়াতেই আমার হাত ধরে ফেললেন তাসফি ভাই। বললেন,
“কোথায় যাবি? উঠছিস কেন?”
ওনার কথায় বিরক্তির মাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেল। জবাব না দিয়ে সরে যারার চেষ্টা করলাম। এবার দু’হাতে ধরে ফেললেন আমায়। বললেন,
“কি হলো? বলতে পারছিস না, কোথায় যাবি?”
“আপনাকে কেন বলতে হবে? দেখি ছাড়েন, আমি….”
“ঠিক আছে, বলতে হবে না।”
বলেই হুট করে কোলে তুলে নিলেন। চেঁচিয়ে উঠলাম কিছুটা, ছটফটিয়ে নামার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। ধমকে উঠলেন উনি। বললেন,
“অসুস্থ শরীর নিয়ে এমন পেঙ্গুইনের মতো লাফালাফি করছিস কেন? বেয়াদব! বলতে পারছিস না কোথায় যাবি?”
মিইয়ে গেলাম ওনার ধমকে। বজ্জাত লোক একটা। এই বিখ্যাত ধমক ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না যেন। তাকালাম ওনার দিকে। মিনমিনে গলায় আস্তে করে বললাম,
“ও..ওয়াশরুমে যাবো।”
“আগে বললে কি হতো? ঢং করতে ভালো লাগে, তাই না?”
কিছু বলার আগেই উনি এগিয়ে যেতে লাগলেন ওয়াশরুমের দিকে। ভেতরে ঢুকে নামিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমি এখানেই আছি, দরজা আটকাতে হবে না।”
“আপনি কিন্তু….”
আমাকে বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেলেন। হতাশার নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। এই মানুষটা কখনোই ভালো হবার নয়। আস্ত একটা বজ্জাত লোক।
কিছুটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ওনাকে। এগিয়ে যেতে চাইলে উনি আবারও হুট করে কোলে তুলে নিলেন। ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম ওনাকে। বললাম,
“আরে… আবার কোলে নিতে হবে কেন? এতটুকুও কি যেতে পারবো না আমি?”
“গায়ে এতটুকুও শক্তি নাই। আর বলে কি না, ‘এতটুকুও কি যেতে পারবো না আমি’। হু!”
“এই…. এই, আপনি কি আমায় ভেঙ্গেচ্ছেন?”
“আরে না, ভেঙ্গাবো কেন? পাগল! আমি তো আমার বউটাকে আদর করতে চাচ্ছি।”
বলেই টুপ করে ওনার ঠোঁটের স্পর্শ ছুঁয়ে দিলেন আমার ঠোঁটে। মুহুর্তেই চোখ দুটো বড় বড় আকৃতির ধারণ করলো যেন। ওনার থেকে এমনটা কিছুতেই আসা করি নি আমি। অসভ্য লোক একটা। যখন যেটা ইচ্ছে হবে, তখন কি সেটাই করে যাবে আমার সাথে? কিছুটা চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
“অসভ্য, বজ্জাত লোক একটা, নামান বলছি আমাকে।”
বিছানায় নামাতে গিয়েও নামালেন না আমার। শক্ত করে জড়িয়ে পিছিয়ে এলেন কিছুটা। বিরক্ত হলাম আমি। চোখে মুখে বিরক্তির রেশ ফুটিয়ে এনে বললাম,
“কি হলো? নামাতে বললাম না? দেখি, ছাড়েন আমায়।”
“ছাড়তে তো ইচ্ছে হচ্ছে না বউ, তোমাকে কোলে নিয়ে শুধুই আদর আদর পাচ্ছে।”
স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। আস্তে করে বললাম,
“এতোদিন? এতদিন তো আমাকে সহ্যই করতে পারেন নি, তাহলে আজকে হঠাৎ আমাকে দেখে এত আদর আদর পাচ্ছে কেন?”
চমকে উঠলেন তাসফি ভাই। আবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। হয়তো আমার থেকে এমন কথা প্রত্যাশা করেন নি। হালকা হাসলাম আমি। আবারও বললাম,
“ওও সরি! আমি তো ভুলেই গেছিলাম, আপনার এই আদর, এই ভালোবাসা সবটাই তো আমাদের সন্তানের জন্য, আমার জন্য তো এর বিন্দু পরিমাণও নেই।”
“রুপু…. কি বলছিস এগুলো? আমি তোকে….”
“ঠিক কথায় তো বলছি। আমার প্রতি আপনার সবটায় তো দেখানো, দ্বায়িত্ব মাত্র। ভালোবাসা তো নয়।”
“কেন মনে হয় এমনটা তোর?”
“আপনার করা অবহেলা গুলো ঠিকই বুঝিয়ে দেয় আমাকে। একটুকুও ভালোবাসেন না আপনি আমায়। থাকবো না আমি, চলে যাবো এখান থেকে।”
সহসায় কিছু বললেন না উনি। আলগোছে শুইয়ে দিলেন বিছানায়। উনিও ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। আস্তে করে বললেন,
“চলে যাবা? আচ্ছা ঠিক আছে, কেন চলে যেতে চাও?”
ওনার বলা কথায় কান্না পেল আমার। নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিলাম। বলে উঠলাম,
“আপনার অবহেলা ঠিক সহ্য হয় না আমার, নিতে পারি না আমি। আপনার ভালোবাসা নামক দায়বদ্ধতায় জড়িয়ে রাখতে চাই না নিজেকে। আপনার দ্বায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্তি করে নিতে, চলে যাবো আমি, অনেক দূর চলে যাবো।”
আঁটকে রাখা কান্নাটা দলা পাকিয়ে আসলো। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। দু-হাত গালে রেখে আলতো করে চোখের পানিগুলো মুছিয়ে দিলেন। বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকলেন এক দৃষ্টিতে। চোখ সরিয়ে নিলাম ওনার থেকে। ওনাকে ছাড়িয়ে ওঠার চেষ্টা করতেই হুট করেই জড়িয়ে ধরলেন আমায়। গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে দিলেন। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলাম, স্থির হয়ে গেলাম মুহুর্তেই। বেশ কিছু সময় সেভাবেই থাকার পর মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,
“ভালোবাসি! ভালোবাসি! ভালোবাসি! আমার রুপুসোনা কে ভীষণ ভালোবাসি। আমার এই ভালোবাসা থেকে কিছুতেই আপনার মুক্তি নেই ম্যাডাম।”
অনুভব করলাম হঠাৎ কাঁপুনির মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। অজান্তেই এক হাত চলে গেল ওনার ঘারে। খামচে ধরলাম ওনার টি-শার্ট। অস্পষ্ট সুরে আস্তে করে বললাম,
“আপনার অবহেলায় বেঁচে থাকা সম্ভব, ভালো থাকা সম্ভব নয় তাসফি।”
আগের চেয়েও অধিক ভাবে জড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে। একটু ছাড় পেলেই মনে হয় হারিয়ে যাবো ওনার থেকে। কিছু একটা বললেন, কিন্তু কোন কথায় যেন আমার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না।
.
বয়সের তুলনায় দিন দিন নিজেকে ছোট বলে মনে হচ্ছে। বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে নিজেই যেন একটা বাচ্চাতে পরিণত হয়ে উঠেছি। আম্মু ও ফুপির সারাদিনের এত এত যত্ন আর ভালোবাসায় ঠিক বাচ্চা বলেই মনে হচ্ছে নিজেকে। প্রায় তিন মাস সময় কেটে গেছে তাদের আদর যত্ন খেতে খেতে। তাসফি ভাইও কেয়ার, যত্ন নামক ব্যাপক অত্যাচার চালু করেছেন আমার প্রতি। ফিরে এসেছেন তার পুরোনো সত্তায়। ওনার লাগাম ছাড়া কথা বার্তায় জ্বালিয়ে ফেলেছেন আমায়। লাগাতার ওনাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেও কেন কাজ হয় নি। ওনার থেকে দূরে চলে যাবার প্রয়াশ চালিয়ে গেলেও তাতেও কোন লাভ হয় নি। ঠিকই আমাকে বেঁধে ফেলেছেন উনি।
আম্মু চলে গেলেও আবারও এসেছে। আমার এই অসুস্থতায় নাকি কিছুতেই ওখানে মন টিকে না। ডেলিভারি পর্যন্ত আমার সাথেই থাকতে চায়। বাসার কেউ আর বারণ করে নি আম্মু কে। নয় মাসে পড়লেও ডেলিভারির সময়টা এখনো অনেক। এতদিনে আমার উন্নতিটাও হয়েছে কিছুটা। শরীরে র”ক্তের পরিমাণটাও কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ডেলিভারির সময় এটাও নাকি পর্যন্ত পরিমাণ নয়। এতটুকুই বা হবেই না কেন? মি. বজ্জাত তাসফি যে নিজে আমার প্রতিটি দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ডাক্তার তবুও সাবধানে চলাফেরা করতে বলেছেন, প্রোপার রেস্টে থাকতে বলেছেন।
খাবার ভর্তি প্লেটে আম্মু ও ফুপি সামনে এসে বসতেই বিরক্তিতে চোখ মুখ ছেয়ে গেল। খাবার গুলো দেখেই গা গুলিয়ে দুপুরের খাবার গুলো বেরিয়ে আসতে চাইলো। মাঝখানে অনেকটা সুস্থবোধ করলেও ইদানীং আবারও খাবারে গা গুলিয়ে বমি বমি ভাব শুরু হয়েছে। সবাই আবারও বেশ চিন্তায় পড়বে বলে বুঝতে দেই নি কাউকে। কিন্তু আজকে হঠাৎ খাবারগুলো দেখে আর সামলাতে পারবো না হয়তো নিজেকে। চোখে মুখে হাজারো বিরক্তি এনে বললাম,
“খাবো না আমি, নিয়ে যাও এগুলো।”
“খাবি না মানে? দুপুরেও তো ঠিক ভাবে খাস নি, অল্প করে খেয়ে নে।”
“খাবো না। তোমাদের কি আর কোন কাজ নেই? সারাক্ষণ শুধু আমার খাওয়ার পিছনে পড়ে থাকো? নিয়ে যাও তো এগুলো।”
আম্মু কপাল কুঁচকে তাকালো আমার দিকে। ফুপি বলে উঠলো,
“কেন মা? আবার কি হলো তোর? কয়েকদিন থেকেই দেখছি, আবারও খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিছিস।”
“আমার বউকে তোমাদের খাওয়ানোর সাধ্য নেই আম্মু। সে তো বাচ্চা, বাচ্চাদের মতোই আদর দিয়ে খাওয়াতে হবে। সেটা অবশ্যই তার একমাত্র বরের আদর হতে হবে।”
ফুপির কথার প্রতিত্তোরে হঠাৎ রুমে ঢুকে বলে উঠলেন তাসফি ভাই। কটমট চোখে তাকালাম ওনার দিকে। একদল রাগ এসে ভীর জমালো। অসভ্য লোক একটা, সবসময় নির্লজ্জ মার্কা চলতে থাকে তার মুখে। আমি রাগে মুখ ফুলিয়ে ফেললেও আম্মুও ফুপি স্বাভাবিক ভাবেই নিলো কথাটা। উনি আবারও বললেন,
“মামী, আম্মু তোমরা যাও। ওকে আমি খাওয়াচ্ছি।”
“খাওয়াতো বাবা। দিন দিন যা অবস্থা হচ্ছে শরীরের। আমার তো খুব চিন্তা হয়, কি যে হবে…”
বলেই উঠে দাঁড়ালো আম্মু। ফুপিও একই সুরে তাল মিলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আমাকে খাওয়ানোর কথা বলে দুজনেই বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। এবার রীতিমতো কান্না পেল আমার। নিজেকে স্কুলের বাচ্চা উপাধি দিতে ইচ্ছে হলো। আমার ভাবনার মাঝেই প্লেটটা হাতে নিয়ে নিয়ে এগিয়ে এলেন মি. বজ্জাত লোকটা। খাওয়াতে চাইলে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। খেতে চাইলাম না কিছুতেই। ধমকে উঠলেন উনি। বারণ করলেও শুনলেন না। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও খেতে হলো। বার কয়েক মুখে দিলেও পরবর্তীতে আর পারলাম না। মুখ ফুলিয়ে আস্তে করে বলে উঠলাম,
“আর খাবো না, প্লিজ!”
“হা কর, আর একটু….”
“প্লিজ! আর একটু খেলে বমি হয়ে যতটুকু খেয়েছি সেটাও বেরিয়ে আসবে। পরে খেয়ে নিবো।”
আমার কথায় মায়া হলো হয়তো ওনার। রেখে দিলেন খাবারের প্লেট, কড়া গলায় বললেন পড়ে কিন্তু খেতে হবে। আমিও মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম। বোঝালাম, অবশ্যই খাবো। কপাল কুঁচকে একবার তাকিয়ে চলে গেলেন সবকিছু নিয়ে।
.
প্রতিদিনের মতো আজকেও ঠিক মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেল। প্রতিরাতে সাধারণ ভাবে ঘুম ভেঙে গেলেও আজকে আচমকাই একটা বাজে স্বপ্নে ঘুমটা ভাঙলো। জাগার পর কিছুতেই মনে করতে পারলাম না স্বপ্নটা ঠিক কি ছিলো।কিন্তু খুব বাজে একটা স্বপ্ন ছিলো সেটা উপলব্ধি করতে পারলাম। প্রতিদিনের মতোই নিজেকে ওনার বুকে আবিষ্কার করলাম। হঠাৎ দেখা বাজে স্বপ্নে দুরুদুরু বুক মৃদু কাঁপতে লাগলো পুরো শরীর। জড়িয়ে থাকা তাসফি ভাইকে আরও জড়িয়ে ধরলাম। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে শান্ত করালাম নিজেকে। হালকা মাথা তুলে তাকালাম ওনার দিকে। গভীর ঘুম ঘুমিয়ে আছেন। প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই ঘুম ভেঙে যায় ওনার। আমার উঠতে না দিয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নেন নিজের সাথে। হাজারো বিরক্ত করে নানান কথা বললেও তার কোন কথায় কানে নেন না উনি। সেদিন হঠাৎ অসুস্থ হবার পর গত কয়েক মাসে আগেই তাসফি কে ফিরে পেয়েছি, সাথে ওনার সেই পাগলামিতে ভরপুর ভালোবাসা। হ্যাঁ! এই মানুষটার সবকিছুই শুধু আমার জন্য, নিজের থেকেও বেশি আমাকে ভালোবাসেন। গত তিন মাসে আমাকে আবারও নতুন ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
রুমের আবছায়া আলোয় তাকালাম ওনার দিকে। বাচ্চাদের মতো শান্ত হয়ে গভীর ঘুমে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কপালে, গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। এমতাবস্থায় ওনাকে দেখে অবাধ্য অনুভূতি গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। হাত বাড়িয়ে আলগোছে ছুঁয়ে দিলাম ওনার গালে। এলোমেলো চুলেও হাত বুলিয়ে দিলাম। একটু নড়েচড়ে উঠলেন উনি। সাবধানতায় দু’হাতে আগলে নিলেন। হালকা হাসলাম আমি। ঘুমের ঘোরেও ঠিক কতটা আগলে রাখে আমাকে। মাথা উঁচিয়ে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ দিলাম ওনার গালে। সরে এসে আলগোছে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। সারাটাদিন ভার্সিটি ও আমাকে সামলে এতটাই ক্লান্ত যে জাগা পেলেন না কিছুতেই।
আস্তে আস্তে নেমে যেতে লাগলাম বিছানা ছেড়ে। মাথাটা হঠাৎ চক্কর দেবার সাথে সাথে গা গুলিয়ে উঠলো। বিছানা ছেড়ে আস্তে করে নেমে এগিয়ে গেলাম টেবিলে দিকে। গ্লাসে পানি ঢেলে হাতে নিতেই শরীরে হালকা কম্পন সৃষ্টি হলো, গ্লাসের অর্ধেক পানি পারে গেল ফ্লোরে। হতাশার নিশ্বাস ছাড়লাম। বাকি পানিটা খেয়ে রেখে দিলাম গ্লাসটা। কিছুটা রিলাক্স ফিল করলেও পুরোপুরি পারলাম না। রুমের আবছা আলোয় গুটিগুটি পায়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে বেরিয়ে এলাম। এবার কিছুটা স্বস্তি পেলাম যেন। বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ তরল কিছুর সাথে পা লেগে গেল। দু’হাত বাড়িয়ে কিছু ধরার চেষ্টা করেও পেলাম না। ভারসাম্য রাখতে পারলাম না নিজের, স্লিপ কেটে পা পিছলে গেল সহসায়। এক হাত পেটে রেখে আত্মদান করে ডেকে উঠলাম ওনাকে।
“আহ্! তাসফিইই….”
ফ্লোরে পড়তেই নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম মুহুর্তেই। অসহ্য ব্যাথা আর যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলাম সমানে। হালকা ভাবে কানে ভেসে আসলে নিজের নাম, জ্বলে উঠলো রুমের আলো। দু’হাতে আগলে ধরলো কেউ। কানে স্পষ্ট ভাবে ধরা দিলো কিছু কথা।
“রুপু! এই রুপু, কি হয়েছে তোর? এত ব্লাড কেন? তাকা আমার দিকে, এ্যাই মেয়ে….”
ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চোখ খুলে তাকাতে পারলাম না ওনার দিকে, আর না জবাব দিতে পারলাম ওনার কথার। র*ক্ত কিসের সেটাও দেখার সুযোগ মিললো না। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম শুধু। এই মুহুর্তে শুধু একটা কথায় মাথায় আসতে লাগলো, আমার বাচ্চাটা ঠিক আছে তো? ওর কিছু হয় নি তো? বাচ্চার কথা ভেবে শক্ত করলাম নিজেকে। দু’হাতে ওনাকে খামচে ধরে চোখ খোলার চেষ্টা করলাম। অস্পষ্ট সুরে বলার চেষ্টা করলাম,
“আ..আমার বাচ্চাকে বাঁচিয়ে দিন তাসফি। ওর কিছু হতে দিয়েন না।”
এতক্ষণে কিছুটা হুস হলো ওনার। চিৎকার করে ফুপি ফুপা ও আম্মুকে ডাকতে লাগলেন। উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দিয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে। আলগোছে কোলে তুলে নিয়ে বলে উঠলেন,
“রুপু চোখ দুটো খোলা রাখ, একদম বন্ধ করবি না। তাকিয়ে থাক আমার দিকে।”
ওনার কথা মতো মিটমিট করে তাকানোর চেষ্টা করলাম। উনি চিৎকার করে আবারও ডেকে উঠলেন সবাইকে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই সবাই বেরিয়ে এলো। কিছু একটা বললেও তার কোন কথায় আমার কানে গেল না। তাসফি ভাই বলে উঠলেন,
“জানি না আমি, ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। এখুনি সাদিকে ফোন করো।”
বলেই আমার দিকে তাকালেন। উত্তেজিত কণ্ঠে আমাকে বললেন,
“চোখ খোলা রাখ রুপু, একদম চোখ বন্ধ করবি না।”
যন্ত্রণায় ছটফট করলেও ওনার কথায় চোখ খুলে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম, তাকিয়ে দেখতে লাগলাম ওনাকে। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে এখানেই আমার জীবনের সমাপ্তি। কিন্তু আমার বাচ্চা? ও ঠিক আছে তো, পৃথিবীতে সুস্থ ভাবে আসতে পারবে তো? অস্পষ্ট সুরে ডেকে উঠলাম ওনাকে। বলার চেষ্টা করলাম,
“আম্…আমাদের বাচ্চাকে বাঁচিয়ে নেও তাসফি, ওর কিছু হতে দিও না। আমার দ্বায়িত্ব আর নিতে হবে না তোমাকে, ভালোবাসতে হবে না আমাকে। সবটা দিয়ে আমাদের সন্তানকে আগলে রেখো। আমাকে করা অবহেলা ওকে করবে না, আমার মতো ওকেও দূরে ঠেলে দিও না।”
“রুপু! এ্যাই রুপু, কিছু হবে না তোমার। তাকাও আমার দিকে। চোখ খোলা রাখো….”
“ওকে বাঁচিয়ে নেও তাসফি। আমাদের সন্তানের কিছু হতে দিও না। আমি ওর ক্ষতি চাই নি, ইচ্ছে করে এমনটা করতে চাই নি। আমি ওকে অনেক ভালোবাসি, অনেক….”
“একদম উল্টা পাল্টা কথা বলবি না….”
ধমকে চুপ করে দিলেন। পাত্তা দিলাম না আমি। নিজ মনে আবারও বলে উঠলাম,
“আমার দ্বায়িত্ব আর আপনাকে নিতে হবে না তাসফি। চলে যাবো, অনেক দূরে চলে যাবো….”
“এসব কথা একদম বলবি না। ঠিক কতটা ভালোবাসলে আমার থেকে দূরে যেতে চাইবে না রুপু, ঠিক ততটাই ভালোবাসবো তোমাকে। তার চেয়ে অনেক বেশিই ভালোবাসবো, তবুও আমাকে ছেড়ে যাবার কথা বলবে না।”
নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলে উঠলেন। ওনার মাঝে আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় তীব্র ভাবে প্রতিফলিত হয়ে উঠলো। দু’হাতে ওনাকে খামচে ধরে অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম,
“ভালোবাসি! আপনাকে অনেক বেশিই ভালোবাসি তাসফি।”
.
ধীরে ধীরে তীব্র যন্ত্রণার সাথে সাথে ছটফটানির মাত্রাটাও বেড়ে গেল। হাসপাতালে আনার পর অবস্থার গতিবেগ দেখে দ্রুত অপারেশন করতে চাইলো। অপারেশন থিয়েটারে যতই এগিয়ে নিতে যেতে চাইলো ততই তাসফি ভাই আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখলেন। বলতে লাগলেন,
“অনেক ভালোবাসবো রুপু, তোমার কল্পনার থেকেও বেশি ভালোবাসবো তোমাকে, তবুও আমাকে ছেড়ে যাবার কথা ভাববে না তুমি….”
আরও কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারলেন না। হাত ছেড়ে নিলো ওনার থেকে, আমাকে নিয়ে চলে এলো।
অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে খুব জলদিই সবকিছু গুছিয়ে নিলো। বেশ কয়েকটা ইনজেকশন শরীরে পুস করে চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করতে বললো সাদিক ভাইয়া। চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে আসলেও অতি কষ্টে খোলা রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। ঠিক কতটা সময় পেরিয়ে গেল জানা নেই আমার। কানে ভেসে আসলো কারোর কথা।
“আর সম্ভব নয়। এমনিতেই শরীরে ব্লাড ছিলো না, তার মধ্যে এত ব্লাড লস, মা বাচ্চা দুজনের লাইফ রিক্সে, সম্ভবত একজন কে বাঁচানো যাবে।”
চমকে উঠলাম আমি। মুহুর্তেই শ্বাস প্রশ্বাসের আনাগোনা বেড়ে গেল। হাত বাড়িয়ে টেনে ধরলাম সাদিক ভাইয়ার হাত। তাকালেন আমার দিকে। এগিয়ে এসে দাঁড়াতেই মৃদু গলায় অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম,
“আমাদের সন্তানকে বাঁচিয়ে নিন ভাইয়া, ওর কিছু হতে দিয়েন না। ত্…তাসফি ওকে অনেক ভালোবাসে, ওর কিছু হতে দিয়েন না ভাইয়া।”
.
.
চলবে…..