সায়র পর্ব-১৭+১৮

0
364

#সায়র
#পর্ব_১৭
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

কিরণের হাতের ব্যথা কিছুটা কমেছে। হাত বেশি নাড়াতে পারে না, তবে এখন আর নিজের কাজে মায়ের সাহায্য লাগে না। কিরণের মা আজ আটদিন এখানেই থেকেছে তার সাথে। কিরণের বাকি এক সপ্তাহ শেষ হয়ে গিয়েছে। উজানের বাংলো ছেড়ে তার যাওয়ার কথা ছিল হোস্টেলে। সে উজানকেও বলেছিল সে চলে যাবে। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পর হোস্টেলে থাকা একদমই বন্ধ হয়ে গেছে। কিরণ শুনেছে সীট নাকি বুক হয়ে গেছে। আর সীট খালি নেই। সীট তো আর কিরণের জন্য অপেক্ষা করবে না। এটা শুনে কিরণের চিন্তার শেষ নেই। এখন সে কোথায় থাকার জায়গা খুঁজবে? ঢাকা শহরে বাসা ভাড়াও আকাশচুম্বী, যা কিরণের পক্ষে সামাল দেওয়া কষ্টকর। আবার উজানের বাসাতেও দীর্ঘদিন থাকা যাবে না। চক্ষুলজ্জা বলে একটা কথা আছে না!

কিরণ উজানের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে। ভেতরে যাবে কিনা ভাবছে। উজান বলেছিল কিরণকে দুই সপ্তাহ সময় দেয়ার পর তাকে জাওভানের হাতে তুলে দিয়ে আসবে। দুই সপ্তাহ অলরেডি শেষ। কিন্তু এই শেষ এক সপ্তাহে কিরণ একবারও উজানকে দেখলো না সেই বিষয়ে কোনো কথা তুলতে।

আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার যেটা কিরণকে প্রতিদিন ভাবিয়ে তুলছে, তা হলো এই আটদিনে একটাবারও জাওভান তাকে কল করেনি। শেষ দিন দেখা হয়েছিল যেদিন জাওভান কিরণকে হুমকি দিয়েছিল। এমন না যে কিরণ মিস করে জাওভানকে। বরং আতঙ্কে থাকে। যদি জাওভান কিছু উল্টাপাল্টা করে থাকে। কিরণ তার ভাইকে নিয়ে বেশি ভয় পায়। তার ছোটো ভাই হসপিটালে। কিরণ সর্বদা তটস্থ থাকে। দিনে একশোবার হলেও ভাইকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবে সব ঠিক আছে কিনা। মমতাজকে বলেছিল চলে যেতে, মমতাজ মেয়েকে একা ছাড়তে চাননি।

তিনি চলে যাবেন কালকে। মেয়ে একা একটা ছেলের বাড়িতে আছেন সেটা নিয়ে প্রথমে তিনি অনেক চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু উজানকে দেখার পর, তার ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তার আর চিন্তায় থাকতে হয় না। আর এমনিতেও মেয়ের জীবনে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না। কিরণ যেমন ভাবে ইচ্ছা, যেখানে ইচ্ছা থাকুক, যা ইচ্ছা করুক। শুধু মেয়েটা একটু খুশি থাকলেই চলবে। মেয়ের মুখে একটু হাসি ফুটুক এই একটাই তার কামনা।

কিরণ চাইছিল উজানের সাথে ডিল ক্যান্সেলের ব্যাপারে কথা বলবে। যেহেতু এই ডিল রাখার আর কোনো মানে দেখছে না সে। তবে তার একটা দিক দিয়ে অসুবিধা হবে, উজান কিরণের পরিবারকে যেই সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দিয়েছে তা হয়তো খোয়াতে হবে। কিরণের ভাই আর মায়ের জন্য উত্তরাতে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে, যেটা সে আজকেই মায়ের মুখ থেকে শুনেছে। তখন তার মাথায় আসে, ফ্ল্যাটে থাকলে অন্তত তার বাসা ভাড়া কিংবা হোস্টেলের খরচ বেঁচে যাবে, আর মা আর কিয়াদের সাথেও একসাথে থাকা হবে। কিন্তু এখন যখন ডিল ক্যান্সেলই করে দিবে সেখানে তো উজান নিশ্চয়ই আর ফ্ল্যাট দিবে না?

কিরণের এলোমেলো ভাবনার মাঝে খট করে উজানের রুমের দরজাটা খুলে যায়। আকস্মিক হওয়ার দরুণ কিরণ ঈষৎ কেঁপে উঠে। নিজেকে সামলে সামনে তাকায়। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা উজানকে সকালের নরম স্নিগ্ধ রোদের মতো সতেজ লাগছে। সাদা টিশার্ট আর একটা টাউজার পরনের উজানের এলোমেলো চুল কপালে ছড়ানো। চোখজোড়ায় এখনো ঘুম লেগে আছে। কিরণ জীবনেও ঘুম থেকে ওঠা উজানকে দেখেনি। দেখবেই বা কীভাবে! উজান তো ভেরের পাখি। আর সেখানে কিরণ লেট লতিফ।

উজান তখন সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। প্রতিদিন সে সকাল ছয়টা বাজে ঘুম থেকে উঠে এক্সারসাইজ শুরু করে। নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুবই সচেতন সে। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া ঘুম, সব তার রুটিন মতো। ফলস্বরূপ তার পেটে মেদ নেই, চমৎকার সুঠাম দেহ। কিন্তু আজ একটু বেশিই দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে সে। গতকাল রাতে সে একটা পেইন্টিং শেষ করেছে। তার জন্যই ঘুমাতে এত দেরি।

‘কী হয়েছে? ডাকছিলে কেন?’ উজানের ঘুম জড়ানো কণ্ঠ।

কিরণকে ভাবান্বিত দেখায়। সে কখন উজানকে ডাকল? তার তো মনে পড়ে না। এখানে এসেছে ধরেই তো দাঁড়িয়ে চিন্তার ঝুড়ি মেলে বসেছিল।

‘কী হয়েছে কিরণ?’

হঠাৎ করেই কিরণের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ খেলে যায়। উজানের জড়ানো কণ্ঠে কিরণ ডাকটা খুবই আবেশী লাগছে তার কাছে। এমনকি সব কথাই।

ধরাম করে দরজা আটকানোর আওয়াজে কিরণের হুশ ফিরে। দেখে উজান দরজা আটকে দিয়েছে। কী হলো এটা? ওহ! দোষটা তো তারই। সেই তো কথা না বলে আজেবাজে চিন্তা করছিল।

হতাশার শ্বাস ফেলে কিরণ চলে যেতে নেয়। এক পা বাড়াতেই আবারো দরজা খোলার আওয়াজ। কিরণ পিছে ফিরে। উজান দরজা খুলে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

‘ভাবা শেষ?’

কিরণ ছোট করে বলে, ‘হু।’

‘কী জন্য এসেছো?’

‘কিছু কথা ছিল তোমার সাথে।’

উজান দরজা পুরোটা মেলল। ‘এসো।’

কিরণ রুমের ভেতরে যেতেই মনমাতানো সুগন্ধী তার নাকে এসে সুড়সুড়ি দিলো। উজান এখানে থাকা শুরু করার পর থেকে কিরণ কখনো আসেনি তার রুমে। উজানের রুমের ঘ্রাণটা মোহনীয়। কিরণ চোখ বুজে শ্বাস টেনে ঘ্রাণটাকে নিজের মধ্যে নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। উজানকে জিজ্ঞেস করতে হবে সে কোন পারফিউম ইউজ করে।

‘বসো। আমি আসছি।’

উজান রুমে থাকা সোফাটাকে দেখিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। কিরণ ঘুরে ঘুরে রুমটাকে দেখতে থাকে। উজান এখানে থাকার পর অনেক আসবাব চেঞ্জ করেছে। উজানের রুমটা অনেক বড়। বড় হওয়ারই কথা যেহেতু এটা মাস্টার বেডরুম। রুমটার কানায় কানায় শৌখিনতার ছোঁয়া। হেডবোর্ডের বড় একটা খাট। তার দুপাশেই ছোট তেপায়া টেবিল। টেবিলের উপরে ভাস্কর্য। দেয়ালে ক্যানভাসে আঁকা চোখ ধাঁধানো কিছু পেইন্টিং। মেঝেতে বিশাল সাইজের কার্পেট। একপাশে সোফা সেট। কোণায় বিভিন্ন ধরনের ল্যাম্প। আর বারান্দার দেয়ালটা সম্পূর্ণ কাঁচের। দিনের আলোয় ঝলমল করতে থাকে সারাটা রুম।

কিরণ গিয়ে সোফায় বসে পড়ে। সোফার সাইডের দেয়াল জুড়ে বড় একটা পেইন্টিং। চারিদিকে থৈ থৈ করা নীল জল। জোৎস্নার কোমল আলো ঝিকিমিকি করছে সমুদ্রের পানিতে। তার মাঝে একটি মেয়ে দুইহাত ছড়িয়ে সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ছে। ছবিটা এতটাই জীবন্ত যে দেখলে মনে হয় চোখের সামনেই সমুদ্র, ঢেউগুলো এসে এক্ষুনি পা ভিজেয়ে দিয়ে যাবে, মেয়েটাকে ছোঁয়া যাবে হাত বাড়ালেই। পেইন্টিংটার নাম কোণায় লেখা- সায়র।

উজান এসে কিরণের সামনের সোফাটায় বসে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে,

‘বলো কী বলবে?’

ভেজা মুখের উজানকে সুদর্শন লাগছিলো আরো বেশি। কিরণ উজানের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বারান্দায় দৃষ্টিপাত করল।

‘ডিলের ব্যাপারে আলোচনা করতে এসেছি।’

‘ডিল ক্যান্সেল।”

কিরণ চমক লাগানো চোখে চায় উজানের দিকে। উজান ডিল ক্যান্সেল করে দিয়েছে? বিশ্বাস হয় না তার।

‘তুমি শিওর উজি?’

‘হুম।’

‘তাহলে তোমার টাকা আমি ফি..’

উজান কিরণকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ওসব নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি যা দেই তা ফিরিয়ে নেই না।’

‘কিন্তু…’

‘কোনো কিন্তু না। তোমাকে আমি কম হয়রানি করিনি। ছোটো ভাইয়ের কথা ভাবতে গিয়ে তোমার জীবনটাও শেষ করেছি। এগুলো সরি হিসেবে রাখতে পারো। ভবিষ্যতেও তোমার যদি কোনো সাহায্য লাগে আমাকে বলতে পারো। আ’ম অলয়েজ দেয়ার ফর ইউ।’

উজান একটু থেমে বলে, ‘উত্তরায় তোমাদের জন্য যেই ফ্ল্যাট কিনেছি সেটাতে তোমরা চাইলে এই সপ্তাহে উঠতে পারো। সবকিছু ঠিকঠাক করে দেবো আমি। ততদিনে তুমি এখানে থাকতে পারো।’

কিরণের অনেক লজ্জা লাগছিল উজান তাকে এতভাবে সাহায্য করছে দেখে। কিন্তু ভেতরের মনটা বলে উঠল, “এটা সাহায্য না রে পাগল। এটা ক্ষতিপূরণ। তোকে তো জাহান্নামে ঠেলে দিতে চেয়েছিল সে, আজ সে নিজেই তোকে ফিরিয়ে আনছে। সেটারই ক্ষতিপূরণ এসব। লজ্জা না পেয়ে মেনে নে।”

কিরণ অধিক কষ্টে মুখ ফুটে বলল, ‘থ্যাংকস।’

কিরণ যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে যেতে উজান দরাজ কণ্ঠে ডেকে উঠে।

‘কিরণ।’

কিরণের পা থমকায়। ঘাড় ঘুরায় উজানের দিকে। উজানের দৃষ্টি তখন সামনের টানানো সায়র পেইন্টিংটার দিকে। সেখানে দৃষ্টি আবদ্ধ করে ধীরস্বরে বলল,

‘সরি।’

কিরণ আর কিছু বলল না। শব্দহীন পায়ে উজানের রুম ত্যাগ করে।

.

.

বেলা মধ্যাহ্ন। দুপুরের খাবার তৈরি করছেন মমতাজ। চিংড়ি মাছ ভর্তা, কলা ভর্তা, মুরগীর মাংস, আর চিংড়ি মালাইকারী। উজান তখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। রান্নাঘরে যায় নিজের খাবার তৈরি করতে। উজানকে রান্নাঘরে দেখে মমতাজ বলেন,

‘উজান বাবা, তোমার আজ কিছু করতে হবে না‌। আজ তুমি আমাদের সাথে খাবে।’

উজান তার নিজের রান্না নিজে করে উপরে নিয়ে যেত। একা একা খেতেই তার পছন্দ। মমতাজ আর কিরণ নিচেই ডাইনিংএ খেত। মমতাজ এর আগে যতবার উজানকে ডাকতে চেয়েছে কিরণ ততবারই বারণ করেছে। কিরণ জানে উজান ইন্ট্রোভার্ট। উজানের বাড়িতেই থেকে শুধু শুধু উজানকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চায় না সে। কিন্তু আজ মমতাজ চাইছেন উজান তাদের সাথে একসাথে বসে খাবে। সারাদিন কীসব লতাপাতা খায়, ভাত খায় এক কাপের চেয়েও কম। এসব খেলে সুস্থ থাকে মানুষ? তাই তিনি উজানকে নিজের হাতের রান্না খাওয়াতে চান। আর এমনিতেও তিনি তো কালকে চলেই যাবেন। এরপর আর দেখা হবে কিনা কে জানে। আজকে একটু ভালোমন্দ খাক ছেলেটা। ছেলেটার মা বাবা তো আর সাথে থাকে না, নিজে বানাবে সেই সময়টাও তো ছেলেটার নেই।

উজান বাঁধা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু রান্নাঘরে থাকা কিরণ মায়ের পেছন থেকে উজানকে চোখের ইশারায় বলছিল অন্তত আজকের জন্য হ্যাঁ বলতে। উজান চুপ করে রইল। এক টেবিলে বসে দুইজনের সাথে খাবে এটা ভাবতেই তার ভেতরটা কেমন খচখচ করে। সে কখনোই একসাথে খেতে বসেনি। অভ্যাস নেই। ছোটো বেলায় নানু খাইয়ে দিতো। নানু মারা যাওয়ার পর নিজের মতো করে সবটা করে। জাওভান থাকাকালীন জাওভান বাহিরেই বেশি সময় কাটাতো।

মমতাজ তাকে বারবার অনুরোধ করছেন। বয়সে বড় একজন এমনভাবে অনুরোধ করছেন যে না করলে খারাপ দেখায়। উজান একজন মুরব্বীর মুখের উপর না করতে পারছে না। কোনোদিন পারবেও না। তার কথায় কেউ কষ্ট পাক এটা সে চায় না। তাই নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বলল,

‘আচ্ছা আন্টি।’

মমতাজ অনেক খুশি হলেন। তিনি মেন্যুতে আরেকটা পদ যোগ করলেন, বাঁধাকপি ভাজি।

খাবার টেবিলে উজানের অস্বস্তি টের পেল কিরণ। তার মা’ও না! বারবার উজানের পাতে এটাসেটা তুলে দিচ্ছে আর খাবার সম্পর্কে একশোটা উপদেশ দিচ্ছেন। এটা খাওয়া ভালো, ওটা খেলে ভালো হয়, উজান যা খায় এসব খেলে স্বাস্থ্য ঠিক থাকে না হেনতেন। উজান না পারছে কিছু করতে না পারছে বলতে। কিরণ উজানের ধৈর্য্যশক্তি দেখে অবাক না হয়ে পারে না। উজানের মুখাবয়ব এতটাই নির্মল আর স্বচ্ছ যে দেখলে মনে হয় মমতাজ যা বলছেন তার সব কথার সাথে সে সহমত।

মমতাজ রান্নাঘরে গেলেন ভাত আনতে। এরমধ্যে উজান মুখোমুখি বসে থাকা কিরণের পাতে সব খাবার ঢেলে দিলো। নিজের পাতে একটু ভাত আর ভর্তা রাখল। কিরণ আরে আরে করে চেঁচাতে গিয়ে থেমে গেল। উজান আঙুল ঠোঁটে ঠেকিয়ে কিরণকে চুপ থাকতে বলছে। কিরণ ফিসফিস করে বলল,

‘আমি এতকিছু খেতে পারব না। আপনাকে দিয়েছে আপনি খান।’

উজান কিরণের ন্যায় ফিসফিস করে বলল,
‘এক বিন্দু খাবারও যাতে নষ্ট না হয়। সবটা খাবে তুমি।’

‘আরেহ..’

‘সবটা।’ কঠিন গলা উজানের।

‘উফফ।’

মমতাজ রান্নাঘর থেকে ভাতের বাটি হাতে ফিরলে উজান সোজা হয়ে বসে চোখমুখ স্বাভাবিক করে ফেলল। যেন এই মুহুর্তে কিছুই হয়নি। তাকে নিষ্পাপ বাচ্চার মতো বসে থাকতে দেখে কিরণ বিড়বিড় করে কিছু কথা শোনালো।

উজানের শেষের এক লোকমা ভাত খেয়ে বলে,

‘আপনার রান্না সত্যি চমৎকার আন্টি। বিশেষ করে এই চিংড়ি ভর্তা।’

তা শুনে কিরণ মনে মনে তিরস্কার করল উজানকে, “উউউউহ! না খেয়েই চমৎকার! ঢং দেখে বাঁচি না।”

মমতাজ অনেক আপ্লুত হলেন। উজানকে আরো সাধলেন,

‘নাও বাবা, চিংড়ি ভর্তাটা আরেকটু নাও না। গরম ভাত দেই, মজা লাগবে আরো।’

‘না না আন্টি। আমার পেট ভরে গেছে। আর খাবো না এখন। আমি উঠছি।’

মমতাজ তৃপ্তি ভরা চোখে তাকালেন। নিজের মেয়েটাও এমনভাবে একটু প্রশংসা করে না। তিনি ভাবলেন যাওয়ার আগে উজানকে চিংড়ি ভর্তা রেসিপিটা দিয়ে যাবেন।

.

.

সন্ধ্যা নামার আগ মুহুর্তে আহযান আর আয়াতের দেখা পাওয়া যায়। তারা এসেছে বিয়ের কার্ড দিতে। তার আর আয়াতের। আয়াত কিরণকে দেখে অবাক হয়। তার অবস্থা শুনে আফসোসও করে। উজান তখন পুলের পাশে বসেছিল। মোটা ফ্রেমের চশমার বিপরীতে থাকা গম্ভীর চোখগুলো তখন হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে লেখা ‘Being the best version of you’ বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ। আহযান আসায় তাকে বই থেকে মনোযোগ সরাতে হয়। আহযান জানে উজান কখনো তার বিয়েতে আসবে না। উজান মানুষের ভীড়ে থাকতে অপছন্দ করে। তাও আহযানের মেন্টর হিসেবে উজানকে ভদ্রতা রক্ষার্থে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছে।

কিরণ ড্রয়িংরুমে ডিজাইন বই হাতে নিয়ে বসেছিল। এখন আয়াতের সাথে খোশগল্পে মেতেছে। মমতাজ তার জামাকাপড় ব্যাগে ভরছিলেন।

এই সাদামাটা সন্ধ্যাটাকে বিনষ্ট করতে আগমন হয় জাওভান নামক জাহান্নামের।

মেইন দরজা ভেজানো ছিল তখন। জাওভান এসেই দরজায় এমন জোরে ধাক্কা দেয় যে আয়াত আর কিরণ পিলে চমকে উঠে। কিরণ জাওভানকে দেখে নিদারুণ আতঙ্কে মুখের রক্ত সরে যায় কিরণের। জাওভানের চোখ টকটকে লাল, চুল এলোমেলো, চেহারা ফ্যাকাসে।

সে কিরণকে দেখে বাঁকা হাসে। বিড়বিড় করে বলে,

‘জান আমি এসেছি, তোমাকে নিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেই এসেছি সোনা। তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, আমার করে…’

এগিয়ে যেতে থাকে কিরণের দিকে। কিরণের সামনে আসতেই তাকে হাত ধরে টেনে উঠায়। কিরণের কাছে মুখ নিয়ে যায়। কিরণ মাথা সরিয়ে নিতে গেলে জাওভান কিরণের চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরায়। কিরণের ব্যথাতুর শব্দ জাওভানের কানে লাগে না। সে কিরণের মুখের কাছে মুখ এনে বলে,

‘তুমি আমার হবে কিরণ। একমাত্র আমার, আমার কিরণ..’

‘জাওভান চুল ছাড়ো।’ ব্যথায় কিরণের মনে হয় চুলের গোছা ছিঁড়ে আসবে।

কিরণের কথা শুনে জাওভানের চোখ ভস করে জ্বলে উঠে। দাঁতে দাঁত ঘষে বলে,

‘ধরেছি কী ছাড়ার জন্য নাকি? ছাড়বো না তোকে, তুই শুধু আমার, শুধুই আমার, তোকে ধরার অধিকারও আমার। তোর সবকিছু আমার।’

জাওভান এলোমেলো বিলাপ করতে থাকে। কিরণের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। আয়াত কিরণের পাশে ছিল। সে দুরুদুরু বুকে বলে,

‘কিরণকে ছাড়ুন ভাইয়া।’

জাওভান ঘাড় কাত করে তাকায় আয়াতের দিকে। আয়াতের গলা ‌শুকিয়ে গেল ভয়ে। জাওভান আয়াতের কাঁধ ধরে জোরে ধাক্কা মারে আচমকা। সে গিয়ে টি টেবিলের উপর আছড়ে পড়ে। তারপর কিরণের চুল ধরে আবার টানতে টানতে নিয়ে যায়।

চেঁচামেচি শুনে উজান আর আহযান ঘরে আসে। মমতাজও বেরিয়ে আসেন। আহযান ছুটে আয়াতের কাছে। ততক্ষণে জাওভান কিরণকে দরজার বাহিরে নিয়ে গেছে।

কিরণ বাহিরের পিলার শক্ত করে চেপে ধরল ডান হাতে। সে কিছুতেই জাওভানের সাথে নিজের জীবন আর জড়াতে চায় না। উজান তো বলেছিল তাকে সাহায্য করবে। এখন এই আপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সে সাহায্য চাইলেককি উজান না করবে?

কিরণ ছটফট করতে লাগল, ‘ছাড়ো জাওভান। আমি যাবো না তোমার সাথে কোথাও।’

জাওভান চুল ছেড়ে কিরণের ডান হাত চেপে ধরে। পিলার থেকে কিরণের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,

‘যাবি না মানে, তোর ঘাড় যাবে। কত মিথ্যা বলেছিস আমায় হুম? এই বাড়িতে থেকে আমাকে বলতি তুই নিজের দেশের বাড়ি! মিথ্যাবাদী! অনেক হয়েছে, আজকে তোকে নিজের করেই ছাড়বো আমি। তোকে বিয়ে করার সব বন্দোবস্ত করেই এসেছি আমি। চল, আজ তোর আমার বিয়ে হবে, তারপর হবে আমাদের সোহাগ রাত। আজকে তোমার অনেক আদর করব কিরণ। কোনো কষ্ট দেব না বিশ্বাস করো… ‘

কিরণের চোখে পানি চলে এসেছে হাতের ব্যথায়। হাত মঁচকে ধরেছে জাওভান। সে হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে,

‘তোকে বিয়ে করবো না আমি। নরকে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই।’

জাওভান উচ্চস্বরে বলল, ‘কেন বিয়ে করবি না তুই আমায় হুম? কেন করবি না? একটা বছর হয়ে গিয়েছে তোর পিছে কুত্তার মতো ঘুরেছি বিয়ের জন্য। তুই পাত্তাই দেস না। কী সমস্যা তোর বিয়ে করলে? যতবারই বিয়ের কথা বলি ততবারই তোর না না শুনি। আর না, আজ তোকে বিয়ে করতেই হবে। তারপর তোর ডানা ভাঙব আমি।’

কিরণকে টেনে জাওভান গেট অবধি নিয়ে গেল। কিরণ মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিল, সে তার জীবনের চরম সত্যিটা জানাবে এখন। যেই কথাটা আজ অবধি উজান আর তার মা ছাড়া জানে না আজ সেই কথাটা সে জাওভানকে বলবে। জাওভান তার সত্যি শুনে মানুক কিংবা না মানুক, কিরণের বিয়ে হোক বা না হোক, সে এই কথাটা জাওভানকে বলবেই বলবে।

সে তখন কান্নারত ভাঙা ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলল,

‘জাওভান। আই ওয়াজ রেইপড।’

থমকে যায় জাওভান। এক মুহুর্তের জন্য হার্টবিট বন্ধ হয়ে যায় তার। ভেতরটা দুলে উঠে। সে কি ভুল শুনলো? উজান ততক্ষণে সদর দরজা পেরোয়। জাওভান পেছনে ফিরে দেখে কিরণ কান্না করতে করতে মাটিতে বসে পড়েছে। তার কানে কিরণের বলা কথাটা বেজে উঠে বারংবার। কিরণের হাত ধরা তার হাতটা আলগা হয়ে যায়।

.
.
চলবে…

#সায়র
#পর্ব_১৮
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

কিরণের তখন ছয় বছর বয়স। ছোট্ট আদুরে কিরণ ছিল মায়ের চোখের মণি। কিছুটা বোকাও ছিল বৈকি। শান্তশিষ্ট বোকা স্বভাবের কিরণ স্কুলে সবসময় চুপচাপ থাকতো। প্রাক প্রাথমিকে সে তখন পড়তো। সে ছিল ফার্স্ট গার্ল। তা নিয়ে তার আরো দুইজন সহপাঠী খুবই হিংসা করত। কতবার ক্লাস শেষে কিরণকে স্কুলের পেছনে নিয়ে টিজ করেছে হিসাব নেই। কিরণের মসৃণ চুল ধরে টানতো, কিংবা তার পেন্সিল, কলম কেড়ে নিতো, আবার কলম দিয়ে সাদা ড্রেসে আঁকিবুকি করে কিরণের ড্রেস নষ্ট করত। ভীতু কিরণ চুপিচুপি কান্না করতো। মাকেও বলতো না। মেয়ে দুটো হুমকি দিয়েছিল, কিরণ যদি তার মাকে বলে দেয় তাহলে তারা কিরণের বই খাতা ছিঁড়ে কিরণকেও নদীতে ফেলে দিবে। এই ভয়ে কিরণ কাউকে বলত না।

স্কুলে তার কোনো ফ্রেন্ড না থাকলেও বাড়িতে বন্ধু বান্ধবের অভাব নেই। এই পাড়ার ময়না, ওই পাড়ার রাজু, সবার সাথে কিরণের ভাব।

একদিন সে দেখে তার বাসায় নতুন একটা আঙ্কেল। এটা নাকি তার আব্বা। কিরণ কখনো কাউকে আব্বা ডাকেনি। সে জানেনা বাবারা কেমন হয়। তাকে বলেছিল তার আব্বা বিদেশ থাকে। একদিন ঠিক আসবে তার কাছে। সবাই বলে কিরণ নাকি তার আব্বার মতো দেখতে। কিরণ আয়নায় গিয়ে নিজের চেহারা দেখে আর লোকটার চেহারা দেখে বারবার। কই? তার সাথে তো এই‌‌‌ লোকটার চেহারার কোনো মিল নেই! তখন তার মা মমতাজ আঙ্কেলটাকে দেখিয়ে দিয়ে বলে,

‘মা কিরণ, এখন থেকে তুমি ওনাকে আব্বা ডাকবে কেমন? ডাকো, আব্বা বলো।’

কিরণের ছোট্ট মাথায় ঢুকে না কেন তার বাবা এত দেরি করে আসলেন। কেন এতদিন তার কাছে ছিলো না। লোকটি তাকে দুহাত বাড়িয়ে কাছে আসতে বললেন। তার মা তাকে উৎসাহ দিচ্ছে কাছে যাওয়ার জন্য। গুটিগুটি পায়ে কিরণ হেঁটে যায় তার বাবার কাছে। লোকটি দুহাত বাড়িয়ে কিরণকে কোলে তুলে নিলো।

কিরণ জড়তা নিয়ে বলল, ‘আব্বা।’

লোকটির চোখমুখ উজ্জ্বল হলো। কিরণকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই বুকে কিরণ শান্তি খুঁজে পেল হঠাৎ করে। সেও তার ছোট ছোট হাত দিয়ে তার আব্বার গলা জড়িয়ে ধরল। এখন থেকে সে সবাইকে বলতে পারবে তার আব্বা আছে।

কিরণের বাবা তাকে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যেত। বাবাকে পাশে পেয়ে কিরণের ভয় দূর হলো। সে তার সহপাঠীদের বলল এখন যদি তারা কিছু করে তাকে তাহলে সে তার আব্বাকে বলে সবাইকে পুলিশে দিয়ে দিবে। সহপাঠীরা জেলে ঢোকার ভয়ে কিরণকে কিছু করতে পারত না আর। কিরণ তখন মাথা উঁচিয়ে চলাফেরা করত। কিরণের বাবা সবসময় তার ঢাল হয়ে পাশে থাকতো। সে তার বাবাকে ডাকে সুপারম্যান।

একদিন তার বাবা তাকে নিয়ে গেল কাকন পাড়ায়। এই পাড়া তার গ্রামের তিন গ্রাম পর। সেদিন ছিল ঝড়ো বৃষ্টি। সে আর তার বাবা যাচ্ছে মমতা আন্টিদের বাসায়। বাতাসে মাটির সোঁদা গন্ধ। কিরণের বাবা কিরণকে কোলে নিয়ে কাদা মাটির রাস্তা পার হয়ে কাকন পাড়ায় ঢুকেন। বজ্রপাতের শব্দে কিরণ বাবাকে শক্ত করে ধরে। তার বাবার পিঠ ভিজে গেছে বৃষ্টিতে। ছাতাটা কিরণের দিকে দিয়ে কিরণকে ঘিরে দিয়েছেন যাতে কিরণ না ভিজে।

মমতা আন্টির বাসায় পৌঁছানোর পর কিরণের বাবা দ্রুত একটা তোয়ালে নিয়ে কিরণের মাথা মুছিয়ে দেন, যদিও কিরণ ভিজেনি। কিরণ তার বড় বড় চোখ মেলে বাড়িটাকে দেখল। সে কখনো মমতা আন্টিদের বাসায় আসেনি। এটাই প্রথম। সে চিনেও না মমতা আন্টিকে। তিনি নাকি বাবার কেউ হন। কিরণ ভেতরে গিয়ে দেখল পুরো বাড়িটা অন্ধকার, একটা হারিকেন সামনের রুমে জ্বালানো। বাড়িটা তাদের টিনের ঘরের মতো না, বিল্ডিং। অনেক সুন্দর করে সাজানো। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে চারপাশ আলোকিত করছে, আবার ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।

তার বাবা তাকে সোফায় বসিয়ে কোথাও গিয়েছেন জানি। দুই ঝুঁটি করা কিরণ মাথা দুপাশে নাড়িয়ে সোফায় পা দুলিয়ে দুলিয়ে চারপাশটা দেখতে লাগল। তার হাতে ম্যাংগোবার।

হঠাৎ এমন জোরে বিদ্যুৎ চমকালো যে কিরণের ছোট্ট আত্না বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে চিৎকার করে উঠল। কান চেপে ধরল দুহাতে। ম্যাংগোবার পড়ে গেল মেঝেতে।

‘মামনি ভয় পেলে নাকি?’

কারো গলার স্বর শুনে কিরণ চোখ মেলে তাকায়। কাউকে দেখতে পায় না অন্ধকারে। তখন আবার বিজলি চমকালো। বিজলির ঝলকানিতে সে দেখলো একজন লোক তার সোফার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা ঠিক তার বাবার বয়সী। তখন সে তার বাবাকে দেখল পাশে। লোকটা কিরণকে এক পলক দেখে চলে গেল কোথাও।

কিরণের বাবা এসে কিরণের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিতেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবার বুকে। তার বাবা তাকে কোলে করে একটা রুমে নিয়ে গেল। খাটে বসিয়ে তার পাশে বসলেন তিনি। কিরণ দেখল ঐ লোকটা খাটের সামনে চেয়ারে বসে আছে।

‘কিরণ, আম্মু।’

কিরণ বাবার দিকে চায়, ‘জি আব্বা।’

কিরণের বাবা কিরণকে নিজের কোলে বসিয়ে কপালে চুমু দিলেন।

‘আব্বা তোমাকে কত ভালোবাসি জানো?’

কিরণের মুখে হাসি ফুটল। সে হাসি হাসি মুখে বলল, ‘জি আব্বা জানি।’

কিরণের বাবা কিরণের নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘তাহলে বলো তো কত ভালোবাসি?’

কিরণ দুহাত দুইপাশে ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এত্তগুলা।’

‘তুমি আমাকে কতগুলা ভালোবাসো?’

কিরণ হাতগুলো আগের চেয়েও টান টান করতে লাগল, ‘এত্ত এত্তগুলো।’

কিরণের বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘এইতো আমার ভালো মেয়ে। এখন শুনো। এই যে আঙ্কেলটা দেখছো না?’

তিনি লোকটার দিকে আঙুল দিয়ে নির্দেশ দিলো। কিরণ তার দিকে তাকাল।

‘এই আঙ্কেলটাও তোমাকে অনেক ভালোবাসে জানো?’

‘আমি তো আঙ্কেলটাকে চিনি না আব্বা।’

‘কিন্তু উনি তোমাকে চিনে, তুমি যখন ছোটো ছিলে তখন থেকে চিনতো। উনি কিন্তু তোমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে।’

কিরণের কথাটা বিশ্বাস হলো না। তার আব্বার চেয়ে বেশি এই দুনিয়ায় কেউ তাকে ভালোবাসতে পারে না, না না। কিরণের চিন্তিত মুখ দেখে তার বাবা বলল,

‘ঐ আঙ্কেলটা তোমার জন্য অনেক আইসক্রিম কিনে রেখেছে, অনেক চকলেটও আছে।’

কিরণের চোখ চকচক করে উঠে, ‘সত্যি!’

‘হুম, তবে আগে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।’

কিরণের মুখ মলিন হয়ে গেল। চকলেট, আইসক্রিমের জন্য কাজ করতে হয় নাকি? সে জীবনে প্রথম শুনলো।

‘কঠিন কাজ না। ঐ আঙ্কেলটা তোমাকে আজকে একটু আদর করবে। তারপর তোমাকে অনেকগুলো চকলেট দিবে।’

‘আদর?’ কিরণের চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করল।

কিরণের বাবা কিরণের কপালে আর গালে চুমু দিয়ে বলল, ‘এই যে, আব্বা যেমন তোমাকে আদর করি, এই আঙ্কেলটাও তোমাকে এভাবে আদর করবে। তুমিও আঙ্কেলটাকে এভাবে আদর দিয়ে আসো। যাও মা।’

কিরণ বিভ্রান্ত। তার ছোট্ট মাথায় কিছুই ঢুকল না এসব। বাবার জোরাজুরিতে সে আঙ্কেলের কাছে গেল। এক আঙুল মুখে পুরে সে চিন্তা করতে লাগল। বাবার চোখের দিকে তাকাতেই বাবা তাকে চোখের ইশারায় আঙ্কেলের কোলে যেতে বলল। আঙ্কেল নেওয়ার জন্য হাত বাড়াচ্ছেন। কিরণ তার কোলে উঠে গালে দ্রূত একটা চুমু দিয়ে নেমে গেল। একহাত বাড়িয়ে বলল,

‘এবার আমার আইসক্রিম চকলেট দাও।’

কিরণের বাবা রাগী মুখে বললেন, ‘এটা কী করলে? তোমাকে বলেছি না আঙ্কেলের কোলে যেতে?’

কিরণ ভয় পেয়ে গেল। সে কখনোই তার বাবাকে এত রেগে যেতে দেখেনি। সে সোফার সাথে ঘেঁষে দাঁড়াল ভয়ে। লোকটি কিরণের বাবাকে ধমকে উঠলেন,

‘ফারুক! এভাবে কথা বলছো কেন ওর সাথে? দেখলে না ভয় পাচ্ছে কেমন।’

তারপর কিরণের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘এখানে আসো আম্মু। তোমার আব্বাকে আমি বকে দিয়েছি। আর তোমাকে বকবে না।’

এই বলে তিনি কিরণকে কোলে নিলেন। কিরণের বাবা শান্ত হয়ে কিরণের কাছে এসে বলল,

‘আব্বার ভুল হয়েছে মা, এমনটা আর করব না। তোমাকে এখন আঙ্কেল আদর করবে, তুমি চুপ থাকবে একদম কেমন?’

কিরণ একবার আঙ্কেলের মুখে আরেকবার বাবার মুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, ‘আমার আইসক্রিম লাগবে না আব্বা।’

কিরণের বাবা রাগ সামলাতে গিয়ে লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত হন। তিনি কিরণের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘কেন লাগবে না? তোমার প্রিয় ভ্যানিলা ফ্লেভারের আইসক্রিম আছে অনেকগুলো। তুমি একদম ভয় পাবে না। আব্বা তো আছি তোমার সাথেই। কেমন?’

তিনি আরো ভুলিয়ে ভালিয়ে কিরণকে বুঝালেন। কিরণ যখন স্বাভাবিক হলো তখন আঙ্কেলটি কিরণকে বিছানায় নিয়ে গেল। তার বাবা সোফায় বসে পড়লেন। লোকটি কিরণের হাতে কতগুলো চকলেট দিয়ে মজার মজার কথা বলে কিরণকে হাসালেন। চুলে বিলি কেটে দিলেন, গালে আদর দিলেন। অতঃপর ধীরে ধীরে কিরণের পায়ে হাত বুলিয়ে পেটে হাত বুলাতে লাগলেন। কিরণ সেই বয়সে ব্যাড টাচ সম্পর্কে অবগত ছিল না। সে ভাবছে তিনিও তার বাবার মতো আদর করছে।

‘আম্মু, আমি তোমাকে তোমার আব্বার চেয়েও আরো বেশি আদর করব। তোমার ভালো লাগবে দেখো।’

কিরণ চকলেট খাওয়ায় ব্যস্ত ছিল। সেই কথা তার কানে গেল না। লোকটি কিরণের জামার ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে বুকে রাখলেন। কিরণ চমকে উঠল। তার বাবা তো তাকে এভাবে আদর করে না। সে আঙ্কেলের হাত সরিয়ে দিতে লাগল,

‘আমার আব্বা এভাবে আমাকে আদর করে না আঙ্কেল। ছাড়ো আমাকে।’

‘আমি তো বলেছি আম্মু, তোমার আব্বার চেয়েও বেশি আদর করব আমি। এটাও একটা আদর। আঙ্কেল কি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি? তুমি কি ব্যথা পাচ্ছ আমার আদরে? বলো?’

কিরণ দুদিকে মাথা নাড়ল।

‘এই আদরে ব্যথা পাওয়া যায়না মামনি।’ বলেই তিনি তার হাত কিরণের আরো গভীরে ছোঁয়ালেন। কিরণ তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। তার বাবা তাকে আশ্বাস দিচ্ছেন। কিরণের মনে হলো, তার বাবা যখন সাথে আছে তখন ভয় কিসের। তার বাবা তো সুপারম্যান। তার বাবা যেহেতু একা ভালো বলছে তাই এটাই ভালো।

লোকটা কিরণকে খাটে শুয়িয়ে তার অন্তরঙ্গে হাত ছোঁয়ালেন। এভাবে আস্তে ধীরে তিনি চরম পর্যায়ে চলে গেলেন। কিরণ চিৎকার করে উঠল। তার চোখ বেয়ে পানি ঝরছে অনবরত। তার বাবা পাশে এসে তার চুলে হাত বুলিয়ে বিভিন্ন কথা বলে যেতে লাগল। কিন্তু কিরণের যন্ত্রনায় তার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। সে পরপর অনেকবার চিৎকার করে উঠল। ঝড়ের দাপটে তার চিকন কণ্ঠের চিৎকার আশেপাশের কারো কানে গেল না।

সে আর্তনাদ করে বাবাকে ডেকে উঠল, তার সুপারম্যান বাবা তাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিবে এই আশায়। ‘আব্বা আব্বা ও আব্বা, আমার অনেক ব্যথা করছে আব্বা। আঙ্কেলকে বলো সরতে, আব্বা… ‘

সে অনবরত বাবাকে ডেকেই চলছে। তার আর্তচিৎকার বাবা নামক মানুষটার হৃদয় অবধি পৌঁছাল না। বোধকরি, কান অবধিও যায়নি!

কিরণের ছোট্ট দেহটা নগ্ন অবস্থায় বিছানায় পড়ে। তার চারিদিকে রক্ত মাখা। আঙ্কেল নামক লোকটি তার হাতে কি যেন দিয়েছেন। এটা হাসপাতালে দেখেছে কিরণ। একটা প্যাকেটের সাথে পাইপ লাগিয়ে হাত অবধি দেওয়া। কিরণের দুর্বল চোখজোড়া আধবোজা। সে বিড়বিড় করে বাবাকে ডাকছে। তার চুল এলোমেলো। কোমল শরীরটায় নৃশংসতার ছাপ।

সে আধবোজা চোখে এতটুকু দেখতে পেল, তার আব্বাকে ঐ আঙ্কেলটা কয়েক বান্ডিল টাকা তুলে দিচ্ছেন। তার চোখ বুজে আসছে। শরীর ব্যথা করছে। চৈতন্য হারাবার মুহুর্তে সে আবছা করে শুনতে পেল ঐ লোকটা বলছে,

‘কালকে আবার, ডাবল পাবে..’

সকালে কিরণের যখন ঘুম ভাঙল সে দেখল তার গায়ে নতুন জামা। বাহিরে এখনো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। ঐ পাইপটা এখনো তার হাতে লাগানো। সে উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না। গতকালকের ব্যথা অনেকটা কমেছে। তার মনে হয় তার গায়ে কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। একবার চুলার কাছে লাকড়ি দিয়ে দুষ্টুমি করতে গিয়ে হাতে আগুন লেগেছিল। সেইরকম ব্যথা তার শরীরে।

সে দেখল তার বাবা দরজা খুলে আসছে। তার মুখে লেপ্টে আছে চওড়া হাসি। হাতে কত রকমের খাবার। তিনি এসে কিরণকে ধরে উঠে বসিয়ে দিলেন। কিরণ বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কান্নার তোড়ে সে কিছু বলতে পারল না। শুধু বলল, ‘আব্বা..আব্বা…ঐ… ‘

কিরণের বাবা তার কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘কিচ্ছু হয়নি আম্মু। দেখছো না তোমার জন্য কত্ত মজার মজার খাবার এনেছি। তোমার জামাটা দেখছো? তুমি না পরীর ড্রেস পরতে চাইছিলে? আব্বা তো কিনে দিতে পারিনি। ঐ আঙ্কেলটা তোমাকে দিয়েছে। আরো অনেক পরীর ড্রেস আছে তোমার জন্য।’

এই বলে তিনি কিরণের চোখ মুছিয়ে দিলো। কিরণ হেঁচকি তুলতে লাগল শুধু।

আঙ্কেলটা আবার রুমে আসলেন। কিরণ তাকে দেখে আতঙ্কে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। বাবা অভয় দিয়ে বললেন,

‘তুমি যে কালকে আঙ্কেলকে খুশি করেছো তাই আঙ্কেল তোমাকে এতকিছু দিয়েছে। আঙ্কেলকে একটা ধন্যবাদ দাও।’

কিরণ তার বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে রাখে। তার ভয় করছে ঐ আঙ্কেলটাকে।

কিরণ দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। তার পাতে কয়েক রকমের খাবার। সে হা করে দেখছে। তার বিশ্বাস হয় না এত খাবার যে তার জন্য। আগে তো সবসময় ডাল আর আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খেত। বড়জোর হলে এক টুকরা মাছ জুটতো কপালে। অথচ আজ কত খাবার, মুরগীর মাংস সাথে আরো কত কী, কিরণ তার নামও জানে না।

কিরণরা নাকি এখানে তিনদিন থাকবে। নোকিয়া বাটন ফোনে মায়ের সাথে কথা বলার মুহুর্তে তার বাবা তাকে বলেছিল,

‘গতকাল যা যা হয়েছে তা কিন্তু ভুলেও মা কে বলবে না। বললে কিন্তু আব্বা অনেক কষ্ট পাবো।’

কিরণ তার আব্বাকে কষ্ট দিতে চায় না। তার আব্বা তার কাজে কষ্ট পাবে সে এটা হতেই দিবে না। তাই সে আব্বা যা যা শিখিয়ে দিলো, মাকেও তা তা বলল।

পরদিন রাতে আবার আঙ্কেলটা তার রুমে আসলেন। তাকে সেই আগের ন্যয় আদর করলেন। কিরণের এবার খুব ব্যথা লাগল। আঙ্কেলটাকে কেমন যেন রাক্ষসের মতো লাগল। ঠাকুরমার ঝুলিতে যেমন রাক্ষস থাকে তেমন। সে এবার আরো বেশি চিৎকার করল। কিন্তু এবার তার বাবাকে দেখতে পেল না সে। আঙ্কেলটা দরজা আটকে দিয়েছে। বৃষ্টির ছাটে জানালার পর্দা ভিজে চুপচুপে। কিরণ আঙ্কেলটাকে কান্নারত কণ্ঠে অনুরোধ করল,

‘আমার আব্বাকে আসতে বলুন আঙ্কেল, আমি আব্বার কাছে যাব। আব্বা..’

‘আমি আছি তো মামনি। তোমার আব্বা ভাত খাচ্ছে। খাওয়ার সময় কাউকে ডিস্টার্ব করতে নেই।’

কিরণ আঙ্কেলটার পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়ল,

‘আঙ্কেল, আব্বাকে…আব্বাআআ… ‘

কিরণের গলা ভেঙে আসছে। বুক ধড়ফড় করছে ভয়ে। চোখে আকুতি মিনতি। চেহারা নীলবর্ণ ধারণ করেছে ভয়ে। তা দেখে আঙ্কেলের মন গলল না। তিনি এবার জোর করে কিরণকে খাটে ছুঁড়ে মারলেন। আকাশ গর্জন করে উঠল ক্ষণে ক্ষণে, বিজলি চমকায়। লোকটা পাষাণের ন্যায় খুবলে খুবলে খেল কিরণের কোমল দেহটা। কিরণ একসময় ভয়ে, যন্ত্রণায় আবার জ্ঞান হারাল।

কিরণ যখন নিজের বাড়িতে ফিরে তখন তার বাবা তাকে কসম কেটে বলেছিল, এসব যাতে কাউকে না বলে। মাকেও না। যদি বলে কেমন ঘুরেছ, তাহলে যাতে সে বলে আঙ্কেল আন্টি অনেক ভালো। তাকে অনেক আদর করেছে। অনেক ভালো ভালো খাবার খাইয়েছে।

এই ঘটনার বেশ কয়েকদিন কিরণ কেমন মনমরা হয়ে থাকত। কারো সাথে মিশতো না, ঠিক মতো খেত না। চোখমুখ শুকিয়ে দেবে গিয়েছে। কিরণের বাবা কিরণের এই অবস্থা দেখে তাকে অনেক জায়গায় ঘুরিয়ে আনলো। অনেক মজার মজার খাবার দিলো। তাকে অনেকদিন বিভিন্ন জিনিসে ডুবিয়ে রেখে তার মন ভালো করল, পাছে তিনি ধরা পড়ে যান।

কিরণ আবার হাসিখুশি জীবনে ফিরে এলো। তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ঐ ঘটনা এখন হানা দেয় না। প্রতিদিন তার বাবা তাকে তার পছন্দের জিনিস কিনে দেয়। আগে কিনে দিতে পারতো না, কিন্তু এখন দেয়।

কিরণের তখন নয় বছর। তার নাকি একটা ছোট্ট ভাই আসবে শুনেছে। কিরণের মা তার নামও ঠিক করে রেখেছে। কিয়াদ। কিরণের নামের সাথে মিলিয়ে রাখবে। তা শুনে কিরণের কী খুশি! সে সারাঘর মাতিয়ে রাখতো তার ভাই আসবে শুনে। ভাইয়ের জন্য মাটি দিয়ে হাড়িপাতিল তৈরি করত সে। এগুলোয় রান্না করে ভাইকে খাওয়াবে।

তখনও ছিল বর্ষাকাল। টিনের চালে ঝংকার তুলে বৃষ্টির ফোঁটা আগ্রাসীভাবে পড়ছে। কিরণ একহাতে পুতুল জড়িয়ে বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝরাতে হঠাৎ শরীরে কারো স্পর্শ অনুভূত হতেই ঘুম ভেঙে যায় কিরণের। সে দেখে তার আব্বা তাকে জড়িয়ে ধরে আছে।

‘আব… ‘

‘শশ।’ কিরণের বাবা কিরণের মুখ চেপে ধরে আছে।

‘কিরণ মা, কথা বলো না। আজকে আব্বা তোমার সাথে ঘুমালে তুমি কি রাগ করবে? আজকে আব্বার ভয় করছে অনেক।’

কিরণের বাবা কখনোই তার সাথে ঘুমাতেন না। কিন্তু তার সুপারম্যান আব্বার ভয় লাগছে শুনে সে অনেক অবাক হলো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘আব্বা তোমার কেন ভয় লাগছে?’

‘এই যে কেমন বিদ্যুৎ চমকায়।’

‘তাহলে তো মায়েরও ভয় লাগছে।’

‘না, তোমার মায়ের ভয় লাগে না, তোমার মায়ের সাথে তো তোমার ভাই আছে। তাই আমি আজ আমার কিরণের সাথে থাকব।’

‘আচ্ছা।’

কিরণ আবার পুতুল জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। কিরণের বাবা কিরণকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললেন,

‘আম্মু, তোমার আব্বার ভয় লাগছে অনেক। তুমি আব্বাকে আদর করে দেবে না?’

কিরণ স্বভাবসুলভভাবে ফারুকের কপালে চুমু দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল।

‘এই আদর না কিরণ। আমি তোমাকে আরেকটু বেশি আদর করব।’

‘সেটা কী আব্বু?’

‘তবে প্রমিস করো তুমি তোমার আম্মুকে বলবে না। তাহলে তোমাকে মেলায় নিয়ে যাব।’

‘আচ্ছা, প্রমিস।’

কিরণের বাবা এবার কিরণকে বাজেভাবে ছুঁতে লাগল। সেই মুহুর্তে কিরণের ঐ রাক্ষস আঙ্কেলটার কথা মনে পড়ল। সে বাবাকে সরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আব্বা কী করছো?’

কিরণের আব্বা বিড়বিড় করে কী বলল কিরণ শুনল না। তার মুখ পাংশুটে হয়ে গেল ভয়ে। কিরণকে তার আব্বা জোর জবরদস্তি করতে লাগল। কিরণের লঘু শরীরের শক্তি তার বাবার শক্তির সাথে পেরে উঠল না। সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, গলা কাটা মুরগীর মতো হাত পা নাড়িয়ে তড়পাচ্ছে। তার আব্বা তার সাথে ঐ রাক্ষসটার মতো করবে সেটা সে ভাবেনি। তার বাবা তার সুপারম্যান। বাবা কেন তার সাথে এমন করছে?

কিরণের মায়ের ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। দেখলেন পাশে তার স্বামী নেই। এটা তার দ্বিতীয় বিয়ে। কিরণের দুমাসের সময় কিরণের বাবা মারা যায়। তারপর পরিবারের জোরাজুরিতে তিনি ফারুককে বিয়ে করেন। ফারুক একটা অফিসের দারোয়ান।

কিরণের মা ফারুককে খুঁজতে উঠেন। ভাবেন হয়তো বাথরুমে গেছে। তিনি জানালা খুলে দেখেন বাহিরে ঝড় বইছে। এই ঝড়ে মানুষটা একা একা গেল? লাইটাও নিল না সাথে। কিরণের মা ডাইনিং রুমে আসতেই ক্ষীণ চিৎকার তার কানে বাজে। চিৎকারটা কিরণের রুম থেকে আসছে। বৃষ্টির আওয়াজে তিনি ভালো করে শুনেন না। তাই কিরণের রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। যেতেই তার ভেতরের হৃৎপিন্ডটা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তিনি বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। শ্বাস নিতে লাগলেন বড় বড়।

ফারুক তার মেয়ের রুমে তার মেয়েকে ধ’র্ষণ করছে। কিরণের দেহটা চাপা পড়ে আছে ফারুকের শরীরের নিচে।

কিরণের মা দ্রুত উঠে লাইটটা অন করে ফারুকের মুখের দিকে দিলেন। হঠাৎ আলো লাগায় ফারুক চমকে উঠে। নিজের স্ত্রীকে দেখে থতমত খেয়ে যান তিনি।

কিরণের মা মুখে হাত দিয়ে কান্না করে দেন,

‘কিরণের বাপ। তুমি এটা কী করলে?’

ফারুক দ্রুত উঠে লুঙ্গি পরে নেন। ভয় না পেয়ে সোজা গিয়ে মমতাজের টুঁটি চেপে ধরেন। কটমট করে বললেন,

‘খা’নকি মা’গী, একটা কথা মুখ দিয়া বাইর হইব তো তোর আর তোর মাইয়ার লাশ কালকে নদীতে ভাসামু আমি। একটা কথাও কবি না। মুখ বন্ধ রাখবি। নাইলে পেটেরটাও হারাবি।’

এই বলে মমতাজকে ছেড়ে চলে গেলেন। মমতাজ এগিয়ে যায় তার মেয়ের পানে। কিরণ হাত পা নাড়িয়ে ছটফট করছিল আর মাকে ডাকছিল।

‘মা, ও মা, আব্বা অনেক খারাপ…’

কিরণের মা কিরণকে উঠিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন নিজের বুকে। ভেবেছিল তার কিরণটা বাবার ভালোবাসা পাবে, কিন্তু এখন তো…! তার প্রথম স্বামী মেয়ের নাম রেখেছিলেন কিরণ। কারণ তার মেয়ে তার জীবনে আলো এনে দিয়েছেন।কিন্তু মমতাজ কিরণের জীবনে কিরণ আনতে পারেননি।

কিরণ তখন কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘আব্বা ঐ রাক্ষসটার মতো হয়ে গেছে মা… ঐ রাক্ষসটাও আমার সাথে এমন করেছে।’

কিরণের মা কিরণকে সামনে বসিয়ে ভ্রূকুটি করে বললেন, ‘রাক্ষস মানে? কী হইছে তোর সাথে, সবটা বল।’

কিরণ সবটা বলে দিল। শুনে তার মা স্তব্ধ বনে গেল। তার মেয়েটার সাথে এতকিছু হয়ে গেল অথচ তিনি মা হয়ে জানলেন না? কেমন মা তিনি? এইজন্যেই ফারুকের কাছে এত টাকা ছিল? আর ফারুক কিনা বলে সে আলাদা ব্যবসায়ের লাভ পায়! এই তার ব্যবসা? ছোট্ট মেয়েটাকে অন্য লোকের থাবায় পাঠিয়ে টাকা উপার্জন করে? তার ছোট্ট কিরণটা কতকিছু সহ্য করল এই ছোট্ট জীবনে? মমতাজের তখন ইচ্ছা করছিল কিরণকে গলা টিপে মে’রে নিজে ফাঁ’সি দিতে। মেয়েটার এই কষ্ট তিনি কীভাবে সইবেন? কিন্তু যখন তার পেটের ছেলেটার কথা মনে পড়ে তখন পাপ ক্জ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন।

মমতাজ নিরুপায় ছিলেন। তার পরিবারের কেউ নেই। বাবা মা মারা গেছেন। ভাই বোন কেউ নেই। ফারুক তাড়িয়ে দিলে তিনি পেটেরটাকে নিয়ে কোথায় যাবেন? নিজেও খেটে খেতে পারেন না। তাই তিনি পরদিন সকালে ফারুককে না জানিয়ে পাশের বাসার এক মহিলাকে দিয়ে কিরণকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলেন। ফারুক এসে তা জেনে অনেক মারল মমতাজকে। কিন্তু তাও মমতাজ মুখ খুললেন না কিরণের ব্যাপারে।

সময় যত যেতে লাগে কিরণের ততই চুপচাপ হতে থাকে। তখন থেকেই সে বোডিং এ থাকে। তার মা মাসে এক দুবার লুকিয়ে এসে দেখে যায় তাকে। সাথে আনে ছোট্ট ভাইটাকে। কিরণ তার ভাই ছাড়া আর কারো সাথেই তেমন মেশে না। সময়ের পরিক্রমায় কিরণ বুঝতে পারে যে সে রেইপড হয়েছে ঐ লোকটা এবং তার বাবা নামক নরপশুর কাছে। বাবা না, সৎ বাবা হবে। বোঝার পর কিরণের জীবনও বদলায়। আগের হাসিখুশি কিরণ মুখ গোমড়া করে রাখে এখন। হোস্টেলে নিজের মতো করে থাকে। খেলে না, মুখ গম্ভীর হয়ে থাকে তার, মনমরা করে রাখে, কেউ নরমাল কথা বললেও সে খিটমিটে হয়ে যায়, মারামারি করে। বাবা নামটার উপর তীব্র ঘৃণা জন্মে। শেষ কবে সে মুখ ফুটে হেসেছে বলতে পারবে না সে। সুখ নামক জিনিসটা তা জীবন থেকে হারিয়ে যায়। জীবনের ছন্দপতন হয়।

.
.
চলবে…