#বিষাক্ত_ভালোবাসা
পর্ব: ০২
লেখনীতে : শারমিন আক্তার বর্ষা
— জ্ঞা’ন ফিরে নিজেকে বিছানার ওপর উপ’ল’ব্ধি করলাম। বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলের ওপরে পরে থাকতে দেখলাম ছোট্ট একটি খাম। মাথাটা ঝিমাচ্ছে,চোখ ঝাপসা ঝাপসা লাগছে,কোনো কিছু বোঝার আগে রুমের মধ্যে প্রবেশ করল একজন মহিলা। কড়াকড়ি ভাবে তাকাতে দেখলাম মহিলাটি আর কেউ নয় বরং আমার মা। মা’কে দেখে আমি রীতিমতো হকচকিয়ে ওঠলাম। মা আমার কাছে এসে বিছানার ওপরে বসলেন। আমার চুলে কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে করুণকণ্ঠে বলেন,
— বউমার খবরটা শুনে আমি আর বাড়িতে বসে থাকতে পারলাম না। কালকে শুনেছি আর আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠে গ্রাম থেকে শহরে চলে আসছি। তা বউ মাকে আসছি পর থেকে কোথাও দেখছি না। কোথায় সে? আর তুইও কেমন ফ্লোরে পরে ছিলি দরজাও খোলা ছিল। কি হয়েছে?
মা’র কথা শুনে শুঁকনো ঢোক গিললাম। মনে করতে লাগলাম তখনকার ঘটনা। আমাকে চুপ থাকতে দেখে মা আবারও প্রশ্ন করেন তার বউমা কোথায়? আমি এবারও কোনো উত্তর দিতে পারিনি। মা’র চোখে তাকানোর সাহস হচ্ছে না আমার,মাথা নিচু করে নিস্তর বসে আছি। মা’র কথাগুলো আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে, একবার বলছে বউমার খবর শুনে আসছে আবার বলছে খবরটা নাকি কাল শুনেছে। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, কোন খবরের কথা বলছে মা? আমি মা’র মুখোমুখি অপরাধীর মতো তাকালাম। মসৃণ কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম,
— কোন খবরের কথা বলছো তুমি মা? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আমার কথাশুনে মা শব্দ করে হেসে ফেলল। মনে হচ্ছে আমি কোনো জোক্স বলেছি। মা’র উদ্ভট হাসি দেখে আমি অবাক হলাম। ভ্রুকুটি কুঁচকে তাকালাম। আমার হাবভাব লক্ষ্য করে মা হাসি থামায়। আমার কপাল ছুঁইয়ে হাত নামিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে,
— আমার ছোট্ট বাবু যে অনেক বড় হয়ে গেছে। এবার তো তার ঘর আলো করে ছোট্ট রাজপুত্র, রাজকন্যা আসবে। আমার সংসার আলোকিত করবে, পরিপূর্ণ করতে ছোট্ট ছোট্ট নাতি নাতনি আসবে।
মার কথার পিঠে হা হয়ে গেলাম। অস্ফুটস্বরে বলে উঠলাম,
— নাতি নাতনি?
মা আমার ভারী কণ্ঠ শুনে কপাল কুঁচকালেন। ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগী ও গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
— এমন ভাব ধরছিস, মনে হচ্ছে কিছুই জানিস না।বউমার সাথে আমার কাল বিকালে কথা হয়েছে ও আমাকে বলেছে রাতেই তোকে খুশির খবর টা জানাবে। তাহলে, তুই এমন বিহেভ করছিস কেন? মনে হচ্ছে তোকে সে বলেনি।
অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। মা’র কথায় জেনো,আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। মুখ ফুটে কথা বের হচ্ছে,মনে হচ্ছে আমি কথা বলার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলছি। আমতা আমতা করে বললাম,
— খুশির খবর?
মা আমার আগের মত খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমার মাথায় হাত রেখে বলল,
— হ্যাঁ রে। তুই বাবা হতে চলছিস আর বউমা মা হতে চলেছে। বউমা দুই মাসের গর্ভবতী। আমাকে কাল বিকেলে কল দিয়েছিল। হুটহাট মাথা ঘুরানো বমি বমি ভাব বলে,হাসপাতালে যায় তখন প্রেগন্যান্সি টেস্টে কনফার্ম হয় ইয়ানা, ও-যে প্রেগন্যান্ট আর ও তখনই আমাকে ফোনে খবরটা জানায়। আমি তো খুশিতে তখনই চলে আসতাম। কিন্তু আসতে আসতে অনেকটা রাত হয়ে যাবে বলে আসিনি সকাল হতেই শহরের উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বের হই। তাছাড়া বউমা তো আমাকে বলেছিল সে তোকে নিজে এই খবরটা দিবে তাহলে এবার কেন দিল না। ভুলে গেলো কিভাবে? বউমা তো এতটা কেয়ারলেস নয়। মা হবে বলে, তো তার মুখ থেকে হাসি থামছিল’ই না। বিয়ের ছয় মাস পর, গর্ভধারণ করতে সক্ষম হয়েছে মেয়েটা। একটা বাচ্চার জন্য কতই না আল্লাহর কাছে আর্যি করেছে। অবশেষে আল্লাহ মেয়ে টার চাওয়া পূরণ করেছেন। তা আমি এতক্ষণ ধরে বকবক করছি তুই একবারও বললি না, বউ মা কোথায়? তাকে একটু দেখে নিজের চোখ টাকে জুড়াতে চাই। কোথায় সে?
কথা বলতে বলতে মা’র চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরল। আমি এখনও মায়ের কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। অপলকভাবে তাকিয়ে রইলাম। মনে পরল তখন ইয়ানার মেসেজ টার কথা,সে বলেছিল সারপ্রাইজ দিবে। কিন্তু তা আর দিলো কোই?
মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে,তবুও বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালাম। ছোট্ট টেবিলের ওপরে থাকা খামটা হাতে নিলাম, খামের ভেতরে দেখলাম একটা সাদা কাগজ,কাগজটা হাতে নিয়ে দেখি তাতে কিছু লিখা। মা আমার হাতে কাগজ দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
— বাবু তোর হাতে কি ওটা? কি লেখা আছে ওই কাগজে? ছোট থেকে মা আমাকে বাবু বলে ডাকে আর এখনও তাই, উনার এই অভ্যেসটা এখনও যায়নি। মাকে বললাম,
— দাঁড়াও আমি দেখে তোমাকে বলছি।
কাগজটা খুলে দেখি, ইয়ানার নিজ হাতে লিখা কিছু কথা, শব্দ করে পড়তে লাগলাম,
— তোমার সবটা জেনেই তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম। ভেবেছিলাম আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে একদিন তোমার সব বদঅভ্যেস গুলো পাল্টে ফেলবো। কিন্তু আমি সবটা পারিনি। হয়তো আমার ভালোবাসায় কমতি ছিল। তাইতো তুমি পেরেছো আমাকে নিয়ে বাজি খেলতে,যাইহোক এমনটা করা কি খুব বেশি জরুরি ছিল ইয়াসির? জানি না বিশ্বাস করবে কী না। তবে সত্য বলছি আমাকে তুমি কোনো জায়গায় ছাড়োনি একদম জীবন্ত লা’শ বানিয়ে দিয়েছো। বাবা মা’র বাড়ি থেকে শুধু এক কাপড়ে বের হয়ে আসছিলাম, তোমার হাত ধরে তোমায় ভালোবেসে। আর তুমি কি করলে ইয়াসির? জানো কাল রাতে তুমি আসার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত আমি অনেক এক্সা’ইটেড ছিলাম, কখন তুমি আসবে আর কখন আমি তোমাকে বলবো, আমরা বাবা মা হতে যাচ্ছি। খুশির সীমা ছিল না আমার। যতটা না খুশি হয়েছিলাম তার থেকেও ডাবল যন্ত্রণা তুমি আমাকে দিয়েছো। বিকেল থেকে কত স্বপ্ন বুনে ছিলাম, সে স্বপ্ন আকাঙ্খা তুমি নিজ হাতে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছো ইয়াসির, আমি ইয়ানা মেহফাজ তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু ইয়াসির একটা কথা তুমি মনে রেখো, জীবনে কখনো শান্তি তে থাকতে পারবে না। তুমি যে অন্যায় করেছো আমার ও আমাদের বাচ্চার সাথে তা তোমাকে প্রকৃতি ঠিক একদিন ফিরিয়ে দিবে।
মাথা ঘুরিয়ে আসলো ধুপ করে বিছানার ওপরে বসে পরলাম। মাথা কাজ করছে না। নিজেকে পাগল,পাগল ঠেকছে। বুকের মধ্যে কম্পন বয়ে যাচ্ছে,শোক ছিল স্ত্রী হারানোর সেখানে এখন শোক দ্বিগুণ হয়েছে। অশ্রুসিক্ত চোখে মা’র দিকে তাকালাম। মা ওঠে এসে আমার পাশে বসে। কাঁধে হাত রেখে শুধালো,কি হয়েছে?
আমি ডানেবামে মাথা নাড়ালাম। কিছু হয়নি। মনে মনে মনস্থির করলাম, যে কোনো কিছুর মূল্যে হলেও আমাকে আমার ইয়ানা কে ফিরিয়ে আনতে হবে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়,মা’কে বলে আসছি। তোমার বউ মাকে আনতে যাচ্ছি। তবে বিপত্তি সৃষ্টি হল তখন,যখন তায়েফের বাড়ি পৌঁছে ওখানে আমি ইয়ানা কে পেলাম না। তায়েফ তার বাড়ির উঠানের দক্ষিণ দিকে একটা কাঁঠাল গাছের নিচে চেয়ারে বসে আয়েশ করছে। আমাকে দেখে সে নড়েচড়ে ওঠে,আমি সোজা দৌঁড়ে গিয়ে ওর পায়ে পরে যাই। হাত দু’টি জোড় করে বলি,আমার স্ত্রী কে আমাকে দিয়ে দাও,বিনিময়ে আমার যা আছে সব তুই নিয়ে নে।
তায়েফ অপদস্তক চোখের পলক ফেলে,শুঁকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে আমাকে বলে,
— আমাকে ক্ষমা করে দিস ভাই। জানি না, আমার কি হয়েছিল? আমি তোর সাথে অন্যায় করেছি। ভাবীর সাথেও অন্যায় করেছি। আমি ভাবীকে নিয়ে আসার সময়,তিনি আমার পা ধরে কান্নাকাটি শুরু করে। এবং তিনি বলেন,উনি প্রেগন্যান্ট আমি নিজের ভুল বুঝতে পারছি।
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরা অশ্রুকণা মুছে নিয়ে মসৃণ কণ্ঠে বললাম,
— তোর ভাবীকে নিয়ে আয় যাহ তায়েফ, ওকে গিয়ে বল আমি ওকে নিতে আসছি। তায়েফ অবাক কণ্ঠে বলে,
— ভাবী তো আমার বাড়িতে নাই। উনি তো রাস্তা থেকেই কোথায় জেনো চলে গেছে। আমি ভাবছিলাম তোর কাছে যাবে। তোর নাম্বারেও অনেকবার কল দিয়েছি রিং হয়েছিল কিন্তু তুই রিসিভ করিসনি।
চলবে?