বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব-১১+১২

0
252

#বিষাক্ত_ভালোবাসা
#পর্বঃ১১
লেখিকা: #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

– ‘এত রাতে এই নির্জন রাস্তা দিয়ে যাওয়া কী ঠিক হচ্ছে আরিশ? কোনো গার্ড ছাড়া নির্জন পথ জানিসই তো তোকে সব সময় টার্গেট করে। এখন যদি কোনো বিপদ হয়।
পাশে বসা ওয়াসিফের কথা শুনেও, না শোনার মত জিপ চালাচ্ছে আরিশ। ওয়াসিফের ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই আরিশের। রাতের মধ্যভাগ, ঘন জঙ্গলের মাঝে একটা রোড দিয়ে যাচ্ছে জিপটা। কিছুপথ দূরে, এসে জিপটা থামালো আরিশ। রাস্তার মাঝে বড়বড় দুইটা গাছ ফেলা,দেখে কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকালো আরিশ৷ স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে,দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁট জোড়া নিবদ্ধ করে। তীক্ষ্ণ ও চোখে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে বলে,

– ‘গাড়ি থেকে নাম ওয়াসিফ।’ আরিশের কর্কশকণ্ঠ শুনে ওয়াসিফ আরিশের মুখোমুখি তাকাই। অস্ফুটস্বরে বলে,
– ‘A.S আমি এমনই কিছুর সন্দেহ করছিলাম। ওরা জেনে গেছে আমরা এই পথ দিয়ে যাচ্ছি। আমার নিজের জন্য চিন্তা হচ্ছে না বিশ্বাস কর ভাই। আমার তোর জন্য চিন্তা হচ্ছে।’
এতক্ষণ আরিশের দৃষ্টি অন্য দিকে থাকলেও এখন সে মাথা ঘুরিয়ে ওয়াসিফের দিকে তাকাল, মৃদুস্বরে বলে,
– ‘আমি আছি। বিশ্বাস করিস তো আমাকে? আমি থাকতে কারো কোনো ক্ষতি হতে দিবো না। ইন শা আল্লাহ! এখন জিপ থেকে নাম।’
A.S আরিশের কথামত ওয়াসিফ জিপ থেকে নামে। অন্য দিকে আরিশ নিজেও গাড়ি থেকে নামে। জঙ্গলের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে,ওরা এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনদিকে যাবে। সামনে গেলে বিপদ অনিবার্য, পিছনে ওদের লোক থাকবে এটা সন্দেহ। এখন রহিল জঙ্গলের দুইদিক। আরিশ গম্ভীর হয়ে একবার হাতের ডানপাশে ও আরেকবার বামপাশে তাকাচ্ছে। হাতের ডানপাশ থেকে অদ্ভুত শব্দ কর্ণকুহরে আসছে। মনে হচ্ছে, মাটিতে পড়ে থাকা শুঁকনো পাতাপুতা পাড়িয়ে অনেকে এদিকে আসতাছে সেটাও বরই সাবধানতার সাথে। আরিশ ভ্রু কুঁচকে বামপাশে তাকিয়ে বলল,

– ‘এদিকটায় মনে হচ্ছে, কেউ নেই চল দ্রুত।’
আরিশ ও ওয়াসিফ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দৌঁড়াতে লাগল। হঠাৎ একটা গু’লি এসে গাছে লাগল। গু’লির শব্দে থমকে দাঁড়ালো আরিশ ও ওয়াসিফ। তারপর ওরাও ওদের পি’স্ত’ল বের করে চারপাশে নজর বুলিয়ে ছুটতে লাগল। ওদেরকে ছুটতে দেখে নিয়েছিল রাজেশ সরকার, ও তখনই ওদের পিছু নেয়। রাজেশ সরকার ওর লোকগুলো সহ আরিশ ও ওয়াসিফের ওপরে আক্রমণ করে। আকাশে চাঁদ নেই,চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এরমধ্যে লোকগুলো গু’লি চালাচ্ছে, ওয়াসিফ ও আরিশ থেমে যায়। দুইটা গাছের আড়ালে দাঁড়ায়। গাছের আড়ালে দাঁড়ায়ে নিজেরাও আক্রমণের পাল্টা জবাব দেয়। দুই পাশ থেকে পি’স্ত’লের গু’লির শব্দ শোনা যাচ্ছে সাথে অনেকের মুখের অ’দ্ভু’ট আওয়াজ। প্রথম গু’লি এসে আরিশের বুকে এসে লাগে। মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ করল। পাশের গাছ থেকে দেখে থমকে গেলো ওয়াসিফ। নিজেকে যথাযথ শান্ত রাখে আরিশ। শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে সে।
রাজেশ সরকার ভীষণ আনন্দিত খুশি হল। তার পি’স্ত’লের শেষ গু’লি টাই আরিশের বুক চিঁড়ে গেছে। অন্য দিকে তার বেশ লোকগুলোকে মে’রে ফেলছে আরিশ। আর মাত্র দু’জন বেঁচে আছে৷ এখন এই দু’জন কে নিয়ে লড়াই করে পাড় পাবে না সে। দু’জনকে রেখে রাজেশ অন্য দিকে ছুটে চলে যায়। এদিকে ওয়াসিফ বাকি দু’জনকে মে’রে ফেলে। পি’স্ত’ল পিছনে গুঁজে আরিশের কাছে ছুটে আসে। বুক চিঁড়ে চুঁইচুঁই করে র’ক্ত বের হচ্ছে, আরিশের শার্ট র’ক্তা’ক্ত ভিজে চিপচিপে হয়ে গেছে। পরনের শার্ট খুলে বুকে টাইট করে বাঁধে তারপর আরিশকে তুলে জিপটার কাছে আসে। এতদূর পথ আরিশকে তুলে নিয়ে আসতে বেশ কষ্ট পোহাতে হয়ে ওয়াসিফ কে কিন্তু তার ওদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা, যে করে হোক আরিশকে হসপিটাল নিতে হবে।
____________
সকাল সকাল ফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙে। ঘুমঘুম চোখে, চোখ মেলে ফোনের স্কিনে তাকাল ইয়াসির। ভাগ্নের জন্য অপেক্ষা করতে ইজি চেয়ারে ঘুমিয়ে পরে। সকাল ছয়টা বেজে গেছে অথচ এখন অব্ধি আরিশ বাড়ি পৌঁছায়নি। চিন্তিত হয়ে, আরিশের নাম্বারে কল দেয়। প্রতিবারের এবারও বলছে,ফোনে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না৷ কিছুক্ষণ পর আবারও চেষ্টা করুন।
উপায় না পেয়ে, আরিশের বন্ধু তাজ ও প্রবীরের নাম্বারে ডায়াল করল সে। দু’জনে কল রিসিভ করে বলে, শহরের বাহিরে গেছে কি একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংয়ের জন্য।
কিন্তু ওদের কথায় মনে স্বস্তি পেলো না ইয়াসির। মনে হচ্ছে, আরিশের কিছু হয়েছে।কেননা, এর আগে আরিশ কখনো ওর ফোন বন্ধ করেনি। যতবড় মিটিং হোক না কেনো?
___________
দুইহাত মুঠো বন্ধি করে ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে ওয়াসিফ। ডাক্তার অনেকক্ষণ যাবত নিরবতা পালন করছে। শ্বাস ফেলে শান্ত কণ্ঠে বলল,
– ‘ চিন্তার কোনো কারণ নেই, গু’লি বুকের পাশ কেটে চলে গেছে। আমি ব্যান্ডেজ করে দিছি। এরপর উনাকে বলবেন সাবধানে থাকতে লড়াই ঝগড়ার মধ্যে না যেতে। এখন উনি সেন্সলেস। কিছুক্ষণ পর,জ্ঞান ফিরলে আপনি উনাকে নিয়ে যেতে পারবেন।’ পুরো মনোযোগ সহকারে ডাক্তারের কথা শুনে ওয়াসিফ। নির্মূল কণ্ঠে ছোট্ট করে, ‘ থ্যাঙ্কিউ’ বলে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে যায়।
আরিশের কেবিনে এসে তার পাশে বসে। তীক্ষ্ণ ও ভারী নিঃশ্বাস ফেলে।
______________
মিসেস সুমাইয়া সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে, উনার জা কে সাথে নিয়ে বেশ হরেকরকমের পিঠাপুলি বানিয়ে ফেলেন। দু’জনে মিলে কাজ করায় তারাতাড়ি হয়ে যায়।
সকাল সাতটা বাজে, শ্যামা ওঠে সবাইকে ঘুম থেকে তুলে এবং সবাই ফ্রেশ হয়ে,একসাথে ডাইনিং টেবিলে আসে। আজ সকালের নাস্তা হচ্ছে, পিঠা। অনেক রকমারি পিঠা বানিয়ে টেবিলের ওপরে সাজানো যার যেটা খেতে ইচ্ছে করবে সে ওটাই খাবে। খাওয়া শেষে ওঠে রুমে চলে আসে রুহানি৷ মা’কে ছাড়া কখনো থাকেনি। বাংলাদেশে আসছে পর থেকে তো মাকে ছাড়াই থাকতে হচ্ছে। রুহানির ফোন শ্যামার ওয়ারড্রবের ওপরে,ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। ফোন দেয় ইয়ানার নাম্বারে৷ নাম্বারটি বারবার সুইস অফ বলছে।
রাতে ইয়ানার শরীর খা’রাপ করেছিল। সে পুরো রাত ঘুমাতে পারেনি। জ্বরে শুধু কাতরেছে। পুরো রাত ইয়ানার পাশে জেগে বসেছিল মেইজি। অসুস্থতার কারণে,ইয়ানা খেয়াল করেনি ওর ফোনে চার্জ নেই ফোনটা যে বন্ধ।
বাড়ির নাম্বারে কল দিতে মেইজি কল রিসিভ করে। রুহানির চিন্তিত কণ্ঠস্বর শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় মেইজি৷ মেইজি চাইলেও সত্য বলতে পারবে না যে, ইয়ানার হেল্থ কন্ডিশন ভালো নয়। হাসপাতালে নিতে হতে পারে। এদিকে রাতেই ইয়ানা বলে রাখছে রুহানি ফোন দিলে ওকে জেনো তার অসুস্থতার খবর না জানানো হয়। নয়তো পরদেশে বেচারী চিন্তা করবে কিংবা মায়ের জন্য কান্না করবে৷ রুহানি দুইটার মধ্যে একটাও জানো না করে সেজন্য মেইজিকে বলতে মানা করেছে। মেইজি ও ইয়ানার কথা রক্ষা করে। লুকিয়ে যায় রুহানির কাছ থেকে। রুহানি মেইজির থেকে কিছু প্রশ্ন করে কল রেখে দেয়। কিছুক্ষণ পর রুমে প্রবেশ করে শ্যামা,রুহানি ও বাকিদের উদ্দেশ্য বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল,

– ‘ তোরা কি আমার বিয়ের শপিংয়ের জন্য যাবি না? না মানে শপিং নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নাই। বিয়ের মাত্র ক’টা দিন বাকি। তোদের জন্য আমি শপিং করিনি।’

শ্যামাকে রাগতে দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল রুহানি নাজিন। মৃদুস্বরে বলল,

– ‘ রাগ করছিস কেন? চল আজকেই যাবো।’
মি.মাহিন কে বলে ক্রেডিটকার্ড নিয়ে মার্কেটের উদ্দেশ্য বের হয়। শপিংমলে এসে এক এক করে অনেকগুলো লেহেঙ্গা দেখতে লাগে। বিয়ে বলে কথা, বউ তো মেয়েরা একবারই সাজে বিয়ে একবারই হয়। সব থেকে গরজিয়াছ লুকের লেহেঙ্গা টাই নিবে শ্যামা। অনেকগুলো লেহেঙ্গা দেখে একটা চুস করল। শপিংমলে আসলে সময়ের জেনো হুদিস থাকে না। টাইম জেনো তিরতির করে চলে যায়। শ্যামার বিয়ের শপিং শেষ হতে পাঁচ ছয় ঘন্টা ফুরিয়ে যায়। শ্যামার সাথে বাকিরাও টুকটাক শপিং করে মল থেকে বের হয়। রাস্তায় একসাথে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে নিশানের সাথে লেগে রাইসা রাস্তার মোড়ে উপুড় হয়ে পরে যায়। হাতের কনুইতে বেশ ব্যাথা পায়। রাইসা একটু আহ্লাদী স্বভাবের একটু সামান্য বিষয় কে মস্ত বড় করা ওর স্বভাব। হাতের কনুইয়ের দিকে ছিলে র’ক্ত বেরিয়েছে। তা দেখে চেঁচামেচি শুরু করেছে রাইসা। ওর ড্রামা দেখে বিরক্ত বোধ করছে অন্যরা। বিরক্ত হয়ে লাভ নেই, শ্যামা ও নিশান বলে,
– ‘এটা রোড রাইসা। এভাবে চিৎকার করছিস কেন? দেখ লোকেরা কেমনে তাকাচ্ছে। ওঠ তোকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।’
_____________
হাসপাতালে আসার পর, রাইসা আরও ন্যাকামি করতে লাগল। ন্যাকা স্বরে বলল,
– ‘ আমি বাঁচ’বো তো দোস্ত? আমার শরীরের সব র’ক্ত মনে হয় বেরিয়ে যাচ্ছে।’

আরিফের চোখে মুখে বিরক্তির ছাঁপ স্পষ্ট। ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে রাগ দমন করার চেষ্টা করছে ও। শ্যামা ও আয়রা রাইসাকে ধরে হাসপাতালের ভেতরে এগিয়ে যাচ্ছে। পিছনে বাকিরা আসছে। এমন বিহেভ করছে রাইসা মনে হচ্ছে, ওর ওপর দিয়ে গাড়ি চলে গেছে। মানুষ হাত কে’টে গেলেও হয়তো এত কষ্ট পায় না যতটা ও ড্রামা করছে।
কাঁধের ব্যাগটা খুলে পড়ে যাচ্ছিল দেখে দাঁড়িয়ে পরল রুহানি। হুট করে মনে হল, ফোনটা বাজছে। ব্যাগটা কাঁধে আগের ন্যায় ঝুলিয়ে ব্যাগের চেইন খুলে ফোনটা বের করে, সে মূহুর্তে সামনে থেকে আসা কারো সাথে ধাক্কা লাগে। রুহনির হাত থেকে ফোনটা ঠাসস করে ফ্লোরে পরে যায়। হা করে ফ্লোরের দিকে তাকাই পরপর রাগী চোখে ওই লোকটার দিকে তাকালাম। লোকটা ধাক্কা দিয়ে সোজা হেঁটে চলে যাচ্ছে। রাগী গলায় ধমক দিয়ে বললাম,
– ‘ ওয়য় হ্যালো মিস্টার? প্রবলেম কি আপনার ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছেন। স্যরি বলার প্রয়োজন ও মনে করছেন না অন্ধ নাকি?’

রুহানির তীক্ষ্ণ কথাগুলো শুনে রাগে কটমট করে পিছনে ঘুরে তাকাল ওয়াসিফ। হাত জোড়া মুঠ করে রুহানির দিকে এগিয়ে আসতে যাবে তখন ওয়াসিফের নজর গেলো রুহানির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার ওপরে। শূন্যে হাত উঠিয়ে হাতের ইশারায় ওয়াসিফ কে চলে যেতে বলল সে। তার ইশারা বুঝে আগের ন্যায় হেঁটে চলে যায়। ওয়াসিফের চলে যাওয়া দেখে বিরক্তিকর কণ্ঠে ‘ওয়য়!’ বলে চেঁচাল রুহানি। পিছন থেকে কারো নরম গলা শুনে থমকে গেলো রুহানি। হাত জোড়া জড়সড় করে থমথমে দাঁড়িয়ে রইল। শুঁকনো ঢোক গিলে পিছনে তাকাই। A.S আমার থেকে কিঞ্চিত পরিমাণ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি শালিনকণ্ঠে বলল,
– ‘ এটা হসপিটাল মিস।’

চলবে… ইন শা আল্লাহ!

#বিষাক্ত_ভালোবাসা
#পর্বঃ১২
#লেখিকা: #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

” মাঝেমধ্যে নিজেকে নিষ্ঠুর মনে হয়। এমনও মনে হয় আমি রুহানির সাথে অন্যায় করছি। এতগুলো বছর ওকে ওর বাবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখছি। আমি স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথা ভেবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসছি। একটিবার রুহানির কথা ইয়াসিরকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি। কিন্তু আমি কি করতাম? ইয়াসির আমি চলে আসার সময় একটাবারও আমাকে আঁটকায়নি। একবারও বলেনি, ছেড়ে যেও না। এসব জু’য়া খেলায় হাড়-জিত আমার কাছে কোনো মাইনে রাখে না। ইয়াসির যদি একটিবার আমাকে আটকা তো, সত্যি বলছি আমি মেইজি তাহলে, আমি ম’রে গেলেও ইয়াসির কে একা করে চলে আসতাম না।

আমি ইয়াসিরকে ভুলবার চেষ্টা করেছি, ঘৃণা করতে চেয়েছি কিন্তু এত বছরে আমি তা পারিনি। আমি যত ও’কে ভুলতে চাই ‘ও’ তত আমার মনে পরে যায়। বাবা মা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল, আমি জেনো মুভ অন করি। রুহানিকে উনারা দেখবেন। আমার নতুন কারো সাথে, নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য জবরদস্তিও করেছিলেন। বাবার বন্ধুর ছেলে রাজি ছিল, আমার মেয়ে সহ আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু আমি আমার মেয়েকে ছাড়তে পারবো না। ইয়াসিরের জায়গা আমার জীবনে দ্বিতীয় কাউকে দিতে পারবো না বলে, সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করে ছিলাম। আমি এতগুলো বছর শুধু রুহানিকে বুকে জড়িয়ে দিন পাড় করেছি। আমার মনে বহু কষ্ট চাপা পরে আছে,না পারি কাউকে বলতে আর না পারি দেখাতে। কতশত রাত যে নির্ঘুম কাটিয়েছি, একাকি চোখের জল ফেলেছি হিসেব নেই। আমি কখনো চাইনি, রুহানি ওর বাবাকে ঘৃণা করুক। তাই কখনো ইয়াসিরকে ছেড়ে চলে আসার মূল ঘটনা ওকে বলিনি৷ ও যখন ছোট ছিল ছুটে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে ‘ওর’ বাবার কথা জানতে চাইতো তখন আমার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠতো৷ উথাল-পাতাল ঢেউ বয়ে যেতো। সত্য টা লুকাতে গিয়ে মেয়ের চোখে স্বার্থপর মা হয়েছি। আমি জানি, সত্য টা জানলে রুহানি ওর বাবাকে ঘৃণা করবে আর তা আমি চাইনা। মানুষ চাইলে সব সম্ভব। রুহানি যদি ওর বাবার সম্মুখীন হয়, তাহলে কি হবে তুমি কল্পনা করতে পারছো মেইজি?”

ইয়ানার হাতের ওপর নিজ হাতটি রাখে মেইজি। নির্মূল কণ্ঠে বলে,

” তুমি যা ভাবছো তা নাও হতে পারে। ওত বড় শহরে রুহানি বেবি ওর বাবাকে খুঁজে নাও পেতে পারে। তাছাড়া তুমিই তো বলেছো রুহানি ওর বাবাকে কখনো দেখেনি।”

কণ্ঠে গাম্ভীর্য, শুঁকনো ঢোক গিলে ইয়ানা বলল,
” মেরাক্কেল বলেও কিছু আছে মেইজি। ভীষণ ভয় করছে। বুকের মধ্যে ধুকধুক করছে।”
______________

বহুদিন পর আজ কোম্পানিতে পা রাখলেন ইয়াসির রেদোয়ান। ইয়াসির কে আসতে দেখে A.S এর এ্যাসিসটেন্ট এগিয়ে গেলো। আরিশের এ্যাসিসটেন্টকে অফিসে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন ইয়াসির। সন্দেহের নজরে তিনি সবার দিকে তাকাচ্ছেন। ফ্লোরের সকল কর্মীরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন এক থমথমে পরিবেশ। ইয়াসিরের সকল প্রোপার্টির দেখাশোনা করে A.S কিংবা বলা যায় সব কিছু A.S এর হাতে। সব কিছু এ.স কে বুঝিয়ে দিয়ে রিটায়ার্ড হয়েছে ইয়াসির। ইতিপূর্বে উনি শেষ কবে অফিসে পা রাখছেন কারো জানা নেই। তবে উনি বেশ গম্ভীর ও রাগী মানুষ সকলের ধারণা। ইয়াসির এ.স এর কেবিনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন ছুঁড়ল, আরিশ কোথায়?
এ.স এর এ্যাসিসটেন্ট কিছু বলার আগে পিছন থেকে কারো গুরুগম্ভীর কণ্ঠ শুনে ইয়াসির থমকে দাঁড়ালো। পিছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটার পা থেকে মাথা অব্ধি পর্যবেক্ষণ করে শক্ত গলায় বলল,

” ওয়াসিফ! আরিশ কোথায়?”

ওয়াসিফ মাথা নিচু করে ফ্লোরের ওপরে দৃষ্টি স্থির করে নিঃশ্বাস ফেলল। দু-হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ইয়াসিরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। শানিত গলায় বলল,

” আঙ্কেল আপনি হঠাৎ অফিসে আসতে গেলেন কেনো? কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে জানাতে পারতেন। আমি আপনার বাড়িতে চলে আসতাম।”

ইয়াসির রাগী গলায় বলল,

” আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করছি ওয়াসিফ এ.স কোথায়?”

ওয়াসিফ প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে ঘড়িতে টাইম দেখে বলল,

” এ.স ওর টিম মেম্বারদের নিয়ে মিটিং রুমে একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংয়ে আছে। এই বিশ পঁচিশ মিনিটে মিটিং শেষ করে ওর কেবিনে চলে আসবে।”
____________
চার দিন পর,
পুরো দমে শ্যামার বিয়ের তোড়জোড় চলছে। আত্মীয়-স্বজনেরা মোটামুটি সবাই চলে এসেছে। বিয়েটা শ্যামাদের বাড়িতে বসেই হবে। বাড়িতেই ওর বিয়ের সমস্ত রিচুয়াল’স পালন করা হবে। ওর বিয়ের আয়োজনটা মোটামুটি ধূমধাম করেই দেওয়া হচ্ছে। আত্মীয়-স্বজনেরা ছাড়াও মি.মাহিনের বিজনেস পার্টনার, অফিসের এমপ্লোই সহ সবাইকেই প্রায় এই বিয়েতে ইনভাইট করা হয়েছে। শ্যামার বাবা নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কোনো রকম কমতি রাখেনি। শ্যামা যেভাবে বলেছে উনি ঠিক সেই ভাবেই বিয়ের সমস্ত আয়োজন করেছেন।

ডেসিনটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে শ্যামা। বিছানার ওপর বসে, ভ্রু কিঞ্চিত উঁচু করে তাকিয়ে সুক্ষ্ম কণ্ঠে বলল,

” সকাল সকাল সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস? বিকেলে তো তোর হলুদের ফাংশন।”

ডেসিনটেবিলের মিররের ওপর থেকে নেত্রযুগল রুহানির দিকে তাক করে শ্যামা কাঠকাঠ কণ্ঠে বলল,

” আমার কিছু জরুরি জিনিস কিনা বাকি রয়ে গেছে। ওইদিন এতএত শপিংয়ের মাঝে খেয়াল করিনি। কাল রাতে সব জিনিস চেক করতে দেখলাম। মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস গুলো আনতে পারিনি। আর ওগুলো আমার লাগবেই। তাই শপিংমলে যাবো।”

শ্যামার কথা শুনে চটকরে দাঁড়িয়ে পরল রুহানি। শক্ত গলায় বলল,

” আমিও যাবো। তুই চলে গেলে আমার এখানে একা একা মোটেও ভাল্লাগবে না।”

শ্যামা চোখের কার্নিশে কাজল লাগাতে লাগাতে বলল,

” একা কোথায়? ওরা সবাই তো থাকছে।”

রুহানি বায়না ধরে বলল,
” থাকুক ওরা। তবুও আমি যাবো।”

শ্যামা আয়নাতে এক পলক রুহানিকে দেখে বলল,
” আচ্ছা ঠিক আছে। যা, জাস্ট পাঁচ মিনিটে রেডি হবি।”
____________
একটা শপে এসে, শ্যামা ওর দরকারি জিনিসপত্র গুলো সার্চ করছে। বেশ কয়েকটা পেয়েছে আর কিছু পায়নি। এমন করে খুঁজতে খুঁজতে গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে সেকেন্ড ফ্লোরে আসে। বেশ কয়েকটা শপ খোঁজার পর, শ্যামা ওর দরকারি সব জিনিস পত্র বুঝে নেয়।
মলের দক্ষিণ দিকে পার্কিং স্পট। শপিংমল থেকে বের হয়ে কিছুটা পথ পা হেঁটে যেতে হয়। রুহানি শ্যামার সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিল, এমতাবস্থায় কোথা থেকে একজন ছুট্টে এসে রুহানির কাঁধের ব্যাগ টা ছু মেরে নিয়ে দৌঁড় দেয়। আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে যায় রুহানি। হা করে দাঁড়িয়ে পরে। পাশে থাকা শ্যামা ‘হেল্প হেল্প’ বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। রুহানি কাঁদো কাঁদো ফেস বানিয়ে জড়ানো কণ্ঠে বলল,
” আমার ব্যাগ। ওটাতে আমার ফোন পার্স কার্ড সবকিছু ছিল।”

শ্যামা রুহানির হাত ধরে টেনে ধরে দৌঁড়াতে লাগল। হুট করে একজন ছেলে এসে রুহানি ও শ্যামার পথ হ্রুদে দাঁড়ালো। হাতের ব্যাগটা রুহানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

” ম্যাম আপনার ব্যাগটা। ”

ছেলেটার হাত থেকে ছ’ মেরে ব্যাগটা নিয়ে নেয় রুহানি। ব্যাগের জিপ খুলে উলটপালট করে দেখতে লাগে ভেতরে সবকিছু আছে কি না! রুহানির চিন্তিত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ছেলেটা মলিন হাসল। মসৃণ কণ্ঠে বলল,

” সব কিছু ভালো করে চেক করে নিবেন মিস রুহানি। তারপর একটু রিলাক্স হয়ে জানাবেন, কোনো কিছু আবার মিস নেই তো।”

ব্যাগের ভেতর থেকে চোখ সরিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে আরিশের দিকে তাকালো রুহানি। চোখ জোড়া পিটপিট করে শুধালো,

” আপনি আমার ব্যাগ কোথায় পেলেন? তারমানে আমার ব্যাগটা আপনি চুরি করেছেন? আপনার সাহস তো কম না৷ আমার ব্যাগ নিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন।”

রুহানির কথাশুনে ভ্রুযুগল কুঁচকানো করে ডানে বামে তাকালো আরিশ। ঠোঁট জোড়া মসৃণ করে বলল,

” এক্সকিউজ মি! আপনি কি আমাকে চোর বলছেন?’

বিঃদ্রঃ ব্যস্ততার জন্য গল্প লিখার সময় পাইনি। দুদিন পর গল্প দেওয়ার জন্য স্যরি। কথা দিচ্ছি আগামীকাল গল্পের পরবর্তী পর্ব’ বড় করে দিবো।

চলবে… ইন শা আল্লাহ!