#বিষাক্ত_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৭
#লেখিকা: #শারমিন_আক্তার_বর্ষা
শীতের সকালে ঘাসের গায়ে যেমন জমে শিশিরের বিন্দু ফোঁটা ঠিক তেমনি নিহান কর্ণর কপালে জমেছে ঘামের কণা। সকাল সকাল থানায় স্বয়ং ডিআইজি দিদার ম্মেদ উপস্থিত হয়েছেন। উনার রাগান্বিত চেহারা দেখে অনুমান করা যাচ্ছে তিনি মারাত্মক রেগে আছেন। উনার মুখশ্রী দেখে বুঝার উপায় নেই, উনি ঠিক কোন বিষয়টি নিয়ে ক্রোধিত আছেন। ডিআইজি দিদার ম্মেদ’র সামনে হাত দু’টি গুটিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নিহান কর্ণ ও আদ্রিক আহির মির্জা। আঁড়চোখে দুজন ইন্সপেক্টর দুজনার দিকে তাকাল। হঠাৎ জরুরি তলব, বিশেষ প্রয়োজনীয় কথা বলতে ডিআইজি স্যার নিজে আসছেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তিন জনের মাঝে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। ডিআইজি স্যার এতক্ষণ ধরে নিজের মুখে কুলু পেতে রাখছেন। টেবিলের ওপরের কেসের ফাইলগুলো নেড়েচেড়ে দেখছেন। ডিআইজি দিদার ম্মেদ স্বগতোক্তি করলেন আপন মনে। ডিআইজি স্যারের মুখে গাম্ভীর্যের আভা ছড়ানো, ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ত্যাগ করল নিহান ও আদ্রিক। কেসের ফাইলগুলো টেবিলের ওপরে ছুঁড়ে ফেললেন, মাত্রাতিরিক্ত রাগে চেঁচিয়ে বলে,
“পরপর এতগুলো খু’ন হয়ে গেছে। অথচ তোমরা এখনও কোনো ক্লু খুঁজে বের করতে পারছো না। তোমরা কেসটা নিয়ে তদন্ত করছো নাকি হেলাফেলা করে ফেলে রাখছো? আসল ক্রিমিনাল কে খুঁজে বের করার জন্য যখন যা পদক্ষেপ নিতে হয়, তোমরা নাও। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যদি তোমরা এই কেস সল্ভ করতে না পারো, তাহলে আমি এই কেসের ফাইল অন্য ইনস্পেক্টরের হাতে হস্তান্তর করবো।”
রাগে ও ক্ষোভে ডিআইজি দিদারের চোখ দু’টি আগুনের লাভার ন্যায়, রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
টেলিভিশনে সাংবাদিকরা যা-চ্ছে তাই বলছে,’ এতগুলো খু/ন হচ্ছে অথচ দেশের আইন কিছুই করতে পারছে না।
পুলিশরা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে?’
এখনও কিছু করতে না পারলে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করা যাবে না।
অন্যদিকে উপর থেকে ডিআইজি দিদার এর ওপর পেসার আসছে। কেসটা নিয়ে কতদূর তদন্ত হয়েছে কেস নিয়ে আঁধোও কি ইনভেস্টিগেট হচ্ছে না-কি না?
শান্ত হয়ে বসে টেবিলের ওপর থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোকে অর্ধেক পানি পান করে, সুক্ষ্ম শ্বাস ফেলল ডিআইজি দিদার। নিজের রাগের ওপর যথার্থ নিয়ন্ত্রণ এনে ডিআইজি দিদার স্বাভাবিক হয়ে কিয়ৎক্ষণ বাদে থানা থেকে বেরিয়ে যান।
ডিআইজি দিদার ওঠে চলে যেতেই নিহান রাগে টেবিলের ওপর থেকে গ্লাসটা হাতে নিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারল অপজিটে গ্লাস ভাঙার শব্দ শুনে হকচকিয়ে ওঠে আদ্রিক। চেয়ারে বসে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে কর্কশকণ্ঠে বলল, “একটা কেস সল্ভ করতে গেলে আরেকটা উল্টিয়ে যাচ্ছে। শুরুটা মিললে শেষটা গোলমাল পাকিয়ে যায়। আবার শেষটা মিললে শুরুটা। সব জেনো এক গোলকধাঁধা। রাগে নিজের চুল নিজে টেনে ধরল নিহান। আজ পর্যন্ত অনেক কেস সল্ভ করেছে নিহান, কিন্তু কোনো টাই এইটার মতো জটিল অথবা গোলমেলে ছিল না। যখনই কেসটা সল্ভ করার চেষ্টা করছে,আসল ক্রিমিনালের ধরা পাবে তখনই সব ধোঁয়াশা হয়ে যায়। সব শেষে হাত শূন্য।
দু’টি আঙুল দিয়ে কপাল চেপে ধরে চোখজোড়া বন্ধ করে ঠাই বসে রইল নিহান। আদ্রিক টুকটাক কথা বলে চলে যায়। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে শুরু থেকে এই পর্যন্ত সব কিছু ঘটনা মিলানোর চেষ্টা করছে নিহান। এমতাবস্থায় হঠাৎ প্যান্টের পকেটের ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল।
রিংটোনের শব্দে ধ্যান ভাঙলো নিহানের চট করে চোখজোড়া মেলে তাকাল। ফোন হাতে ভ্রু কুঁচকানো করে স্কিনে তাকাই অচেনা নাম্বার। কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে ফোন রিসিভ করতে অপরপাশ থেকে পুরুষালী গুরুগম্ভীর কণ্ঠে কেউ বলল,
” ইন্সপেক্টর নিহান কর্ণ আপনার যদি মার্ডার মিস্ট্রি কেসের আসল ক্রিমিনাল দের ধরবার জন্য কোনো হেল্প প্রয়োজন পরে তাহলে আজ সন্ধ্যায় জুরাইন গোরস্তানের দক্ষিণে একটা পুরালো ভাংলো আছে ওখানে চলে আসবেন। আসল ক্রিমিনাল সহ তাদের সকল কুকিত্তির প্রমাণ আমি আপনাকে দিবো। মনে রাখবেন, আপনি একা আসবেন।”
.
দুইদিন পর, বন্ধু বান্ধব সকলে মিলে ঘুরতে বের হয়েছে সাথে করে নতুন বর ও বউ রয়েছে। সবাই বেশ হাসিখুশি ও মিশুক। আজ পুরো দিন বাহিরে ঘুরবে ও বাহিরে খাওয়া দাওয়া করবে। আগামীকাল রুহানি ও বাকিদের ফিরে যাওয়ার কথা। রুহানি ও বাকি বন্ধুরা চলে যাবে বৈকি বেচারি শ্যামার ভীষণ মন খারাপ। কিন্তু কিছু করার নেই যেতে তো হবে। কানাডা পড়তে যাওয়ার পর ওরা সবাই যে শ্যামার অনেক আপন হয়েগেছে। দু’দিন পর চলে যাবে ভাবতে ঢুকুরে কেঁদে ফেলছে। ওর মন ভালো করার জন্যই সবাই একসাথে বেরিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরির পর, লেকের পাশে এসে বসল রুহানি ও বাকিরা। শ্যামা বাঙালি মেয়ে ওর ফুচকা অনেক পছন্দ। ফুচকা ওয়ালা দেখে গাড়ি থামিয়ে নেমে পরে। ওর জন্য সবার নামতে হয়। রুহানির ফুচকা পছন্দ নয়, তাই ‘ও’ হাঁটতে হাঁটতে সকলের থেকে একটু দূরে চলে আসে। আজও অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে লেকে ইয়াসিরের সাথে রুহানির দেখা হল। ইয়াসির সাধারণ মানুষের মত লেকের পাশে বসে আছে, রুহানি আগ বাড়িয়ে ইয়াসিরের সাথে কথা বলতে আসে। আগের বারের মতো এবার ইয়াসির রুহানির সাথে ভালো আচরণ করল না। রুহানিকে দেখে তিনি নাক কুঁচকালেন। এক সপ্তাহ আগে রুহানির সাথে দেখা হয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ বসে গল্পগুজব করে ছিল সেগুলো হয়তো ইয়াসিরের মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। ইয়াসির আজ চিনতে পারল না রুহানিকে। পাশে বসায় রেগে গিয়ে রুহানিকে বেশ কড়া কথা শুনিয়ে দিয়ে ওঠে চলে যায় ইয়াসির। ইয়াসিরের হঠাৎ এমন আচরণে মনে কষ্ট পায় রুহানি। ঠোঁট মুখ কালো করে বসে রয়। অচেনা লোক, তাছাড়া তার মতো ক’জনই বা প্রথম দেখায় সব মানুষকে মনে রাখে? ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তাহলে কেনো রুহানি এই স্বাভাবিক বিষয় টাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারছে না? কেনো রুহানির কষ্ট হচ্ছে? কেনো ই বা চোখের কার্নিশে জমলো অশ্রুকণা।
হাতের তর্জনী দিয়ে চোখ মুছে ওঠে দাঁড়াল রুহানি। অন্য মন্যস্ক হাঁটতে শুরু করল। অন্য দিকে, সকলে ফুচকা খেলো। গাড়িতে ওঠে দেখে ওদের মাঝে রুহানি নেই। গাড়ি নিয়ে অন্য দিকে রুহানিকে খুঁজতে লাগে, কিন্তু রুহানি ওইদিকে নেই। রাস্তায় কয়েকজনকে রুহানির ছবি দেখালে তারা জানায় উনারা কেউ রুহানিকে এ পথে যেতে দেখেনি। নিরাশ হয়ে আগের ন্যায় গাড়িতে ওঠে রাস্তার আশপাশে খুঁজতে লাগল।
রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বহুদূরে চলে আসছে রুহানি। রাস্তার মোড়ে কুকুরের ঘেউঘেউ ডাকে হুঁশশ ফিরে পেলো সে। সরু দৃষ্টিতে আশপাশ লক্ষ্য করে দেখল। সে পথভ্রষ্ট ভুল পথে প্রচলিত হয়েছে। পিছনে ঘুরে লেকে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হল। কিন্তু কিছুদূর আসতে রাস্তা গুলিয়ে ফেলল রুহানি। চৌরাস্তা মানে চারটা রাস্তা,এখন কোন রাস্তা দিয়ে এসেছিল জানা নাই। হতাশাজনক শ্বাস ফেলল অভিমানে ঠোঁট কামড়ে আশপাশটা আবারও লক্ষ্য করল। সকাল বেলা, এই আটটা ন’টা বাজে বোধহয়। তেমন কোনো গাড়িঘোড়া নেই, শুধু কয়েকটা রিক্সা চলাচল করছে এই পথে। সাথে ব্যাগ নেই। রিক্সা ভাড়া করবে তারও উপায় নেই। হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে বুদ্ধি আসল, শ্যামা বা অন্যদের কল দেওয়ার। কিন্তু হল না কিছুই। সিম কোম্পানি জানাল, পর্যাপ্ত ব্যালেন্স নেই। ফোনে নেট ও নাই। কোনো ভাবে কল দেওয়ার কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশের সিম অফারের সম্মন্ধে রুহানির কোনো ধারণা নেই, কেননা সে এদেশে নতুন। আর রিচার্জ করবে সাথে টাকা নেই। ফোনে ব্যালেন্স না থাকলে যে নেটে কল দিবে তারও উপায় নেই। আশপাশের কয়েক জনের থেকে রুহানি সাহায্য চাইল। রুহানির ইংলিশ কেউ বুঝতে পারছে না। হেলাফেলা করে রুহানিকে এড়িয়ে চলে যাচ্ছে। চারটা রাস্তার দিকে তাকিয়ে কান্না পেলো রুহানির। কান্না কান্না ভাব, এমতাবস্থায় চোখ গিয়ে পরল, রোডের ওইপাশে একটা গাড়ির ওপরে মাত্রই এসে গাড়িটা থামছে। গাড়ির পিছনে ডিক্রি তে একটা বোর্ড ঝুলানো। তাতে ইংলিশে লিখা-
‘এই গাড়িতে ওয়াইফাই ফ্রী। গাড়িতে ওঠেন ফ্রী তে ওয়াইফাই ব্যবহার করেন।’
ওয়াই-ফাই আছে শুনে, রুহানি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। মনে মনে বলল, আমাকে এই গাড়িতে ওঠতেই হবে। সামনে ড্রাইভার স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে বসে আছে। লো ভলিউমে গান বাজছে, চোখ জোড়া বন্ধ করে সে গান উপভোগ করছে ড্রাইভার নাজিম। রুহানির বেশ কয়েকবার ডাকার পর, নাজিম চোখ মেলল। গ্লাস নামাতে রুহানি ইনোসেন্ট লুকে রিকুয়েষ্ট করল, তার ফোনে জেনো ওয়াইফাই কানেক্ট করে দেয়। এটাও বলে, তার জরুরি কল দিতে হবে। আর সাথে করে ব্যাগ নিয়ে আসতে ভুলে গেছে।
নাজিম পিছনের ডোরের লক আনলক করল। রুহানির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে তাকে বলল,
“আপনি গাড়িতে ওঠে বসুন। আমি কানেক্ট করে দিচ্ছি। প্রয়োজন মিটে গেলে নেমে যাবেন।”
বিপদের সময় আশার আলো হয়ে আসল এই গাড়িটা। খুশিতে আপ্লূত রুহানি সাত পাঁচ না ভেবে গাড়িতে ওঠে বসে পরল। একহাত দিয়ে তার ব্লেজার টা কাঁধের ওপর ফেলে আছে ও অন্য হাত তার প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে কালো শার্ট-প্যান্ট পরণে একটা ছেলে, রাস্তা দিয়ে স্টাইল করতে করতে হেঁটে এদিকেই আসছে।
আচমকা গাড়ির দরজা খুলে গাড়ির ভেতরে ঢুকে বসলো। সামনে ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে রুহানি শাসিত কণ্ঠে বলল,
“আপনি গাড়িতে উঠছেন কেন যান নামুন?”
রুহানির কথা শুনে ঘাড় কাত করে লোকটা রুহানির দিকে বাজপাখির নজরে তাকাল। ঠোঁট জোড়া বাঁকা করে হেসে সুক্ষ্ম কণ্ঠে বলল,
” আমার গাড়ি থেকে আমিই নেমে যাবো মিস রুহানি?”
কণ্ঠে গম্ভীরতা শুনে থমকে গেলো রুহানি। মূহুর্তে পরিবেশ টা কেমন থমথমে হয়ে গেলো। শুঁকনো ঢোক গিলল সে। এই কণ্ঠস্বর যে তার পূর্ব পরিচিত হাজারও মানুষের ভীড়ে ও শত বছর পরেও তার এই কণ্ঠস্বর চিনতে ভুল হবে না। নিষ্পলক চোখে তাকাই পাশে বসা লোকটার দিকে,লোকটার মুখশ্রী দর্শন হতে ছিটকে উঠলাম। নিজ জায়গা থেকে কিছুটা নড়েচড়ে গেলাম। ড্রাইভার সুযোগে গাড়ির ডোর গুলো লক করে ফেলল। আমি চেয়েও দরজা খুলতে পারছি না। ভয়ে আমার হাত পা নিষ্ক্রিয় হয়ে আসছে। লোকটা তাত্ক্ষণিক আমার হাত ধরে টেনে তার মুখোমুখি ঘোরালো। কাঁপা কাঁপা গলায় তার নাম উচ্চারণ করলাম, ” এ.স?”
এ.স তথা আরিশ আমার দুইহাত তার শক্তপোক্ত দুইহাত দিয়ে চেপে ধরে। গাড়ির ডোরের সাথে আমাকে চেপে ধরল। উনি আস্তেধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে আমি ভয়তে চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নেই। আমার হার্ট বিট করছে। আমি চাইনা আরিশ আমার সামনেও আসুক। এখন কেনো জানি না, উনার আমাকে স্পর্শ করা, আমার কাছাকাছি আসা, উনার গরম নিঃশ্বাস আমার গায়ে উপচে পড়া সব কিছুর মধ্যে আমার ভালো লাগা ও অদ্ভুত অনূভুতির সঞ্চরণ ঘটছে। আমার কানের লতির সাথে আরিশ তার নাক ঘষল। আমি কিছুটা নড়েচড়ে উঠলাম। আরিশ আমার হাতজোড়া আরও শক্ত করে চেপে ধরল। আরিশ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুহানি কে পরখ করে নিলো।
একটু ঝুঁকে আমার কানের কাছে তার ঠোঁট জোড়া নিয়ে ফিসফিস আওয়াজে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
” তুমি স্নিগ্ধ একদম ওই দিঘির পুষ্প ফুলের মতো। আর আমার এই প্রস্ফুটিত পুষ্প ফুল টার উপর যত নজর!”
চলবে… ইন শা আল্লাহ!
#বিষাক্ত_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৮
#লেখিকা: #শারমিন_আক্তার_বর্ষা
আরিশের ফিসফিসানি শুনে হকচকিয়ে ওঠে রুহানি, শব্দ করে কাশতে লাগে। এক বোতল মাম পানি রুহানির দিকে এগিয়ে দেয় আরিশ। বোতলের ঢাকনা খুলে কয়েক ঢোক পানি পান করে রুহানি। চলন্ত গাড়ি হঠাৎ কোনো এক জায়গায় এসে থামলো। গাড়ি থামতে চারপাশে নজর বুলাতে লাগে রুহানি। নাজিম গাড়ির লক খুলে দেয়। রুহানি একহাতে ওড়নার একপাশ টেনে ধরে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। গাড়ির দরজা অটো লক হয়ে যায়। রুহানি হাঁটতে গিয়ে টের পেলো পিছনে ওড়না টান পড়ছে। আরিশ ওড়না ধরেছে রাগে দাঁতে দাঁত চাপে রুহানি। চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয়। বন্ধ চোখ জোড়া মেলে আশপাশটা পরখ করে আরিশের উদ্দেশ্য কর্কশকণ্ঠে বলল,’ ওড়না ছাড়েন বলছি মি. আরিশ। আপনি ওড়না না ছাড়লে কিন্তু আমি এখন চিৎকার করবো।’
রুহানির কথার কোনো প্রতিত্ত্যর করছে না আরিশ। রাগান্বিত হয়ে পিছনে ঘুরতে দেখল, আরিশ গাড়ির দরজা থেকে একটু দূরে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওষ্ঠদ্বয় জুড়ে অমায়িক দুষ্ট হাসি। রুহানি ভ্রুযুগল কুঁচকানো করে একবার আরিশকে দেখে পরপর গাড়ির দরজার দিকে তাকায়। দরজায় আঁটকে গেছে রুহানির ওড়নার এককোণা। আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে যায় রুহানি। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে ও’র। মাথা নিচু করে ওড়না টানছে রুহানি। দরজা লক ওড়না টানলে কি বের হবে?
রুহানির বোকামি দেখে আরিশ গালে হাত দিয়ে শব্দ করে হাসতে শুরু করল। আরিশের অট্টহাসির শব্দ শুনে লজ্জায় মাথা নুইয়ে যাচ্ছে রুহানির। ওড়নার অন্য কোণা ধরে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রয়। প্যান্টের পকেটে দুইহাত ঢুকিয়ে রেখে রুহানির লজ্জা মিশ্রিত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল আরিশ। পা হেঁটে রুহানির কাছে আসল। গ্লাসের ওপর দিয়ে ড্রাইভারকে পিছনের দরজা আনলক করতে বলল। দরজা আনলক করতে রুহানির ওড়না বেরিয়ে আসে। দুইহাতের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে রুহানি রাস্তার অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করে। আরিশ রুহানির পিছনে গেলো, রুহানির সামনে এসে দাঁড়ালো। মলিন কণ্ঠে বলল,’ মনে তো হয় না। রাস্তাঘাট চিনো বলে, যেভাবে হাঁটছো মনে হচ্ছে বাংলাদেশের ম্যাপ তোমার মুখস্থ।’
আরিশের কথার পিঠে রুহানি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,’ চিনিনা। তো কি হয়েছে চিনে নিবো। এখানে মানুষ কী কম আছে নাকি? যে কাউকে বললেই হেল্প করবে।’
রুহানির কথাশুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আরিশ বলে,’তা ম্যাডাম। টাকা পয়সা আছে কিছু? বাড়ি যেতে হলে যে ভাড়া লাগবে।’
ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল রুহানি। এই কথার পিঠে তার কথার ভান্ডার খালি পরে আছে। রুহানিকে চুপ থাকতে দেখে আরিশ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,’ সামনে একটা পার্ক আছে। যাবে?’
রুহানি চোখ জোড়া ছোটছোট করে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে,’ আমি কেন আপনার সাথে যেতে যাবো?’
আরিশ রুহানির একহাত ও’র বগলদাবা করে নিয়ে সুকণ্ঠে বলে,’ কারণ তুমি যে আমার। তাছাড়া যেহেতু তোমাকে আমি এখানে নিয়ে আসছি সেহেতু আমি যা বলবো তোমাকে তা শুনতে হবে। এছাড়া তোমার কাছে সেকেন্ড অপশনও নেই।’
রুহানি রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,’ আপনি আমার সাথে এমন জবরদস্তি করছেন কেন?’
আরিশ রুহানির দিকে তাকাল, দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল,’ কারণ তুমি যে দু’দিন বাদ আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তখন ইচ্ছে করলেও তোমাকে দেখতে পাবো না।’
কথাটি বলতে বলতে আরিশের গলা ধরে আসলো। আরিশের চোখ দু’টো ছলছল করে উঠলো। রুহানি আরিশের চোখ দু’টি দেখে বলল,
‘আপনি কাঁদছেন?’
আরিশ রুহানির দিকে তাকাল, মৃদুস্বরে বলল,’ ধুরর পাগলী ছেলেরা কখনো কাঁদে নাকি?’
রুহানি শাহাদত আঙুল আরিশের চোখ বরাবর তাক করে বলে,’ আপনার চোখে যে পানি।’
আরিশ একহাত দিয়ে কপাল চুলকে ক্ষীণকণ্ঠে বলে,
‘তুমি যে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে সে তীব্র যন্ত্রণা আমি এখনই অনুভব করতে পারছি রুহানি। আর এ জল সে তীব্র বেদনার কিঞ্চিত চিহ্ন।’
— ‘ এ.স ওই মেয়ের জন্য দিওয়ানা হয়ে গেছে। কাজকর্ম ভুলে সব সময় ওই মেয়েটার পিছনে পরে থাকছে বস। একটুর জন্য আমরা মেয়েটাকে তুলে আনতে পারিনি। মেয়েটাকে তুলতে যাচ্ছিলাম জানি না তখন এ.স এর লোকজন কোথা থেকে চলে আসল,আর আমাদের ওখানে ধাওয়া করে।’
‘এ.স যার কোনো পিছুটান নেই। এতদিনে এ.স এর পিছুটান হয়েছে। মেয়েটাকে হাতের মুঠোয় নিতে পারলে এ.স সুরসুর করে আমার পায়ের সামনে এসে বসবে। তখন আমি ও’কে শাস্তি দিবো। আমার বোনের হ’ত্যা’র শাস্তি। ওর জন্য শুধু মাত্র ওর জন্য আমার ফুলের মতো বোনটা আর নাই। মৃত্যু’র পর ওই কবরস্থানেও জায়গা হয়নি। দেশের বাহিরে ছিলাম বলে, কিছু করতে পারিনি কিন্তু এবার আমি রাজেশ সরকার কড়ায়গণ্ডায় সব উসুল করবো। আমার আদরের ছোট্ট বোনটি আত্মহত্যা করেছে শুধু ওর জন্য, ওকে আমি শান্তিতে বাঁচতে দেবো না। কিছুতেই না।’
‘অতীত- চার বছর আগে’
একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে আরিশ ও নাজিহা। নাজিহা এবার অনার্স প্রথম বর্ষে আর আরিশ অনার্স ৩য় বর্ষে। ভার্সিটিতে প্রথমদিন রেগিংয়ের শিকার হয় নাজিহা। কতগুলো সিনিয়র ছেলে ও’কে একা পেয়ে ভার্সিটির ক্যাম্পাসে অপদস্ত করছে। ভার্সিটির দ্বিতীয় তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন্ধু ওয়াসিফ, তাজ, প্রবীর ও আমানের সাথে কথা বলছে আরিশ। একনজর ক্যাম্পাসের দিকে তাকাতে দেখল কতগুলো ছেলে মেয়েটাকে বিরক্ত করছে। ভার্সিটির মধ্যে সিনিয়ররা দুইটা দলে বিভক্ত একজন আরিশের দল ও আরেকটা হচ্ছে ওদের যারা নাজিহা কে বিরক্ত করছে। আরিশকে ওখানে দেখে ওদের দলের লিডার নাসিম বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকানো করে আরিশের দিকে তাকালো। হাতের চুটকি বাজিয়ে বলল,
‘দেখ আরিশ তোদের কোনো কাজে আমরা নাক গলাই না। তো তোরাও আমাদের কাজ থেকে দূরে থাক।’
আরিশ দুকদম এগিয়ে গেলো, নাসিমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাগী গলায় বলে,’ আমাদের কাজ কোনো মেয়ে মানুষ কে অপদস্ত করা নয়। আর আমরা থাকতে কেউ এই কাজ করলে তাকে আমরা ছেড়ে কথা বলবো না।’
এক কথায় দুই কথায় দু’জনে রেগে গেলো। আরিশের ওপর হাত তুলতে শূন্যে হাত উঠালো নাসিম। তার আগে পেছন থেকে তাজ ও প্রবীর এগিয়ে আসে। নাসিম কে দু’জনে মিলে মাটিতে ফেলে পেটায়। নাসিমকে মার খেতে দেখে ওর সাঙ্গুরা লেজ গুটিয়ে পালায়। আরিশের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাই রয় নাজিহা। আরিশের এমন উদারতার উপরে মোহিত হয় নাজিহা। মনে মনে আরিশের কথা চিন্তা করতে লজ্জা পায়। ক্যাম্পাস থেকে ক্লাসে চলে যায়। দুইটা ক্লাস শেষে লাইব্রেরি তে আসে নাজিহা। ক্লাসে একটা মেয়ের সাথে পরিচয় অল্প সময়ে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়। লাইব্রেরি তে এসে দু’জনে পাশাপাশি বসে। নাজিহার নতুন বন্ধু মাহবুবা ওকে জানায় আরিশ সম্পর্কে, আরিশের সম্পর্কে যত শুনছে নাজিহা আরিশের প্রতি তত দূর্বল হতে লাগল। লাইব্রেরি তে এসেও বিপাকে পরল নাজিহা। এখানে এসেও কয়েকজন সিনিয়র মেয়ে নাজিহাকে অপমান করতে লাগে। এইদৃশ্য আবার নজর বন্ধি হল আরিশের। সে আবারও এসে মেয়েগুলো কে ধমকানো শুরু করল। ভার্সিটি কারো বাপের নয়। এখানে সবার সমান অধিকার রয়েছে। মেয়েগুলো আরিশকে দেখে থরথর করে কাঁপতে লাগে এক পর্যায়ে ছুটে চলে যায়। নাজিহার দিকে তাকিয়ে সম্মান দেখানোর জন্য মৃদু হাসল আরিশ। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে।
রাতের পর রাত জাগতে লাগে নাজিহা, চোখেমুখে শুধু তার আরিশের জল্পনা কল্পনা। আস্তে আস্তে নাজিহা আরিশকে অধিক ভালো বেসে ফেললো। একদিন আরিশকে না দেখলে মরে যাবে এমন অবস্থা। ভার্সিটিতে ক্লাস না হলেও রোজ আসে শুধু মাত্র আরিশকে দূর থেকে দেখবে বলে। একদিন বিশেষ কারণে ভার্সিটিতে আসল না আরিশ ও ও’র বন্ধুরা। পরদিন ভার্সিটির ক্যাম্পাসে একটা বড় গাছের নিচে বসে আরিশ ওর বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে। সাহস করে এগিয়ে গেলো নাজিহা। আমতাআমতা করে প্রশ্ন করল,’গতকাল কেনো আসেননি।’
নাজিহার কথায় চটে গেল আরিশ। পাশ থেকে খোঁচা মেরে প্রবীর বলে, ‘আরিশ কেন ভার্সিটিতে আসেনি সেই কৈফিয়ত কি তুমি পিচ্চি মেয়েকে দিতে হবে? জুনিয়র হয়ে সিনিয়র কে এই প্রশ্ন করার সাহস কোথায় পেয়েছো তুমি?’
একই প্রশ্ন যখন আরিশ নাজিহাকে করল, তখন নাজিহা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনাকে একদিন না দেখলে আমার ধম বন্ধ হয়ে আসে।’
নাজিহার কথা শেষ হতে অট্টহাসি তে লুটিয়ে পরে ওয়াসিফ, তাজ ও আমান। প্রবীর ভ্রু কুঁচকে আরিশের দিকে তাকাল। আরিশ শক্ত ও গম্ভীর গলায় বলল,
‘ দেখো মেয়ে। তোমাকে আমি ভালোবাসি না। আর না আমার ভালোবাসার জন্য কাউকে প্রয়োজন। সামনে তোমার ব্রাইট ফিউচার ফেলে এখনই প্রেম ভালোবাসা নিয়ে পরে আছো। ভার্সিটিতে কি প্রেম ভালোবাসা করতে আসো? এরপর থেকে আমার সামনে আসবে না।’
নাজিহার বুক চিঁড়ে কান্না আসছে। নিজেকে যথাযথ সামলে করুণকণ্ঠে শুধালে,’ আপনি যদি আমাকে ভালোই না বাসেন তাহলে কেন সব সময় আমাকে বিপদে দেখে আমাকে রক্ষা করেন?’
নাজিহার কথায় আকাশ সমান অবাক হল আরিশ। ভ্রুক্ষেপহীন চোখে তাকিয়ে বলল,’ এক্সকিউজ মি! তোমাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছি বলে, তুমি ভাবছো আমি তোমাকে লাভ করি। হোয়াট ননসেন্স। আমরা সিনিয়র তোমরা জুনিয়র। জুনিয়র দের হার্সমেন্ট হতে দেখে সিনিয়র রা এগিয়ে যাবেই এটাই বাস্তব। তোমার জায়গা অন্য মেয়ে হলেও আমরা এটাই করি। তাই বলে, সবার সাথে আমার প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক না। গোবেট দেখেছি তোমার মত না। এখন যাও আমার সামনে থেকে, নেক্সট টাইম আমার সামনে আসার আগে দু’বার ভাববে।’ শেষের কথাটি উচ্চ স্বরে ধমক দিয়ে বলল আরিশ। আরিশের সামনে থেকে এক দৌঁড়ে চলে আসে নাজিহা। ভার্সিটির গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। পুরোটা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি আসে। আরিশের এভাবে তাকে প্রত্যাখান করাটা সে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছে না।
বোন নাজিহা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই রাজেশের একমাত্র ছোট্ট বোনটাকে জুড়ে ওর পৃথিবী। আজ নয় দিন হয়েছে বিজনেসের কাজে দেশের বাহিরে গেছে সে। আগামী দু’দিন পর ফিরে আসবে। নাজিহা একটা ছেলেকে ভালোবাসে ছেলের নাম ছবি হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ট করেছে রাজেশের কাছে। আরিশের ছবি দেখে ভীষণ পছন্দ হয়েছে রাজেশের। আরিশকে দেখে পছন্দ হবে না এমন মেয়ে কমই আছে।
বাড়িতে ঢুকে ফোন হাতে ভাই রাজেশের হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভয়েস নোট পাঠালো নাজিহা। তারপর গলায় ওড়না বেঁধে ঝুলে পরল ফ্যানের সাথে। ভয়েস নোটটা রাজেশ শুনে বিকেলে, কাজের জন্য ফোন হাতে নেওয়ার সময় পায়নি। বিকেলে রিলাক্স হয়ে কেবিনে ঢুকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ‘বোনু’ নামে সেভ করা নাম্বার থেকে ভয়েস নোট। নাজিহার শেষ ভয়েস শুনে ভেঙে পরে রাজেশ।
কান্না করছে নাজিহা। কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। তবুও জোর করে বলছে,
‘ভাইয়া আমাকে মাফ করে দিস। আমি তোকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমি আরিশকে ছাড়া বাঁচবো না ভাইয়া। আর ‘ও’ আজকে ভরা ক্যাম্পাসে বলছে, আমাকে ‘ও’ ভালোবাসে না। ওকে ছাড়া জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আমি ওকে ভালোবেসে চলে যাচ্ছি ভাইয়া। আমাকে ক্ষমা করে দিস।’
ভয়েস নোট শেষ হতে বারবার নাজিহার ফোনে কল লাগাল রাজেশ কিন্তু কল সে-তো রিসিভ করছে না নাজিহা। পরদিন সকালে ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে বাংলাদেশে আসে রাজেশ। বাড়ি পৌঁছে দ্রুত নাজিহার রুমের সামনে আসে, রুম ভেতর থেকে লক করা। দরজা ভেঙে রুমে ঢুকে দেখে, গোটা একদিন ধরে ফ্যানের সাথে ঝুলছে নাজিহার মৃত’দেহ। আত্মহ’ত্যার মৃত্যু বলে কবরস্থানে কবর দেওয়া হয় না, জানাজা ও দিলো না। মসজিদের ইমামের পায়ে ধরে রাজেশ কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হয়না। ইসলাম বিরুদ্ধে যারা আত্মহত্যা করে যারা মারা যায় তাদের কবরস্থানে জায়গা নেই, আর তাদের জানাজা দেওয়াও হয় না। কোনো এক প্রবাহিত গঙ্গায় নাজিহার দেহ ভাসিয়ে দিলো রাজেশ। জীবনের শেষ কান্না ‘ও’ তখনই করেছে। নাজিহাকে ভাসিয়ে দিয়ে হিংস্র পশুর মত হয়ে যায়। মাটির ওপর দাঁড়িয়ে বলে, যে ছেলে আমার বোনকে বাঁচতে দেয়নি তাকে আমি নিজের হাতে মারবো। রাতারাতি একটা গ্যাং তৈরি করল রাজেশ। অপরদিকে আরিশের শত্রুর তালিকায় আরও একজন যুক্ত হলো। এক সপ্তাহ হয়েগেছে এর মধ্যে একদিনও ভার্সিটিতে নাজিহাকে কেউ আসতে দেখেনি। লক্ষ্য করেছে প্রবীর কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপহীন নেই আরিশের।
প্রেম ভালোবাসার প্রস্তাব জীবনে বহু পেয়েছে ও পাচ্ছে কিন্তু আরিশের মেয়েদের প্রতি ইন্টারেস্ট নেই বললেই চলে। তার তো শুধু লক্ষ্য নিজের নাম অর্জন করা। নিজের নাম অর্জন করার জন্য অল্প বয়সে মামার বিজনেস জয়েন করেছে। অল্প বয়সে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কিংয়ের সাথে ডিল করছে। পরবর্তী তে ছয় মাসের মধ্যে কিং কে মেরে সে নিজে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কিং হয়েছে। সে নিজেও জানে চারপাশে তার শত্রুর অভাব নেই।
এই সবে আরিশ এখন পর্যন্ত জানেই না তাকে ভালোবেসে একটা মেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।
.
.
গ্রাউন্ডফ্লোর লিফটে দশ বারোজন ছেলে ও মেয়ে ওঠেছে একেকজন একেক ফ্লোরে নেমে যাবে। লিফটের বাটনে টিপ দিতে দরজা বন্ধ হবে এমন সময় একজন পা রাখে লিফটের দরজার সামনে, দরজাটা আবার খোলে যায়। সকলে ভ্রু কুঁচকে জুতার দিকে একবার তাকিয়ে উপরে তাকাল। এ.স কে দেখে এমপ্লয়ি গুলো নড়েচড়ে দাঁড়াল। বিনয়ের সাথে সালাম দিল, সালামের উত্তর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল এ.স। সবার পেছন থেকে সামনে এগিয়ে আসে আমান। এ.স এর কানে কানে বলে,’ এতক্ষণ কোথায় ছিলি ব্রো?’
প্যান্টের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে সটানভাবে দাঁড়িয়ে আছে এ.স বাম চোখের ভ্রু উঁচু করে আমানের দিকে তাকাল। আমান শুঁকনো ঢোক গিলে চুপসে গেলো। পেছন থেকে আমানের কানে কানে তাজ বলে,
‘ জায়গা দেখে প্রশ্ন করবি তো ষ্টুপিড।’
গা থেকে ব্লেজার খুলে কেবিনের বা পাশে সোফার উপরে ছুঁড়ে ফেলল আরিশ। পরপর ওরা চারজন দরজা ঠেলে কেবিনে ঢুকল। আরিশের দিকে নেত্রযুগল কুঞ্চিত করে তাকাই আছে, প্রবীর, ওয়াসিফ, আমান ও তাজ ওদেরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কোনো হেলদোল না দেখিয়ে ইজি চেয়ারে পায়ের ওপরে পা তুলে বসল আরিশ। ঠোঁট জোড়া চুকো করে শানিতকণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে,’ হোয়াট?’
একে একে ওরা চারজন টেবিল ঘিরে দাঁড়াল। শক্ত গলায় আরিশকে প্রশ্ন করল,’ভাই তুই কি সিরিয়াসলি ওই রুহানি নামক মেয়েটাকে ভালোবাসিস?’
ওদের চারজনের মুখে একই প্রশ্ন শুনে অট্টহাসি তে ফেটে পড়ল আরিশ। জোরপূর্বক নিজের হাসি দমিয়ে নেয়। তাত্ক্ষণিক ডেস্কের ওপর দু-হাত রাখে। ঠোঁট জোড়া বাঁকা করে ডেভিল হাসি হাসল। শাসিতকণ্ঠে বলে, ‘দাবা খেলতে বেশ লাগে। আর সে দাবার গুটি যদি হয় মানুষ তাহলে তো কথাই নাই। আর রুহানি হচ্ছে তাই, দাবার গুটি।’
চলবে… ইন শা আল্লাহ!