বিষাক্ত ভালোবাসা পর্ব-২৩+২৪

0
240

#বিষাক্ত_ভালোবাসা
#পর্বঃ২৩
#লেখিকা #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

হোটেল লবি দিয়ে যাচ্ছিলাম। হটাৎ আমাকে দেখে দূর থেকে একটি ছেলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল চোখে সকলে আমাকে দেখছে। ছেলেটা দু’হাতে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘স্যার আমার মা-কে বাঁচান।’

‘তোমার মা কে? আর আমি উনাকে কিভাবে বাঁচাব?’

‘স্যার আপনি ওইদিন আমার মা আপনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তখন আপনি ওনাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজ দু’দিন ধরে মা বাসায় আসছে না। ওইদিন বিকেলে মা আমাকে কল দিয়ে বলেছিল, আপনি ওনার সাথে দেখা করেননি। তখন ওনি বাড়িতেই আসতে ছিল। তখন আমি শুনি৷ মা কারো সাথে চেচামেচি করছে। মা-র পাশে কয়েকজন লোকের গলা শুনেছি। ওরা আমার মা-কে তুলে নিয়ে গেছে। আমার মা’কে আপনি বাঁচান।’

পনেরো বছরের ছেলে তোমাল হোটেল রুমে পাঠিয়ে ওরা গাড়ি করে বের হয়ে যায়। এদিকে আজ আরিশের একটা ইন্টারভিউ আছে। আরিশের সাথে তাজ ও প্রবীর ছুটে গিয়েছে। গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে পিছু ফিরে তাকাই ওয়াসিফ। বলল, ‘তোর কি মনে হয় আর্শি কে কে তুলে নিয়ে গেছে? আর নিলেও কোথায় নিয়ে গেছে?’

আরিশ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে, ‘আর্শি আপার লোকেশন ট্রাক কর।’

ল্যাপটপ গেঁটে দশ মিনিট পর আমান বলল, ‘আর্শি আপার লাস্ট লোকেশন হোটেল তাজ এর সামনে দেখাচ্ছে।’
_____
হোটেল তাজ এর সামনে সিসি টিভি ফুটেজ চেক করে কনফার্ম হয় আরিশ। কাউকে কল দেয়। কল রিসিভ করার পর কর্কশকণ্ঠে বলল, ‘ ২৪ঘন্টার মধ্যে আর্শি আপার খবর আমার চাই। নয়তো বুঝতে পারছিস আমি কি করব।’

‘তুই এত হাইপার হচ্ছিস কেন। ভাই শান্ত হ দেখবি আমরা উনাকে পেয়ে যাবো।’

‘উনাকে পেতে হবে। দু’দিন ধরে আপার কোনো খোঁজ খবর নাই। শুনিসনি উনার ছেলে তোমাল কি বলল, ও পুলিশের কাছে গিয়েছে কিন্তু পুলিশ আপাকে পায়নি। মানে বুঝিস তুই? আমাকে বাঁচাতে গিয়ে উনার স্বামী ঋষি মা’রা গেছে। আমি চাইনা আমার অবহেলায় আপা বা উনার ছেলের কোনো ক্ষতি হোক।’

‘আমরা জানি ঋষি একজন তোর সাহসী গার্ড ছিল। যে শেষে তোর জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন দিয়ে দিতে পিছ পা হয়নি। ওর স্ত্রী কে সুরক্ষা করা আমার দায়িত্ব। আমরা খুঁজে বের করবো।’

‘রুহানির ওপর যারা নজর রাখছে তারা নতুন কোনো আপডেট দিয়েছে কী?’

‘হ্যাঁ।আমাদের নতুন চারজন গার্ড রুহানির ওপর নজর রাখছে। ওরা কিছুদিন আগে আমাদের টিম জয়েন হয়েছে। ওদের মধ্যে একজন জানিয়েছে, রুহানি দুই বার একজন লোকের সাথে রাস্তায় দেখা করেছে। আর লোকটা দুই বার রুহানিকে অপমান করেছে।’

‘লোকটা কে?’

‘লোক টাকে ওরা চিনে না। আমি ওদের বলেছি খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য কিন্তু ওরা বলে পরবর্তী তে লোকটাকে ওরা আর খুঁজে পায়নি।’

‘পায়নি মানে কী? ওদের টাকা দিয়ে এমনি এমনি রাখা হয়েছে নাকি?’

‘এ.স এটা আরও দু’দিন আগের ঘটনা। আমাকে একটু আগে জানিয়েছে।’

‘দু’দিন আগের ঘটনা দু’দিন আগে না জানিয়ে এখন জানাচ্ছে? সবগুলো কে আস্ত কবর দেওয়া উচিত সালা বাস্টার্ড। ওদের এখনই ইনফর্ম করে দাও রুহানিকে নিয়ে কোনো হেলাফেলা আমি বরদাস্ত করবো না। ওরা চারজন যদি মেয়েটাকে দেখে রাখতে না পারে তাহলে আরও লোক লাগাও। রুহানির কোনো ক্ষতি জেনো না হয়। রুহানির টাইম টূ টাইম খবর আমার চাই।’
_______
‘বাংলাদেশে আমার কাজ শেষ হয়নি। আমি এখানে আসছি আমার বাবাকে খুঁজতে কিন্তু আমি এখনও বাবাকে খুঁজে পাইনি। দেখতে দেখতে বিশ দিন হয়ে গেছে। আমাকে এবার সিরিয়াসলি বাবাকে খুঁজতে হবে। আমি এখনই যেতে পারবো না।’

নাজিন, আদনান, লাবণ্য একত্রে বলল, ‘আমরাও কোথায় এখনই যেতে চাচ্ছি? থাকি না আরও চার পাঁচ মাস।’

‘তিন মাস পর যে এক্সাম শুরু হবে ভুলে গেছিস না? কয়েকটা প্রেমিক প্রেমিকা জুটিয়ে বের করবে না। আশ্চর্য! ‘

‘দেখ শ্যামা তুই তো বিয়ে করে বিয়াইত্তা সার্টিফিকেট নিয়ে নিছিস। এখন তো তোর কোনো প্যারা নাই। আমরা তো সিঙ্গেল আমাদের তো একটা হিল্লে হওয়া চাই। ‘

আদনান কে সাপোর্ট করে তাতে অন্যরা হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলালো। বিরক্ত হয়ে ওদের মধ্য হতে ওঠে চলে যায় রুহানি। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাবা তোমায় আমি পাবো তো?’

_________
পরদিন সকালে, একটা নির্জন রাস্তার মোড়ে আর্শি মমতার দেহ খুঁজে পেলো ইন্সপেক্টর নিহান কর্ণ। শরীর টা ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছে। গালে চড় মারার ছাপ গলায় কামড়ের দাগ। হাতের পায়ের অবস্থা বলা যায় না। নখ দিয়ে আঁচড়ের দাগগুলি স্পষ্ট। নিহান আর্শি মমতা কে পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে আসে। উনার প্রিয় বন্ধু ডাক্তার রিজভী রিপোর্ট হাতে বলল, ‘মহিলা টিকে অনেকজন মিলে গনধর্ষন করে এবং তার জন্য সে মারা গেছে। রিপোর্টে যা বুঝলাম, টানা তিন দিন ধরে উনার ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। শেষ পরিনতি মৃত্যু।’

ডাক্তারের কথাগুলো এ.স সহ তোমাল শুনতে পায়। তোমালের মা’য়ের মৃত্যু খবর শুনে ছেলেটা কান্না জুড়ে দেয়। এ.স রাগান্বিত চোখে তাজ ও প্রবীরের দিকে তাকায়। রাগে হাত কাঁপছে। ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলে ওরা। এ.স কে দেখে এগিয়ে আসে ইন্সপেক্টর নিহান কর্ণ। এ.স দাঁত চেপে বলে, ‘আজ যা ওরা করেছে। তার ফল ওদের কড়ায় গন্ডায় উসুল করতে হবে ইন্সপেক্টর।’

———-
সাত দিন হয়ে গেছে, শহরের অলিগলি খুঁজে ব্যর্থ হয়েছে রুহানি। অবশেষে হার মেনেছে সে, বাবার নাম ছাড়া কিছুই জানে না। খুঁজবে কিভাবে? বাবার পেশা কি? কি করে? কোথায় আছে? দেখতে কেমন? কিছুই জানে না। এভাবে আর যাইহোক একটা মানুষ কে খোঁজা যায় না। ব্যর্থ হয়ে কানাডা ফিরে যাবে সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন সকালে চলে যাবে, মন সাই দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে খুব আপন কিছু এখানে রেখে যাচ্ছে। কিন্তু কি সেটা? এইরকম অদ্ভুত অনূভুতি হচ্ছে কেনো? সে তো এখানে কিছু নিয়ে আসেনি তাহলে রেখে যাওয়ার ভয় হচ্ছে কেনো?

সুক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বারান্দা থেকে রুমে চলে আসে। তবুও মনের মধ্যে অশান্তি। অস্বস্তি অনুভব করছি। কিন্তু কেনো আমার এমন লাগছে? মাথাটাও ধরেছে। আমার কেন ভয় হচ্ছে? কেনো বারবার মনে হচ্ছে খুব খুব কাছের প্রিয় কিছু হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে?
________
‘মন খারাপ করে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

‘ভালো লাগছে না প্লিজ এখান থেকে যা। আমাকে একলা থাকতে দে।’

ওয়াসিফের প্রশ্নের তেমন গুরুত্ব দিল না আমান। বিরক্তিকর কণ্ঠে তাকে এখান থেকে চলে যেতে বলে। কিন্তু ওয়াসিফ নাছোরবান্দা। বারবার জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে?

‘আগামীকাল ভোরে নাজিন কানাডা চলে যাচ্ছে। আর চাইলেও ওর সাথে দেখা করতে পারবো না। তাই ভালো লাগছে না। হইছে শুনছিস শান্তি হইছে? এখন যা আমাকে একা থাকতে দে।’

আমানের উচ্চস্বরে বলা কথা শুনে ফেলল আরিশ। আরিশের মুখশ্রীর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাই প্রবীর ও তাজ। ওরা আসলে বুঝবার চেষ্টা করছে আরিশের ভাবভঙ্গি। আরিশ ভারী শ্বাস ফেলে সোফায় গিয়ে বসে।

তাজ বলে,
‘নাজিন যেহেতু চলে যাবে তার মানে হচ্ছে ওর সব বন্ধুরা চলে যাবে সাথে রুহানি ও চলে যাবে এ.স তুই ওদের আঁটকাবি না।’

‘ওদের চলে যাওয়ার সময় হয়েছে তাই ওরা চলে যাচ্ছে। ওদের আমি কেন আটকাতে যাবো?’

এ.স ও তাজের কণ্ঠস্বর শুনে বেলকনি থেকে আমান ও ওয়াসিফ রুমে আসে। আরিশের কথা শুনে ওয়াসিফ শানিতকণ্ঠে বলে, ‘তোর চোখমুখ দেখে বুঝা যায় তুই রুহানির প্রতি দূর্বল। তাহলে কেন একথা তুই আমাদের সামনে শিকার করিস না?’

‘আমি রুহানির প্রতি দূর্বল নই। একদম আজেবাজে কথা বলবি না।’

রাগান্বিত হয়ে আরিশ ছোট টেবিলের ওপরে লাণ্থি দিয়ে দাঁড়াল। আমান সরু কণ্ঠে বলল, ‘তুই যদি রুহানির প্রতি দূর্বল নাই হ’তি তাহলে রোজ রোজ মাঝরাতে দেখতে তার বেলকনিতে যেতিস না। রুহানি ঘুমিয়ে গেলে তার রুমে ঢুকে মেয়েটাকে ঘন্টা ঘন্টা বসে দেখতিস না। সারাদিন চোখে চোখে রাখতি না। তুই নিজেও জানিস তুই তাকে ভালোবাসিস। আর সেজন্যই সব সময় তাকে আগলে রাখার জন্য এতগুলো গার্ড তার চারপাশে রেখে দিছিস। তুই মানিস আর না মানিস তুই ও’কে ভালোবাসিস।’

মাত্রাতিরিক্ত রাগে আমানের গালে কষে চড় বসালো আরিশ। মূহুর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলো পরিবেশ। আঙুল তুলে শাসিয়ে বলল, ‘এরপর রুহানিকে আমার সাথে জড়িয়ে কেউ কোনো কথা বলবি না। ওদের দেশ থেকে চলে যাওয়াই ভালো।’
___________
সকাল নয়টা বাজে, আরিশের নাম্বারে একটা কল আসলো। কল রিসিভ করার পর অপরপাশের ব্যক্তি গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘বস মেয়েটি ও তার বন্ধু গুলো সেইফলি এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনে প্রবেশ করেছে। আর কোনো চিন্তার বিষয় নেই।’

কান থেকে ফোনটি নামিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আরিশ। দীর্ঘক্ষণ শাওয়ার নিয়ে বের হয়। আলমারির কাভার্ড থেকে মেরুন রঙের একটা শার্ট বের করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরছে। চোখের সামনে বার বার রুহানির মুখটি ভেসে উঠছে। চোখের কার্নিশে জমে একফোঁটা নোনাজল। হাতের তর্জনী দিয়ে জল টুকু মুছে নেয়। শক্ত গলায় বলল, ‘আমার স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তোমাকে দূরে সরানো জরুরি ছিল। তুমি এখানে থাকলে আমি সেটা কখনোই করতে পারতাম না।’
_________
‘আরিশের জন্য আমি মেয়ে পছন্দ করেছি। আমার ছোট বেলার বন্ধু অজয়ের মেয়েকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। ওর সাথে আরিশের বিয়েটা সেরে ফেলবো। কিন্তু এমনি এমনি আরিশ বিয়ে করতে রাজি হবে না। ও’কে রাজি করানোর জন্য আমাকে অসুস্থ হতে হবে। অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে আরিশ কে বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে ওদের চারহাত এক করে দিবো। তারপর আমি মরেও শান্তি পাবো। মরার আগে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারবো, আমার পরে আমার ভাগ্নে কে দেখার জন্য ওর জীবনসঙ্গী রেখে গেলাম।’

‘কিন্তু স্যার আপনি এটা করবেন কিভাবে? আমরা সবাই জানি এ.স বিয়ের কথা শুনলে কেমন নাক ছিটকায়। আর উনি বিয়ের জন্য রাজি হবেন? বলে আমার মনে হয় না।’

‘আকাশ। আমি কি বলেছি তুমি হয়তো বুঝোনি। বললাম না অসুস্থতার অজুহাত দেখাতে হবে। এমনিতেও আমার শরীরটা ভালো যায় না। মনে হয় বেশিদিন বাঁচবো না। ছেলের জন্য ভালো কিছু করে যেতে হবে। একা রেখে যেতে পারবো না। আমার বোনের শেষ চিহ্ন আরিশ। ও’কে কিভাবে আমি একা রেখে যাবো। কাউকে না কাউকে তো ও’কে সামলে রাখার জন্য লাগবে। ‘
_____________

রাত নয়টা ঘড়ির কাঁটা ঠকঠক করছে। তাজ, প্রবীর, আমান ও ওয়াসিফ চারজনে বসে কিছু ফাইল ঘাটাঘাটি করছে। ল্যাপটপে এক দৃষ্টিতে কিছু করছে আরিশ। পাঁচ জনের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ আরিশের ফোনের স্কিনের আলো জ্বলে উঠে। একটা মেসেজ আসছে। দেখেও না দেখার মত করে আরিশ নিজের কাজ করছে। পরপর তিনটে মেসেজ, রিংটোন শুনে আঁড় দৃষ্টিতে মোবাইলের ওপরে তাকাল। বাম হাতে ফোনটি নিয়ে লক খুলে মেসেজ সিন করে। লোড নিচ্ছে, তিনটা এসএমএসে তিনটা ভিডিও আসছে। আননোন নাম্বার থেকে ভিডিও আসছে দেখে কপাল কুঁচকালো আরিশ। ভিডিও প্লে করতে আরিশের মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায়। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে, চোখের দুটো লাল রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।রাগে কপালের রগচটা ফুলে উঠেছে। আরিশের ফর্সা ত্বক মাত্রাতিরিক্ত রাগে লাল হয়ে গেছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আরিশের এমন অবস্থা দেখে অবাক হচ্ছে ওরা। ওদের মাথায় আসছে না আরিশ কি এমন দেখছে ফোনে যা দেখা মাত্র ওর এমন অবস্থা হচ্ছে। চোখের পাপড়ি কয়েকবার পলক ফেলল আরিশ। চোখ দিয়ে এখনও অনবরত জল গড়িয়ে পরছে। ওরা কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। একে একে তিনটি ভিডিও দেখল আরিশ। রক্তাক্ত আহত অবস্থায় রুহানিকে একটা রুমের মধ্যে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হইছে। আহত রুহানি জ্ঞান হারিয়ে চেয়ারের সাথে হেলে পড়েছে। রুহানির এমন করুণ অবস্থা দেখে নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না আরিশ। হাতের ফোনটি টেবিলের ওপরে আঁচড়ে ফেলল। টেবিলের ওপর থেকে ল্যাপটপ অনান্য সব কিছু হাত দিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। রাগে ক্ষোভে শরীর রিরি করে কাঁপছে।

হুংকার দিয়ে বলল,
‘আমার কলিজার গায়ে হাত দিয়েছিস। আমার কলিজার গায়ে হাত তুলছিস তোরা ওর শরীর থেকে রক্ত জড়িয়েছিস। নিজেদের মৃত্যু কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিস,তোদের একটাকে আরিশ শাহ আস্ত রাখবো না।’

চলবে… ইন শা আল্লাহ!
বি:দ্র: ভুলক্রটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

#বিষাক্ত_ভালোবাসা
#পর্বঃ২৪
#লেখিকা #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

‘ইমিগ্রেশনের ভেতরে রুহানিকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় আধঘন্টা যাবৎ খুঁজেও কোথাও পেলো না। হার মেনে কয়েকজন লোকজন কে রুহানির ছবি দেখাল। একজন রুহানির ছবি দেখে বলে, ‘কিছুক্ষণ আগে উনাকে ইমিগ্রেশন দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছি।’

সুক্ষ্ম শ্বাস ফেলে সকলে এয়ারপোর্টের বাহিরে আসে। আশপাশে খুঁজে কোথাও রুহানিকে দেখতে পায় না। রুহানির নাম্বারে অনবরত কল দিচ্ছে, ফোনটা বারবার বন্ধ বলছে। বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। শ্যামার বাবা মি.মাহিন চিন্তিত হয়ে পরেন। কোনো উপায় না পেয়ে পুলিশের আশ্রয় নেয়। ইন্সপেক্টর আলী ভরসা দেন উনারা রুহানিকে খুঁজে বের করবেন।
_______
ইমিগ্রেশন দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার পর থেকে রুহানির বুকের মধ্যে কেমন ধুক করে উঠে। গতকাল রাতে থেকে তার অস্বস্তি একটুও কমেনি বরং বেড়েছে। মনের মধ্যে কেউ হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে মনে হচ্ছিল। ইমিগ্রেশন দিয়ে ঢুকতে রুহানির মন তাকে বাঁধা দেয়। মন আর মস্তিষ্কের লড়াইয়ে দ্বিধায় পড়ে যায় রুহানি। এমন সময় তার মন তাকে বলে, ‘চলেই তো যাবি। যাওয়ার আগে মানুষ টার সাথে দেখা করা উচিত। তাকে জানানো উচিত তুই চলে যাচ্ছিস।’

দ্বিতীয় বার কিছু ভাবেনি রুহানি। পিছনে ঘুরে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এয়ারপোর্টের বাহিরে চলে আসে। দৌঁড়ে একটা গাড়ির কাছে যায়। ট্যাক্সি ভাড়া করে, এ.স এর কোম্পানির নাম বলে৷ ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। অনেক পথ পাড়ি জমাতে হটাৎ গাড়ি জোরে ব্রেক কোষে। রুহানি কিছু বলার আগে, তার পাশে ডোর কেউ টেনে খুলে দেয়। আকস্মিক ঘটনায় তাজ্জব বনে যায় রুহানি। দুই জন মাস্ক পরা লোক রুহানি কে টেনে গাড়ি থেকে নামায়। রুহানি চেঁচামেচি করার সুযোগ পায়নি। তারা রুহানির মুখ চেপে ধরে। সকাল বেলা এদিকের রাস্তায় সচরাচর লোকজন চলাচল করে না।

ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি থেকে বের হল। উনি কিছু বলার জন্য মুখ খুলেন। একজন লোক ড্রাইভারের মুখের মধ্যে পিস্তল ঢুকিয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘নিজের জীবন বাঁচাতে চাইলে চুপচাপ চলে যা। আর যদি কারো সামনে মুখ খুলিস তাহলে ওপারে চলে যাবি।’

ড্রাইভার ভয় পেয়ে গাড়ি সহ পালিয়ে যায়। রুহানি কে টেনে একটা কালো গাড়িতে ওঠায়। অন্ধকার আচ্ছন্ন একটা রুমের মধ্যে রুহানি কে নিয়ে আসে। এক ধাক্কা দিয়ে রুমের মধ্যে ফেলে দেয়। ফ্লোরের ওপরে পরে হাঁটু তে ব্যথা পায় রুহানি। মুখ বাঁধা বলে, শব্দ করতে করতে পারেনি। হাঁটু তে হাতের কনুইয়ে চট লেগেছে ভীষণ।

সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একটা বন্ধ করে বন্ধির মতো বন্ধ হয়ে পরে থাকে রুহানি। সন্ধ্যা ছয়টার নাগাদ বন্ধ দরজাটা হঠাৎ খুলে যায়। পুরো রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার, দরজাটা খুলা মাত্র বাহির থেকে সাদা আলো রুমে উপচে পরে। পেছনে আলো সামনে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পিটপিট করে লোকটাকে দেখল রুহানি। হেঁটে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে লোকটা।

রুহানি কে দেখে আপন মনে অট্টহাসি তে মেতে ওঠল লোকটা। রুহানির চুলের মুঠি ধরে নিজের মুখোমুখি করল। সারাদিন না খাওয়া খিদে লাগছে। শরীরটা দূর্বল হয়ে পরেছে। লোকটা রুহানির চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে দাঁত কটমট করে রুহানির মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল। চোখের ইশারায় দু’জন লোককে রুমের ভেতরে প্রবেশ করতে বলে। মুখ বাঁধা হাত পিছন দিকে করে বাঁধা। দু’টি লোক অনাবিক অত্যাচার করছে রুহানির ওপরে। চোখ দু’টি দিয়ে অঝোরে পানি পরছে। দু’জন লোক তাদের প্যান্টের বেল্ট খুলে রুহানির গায়ে মারছে। ব্যথায় মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ করছে।

অন্য একজন সামনে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছে। রুহানি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। দু’জন লোক রুহানি কে ধরে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে দিয়েছে। কপাল কাটা রক্ত বের হচ্ছে, ঠোঁট দিয়েও রক্ত পরছে। আয়েশি ভঙ্গিতে বসে রুহানির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট জোড়া বাঁকা করে হাসছে। তৃতীয় ভিডিও নিজে হাতে করছে লোকটি।

অন্য একজন রুহানির হাতের ওপর তার রেখে রুহানিকে স্পর্শ করে বলল, ‘মেয়েটা জোস বস। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমরা সবাই একটু ফূর্তি করতাম।’

রাত বারো টা. এখনও রুহানির জ্ঞান ফিরেনি। রুহানির দিকে এক পলল তাকিয়ে থাকল। ফোনে নতুন একটি সিম সেট করে। তিনটি ভিডিও একে একে আরিশের নাম্বারে সেন্ট করে নাম্বার টা ফোন থেকে খুলে ফেলে।
ডেভিল হাসি হেসে বলল, ‘এ.স তোর প্রাণভোমরা এখন আমার হাতে কি করবি তুই?’
____________
আরিশ ফ্লোর থেকে ফোন হাতে নেয়। ইন্সপেক্টর নিহান কর্ণ কে কল দেয়। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘ইন্সপেক্টর ত্রিশ মিনিটের মধ্যে পুরানো বাগান বাড়িতে আসুন। সাথে আপনার ফোর্স ও ইন্সপেক্টর আদ্রিক কেও নিয়ে আসবেন। কোনো পাল্টা প্রশ্ন করবেন না। যতটা বলেছি ততটাই করুন।’

বাগান বাড়ি! কপালে হাত দিয়ে গম্ভীর বসে আছে আরিশ। তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রবীর, তাজ ও অন্য পাশে ওয়াসিফ ও আমান। সামনে চেয়ারে ইন্সপেক্টর নিহান ও আদ্রিক বসে আছে। আরিশের ফোনে ভিডিও গুলো দেখে নির্নিমেষ চোখে আরিশের দিকে তাকাল। আরিশ টেবিলের ওপরে হাত শব্দ করে রেখে বলল, ‘আমি ওদের একটা কেও জ্যন্ত রাখবো না ইন্সপেক্টর। ওরা জানে না, ওরা এ.স এর কলিজার গায়ে হাত দিছে। আমার মনে হচ্ছে কেউ আমার শরীর থেকে কেউ আমার চামড়া ছিলে নিচ্ছে। আমি ওদের টুকরো টুকরো করে ফেলবো।’

আরিশের রাগ দেখে হতবুদ্ধি চোখে ওরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। এই না কয়েক দিন আগেও বলেছিল, রুহানি ও’র দাবার গুটি ‘ও’ রুহানি কে ভালোবাসে না। তাহলে তার বিপদে সে এত রেগে গেলো কেনো?

এ.স ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে বলল, ‘ইন্সপেক্টর! আমি ওইদিন রাজেশ সরকারের বিরুদ্ধে আপনার হাতে সব প্রমাণ দিয়েছি। আজ আপনাকে ও’কে হাতেনাতে ধরে এ্যরেস্ট করতে হবে। আপনি ওদের এ্যরেস্ট না করলে আমার হাত থেকে একটা কেও কেউ বাঁচাতে পারবে না।’

ইন্সপেক্টর নিহান ও আদ্রিক একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে শক্ত ও গম্ভীর গলায় বলল, ‘তা নাহয় করা যাবে। কিন্তু আমরা ওদের ওখান পর্যন্ত পৌঁছাবো কিভাবে?’

‘আরিশ শাহ চাইলে গর্ত থেকে সাপ কেও বের করে আনতে পারে। আর সেখানে তো সামান্য গরু ছাগল কে খুঁজে বের করা খুব ইজি।’

এর আগেও যে কোনো কঠিন কেস সল্ভ করার জন্য নিহান কর্ণ সহ বড় বড় অফিসার গণ, ডিআইজি সহ অনেকে আরিশের থেকে সাহায্য নেয়। আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়া হলেও আরিশ কোনো খারাপ কাজে যুক্ত নেই। আড়ালে থেকে পুলিশের সাহায্য করে। আড়ালে থেকে অনেক মানুষ কে সাহায্য করে। যথা সম্ভব লোকেদের বিপদে এগিয়ে আসে। আরিশ শাহ নামে পুলিশে কোনো রেকর্ড নাই। আজ পর্যন্ত আঙুল তুলে কেউ আরিশ শাহ কে বলতে পারবে না সে অন্যায় করেছে বা অন্যায় কে প্রশ্রয় দিয়েছে। পুলিশ যে কাজ করতে পারে না সে কাজ মূহুর্তে এ.স করার ক্ষমতা রাখে।
_________
রাত পোহাল, ভোর হল, এখনও রুহানির কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাতে একবার শ্যামার নাম্বারে কল দিয়েছিল আরিশ। শ্যামা কল রিসিভ করে ভয় পেয়ে যায়৷ আরিশের ধমক শুনে। আরিশ শ্যামাকে ধমকিয়ে জিজ্ঞেস করে কেন সে সারাদিন তাকে কল দেয় নি? কেন জানায়নি রুহানির নিখোঁজ হওয়ার খবর।

শ্যামা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘আমরা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে ছিলাম ভাইয়া। এই সেই ঝামেলায় আপনাকে জানানোর কথা মাথায় আসেনি।’

আরিশ রাগান্বিত হয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘নিকুচি করেছে তোমার পুলিশ স্টেশন। তোমাকে আগেও বলেছি রুহানি আমার কাছে সব থেকে ইম্পর্ট্যান্ট। তবুও তুমি তার সম্পর্কে এত বড় একটা কথা জানাও নাই।’

শ্যামা নিচু কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে মাফ করে দিন ভাইয়া। আমাদের মাথায় তখন এতকিছু আসেনি।’

শ্যামার কণ্ঠ শুনে আরিশ রাগ কমালো। রুহানির কথা তাকে জানালো না। কিছু না বলে কল কেটে দেয়। তীক্ষ্ণ শ্বাস ফেলে আরিশ। এক আঙুল কপালে ঠেকিয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ায়। চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরল। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘কোথায় তুমি মায়ারনী? আমার ভুল হয়েগেছে। তোমাকে কারো ভরসায় ছাড়া উচিত হয়নি। আমার এয়ারপোর্টে যাওয়া উচিত ছিল।’

চলবে… ইন শা আল্লাহ!
বি:দ্র: ভুলক্রটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।