বিবাহিতার সাতকাহন পর্ব-১৮+১৯

0
359

#বিবাহিতার সাতকাহন
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৮

পিয়াসের মুখটা বিক্ষত। নাক মুখ একদম থেতলে গেছে। আমার চোখ দিয়ে তার অবস্থান দেখে গড়গড় করে পানি পড়ছে। নিজেকে আজ ভীষণ বিষন্ন লাগছে। আমি হালকা গলায় ডেকে উঠলাম

“পিয়াস আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছো? আমি মুমু।”

পিয়াসের হাতটা শুধু নড়ে উঠেছে। ওর হুঁশ নেই বুঝায় যাচ্ছে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। দুই মিনিট পর নার্স এসে জানান দিল রুম থেকে বের হয়ে যেতে হবে। আমি দাঁড়িয়ে থাকার সাহসও পেলাম না। আস্তে করে বেরিয়ে গেলাম। নীরবতা আমাকে ভীষণভাবে গ্রাস করছে। আমি বের হওয়ার পর সবাই জিজ্ঞেস করে উঠল পিয়াসের অবস্থা কী। বলার আর সাহস আমার হলো না। নীরবতাকেই সঙ্গী করে নিলাম।

দ্রূত নুহাশের সাথে বাসায় ফিরলাম। সারাদিন এসব করেই কাটল। রাতটাও আমাকে ভীষণ পিড়া দিল। সকালের সূচণা হলো তবে মনটা স্থির হলো না।
বিষন্নতা আমাকে ভীষণভাবে গ্রাস করেছে। না পাওয়া গুলো এখনও আমার পিছু ছাড়ছে না। সকালটা শুরু হলো ত্যাজী সূর্যের রক্তাক্ত আভায়। ভেতরে বয়ে চলা এক কড়াল রক্তক্ষরণের স্রোত আমাকে যেন ভীষণভাবে আঘাত হানছে। আমি চাই এক হয় আরেক। মাথার কাছে এসে কোনো ঝিঁঝিঁ পোকা যেন আমাকে বলে যাচ্ছে আমি ভালো নেই তবে ভালো থাকতে চাই। নিঃসঙ্গতা আমাকে ভীষণভাবে তলিয়ে নিয়েছে। তলিয়ে যেতে যেতে কোনো এক অতল গহ্বরে আমি হারিয়ে যাচ্ছি। নিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে আমার ভেতরে থাকা অস্তিত্ব। ভেতরে বেড়ে উঠা ছোটো ব্রূণটা যেন আমাকে নিয়ে হাসছে। সে হয়তো ভাবছে তার মা অপরাধী। কিন্তু তার মা তো জানে এখানে তার কোনো হাত ছিল না।

পিয়াসের চিকিৎসা চলমান। এখন সে সিঙ্গাপুর আছে৷ সেখানেই চিকিৎসা করা হবে আর সাথে প্লাস্টিক সার্জারি। এদিকে পিয়াসের পুরো পরিবার দেশের বাইরে। শুধু মিথি বাসায়। মিথি মাঝে মাঝে এসে পিয়াসের আপডেট দিয়ে যায় আর আমি মাঝে মাঝে তাকে খাবার দিয়ে আসি৷ একা মেয়ে হাত পুড়িয়ে রান্না করে খেতে তার ভীষণ অসুবিধায় হচ্ছে। এভাবেই সময় কাটছে তবে অশান্তি যেন পিছু ছাড়ছে না। এ সময় আমার দরকার ছিল বাড়তি যত্ন বাড়তি খাবার। তবে মাঝে মাঝে বাড়তি খাবার না খেয়ে, না খেয়েও থাকতে হচ্ছে।

শ্বাশুড়ি মা তার মেয়ের সাথে ঝগড়া লেগে আমার বাসায় খাওয়া বন্ধ করে দেয়। উনাকে রেখে খেতে বসলে বলে উঠে আমি উনার পেটের মেয়ে না, বলেই খেতে বসে পড়ি। যদিও এটা বুঝার ক্ষমতা মা হয়েও উনার নেই যে, এ সময় আমার সঠিক সময়ে খাওয়া কতটা জরুরি।

উনার গা জ্বালানো এসব কথা শুনে খাবার হজম তো সহজে হয় না আমার। তাই শ্বাশুড়ি মায়ের রাগ ভাঙ্গানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তিনি রাগ যদিও তার মেয়ের সাথে করেছে তবে তা ভাঙ্গিয়ে উনাকে খাওয়ানোর দায়িত্বটা পড়ে আমার উপর। সব মিলিয়ে আমার পেটে ক্ষুধায় ইঁদুর দৌড়ালেও রাগ অভিমানের পালার সমাপ্তি না ঘটিয়ে খেতে পারি না। এ অসহনীয় কষ্টের তীব্রতা কত প্রখর এটা কেবল আমি টের পাই।

আর নুহাশ এখানে নীরব। সে মায়ের পক্ষেও নেই বউয়ের পক্ষেও নেই। সে তার জায়গায় গতিশীল। আমি খেয়েছি নাকি বসে আছি তাতে তার কিছু যায় আসে না। মাস শেষে বেতন পাচ্ছে, বাজার আনছে, পোশাক কিনে দিচ্ছে, এই তো এতেই তার দায়িত্ব শেষ। আর কোনো দায়িত্ব স্বামী হিসেবে তার নেই।

মাঝে মাঝে পিয়াসের কথা মনে পড়ে ভীষণ খারাপ লাগে। সে তো আমাকে বুঝত, সময় দিত, আমার ভালো লাগা – মন্দ লাগা গুলো পাত্তা দিত। এখন তো পিয়াসও নেই। ইহকাল আর পরকালের মাঝখানে যুদ্ধ করছে। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। মাতৃত্বের এ সুখটা আজকাল আমাকে ভীষণ প্যারাও দেয়। সামনে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা । পড়তেও পারছি না। সব মিলিয়ে বিয়ের পর জীবনটা যেন আরও এলোমেলো হয়ে গেল। এখন আমি বিয়ের আগের জীবনটাকে খুব অনুভব করি। টঙ এর দোকানে বসে বান্ধবীরা চা খাওয়া, এলোমেলো আড্ডা দেওয়া। ক্যাম্পাসের স্মৃতিচারণ যেন চোখে ভেসে উঠছে।

তীব্র, অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে সময় পার হচ্ছে আমার। সারারাত কাটে ছটফট করে। ভেতরে যে বেড়ে চলছে সে কী এত কষ্টের মধ্যে সুখে আছে কি’না তা ভাবতে ভাবতে অস্থির লাগে ভীষণ। নিজেকে ছন্নছাড়া এক নিঃসঙ্গ বন্ধি পাখি লাগে আজকাল।

বহমান সময় চলছে, সে তো আর থেমে থাকবে না। কখনও জীবনে সুখ আসে আর কখনও সুখ আড়াল করে দুঃখ নামে। সুখ দুঃখের পালাক্রমেই রুপান্তরের খেলায় আজকে আমার প্রসবের সময় এসেছে। এর মধ্যে পিয়াসও বেশ সুস্থ। দীর্ঘ ৮ মাস চিকিৎসা করার পর সে এখন সুস্থ। মুখে কয়েকবার প্লাস্টিক সার্জারি করতে হয়েছে বিকৃত মুখটাকে আকৃতি দেওয়ার জন্য। শুনেছি কিছুদিন পর বাংলাদেশে আসবে। এর বাইরে আর খোঁজ নিতে পারিনি। নিতে পারলেও আর নিতে চাইনি। নিজেকে একটু গুটিয়ে নিয়েছি সব জায়গা থেকে।

হঠাৎ পেট, কোমড়ে অসহ্য ব্যথা। নিজেকে সামলাতে পারছি না। পাশে নুহাশও নেই। বড়ো বোনটা আছে। শ্বাশুড়ি মা হাসপাতালে আসেনি। হাসপাতালে থেকে উনার অভ্যাস নেই। যদিও শুনেছিলাম আমার ননদীনির বাচ্চা হওয়ার সময় হাসপাতালে বেশ কয়েকদিন থেকে সেবা যত্ন করেছিলেন। কিন্তু আমার বেলায় তা জুটে নি। এদিকে মায়ের আদরটাও এখন আমি পাচ্ছি না। আমি পরিবারের সবার ছোটো মেয়ে। আর আমার মায়ের বয়সও বেশ। সে নিজেই বার্ধক্যের গ্যাড়াকলে আটকে গেছে। আমাকে আর কী যত্ন নিবে। ছিল বড়োবোন যাকে সবসময় পাশে পেয়েছি আজ এ অতীব সময়েও সে পাশে আছে। হয়তো তার ঋন কখনও আমি পরিশোধ করতে পারব না।

রাত বাজে তিনটে। অসহনীয় ব্যথা আমাকে গ্রাস করছে। টানা চার ঘন্টার ব্যথা। ডাক্তার চাচ্ছে সিজার করতে তবে শ্বাশুড়ি মা অনুমতি দিচ্ছে না। বোনকে কল দিয়ে পই পই করে বলে দিচ্ছে সিজার যেন করা না হয়। এদিকে আমার অবস্থা খারাপ দিকে যাচ্ছে। নুহাশকে কল দিয়েও পাওয়া যচ্ছে না। একটা মিটিং এ আটকে আছে সে। এদিকে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার শেষ বারের মতো বলে দিল আমাকে সিজার করানো না হলে বাচ্চার অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে এবং আমারও এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।

অবস্থার বেগতিক দেখে আমার বোন এবার সিজারের সিদ্ধান্ত নিল। এতে যা হবার হবে। আমি এ সময়টায় আমার বোনকে কেবল পাশে পেয়েছি আর কাউকে নয়। টানা ৬ ঘন্টা ব্যথা সহ্যের পর আমাকে সিজার করতে নিয়ে গেল।

আমার কোল আলো করে আমার ছেলে আসলো। নাম রেখা আগেই ছিল। শুদ্ধ। আমার কোলে শুদ্ধ আসলো। শুদ্ধর বাবা এ মুহুর্তে নেই যে ওর কানে আজান দিবে। এ সময়টায় নুহাশকে খুব প্রয়োজন ছিল তবে অদৃষ্টের চাওয়া ভিন্ন ছিল তাই নুহাশকে পাশে পাই নি।

আমার ঘুম ঘুম চোখ। আমাকে এক জায়গায় আর শুদ্ধকে আরেক জায়গায় রাখা হলো। নুহাশ এসে বাবুকে দেখে গেল। আমাকে দূর থেকে দেখে গেল। শ্বাশুড়ি মায়ের কোমড়ে নাকি অনেক ব্যথা তাই আসতে পারে নি। আমার বোনটা আমার পাশে ছিল। দুদিন পর আমাকে কেবিনে দেওয়া হলো। আর সেদিনেই আমার শ্বাশুড়ি মা আসলেন
এসেই জুড়ে দিলেন নতুন কথা। উনার কথা শুনে মনে হচ্ছিল সিজার করে মস্ত বড়ো ভুল করেছি আমি। আমার বোনের এমন সিদ্ধান্তে তিনি বেশ রাগান্বিত।

অনেকক্ষণ তিনি বাজে বকলেন। এমন সময় কেবিনের দরজায় কারও কড়া নড়ার আওয়াজ পেলাম। আমার বোন দরজা খুলতেই আমি দরজার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম পিয়াসকে দেখে।

#বিবাহিতার সাতকাহন
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৯

এ সময়ে এ অবস্থায় পিয়াসকে দেখব আশাও করিনি। শুনেছিলাম ও আসবে কিছুদিন পর তবে আজকেই আসবে তা জানা ছিল না। যদিও আমি আর পিয়াসের সাথে সামান্য পরিমাণ কথাও বলতে চাই না। কারণ আমি চাই সে আলাদা জীবন নিয়ে ভালো থাকুক। আমার কোলেও এখন আমার শুদ্ধ এসেছে। সুতরাং আমার ছেলের জন্য হলেও পিয়াসের থেকে দূরে থাকা বাঞ্চনীয়। কে চায় তার জীবনে নতুন করে ঝামেলা হোক। আমি যেহেতু শত যন্ত্রণার পরও নুহাশকে ছাড়ব না সুতরাং পিয়াসকে আমার জীবনে জড়ানো কোনোভাবেই ঠিক হবে না। যেহেতু পিয়াস সম্পর্কের পরিণতি আর মানেটাই বদলে দিয়েছে সেহেতু এ জায়গায় আর কোনোকিছু এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না। পিয়াসকে দেখে আমার একটু বুকও কাঁপছে বটে। শুদ্ধকে কোলে জোরে চেপে ধরে পিয়াসের দিকে তাকালাম। ওর মুখটায় প্লাস্টিক সার্জারি করার পরও কাটার দাগ রয়ে গিয়েছে। আমার শ্বাশুড়ি মা পিয়াসকে কখনও এর আগে সামনাসামনি দেখে নি। তাই তাকে এভাবে কেবিনে হুট করে আসতে দেখে বেশ রাগ গলায় বলে উঠলেন

“কে আপনি? এভাবে কেবিনে ঢুকে পড়ছেন কেন? আপনাকে তো চিনতে পারছি না! বলা নেই কওয়া নেই হুট করে কেবিনে ঢুকে পড়তেছেন।”

অবশ্য আমার বড়োবোন পিয়াসকে ভালো করেই চিনত। তাই শ্বাশুড়ি মাকে আটকে দিয়ে বলল

“নুহাশের কলিগের ছেলে পিয়াস। ঐ যে যার চিকিৎসা দেশের বাইরে চলছিল সে ছেলে। মুমুকে বড়ো বোনের মতো সম্মান করে। তাই হয়তো মুমুকে দেখতে এসেছে।”

শ্বাশুড়ি মা আপুর কথা শুনে মুখটাকে ফুলিয়ে ওপাশ ফিরে তাকাল। পিয়াস দূর থেকে দাঁড়িয়েই আমাকে বলে উঠল

“মুমু আপু সুস্থ হয়েই তোমাকে দেখতে চলে আসলাম। শুনেছি তুমি মা হয়েছো। তোমার ছেলে হয়েছে। তাই তোমার ছেলের জন্য কিছু উপহার এনেছি। আশা করি তুমি নিবে। আর দ্রূত বাসায় ব্যাক করো। অনেক কথা জমে আছে তোমাকে শেয়ার করব। এখন গেলাম কেমন।”

পিয়াসের কথা শুনে আমার ভয়টা আরও বেশি কাজ করতে লাগল। না জানি শ্বাশুড়ি মা আমাকে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ করে বসে নাকি। কারণ পিয়াসের কথার ধরণ ভিন্ন তার উপর যে হারে তুমি বলছে এতে যে কারও মনে সন্দেহ আসাটাই স্বাভাবিক। ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে পিয়াসকে উত্তর দিলাম

“হুম ভালো থাকো। আর বোকার মতো সুইসাইডের সিদ্ধান্ত আর নিও না। এবার তো এইচ এস সি পরীক্ষা দিতে পারো নি। সামনের বছর আবার দিও। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। বাসায় ব্যাক করলে কথা হবে। খুব ভালো থাকো।’

শুদ্ধর জন্য আনা উপহার গুলো পিয়াস আপুর হাতে দিয়ে প্রস্থান নিল। আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। জানি না পিয়াসের মনে কী চলছে তবে খারাপ কিছু হওয়ার সম্ভবনাও যে রয়েছে তাও আন্দাজ করতে পারছি। এ দুটানা, গোলক ধাঁধা থেকে যে কবে বের হতে পারব জানি না।

হাসপাতালে আরও দুদিন থেকে বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফেরার সাথে সাথে দরজার সামনে পিয়াসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কলিজা যেন কেঁপে উঠল। থমকে দাঁড়ালাম। সবাই সামনের দিকে এগুলেও আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু সামনে যেতেই সবাই পিছু ফিরল। লক্ষ্য করল আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। নুহাশ একটু পিছু এসে আমাকে টেনে সামনের দিকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল

” তোমার কি হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?”

আমি নিজেকে সামলে উত্তর দিলাম

“নাহ। তবে পিয়াস এখানে কী করছে?”

নুহাশ হেসে জবাব দিল

“পিয়াস এখানে এসেছে আমাদের বাবুকে ওয়েলকাম করতে। আমাকে কল দিয়ে বলল বাবু আসবে তাই সে কেক এনেছে। ছেলেটা বেশ নাছোরবান্দা। আল্লাহ ওকে বাঁচিয়ে এনেছে এতেই আলহামদুলিল্লাহ। আমি আর বাঁধা দেইনি। বাচ্চা মানুষ কিছু করতে চেয়েছে করুক।”

আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম শুধু। আপু বাবুকে কোলে নিয়ে রুমে ঢুকল। আমি আর নুহাশও রুমে ঢুকলাম। পিয়াস ততক্ষণে দরজার পাশ থেকে সরে গিয়ে টেবিলের কাছে গেল। বাবুকে কোলে নিয়ে আমাকে ডাক দিল কেক কাটার জন্য। যদিও এমনটা নুহাশের করা উচিত ছিল। কারণ একটা সন্তান জন্ম হওয়ার পর সবাই শুধু বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাচ্চার মায়েরও যে একটু যত্ন, ভালোবাসা দরকার সেটা সবাই ভুলে যায়। কেউ এটা বুঝে না শুদ্ধ যেমন নিউবর্ন বেবি ঠিক তেমনি আমিও নিউবর্ন মা। আমারও যত্নের দরকার। বরং যত্নটা আমার আরও বেশি দরকার। কারণ আমি সুস্থ থাকলেই আমি আমার বাচ্চাকে সুস্থ রাখতে পারব।

কেক কাটা হলো, খাওয়া হলো। পিয়াসেই নিজ হাতে সব রান্না করেছে। এখন পিয়াস ঠিক কী চাচ্ছে তা বুঝে উঠতে পারছি না। আমি নিশ্চয় পিয়াসের কাছে যাব না এটা সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। তবে কেন এত মায়ায় আবারও জড়াতে চাচ্ছে সে প্রশ্ন কেবল মাথায় বিদ্ধ হচ্ছে।

সেদিনের মতো দিনটা পার হলো। সারাদিন রাত ব্যস্ত সময় পার হয় শুদ্ধকে নিয়ে। আপু চলে গিয়েছে। শ্বাশুড়ি মা ও বেশিদিন থাকেনি। এখন একা বাসায় সারাদিন বাচ্চা সামলানো রান্না করা বেশ মুশকিলেই হয়ে গিয়েছে। কাজের একটা মানুষও এ মুহুর্তে পাওয়া বেশ মুশকিল।

পিয়াস এখন আর আমাকে জ্বালায় না। মাঝে মাঝে তার নতুন প্রেমের গল্প শোনায়। সে নাকি নতুন প্রেমে পড়েছে। অন্য কাউকে নিয়ে নিজেকে খুশি রাখতে শিখে গেছে। আমি শুধু হু হা করে যাই। ভালো হয়েছে আলাদা জীবনে ভালো থাকবে এটাই বরং ভালো। তবে যখন জানতে পারলাম তার প্রেম এক নারীতে সীমাবদ্ধ না হয়ে বহু নারীতে আসক্ত হয়েছে তখন একটু খারাপ লেগেছে। অন্তত পিয়াসের কাছে এমন কিছু আশা আমি করিনি। রক্ষণশীল একটা পুরুষ কেন যে ভক্ষণশীল হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। যদিও তার জীবন সে জীবনে আমার কোনো অধিকার নেই নাক গলানোর। তাই তার কথাগুলো শোনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকি আমি।

এই তো কোনোরকম সংসার জীবন ভালোই যাচ্ছে। শত যন্ত্রণার মধ্যেও অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি, পড়েছি, বাচ্চা সামলিয়েছি আবার রান্না করে, ঘরের সব কাজও সামলিয়েছি। যে আমি পানিটা ঢেলে খেতে পারতাম না সে আমি আজ এত দায়িত্বশীল মেয়ে, মা, বউ। সত্যি বলতে দায়িত্ব ঘাড়ে এসে চেপে বসলে তা কখনও এড়ানো যায় না।

শুদ্ধর বয়স ছয় মাস হয়ে গিয়েছে দেখতে দেখতে। সময় বেশ দ্রুত এগিয়ে চলে। এই তো কিছুদিন আগে ছেলেটা আমার পেটে ছিল আর আজকে আমার কোলে বসে দুষ্টমি করছে। সময়ের বহমান গতিয়ময়তা এড়িয়ে চলা ভীষণ কঠিন।

আজকাল আবার পিয়াসের পাগলামি বেড়েছে। নাছোরবান্দা কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না তার সাথে আমার বিয়ে কখনও সম্ভব না। আমি নুহাশকে ছেড়ে তার কাছে কখনও যাব না। আর এ ছয় মাসে সে নাকি ছয়টা মেয়ের সাথে প্রেম করেছে কাউকেই তার ভালো লাগেনি। মুমু আসক্ত হয়ে গিয়েছে বলা চলে। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি পিয়াস ছয়টা প্রেম করেছে। তবে পরে মেয়েদের পাগলামির রেকর্ড যখন কানে এসেছে তখন বুঝতে পেরেছি পাকা খেলোয়ারের মতো পড়ালেখা বাদ দিয়ে মেয়ে পটিয়েছে। যখন দেখেছে মেয়ে পটে গেছে তখন সেখান থেকে দূরে চলে এসেছে। বোকা মেয়েরাও পিয়াসের থাবাতে কপোকাত হয়ে কাঁদছে।

রাত তিনটে বাজে। শুদ্ধ জোরে জোরে কাঁদছে। শুদ্ধর কান্না সামলাতে সামলাতে সময় যাচ্ছে। নুহাশ ডিউটিতে আছে। বাসায় কেউ নেই। একাই ছেলেকে সামলাতে লাগলাম।

কলিং বেলের আওয়াজ কানে আসলো। দরজায় গিয়ে কে কে করার আগেই দরজা খোলে গেল। যদিও দরজায় লক লাগানো ছিল। কীভাবে ওপাশ থেকে খুললো বুঝতে পারছি না। সামনের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম পিয়াস।

কপি করা নিষেধ