#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৩.
এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে করতে মোহনা এবার ক্লান্ত। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তার পাশের লোকটা বরাবরের মতোই বেশ নিরব। সে যেন মুখ খুলবে না বলে পণ করেছে। মোহনার এবার রাগ হচ্ছে। একেবারে গা জ্বালানো রাগ। লোকটা কিছু বলছে না কেন? এত প্যারা দেওয়ার কোনো মানেই হয়না। মোহনা চট করে উঠে দাঁড়াল। রেগে গিয়ে বলল,
‘সবকিছুর একটা লিমিট থাকে লরিন। আমার আর এসব সহ্য হচ্ছে না। আপনি এক্ষুণি আপনার হোটেলে ফিরে যান। তারপর সেখান থেকে সব প্যাক করে নিজের দেশে চলে যান। বাংলাদেশে আর একদিনও আপনি থাকতে পারবেন না। আপনি ভীষণ বাজে একটা লোক। আপনাকে এত অনুরোধ করার পরও আপনি আমাকে কিচ্ছু বলতে চাইছেন না। আপনার এইসব কর্মকান্ড আমার আর সহ্য হচ্ছে না। হয় আমাকে এক্ষুণি সব সত্যি বলুন, নয়তো এক্ষুণি এখান থেকে চলে যান।’
এত কথার পরেও লরিনের মাঝে খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে এক পলক তার হাত ঘড়িটার দিকে চেয়ে বলল,
‘দুইটা বাজতে চলল। ঠোমার এখন ঘুমানো উচিত মোহনা।’
মোহনা রেগে বলল,
‘ঘুমাবো না। আপনি আমার কথার জবাব দিন। বলুন, আপনাকে কে সাহায্য করছে? কার কাছ থেকে আপনি আমার সম্পর্কে এত কিছু জেনেছেন? বলুন লরিন, প্লীজ।’
লরিন নরম সুরে জবাব দিল,
‘Calm down mohona. এত হাইপার কেন হচ্ছো? সবকিছুই জানতে পারবে। সময় এলে আমি নিজেই ঠোমাকে সব বলব। এখনই এত উত্তেজিত হইয়ো না। আমি একদিন ঠোমায় সব বলব।’
‘সেই একদিন টা কোনদিন? আমাকে এক্সেক্ট ডেইট বলুন।’
‘Ok fine. সামনে মাসের বারো তারিখ।’
মোহনার কপালে ভাঁজ পড়ল। সে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘আপনি তাহলে এতদিন এখানে থাকবেন?’
লরিন হেসে বলল,
‘হ্যাঁ।’
মোহনা বিরক্ত হয়ে আবার বসল। লরিন বলল,
‘এবার শান্তি পেয়েছ?’
মোহনা তার দিকে চেয়ে বলল,
‘আপনি ভীষণ বিরক্তিকর একটা মানুষ লরিন।’
‘I know. But you know what, মানুষকে বিরক্ত করাটা একটা আর্ট। এটা সবাই পারে না। আমি পারছি, তার মানে আমি ট্যালেন্টেট।’
‘কচু আপনি।’
‘কচু? what’s that?’
‘কচু মানে আপনার মাথা।’
লরিন মাথায় হাত দিয়ে বলে,
‘কচু মিনস মাথা। মাথা মিনস হেড। ওহ, It means কচু মিনস হেড?’
মোহনা তার মাথায় হাত দিয়ে বসে। কাকে সে কী বলছে। উফফ! লোকটা তাকে পাগল করে তবেই দম ফেলবে। মোহনা জোরে নিশ্বাস টেনে বলে,
‘কচু মিনস নাথিং। কচুর চিন্তা বাদ দিয়ে আপনি এখন ঘুমাতে যান। আর আমাকেও এবার একটু শান্তি দিন।’
লরিন ভাবুক চোখে চেয়ে বলল,
‘শান্টি কোন দোকানে কিনতে পাওয়া যায়? বলো, আমি ঠোমার জন্য কিনে নিয়ে আসি।’
‘মজা করছেন আমার সাথে? আমি কিন্তু একদমই মজার মুডে নেই।’
লরিন হাসল। বলল,
‘ঠুমি সবসময়ই রেগে থাকো। কখনো তো একটু হেসে হেসেও কথা বলতে পারো। বেশি রাগ শরীরের জন্য ভালো নয়।’
‘হয়েছে আপনার বলা? আমি কেবিনে গেলাম। পারলে আপনিও হোটেলে চলে যান। গুড নাইট।’
লরি মৃদু সুরে বলল,
‘গুড নাইট।’
মোহনা তারপর কেবিনে চলে যায়। লরিন কিন্তু যায় না। সে বসে থাকে ঠাঁই। সেখানে বসেই দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই ঘুম তার ভাঙে সকাল দশটায়, কারোর কর্কশ সুরে। তাকিয়ে দেখে তার সামনে মোহনা রণমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। লরিন সোজা হয়ে বসে, তার ভাবখানা বোঝার চেষ্টা করে। মোহনার রেগে যাওয়ার কারণ ঘাটতেই তার মনে পড়ে সে সারারাত এই হসপিটালেই ছিল। আর তার জন্যই মোহনা এই মূর্তি ধারণ করেছে। লরিন তখন প্রসন্ন হাসে। চোখ কচলে উঠে দাঁড়ায়। ভারী স্বরে বলে,
‘কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।’
মোহনা নাক মুখ কুঁচকে বলল,
‘আর মিথ্যে বলতে হবে না। আপনি যে ঘাড়ত্যাড়া সেটা আমি জানি। এখন আর মিথ্যে বলে লাভ নেই। চলুন কেবিনে চলুন; আম্মু ডাকছে।’
মোহনা কেবিনের দিকে পা বাড়ায়। লরিনও তার পেছন পেছন যায়। কেবিনে গিয়ে দেখে এশা আর রাফাতও চলে এসেছে। লরিন অবাক হয়। ওরা দূরে থেকেও এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। আর সে কাছে থেকেও এতক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। কী সাংঘাতিক ঘুম তার!
লায়লা বেগম লরিন কে দেখে বসতে বললেন। রাফাত আসার সময় নাস্তা নিয়ে এসেছে। সবাই এখন নাস্তা খাবে। লরিন ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসে। মাহবুব সাহেব হালকা খাবার খেয়ে রেস্ট নিচ্ছেলেন। এতক্ষণ খেয়াল না করলেও এবার তিনি লরিনকে খেয়াল করলেন। অপরিচিত লাগল তাকে। মাহবুব সাহেব আস্তে করে লায়লা বেগমকে ডাকলেন। লায়লা বেগম কাছে গেলে তিনি তাকে লরিনের কথা জিজ্ঞেস করলেন। লায়লা বেগম বললেন, লরিন মোহনার বন্ধু আরো বললেন সেই তাকে কে রক্ত দিয়ে সাহায্য করেছে। মাহবুব সাহেব বেশ খুশি হলেন। লরিনকে আস্তে করে ডাকলেন। লরিন তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মাহবুব সাহেব নিচু স্বরে বললেন,
‘ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি না থাকলে হয়তো আজ আমার অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যেত। তোমার জন্য অনেক অনেক দোয়া রইল বাবা।’
লরিন খুশি খুশি গলায় বলল,
‘আমি কৃতজ্ঞ আংকেল। আপনার সুস্থতা কামনা করছি।’
মাহবুব সাহেব আলতো হেসে বললেন,
‘আচ্ছা, যাও খেতে বসো।’
সবাই একসাথে বসে সকালের নাস্তা করল। মাহবুব সাহেব বেডে হেলান দিয়ে বসে সবাইকে দেখছিলেন। লরিনকে একটু বেশিই খেয়াল করছিলেন। সে যে বিদেশি সেটা বুঝতে মাহবুব সাহেবের বেশি একটা সময় নিল না। তার কথাবার্তা, তার শারীরিক গঠন খুব সহজেই এটা বুঝিয়ে দেয় যে সে বিদেশি। তাও ছেলেটার মাঝে একটা দেশি দেশি ভাব আছে। কেমন খুব সহজেই মিশে যেতে পারে। মাহবুব সাহেবের মনে বেশ কৌতূহল জাগে ছেলেটার সম্পর্কে আরো কিছু জানার জন্য। মোহনাও কখনো তার এই বন্ধুর সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়নি। নতুন বন্ধুত্ব হয়েছে হয়তো। হ্যাঁ, হয়তো এইজন্যই মোহনা ওকে আপনি আপনি করে সম্বোধন করছে।
.
মোহনা বাবাকে একটা ঔষধ দিয়ে বলল,
‘বাবা, নাও। এই ঔষধটা এখন খেতে হবে।’
মাহবুব সাহেব ঔষধটা খেয়ে নিলেন। রুমে তখন মোহনার বন্ধুরা কেউ নেই। মোহনা ঔষধের প্যাকেট নিয়ে বক্সে রাখছিল। তার বাবা তখন বলল,
‘লরিন কি বিদেশি, মোহনা?’
মোহনা তাকিয়ে ইতস্তত কন্ঠে বলল,
‘হ্যাঁ বাবা, ও বিদেশি।’
‘আচ্ছা। তোমাদের ইউনিভার্সিটিতে পড়ে?’
মোহনা ঢোক গিলে। আবারও মিথ্যে বলতে হবে। তাই আর সাত পাঁচ না ভেবে সে বলে দিল,
‘হ্যাঁ।’
‘তোমরা কি একই ব্যাচের?’
মোহনা মাথা খাটিয়ে বলল,
‘না বাবা, ও আমার এক ব্যাচ সিনিয়র।’
‘ওহহ আচ্ছা। ছেলেটা ভালোই। বিদেশি হলেও খুব সুন্দর বাংলা বলতে পারে। ওর সাথে কথা বলে আমার ভালো লেগেছে।’
মোহনা প্রত্যুত্তরে ম্লান হাসে। বাবা বলেন,
‘কালকে থেকে তো তোমাদের উপরও কম ধকল যাইনি। তাই যাও এখন তোমাদের মা’কে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি এখানে একাই থাকতে পারবো। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।’
‘না বাবা, একসাথে সবার যাওয়ার দরকার নেই। মা আর মাহিয়া এখন যাক। তারপর ওরা এলে আবার আমি যাবো।’
‘আহা, এত ঝামেলা করার কী দরকার। একসাথে যাও একসাথে চলে আসবে। আমি এখানে একা থাকতে পারব।’
ওয়াশরুম থেকে মোহনার মা এসে বললেন,
‘মোহনা যা বলেছে তাই হবে। তোমার একা থাকার দরকার নেই। আমি আর মাহিয়া আগে গিয়ে আসি তারপর মোহনা যাবে।’
মাহবুব সাহেব তর্কে হেরে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মহিলা মানুষ সব এক কথায় থাকলে তখন তর্ক না করে চুপ থাকায় শ্রেয়।
মা আর মাহিয়া বাসায় গেল। মোহনা হসপিটালে একাই। মাহবুব সাহেব চোখ বুজে শুয়ে আছেন। এশা আছে তবে রাফাত কোথাও গিয়েছে। সকালের খাবারের পর মোহনা আর লরিন কে দেখেনি। হয়তো সেও হোটেলে ফিরে গিয়েছে।
কিছুক্ষণ বাদেই লায়লা বেগম আর মাহিয়া ফিরে আসে। মা একেবারে দুপুরের রান্নাবান্না করে নিয়ে এসেছেন। মোহনা এবার বাসার দিকে যায়। সে রিক্সা ডেকে রিক্সায় উঠার সঙ্গে সঙ্গেই কোথ থেকে যেন লরিন এসে হাজির হয়। মোহনা অবাক চিত্তে বলে,
‘আপনি আবার কোথ থেকে এলেন?’
লরিন জবাব না দিয়ে রিক্সায় উঠে তার পাশে বসে পড়ল। মোহনা বড়ো বড়ো চোখ করে বলল,
‘আরে কী হলো?’
লরিন তাকে পাত্তা না দিয়েই রিক্সাওয়ালকে বলল,
‘মামা চলেন..’
চলবে…
#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৪.
‘আমার কিন্তু এবার খুব রাগ হচ্ছে লরিন। আপনি আমার সাথে কেন যাচ্ছেন? আরেকটা রিক্সা নিতে পারছেন না?’
লরিন মুচকি হেসে বলল,
‘না, পারছি না। সামান্য রিক্সাও ঠুমি আমার সাথে শেয়ার করতে পারছ না? এত হিংসুটে কেন ঠুমি?’
‘কী? আমি হিংসুটে?’
মোহনা ভীষণ রকম চটে গেল। লরিন ঠোঁট চেপে হাসছে। মোহনা কে রাগিয়ে সে বেশ মজা পাচ্ছে। মোহনা বড়ো বড়ো নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘আপনি একটা অসভ্য ছেলে। নূন্যতম সভ্যতাও আপনার মাঝে নেই। আপনাকে শুধু আমি কেন জীবনেও কোনো মেয়ে পছন্দ করবে না।’
লরিন শব্দ করে হেসে বলল,
‘Seriously, you think so? Do you know, আমার ইউনিভার্সিটির কত মেয়ে আমার সাথে ডেট করতে চায়? You don’t have any idea, they are crazy for me. আর ঠুমি বলছো, কেউ আমাকে পছন্দই করবে না? আহ, হাসালে আমায়।’
মোহনা দম ছেড়ে বলল,
‘তো যান না আপনার ইউনিভার্সিটির সেইসব পাগলদের কাছেই যান। তাদের সাথেই গিয়ে ডেট ফেট করুন। এখানে কেন পড়ে আছেন? এখানে থেকে আপনার কোনো লাভ নেই, উল্টো অনেক লস হচ্ছে। তাই বেটার হবে, নিজের দেশে ফিরে যান, আর ঐসব মেয়েদের সাথে ডেট করুন।’
লরিন তীক্ষ্ণ চোখে মোহনার দিকে চেয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘By any chance, are you jealous Mohona?’
মোহনা পাল্টা জবাবে চেঁচিয়ে উঠল। বলল,
‘আমি কেন জেলাস হব? আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড লাগি নাকি যে আপনার এসব কথা শুনে আমার হিংসে লাগবে? এসব আজগুবি কথা বলা বন্ধ করুন। যা বলেছি এখন সেটা নিয়েই ভাবুন। তাতেই আপনার মঙ্গল।’
লরিন কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ পর আবার মোহনাই তাকে বলল,
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘Yeah, sure.’
‘Are you Muslim?’
‘Yeah, I am Muslim.’
মোহনা জবাব পেয়ে খানিক বিমোহিত হলো। একপলক লরিনের দিকে চেয়ে পরে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে চাইল। খানিক সময় চুপ থেকে আবারও মোহনা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘আপনার মা বাবা জানেন আপনি যে বাংলাদেশে এসেছেন?’
লরিন মোহনার দিকে চেয়ে বলল,
‘আমার মা বাবা নেই। আংকেলের কাছে বড়ো হয়েছি। আর উনি জানেন সবকিছু।’
মোহনা নিচু সুরে বলল,
‘স্যরি।’
‘It’s ok.’
পরে আর কেউই কোনো কথা বলেনি। মোহনার কেমন অস্বস্তি লাগছিল। তার মনে হচ্ছিল লরিনের হয়তো তার প্রশ্ন শুনে খারাপ লাগছে। মোহনা একবার চেয়েছিল লরিনের সাথে আরেকবার কথা বলবে। কিন্তু দ্বিধা দ্বন্দ্বের পাহাড় সরিয়ে কথা বলা আর হয়ে উঠেনি। এর মাঝে মোহনাও তার বাসায় এসে পৌঁছে যায়। রিক্সা থেকে নেমে টাকা বের করতে নিলেই লরিন তাকে বাঁধা দিয়ে বলে, সে একেবারে হোটেলে নেমে টাকা দিয়ে দিবে। মোহনা আর কিছু বলে না। লরিন হালকা করে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে সেখান থেকে চলে আসে।
গোসল শেষ করে এসে মোহনা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। দুপুরের ঝলসানো সূর্য একেবারে মাথার উপর। চারদিকে তার ভীষণ কিরন। উত্তপ্ত দহনে তার জনজীবন অতিষ্ঠ। তার এত কিসের তেজ? সারাক্ষণ এত দাউ দাউ করে কেন জ্বলে? একটু শান্ত হতে পারে না, অসহ্য। সূর্যকে এতসব কথা শুনিয়ে তবেই মোহনা ক্ষান্ত হলো। আজকাল সূর্যের এই তেজ তার পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ না হওয়ার কারণ তার জানা নেই। তবে মনে তার সূক্ষ যন্ত্রণা হচ্ছে। শীতকালকে কেন যেন খুব মিস করছে সে। সেই হাড় হিম করা শীত এখন আর আসে না। আগে শীতে গ্রামে গেলে সে শীতের কঠিন দাপট টের পেত। এখন আর গ্রামে যাওয়া হয় না। ঢাকা শহরে শীতের খুব একটা দেখা মেলে না। এত এত দালানকোঠার ভীড়ে শীত আসলে পাশ কাটিয়ে আসতে পারে না। তার মোটা শরীর নিয়ে মাঝখানেই আটকে যায়। তাই তো শীতের কথা আজকাল খুব মনে পড়ে। মনে হয়, এই অসহ্য উত্তাপের পরে এবার একটু শীতলতার খুব প্রয়োজন। আর কত সময় সেই মহান সময়ের অপেক্ষা করতে হবে কে জানে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মোহনার চুল শুকানো হয়ে গিয়েছে। সে রুমে এসে মুখে অল্প একটু ক্রিম মাখে। তারপর ওড়না টা গায়ে জড়িয়ে ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। গেইটে তালা দিয়ে বাইরে বের হয়ে মোহনা রিক্সা খুঁজতে লাগে। এই ভর দুপুরে সে তেমন কোনো রিক্সা’ই দেখছে না। অনেক্ষণ সে তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। পরে কোনো রিক্সার হদিস না পেয়ে পায়ে হেঁটেই সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। প্রায় পনেরো মিনিট হাঁটার পর সে থামল। সূর্যের তাপে ঘেমে একাকার। আর হাঁটতেও ইচ্ছে করছে না। দূর থেকে একটা রিক্সা আসতে দেখে মনে মনে ভীষণ খুশি হয়ে হয় সে। তবে তার সেই খুশী বেশিক্ষণ টিকে না। রিক্সাটা একটু কাছে আসার পরই মোহনা বুঝতে পারে এতে মানুষ আছে। হতাশ হয়ে পড়ে সে। মন খারাপ করে সাইড হয়ে দাঁড়ায়। রিক্সাটা তার কাছে এসেই থামে। মোহনা ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখে রিক্সায় আর কেউ না লরিন। তাকে দেখে মোহনা দুই হাত বুকের উপর ভাঁজ করে বিরক্ত সুরে বলে,
‘আপনি?’
‘হ্যাঁ, উঠে পড়।’
‘না, আমি আপনার সাথে যাব না।’
‘শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে? এখানে এখন কোনো গাড়ি পাবে না। চল আমার সাথে, ঠোমাকে আমি নামিয়ে দিয়ে চলে যাব।’
মোহনা ভেবে আর কোনো উপায় বের করতে পারল না। লরিনের সাথে না গেলে তাকে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে লরিনের পাশে রিক্সায় উঠে বসল সে। রিক্সা অতঃপর চলতে আরম্ভ করল।
দুজনেই খুব চুপচাপ। ফাঁকা রাস্তায় খুব একটা গাড়ি নেই। মেশিনের রিক্সাটা তাই খুব ছুটছে। মোহনা খোলা চুল বাতাসের তালে তালে যেন এক নৃত্য তে মেতেছে। একপাশের চুল বারবার লরিনের মুখের উপর গিয়ে পড়ছে। মোহনা সেগুলো কে দ্রুত গুছিয়ে নিলেও বাতাসের বেগে সে আটকাতে পারছে না। এক পর্যায়ে চুলগুলো সব একপাশে নিয়ে এল। লরিন তখন ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘চুলগুলোকেও কি একটু স্বাধীনতা দেওয়া যায় না?’
মোহনা বুঝল না। প্রশ্নসূচক দৃষ্টি তে তাকালে লরিন বলে,
‘বুঝনি? থাক আর বুঝতে হবে না।’
মোহনা কিছুক্ষণ বিরক্ত চোখে চেয়ে থেকে চোখ সরাল। লরিন পুনরায় বলল,
‘আচ্ছা, ঠোমার বাবার এক্সিডেন্ট কীভাবে হয়েছিল?’
‘জানি না, এই ব্যাপারে এখনো বাবার সাথে কথা হয়নি।’
লরিন আর কোনো প্রশ্ন করল না। রিক্সা তার গন্তব্যে এসে থামে। মোহনা নেমে এবার জোর করেই ভাড়া টা দিয়ে দেয়। এতে লরিন খুব রেগে যায়। সে আর সেই রিক্সা দিয়ে যায় না। মোহনার সাথে কোনো কথা না বলেই সোজা রাস্তায় হাঁটা ধরে। লরিনের এমন ব্যবহারে মোহনা খুব অবাক হলেও ব্যাপারটা খুব একটা আমলে নিল না নিয়ে সে ভেতরে চলে যায়।
মোহনা কেবিনে গিয়ে দেখল তার বাবা খেয়ে দেয়ে ঘুমাচ্ছে। মা আর বোন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল, সে আসলে এক সঙ্গে খাবে বলে।
খাওয়া শেষ করে মোহনা মা’কে সাহায্য করে সবকিছু গোছাতে। কাজ করতে করতেই মা’কে সে জিজ্ঞেস করে,
‘আম্মু, বাবার এক্সিডেন্ট টা কীভাবে হয়েছিল? বাবা কিছু বলেছে?’
‘হু, রিক্সা দিয়ে বাস স্টেশনে যাওয়ার সময় নাকি একটা ছোট ট্রাক এসে পেছন দিয়ে জোরে ধাক্কা দেয়। তোর বাবা তাল সামলাতে না পেরে ডিরেক্ট গিয়ে রাস্তায় পড়েন। অত জোরে পড়ার কারণে মাথায় অনেক ব্যাথা পান। রাস্তাতেই নাকি অনেক রক্ত গিয়েছে। পরে সেই রিক্সাওয়ালা সহ আরো কিছু লোক উনাকে হসপিটালে নিয়ে আসেন।’
‘আর ঐ ট্রাক ড্রাইভার? ওকে কেউ ধরতে পারেনি? ও কেন ধাক্কা দিল?’
‘সেকি আর দাঁড়িয়েছে নাকি? ধাক্কা দিয়েই তো পালিয়ে গিয়েছে।’
‘ওর নামে মামলা করতে হবে আম্মু। এভাবে কে গাড়ি চালায়? দেখে শুনে চালাবে না? আমি ওর নামে থানায় মামলা করব।’
‘থাক মা, এখন আর এত ঝামেলা করে কোনো লাভ হবে না। আল্লাহ যে তোমার বাবাকে সুস্থ করে দিয়েছেন সেটাই আমাদের জন্য অনেক।’
মোহনার সেই ট্রাক ড্রাইভারের উপর খুব রাগ হয়। সামনে পেলে হয়তো খুব কেলানি দিত। ঐ লোকের ছোট্ট ভুলের জন্য আরেকটু হলেই তো সে তার বাবাকে একেবারের জন্যই হারিয়ে ফেলছিল। কী ভয়ানক ব্যাপার, ভাবতেই তো বুকে মোচড় দিয়ে উঠে তার।
________________________________________
পরদিন মাহবুব সাহেবকে নিয়ে হসপিটাল থেকে সবাই বাসায় ফিরে। এশা আর রাফাতের সাথে সেখানে লরিনও ছিল। যাকে মোহনা একটু পরপর চোখ রাঙিয়ে বলছিল বাসা থেকে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু লরিন তার বাবার সাথে যে আড্ডা জুড়িয়েছে মনে হচ্ছে না সে এত সহজে যাবে। মোহনার যেমন এতে বিরক্ত লাগছে অন্যদিকে আবার ভয়ও করছে। হুট করে লরিন আবার সবকিছু বলে না দেয়। ওর যা ঠোঁট কাটা স্বভাব, ভুল করেও যদি কিছু বলে ফেলে তাহলেই মোহনা শেষ।
চলবে….