#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৭.
সন্ধ্যার দিকে মেহমানরা চলে গেলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর মোহনা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গিয়ে একটু হেলান দিয়ে বসে। কিছু একটা নিয়ে তার চিন্তা হচ্ছে। সে ছাদ থেকে নামার পর থেকেই খেয়াল করেছে তার মা বাবা আর অরূপের মা বাবা কী একটা নিয়ে যেন খুব সতর্ক ভাবে কথা বলছেন। কেমন একটা যেন চঞ্চলতা ভাব তাদের মধ্যে। কী নিয়ে এত সোরগোল মোহনা তখন বুঝতে পারেনি। পরে মা’কে জিজ্ঞেস করেছিল তবে মাও তাকে তেমন কিছু বলেনি। ব্যাপারটা পুরোপুরি অস্বাভাবিক না হলেও একটু চিন্তা তার হচ্ছেই।
মাহিয়া ধপ করে তার সামনে এসে বসল। দু হাত ছড়িয়ে উল্লাসিত কন্ঠে বলল,
‘আজকে কি সুন্দর একটা দিন কাটিয়েছি, উফ। আর অরূপ ভাইয়া তো ঝাক্কাস একটা মানুষ। দেখো, কত কিছু আমার জন্য নিয়ে এসেছে।’
মাহিয়ার জন্য অরূপ সত্যি সত্যিই অনেক কিছু এনেছে। মেকআপের জিনিস মাহিয়ার বরাবরই পছন্দ। তাই একগাদা মেকআপ এনেছে অরূপ। সাথে তো চকলেট আছেই। তবে মোহনার জন্য সে একটা অদ্ভুত জিনিস এনেছে। একটা ছোট্ট ডায়েরী আর একটা কলম। তবে কলমটার একটা বিশেষত্ব হলো এটা দিয়ে লিখলে সেই লেখা খালি চোখে দেখা যায় না। সেই লেখা দেখতে হলে ঐ কাগজটাকে আগুনের উপর ধরতে হবে। এত কিছু থাকতে এটাই কেন দিল কে জানে? এসব জিনিস দিয়ে সে কী করবে? মোহনা এসব প্রথম দেখেছিল একবার সি আই ডি তে। কাগজে কিছু লেখা থাকে না অথচ আগুনের কাছে নিলেই ফরফরিয়ে সব স্পষ্ট হয়ে উঠে। সেকি আশ্চর্যই না হয়েছিল প্রথম এটা দেখে। এখন আগের কথা ভেবে সে মনে মনে হাসে। তারপর সেই ডায়েরী আর কলমটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখে। তারপর কী ভেবে ডায়েরীটা খুলে মাঝের একটা পাতা বের করে কিছু লিখতে আরম্ভ করে। সামনে থেকে মাহিয়া একটু উঁকি ঝুঁকি মারে দেখার জন্য। তা দেখে মোহনা হেসে বলে,
‘দেখ দেখ, যত খুশী দেখ।’
মোহনা জানে মাহিয়া কিছুই দেখছে না। ইনফেক্ট, সে নিজেও কিছু দেখছে না। আন্দাজের উপর লিখে যাচ্ছে কেবল। কী জানি কী লিখল। লেখা শেষ করে ডায়েরীটা বন্ধ করে কলম সমেত আলমারি তে রেখে দিল। আবার কোনো একদিন হয়তো খুলে দেখবে।
রাতে মাহিয়া আর মোহনা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। মোহনা সারাদিন একটু বেশিই কাজ করেছে। তাই শুতে শুতেই ঘুমে তলিয়ে যায় সে। তবে মাহিয়ার তখনও ঘুম আসে না। জেগে জেগে কী করবে বুঝতে পারছে না। ঘুমন্ত বোনের গায়ে এক পা তুলে ফ্যানের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবে কী করা যায়। ভাবতে ভাবতেই তার হঠাৎ লরিনের কথা মনে পড়ে গেল। সে উঠে তখন আস্তে করে মোহনার ফোনটা নিয়ে লরিন কে একটা টেক্সট দিল। মেসেজে লেখা ছিল, “সরি”
মোহনার নাম্বার থেকে এমন একটা মেসেজ দেখে লরিন তো আকাশ থেকে পড়ল যেন। সে সঙ্গে সঙ্গেই রিপ্লাই দিল,
‘What happen?’
মাহিয়া লিখল,
‘Nothing.’
তারপর মাহিয়া আবার লিখল,
‘Are you angry with me?’
আরেকদফা অবাক হলো লরিন। কেন যেন তার সন্দেহ হলো এটা মোহনা না। সে উত্তরে লিখল,
‘You are Mahiya, am I right?’
মেসেজটা দেখে মাহিয়ার চোখ মুখ বিরক্তিতে গুঁজে এল। সে রিপ্লাই দিল,
‘না, আমি মোহনা।’
লরিন একটা হাসির ইমুজি পাঠিয়ে লিখল,
‘তোমার বোন কখনোই আমার সাথে এত সুন্দর ভাবে কথা বলবে না। তুমি ধরা পড়ে গিয়েছ মাহিয়া।’
মাহিয়া বিরক্তির একটা ইমুজি পাঠাল। লরিন পাঠাল মুচকি হাসির ইমুজি। তারপর লরিন লিখল,
‘এখনো ঘুমাওনি কেন? তোমার বোন কী করছে?’
‘আপু ঘুমাচ্ছে। কিন্তু আমার ঘুম আসছে না।’
লরিন লিখল,
‘তোমার বোন জানলে খুব রাগ করবে। আর মেসেজ দিও না। এই মেসেজ গুলোও ডিলিট করে দাও।’
‘আচ্ছা করে দিব। তবে ভাইয়া, আপনি কি সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন?’
লরিন হালকা হাসির ইমুজি পাঠিয়ে বলল,
‘না, কষ্ট পাওয়ার কী আছে?’
মাহিয়া লিখল,
‘আমাদের বাসায় আবার কবে আসবেন, ভাইয়া?’
‘আসব, একদিন সময় করে আবার আসব।’
মাহিয়া খুব খুশি হয়ে লিখল,
‘আচ্ছা, তাড়াতাড়ি আসবেন।’
লরিন উত্তরে লিখল,
‘ঠিক আছে। এবার তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো। গুড নাইট।’
‘লাস্ট একটা কথা জিজ্ঞেস করব, ভাইয়া?’
‘কী? বলো।’
মাহিয়া কিছুক্ষণ ভেবে লিখল,
‘আপুকে কি আপনি ভালোবাসেন?’
মেসেজ টা দেখে লরিন কিছুক্ষণ নির্বাক চেয়ে রইল মোবাইলের দিকে। উত্তর কী দেবে ভেবে পাচ্ছে না। মেয়েটা ছোট হলেও পাকা ভীষণ। সে ভেবে উত্তরে লিখল,
‘এই যে ম্যাডাম, এত পাকা পাকা কথা না বলে এবার ঘুমান। আপনার আপু জানলে আপনাকে আর আস্ত রাখবে না। সাথে আমারও মাথা ফাটাবে। তাই আপুর হাত থেকে বাঁচতে হলে এখন ঘুমাতে হবে, ওকে? নো মোর মেসেজ, শুভ রাত্রি।’
মেসেজটা দেখে মাহিয়া আর কোন মেসেজ পাঠাল না। সবগুলো মেসেজ ডিলেট করে, ফোনটা বালিশের কাছে রেখে সেও ঘুমিয়ে পড়ল।
___________________
মোহনা তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বের হয়েছে। লেইট হয়ে গিয়েছে অনেক। প্রথম ক্লাসটা নির্ঘাত মিস। যখন তাড়াহুড়ো করা লাগে তখনই কোনো গাড়ি পাওয়া যায় না, এটাই নিয়ম। মোহনা রেগে গেল খুব। সব রিক্সাওয়ালা কি একসাথে শহর থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে? সে উপায়ান্তর না দেখে জোর পায়ে হাঁটতে আরম্ভ করে। কিছুটা পথ সামনে যেতেই পেছন থেকে কে যেন তাকে ডেকে উঠে। সে ফিরে দেখল, এশা। এশার রিক্সাটা মোহনার সামনে এসে থামে। মোহনা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘কিরে, তুই ঐদিকে কোথায় গিয়েছিলি?’
‘ঐ তো একটু সামনে, একটা কাজ ছিল। তুই রিক্সায় উঠ।’
মোহনা তার রিক্সায় উঠে পড়ে। যেতে যেতে মোহনা তার কাছে অরূপের কথা বলে। অরূপের কথা শুনে এশার মুখ যেন কেমন কালো হয়ে গেল। তার যেন ঠিক পছন্দ হলো না অরূপ নামক ছেলেটাকে। তবে সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না, কেবল মোহনার কথাই শুনে গেল।
একটা ক্লাস শেষ হওয়ার পর সবাই যার যার মতো ক্যান্টিনের দিকে যায়। মোহনা, মাহি আর রাফাতও ক্যান্টিনের দিকেই যাচ্ছিল। তবে পথিমধ্যে তারা দিশার গলা পেয়ে থেমে গেল। দিশা যেন ফোনে কার সাথে কথা বলছে। তার স্বর খানিকটা চওড়া। কাকে যেন খুব রাগ দেখিয়ে বলছে,
‘কেন, একটু দেখা করলে কী হয়? তুমি এমন কেন করছো? কেন ঐ মেয়ের পেছনেই পড়ে আছো, আমাকে কি চোখে পড়ে না?’
ওর এহেন টাইপ কথা শুনে সবাই বুঝে যায় সে কার সাথে কথা বলছে। এশা তখন এক ছুটে দিশার পেছনে দাঁড়িয়ে বলে,
‘কিরে, লরিন বুঝি পাত্তা দিচ্ছে না?’
দিশা দাঁতে দাঁত চেপে এশার দিকে চাইলে এশা তাকে চোখ টিপ মেরে হাসতে হাসতে সেখান থেকে চলে যায়।
ক্যান্টিনে বসে বলে,
‘দেখেছিস, আমাদের দিশা এখন সব ছেড়ে বিদেশির পেছনে পড়েছে।’
মোহনা ভারি নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘ভালোই হয়েছে, অনন্ত ঐ মহান পুরুষ আমার ঘাড় থেকে তো নামবে।’
এশা বিরক্ত হয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, তুই এইদিকে পাত্তাই দিচ্ছিস না আর ঐদিকে একজন তার জন্য শহীদ হয়ে যাচ্ছে।’
রাফাত মাঝখান থেকে বলল,
‘এইজন্যই বলে, একেক মানুষের মন একেক রকম। তোমার যাকে ভালো লাগবে না অন্য কেউ আবার তাকেই পাগলের মতো ভালোবাসবে। এটাই প্রকৃতি।’
‘আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে। এইসব প্রাকৃতিক জিনিস পত্র সাইডে রেখে আপাতত দুইটা কফি অর্ডার কর, মাথা ধরেছে কফি খেতে হবে।’
.
বিকেলের দিকে মোহনা বেলকনিতে বসে গুনগুন করে গান গাইছিল আর তার ফুলগুলো দেখছিল। হঠাৎ তখন তার ফোনে টুং করে একটা শব্দ হয়। মোহনা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে একটা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। যেখানে লেখা, “Who is Arup?”. নাম্বারটা মোহনা চিনে ফেলল। লরিনের নাম্বার। কিন্তু সে অরূপের কথা জানতে চাইছে কেন? আর সে অরূপের কথা জানলই বা কী করে?
চলবে…
#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৮.
মোহনা লরিনকে ডিরেক্ট কল করে বসল। লরিন সেই কল রিসিভ করলে মোহনা তিক্ত সুরে বলল,
‘অরূপের কথা আপনি কী করে জানলেন?’
‘কী করে জেনেছি সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হলো এই অরূপটা কে সেটা জানা। Who is he?’
‘আমার বাবার বন্ধুর ছেলে।’
মোহনার সরাসরি জবাব। লরিন খানিকটা চুপ থেকে বলল,
‘ঠোমার বাবা আবার তার সাথে ঠোমার বিয়ে দিয়ে দিবে না তো?’
মোহনা গলার স্বর এবার চওড়া করে বলে,
‘আপনাকে কে বলেছে উনার সাথে বাবা আমায় বিয়ে দিবে? আর যদি দেয় ও তাতেই বা আপনার কী?’
লরিন চাপা সুরে বলল,
‘ঠোমার বিয়ে হয়ে গেলে আমার কী হবে?’
মোহনা বিরক্ত সুরে বলল,
‘আপনিও তখন আপনার দেশের কেউ একজনকে বিয়ে করে সুন্দর সংসার শুরু করবেন।’
লরিন বিষন্ন মনে বলল,
‘ইশ, যদি আমার ক্ষমতা থাকত তবে আমি অবশ্যই আমার মনকে কন্ট্রোল করতে পারতাম। কিন্তু আফসোস! আমার সেই ক্ষমতা নেই।’
‘চাইলেই পারবেন। মন আপনার, সেটাকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতা আপনার থাকতে হবে। নয়তো সেই মন বারবার ভুল কাজ করে বসবে, পরে তো তার জন্য আপনাকেই পস্তাতে হবে তাই না? তাই আগে থেকেই মনকে কন্ট্রোল করতে শিখুন।’
লরিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কিছু হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রণা তাকে ভীষণ ভাবে আঘাত করছে। মোহনার প্রতি তার এক অন্তরীক্ষ মায়া। সেই মায়া কাটিয়ে উঠার মতো ক্ষমতা তার নেই। ভাবলেই তো বুক ধরফর করে, মন বিষিয়ে উঠে। সাধারণ একটা মেয়ের প্রতি এত কেন আকৃষ্ট তার, কেন এত মায়া। মায়ার এই তীব্রতা থেকে সে কীভাবে তার মনকে উদ্ধার করবে সেই উপায় তার আজও জানা নেই। তবুও যদি কোনোদিন মোহনা অন্যকারোর হয়ে যায়, তবে সে অবশ্যই খুব কষ্ট পাবে। বুক তার সেদিন নিশ্চয়ই তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে উঠবে।
লরিননের নিরবতা দেখে মোহনা বলল,
‘আর কিছু বলার আছে আপনার?’
লরিন কিছুটা সময় নিয়ে কম্পিত সুরে বলল,
‘ঠোমাকে হারিয়ে ফেলার কথা ভাবলে আমার বুকে ব্যাথা হয়, মোহনা।’
লরিনের এই সুরে বিষাদ স্পষ্ট। যেন মোহনাকে না পাওয়ার এক আক্ষেপ ছেলেটাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কেমন যেন মোহনার মায়া হয় তার জন্য। ছেলেটার অমন মিইয়ে যাওয়া স্বর তার মনকে আটকে ফেলছে যেন। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি লরিনও শুনতে পায়। হয়তো সেও বুঝতে পারে, মোহনা নিরুপায়। লরিন তাই মিহি সুরে বলে,
‘আমরা কি অন্তত বন্ধুও হতে পারিনা?’
মোহনা দ্বিধাহীন সুরে বলল,
‘যদি বন্ধুত্বের খাতিরে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে তখন আপনার সাথে সাথে আমারও কষ্ট হবে, লরিন।’
লরিন হতাশ হয়ে পড়ল। অনেক ভেবে বলল,
‘তেমন কিছু হবে না। আমি কখনো আমাদের বন্ধুত্বের সীমা লঙ্ঘন করব না। যেমন সম্পর্ক ঠোমার রাফাত আর এশার সাথে তেমন সম্পর্কই ঠোমার আমার সাথে থাকবে।’
মোহনা স্পষ্ট স্বরে বলল,
‘তাহলে আমার বিয়ে হয়ে গেলেও আপনি কষ্ট পাবেন না, বরং এশা আর রাফাত আমার বিয়েতে যেভাবে আনন্দ করবে আপনাকেও ঠিক সেইভাবেই আনন্দ করতে হবে।’
লরিন আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বিচলিত সুরে বলে,
‘তাহলে কি ঠোমার সত্যি সত্যিই অরূপের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে? ঠুমি সত্যিই ওকে বিয়ে করে ফেলবে, মোহনা?’
মোহনা চোখ বুজে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বলল,
‘এই তো বিয়ের কথা শুনে অস্থির হয়ে পড়লেন। এবার আপনিই বলুন, আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব কী করে সম্ভব? আপনি পারবেন একজন বন্ধু হিসেবে আমার বিয়েটা হাসি মুখে মেনে নিতে? যদি বলেন পারবেন, তবে আমিও আপনার বন্ধু হতে রাজি।’
লরিন দুটানায় পড়ে গেল। এর আগে কখনো এমন কঠিন মুহুর্তে সে পড়েনি। কী সিদ্ধান্ত নিবে? কী বলবে? মোহনাকে হারালে যেমন কষ্ট হবে তেমনি বন্ধু হিসেবে তার বিয়ে দেখাটাও কষ্ট হবে। এত জটিল কেন সবকিছু? এত এত প্যাঁচে তার মাথা এখন আর কাজ করছে না। লরিন শুকনো মুখে বলল,
‘আচ্ছা এখন রাখি। পরে বলব।’
লরিন কল কেটে দিল। মোহনা তার ফোনটা পাশে রেখে মনে মনে ভাবতে লাগল, “ইশ, যদি ভাগ্য লরিনের সহায় হতো, তবে কতই না ভালো হতো।”
.
রাত আট’টা,
মোহনা তার টেবিলে বই খুলে বসে আছে। পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। কিছু একটা নিয়ে সে খুব অস্থির। মাহিয়া অন্য টেবিলে গলা ছেড়ে পড়ে যাচ্ছে। পর্যায় সারণির মৌলগুলো তার টুটস্থ মুখস্ত, তাও কেন এই মেয়ে বারবার রসায়ন বই খুলে এই একটা জিনিসই চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে পড়ে কে জানে। মোহনা গালে হাত দিয়ে বোনের দিকে ফিরে তাকায়। বোন তার চোখ বন্ধ করে পড়ে যাচ্ছে। বাহ, মেয়েটা নির্ঘাত এ প্লাস পাবে। ওর বয়সে মোহনাও এত পড়েনি, আর তার জন্যই হয়তো অল্প কিছু পয়েন্টের জন্য তার এ প্লাস ছুটে গিয়েছিল। যাক, সেসব নিয়ে সে আর ভাবতে চায় না। আপাতত তার মন আর মস্তিষ্ক অন্য কথা ভাবছে। সে মাহিয়াকে ডেকে থামতে বলল। মাহিয়া পড়া থামিয়ে অদ্ভুত চোখে বোনের দিকে চেয়ে বলল,
‘কী হয়েছে?’
মোহনা কিছুক্ষণ থ মেরে বসে থেকে বলল,
‘আমার না এবার এশা কে সন্দেহ হচ্ছে।’
মাহিয়ার ফর্সা ললাটে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে বলল,
‘কী নিয়ে?’
মোহনা হাঁসফাঁস করছে। এশাকে সন্দেহ করা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। তবে তার অযাচিত মন সেই কথাই মানতে নারাজ। সে বারংবার কেবল বলে যাচ্ছে, “এশা’ই সে, যে লরিনকে সাহায্য করছে”। তবে এই অদ্ভুত সন্দেহের কোনো যুক্তি এখনও মোহনা তলিয়ে পাচ্ছে না। যুক্তিহীন কোনো বিষয় নিয়ে এশাকে সন্দেহ করা অবাঞ্ছনীয়। তবে একেবারে সন্দেহ না করেও থাকতে পারছে না।
মাহিয়া যেন বোনের এমন নিরবতায় খুব বিরক্ত হলো। তার পড়া থামিয়ে এভাবে ঘাপটি মেরে বসে থাকার কোনো মানে হয়না। সে আবারও তাই পড়তে আরম্ভ করল। এবার মোহনা চেতে গেল। রূঢ় সুরে বলল,
‘আশ্চর্য, একদিনেই সব পড়ে শেষ করে ফেলবি নাকি?’
‘তো কী করব? পড়া বন্ধ করে তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছি কিন্তু, তুমি তো কিছু বলছো’ই না।’
মোহনা নিশ্বাস নিল। বলল,
‘বলতে চাইছি আবার চাইছিও না। আসলে আমার এখন মনে হচ্ছে এশা’ই হয়তো লরিনকে সাহায্য করছে।’
‘কী? মাথা খারাপ তোমার? এশাপু কেন লরিনকে সাহায্য করবে? ও তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ও তোমার সাথে কখনোই এমন করবে না।’
মোহনা অসহায় গলায় বলল,
‘হ্যাঁ, সেটাই তো। আমিও তাই ভাবছি। কিন্তু এশার কিছু ব্যবহারে আমার ওকে সন্দেহ হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না কী করব। ঐ ব্যক্তিটাকেও খুঁজে পাচ্ছি না। তবে আমি শিউর ওদের কারো মধ্যেই এসব কেউ করছে। দিশার উপর থেকে আপাতত আমার সন্দেহ উঠে গিয়েছে। আর বাকি রাফাত, ওর উপর আমার সন্দেহ হচ্ছে না। কারণ ওর আমার ব্যাপারে কোনো ইন্টারেস্টই নেই। ও সারাক্ষণ এশা এশা’ই করে। তো এখন সবশেষে সন্দেহ বার বার এশার উপরই পড়ছে। তারও অবশ্য কারণ আছে। আজ সকালে আমি এশাকে অরূপের কথা বলেছিলাম। রাফাতও কিন্তু অরূপের ব্যাপারে জানে না, জানে শুধু এশা। ওমা, বিকেলে দেখি লরিন আমাকে মেসেজ দিয়ে অরূপের কথা জানতে চাইছে। এখন তুই’ই বল, লরিন কী করে অরূপের কথা জানল? মানলাম, ও হয়তো আমাদের বাড়ির উপর নজর রাখে সেই সুবাদে আমাদের বাড়িতে যে মেহমান এসেছে সেটা হয়তো ও দেখেছে; কিন্তু এখানে অরূপের নাম ও কী করে জানল? আমার তো মনে হচ্ছে এশা’ই ওকে অরূপের কথা বলেছে, আর তাছাড়া ওর জানার কোনো উপায়ও নেই।’
মোহানার কথা শুনে মাহিয়াও খুব চিন্তায় পড়ল। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
‘এখন তাহলে কী করবে? যদি সত্যি সত্যিই এশাপু এত কিছু করে থাকে, তখন?’
মোহনা শক্ত হয়ে বসল। বলল,
‘কাল আমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলব। আর কত লুকোচুরি হবে? এবার যা হবে সামনা সামনি হবে।’
চলবে…