প্রণয় রেখা পর্ব-২১+২২

0
263

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২১.

‘কিন্তু, এশা তো আমাকে এসব কিছু বলেনি।’

মোহনা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ও কেন কিছু বলেনি তা আমি জানিনা। তবে ও এসব কিছু করেছে শুধুমাত্র আপনাকে এই দেশে রাখার জন্য। এতদিন তো আপনি আপনার মায়ের দেশে ছিলেন আর এখন না হয় বাবার দেশে থাকলেন। এই দেশেও আপনার অনেক প্রিয় মানুষ আছেন, যারা আপনাকে ভালোবাসেন। আপনি চাইলেই তাদের সাথে থাকতে পারেন। আফটার অল আপনি তো তাদেরই রক্ত। রক্তের টানে এখানেই থেকে যেতে পারেন। আর আপনার অসুস্থ দাদা দাদুও এমনটাই চান। এখন আপনি ভেবে দেখুন কী করবেন।’

লরিন এখানে থাকতে চায়। তবে সে জানতো না এখানেও তার এত ঘনিষ্ঠ এক পরিবার আছে। সে জানতো না ঐ মানুষগুলো তাকে ভালোবাসে। তার কাছে ঐ সম্পর্কগুলো ছিল অচেনা। সে তো এখানে কেবল মোহনার জন্য থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন তো তারও এখানে একটা থাকার জায়গা আছে। তারও পরিবার আছে। সে চাইলেই এখানে থাকতে পারে, আজীবন থাকতে পারে। কিন্তু এখানে থেকেও যদি সে মোহনাকে না পায় তবে এই থাকাতে কী লাভ?
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর লরিন খুঁজে পেল না। মোহনা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে লরিনের পানে তার উত্তরের আশায়। লরিন ম্লান সুরে বলল,

‘হ্যাঁ, আমি থাকব। আমার পরিবারের কাছেই থেকে যাব। কিন্তু, তাও তো আমি ঠোমাকে পাব না মোহনা।’

মোহনা চোখ সরিয়ে ফেলল। এত আক্ষেপ কেন ছেলেটার? মোহনাকে না পেলে কি তার জীবন বৃথা হয়ে যাবে? নিশ্চয়ই তা হবে না। পৃথিবীতে তো আর মেয়ের অভাব নেই, মোহনা ব্যতীতও আরো সুন্দর মেয়ে আছে। সে চাইলেই অন্য একজনকে বিয়ে করে ফেলতে পারে। এই নিয়ে এত আক্ষেপের কী আছে। মোহনা শক্ত গলায় বলল,

‘আমাকে না পেলে অন্য কাউকে বিয়ে করবেন, তাহলেই তো হয়।’

লরিন হতাশ কন্ঠে বলল,

‘অন্য কাউকে বিয়ে করলেই কি আমি ঠোমাকে ভুলে যেতে পারব?’

মোহনা লরিনের দিকে তাকাল। ছেলেটার চোখদুটো চিকচিক করছে। বেদনা তার নেত্রকোণে স্পষ্ট। মায়া হচ্ছে, খুব মায়া। এত প্রেম কেউ কী করে উপেক্ষা করবে? এত স্বার্থপর কেউ কী করে হয়? মোহনা যে পারছে না। তার কাঠিন্য হৃদয়ও যে অকেজো হয়ে পড়ছে। দূর্বলতা গ্রাস করছে তাকে।

মোহনা চোখ বুজে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘আমার বাবা মা বোধ হয় খুব শীঘ্রই আমার বিয়ে ঠিক করবেন। আর আমি কখনোই আমার মা বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারব না। যদি তারপরও আপনি আমাকেই চান তবে বলব, সাহস থাকলে আমার বাবার সাথে কথা বলুন। প্রেম নয়, বাবাকে গিয়ে ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব দিন। যদি বাবা আপনার প্রস্তাবে রাজি হন তবে আমারও আর কোনো আপত্তি থাকবে না।’

মোহনার কথা শুনে লরিন ভাষা হারিয়ে ফেলে। প্রথমে সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না কিছু। মোহনা তাকে বিয়ের কথা বলতে বলছে? আদৌ সে সত্যি সত্যিই এসব শুনছে তো? এটা আবার তার কোনো সুন্দর স্বপ্ন নয়তো? সে অনেকক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে মোহনার দিকে চেয়ে থাকে। মোহনা তা দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? বিয়ের কথা বলতে বলেছি, বলেনি যে এখনই বিয়ে করব। বাবা রাজী না হলে আমিও রাজী না। আর এই কথাটা মাথায় রেখেই যা করার করবেন।’

লরিন যেন খুশিতে আত্মহারা। সে আপ্লুত হয়ে বলে,

‘আমি যেকোনো মূল্যে ঠোমার বাবাকে রাজি করিয়েই ছাড়ব।’

মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘আগে ঠ কে ত বলতে শিখুন। ওটা ঠোমার না তোমার। বলুন, তোমার নট ঠোমার।’

লরিন মোহনার মতো চেষ্টা করে বলল,

‘ঠঠটোমার।’

মোহনা বলল,

‘এতক্ষণ ঠোমার ছিল আর এখন টোমার হয়ে গিয়েছে। আরে বাবা সব পারেন ঠ আর ত উচ্চারণ করতে পারেন না? তোমার তোমার, ঠোমার বা টোমার না।’

লরিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘আচ্ছা আচ্ছা। ততঅঅ তোমার, তো..তোমার; হয়েছে?’

মোহনা হালকা হেসে বলল,

‘হ্যাঁ, হয়েছে।’

লরিন খুশি হয়ে পাল্টা জবাবে বলে,

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

মোহনা নাক মুখ কুঁচকে বলল,

‘থাক, আপনি যে পারেন সেটা জানি। আর উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হবে না।’

লরিন মোহনার কথা শুনে শব্দ করে হাসল। মোহনা এবার উঠে দাঁড়াল। লরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ঠিক আছে, এখন তাহলে যাই। আল্লাহ হাফেজ।’

লরিন দাঁড়িয়ে বলল,

‘আমি নামিয়ে দিয়ে আসি?’

‘না, আমরা যেতে পারব।’

মোহনা কিছুটা এগিয়ে মাহিয়াকে ডাক দিল। সে এতক্ষণ একটা দোলনায় বসে ছিল। মোহনার ডাক শুনে সে মোহনার কাছে এসে বলল,

‘কথা শেষ?’

‘হ্যাঁ।’

মাহিয়া এবার লরিনের দিকে চেয়ে বলল,

‘আপু আবার খুব বকেছে, তাই না?’

লরিন হেসে বলল,

‘না, এবার আর বকেনি।’

মাহিয়া বড়ো বড়ো চোখ করে বলল,

‘সত্যি?’

মোহনা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

‘তুই এমন ভাবে বলছিস যেন, আমি সবসময় সবাইকে কেবল বকাবকিই করি।’

‘না না, তুমি তো একদমই বকাবকি করো না। তুমি সবার সাথে খুব মিষ্টি করে কথা বলো, তাই না ভাইয়া?’

লরিন ঠোঁট চেপে হেসে বলে,

‘হ্যাঁ, একদমই তাই।’

মোহনা খুব বুঝছে ওকে নিয়ে যে ওরা মজা করছে। তাই ও নাক ফুলিয়ে বলল,

‘আর বেটকাতে হবে না। বাসায় চল। আর আপনিও (লরিনের দিকে চেয়ে) আপনার হোটেলে যান। আর কাল পারলে এশার সাথে কথা বলে আপনার দেশের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করবেন। আসি এখন।’

‘আর, তুমি এশার সাথে কথা বলবে না?’

মোহনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

‘না।’

তারপর সে মাহিয়ার হাত ধরে সেখান থেকে চলে গেল। তারা চলে যাওয়ার পর পরই লরিন এশার নাম্বারে কল করল। এশা কল ধরার পর লরিন বলল,

‘তুমি যে সম্পর্কে আমার বোন হও, সেটা আগে কেন বলোনি এশা?’
.
.
পরদিন মোহনা ভার্সিটিতে গিয়ে দেখল গেইটের সামনে এশা দাঁড়ান। সে এশাকে দেখেও না দেখার ভান করে ভেতরে যেতে লাগল। তাকে দেখে এশা ছুটে এল। মোহনা মোহনা বলে পেছন থেকে অনেক ডাকলও। কিন্তু মোহনা দাঁড়াল না। মোহনাকে থামতে না দেখে এশা দৌড়ে এসে মোহনার হাত চেপে ধরল। এবার মোহনা দাঁড়াল, তাও এশার দিকে ফিরে চাইল না। সামনের দিকে চেয়েই কাঠকাঠ গলায় বলল,

‘আমার হাত ছাড়।’

‘আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ দে প্লিজ।’

এশার আকুতিতে মোহনার মন গলল না। উল্টো সে আরো কঠোর সুরে বলল,

‘হাত ছাড়তে বলছি। ক্লাসে যেতে হবে, লেইট হয়ে যাচ্ছে।’

এশা তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,

‘আচ্ছা ঠিক আছে চল, ক্লাসে গিয়েই কথা বলব।’

মোহনা বড়ো বড়ো পা ফেলে ক্লাসে চলে এল। এশাও তার পেছন পেছন এসেছে। এশা একটা ফাঁকা বেঞ্চে গিয়ে বসে, ভাবে মোহনাও তার পাশে বসবে। কিন্তু, মোহনা গিয়ে আরেকটা মেয়ের পাশে বসে যায়। এটা দেখে এশার খুব খারাপ লাগে। সে বেড়াল পায়ে মোহনার বেঞ্চের কাছে গিয়ে নিরীহ সুরে বলল,

‘আমার সাথে একটু কথা বলবি, প্লিজ।’

মোহনা শুনেও যেন শুনল না। সে ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে অযথাই বসে বসে তার পেইজ উল্টাচ্ছে। এশা দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁই। মোহনার একটু উত্তরের আশায় মন তার ছটফট করছে। একটু পর সেখানে রাফাতও আসে। সে মোহনার কাছে গিয়ে বলে,

‘কল ধরছিলি না কেন আমার? এটলিস্ট মেসেজের রিপ্লাইটা তো দিবি।’

মোহনা বইয়ের উপরেই চোখ রেখে বলল,

‘ইচ্ছে করেনি তাই।’

রাফাত দ্বিরুক্তি না করে দাঁড়িয়ে থাকা এশার দিকে চাইল। এশাও অসহায় চোখে রাফাতের দিকে চেয়ে আছে। কাল থেকে রাফাতও এশার সাথে কোনো কথা বলেনি। এশার এমন ব্যবহারে রাফাতেরও খারাপ লেগেছে। তাই মনের কোণে একটা সুপ্ত রাগ তারও রয়ে গিয়েছে। এশা ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

‘আমার সাথে কেউই কথা বলবি না?’

রাফাত রাগ দেখিয়ে বলে,

‘কেন কথা বলব? কথা বলার মতো অবস্থা রেখেছিস তুই? কী করে এসব করতে পারলি? ইচ্ছে করে মোহনাকে এত প্যারা কেন দিলি, একটুও মায়া হয়নি তোর? লরিন তোর ভাই হলে মোহনাও তো তোর বোনেরই মতো। লরিনের কথা ভাবতে পারলি আর মোহনার কথা একটুও ভাবলি না? এই তোর ভালোবাসা? দুদিন পর তো দেখা যাবে নিজের কোনো এক স্বার্থের জন্য আমাকে ঠকাতেও দু’বার ভাববি না তুই।’

এশার খুব লাগল কথাগুলো। চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল। সেগুলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নাক টেনে বলল,

‘এভাবে বলিস না প্লিজ; আমার কষ্ট হয়।’

‘আমাদেরও কষ্ট হয়েছিল। তুই এমন করবি সেটা দুঃস্বপ্নেও কেউ চিন্তা করেনি। কিন্তু তুই এসব করার আগে একবারও ভাবিসনি। চিন্তা করিসনি, সত্যিটা জানতে পারলে আমাদের কতটা খারাপ লাগবে। তুই যখন আমাদের কষ্টের কথা ভাবিসনি, তাহলে আমরা কেন এখন তোর কষ্টের কথা ভাবব?’

এশা কিছু বলতে চাইছিল তার আগেই মোহনা রাফাতকে বলে উঠল,

‘তুই কেন ওর সাথে এভাবে কথা বলছিস? ও যা করেছে আমার সাথে করেছে। তার বিনিময়ে তুই তোর গার্লফ্রেন্ডকে এভাবে কথা শোনাতে পারিস না, এটা অন্যায়। যা তুই গিয়ে ওর পাশে বস। আর এশা, আমি ঠিক আছি। লরিনের সাথে আমার কথা হয়েছে। আমি ওকে সব বলেছি। আর ও খুব স্বাভাবিক ভাবেই সবটা মেনে নিয়েছে। এই নিয়ে তুই আর চিন্তা করিস না। যা, জায়গায় গিয়ে বস। স্যার চলে আসবেন।’

মুখে সব ঠিক আছে বললেও মনে যে মোহনার অশান্তি চলছে সেটা এশা ঠিকই বুঝতে পারছে। এত সহজে মোহনা তাকে ক্ষমা করবে না। ক্ষমা পাওয়ার জন্য তাকে অনেক বেশি কষ্ট করতে হবে।

চলবে…

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২২.

‘আপনার বাগান পছন্দ?’

‘না। মা’র পছন্দ। এই পুরো বাগানটাই মা’র।’

অরূপের কথা শুনে মোহনার মনে একটু বিষাদ এল। মানুষের বাগান পছন্দ না হওয়াটা বড্ড বেমানান। মানুষ মাত্রই তো প্রকৃতি পূজারী হবে। তার প্রেম, মোহ, ভালোবাসা সব তো কেবল হবে প্রকৃতিকে নিয়েই। অথচ এই মানুষটার নাকি বাগান পছন্দ না। এত বিরস মানুষ কেমন করে হয়?

মোহনাকে কিছু ভাবতে দেখে অরূপ বলল,

‘কী ভাবছ, মোহনা?’

মোহনা হালকা হেসে বলল,

‘না, কিছু না। আচ্ছা, আপনার রুমের বেলকনি টা এত বিশাল কেন? দেখে মনে হয় যেন, এইটা আরেকটা রুম।’

‘ভেবেছি, বিয়ের পর এখানেই আমার বাসর ঘর সাজাব। তাই ইচ্ছে করেই বেলকনিটা বড়ো রেখেছি।’

মোহনা হতভম্ব হয়ে চাইল। এই খোলা আকাশের নিচে বাসর ঘর, সিরিয়াসলি? মোহনার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখটা দেখে অরূপের হাসি পেল। তবে সে হাসি আটকে রেখে বলল,

‘কী হলো, এমন ভাবে হা করে তাকিয়ে আছো কেন? এখানে বাসর রাত করলে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হবে না?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ইনটারেস্টিং হবে।’

পেছন থেকে মাহিয়ার গলা পেয়ে দুজনেই খানিক চমকাল। মাহিয়াকে দেখে অরূপ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল যেন। বাচ্চা মেয়েটাও কথাটা শুনে ফেলেছে?
মাহিয়া তাদের কাছে দৌড়ে এসে বলল,

‘ভাইয়া, তোমার আইডিয়াটা কিন্তু জোস। এমন খোলা আকাশের নিচে যদি একটা বাসর ঘর সাজাতে পারো তাহলে তো মনে করো ব্যাপারটা একেবারে জমে যাবে।’

মোহনা মাহিয়াকে ধমক দিয়ে উঠে বলল,

‘খুব পেকেছিস তাই না? কানের নিচে একটা দিলে সোজা হয়ে যাবি।’

‘ওমা, আমি আবার কী করলাম? আমি তো ভাইয়ার আইডিয়াটার প্রশংসা করছিলাম কেবল।’

অরূপ কথা কাটাতে বলল,

‘আচ্ছা চলো, তোমাদের ছাদে নিয়ে যাই। সেখানেও মায়ের ছোট্ট একটা বাগান আছে।’

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। মাহবুব সাহেবের আড্ডার সময়ের অন্ত আর হলো না। মা, লায়লা বেগমও ভাবির সাথে বেশ জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছেন। আর মাহিয়া তো বরাবরই বকবক প্রিয় মানুষ। বেচারা অরূপ, সেই দুপুর থেকে এই মেয়েটার কথা গিলতে গিলতে এখন বোধ হয় ক্লান্ত। অন্যদিকে মোহনা এক অসহায় বান্দা যে তখন থেকে হাঁসফাঁস করছে বাড়ি ফেরার জন্য। এই পরিবেশে আর নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। এবার বাসায় ফিরতে হবে। শরীর ক্লান্ত না হলেও মন তার ক্লান্ত হয়ে উঠেছে বেশ আগেই। মা’কে গিয়ে দু একবার বলেছেও; কিন্তু, মা তাকে পাত্তা দিচ্ছে কই। বাবাকে যে বলবে সেই সাহসও পাচ্ছে না সে। তাই বিষন্ন মন নিয়ে লিভিং রুমেই চুপচাপ বসে রইল।

বেশ কিছু সময় যাওয়ার পর, লিভিং রুমে লায়লা বেগম এলেন। মোহনা তখন বসে বসে ফোন দেখছিল। তিনি এসে বললেন,

‘মোহনা, চল; তোর বাবা তোকে ডাকছে।’

মোহনা উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কেন মা, বাবা হঠাৎ ডাকছে কেন?’

‘চল, গেলেই বুঝতে পারবি।’

মা’র পেছন পেছন মোহনা আব্দুল্লাহ সাহেবের রুমে যায়। সেখানে তখন সবাই ছিল। মাহিয়া আর অরূপও। মোহনা সেই রুমে প্রবেশ করার পর অরূপের মা তার কাছে এগিয়ে এসে বললেন,

‘তুমি এখানে বসো মা।’

মোহনাকে একটা কাঠের চেয়ারে বসানো হলো। তার অপর পাশের আরেকটা চেহারে অরূপ বসেছে। দুজনের মুখস্রীতেই বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঘুরছে। কেন তাদের এখানে এভাবে বসানো হলো। মোহনার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। মনের মধ্যে এক অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে। তার আশংকাটাই সত্যি হতে যাচ্ছে না তো?

তার ভাবনায় ফোড়ন পড়ল মাহবুব সাহেবের গম্ভীর স্বরে। তিনি গলা ঝেরে বললেন,

‘তোমরা নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছ তাই না, কেন তোমাদের এভাবে এখানে এত জরুরি তলবে ডেকে আনা হয়েছে এই ভেবে? অবশ্যই এর পেছনে কোনো কারণ আছে। আর কারণটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেখো, তোমরা এখন বড়ো হয়েছ। তোমাদের এখন যথেষ্ট জ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে ভালো মন্দ বিচার করবার। তোমাদের জীবন নিয়ে নিশ্চয়ই তোমাদের নিজস্ব অনেক পরিকল্পনা আছে। তবে মা বাবাও কিন্তু সন্তানদের জীবন নিয়ে নিজেদের মতো পরিকল্পনা করেন। তাদের পরিকল্পনাটাও কিন্তু অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ; কারণ মা বাবা যা ভাবেন তা সন্তানদের ভালোর কথা চিন্তা করেই ভাবেন। আর যেহেতু তোমরাও আমাদের সন্তান, তাই তোমাদের নিয়েও আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে আমরা তোমাদের উপর কিছু চাপিয়ে দিব না, তোমাদেরও মত প্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। তাই আগে আমাদের কথাটা মনোযোগ দিয়ে শোনো, তারপর তোমরা ভেবে সিদ্ধান্ত নিও। আব্দুল্লাহ, এবার বাকি কথা তুই বল।’

মাহবুব সাহেব থামার পর এবার আব্দুল্লাহ সাহেব শুরু করলেন।

‘অরূপ, মোহনা, আমরা বড়োরা মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর সেটা হলো তোমাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত। আমরা তোমাদের বিয়ে দিতে চাই। আর এই চাওয়া মানে এই না যে আমরা তোমাদের উপর জবরদস্তি করে আমাদের চাওয়া চাপিয়ে দিব। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এবার তোমরা নিবে। একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত থাকো তোমরা এই ব্যাপারে।’

অরূপ আর মোহনা দুজনেই নিশ্চুপ। দুজনের মাথায় কী চলছে তা সবার অজানা। মাহিয়াও ভীষণ দ্বিধায় আছে। সে না খুশি হতে পারছে আর না পারছে নারাজ হতে। অরূপের সাথে বিয়ে হলে লরিন কষ্ট পাবে এই নিয়ে মাহিয়ার মন খারাপ আবার তার অরূপ ভাইয়াও খুব ভালো ছেলে, তার সাথে বিয়ে হলে তার বোন সুখী হবে এই ভেবেও আবার ভালো লাগছে। কিন্তু, এখন খুশী হবে না কষ্ট পাবে সেটা নিয়ে সে বড্ড দুটানায় পড়ে গিয়েছে।

মোহনা আর অরূপকে নির্বাক দেখে মাহবুব সাহেব বললেন,

‘তোমাদের কি সময় লাগবে?’

মোহনা বাবার দিকে তাকাল তবে, কিছু বলল না। অরূপ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,

‘আমাদের না জানিয়েই এভাবে বিয়ের মতো এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়াটা আমার চোখে ঠিক হয়নি। তাও আপনারা যখন বলছেন, আমাদের সিদ্ধান্ত জানানোর স্বাধীনতা আছে তখন আমি বলব, আমার সময় লাগবে। আপাতত, বিয়ে নিয়ে আমি এখন কিছু ভাবতে পারছি না।’

অরূপের কথা যেন কারোরই পছন্দ হলো না। তবে কেউ কোনো দ্বিরুক্তি জানাতে পারল না। মাহবুব সাহেব মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন,

‘তোমার কী সিদ্ধান্ত, মোহনা?’

মোহনা নত মস্তিষ্কে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,

‘আমারও সময় লাগবে, বাবা।’

সন্তানদের সিদ্ধান্তে দু’পক্ষের মা বাবাই ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। তবে উনাদের ভাষ্যমতে উনারা চাপ প্রয়োগ করতে পারবেন না। আর এখন সন্তানদের সময় দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও তাদের জানা নেই।
.

.

বাড়ি ফিরতে রাত হলো মোহনাদের। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে মা যখন তালা খুলছিল তখন মোহনার হঠাৎ চোখ গেল রাস্তার ওপারের চায়ের দোকানটাই। এটা এখনো খোলা। তবে দুজন লোক ব্যতিত সেখানে আর কেউ নেই। সেই দুজনের মধ্যে একজন ছিলেন চা বিক্রেতা আর অন্যজন ছিলেন লরিন, হ্যাঁ লরিন। লরিনকে এই সময়ে এখানে দেখে মোহনা হতবিহ্বল। সে ভ্রু কুঁচকে সেদিকেই চেয়ে আছে। লরিনের হাতে ধোঁয়া উঠা গরম চা। সে এক চুমুক দিচ্ছে তো একবার মোহনার দিকে তাকাচ্ছে। রাস্তায় এখন তেমন গাড়ি নেই। আশেপাশে মানুষও নেই বলতে গেলে। ছেলেটা এমন সময়ে এখানে কেন এল? মোহনা সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না। মা তালা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সবাই বাসার ভেতরে প্রবেশ করল। বাসায় এসে মোহনা তাড়াতাড়ি তার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর সে তার ফোনটা নিয়ে গেল বেলকনিতে। সেখান থেকে চেয়ে দেখল মানুষটা এখনো ঐ চায়ের দোকানেই বসে। এবার সে বিরক্ত হয়ে লরিনকে কল করল। লরিন সাথে সাথেই তার কলটা রিসিভ করলে সে বলল,

‘এত রাতে এখানে কী করছেন?’

লরিন মোহনার প্রশ্নের জবাবে বলল,

‘আমি আজ বিকেল থেকেই এখানে এসে বসেছিলাম তোমাদের অপেক্ষায়। কোথায় গিয়েছিলে? আমি তো বিয়ের কথা বলতে এসেছিলাম।’

মোহনা রাগান্বিত সুরে বলল,

‘কাল বলেছি আর আজই বিয়ের কথা বলতে চলে এসেছেন? এত তাড়া কেন আপনার?’

‘তাড়াহুড়ো না করলে তো আমার সুযোগ অন্য কেউ নিয়ে নিবে। তাই রিস্ক নিতে চাইছি না আরকি। কিন্তু, আজকে কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?’

লরিনের কথা শুনে মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে বলে, “সেই সুযোগ তো অলরেডি একজনের দ্বারপ্রান্তে ঘুরছে। কবে জানি চট করে সেটা সে হাতিয়ে নেয় কে জানে।”

চলবে…