#পারলে_ঠেকাও
#পর্বঃ২৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ডাক্তার কেয়ার মুখে অর্গান ট্রাফিকিং এর লিডারের নাম শুনে অবাক হয়ে যায় মধুজা ও বর্ণ। কারণ তিনি হলেন রুহুল আমিন! যিনি বর্তমানে হাসপাতালের পরিচালনার দায়িত্বে আছেন।
মধুজা ডাক্তার কেয়াকে জিজ্ঞেস করে,
‘তাহলে তুমি কিভাবে এসবে জড়ালে?’
কেয়া তখন পুরো ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়,
‘আমি একজন অনাথ মেয়ে ছিলাম। একটি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। ছোটবেলা থেকে আমার কোন চাহিদা সেভাবে পূরণ হয়নি। বাট আমি অনেক ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলাম। ১৮ বছর হওয়ার পর যখন আমি অনাথ আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসি তখন রাহেলা ম্যাডাম আমার দায়িত্ব নেন। তার সহায়তায় আমি মেডিকেলে ভর্তি হই। তিনি আমার পড়াশোনার যাবতীয় খরচ বহন করেন। এভাবে আমি একসময় ডক্টর হই। আমি যখন প্রথম সিটি হসপিটালে এজ আ ডক্টর যোগদান করি তখন আমি এসবে জড়িত ছিলাম না। বাট একসময় রুহুল আমিনের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই আমি। ওনাকে আমি অনেক সম্মান করতাম, নিজের আইডল ভাবতাম। ওনার প্ররোচনাতেই আমি এর সাথে যুক্ত হই। উনি একদিন আমাকে বললেন, এসব ডাক্তারি করে আর কত ইনকাম হয়, উনি নাকি আমাকে এমন একটা কাজে জয়েন করাবেন যেখান থেকে আমি অনেক বেশি ইনকাম করতে পারব। ছোটবেলা থেকে লাইফটাকে সেভাবে এনজয় করতে না পারায় আমি সেসময় লোভের বশবর্তী হয়ে ওনার কথায় রাজি হই। দেন উনি আমাকে এই অর্গান ট্রাফিকিং এর সাথে যুক্ত করেন। শুধু আমি নই ঐ হসপিটালের অনেক ডক্টর এবং নার্সও জড়িত আসে এসবে। ডক্টর অক্ষর চৌধুরীসহ কয়েকজন ডক্টর এসব সম্পর্কে কিছু জানে না। কারণ রুহুল আমিন বেছে বেছে লোভী এবং উচ্চাকাঙ্খী মানুষদের এসবে জড়ান। যারা সৎ এবং ভালো মানুষ তাদের গোপনেই হসপিটালের সব কাজকর্ম চলে। আমরা গরীব আর অসহায় রোগীদের টার্গেট করি এবং তাদের মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে অপা’রেশন করে হার্ট, কিডনি এসব বের করে নিই। এরপর চড়া দামে এসব বিক্রি করি।’
মধুজা ঠা’স করে থা’প্পর বসিয়ে দেয় কেয়ার গালে। তার পায়ের কাছে থু থু ফেলে বলে,
‘তোমরা কি মানুষ? ছি! মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তাদের এত বড় ক্ষতি করো। এবার নিজেদের অন্যায়ের শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে।’
৪৫.
মধুজা ও বর্ণ প্রমাণসহ কেয়া ও সিরাজ হাসানকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। অক্ষরকেও কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। রুহুল আমিনসহ এই অর্গান ট্রাফিকিং এর সাথে জড়িত সকল ডক্টর-নার্সকেই গ্রেফতার করা হয়।
অক্ষর ও মধুজা সিটি হসপিটালে এসেছে। এখানে তাদের আসার মূল উদ্দ্যেশ্য ডক্টর রাহেলা খানমের সাথে দেখা করা। তিনি নিজে তাদের ডেকেছেন।
রাহেলা খানমের কেবিনের বাইরে এসে দাড়িয়েছে দুজনে। অক্ষর বলে,
‘মে উই কাম ইন ম্যাম?’
‘ইয়েস কাম।’
রাহেলা খানম নিজের মুখের উপর একটি নিউজ পেপার ধরেছিলেন। অক্ষর ও মধুজা আসতেই তিনি নিউজ পেপারটি সরিয়ে দেন। রাহেলা খানমকে দেখে মধুজা অবাক হয়ে যায়।
‘আপনি!’
রাহেলা খানমও বেশ খানিকটা অবাক হন। কারণ গতকাল যিনি মধুজার সিএনজির ভাড়া দিয়েছিলেন তিনিই হলেন রাহেলা খানম। রাহেলা খানম মৃদু হেসে বলেন,
‘তাহলে আমাদের আবার দেখা হয়েই গেল।’
‘জ্বি, আপনি কাল আমার অনেক বড় উপকার করেছিলেন।’
অক্ষর কিছু বুঝতে পারছিল না৷ তখন মধুজা অক্ষরকে গতকালকের সব ঘটনা খুলে বলে। রাহেলা খানম এবার বলেন,
‘মধুজা আমিও তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমি তোমার কাছে ঋণী। আমার হাজবেন্ডের তৈরি এই হসপিটালে যে আমার অগোচরে এত কিছু হয়ে গেছে আমি ভাবতে পারিনি। আমার ভাইকে অনেক বিশ্বাস করে এখানকার দায়িত্ব দিয়ে চলে গেছিলাম। সেই বিশ্বাসঘাতকতা করল। সাথে কেয়াও। মেয়েটাকে আমি কত ভরসা করেছিলাম অথচ,,,’
মধুজার মনে ডক্টর কেয়াকে নিয়ে প্রশ্ন জাগে। তাই সে প্রশ্ন করে,
‘আচ্ছা ডক্টর কেয়ার সাথে আপনার কি কোন রিলেশন আছে? কারণ আমি ওনার কাছে শুনেছি উনি ওরফান হোম(অনাথ আশ্রম) থেকে বেরোনোর পর আপনি ওনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।’
রাহেলা খানম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
‘সবারই একটা কালো অতীত থাকে। আমার জীবনেও একটা কালো অতীত আছে। যদিও আমি নিজের অতীত কারো সামনে কখনো প্রকাশ করিনি তবে এখন মনে হয় করা উচিৎ। তাহলে মনটা হালকা হবে। আমার বিয়ে হয়েছিল কবীরের সাথে। আমাদের ছিল প্রেমের বিয়ে। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। তবে আমার জীবনে সবথেকে বড় আঘাত আসে তখন যখন সিড়ি থেকে পরে গিয়ে আমার দুমাসের বাচ্চা মিসক্যারেজ হয়ে যায়। যার কারণে আমি আর কখনো মা হতে পারিনি। সেই নিয়ে কবীরের কোন প্রব্লেম ছিল না। আমার নিজেকে খুব লাকি মনে হয়েছিল। বাট একসময়ে আমি জানতে পারি কবীর হসপিটালের এক নার্সের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। সেই কথা জেনে আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিয়েছিলাম। তবে এরমাঝে আরো বড় সত্যি আমার সামনে আসে। কবীর ও সেই নার্সের একটি অবৈধ সন্তানও আছে। যে একটি অনাথ আশ্রমে রয়েছে।’
মধুজা ব্যাপারটা বুঝতে পারে।
‘তার মানে সেই মেয়েই হলো ডক্টর কেয়া।’
রাহেলা খানম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
‘হুম। এই কারণেই আমি কেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এরমধ্যে কবীরও মারা যায়। আমার সাথে ও যতই ধোকাবাজি করুক ডক্টর হিসেবে খারাপ ছিলনা। এই জন্য ওকে রেসপেক্ট করি। যাইহোক অনেক কথা বলে ফেললাম। তোমরা কি খাবে চা নাকি কফি?’
অক্ষর তখন বলে,
‘না ম্যাম আমাদের কিছু লাগবে না। আমরা অনেক টায়ার্ড এখন আসছি।’
‘আচ্ছা।’
৪৬.
অক্ষর ও মধুজা নিজেদের রুমে ছিল।অক্ষর বিছানায় শুয়ে ছিল। যদিও তার চোখে ঘুম নেই তবে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। মধুজা জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিল।
অক্ষর মধুজাকে জানালার কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেও বিছানা থেকে উঠে এসে মধুজার পাশে দাড়ায়। মধুজা মৃদু হেসে বলে,
‘কি হলো পাগলা ডাক্তার? আপনার ঘুম আসছে না?’
‘ঘরে এত সুন্দর বউ থাকলে কি কারো ঘুম আসে নাকি?’
‘আপনি যে কি বলেন না। যান ঘুমাতে যান। এই ক’দিন আপনার উপর দিয়ে যা ধকল গেল। ইউ নিড রেস্ট।’
‘ধকল কি শুধু আমার উপর দিয়ে গেছে নাকি? তোমার উপর দিয়েও তো ধকল গেছে। তুমি তো বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন মনে করো না। হোয়াট এভার, আমার রেস্টের প্রয়োজন নেই। আমার অন্যকিছুর প্রয়োজন।’
‘কি প্রয়োজন?’
‘কিস।’
‘ছি!’
‘ছি ছি করছ কেন? জানো না আজকে কিস ডে?’
মধুজা বুঝতে পারছিল আর বেশিক্ষণ সেখানে থাকলে অক্ষরের রোম্যান্টিক অত্যা’চার থেকে মুক্তি পাবে না। তাই মধুজা আর সেখানে দাড়িয়ে থাকতে চাইল না৷ যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই অক্ষর তার হাত টেনে ধরে। এক ঝটকায় নিজের কাছে টেনে এনে মধুজার ঠোটে নিজের ঠোট ডুবিয়ে দেয়। মধুজা প্রথমে ইতস্তত বোধ করলেও পরে অক্ষরের সাথে তালে তাল মিলিয়ে সেও চুম্বনে অংশ নেয়।
চাদের জোৎস্নায় দুই কপোত কপোতীর প্রেমের সাক্ষী হয় এই রাত। অক্ষর একসময় মধুজাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
‘আমি আর ওয়েট করতে পারছি না হানি। আমি জানি তুমিও আমার জন্য ফিল করো। তোমার হৃদস্পন্দন প্রমাণ করে দিচ্ছে তোমার অনুভূতিকে। আর নিজেকে আড়াল করিও না। নিজেকে মেলে ধরো আমার কাছে। তবে আমি যখন এতদিন ধৈর্য ধরতে পেরেছি তখন আরো একটা দিন ধৈর্য ধরতে পারব। কাল ভালোবাসা দিবস। আমি চাই কাল তুমি আমাকে নিজের মনের কথা বলো। আমি অপেক্ষা করব তোমার মুখে নিজের প্রতি জন্মানো অনুভূতির কথা শোনার জন্য। আশা করি,তুমি আমাকে নিরাশ করবা না। যাও শুয়ে পড়ো।’
মধুজাকে রেখে অক্ষর বাথরুমে চলে যায়। মধুজার কানে অক্ষরের বলা কথাগুলোই বাজতে থাকে। ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে। এই কথা মনে মনে বারবার আওড়ায় সে। অজান্তেই মধুজার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মধুজা বিড়বিড় করে বলে,
‘আমিও আর নিজেকে আড়াল করবো না পাগলা ডাক্তার। আপনার হানি আপনার জন্য কাল অনেক সুন্দর সারপ্রাইজের বন্দোবস্ত করবে। আপনি শুধু অপেক্ষা করুন।’
মধুজার মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨