ফিরে আসা পর্ব-০৩

0
252

#ফিরে_আসা__
লেখা: ShoheL Rana শামী
পর্ব:-০৩

পাদরির সামনে বসে আছে পিটার আর ডায়ানা। দুজনই ভীতিগ্রস্ত। নিজেদের ভবিষ্যত খুব ভালোভাবেই আঁচ করতে পেরেছে তারা। কিন্তু যে ভালোবাসার কারণে তারা এই বিপদের সম্মুখীন, সেই ভালোবাসাটাই যদি অপূর্ণ থেকে যায়, তবে জীবন দেয়াটা বৃথা। মৃত্যুর পর হলেও যেন তারা এক হতে পারে, আবার যেন ফিরে আসতে পারে, দুজন দুজনকে ভালোবাসতে পারে। পাদরি কি কিছু করতে পারবেন তাদের জন্য? যদি না পারে? ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে দুজন। পাদরি তাদের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠলেন,
-এই ধরনীতে প্রতিদিন পাপ বেড়ে চলেছে। তোমরা যা করেছো তা পাপ। তোমাদের ঘোর বিপদ দেখতে পাচ্ছি আমি। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুক।’ বলেই হাতের ইশারায় বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকলেন পাদরি।
-আমরা জানি, আমাদের সামনে ঘোর বিপদ। এটাও জানি, আমরা খুব শীঘ্রই ধরা পড়বো, আর মহারাজ আমাদের মৃত্যুদণ্ড দেবেন। কিন্তু আমরা চাই মৃত্যুর পর যেন আমরা ফিরে আসতে পারি আবার দুজন দুজনকে ভালোবাসার জন্য। এমন কিছু কি করতে পারবেন?’ আড়ষ্ট দৃষ্টিতে পাদরির দিকে তাকালো পিটার।
-অসম্ভব না, তবে ব্যাপারটা অনেক কঠিন।’ মন্তব্য করলেন পাদরি।
-আপনি আমাদের জন্য একটু চেষ্টা করুন না…’ হতাশ কণ্ঠে বললো ডায়ানা।
-এর জন্য তোমাদের শরীর থেকে বেশকিছু রক্ত লাগবে।
-মৃত্যুর পর তো এই শরীরটারই কোনো দাম থাকবে না। যত ইচ্ছে লাগুক রক্ত…’ বললো পিটার।
-তোমাদের রক্ত দিয়েই একটা বই লেখা হবে, এতে তোমাদের প্রেম কাহিনী লেখা থাকবে, সাথে তোমাদের মৃত্যুর কাহিনিও। আর বেশকিছু মন্ত্র লেখা থাকবে।’ বলেই থামলেন পাদরি। ডায়ানা আর পিটার পাদরির দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, যেন তিনি তাদের হতাশ না করেন। পাদরি আবার বলে ওঠলেন,
-যেদিন বইয়ের মন্ত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠবে, তখন যদি কেউ মন্ত্রগুলো পড়ে পুরো বইটা শেষ করে, তবেই তোমাদের দুজনের আত্মা আবার মিলিত হবে এই পৃথিবীতে।
-কিন্তু মন্ত্রগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠবে কখন?
-সেটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার, পঞ্চাশ বছর, একশ বছর, এমনকি পাঁচশ বছরও লাগতে পারে।
-হাজার বছর পরে হলেও আমরা একসাথে মিলতে চাই।’ মন্তব্য করলো পিটার।
-তাও এতো সহজ না। এরই মাঝে যদি বইটা হারিয়ে যায় বা বইটা নষ্ট হয়ে যায়, তবে তোমাদের কখনও ফিরে আসা সম্ভব হবে না।’
পাদরির কথা শুনে পরস্পরের দিকে তাকালো পিটার আর ডায়ানা। তাদের ফিরে আসার একমাত্র উপায়টাও বড্ড দুষ্কর। তবুও চেষ্টা তো করতে হবে। দুজনে তরবারি হাতে নিলো। পাদরি তাদের সামনে বড় একটা পাত্র এনে রাখলেন রক্ত নেয়ার জন্য। ওরা তখন তরবারি দিয়ে হাত কাটলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো হাতের কাটা অংশ হতে। দুজনের শরীর থেকে বেশকিছু রক্ত নেয়ার পর পাদরি তাদের থামতে বললেন। তারপর দুটো কাপড়ের টুকরো এগিয়ে দিলেন কাটা হাতে বাঁধার জন্য। পাদরি তাদের চোখ টিপে ভরসা দিলেন,
-ঈশ্বর তোমাদের ভালোবাসা অপূর্ণ রাখবেন না।

টগবগ করে এগিয়ে চলেছে ঘোড়াগুলো। যেন ঘোড়াগুলোও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পিটার আর ডায়ানাকে খুঁজতে। আর ঘোড়সওয়াররা জানে ওদের দুজনকে না নিয়ে ফিরলে প্রত্যেককেই শাস্তি দেবেন রাজা হেনরি। দীর্ঘপথ খুঁজতে খুঁজতে তারা বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে, ঘোড়াগুলোও বড্ড ক্লান্ত। তবুও থেমে নেই ওরা। পিটার আর ডায়ানা বেশিদূর পালানোর আগেই ধরে ফেলতে হবে। আরও কিছুক্ষণ ঘোড়া ছোটানোর পর ওরা দেখলো সামনে থেকে ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে পিটার আর ডায়ানা। ওদের এগিয়ে আসতে দেখে গতি কমালো সৈন্যদল। মুখোমুখি হতেই পিটার বলে ওঠলো,
-আমাদেরই খুঁজে এসেছো তাই না?
-জি, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনাকে বন্দী করার আদেশ দিয়েছেন মহারাজ।’ বললেন দলপতি।
-তবে আসো, বন্দী করো আমাদের।’ ঘোড়া থেকে নামলো পিটার। ডায়ানাও নামলো।
-আপনাদের তরবারি দিয়ে দিন আমাদের কাছে।’ ঘোড়া থেকে নেমে ওদের তরবারি নিতে গেল দলপতি। কোষ থেকে তরবারি বের করে দলপতিকে দিয়ে দিলেন ওরা। ওদের সাথে যুদ্ধ করে লাভ হবে না। শুধু শুধু কয়েকটা প্রাণ যাবে। ওদের তো কোনো দোষ নেই। ওরা হুকুমের গোলাম। তাই নিজেরাই বন্দী হয়ে গেল পিটার আর ডায়ানা।

রাজ দরবারের সামনে জড়ো হয়েছে শতশত নারী-পুরুষ। অপেক্ষা করছে তারা কবে পিটার আর ডায়ানাকে বন্দী করে আনা হবে। নিজেদের মধ্যে বিষয়টা নিয়ে গুঞ্জন করছে ওরা। কেউ ওদের দুজনের সমালোচনা করছে, আবার কেউ রাজা হেনরির। তবে রাজা হেনরির সমালোচকদের কণ্ঠ অপেক্ষাকৃত নিচু। চারপাশে লক্ষ রেখেই ওরা সমালোচনায় ব্যস্ত। যদি রাজার কোনো চরের নজরে পড়ে যায় তবে নিজেদের জানটাই খোয়াতে হবে।
দূর থেকে রাজা হেনরির বিশাল দলকে আসতে দেখে কোলাহল বেড়ে গেল লোকদের মাঝে। কেউ কেউ ভয় পাচ্ছে কী হয় না হয় এটা ভেবে। কাছে চলে এসেছে দলটা। সামনে একটা ঘোড়ার গাড়িতে পিঞ্জরের মতো বানিয়ে বন্দী করা হয়েছে পিটার আর ডায়ানাকে। দুজনই নিচু হয়ে আছে ভেতরে। দলটা রাজ দরবারের সামনে এসে থামতেই কয়েকজন লোক এগিয়ে গেল বন্দীদের আক্রমণ করতে। সৈন্যরা বাঁধা দিলো তাদের। রাজা হেনরি এসে দাঁড়ালেন ওখানে। সৈন্যদের আদেশ দিলেন তিনি, বন্দীদের কারাগারে নিয়ে যেতে। সৈন্যরা তখন বন্দীদের বের করে নিয়ে যেতে লাগলো রাজ-কারাগারের দিকে। বন্দীদের চেহারায় হতাশার ছাপ। কারও দিকে দৃষ্টি নেই তাদের, নিচু হয়ে হাঁটছে ওরা। তাদের ঘিরে রেখেছে রাজার সৈন্যরা, যাতে ক্রোধান্বিত হয়ে কেউ আক্রমণ করে বসতে না পারে।

পরদিন রাজ দরবারে দুজনের বিচার শুরু হলো। পরকীয়ার শাস্তি হিসেবে রাজা তাদের কী শাস্তি দেবেন তা জানার জন্য আগের দিনের মতো জনতার ভীড় লেগেছে দরবারের সামনে। নিজেদের মধ্যে ওরা আলোচনা করতে লাগলো কী শাস্তি হতে পারে এটা নিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে কয়েকজন বের হয়ে এলো রায় নিয়ে। তারা বের হতেই বাদ্যবাদক ঢাকে বাড়ি দিলেন কয়েকটা। ঢাকের শব্দ শুনে চুপ হয়ে গেল অপেক্ষাকৃত জনতা। একজন তখন জনতার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,
-আমি এখন পাঠ করছি রাজা হেনরির লিখিত রায়। সেনাপতি পিটার মহারাজ হেনরির খুব বিশ্বস্ত সৈন্য ছিলেন। একদিকে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, আবার রানি ডায়ানার সাথে পরকীয়া করে খুব বড় অপরাধ করেছেন। বিশ্বাসঘাতকতা এবং রানির সাথে পরকীয়ার জন্য রাজা হেনরি তাকে উডচেস্টার হিল দুর্গে বন্দী করার হুকুম দেন।’
রায়টা শুনে সাথে সাথে উত্তেজিত হয়ে পড়লো জনতা। হৈচৈ শুরু হলো। তারা জানে ঐ দুর্গে বন্দী করা মানে নিশ্চিত মৃত্যু। ওখান থেকে কেউ ফিরে আসতে পারে না। দুর্গের ভেতরে অন্ধকার থাকে সবসময়, আলো বাতাস ঢোকারও ফুরসত নেই কোনো। বাহির থেকে খাবার দেয়ারও অনুমতি নেই। ক্ষুধার যন্ত্রণায় না খেয়ে লাশ হতে হয় ওখানে। আরও অনেক লাশ আছে ওখানে।
উত্তেজিত জনতাকে থামাতে আবারও ঢাকে বাড়ি পড়লো। জনতা থেমে গেল তখন। রায় পাঠক আবার রায় পড়ে শুনাতে লাগলো,
-আর রানি ডায়ানার অপরাধ আরও গুরুতর। রানি মানে রাজ্যের মাতাস্বরুপ। তিনি রানি হয়ে সেনাপতির সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছেন, তাই তাঁকে গার্ডেন অব হেভেনে জীবন্ত সমাধি দেয়ার আদেশ দেন রাজা হেনরি।’
আবারও জনতার মাঝে কোলাহল শুরু হলো। উত্তেজিত হয়ে পড়লো জনতা। রায় পাঠ করে ভেতর থেকে আসা লোকগুলো আবার ভেতরে চলে গেল। আর জনতার মাঝে বেড়ে চললো উত্তেজনা।

যেদিন রায় কার্যকর করা হবে সেদিন জনসম্মুখে আনা হলো পিটারকে। ওর হাত দুটো পেছনে বাঁধা। যে গাড়িতে করে ওদেরকে বন্দী করে আনা হয়েছিল, সেই গাড়িতে তোলা হলো তাকে। দেখে তাকে মনে হলো খাঁচার ভেতর যেন কোনো বন্দী পাখি। একটু পর ছেড়ে দেয়া হলো ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়া নিয়ে হেনরির একটা সৈন্যদল চললো সাথে সাথে। শেষবারের মতো দেখে নিলো পিটার প্রিয় ভূমিটাকে।
ওরা চলে যেতেই জনতা অপেক্ষা করলো দ্বিতীয় বন্দীর জন্য। একটু পর কারাগার থেকে আনা হলো রানি ডায়ানাকে। ওরও হাত বাঁধা পেছনে। ওকে জীবন্ত সমাধি করার জন্য একটা কফিন আনা হয়েছে। কফিনটার দিকে হতাশার দৃষ্টিতে তাকালো ডায়ানা। চোখ দুটো থেকে বৃষ্টির বেগে অশ্রু ঝরছে। ভাবছে সে, কী অপরাধ করেছিল। শুধু ভালোই তো বেসেছে। বিয়ের আগে থেকেই সে পিটারকে ভালোবেসে এসেছে। রাজা হেনরি তাকে জোর করেই বিয়ে করেছে। রাজার অপরাধের শাস্তি দেবে কে?
কয়েকজন সৈন্য এগিয়ে এলো ডায়ানার দিকে। ওরা তার পা বাঁধলো এবার। মুখটাও বন্ধ করলো। তারপর ওকে ধরে কফিনের ভেতর শুয়ে দিলো। ডায়ানার চোখে অশ্রুর বেগ বেড়ে গেল। ঠিক তখনই দৌড়ে এলো মেরি। এতক্ষণ তাকে আটকে রেখেছিল কয়েকজন মহিলা। তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে এসেছে মেরি। এক মাকে হারিয়েছে সে, আরেক মাকে হারাতে চায় না। দৌড়ে এসে কফিনের পাশে বসে পড়লো। তারপর চিৎকার করে বললো,
-আমার মাকে ক্ষমা করুন। মুক্তি দিন আমার মাকে।’
সেই মুহূর্তে রাজা হেনরি এলেন। পাশে তার নতুন রানি। নতুন বিয়ে করেছেন তিনি অ্যানি বোলকে। হেনরি কয়েকজন সৈন্যকে আদেশ দিলেন মেরিকে নিয়ে যেতে। আদেশ পেয়ে সৈন্যদল মেরিকে ওখান থেকে নিয়ে গেল। হেনরি তখন অ্যানি বোলকে বললেন,
-তোমার মাঝে যদি কখনও ওর মতো আচরণ দেখি, তবে তোমার শাস্তি হবে আরও ভয়ানক, আরও ভয়াবহ।’
অ্যানি বোল ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
-আমি নিজেকে আপনার অনুগত করার চেষ্টা করবো, ইউর ম্যাজেস্টি।’
কফিনের ঢাকনা বন্ধ করে দেয়া হলো। ভেতর থেকে কেবল ডায়ানার গোঙানির শব্দ শোনা গেল। কয়েকজন সৈন্য কফিনটা তুলে নিলো। তারপর নিয়ে চললো গার্ডেন অব হেভেনে জীবন্ত সমাধি দিতে।

গার্ডেন অব হেভেন। বিশাল সমাধিস্থল। শত বছর ধরে হাজার হাজার লাশ নিজের বুকে ধারণ করে আছে সমাধিস্থলটি। রানি ডায়ানাও আজ চিরতরে শায়িত হবে এর বুকে। যারা কফিন বহন করে এনেছিল, তারা কফিনটা নিচে রাখলো। তখনও ভেতর থেকে রানি ডায়ানার গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু কেউ দয়া দেখালো না। সবাই কফিনটা ধরে সামাধির গর্তে রেখে দিলো। তারপর ধীরে ধীরে মাটি দিয়ে ভরাতে লাগলো। আর ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগলো রানি ডায়ানার গোঙানির শব্দটাও। একসময় মাটি দেয়া শেষ হলে, সবাই চলে যেতে লাগলো। শুধু মাটির নিচে পড়ে রইলো একটা জীবন্ত নারী। হয়তো মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না সে।

উডচেস্টার হিল দুর্গের সামনে আসার পর সৈন্যরা ঘোড়া থেকে নেমে সেনাপতি পিটারকে বের করলো বন্দী খাঁচা থেকে। তারপর ধরে দুর্গের ভেতর নিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকতেই পঁচা লাশের গন্ধ নাকে এলো। সৈন্যরা পিটারকে ভেতরে রেখে লোহার দরজাটা আটকে দিলো। অন্ধকারে এদিক ওদিক হাঁটতে লাগলো পিটার। পঁচা লাশের গন্ধটা ধীরে ধীরে অসহ্য হয়ে ওঠছে। অনেকক্ষণ নিশ্বাস আটকে রাখার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ পেরে উঠা যায়? হয়তো একদিন সে নিজেও এরকম পঁচা লাশ হবে, আর তার লাশের গন্ধ সহ্য করতে না পেরে তারই মতো অবস্থা হবে অন্য কোনো বন্দীর।
টগবগ করতে করতে সৈন্যদের ঘোড়ার আওয়াজ দূরে সরে যেতে লাগলো। একসময় আর শোনা গেল না ক্ষীণ আওয়াজটাও। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লো পিটার। ভাবতে লাগলো, এটা কি আসলেই তার প্রাপ্য ছিল? নিজের চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে তার ডায়ানার জন্য। ওকে হয়তো এতক্ষণে জীবন্ত সমাধি দিয়ে ফেলেছে ওরা। সমাধির ভেতর নিশ্বাস নিতে না পেরে কতই না কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। কতই না যন্ত্রণা নিয়ে নিশ্বাসটা বের হয়ে যাবে তার। ভাবতেই অশ্রু গড়িয়ে পড়লো পিটারের চোখ বেয়ে। লাশের গন্ধ থেকে বাঁচতে সে অন্ধকারে হাঁটতে লাগলো এদিক থেকে ওদিকে। হঠাৎ একটা লাশের সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল অনেকগুলো লাশের স্তুপে। কোনো কোনো লাশ কঙ্কাল হয়ে গেছে এতদিনে।
ধীরে ধীরে অক্সিজেনের ঘাটতি শুরু হলো। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হলো পিটারের। শেষ নিশ্বাস নেয়ার আগে সে ভাবলো ঐ পাদরির কথা। পাদরি কি পারবে পুরো বইটা লিখে শেষ করতে? বইয়ের মন্ত্রগুলো জীবন্ত হওয়ার আগে বইটা নষ্ট বা হারিয়ে যাবে না তো? যদি হারিয়ে না যায়, এমন কারও হাতে পড়বে তো বইটা, যে পুরো বইটা পড়ে শেষ করবে? ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করলো পিটার।

১৫৫৩ সাল।
ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ড প্রচণ্ড অসুখে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন। ছয় বছর আগে বাবা অষ্টম হেনরির মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে বসেছিলেন। তখন তিনি ছিলেন মাত্র নয় বছরের বালক। ছয় বছর দক্ষতার সাথে রাজ্য শাসন করার পর হঠাৎ তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভাবনায় পড়ে গেলেন রাজ্যভার কাকে দিয়ে যাবেন। তাঁর দুই সৎবোন মেরি এবং এলিজাবেথ। এলিজাবেথ রাজ্য চালানোর মতো এখনও এতোটা অভিজ্ঞ না। মেরিকেও রাজ্যভার দেয়া যাবে না। কারণ সে শাসক হলে নিশ্চিত একটা যুদ্ধ বাঁধবে ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যাণ্টদের মধ্যে। বাবার প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভের কারণে মেরি প্রোটেস্ট্যাণ্টদের বড় কোনো ক্ষতি করতে পারে। ভাবতে ভাবতে এডওয়ার্ড জানতে চায়লেন,
-আমার বোন মেরি এবং এলিজাবেথ, ওরা কোথায়?’
জানতে চেয়েই চোখ বন্ধ করলেন এডওয়ার্ড। কে যেন জবাব দিলো ওরা দুজন রাজপ্রাসাদে নেই। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন এডওয়ার্ড। কাছের মানুষগুলোকে তিনি কখনও পাশে পাননি। নিজের মাকে তিনি চোখেও দেখেননি। তবে শুনেছেন, তাঁর মায়ের নাম ছিল জেন সিমুর। রানি অ্যানি বোলকে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করার কয়েক বছর পর রাজা অষ্টম হেনরি তাঁর মাকে বিয়ে করেন। কিন্তু রানি জেন সিমুরকেও শিরশ্ছেদ করা হয় এডওয়ার্ডের জন্মের এক বছর পর। রানির অপরাধ ছিল, তিনি নাকি ব্যাভিচারে জড়িত ছিলেন। ভাবতে ভাবতে আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন এডওয়ার্ড। বাবার কুকীর্তিগুলো বড্ড পীড়া দিচ্ছে তাঁকে। তিনি এমন এক বাবার সন্তান যিনি অনেকগুলো বিয়ে করেন, আর কখনও স্ত্রীদের প্রতি সদয় ছিলেন না, যিনি তাঁর তিনজন স্ত্রীকে শিরশ্ছেদ করেন, একজনকে জীবন্ত সমাধি দেন, আরেকজনকে নির্বাসন করেন। বাবার এতো পাপের দায় হয়তো এখন এডওয়ার্ডের উপর এসে পড়েছে, তাই এডওয়ার্ড এই অল্প বয়সে মরতে বসেছেন। মনে মনে উচ্চারণ করলেন এডওয়ার্ড,
-ঈশ্বর, আমার বাবাকে ক্ষমা করুন।’
চারদিক থেকে ভারী হয়ে আসছে বাতাস। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ডের নিশ্বাস।

হ্যাম্পটন কোর্ট। পরিত্যক্ত এক প্রাসাদ। দিনের বেলায়ও এখানে লোকেরা আসতে ভয় পায়। মৃতদের আত্মা নাকি ঘুরে বেড়ায় এই হ্যাম্পটন কোর্ট প্রাসাদে। এই প্রাসাদে একা একা পায়চারি করছিল এলিজাবেথ। কী যেন খুঁজছে সে। সেই মুহূর্তে কোথা থেকে যেন মেরি এলো প্রাসাদে।
-এলি, তুমি এখানে কী করছো বোন একা একা? জানো না এই জায়গাটা ভালো না?’ উত্তেজিত হয়ে এলিজাবেথের হাত ধরে মেরি।
-কে বলছে ভালো না? এখানে নাকি মাঝেমাঝে আমার মায়ের আত্মাকে ঘুরতে দেখা যায়। তাই আমিও দেখতে এসেছি আমার মাকে।’ মেরির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে এলিজাবেথ।
-ওরা মিথ্যে বলছে, তোমার মা এখানে আসে না। চলো ফিরে যায়।
-না, আজ আমি আমার মাকে দেখেই যাবো। কখনও তো দেখিনি। আমার মা দেখতে কেমন ছিল আজ দেখবো।
-চলো বোন আমার। তোমার মা আসবে না। এভাবে আর একা একা এসো না এখানে। চলো আমার সাথে…’ এলিজাবেথের হাত ধরে টানতে লাগলো মেরি। প্রাসাদের সিঁড়িতে তখন শব্দ হলো। সিঁড়ি বেয়ে কাকে যেন নামতে দেখা গেল। একটা সুন্দরী মহিলা। মহিলাটি সিঁড়ি থেকে নেমে করিডরে এসে দাঁড়ালো। হা করে চেয়ে রইলো তার দিকে মেরি আর এলিজাবেথ। মেরির মুখ দিয়ে অস্ফুটে শব্দ বের হলো,
-রানি অ্যানি বোল!’
বিশ্বাস করতে পারছে না মেরি, রানি অ্যানি বোলকে সে এভাবে দেখতে পাবে। বিশ বছর আগে শেষ বারের মতো দেখেছিল সে রানি অ্যানি বোলকে। আজ যেমন বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে সামনে এসেছে রানি অ্যানি বোল, সেদিনও তার এরকম বিষণ্ণ চেহারা ছিল। সেদিন রাজার হুকুমে তাকে মুণ্ডপাত করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তার অপরাধ ছিল রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা। এই অপরাধের কারণেই রানি অ্যানি বোলকে একদিন এই প্রাসাদে নিয়ে এসে সবার সামনে মাথা নত করে বসানো হয়। তারপর তরবারির এক আঘাতে তার ধড় থেকে মাথা আলাদা করা হয়। মেরি সেদিন নিজ চোখে দেখেছিল অ্যানি বোলের মুণ্ডহীন দেহটা কীভাবে ছটফট করছিল।
-এটা আমার মা?’ প্রশ্ন করলো এলিজাবেথ।
-হ্যাঁ…’ ভীতিকণ্ঠে জবাব দিলো মেরি। শক্ত করে ধরে আছে সে এলিজাবেথের হাত। এলিজাবেথ নিজের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করলো,
-ছাড়ো, হাত ছাড়ো আমার। আমি মায়ের কাছে যাবো।’
মেরি ছাড়লো না হাত। তখন রানি অ্যানি বোলের ধড় থেকে মাথা আলাদা হতে লাগলো। মাথাটা আলাদা হয়ে শূন্যে ভাসতে লাগলো। আর মুণ্ডহীন দেহটা পায়চারি করতে লাগলো করিডরে। হা করে চেয়ে রইলো মেরি আর এলিজাবেথ। কিছুক্ষণ পর এলিজাবেথ কেঁদে ওঠলো,
-আমার মা… আমার মায়ের এ অবস্থা কেন?’
মেরি আলতো কণ্ঠে বললো,
-সেদিন তোমার মায়ের এই অবস্থা করেছিল নিষ্ঠুর রাজা।’ রাজা হেনরির প্রতি ঘৃণা ফুটে ওঠলো মেরির চেহারায়।
ঘোড়ার টগবগ আওয়াজ শোনা গেল। কে যেন আসছে এদিকে। এলিজাবেথের হাত ধরে প্রাসাদের বাইরে এলো মেরি। দেখলো একজন বার্তাবাহক এসেছে তাদের কাছে। মেরি তাকে জিজ্ঞেস করলো,
-কী বার্তা নিয়ে এসেছো, বলো?
-দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি রাজকুমারী। রাজা এডওয়ার্ড আর বেঁচে নেই।
-কী বলছো তুমি?’ একসাথে উত্তেজিত হয়ে ওঠলো দু’বোন। ঘোড়ায় উঠে বসলো দ্রুত। তারপর ছুটে চললো রাজপ্রাসাদের দিকে।

রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডের উঁচু পর্যায়ের রাজনীতিবিদরা সম্মিলিত হয়। বৈঠক করে তারা। কে হবে পরবর্তী শাসক। এদিকে মেরি প্রস্তুতি নিচ্ছিল শাসনভার নিজের হাতে নেয়ার জন্য। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাজনীতিবিদরা ঘোষণা করলো, রাজা অষ্টম হেনরির বোনের নাতনি ‘লেডি জেন গ্রে’ হবে ইংল্যান্ডের পরবর্তী শাসক। রাগে ক্রোধে ফেটে পড়লো তখন মেরি। এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। রাজ্যের শাসনভার তার অধিকার, সবদিক দিয়ে সে শাসক হওয়ার যোগ্য।
যেদিন লেডি জেন গ্রে শাসনভার গ্রহণ করে, সেদিন মেরি রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে যায় পূর্ব আঙ্গলিয়ায়। সেখানে মেরি তার বাহিনী গঠন করে গোপনে। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে। একদিন মেরি তার বিশাল বাহিনী নিয়ে ফিরে আসে। সেদিন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। শত-শত মানুষ মারা যায়। পরাজিত হয় জেন গ্রের বাহিনী। মাত্র নয়দিন রাজ্য শাসন করে বহিষ্কৃত হয় লেডি জেন গ্রে। এরপর ইংল্যান্ডের রানি হয় তখন মেরি নিজে। তার আদেশে জেন গ্রেকে নিয়ে যাওয়া হয় টাওয়ার অব লন্ডনে। তাকে যখন মাথা নত করে হাঁটুগেড়ে বসানো হয়, তখন মেরির চোখে ভাসে এডওয়ার্ডের মায়ের চেহারাটা। এই জায়গায় রাজা অষ্টম হেনরি রানি জেন সিমুরের শিরশ্ছেদ করেছিলেন। সেই একই জায়গায় লেডি জেন গ্রেরও শিরশ্ছেদ করে মেরি। এরপর ইংল্যান্ডে চলতে থাকে মেরির শাসন…

[[চলবে…]]