#ফিরে_আসা__
লেখা: ShoheL Rana শামী
পর্ব:-০৪
শত শত ক্যাথলিক গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সবার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা-ই বলে দিচ্ছে নতুন কোনো সম্ভাবনার উন্মেষ ঘটতে চলেছে। অনেক বছর ধরে তালাবদ্ধ ছিল গির্জাটি। রাজা অষ্টম হেনরির সময় ক্যাথলিকদের যখন দমিয়ে দেয়া হয়েছিল, তখন রাজার আদেশে তালাবদ্ধ হয় গির্জাটি। এরপর কাউকে এই গির্জায় প্রবেশ করতে দেখা যায়নি। রানি মেরির নির্দেশে আবার গির্জার তালা ভাঙা হয়। সবকিছু পরিষ্কার করা হয়। নতুন করে আবার চকচক করে ওঠলো ক্যাথলিক গির্জাটি।
ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে রানি মেরিকে আসতে দেখা গেল। তার পাশে বসা জর্জ মারিও। এই গির্জার নতুন পোপ হিসেবে তাঁকে নিয়োগ করেছে রানি মেরি। বয়স পঞ্চাশোর্ধ। কাছে আসতেই মাথা নত করে তাদের সম্মান জানালো ক্যাথলিকরা। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলো রানি মেরি এবং জর্জ মারিও।
-জয় হোক রানি মেরির। জয় হোক।’ সম্মিলিত কণ্ঠে বলে ওঠলো ক্যাথলিকরা। মেরি মৃদু হেসে সবাইকে থামতে বললো হাত তুলে। তারপর সবার উদ্দেশ্য নতুন পোপকে ইশারায় দেখিয়ে বললো,
-ইনি জর্জ মারিও, আমাদের নতুন পোপ। আজ থেকে এই গির্জার দায়িত্ব উনার হাতে থাকবে। উনার হাত ধরেই আমরা ক্যাথলিকরা নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হবো। রাজা হেনরি ক্যাথলিকদের ধ্বংস করার যে ছক এঁকেছিলেন, তা আমি নির্মূল করবো।
-জয় হোক রানি মেরির, জয় হোক।’ আবারও উচ্চারিত হলো সম্মিলিত কণ্ঠে। তখন কয়েকজন প্রোটেস্টাণ্টের একটা দল ঘোড়ায় চড়ে এলো সেখানে। ঘোড়া থেকে নেমে ওরা রানি মেরির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। মেরি তাদের কথা শুনার জন্য আগ্রহ দেখালো। দলটি সামনে এসে কুর্নিশ করলো মেরিকে। তারপর একজন বললো,
-বেয়াদবি নেবেন না। যে গির্জাটি রাজা হেনরির আদেশে বন্ধ করা হয়েছে, সেটি পুনরায় চালু করার অনুমতি আপনি দিতে পারেন না।
-তুমি কার সাথে কথা বলছো ভেবে দেখেছো?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো মেরি।
-জি, কিন্তু এটা আপনি করতে পারেন না। আমরা প্রোটেস্টাণ্টরা একমাত্র ঈশ্বর এবং বাইবেলকেই মানি। ঈশ্বরকে পেতে হলে পোপ বা পাদরি কাউকেই প্রয়োজন নেই।
-তোমাদের সবার মাথা যদি হারাতে না চাও, তবে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও। নয়তো আমি দ্বিতীয়বার ভাববো না।’
রানির কথা শেষ হতেই ফিরে যেতে লাগলো প্রোটেস্টাণ্ট দলটা। তাদের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে রইলো মেরি। আবারও তার জয়ধ্বনি তুললো ক্যাথলিকরা।
পরদিন রাজ দরবারের সামনে প্রোটেস্টাণ্টদের একটা বড় দল আন্দোলন শুরু করলো রানি মেরির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। মেরি সিংহাসনে বসে সেনাপতি লিওনিডাসের উদ্দেশ্য বললো,
-সেনাপতি, তুমি তোমার সৈন্যদের নিয়ে যাও। ওদেরকে থামাও। প্রয়োজনে হত্যা করো।’
-যথা আজ্ঞা, ইউর ম্যাজেস্টি।’
কুর্নিশ করে বেরিয়ে এলো সেনাপতি লিওনিডাস। তারপর হাঁটতে লাগলো অনুশীলন মাঠের দিকে, যেখানে তার সৈন্যরা তরবারি চালনার অনুশীলন করে। মাঠে এসেই লিওনিডাস তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললো,
-সৈন্যরা প্রস্তুত হও এক্ষুনি। বিদ্রোহীরা মেতে ওঠেছে রাজ দরবারের সামনে। তাদের দমাতে হবে।’
সেনাপতির আদেশে প্রস্তুত হয়ে নিলো সৈন্যরা। তারপর আক্রমণ করতে ছুটলো বিদ্রোহীদের। তাদেরকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসতে দেখে প্রোটেস্টাণ্টরাও তরবারি বের করলো। দুপক্ষের মধ্যে তরবারি যুদ্ধ শুরু হলো। অনেকক্ষণ যুদ্ধ চলার পর প্রোটেস্টাণ্টদের বেশ কজন রক্তাক্ত হয়ে ছটফট করতে লাগলো নিচে। কেউ কেউ পালিয়ে গেল। বাকিদের বন্দী করলো সৈন্যরা। বন্দীদের হাঁটুগেড়ে বসানো হলো নিচে। দুহাত পেছনে বাঁধা। কিছুক্ষণ পর রাজ দরবার থেকে বের হয়ে এলো মেরি। বন্দীদের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখলো তাদের। তারপর তরবারি হাতে নিলো। বন্দী প্রোটেস্টাণ্টরা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো রানির দিকে। তারা জানে তাদের পরিণতি কী হতে যাচ্ছে। তবুও প্রাণ ভিক্ষা চায়লো না। তরবারি হাতে নিয়ে রানি মেরি চিৎকার করে ওঠলো,
-আমার রাজ্যে যে রানির সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।’ বলেই আর অপেক্ষা করলো না মেরি। তরবারির আঘাতে বন্দী সবার ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দিলো। এই প্রোটেস্টাণ্টদের মেরে বাবার প্রতি তার ক্ষোভ কিছুটা হলেও কমলো। তবে প্রতিশোধ এখনও শেষ হয়নি। আরও অনেক প্রোটেস্টাণ্টদের রক্ত চায় তার। তাদের রক্তে এ রাজ্য ভাসাবে সে।
গভীর জঙ্গলের প্রবেশমুখে মুখোশ পরা একটা দল উৎপেতে আছে। উৎপেতে ওরা তাকিয়ে আছে জঙ্গলের দিকে। অপেক্ষা করছে তারা। হঠাৎ ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল। নড়েচড়ে বসলো দলটা। দলপতি ইশারায় সবাইকে প্রস্তুত হয়ে নিতে বললো। একটু পর দেখা গেল রানি মেরিকে। মেরি তার সৈন্য নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ফিরে আসছিল জঙ্গল থেকে। শিকার করতে গিয়েছিল তারা। তাদের জন্যই উৎপেতে আছে মুখোশপরা দলটা। কাছাকাছি আসতেই একজন তিরন্দাজ তির ছুড়লো মেরির সৈন্যদের দিকে। ওরা কিছু বুঝে উঠার আগেই মেরির কয়েকজন সৈন্য প্রাণ হারালো তিরের আঘাতে। বাকিরা ঘোড়া থামিয়ে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিলো। তখন বেরিয়ে এলো মুখোশ পরা দলটা। তারা একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো রানির সৈন্যদের উপর। সংখ্যায় ওরা অনেক। চলতে লাগলো আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ। রানি মেরি বুঝতে পারলো, এবার সে পরাজিত হতে যাচ্ছে। তার সৈন্যরাও বুঝতে পেরে রানিকে বাঁচানোর জন্য বললো,
-আপনি ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যান, এদেরকে আমরা দেখছি।’
রানি তাই করলো। সৈন্যদের যুদ্ধ করতে দিয়ে নিজের ঘোড়ায় চড়ে বসলো। তখন মুখোশপরা দলটির দলপতি বলে ওঠলো,
-রানি পালিয়ে যাচ্ছে। আটকাও তাকে।’
কয়েকজন ছুটে গেল রানিকে ধরতে। বাকিরা রানির সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো। মেরি প্রাণপণে ঘোড়া ছুটাতে লাগলো। পেছন পেছন ঘোড়া নিয়ে আসতে লাগলো মুখোশধারীরাও। একজন তির বের করে ছুড়লো ছুটন্ত ঘোড়ার পা লক্ষ্য করে। অব্যর্থ লক্ষ্য। রানিকে নিয়ে উল্টে পড়লো ঘোড়াটি। নিচে কাতরাতে লাগলো রানি মেরি। মুখোশধারীরা গিয়ে তরবারি ধরলো রানির গলায়। মেরি দেখলো বাঁচার কোনো উপায় নেই আর। চোখ বড় বড় করে তাকালো সে মুখোশধারীদের দিকে। তবে ভয় পেল না। তখন মুখোশধারীদের বাকি সৈন্যরাও এসে হাজির হলো। মেরি বুঝলো, তার নিজের সৈন্যরা কেউ আর নেই। ওরা সবাইকে মেরে তাকে মারতে এসেছে। সবাই মেরিকে ঘিরে দাঁড়ালো। হাসতে লাগলো ওরা, বিজয়ের হাসি। সেই মুহূর্তে ঝড়ের বেগে কোথা থেকে যেন তির ছুটে এলো। তিরের আঘাতে মুখোশধারীদের কয়েকজন লুটিয়ে পড়লো নিচে। হতভম্ব হয়ে গেল দলটা। কারা আবার তাদের আক্রমণ করে বসলো? আসন্ন বিপদের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হলো ওরা। রানি মেরিও উঠে দাঁড়ালো। দেখলো, একদল অচেনা সৈন্য তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে সুদর্শন এক পুরুষ। তারা এসে মুখোশধারীদের সাথে তরবারি যুদ্ধ করতে লাগলো। মেরি তাদের যুদ্ধ কৌশল দেখে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো। বেশিক্ষণ লাগলো না বাকি মুখোশধারীদের ধরাশায়ী করতে। নেতৃত্বে যে পুরুষটা, সে দুহাতেই তরবারি চালিয়ে একাই বেশ কজন মুখোশধারীকে লুটিয়ে দিয়েছে মাটির সাথে।
এবার মেরির দিকে এগিয়ে এলো সে। জিজ্ঞেস করলো,
-কে আপনি?’
-আমি মেরি। এই রাজ্যের রানি।
-রানি মেরি!’ হাসলো সুদর্শন পুরুষটি। ‘আমি ফিলিপ। স্পেনের রাজপুত্র। আপনার অতিথি হতে এসেছি।’
-স্বাগতম আপনাকে এবং আপনার সৈন্যদের।’ মেরিও হাসলো। ‘কিন্তু, আপনারা এখানে?’ কিছুটা অবাক হলো মেরি।
-আমরা এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম।
-ভাগ্যিস আপনারা এসেছেন। চলুন রাজপ্রাসাদে যাওয়া যাক।’
ফিলিপ ও তার সৈন্যদের পথ দেখালো রানি মেরি।
রাজপ্রাসাদে ফিলিপ ও তার সৈন্যদের থাকার জায়গা করে দিলো মেরি। ফিলিপকে যে কক্ষে থাকতে দিয়েছে, সেখানে তার সাথে আলাপ করতে এলো সে।
-আপনার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?’ জিজ্ঞেস করলো মেরি।
-নাহ্, আমি ঠিক আছি। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ ইতস্তত করলো ফিলিপ।
-জি, করুন…’
-যারা আপনার উপর আক্রমণ করেছিল, আসলে কারা ওরা? চিনতে পেরেছেন?
-হুমম, ভালো করেই চিনেছি। প্রোটেস্টাণ্ট। আমার রাজ্য থেকে সব প্রোটেস্টাণ্টদের বিতাড়িত করেই ছাড়বো আমি।
-আর আপনার সহায়তায় আমার সৈন্যরাও সবসময় প্রস্তুত থাকবে।
-কৃতজ্ঞ আপনাদের উপর।’ হাসলো মেরি। ‘সময় করে আমার দরবারে আসবেন।’ বলেই বেরিয়ে গেল মেরি। ফিলিপ চেয়ে রইলো ওর দিকে। মেরিকে তার ভালো লেগেছে। স্পেনে যদি ফিরে যায়, তবে আবার মেরিকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে সে।
সিংহাসনে বসে আছে মেরি। সেনাপতি লিওনিডাস ভেতরে ঢুকে কুর্নিশ করলো।
-বলো লিওনিডাস, কী খবর নিয়ে এসেছো?’ প্রশ্ন করলো মেরি।
-ইউর ম্যাজেস্টি, আপনার আদেশে আমরা প্রোটেস্টাণ্টদের উপর হামলা করেছি। অনেক প্রোটেস্টাণ্টদের বন্দী করে এনেছি। তবে ওরা অস্বীকার করছে। তারা বলছে, মুখোশধারীরা তাদের কেউ ছিল না।
-মিথ্যে বলছে ওরা। ওদেরকে শাস্তি দেয়া হবে, ওদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া হবে। আমি ওদের মুণ্ডপাত করবো।
-ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাচ্ছি, ইউর ম্যাজেস্টি।’
ফিলিপকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু হাসলো মেরি।
-আসুন, আসুন, আমার দরবার আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’
হাসিমুখে প্রবেশ করলো ফিলিপ। তারপর রানির উদ্দেশ্যে বললো,
-ইউর ম্যাজেস্টি, যদি অনুমতি দেন, তবে একটা কথা বলতে পারি…
-জি, বলুন…
-বন্দী প্রোটেস্টাণ্টদের শিরশ্ছেদ করবেন না।’
ফিলিপের কথা শুনে রানি মেরিসহ সভার সবাই তাকালো তার দিকে। এই লোকটা কী বলছে এসব?
-মানে? কী বলছেন আপনি?’ প্রশ্ন করলো মেরি। ফিলিপ একটু প্রস্তুতি নিয়ে বললো,
-ওদেরকে শিরশ্ছেদ করবেন না। বরং ওদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মারুন।’
এবার সভার মধ্যে গুঞ্জন সৃষ্টি হলো ফিলিপের মন্তব্যে। রানি মেরিও অবাক হলো। মেরি জানতে চায়লো,
-আপনি এটা করতে বলছেন কেন? জানেন না, প্রোটেস্টাণ্টদের আইনে মুণ্ডপাত করার নিয়ম আছে, আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেয়ার কোনো নিয়ম নেই।
-জানি, ইউর ম্যাজেস্টি। কিন্তু, ক্যাথলিকদের আইনে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেয়ার বিধান আছে। যদি ওদেরকে ক্যাথলিকদের আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হয়, তাহলে ওরা আরও বেশি ফোঁসে ওঠবে। ওরা বিদ্রোহ শুরু করবে। আর বিদ্রোহীদের আপনি সহজেই আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে পারবেন।
-বেশ বলেছেন আপনি।’ ফিলিপের বুদ্ধির প্রশংসা করলো মেরি। তারপর সেনাপতি লিওনিডাসকে আদেশ দিলো,
-সেনাপতি, তুমি আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করো। বন্দীদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে।’
সেনাপতি লিওনিডাস বিশাল এক খোলা মাঠে আগুন জ্বালালো। প্রোটেস্টাণ্টদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার খবর ইতোমধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিক থেকে হাজারো মানুষ আসতে লাগলো পুড়ানোর দৃশ্য দেখতে।
উত্তপ্ত রোদে খুঁটির সাথে বাঁধা আছে প্রোটেস্টাণ্ট বন্দীরা। অসহায়ের মতো চেয়ে আছে তারা জ্বলন্ত আগুনের দিকে। একটু পর এই আগুনে তাদের জ্বলে মরতে হবে। কয়েকটা চিল ডানা মেলে আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে৷ তারাও হয়তো অপেক্ষা করছে প্রোটেস্টাণ্টদের মৃত্যু দৃশ্য দেখতে।
ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে রানি মেরি হাজির হলো মাঠে। সে আসতেই, লোকজন দুদিকে সরে গিয়ে তাকে বন্দীদের কাছে যাওয়ার জায়গা করে দিলো। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে কোনোদিকে না তাকিয়ে বন্দীদের দিকে হাঁটতে লাগলো মেরি। কাছে এসে বন্দী সবাইকে এক নজরে দেখে নিলো সে। তারপর কয়েকটা শুকনো কাঠ ফেললো জ্বলন্ত আগুনে। আগুনটা আরও বেশি দাউদাউ করে ওঠলো। ভিড় থেকে তখন একদল লোক চিৎকার করে ওঠলো,
-এ নিয়ম মানি না। ব্লাডি মেরি ধ্বংস হোক।’
‘ব্লাডি মেরি’ শব্দটা তার কানে খুব জোরালোভাবে এসে লাগলো। পাদরির কথা মনে পড়লো তার। পাদরি তাকে নিয়ে ভবিষ্যতবাণী করেছিল। সেই সময় সে আফসোস করতো এটা ভেবে, সত্যি কি সে ব্লাডি মেরি হয়ে যাবে?
কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, প্রোটেস্টাণ্টদের রক্ত তার জন্য হালাল। যতো বেশি প্রোটেস্টাণ্টরা মরবে, সে ততো খুশি। এটাই শেষ নয়, আরও অনেক প্রোটেস্টাণ্টদের জীবন চায় সে। সেনাপতি লিওনিডাসকে আদেশ করলো মেরি,
-বন্দীদের আগুনে নিক্ষেপ করো।’
লিওনিডাস এবং তার সৈন্যরা মিলে এক এক করে বন্দীদের নিক্ষেপ করতে লাগলো আগুনে। লোকদের মাঝে তখন উত্তেজনা বেড়ে গেল। কারও কারও কান্না শোনা গেল। হয়তো বন্দীদের কোনো আত্মীয় হবে ওরা৷ মেরির ভয়ে সামনে আসতে পারছে না, ভিড়ের মাঝেই কাঁদছে। বন্দীদের মুখ বাঁধা ছিল, তাই আগুনে নিক্ষেপ হতেই কোনো চিৎকার বের হলো না। তবে মনে হলো আগুনের ভেতর বেশ কয়েকটা অগ্নিপিণ্ড ছটফট করছে।
এই ঘটনার পর প্রোটেস্টাণ্টরা অনেক বেশি ফোঁসে ওঠে ক্রোধে। ক্যাথলিকদের আইন অনুসরণ করে প্রোটেস্টাণ্টদের শাস্তি দেয়াটা ওরা কিছুতেই মানতে পারেনি। তাই বিদ্রোহ শুরু করে। মেরি দেখে, ফিলিপের বুদ্ধি কাজে লেগেছে। প্রোটেস্টাণ্ট বিদ্রোহীদের এবার সহজেই সে শাস্তি দিতে পারবে। ফিলিপও চায় প্রোটেস্টাণ্টরা যাতে ধ্বংস হয়ে যায়। স্পেনেও ওদের ধ্বংস করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দুজনের যেহেতু একই লক্ষ্য, এই সুযোগে দুজন আরও কাছাকাছি আসে। এবং একসময় ফিলিপ প্রস্তাব করে,
-যদি আমরা দুজন এক হয়, তবে আমরা অনেক শক্তিশালী হবো। একসাথে মিলে প্রোটেস্টাণ্টদের ধ্বংস করতে পারবো।
-তা ঠিক, কিন্তু এর জন্য আমরা কী করতে পারি?
-বিয়ে। আমাদের বিয়ে হলে, ইংল্যান্ড এবং স্পেনের শক্তি এক হবে। আর রাজা হিসেবে যখন স্পেনে আমার অভিষেক হবে, আপনি স্পেনেরও রানি হতে পারবেন।’
মেরিকে কী যেন ভাবতে দেখা গেলো। একইসাথে স্পেনেরও রানি হতে পারলে তার ক্ষমতা আরও অনেক বেড়ে যাবে।
-আপনি ঠিক বলেছেন। আপনার প্রস্তাবটা ফেলে দেয়ার মতো না।’ রাজি হলো মেরি।
-তাহলে আমরা বিয়ের আয়োজন করতে পারি…’
-হুমম, অবশ্যই।’ মৃদু হাসলো মেরি।
-তাহলে আজই আমরা স্পেনে ফিরে যাবো বিয়ের আয়োজন করতে।
-আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্য।’ চোখ টিপে বললো মেরি। মৃদু হাসলো ফিলিপ।
১৫৫৮ সাল।
মেরি একইসাথে ইংল্যান্ড ও স্পেনের রানি। দুবছর আগে স্পেনে ফিলিপের অভিষেক হয়েছে রাজা হিসেবে। এরপর থেকে মেরির ক্ষমতা আর দেখে কে? স্পেনেও চলতে থাকে প্রোটেস্টাণ্টদের উপর অত্যাচার। ইংল্যান্ডে আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তার এই অত্যাচার। গত পাঁচ বছরে সে কত যে প্রোটেস্টাণ্টদের পুড়িয়ে মেরেছে, শিরশ্ছেদ করে মেরেছে, তা তার নিজেরও হিসাব নেই। ইংল্যান্ডের ক্যাথলিকদের কাছেও তার এই অত্যাচার অসহ্য হয়ে ওঠেছে। সবাই তাকে এক নামেই ডাকে, ব্লাডি মেরি। তারা এখন মেরিকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে এলিজাবেথকে বসাতে চায়।
এজন্য এলিজাবেথও এখন মেরির শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া ফিলিপ তার স্বামী হয়েও এলিজাবেথকে পছন্দ করে। এবং সে এলিজাবেথকে নিজের রানি বানাতে চায়। এ নিয়ে একদিন ফিলিপের সাথে মেরির খুব তর্ক-বিতর্ক হয়। মেরি ফিলিপের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-আমি বুঝতে পারছি, তুমি এলিজাবেথকে পছন্দ করো। তুমি তাকে বিয়ে করতে চাও। কিন্তু এটা মনে রেখো, এটা আমি কখনও হতে দেবো না।’
ফিলিপও রাগ দেখিয়ে বলে,
-চার বছর হলো তোমার আমার বিয়ে হয়েছে। তুমি আমাকে একটা সন্তান দিতে পেরেছো? কী করে ভাবলে আমি দ্বিতীয় কাউকে পছন্দ করবো না?
-গর্ভবতী তো আমি হয়েছিলাম। নাকি হয়নি? বলো, আমি গর্ভবতী হয়নি?’ ফিলিপের গা ধরে ঝাঁকি দিলো মেরি।
-হ্যাঁ হয়েছিলে। দুইবার হয়েছিলে। কিন্তু, দুবারই তোমার গর্ভেই সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। তোমাকে নিয়ে লোকে কী বলে জানো?
-কী বলে?
-বলে, তোমার পেটের ভেতর শয়তান বাসা বেঁধেছে। তাই তোমার সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। তুমি কখনও মা হতে পারবে না। আর আমার তো একজন উত্তরাধিকার লাগবে৷ তুমি সেটা দিতে পারবে না।
-আমি ঐ লোকগুলোর গর্দান নেবো, যারা আমায় নিয়ে এই অপবাদ করে।
-এছাড়া তুমি আর কী করতে পারবে? আমি আজই স্পেনে রওনা দেবো। আর এলিজাবেথকে শেষবারের মতো আমার প্রস্তাবটি করবো।’ বলেই বেরিয়ে যায় ফিলিপ। রাগে ক্রোধে কিছু বলতে পারে না মেরি। ফিলিপ বেরিয়ে এসে এলিজাবেথের সাথে দেখা করে। ভনিতা না করে সোজা বলে ওঠে,
-আমি শেষবারের মতো প্রস্তাব করছি, আমি তোমাকে স্পেনের রানি হিসেবে দেখতে চাই।’
এলিজাবেথও সোজা উত্তর দেয়,
-দেখুন, আমি আগেও আপনাকে নিষেধ করেছি এসব প্রস্তাব আমার সামনে করবেন না। এক স্ত্রী থাকতে আপনারা কী করে আরেকজনকে বিয়ে করতে চান? পুরুষদের উপর থেকে আমার বিশ্বাস উঠে গেছে। আমি আজীবন বিয়ে না করেই থাকবো।
-এটাই তোমার সিদ্ধান্ত?
-হ্যাঁ, এটাই আমার সিদ্ধান্ত।’
এলিজাবেথের কথা শুনে আর থেমে থাকে না ফিলিপ। চলে যায় সে। সেদিনই সে তার সৈন্য নিয়ে প্রস্থান করে স্পেনের উদ্দেশ্যে।
ফিলিপ চলে যাওয়ার পর মেরি খুব কষ্ট পায়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে অনেকটা। তার সব রাগ গিয়ে পড়ে প্রোটেস্টাণ্টদের উপর। সেনাপতি লিওনিডাসকে সে আদেশ দেয়, নতুন করে আক্রমণ চালাতে বিদ্রোহী প্রোটেস্টাণ্টদের উপর। ক্যাথলিকদের মাঝেও যদি কোনো বিদ্রোহী থাকে, তবে তাদেরকেও শেষ করতে হবে।
মেরির এই রক্তপিপাসা দেখে অনেক ক্যাথলিক প্রোটেস্টাণ্টদের সাথে যোগ দিয়েছে আন্দোলনে। সবাই চায় মেরি সিংহাসন ছেড়ে দিক। এলিজাবেথ বসুক সিংহাসনে। প্রতিবাদীদের দমিয়ে দিতে সেনাপতি লিওনিডাস তার সৈন্য নিয়ে সেদিনই বের হলো। যেখানে বিদ্রোহীদের দেখতে পেল, সেখান থেকে বন্দী করতে শুরু করলো। প্রায় শখানেক বন্দী নিয়ে মেরির সামনে উপস্থিত হলো লিওনিডাস। মেরি তাদেরকে বিচারের আওতায় না এনে লিওনিডাসকে আদেশ দিলো, সবাইকে আগুনে পুড়াতে।
‘হায় হায়’ রব উঠলো লোকদের মাঝে। এই রক্তপিপাসু নারীকে এখনই না থামালে অনেক নিরীহ লোক এভাবে জীবন হারাবে। কিন্তু লোকদের হাহাকার পরোয়া না করে মেরির আদেশে বন্দীদের পুড়াতে নিয়ে যাওয়া হলো সেই মাঠে। যথারীতি আগুন জ্বালানো হলো। বিশাল আগুনের স্তুপে এক এক করে নিক্ষেপ করা হলো শখানেক বন্দী সবাইকে।
যারা এই মৃত্যুদৃশ্য দেখতে এলো, কেউ মেনে নিতে পারলো না এ অন্যায়। বন্দীরা আগুনে পুড়ছে, আর কুণ্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়াগুলো শূন্যে উঠে বাতাসে মিশে যাচ্ছে। মনে হলো যেন এ ধোঁয়া নয়, শত নিরীহ লোকের জীবন ধোঁয়া হয়ে বাতাসে হারিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে হাজারো লোক একসাথে গলা মিলালো,
-অত্যাচারী ব্লাডি মেরি, ধ্বংস হও, ধ্বংস হও।’
পৃথিবীর সব অত্যাচারীদের সুসময় বেশিদিন টিকে থাকে না। একদিন না একদিন তাদের অত্যাচারের জবাব দিতে লোকেরা সোচ্চার হয়ে ওঠে। এবার পুরো ইংল্যান্ডবাসী এক হয়ে গেল। ক্যাথলিক বা প্রোটেস্টাণ্ট আলাদা কেউ নয়, সবাই খ্রিষ্টান। সবাই এক হয়ে মেরির ধ্বংস চায়লো।
একদিন রাজপ্রাসাদে একা একা পায়চারি করার সময় হঠাৎ সেনাপতি লিওনিডাস খবর নিয়ে এলো,
-ইউর ম্যাজেস্টি, সামনে বিপদ। হাজার হাজার লোক রাজ দরবার আর রাজপ্রাসাদের সামনে এক হয়েছে।’
মেরিকে অস্থির দেখালো। ভয়ে ঘামছে সে। সে এতক্ষণ পালানোর ফন্দি আঁটছিল। কীভাবে এখান থেকে পালানো যায়। সেনাপতি আবার বলে ওঠলো,
-ইউর ম্যাজেস্টি, আপনাকে পালাতে হবে। আপনি সামনে গেলে ওরা আপনাকে জীবিত ছেড়ে দেবে না।’
অস্থিরতা বেড়ে গেল মেরির। বাইরে চিৎকার শোনা গেল,
-ব্লাডি মেরির ধ্বংস চাই, ব্লাডি মেরির মৃত্যু চাই।’
মেরি আর সময় নষ্ট করলো না। ছদ্মবেশ নিয়ে প্রাসাদের গোপন দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল।
ঘোড়ার পিঠে জোরে জোরে চাবুক মারতে লাগলো মেরি। ঘোড়াটি হ্রেষা রব তুলে ছুটতে লাগলো সামনে। একবার পেছনে তাকালো মেরি। নাহ্, কেউ পিছু নিচ্ছে না। তবুও দ্রুত ঘোড়া ছুটাতে লাগলো সে। যেকোনো মুহূর্তে শত্রুরা পিছু নিতে পারে। কিছুদূর গিয়ে মেরি দেখলো, সামনে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। শত্রু ভেবে মেরি প্রস্তুত হয়ে রইলো। হাত দিয়ে স্পর্শ করলো তরবারিটা। যদি শত্রু হয়, তবে তরবারির এক আঘাতে মাথা দ্বিখণ্ডিত করে দেবে সে তার। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলো, ইনি শত্রু নন। ইনি সেই পাদরি, যিনি তাকে নিয়ে ছোটবেলায় ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন। ঘোড়ার গতি কমালো মেরি। পাদরির সামনে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
-আপনি এখানে? এত বছর কোথায় ছিলেন?
-ইউর ম্যাজেস্টি, কতো জায়গায় তো যেতে হয় আমাকে। তবে আজ আপনাকে পেয়ে ভালোই লাগছে। আপনাকে একটা জিনিস দেয়ার আছে আমার।
-কী জিনিস?
-এই যে, এই বইটা…
-কী বই এটা?
-এটা রানি ডায়ানার বই।
-রানি ডায়ানা!’ অবাক হলো মেরি।
-হ্যাঁ, বইটা এতদিন আমার কাছেই ছিল। আমি যত্ন করে রেখেছিলাম। কিন্তু আমার বয়স তো কম হয়নি। কখন মরে যাবো কে বলতে পারে। তাই বইটা আপনার কাছেই দিয়ে যেতে চাই।
-ঠিক আছে, দিন… কিন্তু কীসের বই এটা?’
পাদরি বইটা মেরির হাতে দিয়ে সব খুলে বললো। পাদরির কথা শেষ হলে, মেরি আবার ছুটতে লাগলো ঘোড়া নিয়ে। পেছনে তখন অনেকগুলো ঘোড়ার হ্রেষা রব শোনা গেল। হয়তো শত্রুরা তার পিছু নিয়েছে।
[[চলবে….]]