#ফিরে_আসা__
লেখা: ShoheL Rana শামী
পর্ব:-০৫
রাজপ্রাসাদের সামনে উত্তেজিত জনগণ মেরির ধ্বংস দেখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে তারা সেনাপতি লিওনিডাস এবং তার সৈন্যদের বন্দী করেছে। করিডরে এসে দাঁড়ালো এলিজাবেথ। হাতের ইশারায় জনগণকে শান্ত হতে বললো সে। এলিজাবেথকে দেখে জনগণ শান্ত হলো। তখন এলিজাবেথ বলতে শুরু করলো,
-প্রিয় জনগণ, আমি আপনাদের অবস্থা বুঝতে পেরেছি। আপনারা সঠিক সময়েই একত্রিত হয়েছেন, এবং আমি আপনাদের সমর্থন করি।’
এলিজাবেথের কথা শুনেই জনগণ চিৎকার করে ওঠলো,
-জয় হোক, রাজকুমারি এলিজাবেথের জয় হোক।’
হাতের ইশারায় আবারও জনগণকে শান্ত করলো এলিজাবেথ। তারপর আবার বলতে শুরু করলো,
-রানি মেরি অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণ নিয়েছে। এতে সে তার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আমরা ইতোমধ্যে আমাদের একটা সৈন্যদল পাঠিয়েছি। তাকে জীবিত ধরে আনা হবে আপনাদের সামনে। তারপর আমি ইংল্যান্ডের রানি হিসেবে শপথ নেবো। এবং রানি মেরির বিচার করবো।’
জনগণ জোরালো কণ্ঠ শোনা গেল এবার,
-দীর্ঘজীবী হোক, রাজকুমারী এলিজাবেথ। দীর্ঘজীবী হোক।’
-তবে আর একটা কথা…’ বলে ওঠলো এলিজাবেথ। ‘সেনাপতি লিওনিডাস এবং তার সৈন্যদের বন্দী করেছেন আপনারা। তাদেরকে কেউ আঘাত করবেন না। তারা রানি মেরির হুকুমের গোলাম ছিল। এতে তাদের কোনো দোষ নেই। তাদের সবাইকে কারাগারে রাখা হবে। তাদেরও বিচার হবে একইসাথে।’
এলিজাবেথের কথায় আশ্বস্ত হলো জনগণ। এবার হয়তো তারা এক যোগ্য রানি পেতে যাচ্ছে। তার হাত ধরে আবার হয়তো শান্তি ফিরে আসবে ইংল্যান্ডে।
আরও কিছুদূর ঘোড়া ছুটালো মেরি। তারপর থামলো। ঘোড়া থেকে নেমে চারদিকে চোখ বুলালো। কাউকে দেখতে পেল না। মাটিতে কান পেতে শত্রুদের ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা যায় কি না দেখলো। নাহ্, শত্রুরা এখনও পিছু ছাড়েনি। এদিকেই আসছে ওরা। মেরি তার ঘোড়ার পিঠে কয়েকটা চাবুক মেরে ছেড়ে দিলো। ঘোড়াটি ছুটতে লাগলো সামনে। শত্রুদের বোকা বানাতে সে করেছে এ কাজটা। শত্রুরা এসে ঘোড়াকে অনুসরণ করে ওদিকেই চলে যাবে।
মেরি ঢুকে পড়লো একটা জঙ্গলে। নিজের পায়ের ছাপ মুছে দিয়ে সে উৎপেতে রইলো। কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পেল শত্রুর দলটাকে। দেখেই চিনতে পারলো মেরি ওদের। এরা এলিজাবেথের সৈন্য। এলিজাবেথও তাহলে তার বিরুদ্ধে গেছে? তবে কি সে সিংহাসনে বসতে চায়? ইংল্যান্ডের রানি হতে চায়?
এলিজাবেথের সৈন্যরা চলে গেল মেরির ঘোড়া যেদিকে ছুটে গেছে ওদিকে। মেরি ভাবলো হয়তো এবারের মতো বেঁচে গেছে সে। যখনই সোজা হয়ে দাঁড়াতে যাবে সে, তখনই অনুভব করলো কে যেন তার পিঠে ছোরা বসিয়েছে জোরে। ‘আহহ’ করে ওঠলো মেরি। পেছনে ঘুরে দেখলো অপরিচিত এক লোক। লোকটার চোখে মুখে ঘৃণা ফুটে ওঠেছে তার প্রতি। লোকটা পিঠ থেকে ছোরাটা বের করে আবারও আঘাত করতে চায়লো মেরির বুকে। মেরি ক্ষিপ্রগতিতে কোষ থেকে তরবারি বের করে লোকটার গলায় চালালো। ছোরাটা পড়ে গেল লোকটার হাত থেকে। গলা কেটে যাওয়ায় ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। গলা চেপে ধরে নিচে পড়ে গেল লোকটা। মেরি হাঁপাতে লাগলো। তার পিঠ থেকেও প্রচুর রক্ত ঝরছে। মেরি লোকটার গা থেকে কাপড় ছিড়ে নিজের ক্ষতস্থানে বাঁধলো। তারপর ভাবলো এই স্থানটাও নিরাপদ নয় তার জন্য। কিন্তু এই ক্ষতস্থান নিয়ে, কোনো বাহন ছাড়া দূরে কোথাও যেতে পারবে না সে। কাছাকাছি একমাত্র নিরাপদ জায়গা হচ্ছে উডচেস্টার হিল দূর্গ। দূর্গটি রাজা অষ্টম হেনরির মৃত্যুর পর থেকেই পরিত্যক্ত। ওদিকে কেউ আর যায় না। এখন সে ঐ দুর্গেই আশ্রয় নেবে। সে জঙ্গলপথ দিয়েই হাঁটতে লাগলো দূর্গের দিকে। ওদিকে এলিজাবেথের সৈন্যরা তাকে না পেয়ে আবার রাজপ্রাসাদে ফিরে যেতে লাগলো।
উডচেস্টার হিল দুর্গের ভেতর ঢুকতেই কেমন যেন একটা গন্ধ নাকে এলো। নাক চেপে ধরে ভেতরে ঢুকলো মেরি। পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু করেছে। দুর্গটি পাহাড়ের উপর হওয়ায়, উঠতে খুব কষ্ট হয়েছে তার। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়লো মেরি। শ্বাস নিতে গিয়ে কেশে ওঠলো কয়েকবার। দুর্গের দরজা খোলা রাখায় ভেতরে আলো এসে পড়েছে। সেই আলোতে দেখলো সামনে কয়েকটা কঙ্কাল পড়ে আছে। এখানে সেনাপতি পিটারের কঙ্কাল কোনটা সে বুঝতে পারলো না।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মেরি দুর্গ থেকে বের হলো। দুর্গের দরজায় তালা ঝুলিয়ে চাবিটা নিজের কাছে রাখলো। ভেতরে আর কিছুক্ষণ থাকলে দম আটকে হয়তো মারা যেতো সে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। ধীরে ধীরে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। আর একটু অন্ধকার হলেই মেরি এখান থেকে চলে যাবে। হঠাৎ মেরির চোখ গেল পাহাড়ের নিচে। বেশ কয়েকজন সৈন্য ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। এরা এলিজাবেথের সৈন্য না। এরা প্রোটেস্টাণ্ট। তবে কি এরা তার অবস্থান জেনে গেছে? ওখান থেকে সরে গেল মেরি। তারপর দুর্গের পেছন দিয়ে নেমে গেল সে। দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো কোনোদিকে না তাকিয়ে। পেছনে তখন ঘোড়ার টগবগ শব্দ শোনা গেল। হয়তো দেখে ফেলেছে ওরা তাকে।
কয়েকদিন পর মেরির লাশ পাওয়া গেল সেন্ট জেমস প্রাসাদে। কারা যেন মেরে ওর লাশটা ঐ প্রাসাদে ফেলে রেখেছে। নৃশংসভাবে মারা হয়েছে ওকে। পুরো চেহারায় তরবারির কাটা দাগ। হাতে-পায়ে এমনভাবে তরবারির আঘাত করা হয়েছে, মাংস খসে খসে পড়ছে। হয়তো পুরো শরীরেই এভাবে তরবারির আঘাত করা হয়েছে। লাশ দেখে ভয় পাওয়ার মতো। হয়তো কোনো একটা দল তাকে এভাবে মেরে নিজেদের ক্রোধ মিটিয়েছে। লাশ দেখে মনে হলো ওরা তাকে অনেক কষ্ট দিয়ে মেরেছে।
সেই পাদরিও এসেছিলেন তার লাশ দেখতে। লাশের আশেপাশে তিনি খুঁজে দেখেছিলেন সেই বইটা। কিন্তু তিনি কোথাও খুঁজে পাননি বইটা। হয়তো তিনি ভুল করেছেন বইটা মেরির হাতে দিয়ে। ডায়ানা আর পিটার হয়তো কখনও আর ফিরে আসতে পারবে না।
মেরির মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেয় এলিজাবেথ। রানি হওয়ার পর সে জনগণের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করে,
-এই রাজ্য আমাদের। আমাদের মাঝে ক্যাথলিক বা প্রোটেস্টাণ্ট কোনো ভেদাভেদ নেই। যার যেটা ইচ্ছে, যে যেটাতে বিশ্বাসী, সে সেটাই অনুসরণ করবে। যদি কখনও ক্যাথলিক আর প্রোটেস্টাণ্টদের মাঝে বিরোধ হয়, যারা বিরোধ সৃষ্টি করবে, সবাইকে শাস্তি দেয়া হবে। এখন থেকে আমরা পরস্পর পরস্পরের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাবো। নিজেরাই শান্তি ফিরিয়ে আনবো আমাদের এই রাজ্যের।’
চারদিক থেকে জনগণের কণ্ঠে প্রশংসার বুলি শোনা গেল রানি এলিজাবেথের। একসাথে সবাই বলে ওঠলো,
-আমাদের রানি দীর্ঘজীবী হোক। জয় হোক রানি এলিজাবেথের।’
ভোরের আলো চারদিক আলোকিত করে তুলেছে। পাখিরা ডাকছে গাছের আড়ালে। তখন ঘুম ভেঙে যায় অালভিনের। বিছানায় উঠে বসে কী যেন ভাবতে থাকে সে। কী স্বপ্ন দেখলো সে এটা? একটা পুরনো দুর্গ, একটা সমাধিস্থল। মাথা থেকে স্বপ্নটা সরাতে পারছে না সে। এই প্রথম স্বপ্নটা দেখলে সে এটাকে স্বপ্ন ভেবেই উড়িয়ে দিতো। কিন্তু সে এর আগেও দুবার দেখেছে একই স্বপ্নটা। কে যেন তাকে ডাকছে সমাধিস্থল থেকে, একটি মেয়ের গলায়। আর পুরাতন দুর্গটির ভেতর থেকে একটা পুরুষের গলায় ডাকছে কে যেন। এই স্বপ্নটা কেন দেখছে সে বারবার?
ভার্সিটিতে প্রবেশ করলো আলভিন। কাঁধে একটা ঝুলানো ব্যাগ। আরও অনেকে তার মতো ভার্সিটিতে ঢুকছে। কেউ কেউ বের হচ্ছে। আলভিন আশেপাশে তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজলো। তখন তার নাম ধরে একটা মেয়ে ডাক দিলো,
-আলভিন… এই আলভিন…’
তাকিয়ে দেখে ওর বান্ধবী লিয়া স্কলাসটিকা ডাকছে ওকে। হাসিমুখে এগিয়ে গেল আলভিন ওর দিকে।
-কী খবর লিয়া? কেমন আছিস?’ জিজ্ঞেস করে আলভিন।
-আমি ভালো আছি। শুন, ইতিহাসের স্যার একটা কাজ দিয়েছে।
-কী কাজ?
-তিনি নাকি একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করবেন।
-কী নিয়ে?
-কয়েকশো বছর আগের রানি এলিজাবেথকে নিয়ে। তিনি আমাদের টিমকে রিসার্চের কাজটি দিয়েছেন।
-ওয়াও! গ্রেট!
-আচ্ছা, তোকে আজ কেমন যেন বিষণ্ন দেখাচ্ছে আলভিন…
-নাহ্, তেমন কিছু না। একটা ব্যাপার আমাকে ভাবাচ্ছে। একটা স্বপ্ন…
-স্বপ্ন?
-হুমম, একটা স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখি। একই স্বপ্ন। একটা সমাধির ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় কে যেন আমায় ডাকছে। আর একটা পরিত্যক্ত দুর্গ থেকে পুরুষের গলায় ডাকছে কে যেন। কী হতে পারে এই স্বপ্নের মানে?
-যেহেতু একই স্বপ্ন কয়েকবার দেখেছিস, নিশ্চয়ই কারণ আছে কোনো। চল এখন, আমাদের টিমের সবাই অপেক্ষা করছে ওখানে।
একটা কক্ষে বসে আলভিনদের টিমের সবাই রানি প্রথম এলিজাবেথকে নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে লাগলো। কেউ কেউ বই পড়ছে, আর কেউ ল্যাপটপের সামনে বসে গুগলে সার্চ করছে। আর আলভিন হাতে মোবাইল নিয়ে টিপছে। হঠাৎ সে প্রশ্ন করলো,
-রানি এলিজাবেথ কতসালে যেন শাসনে এসেছিল?
-১৫৫৮ সালে। এটাও জানিস না? গাধা।’ আলভিনকে খোঁচা দিলো হেনা। সুযোগ পেলেই সে খোঁচা দেয় আলভিনকে। আর সবসময় চোখে চশমা পরে থাকে মেয়েটা।
-তোমরা আসলে জানো কি না, তা যাচাই করতেই প্রশ্নটা করা।’ আলভিন হেনার খোঁচাটা মেনে নিলো না। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে তখন লিয়া বলে ওঠলো,
-গুগলে সার্চ কর আলভিন। জানতে পারবি।
-হুমম…’ অস্ফুটে শব্দ করে গুগলে সার্চ করতে লাগলো আলভিন। কিছুক্ষণ পর সে আবার বলে ওঠলো,
-রানি প্রথম এলিজাবেথের আগে ইংল্যান্ডের শাসনভার ছিল রানি মেরির হাতে।
-রানি মেরি কে জানিস তো?’ জিজ্ঞেস করলো হেনা।
-কে?’ ভ্রু কুঁচকালো আলভিন।
-এটাও জানিস না। ব্লাডি মেরিই হলো রানি মেরি। ইতিহাসের ছাত্র হওয়া তোর আসলে উচিত ছিল না।
-এই শুন শুন, ব্লাডি মেরির কথা যখন ওঠেছে, তার সম্পর্কে একটা কথা বলি…’ মাঝখানে বলে ওঠলো অ্যারিক। টিমের সবচেয়ে মেধাবী বলা হয় অ্যারিককে।
-হ্যাঁ, ব্লাডি মেরি সম্পর্কে কী বলবি বল…’ বাকিরা আগ্রহ দেখালো।
-শুনেছি, অন্ধকার রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর ধ্যানে তার নাম ধরে ডাকলে নাকি আয়নায় ব্লাডি মেরি এসে হাজির হয়।
-সিরিয়াসলি?’ নড়েচড়ে বসলো আলভিন। ইতিহাসের চেয়ে এই হরর টপিকগুলোতে সে বেশি মজা পায়।
-আলভিনকে দেখে মনে হলো, সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকবে ওকে।’ মজা করলো হেনা। সবাই হেসে ওঠলো তখন। কী যেন ভেবে আলভিন বলে ওঠলো,
-ঠিকই ধরেছিস। আমি সত্যি সত্যি ব্যাপারটা করে দেখবো।’ আলভিনের কথা শুনে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো সবাই।
-আলভিন, তুই কি সত্যি পাগল হয়ে গেছিস?
-কেন?’ ভ্রু কুঁচকে তাকালো আলভিন লিয়ার দিকে।
-এই যে এতো রাতে কোথায় যাচ্ছিস?’
-অ্যারিকের বাসায়, ও একা থাকে তাই কাজটা সহজ হবে।
-কোন কাজ?
-ঐ যে ব্লাডি মেরি, আয়নায় ওকে হাজির করতে হবে তো।
-নাহ্, তুই একা যা। আমি বাবা এসবের মধ্যে নেই।’ আলভিনকে না করে দিলেও, লিয়া তাকে একা ছাড়লো না। সঙ্গে সঙ্গে চললো সেও।
-তাইলে সাথে যাচ্ছিস কেন? ফিরে যা তুই…’
-আরেকবার ভেবে দেখ…’ আলভিনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো লিয়া।
-ভাবার কিচ্ছু নেই, চল…’ আবার হাঁটতে লাগলো আলভিন। বাধ্য হয়ে লিয়াও চললো পিছুপিছু।
ওদের দুজনকে হঠাৎ বাসায় দেখে কিছুটা অবাক হলো অ্যারিক।
-তোরা হঠাৎ আমার বাসায়?’
-এই যে দেখ, মোমবাতি নিয়ে এসেছি।’ অ্যারিককে মোমবাতি দেখালো আলভিন।
-মোমবাতি কেন?’ আরও বেশি অবাক হলো অ্যারিক। তখন লিয়া বলে ওঠলো,
-ঐ যে, তুই ওর মাথায় ব্লাডি মেরির পোকাটা ঢুকিয়েছিস, পোকাটা যাচ্ছে না। ও আয়নায় ব্লাডি মেরিকে ডাকতে এসেছে।
-তা আমার বাসায় কেন ডাকতে হবে? তোদের বাসায় আয়না নেই?
-আছে। কিন্তু প্রাইভেসি নেই। ব্যাপারটা আমাদের মধ্যেই রাখতে চাই।’ বললো আলভিন।
-ঠিক আছে চল ঐ রুমে।’
অ্যারিকের পিছুপিছু গেল ওরা অন্য রুমে। ওখানে বড় একটা আয়না আছে। আয়নাটির সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন পর্যবেক্ষণ করলো আলভিন। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
-এই আয়নাতে আসবে তো?
-কেন? এটাকে কি তোর আয়না মনে হয় না?’ পাল্টা প্রশ্ন করলো অ্যারিক।
-না, তা না। আচ্ছা আমি ডাকলে সত্যি সত্যি আসবে তো ব্লাডি মেরি?
-চেষ্টা করে দেখতেই পারিস।
-ঠিক আছে, রাত আরও বাড়ুক। তুই এই ফাঁকে কফির ব্যবস্থা কর আমাদের জন্য।
-আচ্ছা, বস তোরা এখানে।’ বলেই বেরিয়ে গেল অ্যারিক।
রাত গভীর হলে, আলভিন রুমের আলো নিভিয়ে পুরো রুমটা অন্ধকার করলো। তারপর মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখলো আয়নার সামনে। তাতেই কেমন যেন এক ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হলো। অ্যারিক বললো,
-আলভিন, তুই তাহলে চেষ্টা কর। আমরা দুজন পাশের রুমে আছি। এতজন থাকলে হয়তো ব্লাডি মেরি নাও আসতে পারে।
-ঠিক আছে।’ মাথা নাড়লো আলভিন।
-বেস্ট অব লাক।’ আলভিনের কাঁধ আলতো করে চাপড়ালো লিয়া। তারপর ওকে রুমে একা রেখে ওরা দুজন বেরিয়ে গেল। দরজাটা হালকা ভেজিয়ে দিলো, যদি আলভিনের কোনো বিপদ হয়, সাথে সাথে যেন ওরা ঢুকতে পারে।
ওরা বেরিয়ে যেতেই আলভিন পুরো রুমে কয়েকবার পায়চারি করলো। তারপর আয়নার দিকে মুখ করে বসলো। নিজের এবং মোমবাতির প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠলো আয়নায়। তারপর ধ্যানে বসলো সে চোখ বন্ধ করে। আর আলতো কণ্ঠে উচ্চারণ করতে লাগলো,
-ব্লাডি মেরি, আমি তোমায় দেখতে চাই, আমাকে দেখা দাও।’
এভাবে তিনবার উচ্চারণ করলো সে। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুললো। দেখলো, আয়নায় কেবল সে আর মোমবাতি ছাড়া আর কিছুই নাই। পুনরায় চেষ্টা করার জন্য সে আবার চোখ বুজলো। একইভাবে আবার ব্লাডি মেরির নাম ধরে ডাকলো তিনবার। কিন্তু ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখে আবারও একই পরিস্থিতি। ব্লাডি মেরি নেই। দ্বিতীয়বার হতাশ হলো আলভিন। তবে কি ব্যাপারটা মিথ্যা? ব্লাডি মেরি কি আসে না এভাবে ডাকলে? শেষবারের মতো আবার চেষ্টা করলো আলভিন। এবার সে প্রচণ্ড বিশ্বাস নিয়ে ডাকবে। মন থেকে সবকিছু মুছে ফেলে সে শুধু ব্লাডি মেরির কথা ভাবতে লাগলো। গুগলে সে ব্লাডি মেরির ইতিহাস পড়েছে। পুরো ইতিহাসটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাবতে লাগলো। কীভাবে সে বেড়ে ওঠেছিল, কীভাবে সিংহাসন লাভ করেছিল, কীভাবে সে ব্লাডি মেরি হয়েছিল। সব ভাবার পর সে ধীরে ধীরে ডাকলো,
-ব্লাডি মেরি, এসো, হাজির হও আমার সামনে…’
তিনবার ডাকলো আলভিন এভাবে। চোখ খুললো আরও পরে। সরাসরি তাকালো আয়নার দিকে। নাহ্, এবারও আসেনি। হয়তো পুরো ব্যাপারটাই ভূয়া। অথবা অ্যারিক তাকে বোকা বানিয়েছে। মোমবাতিটা হাতে নিয়ে আলভিন উঠে দাঁড়ালো। লাইট অন করে দরজা খুললো। ভেতরে ঢুকলো অ্যারিক এবং লিয়া।
-কী রে, আসেনি ব্লাডি মেরি?’ প্রশ্ন করলো অ্যারিক।
-ধুর, তুই আসলে বোকা বানিয়েছিস আমাকে।’
আলভিনের কথা শুনে ‘হিহিহি’ করে হেসে ওঠলো লিয়া। হাসতে হাসতে বললো,
-আমি আগেই বুঝেছিলাম, আসবে না ব্লাডি মেরি।
-কিন্তু আমার কী দোষ বল, আমি যা শুনেছি, তাই বললাম। অনেকেই নাকি দেখেছে ব্লাডি মেরিকে।’ বললো অ্যারিক।
-আচ্ছা, যা হবার হয়েছে। রাত অনেক হয়েছে। রাতটা এখানেই কাটাতে হবে আজ। ঘুমাবো চল। বৃথা সময় নষ্ট হলো।’ আফসোস করলো আলভিন।
ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসে আছে লিয়া, হেনা, অ্যারিক এবং তাদের টিমের অন্য সদস্যরা। আলভিন সেখানে অনুপস্থিত। সবাই প্রথম এলিজাবেথকে নিয়ে কথা বলছে। তাঁকে নিয়ে ডকুমেন্টারি ফাইলটা প্রায় রেডি। এবার স্যারের কাছে জমা দেয়ার পালা। ফাইলটা সামনে নিয়ে অ্যারিক বলে ওঠলো,
-আমাদের এই ভূখণ্ড রানি প্রথম এলিজাবেথ প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর শাসন করেছেন। সব ধর্মের লোক শান্তিতে থেকেছে তাঁর সময়ে। সেই সোনালি যুগে যদি আমারও জন্ম হতো, একটু ছুঁয়ে দেখতাম রানিকে।
-রানি তোকে ছুঁতে দিতো?’ খোঁচা মারলো হেনা। তখন সবাই হেসে ওঠলো। কিন্তু লিয়াকে দেখা গেল অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছে।
-কী রে লিয়া, কী ভাবছিস?’ প্রশ্ন করলো অ্যারিক।
-কিছু না… আচ্ছা, তোরা কেউ আলভিনের খবর জানিস? ও গত দু’দিন ক্যাম্পাসে এলো না। আর ফোনও বন্ধ।
-তাই তো। আমরা কেমন বন্ধু ওর? একবার খোঁজও নিলাম না।’ বলে ওঠলো হেনা।
-চল, ফাইলটা স্যারের কাছে জমা দিয়ে, ওর বাসায় যায়।’ বলেই উঠে দাঁড়ালো অ্যারিক। বাকিরাও উঠে দাঁড়ালো।
অ্যারিক, হেনা, লিয়া তিনজনেই এসেছে আলভিনের বাসায়। তিনজনই ওরা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরা সোজা তার রুমে চলে এলো। আলভিন রুমেই ছিল। একটা চাদর জড়িয়ে আছে সে। ওদেরকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
-তোরা!
-হ্যাঁ, তোর কোনো খোঁজ নেই দুদিন ধরে। ফোনও অফ। কী হয়েছে বল তো?’ আলভিনের পাশে বসতে বসতে প্রশ্ন করে অ্যারিক।
-আচ্ছা সব বলবো। তোরা এসেছিস, ভালোই হয়েছে। তোদের সাথে শেয়ার করা দরকার বিষয়টা।
-কোনো খারাপ কিছু?’ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে লিয়া।
-আগে শুন পুরো বিষয়টা। তারপর তোরাই ডিসাইড করিস ভালো না খারাপ?
-হুমম… বল…’ তিনজনই নড়েচড়ে বসলো। আলভিন বলতে শুরু করলো,
-ঐদিন ব্লাডি মেরিকে হাজির করতে পারিনি। কিন্তু ওর ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছিল না। পরদিন রাতে আমি আবার চেষ্টা করি আমার বাসায়। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি লাইট অফ করে মোমবাতি জ্বালায় আয়নার সামনে। গভীর বিশ্বাস নিয়ে তাকে তিনবার নাম ধরে ডাকি। প্রথমবার ব্যর্থ হই আমি। কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করি।
-আবারও ব্যর্থ হয়েছিস?’ প্রশ্ন করলো হেনা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আলভিন বলে ওঠলো,
-না, এইবার আয়নায় আমি ব্লাডি মেরিকে দেখতে পাই।
-হোয়াট!’ চমকে ওঠলো তিনজন।
-হুমম, পরেরবার তাকে গালি দিয়ে ডেকেছিলাম। সেবারও ভেবেছিলাম ব্লাডি মেরি আসেনি। কিন্তু যখন মোমবাতি হাতে নিয়ে উঠতে যাবো, হঠাৎ আমার চোখ আটকে যায় আয়নায়। আয়নাতে আমি দেখি, রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে কে যেন। সাথে সাথে ঘাড় ঘুরাই আমি। নাহ্, কেউ নেই রুমে। আবারও আয়নায় তাকাই। এবার ভয়ে আঁতকে ওঠি আমি। আয়নায় ভয়ংকর একটা চেহারা, হাত বাড়ালেই যেন ছুঁতে পারবো। এতো ভয়ংকর যে আমি দেখেই কাঁপতে থাকি। আমি দ্রুত মোমবাতি নেভানোর জন্য ফুঁ দিলাম, দেখি মোমবাতি সামনে নেই। কিন্তু আয়নাতে মোমবাতিটা ঠিকই দেখা যাচ্ছিল। লাইট জ্বালানোর জন্য উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু পা নড়লো না আমার। আমার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সে। দাঁতে দাঁত পিষছিল, যেন তখনই চিবিয়ে খাবে। আমি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না ভয়ে। তাই চোখ বন্ধ করে ফেললাম। হঠাৎ অনুভব করি, সে আমাকে জোরে ধাক্কা দিয়েছে। আমি দেয়ালের সাথে আঘাত খেয়ে আবার তার সামনে এসে পড়ি। সে আমার শরীরে নখ দিয়ে আঁচড় কাটতে লাগলো। এই দেখ, আঁচড়ের দাগ।’ বলেই গা থেকে চাদর সরালো আলভিন। ওরা দেখলো সত্যি সত্যি আলভিনের শরীরে আঁচড়ের দাগ। একদম ক্ষত হয়ে আছে।
-ওহ মাই গড!’ তিনজনই গালে হাত দিয়ে চমকে ওঠলো।
-তারপর, তোকে আর কিছু করেনি?’ প্রশ্ন করে লিয়া।
আলভিন আবার বলতে শুরু করে,
-আমি ব্লাডি মেরির কাছে বাঁচার জন্য আকুতি করি। তখন সে আমাকে বলে, ‘তুই বাঁচতে পারবি, তবে আমার সাথে একটা খেলা খেলতে হবে। সেই খেলাতে জিততে পারলে তুই বাঁচবি।’ আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কী খেলা?’ সে তখন বলে, ‘তোকে একটা পুরাতন দুর্গে যেতে হবে। সেই দুর্গে গেলে একটা বই পাবি। সেই বইটা তোকে পড়ে শেষ করতে হবে। যদি তুই পারিস, তবেই তুই বাঁচবি।’ প্রাণের ভয়ে তখন আমি রাজি হয়। তখন আয়না থেকে চলে যায় ব্লাডি মেরি।
-যাক বাঁচা গেল তাহলে।’ হাফ ছেড়ে যেন বাঁচলো লিয়া।
-না রে, বাঁচিনি…’
-মানে?’ আবারও একসাথে তিনজন চমকে ওঠলো।
-আমিও তাই ভেবেছিলাম, বেঁচে গেছি। কিন্তু যখন ঘুমাতে গেলাম, তাকে আমি স্বপ্নে দেখি। সেই ভয়ংকর চেহারা নিয়ে সে আমার স্বপ্নে আসে, আর আমাকে হুমকি দিয়ে বলে, ‘ভাবিস না তুই বেঁচে গেছিস। যদি আমার সাথে খেলাতে হেরে যাস, তবে তোকে আমি মেরে ফেলবো।’ স্বপ্নটা দেখেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি কাঁপতে থাকি। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে আমার শরীরে। তাই ক্যাম্পাসে পরদিন যাইনি। গতরাতেও যখন ঘুমাই, আমি আবারও ব্লাডি মেরিকে নিয়ে একই স্বপ্ন দেখি। একইভাবে সে আমাকে হুমকি দিয়েছে। এখন আমি বুঝতে পেরেছি, আমি যদি এই খেলাতে জিততে না পারি, ও সত্যি সত্যি আমাকে মেরে ফেলবে।
-মারবে না তোকে। তুই জিতবি, অবশ্যই জিতবি। আমরা একসাথে যাবো ঐ দুর্গে।’ আলভিনকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলো লিয়া। বাকিরাও তার কথায় সম্মতি দিলো।
[[চলবে….]]