#প্রেমের_জোয়ার_ভাটা
#পর্ব_০১
#অধির_রায়
“ডিভোর্সের এতো বছর পর মেয়ের কথা মনে পড়ল৷ মেয়ে মারা গেছে কিনা দেখতে এসেছেন? সৃষ্টিকর্তা আমাদের মা মেয়েকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন৷”
মীরা ছলছল নয়নে আরুশের দিকে তাকিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল৷ এক সাগর অভিমান বাসা বেঁধেছে মীরার মনে৷ সবার ভাগ্যে স্বামীর ভালোবাসা টিকে না৷ ভালোবাসায় এক সময় তিক্ততা চলে আসে৷ আরুশ অপরাধী কন্ঠে বলল,
“আমি আমার মেয়ের সাথে এক বার দেখা করতে চাই৷ তুমি মানা করলেও আমি বাবার অধিকারে মেয়ের সাথে দেখা করতে চাই৷”
মীরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“বেশ ভালো লাগল আরুশের কথা শুনে৷ বাবার অধিকার ফুটে উঠেছে আপনার মনে৷ মনে ছিলনা সেদিন মেয়ের কথা৷ বাবা বলে চিৎকার করে বলেছিল “আমি তোমাকে ছাড়া কোথায় যাব না!” তখন আপনার মনে বাবার অধিকার সুপ্ত অবস্থায় ছিল৷ সেদিন কথা বলেননি কেন বাবার অধিকারে?”
মীরা হাজারটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে৷ আরুশের চোখে মুখে অন্ধকারের ছাপ ঘনিয়ে এসেছে৷ নেত্রদ্বয় ভীষণ ভয়ে ভরপুর৷ হারানোর ব্যথা নিজেকে ঘিরে রেখেছে৷ আর হারানোর শক্তি নেই৷ আরুশ বিনয়ী স্বরে বলল,
“প্লিজ মীরা। আমার মেয়ের সাথে একবার দেখা করার সুযোগ দাও৷ দুই নয়ন ভরে একটি বার দেখতে চাই৷ অবাধ্য নয়ন জোড়া খুঁজে চলছে আমার মেয়েকে৷”
মীরা নিজেকে অনেক কষ্টে সামলিয়ে রেখেছে৷ ভালোবাসার মানুষের কষ্ট স্ব চোখে দেখতে পারছে না৷ হৃদয়টা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে৷ বাধ্য হয়ে আরুশের মুখের উপর কপাট লাগিয়ে দিল। আরুশ নাড়া নেড়ে যাচ্ছে। আরুশের আকুল আবেদন মীরার কর্ণধারে যাচ্ছে না অভিমানী পাল্লার জন্য৷ অভিমানী পাল্লায় সেই অনেক বছর আগে থেকে৷ ছিলনা তো তাদের জীবন এমন বেদনাদায়ক। ভালোবাসায় পূর্ণ ছিল আরুশ মীরার জীবন৷
_______
আকাশে সাদা মেঘেরা খেলা করছে৷ ধরনীর বুকে বইয়ে শীতল হাওয়া৷ হওয়ার সাথে খেলা করছে কৃষকের ধানক্ষেত। শুষ্ক ধরনী ফিরে পাচ্ছে নতুন প্রাণ৷ নদীর জল নেমে গেছে তলানীতে৷ বিনা চাষে চাষ হচ্ছে গম। শীতল হাওয়ায় দোল খাচ্ছে গমের চারা। কবিদের কন্ঠে ধ্বনিত্ব হচ্ছে বাহারী রকমের ছন্দ৷ পাখিরা গান গেয়ে চড়ে বেড়ায় নীল আকাশের নিচে৷ মিরা মন মাতানো ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শহর থেকে আসা ভাইয়ের বন্ধু আরুশ৷ আরুশের মুগ্ধ চাহনীতে মীরার ছন্দপতন ঘটে৷ আরুশ অপ্রস্তুতভাবে বলে ফেলল,
“স্বর্গের অপ্সরী নেমে এসেছে ধরনীর বুকে৷ মুগ্ধতা বিরাজ করছে তোমার নয়নে৷ অবাধ্য মন তোমায় ছুঁতে চাই৷”
আনমনে বলা বাক্যগুলো মীরার কর্ণধারে পৌঁছে যায়৷ মীরা আরুশের দিকে পলক ঘুরিয়ে বলল,
“ভাইয়া আপনি এসব কি বলছেন? আপনার মনে এমন ভাবনা আসে কিভাবে? আমি আপনার ছোট বোনের মতোই৷”
আরুশ পরিস্থিতি সামলিয়ে বলল,
“তুমি ভুল ভাবছো মীরা। আমি তোমাকে নিয়ে এমন কিছু ভাবতে পারিনা৷ অপরুপ সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে৷ আমি শহরে বড় হয়েছি৷ গ্রাম বিষয়ে তেমন ধারনা নেই৷ এতো সুন্দর গ্রাম হতে পারে জানতাম না৷ গ্রামের শীতল হাওয়ায় মন ভরে শ্বাস নেওয়া৷ মুগ্ধ নয়নে প্রকৃতি দেখা৷ সবুজ রঙের সোনালী ফলস ছুঁয়ে দেওয়া বহুদিনের স্বপ্ন ছিল৷ সেগুলো কথা বললাম৷”
মীরা মুচকি হেঁসে বলল,
“সরি আরুশ ভাইয়া৷ আমি আপনার কথা বুঝতে পারিনি৷”
আরুশ ডাগর চোখে মীরাকে এক পলক দেখে বলল,
“ভুল করলে শাস্তি পেতে হয়৷ তবে তোমাকে শাস্তি এখন দেওয়া যাবে না৷ তবে তোমার শাস্তি হিসেবে…”
কোন কথা না বলে গুরুগম্ভীর ভাব নিল৷ মীরা ভয়ে কিছু বলতে পারছে না৷ আরুশ ইহান ভাইয়াকে কিছু বলে দিবে না তো৷ মীরা শুকনো গলায় ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল,
“আপনি কি ইহান ভাইয়াকে কিছু বলে দিবেন৷ প্লিজ ভাইয়াকে কিছু বলবেন না৷”
আরুশ গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,
“শাস্তি হিসেবে তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম৷ সুন্দরী মেয়েরা ভীতু হয় তোমাকে দেখে বিশ্বাস হলো৷ সত্যিই সুন্দরী মেয়েরা ভীতু হয়৷”
মীরা ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আমি মোটেও ভীতু নয়৷ ভীতু হলে আপনার মতো ছেলে নিয়ে নদীর পাড়ে আসতাম না৷ গ্রামের লোক এসব ভালো নজরে দেখে না৷ আমার বাবা শিক্ষক হওয়ায় এসব কুসংস্কার তেমন মানেন না৷ তাই আপনাকে এখানে নিয়ে আসছি৷ গ্রামের সবাই জানে আমি কেমন মেয়ে৷ আমি একটু দুষ্টু প্রকৃতির৷ আমাকে কেউ কিছু বললে আমি তাকে মুখের উপর জবাব দেয়৷”
মীরার কথা শুনে আরুশ হেঁসে বলল,
“হুম তা দেখতেই পাচ্ছি৷ মীরা কতোটা সাহসী। একাই গ্রামের মেঠো পথ ধরে হেঁটে বেড়ায়৷”
মীরা রাগী কন্ঠে বলল,
“মোটেও আমাকে নিয়ে হাসবেন না৷ আমাকে নিয়ে হাসলে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিব৷ ভীষণা গর্ত নদী৷ তলানী খুঁজে পাবেন না৷ সোজা স্বর্গে চলে যাবেন৷”
আরুশ বিরবির করে বলল,
“তোমার হাতে হাত রেখে স্বর্গে যেতে চাই প্রিয়। আমার কি সেই সুযোগ আসবে? বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না তো বন্ধুর বোন বলে৷ আমি সকল বাঁধা পার হতে পারব তো৷”
আপনমনে ভাবনার অনুভূতিগুলো বুকে তীক্ষ্ণ ব্যথার নাড়া দিল৷ পাওয়ার আগেই হারানোর তীব্র ব্যথা অনুভব করছে৷ মীরা ওড়নার কিছু অংশ হাতে নিয়ে খেলা করতে করতে বলল,
“বাড়িতে চলেন৷ ভাইয়া ঘুম থেকে উঠলে আপনাকে নিয়ে আসবেন৷ বাড়িতে অনেক কাজ আছে৷”
আরুশের যেতে ইচ্ছা করছে না৷ মীরার সাথে আরও কিছু সময় পার করতে ইচ্ছা করছে৷ কাউকে এতো ভালো লেগে যাবে কখনও আরুশ ভাবেনি৷ আরুশের মনে প্রেম ভালোবাসা সবই লোক হাসানো ছিল৷ গ্রেজুয়েট কমপ্লিট করেও প্রেমের সন্ধান পেল না৷ শেষে কিনা বন্ধুর বোনের প্রেমে পড়ল আরুশ৷
_____
পড়ন্ত সূর্যের সোনালী আভা ফুটে উঠতেই নৌকার পাঠা তুলে বৈঠা বাইতে শুরু করল ইহান৷ স্রোতের বিপরীতে চলছে নৌকা৷ খোলা আকাশের নিচে প্রাণ খুলে শ্বাস নিচ্ছে আরুশ৷ ইহান নৌকার গতি কমিয়ে বলল,
“আমাদের গ্রাম কেমন দেখলি? তোদের শহরের আবহাওয়ার থেকে আমাদের গ্রামের আবহাওয়া অনেক ভালো৷ নেই কোন কোলাহল। আছে শুধু নিরব নিস্তব্ধ ভালোবাসা।
আরুশ নৌকা শক্ত করে ধরে বলল,
“তোদের গ্রাম অনেক সুন্দর। এখানে থেকে যেতে ইচ্ছা করছে৷ কেন আরও আগে আসা হলো না৷”
“শা”লা তুই তো বিশ্বাসই করিস না৷ তোকে কতোবার জোর করছি আসার জন্য। তুই আমার কথা একবারও রাখিসনি৷ এবার তোকে জোর করে ধরে বেঁধে না আনলে বুঝতি না৷ ঢাকা থেকে এসব ভুলেই গেছিস৷”
আরুশ আফসোসের সাথে বলল,
“আমি গ্রামের সৌন্দর্য আগে জানলে আরও আগে আসতাম৷ তুই কেন আরও আগে জোর করলি না? এটা তোর দোষ৷”
ইহান অট্টহাসি দিয়ে বলল,
“আমি তোকে জোর করিনি! শা”লা দেবদাস। তুই বুঝবি কি সৌন্দর্যের? প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝেই ভালোবাসা নিহিত৷ সকল কবিই প্রকৃতির প্রেমে মুগ্ধ। কবিগণ বসে থাকে বসন্তের জন্য৷ ধরণী তখন শুষ্কতা কাটিয়ে উঠে৷ গাছে ফিরে পায় নতুন প্রাণ৷ কচি পাতার অাবির্ভার হয়৷”
আরুশ মুগ্ধ কন্ঠে বলল,
“আমিও কবিতার ছন্দ খুঁজে পেয়েছি৷ পেয়েছি ভালোবাসার মানুষ৷ স্বপ্ন বুনেছি তাকে নিয়ে৷ ঘর বাঁধব তার সনে৷ তার ডগর চোখের মুগ্ধ চাহনি আমায় পা’গ’ল করেছে৷”
ইহান নৌকা থামিয়ে বলল,
“তুই তো দেখি প্রেমের কবি হয়ে গেলি৷ মনে প্রেম জাগছে নাকি৷”
আরুশ মুচকি হেঁসে বলল,
“এসবের জন্য প্রেম করতে হয়না৷ তুই বললি না আমি প্রকৃতিকে ভালোবাসিনা৷ আমিও খুব ভালোবাসি৷ এখন নিজেকে স্বাধীন রাজ্যের রাজা মনে হচ্ছে৷ আর তুই হলি আমার প্রজা৷ প্রজা মহারানী ছাড়া রাজ্য চলে না৷ মহারাজের জন্য মাহারানীর ব্যবস্থা করেন।”
ইহান রসিকতার সাথে বলল,
“আজ্ঞে হুজুর৷ আপনার জন্য খুব তাড়াতাড়ি মহারানীর খুঁজ করছি৷ সকল রাজ্যের রাজকুমারী আপনার রাজ্যে আমন্ত্রিত। আমি সকল রাজ্যে খরব পাঠিয়ে দিয়েছি৷”
দুই বন্ধু অট্টহাসিতে মেতে উঠল৷ আরও অনেক কথা রয়ে গেল তাদের মাঝে৷ স্রোতের দিকে নৌকা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে পড়ে দুই বন্ধু৷ নৌকা চলছে স্রোতের গতিতে৷ কথা হচ্ছে না বলা অনেক কথা৷ কে আছে কে নেই। দেখার তো সময় নেই৷ আমরা সবাই ফ্যামিলি৷ বন্ধু৷ আমরা সবাই ফ্যামিল, বন্ধু৷
_______
জ্যোংসার আলো গায়ে মাখতে ব্যস্ত তিন জোড়া আঁখি। মাটিতে মাদুর বিছিয়ে গল্প মশু গোলে মেতে উঠেছে তিনজন৷ অনেক না বলা কথা শেয়ার করা হচ্ছে৷ আরুশের চোখ দু’টো বার বার তার মায়াবী মীরাকে দেখতে ব্যস্ত৷ অবাধ্য নয়ন বাঁধা মানে না৷ দু’জনের মাঝখান থেকে আরুশ মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মীরা তুমি কোন ক্লাসে এবার? লেখাপড়া কেমন চলছে?”
কথা বলার জন্য মন আনচান করছিল৷ কি বলে শুরু করবে বুঝতে পারছিল না? লেখাপড়া নিয়ে কথা বলা শ্রেষ্ঠ উপাদান। মীরা জবাব দেওয়ার আগেই ইহান বলল,
“মীরা তো আমাদের ভার্সিটিতেই ভর্তি হলো এবার৷ আগামীমাস থেকে তার ক্লাস শুরু৷”
আরুশ মেঘ না চাইতেই জলের সন্ধান পেল৷ খুশিতে উত্তেজনায় মেতে উঠেছে। উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল….।
চলবে।