#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখকঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ ২৯
‘তারপর কী হলো শিহাব?’
‘তারপর আর কী? আমি মোটামুটি একটু সুস্থ হতেই আমাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর নিয়ে আসে। আমার সুস্থতায় সবাই খুশি থাকলেও আমি মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। হতাশায় পুরোপুরি ডুবে যাচ্ছিলাম। মনের মধ্যে অনেক বড় একটা অপরাধবোধ নিয়ে জীবন কাটাতে লাগলাম। সবসময় মনে হতো আমার কারণেই মুক্তি মারা গেছে। আমি শুধু মুক্তিকে মারিনি ওর পেটে থাকা নিষ্পাপ বাচ্চাটটাকেও হত্যা করেছি। দোষ মুক্তি করলেও, বাচ্চাটার তো কোনো দোষ ছিলো না! বাচ্চাটার মৃত্যু-ই যেন আমাকে বেশি অপরাধবোধে ভোগায়।
মুক্তির মৃত্যুর পর থেকে আমি মোটেও শান্তি পেতাম না। সবসময় অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতাম। ঐ যে কথায় বলেনা, শরীরের ঘা সবাই দেখে কিন্তু মনের ঘা কেউ দেখে না। শরীরের ক্ষত তো চিকিৎসায় সেরে যায় কিন্তু মনের ক্ষতর জন্য কোনো চিকিৎসা নেই। শুধু নিজ মনেই যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। কিছু কষ্টের কথা কাউকে বলাও যায় না, নিজে সহ্যও করা যায় না। শুধু ভিতরে ভিতরে গুমরে মরতে হয়। এভাবেই হতাশায় জীবন কাটতে লাগল আমার। বারবার শুধু বাচ্চাটার মৃত্যুর কথাই মাথায় আসত।’
শিহাব চোখের কোণ মুছল। রেনু শিহাবকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘নিজেকে শান্ত করুন শিহাব।’
কিছুক্ষণ একে-অপরকে জড়িয়ে থাকার পর রেনু বলল,
‘আপনার ধারণা ভুল শিহাব। সব শুনে আমার ধারণাটা বলবো?’
‘হুঁ বলো। তোমার সিদ্ধান্ত জানার জন্যই তো এতসব বলা।’
‘শিহাব, আপনি অন্যায় করেছেন। গোপনে বিয়ে করেছেন, ডিভোর্স দিয়েছেন। সবকিছু আমাদের না জানিয়ে সত্যি খুব বড় অন্যায় করেছেন। তবে আপনি যে কারণে, মনে মনে এত কষ্ট পাচ্ছেন সেটা একদম নিরর্থক। মুক্তির মৃত্যুর জন্য আপনি মোটেও দায়ী নন। মুক্তির নিজের দোষে নিজের জীবন দিয়েছে।’
‘সেটা হয়তো সত্যি। কিন্তু ও বোধ হয় অনেক অসহায় হয়েই আমার কাছে এসেছিলো। হয়তো যাবার মতো আর কেউ ছিলো না। অনেক বেশি অসহায় না হলে, কেউ তার এক্স স্বামীর কাছে যায়? আমার কি সেদিন ওকে সাহায্য করা উচিত ছিলো?’
রেনু বেশ রাগ করে বলল,
‘মেজাজ খারাপ করার মতো কথা বলবেন না তো। নিজের এক্সের জন্য দরদ দেখছি উতলে পড়ছে।’
‘ইয়ে মানে।’
রেনু ধমক দিয়ে বলল,
‘চুপ। আগে আমাকে কথা শেষ করতে দিন। কথার মাঝে কথা বলবেন না।’
রেনুর ধমক খেয়ে শিহাব চুপ হয়ে গেল। রেনু বলল,
‘মুক্তি মোটেও অসহায় হয়ে কিংবা বাচ্চাটাকে বাঁচাতে আপনার কাছে আসেনি। সে এসেছিলো নিজেকে বাঁচাতে, নিজ স্বার্থ রক্ষা করতে। সে যদি বাচ্চাটাকে ভালোবাসতো, তাকে বাঁচাতে চাইতো, তবে সে বাচ্চা কনসিভ করার কথা জেনে বাচ্চা এবরশন করাতে যেতো না। মানলাম রুমেল বলছে এবরশন করাতে, আর সে নাচতে নাচতে গেল এবরশর করাতে? তার নিজের বিবেক বিবেচনা নেই? সে যথেষ্ট ম্যাচিওর এবং শিক্ষিত মেয়ে ছিলো। সে সব কিছু ভেবে করত। তাহলে বাচ্চার বিষয়ে কেন ভাবল না?
সে বাচ্চাটাকে ভালোবেসে রাখতে চায়নি। বরং সে বাচ্চা এবরশন করাতে গেছিলো। আর তার প্রধান কারণ এই ছিলো, যেন তার জীবনে কোনো ঝামেলা না থাকে। তার উপরে উঠার সিড়িতে যেনো বাচ্চা নামক বাঁধা না আসে। কিন্তু পেটের মধ্যে বাচ্চাটা বড় হয়ে যাওয়ায়, সময় বেশি হয়ে যাওয়ায় সে সেটা পারেনি। তার উপর ডাক্তাররা বলে দিয়েছিলো, বাচ্চা এবরশন করালে তার জীবনহানি হতে পারে। বেশি ভয়টা সে এখানেই পেয়েছে।
স্বার্থপর মানুষ মরতে ভয় পায়। তারা মৃত্যুর নাম শুনলেও আঁতকে উঠে। যদি তার মৃত্যু ভয় না হতো, তবে বাচ্চাটাকে মেরে নিজের মতো আবার আনন্দে জীবনযাপন করতো। তাতে রুমেল সাহেব তার সাথে থাকতো বা না থাকতো। এ ধরনের মেয়েদের জন্য হাজারটা রুমেল জুটে যায়। কিন্তু যখন দেখল, তার নিজের প্রাণহানি হতে পারে, তখন সে ভয় পেয়ে গেল। তারপর যখন রুমেল সাহেব ছেড়ে দিলো, তখন সে আরও ভয় পেয়ে গেল।
সে ভাবল বাচ্চা নিয়ে তো, সে একা ভালো থাকতে পারবে না। বাচ্চার জন্য আর তাকে সাপোর্ট করার জন্য একজন খুব প্রয়োজন। সে তখন আপনাকে বেছে নিলো। কারণ সে জানতো আপনি তাকে অসম্ভব ভালোবাসেন। সে যখন আপনাকে ছাড়তে চেয়েছিলো তখন তার পা পর্যন্ত ধরেছিলেন। এসব অনেক কারণে সে ভেবেছিলো আপনি তার জন্য পাগল। সে বুঝেছিলো আপনার কাছে নিজের কষ্টের কথা শোনালে, কতক্ষণ কান্নাকাটি করলে আপনি তার কথা মেনে নিবেন তাকে গ্রহণ করবেন কিন্তু আপনি তার ভাবনার বাইরের সিদ্ধান্ত নিলেন। সে তখন অকূল পাথারে পড়ে গেল। সে মূলত আপনাকে ভয় দেখাতেই সুইসাইডের নাটক করতে চেয়েছিলো। কিন্তু বলে না আল্লাহরও একটা বিচার আছে। তিনি তখন সঠিক বিচার করছেন।
হ্যাঁ বাচ্চাটার মৃত্যুতে খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি, একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। কারণ কঠিন দুনিয়াতে আসার আগেই বাচ্চাটা নিরাপদে আবার আল্লাহর কাছে চলে গেছে। কিন্তু দুনিয়াতে আসলে তার স্থান হয় ডাস্টবিনে, নয়তো কোনো পরিত্যাক্ত স্থানে, নয়তো কোনো অনাথাশ্রমে হতো। বড় হতো নাম পরিচয়হীন। আর মুক্তির কাছে থাকলেও, মুক্তি কী পরিচয় দিতো সমাজের কাছে? কি পরিচয় দিতো বাচ্চাটার বাবার? বাচ্চাটা সমাজের সবার তিক্ত কথায় তিলে তিলে মরে যেতো। বড় হতো সবার চক্ষুশূল হয়ে। তারচেয়ে সৃষ্টিকর্তা বরং তার জিনিস তার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন।
আপনি মুক্তির মৃত্যু নিয়ে এত আত্মগ্লানিতে কেন ভুগছেন? সে আপনার সাথে অন্যায় করেছিলো আপনি তার সাথে নন। পরে আবার নিজে বিপদে পড়ে, নিজ স্বার্থ উদ্ধার করতে আপনাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো কিন্তু আপনি সেদিন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আপনি যদি সেদিন তার কথা শুনে তাকে মেনে নিতেন, তবে পরবর্তীতে সে আবার আপনাকে ধোকা দিতো, এতে কোনো ভুল নেই। যে মেয়েদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেশি তারা জীবনে কোনো কিছুতে তৃপ্ত হয় না। যত বেশি পায়, তাদের তত চাই। মুক্তি এবং মুক্তির বাচ্চার মৃত্যুর জন্য মুক্তি নিজে দায়ী, আপনি মোটেও দায়ী নন। সে জন্য নিজের মন থেকে ঐ পাথরটা সরিয়ে ফেলুন। নিজেকে হালকা করুন।’
শিহাব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রেনু আবার বলল,
‘হ্যাঁ আপনি একটা অন্যায় করেছেন সেটা হলো আমাকে আপনার অতীত না জানিয়ে। যাক সে সব আলোচনা পরে হবে। এখন বলুন আপনি তারপর স্বাভাবিক কী কিরে হলেন? আর মামার সাথে পরিচয় কীভাবে হলো? আর আমাকে-ই-বা কীভাবে ভালোবাসলেন?’
শিহাব বলল,
‘মুক্তির মৃত্যুর কিছু মাস পর ফরিদপুরেই বেশ ভালো পদে চাকরি পেলাম। চাকরিসূত্রে তোমার ছোটো মামা জিয়ার সাথে অনেক ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। তাছাড়া জিয়া আর আমি ইন্টারেও একসাথে পড়ালেখা করেছিলাম। তখন অবশ্য আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম না। জাস্ট ক্লাসমেট ছিলাম। কিন্তু এক জায়গায় এক পদে চাকরি করার কারণে আমাদের সম্পর্কটা খুব ভালো হয়ে যায়। জিয়া চমৎকার একজন মজার মানুষ। আমাকে মানসিকভাবে অনেক সাপোর্ট করতো। যদিও সে আমার অতীত সম্পর্কে কিছুই জানতো না। বা আমিও কখনো তাকে জানাইনি। তবুও আমার মন খারাপ থাকলে সবসময় মন ভালো করার চেষ্টা করত।
আমার বড় ভাইয়া আর জিয়ার বদৌলতে আমি আমার সুস্থ একটা জীবন পেয়েছিলাম। তবুও মনের মাঝে অপরাধবোধ থেকেই গিয়েছিল।
জিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক হবার পর থেকে-ই তোমাদের বাড়ি নিয়মিত যাওয়া-আসা হতো আমার। তোমার নানা বাড়ি আর দাদা বাড়ি তো একটাই। তোমার মা আর বাবা চাচাতো ভাই-বোন ছিলেন। সে সূত্রে তোমার মায়ের সাথেও আমার ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। তাকে সবসময় বড়বোনের মতো খুব সম্মান করতাম।
যখন প্রথম তোমাদের বাড়ি গেলাম, তখন তুুমি পনেরোর কিশোরী। আর আমার বয়স তখন অলরেডি সাতাশ পেরিয়ে আটাশ ছুঁই ছুঁই। তখন অবশ্য তোমার প্রতি মনে কোনোরকম ভালোবাসার ভাবনার জন্ম নেয়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে কীভাবে যেনো হয়ে গেল। আমি নিজেও জানি না কিভাবে? সত্যি বলছি, আমি নিজেও বুঝতে পারিনি কবে কীভাবে তোমায় ভালোবেসে ফেললাম? এ জন্যই বোধ হয় বলে, ভালোবাসা হতে কোনো কারণ লাগে না, বয়সের পার্থক্য কিংবা শারিরীক সৌন্দর্য লাগে না। ভালোবাসা শুধু নিজের মতো হয়ে যায়।
তোমার প্রতি ভালোবাসার ফিলিংসটা যখন বুঝতে পারলাম তখন আমি নিজেও চূড়ান্ত অবাক হয়েছিলাম। তবে তারপরও কীভাবে যেনো তোমাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলি। তারপর থেকে শুরু হলো তোমাদের বাড়ি ঘনঘন যাওয়া।’
রেনু মুচকি হেসে বলল,
‘হুঁ মনে পড়ছে। সে কারণেই আমার জন্য অত অত চকলেট, মিষ্টি, গিফ্ট কিংবা আমার পছন্দের খাবার নিয়ে যেতেন?’
শিহাব মুচকি হাসল। তারপর বলল,
‘আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাইনি। কারণ তোমাকে ভালোবাসলে হারানোর ভয় ছিলো তীব্র। একবার নিজের ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে দ্বিতীয়বার হারানোর শক্তি আমার ছিলো না। তারপরও ভালোবেসে ফেললাম। আমাদের ভালোবাসার কোনো নাম পাবার সম্ভবনা ৫%ও ছিলো না। তার প্রথম এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো আমাদের বয়সের পার্থক্য। আমি জানতাম আমার মতো বুড়োকে না তুমি পছন্দ করবে, আর না তোমার পরিবার! তবুও বলেনা আশায় বাঁচে প্রাণ। প্রথম ভালোবাসাকে তো হারিয়ে ফেললাম। সে কারণে তোমাকে হারানোর ভয় দিন দিন মনে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছিলো সেসময়। নিজেকে বহু কষ্টে বুঝিয়ে রাখতাম।
তোমার যেদিন আঠারোতম জন্মদিন ছিলো সেদিন আমি জিয়ার কাছে বিয়ার প্রস্তাব রাখি। সে সাথে সাথে না করে দেয় এবং বলে তুই-ই ভাব, তুই রেনুর বয়স আঠারো আর তোর প্রায় ত্রিশ। তোর সাথে রেনুর সাথে কি যায়? তোর নিজের বিবেক বিবেচনা কী বলে? তারপর লজ্জায় আর কারো কাছে তোমাকে বিয়ের কথা বলিনি। এমনকি আমার ভালোবাসার কথা কখনও তোমাকে বলিনি বা বুঝতে দেইনি। কিন্তু তোমাকে না পেলেও আমি অন্য কাউকে গ্রহণ করার মতো মন তৈরি করতে পারিনি।
বাসা থেকে একের পর এক মেয়ে দেখাতো, আর আমি প্রত্যাখান করতাম। কারণ মন তো তোমাতে গেঁথে গেছিলো।
তোমার বয়স যখন ২০ বছর তখন তোমার একটা বিয়ে ঠিক হয়। আমি মানতে পারিনি। কৌশলে তোমার বিয়ে ভেঙেছিলাম। অবশ্য সেই ছেলেও অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। জিয়া জেনে গিয়েছিলো আমি তোমার বিয়ে ভেঙেছি। সে আমার সাথে বন্ধুত্ব ভেঙে দেয়। কথা বলা বন্ধ করে দেয়। তোমার জন্য আমি বহু পাগলামি করেছি রেনু, তুমি জানো না। ম্যাচিওর বয়সের হয়েও টিনেজ ছেলেদের মতো কান্ডকারখানা করেছি।
তারপর আবার তোমার বিয়ে ঠিক হয়, তখন তোমার বয়স একুশ। কিন্তু সে বিয়েটা ঠিক হয় খুব গোপনে। আমি তা জানতাম না। তোমার বিয়ের তিনদিন আগে তোমার মামা আমাকে কল করে বলে, তার একটা জরুরি হেল্প লাগবে। সে কাউকে ভরসা করতে পারছে না। আমি খুশি মনে তার হেল্প করতে রাজি হলাম। কারণ ভাবলাম এই বাহানায় আমাদের আবার বন্ধুত্ব হবে। তোমাকে পাবার ক্ষীণ আশা মনে জাগল। তোমার বিয়ের আগের দিন জিয়া আমাকে নওগাঁ পাঠিয়ে দেয় কিছু কাজে। আমিও নওগাঁ চলে গেলাম। নওগাঁ থেকে কাজ সেরে ফিরি তোমার বিয়ের পরের দিন। ততক্ষণে তুমি অন্য কারো হয়ে গেছ।
তোমার বিয়ের পরেরদিন যখন তোমাদের বাড়ি গেলাম তখন তোমাকে আমি প্রথম লাল রঙের শাড়িতে দেখেছিলাম। তোমার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে ছিলো। তুমি তোমার বরের সাথে হেসে হেসে দুষ্টু মিষ্টি কথা বলছিলে। আমার ভিতরটা তখন দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
জিয়া আমায় ফিসফিস করে বলেছিলো,
‘আর তুই রেনুকে পাবি না। রেনুর পছন্দের পাত্রের সাথেই ওর বিয়ে হয়েছে। তোর মতো বুড়োর কাছে আমার ফুলের মতো ভাগ্নিকে বিয়ে দিব, ভাবলি কী করে? সেদিন সেখান থেকে চলে এসেছিলাম। আমার সেদিনের কষ্টটা তুমি বুঝবে না রেনু! কতটা কষ্ট অনুভব করেছিলাম, তা তুমি অনুভব করতে পারবে না! মুক্তিকে হারিয়ে যতটা কষ্ট পেয়েছিলাম তার চেয়ে বহুগুন বেশি কষ্ট তোমাকে হারিয়ে পেয়েছিলাম। আমার কলিজাটা ছিড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছিল সেদিন?’
শিহাবের চোখে জল দেখে রেনুও কাঁদছিলো। শিহাবের কষ্টে যেনো রেনুর বুকটাও ভার হয়ে গেছে। রেনু শিহাবকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আমাকে হারিয়ে এত কষ্ট পেয়েছিলেন?’
শিহাব, রেনুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল,
‘রেনু আমার বুকে মাথা রাখলে বুঝতে পারবে কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম। মানুষ যদি কষ্টে কোনো রঙ ধারণ করত, তবে আমি কষ্টের বিষে কালোনীল হয়ে যেতাম। বার বার মনে হচ্ছিল আমি এখন-ই মরে যাব। সেদিন বাড়ি ফিরে আমি প্রায় মৃত্যু মুখেই চলে গেছিলাম। চোখে সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেছিলো। বেঁচে থাকার আশাটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলাম সেদিন।’
রেনু চমকে উঠে বলে
‘কী!’
চলবে….
#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখকঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ ৩০
রেনু চমকে উঠে বলল,
‘কী।’
‘হ্যাঁ। সেদিন বারবার মনে হচ্ছিল আমার মাঝেই কোনো দোষ আছে, নয়তো যাকেই ভালোবাসি সে-ই কেন দূরে চলে যায়! নিশ্চিত আমার মাঝেই কোনো খুঁত আছে। আসার সময় ফার্মেসী থেকে এক কৌটা ঘুমের ওষুধ নিয়ে এসেছিলাম। রাতে সবার ঘুমানোর পর ভাবলাম খাবো। খেয়ে একেবারে দুনিয়া থেকে বিদায় নিব। ওষুধগুলো খাবার কিছু মুহূর্ত আগে বাবা আমার রুমে আসেন। তিনি এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলেন,
‘ফার্মেসী থেকে যে, ঘুমের ওষুধের কৌটাটা এনেছিলে সেটা কোথায়?’
আমি অনেকটা চমকে গেলাম। ভাবলাম বাবা কীভাবে জানলো? বাবা-ই বললেন,
‘সন্ধ্যার সময় তুমি মাসুদের দোকান থেকে আমার কথা বলে, ঘুমের ওষুধ এনেছো। বলেছো কতদিন যাবত আমার ঘুমে সমস্যা হচ্ছে। মাসুদ আমাদের পরিচিত। সে তোমার কথা বিশ্বাস করে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। এশার নামাজ পড়ার পর আমি মাসুদের দোকানে গিয়েছিলাম প্রেসারের ওষুধ আনতে। তখন মাসুদ বলল, মামা আপনি কেন আসলেন? শিহাব ভাই সন্ধ্যার সময় আপনার জন্য, মাথা ব্যথার আর ঘুমের ওষুধ নিছিলো, তখন সে নিলেই তো পারত। আমি মাসুদের কথায় কিছু বলিনি। শুধু সম্মতি জানিয়ে বলেছি, শিহাবকে বলতে ভুলে গেছিলাম। আমি চাই না আমার পরিবারের সম্মান মাটিতে মিশুক। ওষুধগুলো কি তুমি খেয়োছো? নাকি খাবে বলে পরিকল্পনা করছো?’
বাবার কথা শুনে আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম। বাবা আবার বললেন,
‘তুমি চৌদ্দ-পনেরো বছরের হলে তোমাকে বুঝাতে পারতাম কিংবা মারতে পারতাম কিন্তু এখন তোমাকে যুক্তি দিয়ে বুঝানোর বা মেরে বুঝানোর বয়স নেই। কী হয়েছে বলো আমাকে? আমি যদি পারি সমাধান দিব।’
আমি লজ্জায় অনেক্ষণ চুপ করে ছিলাম। তারপর বাবাকে তোমার সম্পর্কে সবটা খুলে বললাম। বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন,
‘শিহাব, জানো তোমার সমস্যা কী?’
আমি উৎসুক চোখে বাবার দিকে তাকালাম। বাবা বললেন,
‘তোমার সমস্যা হচ্ছে তুমি নিজেকে অনেক বেশি কিছু মনে করো! ভাবো তুমি একাই সকল সমস্যার সমাধান করতে পারবে! কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছো কোনো মানুষ-ই আদৌ তা পারে না। কারো পক্ষেই একা সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না! যদি তুমি তোমার সমস্যাটা আমাকে বা তোমার বড় ভাইয়াকে জানাতে, এতদিনে হয়তো সমাধান হয়ে যেতো। হয়তো রেনু এতদিনে আমাদের ঘরের বউ থাকতো।
যখন তোমার কথায় জিয়া রাজী হচ্ছিল না, তোমার তখনই উচিত ছিলো আমাদের জানানো। আমাদের জানালে আমরা পারিবারিকভাবে বিষয়টা সমাধান করে ফেলতাম কিন্তু না, তুমি পাকনামি করে নিজে সব করতে গেলে, যার ফলশ্রুতিতে তুমি রেনুকে হারিয়ে ফেললে। এখন তো আর কিছু করার নেই। তুমি মরে গেলে রেনুর বা তার পরিবারের কারো কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু তোমার পরিবারের সবার আসবে যাবে। তোমাকে ছাড়া তোমার পরিবার অচল হয়ে যাবে। তোমার বাবা-মা-ও হয়তো জীবিত থাকবে না। তুমি যদি চাও তোমার বাবা-মা তোমার কারণে মারা যাক তাহলে নিশ্চিন্তে ঘুমের ওষুধ খেয়ে নাও।’
এই বলে বাবা চলে গেলেন। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে রইলাম। সেদিন ঘুমের ওষুধ তো খেলাম না কিন্তু সে রাতে আমার প্রচন্ড জ্বর আসে। এত জ্বর আমার কখনও আসেনি। জ্বরের কারণে আমার কোনো হুঁশ ছিলো না। পরের দিন সকালে আমাকে হসপিটালে ভর্তি করতে হয়। প্রায় এগারোদিন ভর্তি ছিলাম হাসপাতালে। ডাক্তাররা আমার জ্বর কোনোভাবেই কমাতে পারছিলে না। জ্বর সাথে টাইফয়েড, বমি, প্রচন্ড মাথা যন্ত্রনায় কাউকে চিনতে পারেনি ক’দিন। বাবা-মা আমার বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। নয়দিনের মাথায় আমার জ্বর কমে। তারপরও দু’দিন হাসপাতালে ছিলাম। এগারোতমদিন বিকালে বাসায় ফিরি।
বাড়ি ফেরার পরের দিন আমার কয়েকজন কলিগরা দেখতে আসেন। তারা নাকি হসপিটালেও দেখতে গিয়েছিলো কিন্তু আমার তখন হুশ ছিলো না। সবাইকে দেখে ভেবেছিলাম হয়তো জিয়াও আমাকে দেখতে আসবে কিন্তু জিয়াকে না দেখে, আমার এক কলিগ মিলন সাহেবের কাছে ওর বিষয়ে জানতে চাইলাম। তখন মিলন সাহেব বললেন,
‘শিহাব তুমি যখন হসপিটালে ভর্তি ছিলে, তখন জিয়া একবার তোমাকে দেখতে গেছিলো কিন্তু তখন তোমার হুশ ছিলো না। ও তোমার জন্য খুব চিন্তা করছিলো। ও আমাকে বলেছিলো, শিহাব আমার কথা শুনলে আজ এত অসুস্থ হতো না। কী কারণে কথাগুলো বলেছিলো, আমি জানি না। হয়তো তুমি জানো। আজও অফিসে থাকলে হয়তো আসত। কিন্তু গত পাঁচদিন আগে ওর ভাগ্নি রেনুর জামাই রোড একসিডেন্টে মারা গেছে। মেয়েটার বিয়ে হলো সাতদিনের মাথায় মেয়েটা বিধবা হলো। আহারে পরীর মতো দেখতে মেয়েটা অথচ কপালটা কত খারাপ!’
বিশ্বাস করো সেদিন তোমার বরের মৃত্যু সংবাদ শুনে ভীষণ খারাপ লেগেছিলো। বারবার তোমার কষ্টেভরা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। তোমাকে আমি সবসময় সুখী দেখতে চাইতাম সে তুমি যার সাথেই থাকো না কেন! তোমার জীবনে দুঃখ আসুক আমি কখনো চাইনি। স্বপ্নেও চাইনি। কিন্তু সেদিন বার বার মনে হচ্ছিল তোমার সাথে এমনটা কেন হলো? সুখ পাওয়াটা তোমার অধিকার। আমি সবসময় তোমার সুখের জন্য প্রার্থণা করতাম। সেই তুমি কষ্টের সাগরে হাবুডুবো খাবে সেটা কখনো চাইনি!
আমি সুস্থ হওয়ার কিছুদিন পর তোমাদের বাড়িতে আবার গেলাম। সেদিন আমি তোমার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। তোমাকে সবসময় রঙিন কাপড়ে দেখেই আমি অভ্যস্ত ছিলাম, সেই তোমার পরনে একটা সাদা রঙের কাপড়। আমার প্রচন্ড রাগ হয়েছিলো। কেন তোমাকে সাদা রঙের কাপড় পরানো হলো? আজকাল তো সেই মধ্যযুগের প্রথা নেই যে, স্বামী মরলে স্ত্রীকে সাদা শাড়ি পরতে হবে। তাহলে তোমার মতো ছোট্ট একটা মেয়েকে কেন সাদা শাড়ি পরানো হলো? পরে অবশ্য জেনেছিলাম তোমার শ্বশুর বাড়ির নাকি রেওয়াজ ছিলো, স্বামী মরার পর মেয়েরা কিছুদিন সাদা শাড়ি পরবে। কিন্তু সে কথা শুনেও আমার প্রচন্ড রাগ উঠেছিলো। তোমার শ্বশুর বাড়ির লোক তোমার উপর কর্তৃত্ব দেখানোর কে? যেখানে তোমার বাবা-মা জীবিত। সে যা হোক, সেসব কথা না বলি।
সেদিন জিয়াও আমাকে ধরে অনেক কান্না করেছিলো। বিড়বিড় করে বলেছিলো,
‘তোর সাথে অন্যায় করার ফল আমার ভাগ্নিটা পেলো। তুই কি ওকে অভিশাপ দিয়েছিলি?’
আমি মৃদু আওয়াজে বলেছিলাম,
‘বিশ্বাস কর আমি কোনো অভিশাপ দেইনি? অভিশাপ দেওয়ার মতো অবস্থায়ও আমি ছিলাম না। তাছাড়া আমি সবসময় চাইতাম রেনু ভালো থাকুক। সে আমার সাথে ওর বিয়ে হোক বা না হোক! তাছাড়া আমার অভিশাপ রেনুর কেন লাগবে? অন্যায় তুই আমার সাথে করেছিলি, রেনু তো নয়! তাহলে রেনু কেন শাস্তি পাবে? রেনু তো জানতোও না যে, আমি ওকে ভালোবাসি। যা হয়েছে সেটা একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে।’
অনেক কষ্টে সেদিন তোমার মামাকে শান্ত করেছিলাম।’
তারপর বেশ কিছু মাস কেটে যায়। সবার কথায় কথায় তোমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু আমার কিছু করার ছিলো না। তবুও তোমার কষ্টগুলো সহ্য হতো না। তোমার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে, আবার তোমার মামার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখলাম। কিন্তু জিয়া প্রচন্ড ঘাড়ত্যাড়া ছিলো। ও প্রচন্ড রাগ করে বলেছিলো,
‘কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না। তুই-ও তেমন রেনুর পিছ ছাড়বি না। আমার ভাগ্নি এখনও পঁচে যায়নি যে, তোর সাথে বিয়ে দিব। তোর কপাল ভালো তুই বেঁচে গেছিস। আমার প্রথমে সন্দেহ হয়েছিলো, হয়তো রেনুর স্বামীর মৃত্যুর পিছনে হাত তোর? কিন্তু পরে অবশ্য সবকিছু খতিয়ে দেখার পর জানলাম তুই আসলেই র্নিদোষ। কিন্তু তা বলে রেনুর বিয়ে কখনও তোর সাথে দিব না।’
এবার আমার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো। একটা জিদ চেপে গেল ভিতরে। সেদিন তোমার মামাকে বলেছিলাম,
‘তুই নিজে রেনুর বিয়ে আমার সাথে দিবি। দেখব আমার কাছে ছাড়া রেনুর বিয়ে তুই কার কাছে দিস?’
তারপর জিয়া তোমার বিয়ে অন্যত্র দেয়ার বেশ চেষ্টা করে কিন্তু কোনো ভাবেই তা পারেনি। বিধবা হওয়ার পর অবশ্য তোমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব খুব কম আসতো। যা-ও আসতো সিরিয়াস খুব কম ছিলো। আর যারা সিরিয়াস ছিলো তাদের আমি কোনো না কোনো ভাবে ভাগিয়ে দিতাম। জিয়া আর আমার মাঝে অলিখিত, অদৃশ্য একটা যুদ্ধ চলছিলো। যুদ্ধটা প্রায় তিন বছর যাবত চলল। যখন দেখলাম আমার বয়স ছত্রিশ পেরিয়ে যাচ্ছে তোমারও চব্বিশ পেরিয়ে যাচ্ছে। তখন ভাবলাম নাহ, যুদ্ধ তো অনেক করলাম, এবার কৌশলে জিততে হবে। বয়স তো আর বসে নেই। কতদিন আর অবিবাহিত থাকব? তোমার বিয়ের বয়স না পেরোলেও আমার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছিল। পরে সব ভেবে কিছু কৌশলে বাজি আমি জিতেছিলাম।
আমি আমার বাবাকে আর বড় ভাইয়াকে দিয়ে সরাসরি তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই। আমার জব, পজিশন, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে তোমার বাবা, চাচা এবং বাকি দুই মামা রাজি হয়। তাদের কাছে আমার বয়সটা ফ্যাক্ট ছিলো না। জিয়া রাজি না হলেও সবার কথাতে রাজি হতে বাধ্য হয়।
বিয়ের কয়েকদিন আগে আমি জিয়ার সাথে কথা বলি। ওকে বুঝিয়ে বলি,
‘জিয়া তোকে আর কীভাবে বোঝাবো আমি জানি না! তবে তোর আর আমার দ্বন্দে রেনুর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ও মানুষের কথা শুনতে শুনতে কষ্টের সাগরে ভাসছে। ওকে আর কষ্ট দিস না। জিয়া এত বছর যাবত তুই শুধু আমার বয়সটা দেখলি বাকি গুণগুলো দেখলি না। আর সবচেয়ে বড় কথা রেনুর প্রতি ভালোবাসাটা দেখলি না। রেনুকে আমার চেয়ে ভালো কেউ বাসতে পারবে না। এরপরও যদি তোর মনে হয় আমার বয়স বেশি বলে, আমি রেনুর জন্য ঠিক না, তাহলে তুই তোর মন মতো রেনুর বিয়ে দিতে পারিস। আমি আর বাঁধা হবো না। কারণ আমি চাই রেনু ভালো থাকুক। আর কষ্ট না পাক।’
সেদিন জিয়া কোনো কথা বলেনি। তবে পরের দিন কল করে বলেছিলো,
‘শোন শিহাব যদি কখনও শুনি তুই বিয়ের পর রেনুকে কষ্ট দিয়েছিস, আমি তোকে মার্ডার করে ফেলব। রেনু আমার খুব যত্নের। আর আমি জানি তুই ওকে খুব ভালোবাসিস। তোর সে ভালোবাসার কাছে আজ আমি হার মানলাম। রেনুকে প্লিজ ভালো রাখিস। মেয়েটা আমার খুব কষ্ট পেয়েছে। ওকে খুব ভালোবাসিস। ওকে এত ভালোবাসিস যাতে ও ওর কালো অতীতটা ভুলে যায়।’
তারপর আর কী? তোমার পরিবার তো মেনে গেল। কিন্তু এবার গণ্ডগোল পাকালো আমার পরিবার। বাবা আর ভাইয়া তো রাজি কারণ তারা সব জানতেন। কিন্তু মা, ভাবি আর শশী একেবারে রাজি ছিলো না। কিন্তু আমি সবার সামনে বেশ বড় গলায় বলেছিলাম,
‘আল্লাহর কসম কেটে বলছি, যদি বিয়ে করি তো রেনুকে করব, নয়তো জীবনে বিয়ে করব না।’
আমার জেদের কাছে সবাই হার মানল ঠিকই কিন্তু শশীর রাগ বরাবরই বেশি ছিলো। যার কারণে ও আমার উপর রাগ করে আমার বিয়ের আগেরদিন ফুপুর বাড়ি চলে যায়। ও ভেবেছিলো ওর রাগ ভাঙাতে আমি বিয়েটা করব না। কিন্তু ও জানতো না আমি তোমার জন্য কত তপস্যা করেছি! ভাবলাম ওর রাগটা আমি পরে ভাঙাতে পারবোই কিন্তু তোমাকে হারালে আর পাব না। অবশেষে তোমাকে পেলাম। রেনু তুমি আমার বহু প্রতীক্ষার ফল। সৃষ্টিকর্তার দরবারে অনেক চাইবার পর তোমায় পেয়েছি। আমি তোমায় খুব ভালোবাসি রেনু। তুমি ভাবতে পারবে না কতটা ভালোবাসি!’
রেনুর চোখ থেকে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে কিন্তু রেনু কিছু বলল না। শুধু শিহাবের বুকে মুখ লুকালো। শিহাবও গভীর আবেশে রেনুকে জড়িয়ে নিলো। এখন দু’জন কোনো কথা বলবে না। রেনু শুধু শিহাবের বুকে নিজের ভালোবাসা অনুভব করবে। আর শিহাব অনুভব করবে রেনুকে। মাঝে মাঝে ভালোবাসায় কিছু বলতে হয় না। শুধু অনুভবে অনুভব করতে হয় একে অপরকে। তখন নীরবতা বলে দেয় নিজেদের ভালোবসার কথা।
৩৯!!
সারা রাত শশী যন্ত্রনায় ঠিকভাবে ঘুমাতে পারেনি। সকালে সূর্য উঠার অনেক আগেই ও উঠে বসে আছে। তখন চারদিকে ফজরের আযান দিচ্ছে কেবল। ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। কিন্তু রাযীনকে উঠাতে ইচ্ছা করছে না। বেচারার উপর দিয়ে রাত থেকে অনেক ধকল গেছে। তারপর আবার সারাদিন কাজ করতে হবে। ও একটু ঘুমাক ভাবল, শশী। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে, এখন ওয়াশরুমে না গেলে প্রস্রাব বিছানায়ই করে ফেলবে।
শশী ধীরে ধীরে ফ্লোরে পা দেয়ার চেষ্টা করল। প্রথমে ডান পা দিয়ে বাম পা দিয়ে ভর দিবে ওমনি রাযীন ধমকে উঠল,
‘এই তুমি নামছো কেন?’
অনেকটা চমকে গিয়ে ভয় পায় শশী। বুকে থু থু দিয়ে বলে,
‘এভাবে কেউ ডাকে?’
‘তুমি নিচে নামছিলে কেন?’
‘ওয়াশরুমে যাব।’
‘তো আমাকে ডাকতে।’
‘না মানে ভাবলাম তুমি ঘুমাচ্ছো তোমাকে ডাকা ঠিক হবে না।’
‘আর এমন পাকনামি করবা না।’
রাযীন, শশীকে কোলে তুলে ওয়াশরুমে ভিতরে ঢুকিয়ে নিজে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। হাই কমোড বসানো ওয়াশরুমে শশীর কোনো সমস্যা হবে না। ফ্রেশ হয়ে, ওযু করে শশী, রাযীনকে ডাকল। রাযীন আবার শশীকে কোলে তুলে নিয়ে এলো। শশী টুপ করে রাযীনে গালে একটা চুমো খেলো। রাযীন হেসে বলল,
‘সকাল সকাল এত মিষ্টি কেন?’
‘কাল রাতে চেয়েছিলে, তারপর কত কিছু হলো! ভাবলাম আমার এত কেয়ার করার জন্য এসব হালকা পাতলা মিষ্টি তো তুমি ডিজার্ভ করো।’
রাযীন, শশীকে চেয়ারে বসিয়ে শশীর গালে চুমো খেয়ে বলল,
‘আমিও কারও কাছ থেকে ভালোবাসা পেলে তা আবার ব্যাক দিতে কাপর্ণ্য করি না। কালকে যদি আমার কথা শুনে সাথে সাথে চুমোটা দিয়ে দিতে, তাহলে এত ঝামেলা হতো না।’
শশী খানিকটা রাগ করে বলল,
‘কী বললা? তার মানে সব দোষ আমার?’
রাযীন আবার শশীর কপালে চুমো খেয়ে বলল,
‘রাগ করে না জানপাখি। আই লাভ ইউ।’
শশী লজ্জা পেলো। রাযীন বলল,
‘চেয়ারে বসে নামাজ পড়ো। আমি ওযু করে আসছি।’
নামাজ শেষে রাযীন, শশীকে বিছানায় শুইয়ে, নিজে শুয়ে বলল,
‘শশী একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। নয়তো শরীর আরও খারাপ লাগবে।’
‘তুমি তো একটু বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারো।’
রাযীন, শশীর নাকে নাক ঘষে বলল,
‘সারাটা রাত আপনি তেমনই ছিলেন। আসেন আবার নিচ্ছি।’
রাযীন, শশীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘শশী তোমার গা গরম হচ্ছে খুব। ডাক্তার অবশ্য আগেই বলেছিলেন যন্ত্রনায় জ্বর আসবে।’
’হুম।’
এবার কিছু সময়ের মধ্যেই শশী ঘুমিয়ে পড়ল। সারা রাতের নিদ্রাহীনতা, ক্লান্তি, ব্যথা সব মিলিয়ে এবার শশী শরীরের সাথে পেরে উঠল না। ঘুমিয়ে পড়ল দ্রুত। রাযীনও দ্রুত ঘুুমিয়ে পড়ল। ও-ও তো সারা রাত জেগে ছিলো, ক্লান্ত রাযীন-ও।
স্নিগ্ধ সকালে মিষ্টি দুটো ভালোবাসাময় প্রাণ ঘুমে বিভোর। সকালের নরম রোদ তাদের ছুঁয়ে দিচ্ছে। মোলায়েম ভালোবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছে। সকালের স্নিগ্ধতা আর নরম রোদ চুপি চুপি বলছে দেখো, ভালোবাসা ভালোবাসছে।
রাযীনের ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে প্রায় সকাল নয়টা বাজে। রাযীন, শশীর দিকে তাকিয়ে দেখল, শশী এখনও গভীর ঘুমে। ওর ভাঙা পা’টা বালিশের উপর উঁচু করে রাখা ছিলো। সেটা নেই। হয়তো ঘুমের ঘোরে পা নামিয়ে ফেলছে। রাযীন খুব সাবধানে উঠে শশীর পা’টার নিচে আবার বালিশ দিয়ে দিলো। শশীর প্লাজুও হাঁটুর উপর উঠে ছিলো। সেটা ঠিক করে দিলো।
রাযীন মৃদু হেসে বলল,
‘এই মেয়ের পা এত ফর্সা কেন? এত সুন্দর পা দেখলেই ভিতরটা এলোমেলো হয়ে যায়। কন্ট্রোল রাযীন সাহেব! এ মেয়ে আপনাকে অনেক জ্বালাবে পোড়াবে। তবে ওর হাঁটুতে একটা কাটা দাগ। ভালোই লাগছে দাগটার কারণে। যদি শোনে আমি ঘুমের মাঝে ওকে এরকম দেখেছি র্নিঘাত আমাকে ধোলাই দিবে। তারচেয়ে বলার-ই প্রয়োজন নেই। তবে কাটা দাগটা দেখে কিউরিসিটি হচ্ছে, কীভাবে কাটল? পরে সময় করে একদিন জেন নিব। এখন দেখি কী নাস্তা তৈরী করা যায়?
রান্নাঘরে এসে রাযীন ভাবল, নাস্তা বাইরে থেকে অর্ডার করবে নাকি নিজে বানাবে? নিজে বানানোর সময়ও নেই। কাজ আছে অনেক। রাযীন ফোনটা হাতে নিলো খাবার অর্ডার করবে করে। ফোন আনলক করে দেখলো সুমির অনেকগুলো মিসকল। রাযীন কল ব্যাক করল। সুমি কল রিসিভ করে বলল,
‘কিরে ফোন ধরছিলি না কেন?’
‘ঘুমাচ্ছিলাম। ফোন সাইলেন্ট ছিলো।’
‘শশীর কী খবর?’
‘যন্ত্রনায় সারা রাত ঘুমায়নি। এখন ঘুমাচ্ছে।’
‘আচ্ছা ঘুমাক। শোন সকালের নাস্তা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। দুপুরেও তোরা আমার বাসায় খাবি। শশী যতদিন সুস্থ না হয়, তোদের রান্না আমার ঘরে হবে।’
‘আপা তোমার অনেক কষ্ট হয়ে যাবে।’
‘কোনো কষ্ট হবে না।’
রাযীন কল কেটে বলল,
‘নাস্তা করে বাজারে যেতে হবে। বিকালে বাবা-মা, শশীর পরিবারের লোক সবাই চলে আসবে। শশীর ঘরে কষ্ট ছাড়া চলার জন্য একটা হুইল চেয়ার আনব। একজন পারমানেন্ট কাজের লোক পেলে যে কী ভালো হতো। শশীকে একা রেখে কোথাও যেতে ভয় করছে। আজকাল সোনার হরিণ সহজে পাওয়া যায় কিন্তু কাজের লোক না।
চলবে….