#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখিকা: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব:৪৩
এতদিন বসে করা প্ল্যান আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দিব না! জেলে আমাদের পরিচিত কেউ আছে কিনা খোঁজ নিন।’
রাসেল বলল,
‘আছে, তবে ছেলে আসামী। তারা তো আর মেয়ে আসামীদের সাথে থাকে না।’
‘তাহলে পরিচিত মেয়ে আসামীদের খোঁজ করেন তাকে টাকা লোভ দিন। টাকা মানুষকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিতে পারে। অতঃপর তাকে বলুন যে ভাবেই হোক শশীর বাচ্চাটা যেন নষ্ট করে ফেলে। বেশি কষ্ট করতে হবে না। জেলে থেকে থেকে শশী এমনি দুর্বল হয়ে গেছে। হালকা ধাক্কা টাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে বাচ্চা এমনিই নষ্ট হয়ে যাবে। দূর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। আরেকটা রাযীন যাতে পৃথিবীতে না আসে। শালার রাযীন দেখছি সুপার ফাস্ট। মানে লোক বাচ্চার জন্য বছরের পর বছর কাঁদে, এ শালা দেখছি বিয়ের দেড় মাসের মধ্যে বউকে প্রেগনেন্ট করে ছাড়ল। আর শশী মেয়েটাও সুবিধার না। বিয়ের আগে চার বছরের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও বিয়ের পর কেমন নাচতে নাচতে রাযীনের কাছে চলে গেল। এদের ভিতর এত সে* ক্স কোথা থেকে আসে?’
রাসেল জিব্বাহ কামড় দিয়ে বলল,
‘ছি ছি ব্রো এসব কাঁচা কথা বলে না। তবে শশী মেয়েটা হুদাই ফাঁসল।’
‘কাউকে না কাউকে তো ফাঁসাতেই হতো। শশী না ফাঁসলে আমরা ফাঁসতাম। বরং শশী নিজেই নিজেকে ফাঁসানোর ব্যবস্থা করে দিছে। ডাম্প একটা মেয়ে। তার পিছনে ঐ রাযীন পাগলের উপ্রে পাগল। মেয়েটার এত বছরের রিলেশন, বিয়ের পর সেই প্রেমিকের সাথে আবার দেখা, চিংড়ি মাছে এলার্জি, রাযীনের সাথে ঝগড়া করে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর। মানে বোকা মেয়েটা নিজেই নিজেকে ফাঁসানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। ওদের জানা উচিত ছিলো, ওদের ঘরের একটা ডুবলিকেট চাবি আমাদের কাছে আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম দু’টোকেই শেষ করে ফেলি। পরে ভাবলাম দু’জনকে মারলে সমস্যা। পুলিশ তদন্তে আমরা ধরাও পড়তে পারি। আর শশীকে মেরে রাযীনকে ফাঁসানোর প্ল্যানটাও তেমন স্ট্রং ছিলো না। কারণ দুনিয়ার সবাই জানে রাযীন নিজে মরবে বাট শশীকে একটা টোকাও দিবে না। তাছাড়া শশী মার্ডার কেসে রাযীনের শাস্তি হলেও ও বেঁচে থাকত। আর ও বেঁচে থাকলে ওর টাকাওয়ালা বাপ ঠিকই ওকে মুক্তি করত। আর রাযীন বেঁচে থাকলে ওদের বংশে তো ওয়ারিশ এমনি থাকত। অতঃপর জানতে পারলাম শশী ম্যাডামের পূর্বের প্রেমের কেস্সা। আহা কী প্রেম! প্রেমের টানে প্রেমিক ফরিদপুর থেকে সোজা কক্সবাজার। তখন ভাবলাম এবার সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। মানে রাযীন মরবে, ফাঁসবে শশী আর আমরা চিল করব ওদের টাকায়। আর টাকা কীভাবে আমাদের হবে তার অগ্রিম প্লানও করা আছে।’
রাসেল হেসে বলল,
‘ব্রো ইউ আর জাস্ট টু গুড। সুমি তোমার ঠিক নাম দিয়েছে মাস্টার মাইন্ড। ব্রো রাযীনের বাবার আনুমানিক কত টাকার সম্পত্তি আছে?’
‘জয়গা জমি পঁঞ্চাশ কোটি টাকার উপরে আছে। আর ব্যবসা কিংবা লিকুয়িড ক্যাশ কত আছে তা জানি না। তবে এত জমি থাকে হিসাব করো তাদের ব্যাংকে কত টাকা আছে।’
‘ওহ মাই গড। এ কারণেই তুমি এখন লাখ লাখ টাকা খরচ করছো?’
‘লাখ লাখ খরচ না করলে কোটি কোটি আসবে কী করে? আচ্ছা বিষ যে ডিলারের কাছ থেকে নিয়েছিলে তার হদিস আবার পুলিশ পাবে নাতো?’
‘নো চান্স ব্রো। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিষধর সাপ পাওয়া যায় সিলেট এবং নোয়াখালিতে। বিষ সিলেট থেকে আনিয়েছি। কেউ জীবনেও জানতে পারবে না, কে আনিয়েছে কিংবা কোথা থেকে আনিয়েছে?’
‘গুড। ওকে বাকি কথা পরে বলব। এখন রাযীনকে আরও অসুস্থ করার পারমানেন্ট ব্যবস্থা করি।’
৫৮!!
শিহাবের কাছে একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসল। কলটা রিসিভ করে শিহাব সালাম করল,
‘আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়াইকুম আসসালাম। আপনি প্লিজ রাযীন সাহেব যে, হসপিটালে সে হসপিটালের অপারেশন থিয়েটারে চলে আসুন।’
শিহাব খানিকটা ভয় পেয়ে বলল,
‘রাযীন ঠিক আছে তো?’
‘জি। আপনি প্লিজ দ্রুত চলে আসুন রাযীন সাহেবই আপনার সাথে দেখা করতে চান।’
শিহাব উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘রাযীন ঠিক হয়ে গেছে।’
‘প্লিজ আর কথা বাড়াবেন না। জলদি চলে আসুন। আর প্লিজ রাযীনের বিষয়ে কাউকে বলবেন না।’
শিহাব অফিস থেকে বের হয়ে জলদি ট্যক্সি ডাকল। রেনুর কিংবা লিপির গয়না বিক্রি করেনি দুই ভাই। তবে নিজেদের শখের গাড়ি দুটো বিক্রি করে দিয়েছে ওরা। সাজ্জাত, শিহাব ওদের বাবা-মাকে বলেছিলো,
‘গাড়ি হয়তো কিছুদিন পর আবার কিনতে পারব কিন্তু বোনটার কিছু হলে কোথায় পাব?’
শিহাব ট্যাক্সি করে সোজা হসপিটালে গেল। গিয়ে ফোনে বলা লোকটার কথা মতো তিন তলায় অপারেশন থিয়েটারে চলে গেল। অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে ঢুকে শিহাব ভূত দেখার মতো চমকে গেল। কারণ রাযীন একটা চেয়ারে বসে বসে ওর বাবার সাথে কথা বলছে। রাযীন, শিহাবকে দেখে মৃদু হেসে সালাম করল। শিহাব এত অবাক হলো যে, সালামের উত্তর দিতেই ভুলে গেল। রাযীন বলল,
‘ভাইয়া কেমন আছেন?’
শিহাব এবারও কোনো উত্তর দিলো না। রাযীনের কাছে গিয়ে বলল,
‘তুমি ভালো হয়ে গেছ রাযীন?’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাযীন বলল,
‘ক’দিন আগে থেকেই আমি কথা বলতে এবং ডান হাত একটু একটু নাড়াতে পারতাম। যদিও বাম পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারি না। সেটাও শীঘ্রই পারব আশাকরি।’
শিহাব এত খুশি হলো যে, বলল,
‘আমি এখনই সবাইকে জানাচ্ছি। সবচেয়ে বেশি খুশি হবে আমার শশীটা। ওকেও এখন দ্রুত ছাড়াতে পারব।’
রাযীন, শিহাবকে থামিয়ে বলল,
‘প্লিজ ভাইয়া এমনটা করবেন না। সবাই এত দ্রুত জানানোর হলে তো আমি ক’দিন আগেই জানাতাম। কিন্তু মেইন অপরাধীকে ধরতে হলে, আমাকে সবার কাছে অসুস্থ হয়েই থাকতে হবে। শশীকে আর আমার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য আমার একটা পরিকল্পনা আছে। দয়া করে পরিকল্পনাটা নষ্ট করবেন না। আমি যতই আদালতে বলি না কেন যে, শশী নির্দোষ কিন্তু আদালত সেটা মানবে না। কারণ তারা প্রমাণ চায় আর প্রমাণ সব শশীর বিরুদ্ধে। আমি হয়তো জানি আমাকে কে মারতে চেয়েছিলো! তার উদ্দেশ্যও কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি। কিন্তু সে এমনভাবে সব প্ল্যান করেছে যে, শশীর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। তারউপর আসল অপরাধী চায় আমাদের সন্তান পৃথিবীতে না আসুক। সে কারণে এতদিন আমার কথায়ই শশীকে একজন পুলিশ অফিসার সারাক্ষণ রক্ষা করে যাচ্ছে। শশীর খাবারে গত পরশু মিসক্যারেজের ওষুধ দেওয়া হয়েছিলো কিন্তু সেই পুলিশ মেয়েটা বুঝতে পেরে শশীকে সে খাবারটা খেতে দেয়নি। মেয়েটা পুলিশ কিন্তু সে আসামীর বেশে জেলে বসে শশী আর আমাদের বাচ্চাকে প্রটেক্ট করছে।
বিগত কদিন যাবত আমি শুধু ভাবছিলাম এবং খোঁজ করছিলাম, শশীর পক্ষে একটা প্রমাণ পাওয়া যায় কিনা? অতঃপর আমার একটা কথা মনে পড়ল। এতদিন আমার মাথায় এ কথাটা আসেনি। সে কারণে নিজেকেই গালাগাল করতে ইচ্ছা করছে। আমার ধারণা যদি সঠিক হয় তাহলে এই একটা প্রমাণই যথেষ্ট শশীকে বাঁচানোর জন্য।’
শিহাব উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘কী প্রমাণ বলো?’
‘সেটা বলছি তার আগে আমাকে একটা কল করতে দিন। বাবা তুমি কথা বলো। আমি ঠিক যেমন বলে দিয়েছি ঠিক তেমন বলবে।
রায়হান রহমান কাউকে কল করে ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে বলল,
‘রায়হান রহমান বলছি।’
‘হ্যাঁ রায়হান বলো?’
‘কাল তোমার একাউন্টে পঞ্চাশ লাখ টাকা পৌঁছে যাবে। আমার পুত্রবধূ শশীর কেসটা কালকের মধ্যে কোর্টে ওঠা চাই।’
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলো। তারপর বলল,
‘আরে রায়নায় থিংক প্রাকটিক্যাল। কাল বৃহস্পতিবার। শুক্রবার, শনিবার কোর্ট বন্ধ। রবিবারের আগে কিছু করা যাবে না। সরকারি কাজ কিছু নিয়ম কানুন তো আছে।’
‘ঠিকআছে তবে শশীর কেস কোর্টে ওঠার আগে শশীকে জেলখানা থেকে সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার ব্যবস্থা করো। ও প্রেগনেন্ট আমাদের কাছে খবর আছে ওকে আর ওর গর্ভের সন্তানকে মারার চেষ্টা করা হবে।’
‘আচ্ছা আমি তোমার কথায়ই তো জেলখানায়ই শশীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। বাকি ক’দিনের জন্য নিরাপত্তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছি। শশী সেইভ থাকবে এটা আমার ওয়াদা।’
রায়হান রহমান কল কেটে বলল,
‘আজকাল ওয়াদা পালন হয় টাকায়।’
রাযীনের বিচক্ষণ বুদ্ধি দেখে শিহাব মুগ্ধ হয়ে গেল। যে কাজ ওরা গত তিন মাস যাবত করতে পারেনি, রাযীন কত সহজে সব করে ফেলছে। শিহাব বলল,
‘যে কাজ আমরা তিন মাসে করতে পারিনি, তুমি কত সহজে তা করে ফেললে! তুমি সত্যিই অনেক বুদ্ধিমান রাযীন।’
‘সবই টাকা খেলা ভাইয়া।’
‘টাকা তো আমরাও কম ঢালিনি রাযীন।’
‘আমি তা বলিনি ভাইয়া। তবে টাকাটা জায়গামতো ঢালতে হবে। ভাইয়া মাত্র বাবা কাকে কল করে কথা বললেন জানেন?’
‘কাকে?’
‘আইন মন্ত্রনালয়ের যিনি প্রধান তার সাথে। বুঝতে পারছেন কার সাথে?’
শিহাব অনেক অবাক হলো। রাযীন বলল,
‘চিন্তা করবেন না। রবিবারের শশীর কেসটা কোর্টে উঠবে। আর রবিবার শশী আমাদের সাথেই থাকবে।’
শিহাব, রাযীনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘তুমি শশীকে এত ভালোবাসো যে ওর জন্য এতকিছু করছো?’
রাযীন কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ভাইয়া আপনাদের বোনটা আপনাদের শুধু বোন, আমার তো প্রাণ।’
আবেগে শিহাবের চোখ ভরে এলো। সাথে শিহাব এটাও খেয়াল করল রাযীন দ্রুত কথা বলতে পারছে না। থেমে থেমে কথা বলছে। কথা খানিকটা জড়িয়েও যাচ্ছে। হয়ত এখনও পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে। শিহাব মনে মনে সর্বশক্তিমান, পরমকরুনাময়কে ধন্যবাদ জানালেন। মনে মনে বলল,
‘হে করুনাময় তুমি সত্যি মহান। তুমি আমার বোনটাকে এমন একজনার স্ত্রী করেছো যে কিনা বোনটাকে সত্যি খুব ভালোবাসে। আর রাযীনকে এত দ্রুত সুস্থ করে তুমি প্রমাণ করলে, তোমার দয়ার কোনো সীমা নেই। নির্দোষকে তুমি কখনও শাস্তি দাও না। হে করুনাময় এখন ওদের দু’জনার জীবনে আর কোনো বাঁধা দিও না। ওদের এক হতে দাও। ওরা ভালো থাকুক। ওরা সবসময় এক সাথে থাকুক।’
তারপর শিহাব, রাযীনকে বলল,
‘রাযীন তুমি সুস্থ ছিলে তাহলে আমাদের কেন জানালে না?’
‘সে রকম সুযোগ ছিলো না। এমনকি আমার বাবা-মাও জানতেন না। বাবা গতকাল জানতে পেরেছেন, মাকে এখনও বলিনি। আর শশী এবং বাকিদেরকে আপনারা কক্সবাজার থেকে ফেরার পূর্বে বলবও না।’
‘কক্সবাজার?’
‘হ্যাঁ ভাইয়া আপনাকে আজ এখনি কক্সবাজার যেতে হবে। এবং কাউকে জানাতে পারবেন না। বাবার সাথে কক্সবাজারের ইন্সপেক্টর মারুফের সাথে কথা হয়েছে। শুনলাম তিনি আপনাদের অনেক হেল্প করেছেন। আপনি তার সাথে যোগাযোগ করে, তাকে নিয়ে আমার ফ্লাটে যাবেন। বাবা ভাইয়াকে ফ্ল্যাটের নতুন চাবিটা দাও।’
শিহাব বলল,
‘আমরা ওখানে গিয়ে কী করব?’
‘শশীর পক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করবেন।’
‘সেটা কীভাবে?’
‘আগে ফ্ল্যাটে পৌঁছান তারপর কল করে আমি সব বলে দিব। এখন বলব না, কারণ দেয়ালেরও কান আছে।’
শিহাব বলল,
‘ঠিক আছে। আমি ট্রাভেল এজেন্সিতে কল করে টিকিট কনর্ফম করছি।’
‘টিকেট করা হয়ে গেছে ভাইয়া। পাঁচটার ফ্ল্যাইট। রাতে তো ফিরতে পারবেন না, ফিরবেন কাল সকালের ফ্ল্যাইটে সে টিকিটও কনর্ফম করা। তবে রাতে ভুলেও আমার ফ্লাটে থাকবেন না। প্রমাণ চুরি হয়ে যাবে। আপনি মারুফ সাহেবকে বলে একটা ব্যবস্থা করে নিবেন।’
রাযীনের কাজের গতিতে শিহাব আবারও অবাক হলো। বেশ মুগ্ধ হয়ে বলল,
‘তুমি আমার চেয়ে কত ছোটো অথচ তোমার বুদ্ধিমত্তা বিচক্ষণতা দেখে আমি মুগ্ধ।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি আর দেরী না করে বেরিয়ে পড়ুন।’
শিহাব বেড়িয়ে যাবার পর রায়হান রহমান বললেন,
‘এখন কী করবি?’
‘বাবা তোমার বউ মাকে জড়িয়ে ধরতে পারল ভালো হতো।’
রায়হান রহমান হেসে বললেন,
‘আমি তোর বাবা।’
‘আমি কখন বললাম তুমি আমার মামা?’
রায়হান রহমান হেসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে নিজের চোখের কোণে জমা আনন্দঅশ্রু মুছলেন। তারপর বলল,
‘বউ মাকে রবিবার জড়িয়ে ধরিস আপাতত আমাকে ধর।’
রাযীন হেসে বলল,
‘তুমি আর আমার বউ কি এক হলা নাকি? তোমার শরীর শক্ত, আমার বউটা তুলোর মতো নরম।’
রায়হান রহমান, রাযীনের কান টেনে বলল,
‘এত দিন অসুস্থ থেকেও তোর বাদরামি মোটেও কমেনি।’
রাযীন হাসল।
সবার সাথে কথা বলে, রাযীন ডাক্তার সাহিনকে বলল,
‘ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ। আপনার সাথে আমাদের কোনো রকম সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও, আপনি যা করলে তা তো রক্তের সম্পর্ক থাকলেও কেউ করে না! ধন্যবাদ ভাই।’
ডাক্তার সাহিন হেসে বলল,
‘ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নাই। আমিও তো মানুষ। তার উপর ডাক্তার। পেশাগত ধর্ম, মানুষের জীবন বাঁচানো। তবে আপনার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছি না।’
রাযীন হাসল। তারপর বলল,
‘আপনি প্রমাণ করলে ভালো মানুষ পৃথিবীতে সত্যিই এখনও আছে।’
ডাক্তার সাহিন হেসে বলল,
‘আপনি আরও আধাঘন্টা এখানে থাকতে পারেন। আপনার বাবার সাথে কিছু বলার হলে বলে নিন। আমার একটু রোগী দেখতে যেতে হবে। বিশ মিনিট পর আসছি।’
ডাক্তার সাহিন চলে যেতেই রাযীন বলল,
‘বাবা তোমার ফোনটা দাও। তোমার বউমাকে একটু দেখি।’
‘আমার বউমা না বলে, বল তোর প্রাণটাকে একটু দেখি।’
রাযীন আবারও হাসল।
রাযীন একজন লেডি পুলিশ অফিসার তানিয়াকে কল করে, শশীকে ভিডিও কলে দেখতে বলল। অফিসারটা রাযীনের খুব ভালো বন্ধু। ওরা একসাথে অনার্স করেছে। সে কারণে রাযীনের সাথে তার সম্পর্কও খুব ভালো। বলতে গেলে তিনিও শশীর সেফটির দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছেন। তাকে রাযীন অনুরোধ করল একবার শশীকে ভিডিও কলে দেখাতে। তিনি ব্যাক ক্যামেরা অন করে চুপি চুপি শশীর অপর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। শশী তখন অন্য একটা মেয়ে আসামীর সাথে গল্প করছিলো। রাযীন গভীর ভাবে শশীর দিকে চেয়ে রইল। শশীর অবস্থা দেখে ওর খুব কষ্ট লাগছিলো। মনে মনে বলল,
‘আর মাত্র তিনটা দিন শশী। তোমাকে আর কষ্ট করতে দিব না। বিগত তিনমাসে তুমি যে কষ্ট পেয়েছো তার সবটা আমি পুষিয়ে দিব। আগের চেয়েও অনেক অনেক বেশি ভালোবাসবো।’
শশীর সাথের মেয়ে কয়েদীটা বলল,
‘বাহ্! শশী আপু তোমার লাভ স্টোরী তো সুন্দর। একটা কথা বলো ভাইয়া তোমার কাছে মাত্র একবার এসেছিলো, এতেই প্রেগনেন্ট হয়ে গেলা?’
শশী লজ্জাময় ভঙ্গিতে হেসে বলল,
‘ব্যাটে বলে মিলে গেলে প্রথম বলেই ছক্কা হয়। আর ম্যাচও জিত যায়।’
মেয়েটা শব্দ করে হাসল। ওদের কথা শুনে হাসল রাযীনও। আর বলল,
‘পাগলী একটা।’
যে পুলিশ অফিসারটা কল করেছিলো সে বলল,
‘রাযীন তুই দেখছি ভালোই ছক্কা মারিস।’
রাযীন লজ্জা পেলো।
চলবে…
#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখিকা: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব:৪৪
‘রাযীন তুই দেখছি ভালোই ছক্কা মারিস।’
রাযীন লজ্জা পেলো। বলল,
‘ঐটা আমার দুষ্টু পাখি। মাঝে মাঝেই এমন উদ্ভট কথা বলে!’
‘শোন রাযীন, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। তোর সাথে থেকে আমরা কম বাদরামি শিখেছিলাম, যে তোর বউ শিখবে না!’
রাযীন হাসল। তানিয়া বলল,
‘সরি রাযীন।’
‘কেন?’
‘সবার মতো আমিও ভেবেছিলাম শশী তোকে মারতে চেয়েছে। সে কারণে এতদিন শশীকে বিভিন্ন প্রবলেমে পড়তে দেখেও হেল্প করিনি বরং মজা নিয়েছি।’
‘কী প্রবলেম?’
‘জেল খানার ভিতরেও অনেক পলেটিক্স চলে। অনেক খারাপ অপরাধীরা অন্যদের খুব বিরক্ত করে। ঐ যে করে না, সবলরা দুর্বলের উপর অত্যাচার তেমন। এসব জেলখানার মধ্যে সাধারণ বিষয়। আর তোর শশী দুনিয়ার ভ্যাদা মার্কা মাইয়া। কেউ কিছু বললে কিছু তো বলতোই না, উল্টা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। এটা নিয়ে অনেক মহিলা কয়েদী ওকে খুব বিরক্ত করেছে। ওকে দিয়ে নিজেদের কাজও করিয়ে নিয়েছে তারা। এমন ভ্যাদা মার্কা মেয়েকে তুই কীভাবে এত ভালোবাসলি?’
রাযীন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘ও ওখানে অনেক কষ্টে অাছে নারে!’
‘হ্যাঁ তা তো থাকবেই। জেলখানায় কী কেউ সুখে থাকে?’
‘ও ভ্যাদা মার্কা মেয়ে নারে। খুব চঞ্চল আর মিষ্টি আমার শশীটা। তবে পরিস্থিতি ওকে এমন করে ফেলেছে। আমার সাথে এত কিছু ঘটল, তার দায় ওর উপর পড়ল। সব কিছু মেয়েটা নিতে পারেনি। তার উপর হুট হরে প্রেগনেন্ট হয়ে গেল। তাই এমন হয়ে গেছে। একবার আবার আমার কাছে আসুক ওকে আবার আগের মতো করে ফেলব। তানিয়া ক্যামেরাটা ওর দিকে কর। ওকে একটু দেখি।’
তানিয়া, রাযীনের কথায় বেশ মুগ্ধ হয়ে বলল,
‘খুব ভালোবাসিস শশীকে?’
‘ভীষণ।’
‘তার মানে আমাদের বন্ধুদের করা ভবিষ্যতবানী সত্যি হলো।’
‘কোনটা?’
‘ভার্সিটি লাইফে যখন কারও প্রেমে পরিসনি তখন বলেছিলাম না, তুই যখন কারও প্রেমে পড়বি, তখন নিজের সবটা দিয়ে, ভেঙেচুরে শুধু তাকেই ভালোবাসবি।’
‘হ্যাঁ তোদের ভবিষ্যতবানী সত্যি হয়েছে। এবার শশীকে দেখি।’
রাযীন দেখল শশী একা বসে আছে। ওর পাশের মেয়েটা ওর সাথে নেই। একা বসে আনমনে নিজের পেটে হাত বুলাচ্ছে আর মিট মিট হাসছে। রাযীন বুঝতে পারল, শশী ওদের বাচ্চার সাথে কথা বলছে। রাযীনও হাসল। রাযীন আরও কিছুক্ষণ শশীকে দেখে কল কাটতে চাইলে তানিয়া বলল,
‘ওয়েট কাটিস না। শশীর সাথে দু মিনিট কথা বলি শোন। দেখি তোর ভ্যাদা মার্কা বউটা কী বলে?’
তানিয়া, শশীর পাশে বসে বলল,
‘হ্যালো শশী।’
‘হ্যালো অফিসার।’
‘তোমার শরীর এখন কেমন?’
‘আজ একটু বেটার।’
‘আজকের লাঞ্চ কেমন ছিলো?’
‘লাঞ্চ তো আজ মা পাঠিয়েছিলেন। খুব ভালো ছিলো।’
‘এখানে একা একা বসে কী বিড়বিড় করছিলে?’
‘আমার বাচ্চার সাথে কথা বলছিলাম।’
‘বাহ্।’
তানিয়া, শশীর পেটে হাত বুলিয়ে বলল,
‘কয় মাস চলছে তোমার?’
‘তিন মাস।’
‘বাহ্! লাথি টাথি মারে?’
‘এত তাড়াতাড়ি তো তা বোঝা যাবে না।’
‘ওহ। তা কী কথা বলছিলে?’
শশী লজ্জা পেয়ে বলল,
‘কিছু না।’
‘আরে আমাকে বলো? আমি তো তোমার চেয়ে বেশি বড় হবো না। বলো? নয়তো বড় বোন ভেবেই বলো?’
‘ওকে বলছিলাম, তুমি আমার জীবনে নতুন সকাল নিয়ে এসেছো। একদিন বিকালে সকাল হয়েছিলো, সে সকালের শুভাগমনে তোমার শুভ আগমন হচ্ছে।’
তানিয়া মাথা চুলকে বলল,
‘কথার মাথা মুন্ডু কিছুই তো বুঝলাম না। বিকালে সকাল কী করে হয়?’
‘আপনি বুঝবেন না। এ কথার মানে শুধু আমি আর আমার বর রাযীন বুঝবে।’
‘খুব ভালোবাসো বুঝি রাযীনকে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কতটা?’
‘এতটা যে, ও যদি বলে শশী এখন মরে যাও, আমি সত্যি সত্যি মরে যাব। তার জন্য দুইবার ভাবব না!’
রাযীন মনে মনে বলল,
‘পাগলীটা আমার। আমি তোমাকে কেন মরতে বলব?’
তানিয়া বলল,
‘আচ্ছা শশী তুমি বসো আমি আসছি।’
‘ওকে অফিসার।’
শশীর থেকে দূরে গিয়ে তানিয়া রাযীনকে জিজ্ঞেস করল,
‘শশীর কথা কিছু বুঝেছিস?’
‘হ্যাঁ সবটাই বুঝেছি।’
‘আমাকেও বুঝিয়ে বল।’
‘বোঝার বয়স হয়নি তোর। যা পুলিশগিরি কর।’
‘মনে রাখিস।’
‘আচ্ছা রাখব।’
‘এখন রাখছি।’
‘শশীর দিকে নজর রাখিস।’
‘আচ্ছা।’
রাযীন কল কেটে আবার স্টেচারে শুয়ে পড়ল। ডাক্তার সাহিন ওকে আবার ওর কেবিনে দিয়ে আসল। রাযীন শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল, ও এত দ্রুত কীভাবে সুস্থ হলো? মাস খানিক আগে শশী যখন ওকে দেখতে আসে সেদিন শশীকে আটকাতে গিয়ে বিস্ময়করভাবেই ওর ডান হাতটা কাজ করা শুরু করে। তখন অতটা খেয়াল না করলেও, পরে ডাক্তার যখন থেরাপি দিতে নিয়ে গেছিলো, তখন খেয়াল করল, ওর ডান হাতটা ভালোই কাজ করছে। রাযীন চেষ্টা করে দেখল ও কথাও একটু আধটু বলতে পারছে।
ডাক্তার সাহিন, রাযীনকে এ বিষয়টায় বিস্তারিত বুঝিয়ে বলেছিলেন,
‘রাযীন সাহেব, মস্তিষ্ক থেকে স্নায়ু যখন নামে, তখন তা স্পাইনাল কর্ডের জাংশনে এসে দিক পরিবর্তন করে। মস্তিষ্কের বাঁ দিক থেকে নামলে স্পাইনাল কর্ডের পরবর্তী অংশে ডান দিকে চলে যায়। তাই মস্তিষ্কে যদি বাঁ দিকে ইনজুরি হয়, তা হলে ঘাড় থেকে নীচের অংশে শরীরের ডান দিকে প্যারালিসিস হয়ে যায়। আপনার ক্ষেত্রেও সেইম হয়েছিলো। কিন্তু সময়ের সাথে আপনার মাথার ইনজুরি ঠিক হয়ে যায় এবং আপনার স্নায়ুগুলো সঠিকভাবে চলাচল শুরু করে। এখানে আপনার স্ত্রীর কোনো হাত নেই। আপনি আগে থেকেই বেশ সুস্থ ছিলেন কিন্তু তখন উত্তেজিত হয়ে আপনার স্ত্রীকে ধরতে পেরেছিলেন বলে মনে হচ্ছে তার কারণে ঠিক হয়েছেন! আপনার সব রিপোর্ট এমনি নরমাল। আপনি খুব অল্প সময়েই সেরে উঠবেন। আপনার পরিবারকে জানানো উচিত যে আপনি সুস্থ হচ্ছেন।’
তখন রাযীন, ডাক্তার সাহিনকে হাত দিয়ে নিষেধ করেছিলো। ডাক্তার সাহিন ঠিকভাবে বুঝলেন না। কারণ রাযীন তখনও ঠিকভাবে কথা বলতে পারছিলো না। রাযীন তার সামনে থাকা ট্যাবটা চেয়েছিলো। কারণ ওর ডান হাত দিয়ে লেখার মতো শক্তি এখনও হয়নি আর বাম হাত দিয়ে লিখতে ও পারে না। সে কারণে ট্যাবে কিবোর্ড অপশন এনে সেখানে অনেকটা সময় নিয়ে বেশ কিছু লেখা টাইপ করল বাম হাত দিয়ে। তারপর ট্যাবটা ডাক্তার সাহিনকে দিলো। সেখানে লেখা ছিলো,
‘আপনি দয়া করে কাউকে বলবেন না, যে আমি দ্রুত সুস্থ হচ্ছি। আমার কেবিনে আমি একটি হিডেন ক্যামেরা দেখেছি। আমার মনে হয়, কেউ একজন সবসময় আমার উপর নজর রাখে। আমাকে যে মারতে চায় সে যদি জানতে পারে, আমি সুস্থ হচ্ছি তাহলে আমার এবং আমার স্ত্রীর অসুবিধা হবে। আপনি প্লিজ কয়টা দিন চুপ থাকুন এবং এমন অভিনয় করুন যাতে সবাই জানে যে, আমি সুস্থ নয় বরং আরও অসুস্থ হচ্ছি। বেশি না, জাস্ট ক’টা দিন। আমি একটু ঠিকভাবে কথা বলতে পারি সে পর্যন্ত ওয়েট করুন।’
ডাক্তার সাহিন, রাযীনের কথায় রাজি হলেন। এবং রাযীনকে হেল্প করতে চাইলেন। সঠিক ট্রিটমেন্ট এবং থেরাপির কারণে রাযীন ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছিল কিন্তু সবার কাছে আরও অসুস্থ হওয়ার ভান করছিলো। রাযীন সবসময় ভাবত কে হতে পারে আসল দোষী। তখনই একদিন গভীর রাতে রাযীনের কেবিনে মুখোশ ধারী এক ডাক্তার আসল। ঠিক ডাক্তার না, ডাক্তারের বেশ ধারী কেউ। যে রাযীনকে ইনজেকশন দিতে চাইলে রাযীন বাম হাত দিয়ে তার হাতটা ধরে ফেলে। সে ভয় পেয়ে, কোনোমতে পালিয়ে গেলেও রাযীন তাকে ঠিকই চিনতে পারল। তার চোখ দুটো রাযীনের অচেনা নয়। ছোটোবেলা থেকে চেনে চোখ দুটোকে। একসাথে বড় হয়েছে চোখ দুটোর সাথে। রাযীনের তারপরও মনে হলো এটা ওর মনের ভুল। নিজ মনের সাথে মস্তিষ্কের দ্বন্দ চলতে লাগল বেশ কিছুদিন। ততদিনে রাযীন ঠিকভাবে কথা বলতে পেরে গেছে। ওর ডান হাত ঠিকভাবে কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। শুধু পায়ে ভর দেওয়া বাকি মাত্র।
তখন সবচেয়ে বড় বোমটা ফাটালো রোমিসা। একদিন বিকালে রোমিসা এসে রাযীনের সামনে খুব কান্না করতে লাগল। রাযীন হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে? রোমিসা কান্নার দরুণ কিছুই বলতে পারছিলো না। হিচকি দিয়ে কাঁদতে লাগল। রোমিসা কিছু বলতে যাবে, তখন ডাক্তার সাহিন আসল রাযীনকে থেরাপির জন্য নিয়ে যেতে। রাযীন, রোমিসাকেও ওর সাথে নিয়ে থেরাপি যে কক্ষে দেয় সেখানে গেল। রোমিসা চোখ মুছে ওদের সাথে গেল। থেরাপি রুমে যাওয়ার পর রাযীন রোমিসাকে জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে তোর? ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিস কেন?’
রোমিসা এত অবাক হলো যে কিছুসময় কোনো কথাই বলতে পারল না। কিছুক্ষণ পর বলল,
‘ভাই তুই কথা বলতে পারিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘এখন বল কাঁদছিস কেন?’
‘ভাই অর্ক আমাদের সবাইকে চিট করছে?’
‘মানে?’
‘কিছুক্ষণ আগে ও তোর সাথে দেখা করতে আসছিলো?’
‘হ্যাঁ। তো?’
‘তখন ও ওর হাতের ঘড়িটা ভুলে কেবিনে ফেলে রেখে যায়। আমি সেটা দিতেই ওর পিছু পিছু যাই। ও হাসপাতালের বাইরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কার সাথে যেনো কথা বলছিলো। আমি আগে পরে কিছু শুনিনি বা বুঝিনি তবে ও কাকে যেনো বলছিলো, ‘শশীর পেটের সন্তানকে নষ্ট করার ব্যবস্থা করুন। রাযীনের কোনো ওয়ারিশ এ পৃথিবীতে আসবে না।’
ভাই কথাটা শুনে আমি আর ওর সামনে যাইনি। দৌঁড়ে চলে আসছি। তবে কী সবকিছুর পিছনে অর্ক? কিন্তু কেন? ও কেন এমন করবে? কীভাবে করবে?’
রাযীন কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর বলল,
‘ইফ আই এ্যাম নট রং এর পিছনে সুমি আপা এবং তার জামাই রাসেলও আছে। সুমি আপার ছোটো ভাই অর্ক। অর্ক সিঙ্গাপুর বসে একা কখনও এসব করতে পারবে না।’
রোমিসা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘অর্ক এসব কেন করবে?’
রাযীন কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,
‘বাবার সম্পত্তির জন্য।’
‘কিন্তু ভাই সম্পত্তি বড় আব্বুরও কম নেই।’
‘অর্কের বাবা মানে বড় আব্বু আর আমাদের বাবা দুজন আপন ভাই হলেও বাবা লাইফে যতটা সফল ততটা বড় আব্বু নয়। বড় আব্বুরও অনেক আছে কিন্তু আমাদের বাবার তুলনায় তা নগণ্য। তো অর্ক কোটিপতি হওয়ার জন্য একটা দীর্ঘমেয়াদী প্ল্যান করল।’
‘কিন্তু তোকে বা তোর বাচ্চাকে মারলে ও কীভাবে বড়লোক হবে?’
রাযীন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘তুই সত্যি বাচ্চারে রোমিসা। আমাদের বাবার ওয়ারিশ আমরা দু’জন। আর সম্পত্তির সিংহভাগ ছেলেদের দেওয়া হয়। তো আমি অথবা আমার কোনো ওয়ারিশ যদি না থাকে, তবে সব সম্পত্তির একমাত্র মালিক হবি তুই এবং তোকে যে বিয়ে করবে সে।’
রোমিসা এবার আরও কান্না করতে করতে বলল,
‘তারমানে অর্ক আমাকে সত্যি ভালোবাসে না? আমাকে ফাঁসিয়েছে সম্পত্তির জন্য?’
‘হয়তো? আচ্ছা তোদের সম্পর্কে প্রথম কে প্রপোজ করেছিলো?’
‘অর্ক-ই।’
‘কিন্তু তুই বাসায় যখন বললি, তখন তো বললি তুই অর্ককে পছন্দ করতি।’
‘করতাম তো পছন্দ। কিন্তু বড় চাচাতো ভাই বলে বলার সাহস করিনি কখনও। তাছাড়া অর্ক তো তোর চেয়ে মাত্র বছর খানিকের ছোটো। বয়সেও আমার চেয়ে কত বড়। আর তাছাড়া অর্কের পিছনে কত মেয়ে ঘুরত। সত্যি বল ভাইয়া অর্কের মতো সুন্দর ছেলে তুই দেখেছিস কখনো? সে কারণে ওকে বলার সাহসই পাইনি কখনও। কিন্তু সে কীভাবে যেনো বুঝে ফেলে, আই লাভ হিম। তো সে প্রপোজ করে। আমি তো স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি আমার স্বপ্নের পুরুষ আমাকে ভালোবাসে। আমিও না করিনি। প্রেম হওয়ার কিছুদিন পরই ও আমাকে আমাদের সম্পর্কের কথা ঘরে জানাতে বলে। আমি ওর সততায় মুগ্ধ হয়ে সবাইকে জানালাম সাথে একটা মিথ্যা বললাম আমি ওকে প্রপোজ করেছিলাম। আর তোরাও সবাই খুশি মনে রাজি হয়ে আমাদের ঘরোয়াভাবে এনগেজমেন্ট করে ফেললি।’
রাযীন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘এখন সবই পানির মতো ক্লিয়ার মনে হচ্ছে। কিন্তু আসল খুনীর সন্ধান পাওয়ার পরও আমার কাছে কোনো ক্লু নেই, যা দিয়ে শশীকে বাঁচাবো। তবে প্রথমে শশীর নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। এ কাজে আমার বন্ধু তানিয়া আমাকে হেল্প করতে পারবে।’
তারপর রাযীন তানিয়াকে কল করে শশীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। এবং বিষয়টা খুব গোপন রাখতে বলে। এতদিন পর্যন্ত রাযীন শুধু বারবার ভাবছিলো কীভাবে শশীর পক্ষে প্রমাণ যোগার করা যায়। কাল হঠাৎ করেই ওর মাথায় আসল। তারপর নিজেকে নিজেও কিছুক্ষণ গালাগাল করল। কেন এত জরুরি বিষয়টা ও ভুলে গেছিলো? এটা ভোলার মতো কোনো বিষয়ই না। তবুও গাধামি করে ভুলে গেছিলো। রাযীন, শিহাবকে কিংবা মারুফকে আগাম কিছু বলেনি। তারা ফ্ল্যাটে পৌঁছে ডাক্তার সাহিনকে কল করবে। ডাক্তার সাহিন তখন রাযীনের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিবেন। রাযীন মনে মনে বলল,
‘হে আল্লাহ আমার ধারণা যেনো সত্যি হয়। প্রমাণ যেনো ওখানেই পাই।’
৬৯!!
কদিন যাবত রেনুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। হালকা সর্দি, জ্বর, কাশি লেগেই আছে। সারাক্ষণ মাথা ব্যথা করছে। রেনু তুলসী পাতার রস নিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে হাসি বেগম তুলসী পাতার রস দিয়ে গেছেন কিন্তু সেটা গলধঃকরন করার ধৈর্য্য রেনুর হচ্ছে না। রেনু সামনে রাখা কাপটার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এসব পাতা ছাতা খেতে আমার একদম ভালো লাগে না। তার চেয়ে কতগুলো ট্যাবলেট খাওয়া ভালো।’
হাসি বেগম রেনুর কান ধরে বললেন,
‘তা কেন ভালো লাগবে? এসব ভালো জিনিস কেন ভালো লাগবে? ভালো লাগবে হাড়, মাংস দিয়ে বানানো ট্যাবলেট। যা খেলে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষ সুস্থ তো হয় কিন্তু ভিতর থেকে অন্য রোগ আক্রান্ত করে। চুপচাপ তুলসী পাতার রসটা খেয়ে ফেল। কাশি কমে যাবে। আমি যেনো তোর খুক খুক আর শুনতে না পাই।’
রেনু বলল,
‘মা।’
হাসি বেগম চোখ রাঙিয়ে বললেন,
‘চুপ। খা জলদি। এটা তেতো না।’
রেনু কোনো উপায় না পেয়ে রসটা এক ঢোকে গিলে পানি খেলো। হাসি বেগম হাতে মিছরির একটা টুকরা দিয়ে বলল,
‘এটা তালমিছরি। মুখে দে মুখের তেতো ভাবটা কমে যাবে।’
রেনু মিছরি মুখে দিয়ে চুপ করে বসে রইল।
চলবে….