সোনালী আলোর ঘ্রাণ পর্ব-১০

0
486

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ১০
(নূর নাফিসা)
.
.
বিস্তর মাঠের অনেকাংশই এখন ফাঁকা দেখায়। সদ্য কাটা ধানের গোছা পাকাপোক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশমুখী। তাদের রূপের সতেজতা জানান দিচ্ছে শীঘ্রই নতুন পাতা মেলে দিবে কাটা গোছাতেই। শূন্য মাঠটাকে সবুজের রঙে রাঙিয়ে পূর্ণতা টেনে দিবে। মনে হবে, আইলের সামান্য দূরত্বে এক একটা সবুজ চাদর বিছিয়ে রাখা আছে ক্ষেতে। গরু, ভেড়া ও ছাগলের লম্বা গোছা টানবে গৃহস্থালির লোকেরা। বেলা শেষে পেটপুরে বাড়ি ফিরবে গৃহপালিত পশুর দল। বিশাল আকাশটার আলোর ঝলকানিতে বেলার শুরু ও সমাপ্তি ঘটে। আকাশপানে তাকালেই সময়ের শুদ্ধতা বুঝে যায় সৃষ্টিকূল।
বিকেলের সোনালী আলো রক্তিম হতে লাগলেই ধান তুলে ফেলা হলো বাড়ির বাইরের এবং ভেতরের উঠুন থেকে। বাবাছেলেরা মাথায় ধানের বস্তা তুলে ঘরের কোণে ও বারান্দায় স্তুপ ফেলছে৷ তার পরপরই গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো খড়ের গাদা। নিচু ফাঁকা জমিতে আটি আটি খড় রোদে শুকাতে দিয়েছিলো। প্রতি সকালে রোদে শুকাতে দিয়ে সন্ধ্যা লগ্নে গোসলের আগে গুটিয়ে ফেলা হয়। নয়তো বৃষ্টি হলেই পরিশ্রম বৃথা যাওয়ার সম্ভাবনা। কাজ শেষ হলে সবাই বাড়ি ফিরলেও আজমাইন আর সিয়াম নেমে গেছে পুকুরে। সাথে নামার জন্য আরও অপেক্ষা করছিলো সঙ্গীরা। এই সন্ধ্যা বেলাও তাদের ঝাপাঝাপি আর সাঁতার কাটা চললো দীর্ঘ সময়। তারপর ফুরফুরে মেজাজে ঠান্ডা ভেজা শরীরে বাড়ি ফিরলো তারা। যেন শরীরের ময়লার সাথে সাথে সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দিয়েছে পুকুরের পানির শীতলতা। বারান্দায় কাপড় বদলে ঘরে এসে খাঁটি সরিষার তেল মাখালো বাবা ছেলেরা। এই তেল খড়কুটোর চুলকানি থেকে রক্ষা করবে তাদের ধারণা। পরবর্তীতে পুরুষেরা অবসর সময় কাটালেও দুই ঘরের রমণীরাই রাতের রান্নার আয়োজনে বসলো। ধানের দিনে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা একটু নয়, অনেকটাই গোল্লায় যায় সবসময়। অথচ সামনে সবারই বার্ষিক পরীক্ষা দাঁড়িয়ে।
দুপুরে মরিয়মের কাছে যাওয়ার কথা থাকলেও যেতে পারেনি আমজাদ আলী। ধানের কাজে ব্যস্ত থেকে জানিয়েছে সন্ধ্যায় যাবে। মরিয়ম আবার সন্ধ্যায় আহমদ আলীর ফোনে কল করে জানালো, এতো ব্যস্ততা ফেলে আমজাদ আলীকে যেতে হবে না। সে-ই আগামীকাল আসবে এ বাড়িতে। রাতে খাবার নিয়ে শ্বশুরের ঘরে এলো সেলিনা বেগম। থালা বাটি টেবিলে রাখতেই আহমদ আলী বললেন,
“ছোট বউ…”
“জ্বি আব্বা?”
“মোয়াজ্জেম কই?”
“উনি তো পোলারে নিয়া বাইরে গেলো হাওয়া বাতাস খাইতে। সারাদিন কাজ করলো না? পোলায় পিছু নিছে আইসক্রিম খাওয়ার লাইগা।”
“ও.. কথা ছিলো কিছু দুজনের সাথেই।”
“কি কথা, আব্বা?”
“মৌসুমীরে তো বিয়া দিবা, নাকি?”
সেলিনা বেগম হাসি টানলেন মুখে।
“জ্বি, আব্বা। মাইয়া বড় যতক্ষণ হইছে, বিয়া তো দেওন লাগবোই।”
“পাত্রপুত্র ঠিক কইরা বসো নাই তো আবার?”
“কি যে কন, আব্বা। পাত্র ঠিক করলে আপনে জানবেন না?”
“হু, তাও যদি পছন্দ কইরা থাকো আরকি। তাই জিগাই।”
“না, না আব্বা। করি নাই। আপনে যদি বাহার উদ্দিন ভাইরে কইতেন একটু দেখতো। আপনার পোলারে তো চিনেনই। কেমন খামখেয়ালি করে সবকিছুতেই। মাইয়ার বিয়ার ব্যাপারে একদমই ভাবতাছে না। খালি কয়, আল্লাহ হুকুম করলে এমনি হইয়া যাইবো। কিন্তু হুকুমজারি হওয়ার জন্যে যে চেষ্টা করতে হয়, অইটা বুঝাইতেই পারি না।”
“থাক, আর বুঝাইয়া কাজ নাই। আমি বিয়া ঠিক কইরা ফেলছি। এইবার আল্লাহ হুকুম করলেই হয়। আজমাইনের সাথে হইবো মৌসুমীর বিয়া। বুঝছো?”
“আজমাইনের সাথে?”
মুহুর্তেই যেন হাসিমাখা মুখটা চিন্তার রেশ ফুটালো। আহমদ আলী তার মুখভঙ্গি দেখে বললেন,
“তোমার মুখটাও যেমন শুকায় গেলো?”
সেলিনা বেগম জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললো,
“তেমন কিছু না, আব্বা। শুকাইবো ক্যা? কিন্তু আজমাইন তো ছোট। কর্মজীবনে পা রাখে নাই এখনো। এতো ছোট পোলার কাছে…”
“ছোট ছোট কইরো না। তোমার মাইয়ার চেয়ে ছোট? আর কর্মজীবনে ঢুকতে কয়দিন? না ঢুকলেও তোমার চিন্তা করতে হইতো না। আরও নিশ্চিন্তায় থাকবা মাইয়ারে চোখের সামনে ভালো খাইতে পরতে দেইখা। আমজাদের তো অর্থকড়ি কামাই কম হইতাছে না। বিয়া আজমাইনের সাথেই হইবো। মরিয়মের মতো আবার ত্যাড়ামি কইরা বইসো না। মাহতাব আর আজমাইনের বিয়া এক দিনেই হইবো। তোমার খরচাপাতিও তবে কম যাইবো। কাল থাইকো, আল্লাহ বাঁচাইলে সবাইরে সামনে নিয়া একটা ভালো দিনক্ষণ ঠিক কইরা ফেলমু। মোয়াজ্জেম ফিরলে আমার কাছে পাঠাইয়ো।”
“জ্বি, আব্বা।”
তার মুখভঙ্গি দেখে একটু ধার গলায়ই কথা বললেন আহমদ আলী। তিনি জানেন, এই বউটাও তার মেয়েটার মতো একটু আপত্তিজনিত এবং চাপাটে স্বভাবের। একমাত্র বড় বউটাই সরল এবং হাসিখুশি থাকে সবসময়। কিঞ্চিৎ গম্ভীরমুখেই চৌকাঠ পার হলেন সেলিনা বেগম। কিছুক্ষণ পর মৌসুমী এলো থালাবাটি নিতে।
“দাদাজান, খাইছো?”
“হু, ভাই। এসব নিয়া যা।”
“যাই। এজন্যই আসছি। ওষুধ খাইছো?”
“হু। শোন, দাদাভাই?”
“কি?”
“তোর বিয়া কিন্তু আজমাইনের সাথেই হইবো। ঠিক আছে?”
মৌসুমী লাজুক ভঙ্গিতে খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
“হুম, একদম ঠিক আছে দাদাজান।”
“তুই খুশি তো?”
“অনেক খুশি। একদম দাদির মতো কারণে অকারণে খুব খুশি।”
আহমদ আলী হাসলেন।
“তুই তো আমার ছোট গিন্নিই।”
“হো। আরও কোনো দরকার আছে?”
“তোর বড় মা রে একটু ডেকে দিস।”
“আচ্ছা।”
মৌসুমী থালাবাটি হাতে নিয়ে আগে বড়মার ঘরের সামনে এসে ডাকলো। পরবর্তীতে উঠুন পেরিয়ে তাদের ঘরে গেলো। যাওয়ার আগে আজমাইনকে দেখে গেলো সেই ঘরে উঁকি দিয়ে। ভাবতেই ভালো লাগে, এই ঘরটা তার হয়ে যাবে। হালিমা খাতুন শ্বশুরের ঘরে এসে বললো,
“আব্বা, ডাকছিলেন?”
“হু।”
“ওষুধ খাইছেন আপনে?”
“খাইছি। শুনো, আরেকটা কথা জানাইতে ডাকছি।”
“জ্বি, আব্বা?”
“আমি কইলে মৌসুমীরে ছেলের বউ বানাইবা না?”
“আল্লাহ! কি কন আব্বা! মৌসুমীর আব্বা আম্মা চাইলে বানাইতাম না ক্যা? অবশ্যই বানামু। আমাদের মাইয়া আমাদের কাছে থাকবো, এইটা তো আরও খুশির খবর।”
“আমি জানতাম। জানতাম, তুমি মৌসুমীরে খুব পছন্দ করো।”
“জ্বি, আব্বা। সব কটা পোলাপান আমি ওই ছোট্ট থেকে কোলে তুইলা বড় করলাম না? কি সুন্দর কইরা ডাক দেয় ‘বড় মা’ বইলা। আমার শখের পোলাপান সব।”
হাস্যোজ্জ্বল মুখে কথা বলতে বলতে একটু আবেগী হয়ে উঠলেন হালিমা খাতুন। আঁচল দিয়ে চোখের কোণা মুছে নিলেন সাথে সাথেই। আহমদ আলী বললেন,
“আমি চাই, একদিনেই তাদের বিয়াও সম্পন্ন হোক।”
“আপনি যেইটা ভালো মনে করেন, আব্বা। আমার কোনো আপত্তি নাই।”
“আচ্ছা। ঠিক আছে। যাও তাইলে।”
হালিমা খাতুন বের হতেই শূন্যে তাকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন আহমদ আলী। আল্লাহ যেন নাতিনাতনির সংসার বাঁধা পর্যন্ত হায়াত দান করেন, খুব করে দোয়ায় সেই আশা বাঁধেন তিনি। সঙ্গিনী তো চলে গেলো। কবে না কবে তারও ডাক পড়ে যায়, খুব ভয় হয়। রবের সৃষ্টি এই পৃথিবী দুঃখে কষ্টে ভরপুর থাকলেও ভারি সুন্দর। এর মায়া ছাড়তে ইচ্ছে হয় না কভু। ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবতেই ভয় জন্মে। একা একা কিভাবে পাড়ি দিবে পরকালের পথ? ওইতো, সঙ্গিনী একা একাই পড়ে আছে গোরস্থানে। কেউ কি এক টুকরো আলো জ্বেলে দিবে অন্ধকার কবরে? কি করে থাকবে একা সেই ঘরে? আল্লাহ তার কোন পাল্লা ভারি করে রেখেছেন কে জানে? ভাবতেই ভারি নিশ্বাস পড়লো আহমদ আলীর ভেতর থেকে।
মৌসুমী বই সামনে নিয়ে বসলেও পড়া হলো না তার। চোখ বইয়ের দিকে থাকলেও মনযোগ অন্যত্র ছড়িয়ে। বইটা যেন এক কল্পজগতের আয়না। এই আয়নায় এখন আজমাইন ছাড়া অন্য কিছুই দেখা যায় না। আজমাইন, আজমাইন। এক প্রেমিক পুরুষ, আজমাইন। এই আজমাইন তার হাসিতে হাসে। এই আজমাইন তার দুঃখ মুছে দেয়। দুঃখের দিনেও ঠোঁটের ধার টেনে হাসি ফুটিয়ে দেয় আর বলে, “হাসলে তোকে নায়িকার মতো লাগে। তাই তুই সবসময় হাসবি।” এই আজমাইন মুঠোয় লুকিয়ে বাদাম নিয়ে আসে৷ চুপি চুপি হাতে ঠেসে দিয়ে বলে, “এগুলো তোর। এই পৃথিবীর সব বাদাম ফলে শুধুমাত্র তোর জন্য। তুই প্রতিদিন বাদাম খাবি। আমি তোকে এনে দিবো।” এই আজমাইন তাকে সাজিয়ে দিতে খাদেম আনসারির বাড়ির গেইট থেকে বড় লাল জবা ছিড়ে নিয়ে আসে। সেই জবা তার কানে গুজে দিয়ে বলে, “জবারা শুধু তোর জন্যই ফুটে। ভুলেভালে গাছটা খাদেরমের জমিতে উঠে গেছে।” ঢালু পাড় থেকে বকুল ফুল এনে নিজ হাতে মালা গাঁথে। সেই মালা তার খোপায় জড়িয়ে দিয়ে বলে, “বকুলের মালায় তোকে ফুল পরি দেখায়। আমি নিজ হাতে মালা গেঁথেছি তোর জন্য। আমার মিষ্টি ফুল পরি তুই।” এই আজমাইন তাকে রাঙিয়ে দিতে নিজ হাতে তার পায়ে আলতা পরিয়ে দেয়। মনের মাধুরি মিশিয়ে এঁকে দেয় আলপনা। এই আজমাইন তাকে চমকে দিতে গরমের তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ঢিল ছুড়ে আইসক্রিমও মেরে দেয়। ভেঙে দেয় কল্পজগতের আয়না! ইশ! বইটাই ভিজিয়ে দিলো। কিন্তু এ তো আজমাইন না। সিয়াম নিজে এক আইসক্রিম খেতে খেতে অন্যটা তার সমনে ঢিল মেরে বললো,
“আপু, আইসক্রিম খা। আব্বা কিনে দিছে তোরে একটা। মমোরে একটা। আর আমি খাইছি দুইটা। হি হি হি।”
কথার পরপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে সিয়াম। দুইটা আইসক্রিম খেয়ে সে বড়-ই খুশি। এদিকে তার রাজপুত্র দর্শনের আয়না ভেঙে ফেলায় ভারি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে মৌসুমী। কি সুন্দর এক রোমাঞ্চকর দুনিয়ায় গমন করেছিলো সে। এই ছাগলটা সামনে এসে না দাঁড়ালে হতো না? আব্বা কেন কিনে দিলো আইসক্রিম? এই আইসক্রিম তো তার আজমাইন নিয়ে আসবে এক টুকরো প্রেম মিশিয়ে। বলবে, “এই পৃথিবীর সব আইসক্রিম তৈরি হয় তোর জন্য। গরমকালে তুই প্রতিদিন আইসক্রিম খাবি। আমি নিয়ে আসবো তোর জন্য। প্রয়োজনে আইসক্রিম ফেরি করতে বসবো শুধুমাত্র আমার ফুল পরির জন্য।”

চলবে।