“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ২৬
(নূর নাফিসা)
.
.
“মৌসুমী? এই মৌসুমী? ঘুমিয়ে পড়ছিস? এই মৌসুমী?”
ডাকছে, শুনছে, কিন্তু কোনো সাড়া প্রদান করছে না মৌসুমী। কিছুক্ষণ ডেকে ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে চলে গেলো। ওদিকে মোয়াজ্জেম আলী ঘর থেকে বেরিয়েছেন। এপাশের দরজার সামনে এসে আজমাইনের উদ্দেশ্যে গলা ছাড়লেন,
“আজমাইন আইছোস ঘরে?”
সে দরজা খুলে সাড়া দিলো,
“জ্বি, চাচা।”
“আচ্ছা, তাইলে গেইটে তালা দিলাম।”
“দাও।”
আজমাইন ঘুমানোর জন্য বিছানা গুছালো। মশারি টানালো। মনে হলো বহুদিন পর মশারি ধরেছে। এদিকে বাবার গলা শুনে মৌসুমী তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো। মোয়াজ্জেম আলী তখন গেইটে তালা লাগাতে ব্যস্ত। মৌসুমী উঠুনে নেমে এসে বললো,
“আব্বা, একটু দাঁড়াইয়ো তো। টয়লেটে যামু।”
“যা। দাঁড়াইছি।”
মৌসুমী তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এলো। বাথরুমে যাওয়ার জন্য রাতে একা বের হওয়ার সাহস হয় না তার। মনে হয় পেছন থেকে কেউ খপ করে ধরে ফেলবে। কিংবা বাথরুম থেকে বের হলেই কেউ এসে ভাও করে উঠবে! ভাগ্যিস, বাবাকে পেয়েছে। নয়তো কাকে ডাকতো এখন? বাথরুম থেকে বেরিয়ে একবার ভাবলো বড়মার কাছেই গিয়ে ঘুমিয়ে থাকুক। আবার লাইট নেভানো দেখে ভাবলো ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই আর ডেকে ঘুম নষ্ট করতে গেলো না। রোজার ঘরেই চলে গেলো। মেয়ে ঘরে গেলে মোয়াজ্জেম আলীও চলে গেলো নিজের ঘরে। পরদিনও কেউ কথা বলে না আজমাইনের সাথে। সকালে ঘুম থেকেই উঠেনি সে। কেউ ডাকেওনি৷ ঘুম থেকে উঠে দেখলো রোদে ফকফক করছে বাড়িঘর। অথচ শীতের সকালে রোদের দেখা পাওয়া মুশকিল। বুঝলো দুপুর হয়ে এসেছে। খেয়াল হলো তার ঘরের দরজা এখনো আটকানো। মনে পড়লো, মৌসুমী তো আজ ঘুমায়নি এই ঘরে। নয়তো তার এই সেই কাজের খটখট শব্দে আরও আগেই ঘুম ভেঙে যেতো। ঘর থেকে বেরিয়ে দাদাজানের ঘরের সামনে বারান্দায় মৌসুমীকে দেখে হাই তুলতে তুলতেই হাতে ইশারা করে ডাকলো এদিকে আসার জন্য।
“দেখি হাতটা।”
মৌসুমী এলো না। গোমড়ামুখো হয়ে তাকিয়ে বিপরীতে বারান্দা দিয়ে বাবার ঘরের দিকে চলে গেলো। তার স্পর্ধা দেখে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আজমাইন। হাতমুখ ধুয়ে মায়ের সামনেও গেলো। গোসলে যাওয়ার আগে উঠুন ঝাড়ু দিয়ে ময়লা তুলছিলো হালিমা খাতুন। রান্নাঘরে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো,
“মা, কি রান্না করছো?”
কোনো জবাব এলো না মায়ের কাছ থেকে। আজমাইন মায়ের মুখে তাকিয়ে মনোভাব বুঝার চেষ্টা করতে করতেই রান্নাঘরে গিয়ে প্লেট হাতে নিলো। ভাত নিয়ে খেলো। হুটহাট মাইর খেতে হবে, সেই প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে মনে মনে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। আজ আর বাইরে খেলাধুলা, আড্ডায় যায়নি। বাড়ির বাইরে গেলেও এদিকেই একটু আধটু হেঁটে চলে এসেছে। দুপুরের সময়টা শুয়ে থেকেই কাটালো। বিকেলে আবারও বাইরে গেলে মমোকে গেইটের বাইরে খেলতে দেখলো। ডেকে বললো,
“বাড়ির বাইরে আইছোস ক্যা? উঠানে খেলা যায় না? গেইটের ভেতরে যা!”
“তেঁতুল নিতে আইছি।”
“এই তেঁতুল ভালা না। পঁচাগুলা পড়ে। ফালায় দে। কালকে গোসলের আগে বলিস, পাইড়া দিমু নে। বাদাম খাবি?”
মমো হাতের কুঁড়ানো তেঁতুল ফেলে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে হাসিমুখে বললো,
“হো।”
“আয়, নিয়ে যা।”
আজমাইনের সাথে দোকানে গেলো সে। হাতে দশ টাকার বাদাম কিনে দিয়ে নিজের সাথেই আবার বাড়িতে নিয়ে আসতে আসতে বললো,
“মৌসুমী কি করে?”
“পড়ে, পড়ে।”
“আপুকে নিয়ে বাদাম দিবি। তুইও খাবি। ঠিক আছে?”
“আচ্ছা।”
“আমারে দিয়া যা কয়টা।”
প্যাকেট থেকে নিজ হাতেই পাঁচ-ছয়টা বাদাম তুলে নিলো আজমাইন। মমো রোজার ঘরের দিকে যেতে লাগলে আজমাইন বললো,
“ওদিকে কই যাস? দরজা লাগানো, দেখোস না? তোগো ঘরে দ্যাখ। এদিকে নাই।”
মমো নিজেদের ঘরের দিকেই গেলো। মৌসুমীকে বললে একটু ভাব নিয়ে বাদাম ফিরিয়ে দিলো সে। পাঠিয়ে দিলো আজমাইনের কাছে। আজমাইনের ঘরের সামনে এসে মমো বললো,
“আজাম ভাই, আপু খাইবো না কইছে তোমার বাদাম। আমিই খাই।”
কথাটুকু বলে মমো সরে এলো দরজা থেকে। তার অনেকগুলো বাদাম হয়েছে, এতেই তার বড্ড লাভ। আপু না খেয়ে ভালোই করেছে। কিন্তু মৌসুমী খাবে না জেনে আজমাইন এসে আরও কিছু বাদাম নিয়ে গেলো।
“তুই এতোগুলা খাইতে পারবি না। পেটে অসুখ হইবো। দে, আমিও খাই।”
অর্ধেক প্যাকেটই খালি হয়ে গেলো তার। ব্যাপারটা মন্দ ঠেকলো মমোর। সে কিনে দেওয়াতে কিছু বলতে পারলো না। নয়তো একটা চিৎকার মেরে বসে থাকতো। যদিও আজাম ভাইকে একটু ভালোই বাসে সে, মাঝে মাঝে মজা কিনে দেয় বলে। নয়তো সিয়াম এক টুকরো ধরলেই মাইর দেয়, জেদ দেখায়।
সন্ধ্যায় কাজ সেরে আহমদ আলীর কাছে এলো হালিমা খাতুন।
“আব্বা, ভাত দিমু এখন?”
“আরেকটু পরে খাই। ইশার আজানটা দেক।”
“আচ্ছা। আরেকটা চাদর দিমু?”
“না, না। কম্বলটা নিয়েই বইসা থাকি।”
হালিমা খাতুন এগিয়ে শ্বশুরের গায়ে কম্বলটা ঠিকঠাক জড়িয়ে দিলেন। তারপর বললেন,
“আব্বা, মোবাইলের ব্যালেন্স আছে?”
“আছে তো বোধহয়। কথা কইতা আমজাদের সাথে?”
“না, উনার সাথে তো কথা হইলো গতকাল। মাহতাবের সাথে একটু কথা কইতাম।”
“কও তাইলে।”
“ভাবতাছিলাম মাহতাবরে কইতাম, আজমাইনরে তার কাছে কোনো একটা ব্যবস্থা কইরা দিতে। বাড়িতে আজাইরা থাইকা থাইকা কেমন বাদাইমা হইতাছে দেখতাছেন তো। যা করতাছে, আমার চিন্তায় ভাল্লাগে না। মাথাটা ব্যাথা করে। আর কত বুঝান যায়, বলেন। এই এলাকায় থাকলে পোলা মানুষ হইতো না। ওর বাপে এইসব শুনলে স্ট্রোক করবো। এমনিতেই তো কত চিন্তা করে। পোলাপান নম্রভদ্র হইলে মানুষ করা যায়। এইসব পোলাপান কি সেইভাবে চলে?”
“না। ঠিকই আছে। আমিও তো ভাবতাছিলাম পরীক্ষাটা দিলেই কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করমু।”
“পরীক্ষা দেওয়া লাগবো না। পড়াশোনা করে না তো। বইটা ছুঁইয়াও দেখে না একটা দিন।”
“আচ্ছা, দাও দেখি মাহতাব কি কয়।”
আহমদ আলী নিজের ফোন থেকে কল করলেন। মাহতাব কল কেটে দিয়ে কলব্যাক করলো।
“আসসালামু আলাইকুম, নানাজান।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
“কেমন আছে তোমার শরীরটা?”
“এইতো ভাই, আছি আল্লাহর রহমতে। নে তো, তোর বড় মামী একটু কথা বলবো।”
“দাও।”
“হ্যালো, মাহতাব বাবা?”
“আসসালামু আলাইকুম, মামী। কেমন আছেন?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই। তোমার শরীরটা ভালো আছে?”
“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।”
“আজমাইনরে নিয়া একটু কথা বলতাম তোমার সাথে।”
“কি কথা, মামী?”
“তারে কি ওইদিকে কোনো কাজে টাজে লাগায় দিতে পারবা?”
“কাজে? এখনই কি দরকার। এইচএসসি পরীক্ষাটা শেষ হোক। সার্টিফিকেট হলে ভালো চাকরি পাবে।”
“ওয় তো পড়াশোনার পোলা না। দেখোই তো, কেমন বাঁদরামি করে। তার পড়াশোনা হইতো না। পাড়ায় বাজে পোলাপানের সাথে সারাক্ষণ আড্ডা দেয়, খেলাধূলায় সময় নষ্ট করে। ক’দিন যাবত যা দেখতাছি, পোলা অমানুষ হইতেও সময় নিবো না। তোমার মামা থাকে দূরে, মাঠে ঘাটে গিয়া কে খোঁজ রাখবো কও? দেখো একটা কাজে লাগাইতে পারো কি না। আমার আয়ের খুব জরুরী না। আয় যেমনই হোক, তারে ব্যস্ত রাখো। পরিশ্রমে থাকলে অপকর্মে যাইতে পারবো না। এই এলাকায় রাখা যাইবো না তারে। তুমি একটু চেষ্টা কইরা দেখো।”
মাহতাব কণ্ঠে ভাবনার রেশ টেনে বললো,
“কাজে তো লাগানোই যায়। আচ্ছা মামী, আমি কথা বলে দেখি। ঠিক হলে জানাবো।”
“আচ্ছা, বাবা। তুমি আবার কবে আসবা?”
“এই মাসে আর আসা হবে না। আগামী মাসে আবার হয়তো। আচ্ছা, আমি কোনো ব্যবস্থা করতে পারলে জানাবো আপনাকে।”
“আচ্ছা, ভালো থাইকো।”
“জ্বি, ইনশাআল্লাহ। আপনিও ভালো থাকবেন। দুশ্চিন্তা করবেন না। ব্যবস্থা একটা হয়েই যাবে। রাখি তবে।”
“আচ্ছা।”
কল কাটতেই একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন হালিমা খাতুন। দুশ্চিন্তার চাপে যেন চেহারাটা অসুস্থতার ভাব ফুটিয়ে রেখেছে। আহমদ আলী কিছুক্ষণ কথা বলে সান্ত্বনা দিলেন তাকে। এরই মধ্যে ইশারের আজান পড়লো। ওযুর পানি খাটের ধারেই এগিয়ে দিলো হালিমা খাতুন। সেলিনা বেগমও আজান শুনে এসেছিলেন গরম পানি নিয়ে। দেখলেন হালিমা খাতুনই পানি এগিয়ে দিচ্ছে। তাই পানির কলসি একপাশে রেখে চলে গেলেন তিনি। ইশারের নামাজ আদায়ের পর শ্বশুরের ঘরে খাবার নিয়ে গেলেন হালিমা খাতুন। আজমাইন তখন রাস্তার দিক থেকেই একটু ঘুরেফিরে বাড়ি এলো। সিয়ামের সাথে উঠুনে দুষ্টুমি করতে লাগলো। মৌসুমী সন্ধ্যায় রোজার ঘরে প্রবেশের পর আজমাইন একবার যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলো। কিন্তু দেখলো ভেতর থেকে দরজা আটকানো। ডাকেনি, মা এসে না আবার মাইর শুরু করে পড়ায় বিরক্ত করে ভেবে। এখন সিয়ামের সাথে দুষ্টুমির এক পর্যায়ে হঠাৎ দরজা খোলা দেখায় আজমাইন গেলো। দরজার পাশে গিয়েও যেন থেমে গেলো। ভেতরে হালিমা খাতুন আছেন। মৌসুমীকে ভাত মেখে খায়িয়ে দিচ্ছেন। আজমাইনকে হুট করে যেতে দেখেই তিনি মলিন কণ্ঠে বললেন,
“ভাত গরম আছে, খাইলে খা গিয়া।”
“তুমি খাইছো?”
“না, আমি পরে খামু।”
আজমাইন আবারও উঠুনে নেমে এলো। সিয়ামের দুষ্টুমি আবারও চালিয়ে গেলো। হালিমা খাতুন বেরিয়ে রান্নাঘরে গেলে আজমাইনও গেলো এবার খেতে। মায়ের সাথেই খাওয়া হোক। হলোও তা-ই। পরপরই মৌসুমীর ঘরের দরজা বন্ধ দেখে নিজের ঘরে চলে গেলো। একবার নিজের বই হাতে নিলো। পিছন থেকে শয়তান যেন টেনে ধরে রাখলো। তুই এইসব পারবি না। পড়া তোর দ্বারা হবে না। তোকে দেখে বই হাসবে, টিটকারি মারবে।
মন তার টিকলোই না বইয়ের কাছে। রেখে দিলো যেমন ভাজে ছিলো, তেমনই ভাবে। মশারি টানিয়ে লেপ মুড়ে ঘুমাতে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পরে উঠে আবার বাথরুমে গেলো। দাদার ঘরের লাইট অফ হয়েছে মাত্রই। মায়ের ঘরের লাইটও অফ। চাচার ঘরের দুই রুমের লাইটই জ্বলে আছে। এদিকে দুদিন যাবত হওয়া বিদ্যাসুন্দরীর ঘরে লাইট জ্বলে আছে। যদিও রাত খুব হয়নি, তবুও শীতের সন্ধ্যায়ই চোখে ঘুম নামিয়ে আনে ঠান্ডা এবং অলসতা। বাথরুম থেকে এসে আজমাইন রোজার ঘরের সামনেই এলো। জানালাটা চাপানো ছিলো, কিন্তু আটকানো না। আজমাইন প্রথমে কান পেতে শব্দ শুনতে চেষ্টা করলো, কিন্তু কোনো শব্দ পাওয়া গেলো না। সে কি লাইট জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে গেছে নাকি? আবারও জানালা খোলা! আজমাইন জানালার পাট্টায় ধাক্কা দিতেই মৌসুমীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে লাফিয়ে উঠলো। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো আজমাইনের দিকে। সে এতোক্ষণ ভাবনায় ব্যস্ত ছিলো। পড়তে বসলেই দুনিয়ার যত ভাবনা এসে চেপে যায় তার মাথায়। একেবারে ছোট থেকে বড়বেলা পর্যন্ত ঘটা সকল কাহিনী মাথায় চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এরই মধ্যে জানালাটা খুলে ফেলে বড্ড ভয় পেয়ে গেলো সে। আজমাইন জানালার গ্রিল ধরে উঁকি দিয়ে বললো,
“পড়া কই তোর? এই, তুই কি একবার টয়লেটেও যাস না? সারাক্ষণ বন্দী থাকোস ক্যামনে? ঘরের ভেতরেই টয়লেট করস?”
ঠাস করে জানালাটা লাগিয়ে দিলো মৌসুমী। যার জন্য আসা, তা-ই তো হলো না! আজমাইন টোকা দিতে লাগলো জানালায়। ফিসফিসে গলায় ডাকলো,
“এই, শোন! এই, মৌ।”
পরক্ষণে দরজায় টোকা দিয়ে আরও কোমল কণ্ঠে বললো,
“মৌ, এই মৌ। খুল না দরজাটা। বাইরে থেকে আটকে দিবো কিন্তু। মৌ, শুন।”
কোমল কণ্ঠের ডাক শুনে মায়া হলো মৌসুমীর। বড় মাও তো কথা বললো তখন তার সাথে। তবে আর অভিমান করে লাভ কি? বারবার যখন ডাকছে, একবার নাহয় শোনাই যাক। সেই ভেবে দরজা খুললো মৌসুমী।
“কি হইছে?”
আজমাইন তাকে ঠেলে আগে দরজার ভেতরে এলো।
“এই ঘরে ক্যা তুই?”
“আমার ইচ্ছা।”
“ওই ঘরে আয়।”
“না।”
“ক্যা?”
“আমি এইখানে পড়মু।”
“ওই ঘরে গিয়া পড়।”
“ওই ঘরে আমি তোমার যন্ত্রণায় পড়তে পারি না।”
“এই ঘরে যেমন খুব পড়তাছোস!”
“পড়লেও সই, না পড়লেও সই। তোমার ঘরে তুমি যাও।”
“তুইও যাবি। আয়। দেখি হাত কতখানি কাটছে?”
“ক্যা? দেখে কি লাভ? তুমি তো খুশিই হইছো।”
“ক্যা, আমি কাটছি তোর হাত?”
“কাটছোই তো!”
মিথ্যে দোষারোপ করায় একটু শক্ত চোখে তাকালো আজমাইন। তারপর হাতটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বললো,
“আরও কোথাও ব্যাথা পাইছোস?”
“হু।”
“কোথায়?”
“দেখানো যাইবো না।”
“ক্যা?”
“মনের ব্যাথা কি কাউরে দেখানো যায়?”
তার জবাবে হালকা হেসে উঠলো আজমাইন। হাত টেনে বললো,
“আয়, ঠান্ডা লাগতাছে।”
মৌসুমী শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
“না, আমি যাবো না তোমার ঘরে। তুমি খালি আমারে মারো।”
“মারতাম না, আয়।”
“না, মারবা।”
“কইছি না, মারতাম না! তাড়াতাড়ি আয়।”
“উহু।”
গোমড়ামুখে মৌসুমী বিপরীতে জোর দিয়েই দাঁড়িয়ে রইলো। আজমাইন একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বাইরে ঠেলতে ঠেলতে কানের কাছে ফিসফিস করলো,
“আয়, মারতাম না৷ আদর দিমু।”
“না, আমার লাগবো না আদর।”
“আবার বলে লাগবো না! কোলে উঠাইয়া কিন্তু ফালায় দিমু তবে। তাড়াতাড়ি হাঁট!”
এই ঘরের দরজায় তালা দেওয়ার জন্য তালা নিয়ে তাকে ঠেলে ঠেলেই বের করলো আজমাইন। টেনে নিয়ে গেলো নিজের ঘরে। বই রোজার ঘরের টেবিলেই পড়ে আছে। বিদ্যাসুন্দরী কতটুকু যে পড়ে, সেইটাও ভালোই জানা আছে তার।
“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ২৭
(নূর নাফিসা)
.
.
পরবর্তী সপ্তাহেই মাহতাব কল করে বললো, আজমাইনকে শহরে পাঠিয়ে দিতে। মামীর সাথে কথা বলে আবার ওদিকে রোজার সাথেও কথা বলেছে। ঠিকানা দিয়ে দিলো রোজার কাছেও। রোজা একটা প্রহর কাটিয়ে গেলো বাবার বাড়ি এসে। মায়ের হাতে ঠিকানাটা দিয়ে গেলো। কিন্তু আজমাইনকে মানাতে পারছে না হালিমা খাতুন। তাকে ডেকে বলতেই আজমাইন বললো সে যাবে না শহরে কাজ করতে। বাড়িতেই থাকবে। হালিমা খাতুন আহমদ আলীকে দিয়েও বলালো। ঘাড় বাঁকা স্বভাবের উগ্র আজমাইন তাতেও রাজি হলো না। সে একদমই ইচ্ছুক না এখন কাজের জন্য। তারউপর বাড়ি ছেড়ে শহর নামক বনবাসেও যেতে আগ্রহী না। প্রয়োজনে বাবার ওই জমিজমায় নানারকমের ফসল ফলাবে, কিন্তু শহরে যাবে না। হালিমা খাতুন মাথায় হাত বুলিয়েই কিছুক্ষণ বুঝিয়ে গেলো তাকে। কথা সব এক কানে প্রবেশ করে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে। শূন্য মাথা শূন্যই রয়ে গেলো। পরদিন সকালেই গিয়ে ফসলের মাঠে নামলো। বাড়িতে বলেও যায়নি। এদিকে মৌসুমীর পরীক্ষা চলছে। সারাবছর তিড়িংবিড়িং করলেও সকাল বিকাল পড়ছে এখন। পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার আগে তৈরি হয়ে ঝটপট নাস্তা করতে এলো রান্নাঘরে।
“বড় মা, তোমার রান্না শেষ?”
“হু, আয় ভাত বেড়ে দেই।”
“তোমার দিতে হবে না। আমিই নেই। তুমি এমনিতেই কত কাজ করতাছো। পরীক্ষার যন্ত্রণায় আমিও পারছি না তোমাকে একটু সাহায্য করতে।”
“তোর সাহায্য করা লাগবো না। তুই মনযোগে পড়ে পরীক্ষা দে৷ এইটুকু কাজ আমিই করতে পারি।”
“আচ্ছা, তুমি চিন্তা কইরো না। পরীক্ষাটা শেষ হইলেই তোমার সব কাজ আমি কইরা দিমু।”
“এই পোলা উঠে নাই এখনো? ঢাকা যাইতে হইবো, এখনও ঘুমায়! কাপড়চোপড় গুছাইবো না?”
“নাহ! তোমার ছেলে তো ঘরে নাই। কোন সকালেই উঠে গেছে আমার সাথে সাথে।”
“কই? দেখলাম না তো। কই গেছে?”
“কি জানি!”
এই ক’দিনের মধ্যে আজমাইন মারেনি একদমই। তার আদর আদর ভাবভঙ্গিতে গভীর গভীর প্রেমে ডুবে যাচ্ছে মৌসুমী। টুকটাক দুষ্টুমি চললেও ক্ষেপে না সে। এতে করে মৌসুমীর মনেও দুষ্টুমির পরিবর্তে ভালোবাসা সাড়া দেয় ক্ষণে ক্ষণে। নাস্তা করে কলম, পত্র নিয়ে বের হতে গেলেই আজমাইনকে আসতে দেখলো বাড়িতে। হাঁটু পর্যন্ত কাঁদা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। বাথরুমে যেতে যেতে মায়ের উদ্দেশ্যে গলা ছেড়েছে,
“ও মা, খাবার দিয়ো।”
হালিমা খাতুন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কপাল কুচকে বললো,
“এই অবস্থা ক্যা তোর? কোত্থেকে আইছোস?”
“ক্ষেতে গেছিলাম। ঢালপাড়ের ক্ষেতে পানি তুললাম। কয়টা লালশাক আর ধনেপাতা বুনে দিবো। লাউয়ের চারাগুলায়ও পানি দিলাম। ডগা তো ভালোই ছাড়ছে। তিন চারদিন পরেই খাইতে পারবা। নইলে আগামী সপ্তাহে। একটু যত্ন করলে লাউ ধরে যাইবো দেখবা দুই সপ্তাহের ভিতরে। কয়টা সার এনে দিমু। বিকেলে গিয়া আবার পানি দিমু নে। সরিষা ক্ষেতেও ঘুরে আইলাম।”
“তোরে কে কইছে কামলাগিড়ি দেখাইতে? আমি কইছি আমার ক্ষেতখামার দ্যাখ?”
“তুমি না কইলেই দেখা লাগবো না? খাইবা কি নইলে?”
“কি খামু, সেই চিন্তা তোর করা লাগতো না। সকাল বিকাল লাউ গাছে আমিই পানি দিতে পারি। তোরা বাপ পোলা বাড়িতে থাকলেও সরিষা পাকলে সবারই গিয়া তুলতে হয়। প্রয়োজনে দুইদিনের জায়গায় চারদিনে কাজ শেষ করমু। সেই চিন্তা তোর একদমই করা লাগতো না। তোরে যেইটা কইছি, ওইটা কর। একেবারে গোসল সেরে আয়। খাওয়াদাওয়া কইরা, কাপড়ের ব্যাগ গুছাইয়া আল্লাহর নাম নিয়া ঢাকা যা। ঠিকানা লিখে দিয়া গেছে রোজা। মাহতাবের ফোন নম্বর নিয়া যাবি, পথ চিনতে সমস্যা হইলে দোকান থেকে কল করবি। বারে বারে তোর কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে আমারও ভাল্লাগে না। যা কইতাছি, মাথায় নিয়া কাজ কর।”
“ধুর!”
হাতমুখ ধুতে চলে গেলো আজমাইন। যে ছেলে ঘুম থেকে উঠতে উঠতেই দুপুর হয়ে যায়, সে আজ শহরে না যাওয়ার অজুহাতে ভোরে উঠেই জমিতে লেগে গেছে কাঁদা মাখিয়ে কাজ করতে! তার কামলাগিরির উপর হেসে বড় মা এবং মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলো মৌসুমী। পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে এসেও আজমাইনকে বাড়ির পাশেই দেখতে পেলো। যায়নি সে শহরে। প্রতিবেশী চাচাতো ভাইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। ছোঁলা খাচ্ছে কুটুরমুটুর। মৌসুমীকে দেখতেই রাস্তার ওপাশ থেকে এপাশে চলে এলো মুখ নাড়াতে নাড়াতে। মৌসুমীর সাথে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো,
“কি পরীক্ষা ছিলো আজ?”
“বিজ্ঞান। কি খাও তুমি?”
আজমাইন জবাব না দিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে মুঠো ভরে ছোঁলা তুলে এনে তার এক হাতে ধরিয়ে দিলো। মৌসুমী মুখে দিতে দিতে বললো,
“এতো টাকা কই পাও? সারাদিন খালি খাইতেই থাকো যে?”
“আব্বা পাঁচশো দিয়া গেছিলো না? একশো এখনো আছে।”
“তুমি আসলেই নির্মুইল্লা। বড়মা তোমারে এমনি এমনি কয় না। এই টাকা দিয়ে কি অন্যকিছু করতে পারতা না? মাত্র ক’দিনেই চারশো ফুরায় ফেলছে। কই আমারে তো একদিন পাঁচটা টাকা দিয়ে বললা না যে, নে মৌসুমী। তুই পরীক্ষা দিতাছোস, ক্ষুধা লাগলে কিছু খাইছ।”
আজমাইন হাতের দুই দানা ছোঁলা তার হাতে দিয়ে বললো,
“নে মৌসুমী। পরীক্ষা দিয়া আইছোস, ক্ষুধা লাগছে নিশ্চয়ই। তাই তোরে বুট খাইতে দিলাম।”
মৌসুমী কুটিকুটি হাসলো। পরক্ষণে খেতে খেতে বললো,
“ঢাকা যাও নাই ক্যা?”
“যাইতাম না। তোর পরীক্ষা কেমন হইছে?”
“ভালোই।”
“পাস করবি তো?”
“তোমার কি মনে হয়, তোমার মতো ফেইল কইরা দুইবার গিয়া ম্যাট্রিক দিমু?”
“পাস কইরাও ম্যাট্রিক দুইবার দেওয়া যায়। আমি পাশ কইরা দিসি।”
“আহারে! সোহাগ চাঁদ আমার! পড়াশোনাই করতে চায় না, পাস কইরা তিনি দুইবার মেট্রিক দিছে শখে!”
“বকরবকর করিস না৷ দেখমু, কি রেজাল্ট যে করস।”
“দেইখো, দেইখো। যাও! তুমি দেখলেই কি, আর না দেখলেই কি! বড়মা কাজে যেতে বলছে, কাজে যাও। ফুটানি কইরা জীবন চলতো না। বউ হাত পাতলে দুই টাকাও দিতে পারতা না।”
“ক্যা, তুই কি ভিখারি? হাত পাতবি যে?”
“বড় বড় কথাটুকুই বলতে পারো। কাজের বেলায় নাই। যার কামাই আছে, তার কাছে হাতও পাততে হয় না। এমনি এমনি হাত ভরা রাখে। জেঠুকে দেখো না? মাসের খরচ এক মুঠেই বড়মার হাতে পাঠায় দেয় চাওয়ার আগে। তুমি এই ফুটানি কইরা চললে জীবনে পারবা সেইটা দিতে? বাপের আয় ফুরাইলেই সব শেষ!”
বলতে বলতে গেইট ঠেলে বাড়িতে প্রবেশ করলো। মাকে সামনে পেয়ে পরীক্ষার গল্প জুড়ে দিলো। সেলিনা বেগম নিমপাতা পিষে গোলগোল করে রোদে শুকাতে দিচ্ছে। শুকালে এগুলো বোয়াম ভরে রেখে দেয়। এরপর প্রতি সকালে ট্যাবলেটের মতো পানি দিয়ে গিলে খান তারা। শরীর রোগমুক্ত রাখার অন্যতম ওষুধ মনে করেন। তারউপর প্রতিনিয়ত কালোজিরার খাদ্য ব্যবহার তো আছেই। মৌসুমী মায়ের কাছে গেলেই এদিকে আজমাইন চলে গেছে ঘরে। হালিমা খাতুন ভীষণ রাগ হলেন আজমাইন ঢাকা না যাওয়ায়। বিকেল পর্যন্তই ধমকে গেলেন, চোখ রাঙালেন। সন্ধ্যা হতেই কষ্টের কান্না জুড়লেন। মাহতাব ছেলেটাকে বলার পর একটা দায়িত্ব নিয়ে সে সপ্তাহের মধ্যে কাজের ব্যবস্থা করে দিলো। অথচ দুদিন যাবত ঠেলে ধাক্কিয়েও পাঠাতে পারলো না ঘাউড়াটে ছেলেকে। সে যাবে মানে, যাবেই না। বকাঝকা করায় আজমাইন উঁচু কণ্ঠে মেজাজ দেখালে কষিয়ে দুইটা থাপ্পড়ও বসিয়ে দিলো কানের কাছে। অথচ থাপ্পড় দিয়ে এখন এই মা-ই কাঁদে! তবুও এই কষ্টটা বুঝাতে পারে না ছেলেকে। শয়তান যেন পুরো মাথাটাকে ঘিরে রেখেছে। কারো ভালো কথাই কানে নিচ্ছে না। দাদাজানের কথাও মানলো না। এরপর মায়ের হাতে থাপ্পড় খেয়ে এবং মায়ের কান্নাকাটির সাথে বেদনার বিলাপ শুনে মেজাজ যেন আরও চড়ে রইলো। রাতে ভাতও খেলো না। তাকে রাগান্বিত দেখে মৌসুমী জোর করার সাহসও পেলো না। মলিন মুখে ডাকতে এসেছিলো দুইবার। চোখ রাঙিয়ে ধমকে দিয়েছে তাকে। থাপ্পড়ের ঝাঁঝ যেন যেকোনো মুহুর্তে ফুল্কে দিতে পারে যারতার উপর! মৌসুমী তার সাথে ঘুমাতেও এলো ভেজা বেড়ালের মতো। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই রেগেমেগে ব্যাগ গুছাতে শুরু করেছে। খুটিনাটির শব্দে মৌসুমী ঘুম থেকে জেগে যেন হতম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় যাও?”
কোনোই জবাব দিলো না আজমাইন। কাপড়ের আধ পুরনো ব্যাগটার চেইনটা ঘ্যাঁচ করে টেনে বন্ধ করে নিলো। দরজা খুলে হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো হাতের আঙুলে এলোমেলো চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে। সে বের হওয়ার সময়ই মৌসুমী হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নেমেছে। মাত্র ঘুম ভেঙেছে, এমনিতেই তো শরীরটা ঝিমিয়ে আছে। তাই যেন চলতেও চাইছে না ঠিকঠাক। বাঁধা পাচ্ছে পর্যাপ্ত গতিতে ছুটতে। ছুটে এসে হালিমা খাতুনকে রুম থেকে ডাকতে ডাকতে আজমাইন গেইট দিয়েও বেড়িয়ে গেছে। হালিমা খাতুন সজাগই ছিলেন। নামাজ আদায় করে জায়নামাজে বসে বসে জিকির করছিলেন। মৌসুমীর ডাকে ছুটে এসে গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে দেখলো, ছেলে হনহনিয়ে সেই দূর পথে হেঁটে যাচ্ছে। একরাশ অভিমান নিয়ে বাড়ি ছাড়ছে। কোথায় যাচ্ছে? কর্মস্থলে? ঠিকানাও যে নিলো না, টাকাও নিলো না! মাহতাবের ফোন নম্বরটাও তো বোধহয় নেয়নি সাথে। কোথায় যাচ্ছে তবে, অজানা পথে?