সোনালী আলোর ঘ্রাণ পর্ব-২৮+২৯

0
393

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ২৮
(নূর নাফিসা)
.
.
ছেলেটা কোথায় গেলো? শহরেই তো? ঠিকঠাক যেতে পারছে তো? ঠিকানা যে নিলো না! ছেলের কাছে টাকাও তো নেই! তবে কিভাবে কোথায়? দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় আধ বেলা কেটে গেলো হালিমা খাতুনের। দুপুরে আহমদ আলীর ফোনটা নিয়ে মাহতাবের কাছে কল করলেন। মাহতাব কলব্যাক করে সালাম দিলো। হালিমা খাতুন জবাব দিয়ে বললেন,
“বাবা, আমি তোমার বড় মামী বলছি।”
“জ্বি মামী। আজমাইনকে পাঠাতে বলেছিলাম, এলো না কেন? আমি তো কাজ ঠিক করে রেখেছি, আজ থেকে কাজ শুরু করার কথা। এখন অফিসের লোক তো আমাকে ধরেছে, কাজের অনুরোধ করে লোক দিচ্ছি না কেন!”
“আজমাইন যায়নি তোমার কাছে?”
“আমার কাছে! কোথায়, না তো! সে কি রওনা হয়েছিলো?”
“হু, গেলো তো। এজন্যই তোমার কাছে কল দিলাম খোঁজটা নিতে।”
“কি বলেন! কবে এসেছে সে?”
“আজকেই।”
“ওহ্! কখন রওনা হয়েছে?”
“ভোরে।”
“ভোরে? তবে এসে পড়বে। অপেক্ষা করে দেখি। দুশ্চিন্তা করবেন না।”
“কিন্তু বাবা, সে তো ঠিকানাও নেয় নাই সাথে! জোর করে পাঠাচ্ছিলাম বলে রাগ কইরা চলে গেছে। ঠিকানা ছাড়া যাইবো ক্যামনে?”
“কি বলেন! ঠিকানা না নিয়ে কিভাবে কি! এখানে আসবে যে, বলে এসেছে আসার সময়?”
“কিছু বলে নাই। কারো সাথে দেখাও করে নাই।”
মাহতাব দুশ্চিন্তার প্রভাবে মুখে শব্দ করলো। এরপর বললো,
“আচ্ছা, দেখি তবুও অপেক্ষা করে। কোথায় যাবে তবে আর! না দেখুন আবার গ্রামেই ঘুরাঘুরি করে বাসায় ফিরে।”
“আল্লাহই ভালো জানে। তোমার কাছে গেলে জানাইয়ো। আমার খুব ভয় লাগতাছে।”
“আচ্ছা, চিন্তা করবেন না। আল্লাহকে ডাকুন। তিনিই হেফাজতের মালিক।”
হালিমার মনটা যেন আরও আঁকুপাঁকু করতে শুরু করলো। বাড়ির সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লো। মোয়াজ্জেম আলী দুইবার করে পুরো গ্রাম হেঁটে এলেন। তার সঙ্গে চলাফেরা করা বন্ধুবান্ধবদের জিজ্ঞেস করলেন আজমাইনকে কোথাও দেখেছে কি না। কেউই আজ তাকে দেখেনি একবারের জন্যও। রোজাকে কল করবে করবে করেও করলেন না হালিমা খাতুন। মেয়েটাও দুশ্চিন্তায় পড়বে ভেবে। ওদিকে মোয়াজ্জেম আলী দুপুর দুইটার দিকে খবর নিয়ে এলেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে মরিয়মের বাড়িও চলে গেছেন। আর সেখানে গিয়েই খোঁজ পেয়েছেন আজমাইনের। মোয়াজ্জেম আলীও বললো সকালে রোজার কাছে গিয়েছিলো আজমাইন। এদিকে রোজাও মাত্রই আহমদ আলীর ফোনে কল করেছে মরিয়মের ফোন থেকে। আহমদ আলী ডাকতেই মৌসুমী ছুটে গিয়ে ফোন নিয়ে এলো। হালিমা খাতুনের কাছে দিতেই তিনি রোজাকে বললেন,
“আজমাইন নাকি তোর কাছে গেছিলো সকালে? কই এখন?”
“কেন, তোমার কাছে বলে আসেনি কিছু?”
“না তো। রাগ কইরা চলে গেছে। কাউকেই কিছু বলে নাই।”
“তবে তুমি আমাকে একবার ফোন করবে না? চাচা না এলে তো জানতেই পারতাম না কিছু!”
“তুই দুশ্চিন্তা করবি দেখে কল করি নাই। কখন গেছে আজমাইন তোর কাছে?”
“খুব সকালেই এসেছে। তার ভাইয়ার ফোন নম্বর আর ঠিকানা নিয়ে গেছে। নাস্তা করতে বললাম, দুইটা মোয়া হাতে নিয়ে খেতে খেতে চলে গেলো। রাগ করে এসেছে, এই ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেনি। ঠিকানাটা নাকি হারিয়ে ফেলেছো, তাই সে নিয়ে গেলো।”
“নাহ! ঠিকানা তো হারাই নাই।”
“ওই তো, না বলে বেরিয়েছে তাই মিথ্যে বলেছে।”
“টাকাও যে নেয় নাই। আমার চিন্তায় ভাল্লাগতাসে না। ক্যামনে যাইবো টাকা ছাড়া?”
“তার কাছে টাকা আছে দেখলাম তো। আমি আবার দিয়ে দিলাম একশো টাকা। চিন্তা করো না। যেতে পারবে। জিজ্ঞেস করতে করতে পথঘাট চিনে নিবে।”
“ঠিকঠাক গেলেই হয়। এই ছেলেটারে নিয়া আমার কোনোদিকে শান্তি নাই।”
“আহ! চিন্তা করো না তো। শান্ত হও। ঠিকঠাক গেলেই হয়। আমি দেখি তার ভাইকে কল করে। এতোক্ষণে তো পৌঁছে যাওয়ার কথা। শহরের রাস্তায় জ্যাম থাকলে একটু দেরিও হতে পারে। চিন্তা করো না।”
“আচ্ছা। ভালোই আছিস তোরা?”
“জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ। আব্বাকে জানিয়েছিলে আজমাইনের কথা?”
“হুম। তোর আব্বার মত নিয়াই তারে জোর দিছি।”
“আচ্ছা, সেখানে গেলে ভাইয়া দেখবে পরের ব্যাপার। দুশ্চিন্তা করে মাথা নষ্ট করো না। ফোন রাখি।”
“আচ্ছা।”
কিছুটা স্বস্তি পেলো হালিমা খাতুন। কিন্তু অর্ধাংশও হয়তো না। ছেলের পৌঁছানোর খবর আসা পর্যন্ত না। আরেক চিন্তায় জমে আছেন তিনি। ফোন রেখেই বিড়বিড় করলো,
“টাকা পাইলো কই? তার কাছে টাকা কোত্থেকে আসবো! মৌসুমী, তুই দেখছোস তার কাছে টাকা? কারো কাছ থেকে নিছে শুনছোস?”
“না বড়মা। তবে বড় চাচা যে যাওয়ার আগে পাঁচশো টাকা দিসিলো, ওইটা এতোদিন যাবত খাইতে খাইতে গতকাল শুনছি তার কাছে একশোর মতো আছে।”
“ওহ্! আচ্ছা। তবে তো হইছেই। কিন্তু এই টাকায় নাহয় ভাড়া হইলো, খাওয়াদাওয়া করবো না কিছু?”
চিন্তা মৌসুমীরও হচ্ছিলো ভীষণ। কিন্তু রোজার কাছ থেকে পাওয়া খবরে চিন্তার রেশ কমে এসেছে। হালিমা খাতুনের দুশ্চিন্তা দেখা হচ্ছে না তার দ্বারা। সে সান্ত্বনা দিতে বললো,
“হইছে বড়মা। এতো ভাবতে হইবো না তোমার। মাহতাব ভাই থাকাখাওয়ার সকল বন্দোবস্ত করে দিবো।”
“মাহতাব পর্যন্ত যাইতে তো হইবো তার আগে। পথে কি কিছু খাইয়া নিছে পোলাটা!”
ছেলের উপর জবরদস্তি করেও এখন তার কান্না আসছে। আঁচলে মুখ চেপে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লেন পাকা বারান্দায়। সেলিনা বেগম পাশে বসে সান্ত্বনা দিতে লেগেছেন। মৌসুমী ফোনটা দিতে গিয়ে দাদাজানকে তার নাতির শহরে যাওয়া নিয়ে সম্পূর্ণ কাণ্ড শুনাতে লাগলো। মিনিট বিশেক পরেই মাহতাব কল দিয়ে জানালো আজমাইন গিয়ে পৌঁছেছে তার কাছে। এবার যেন মাথা থেকে দুশ্চিন্তার পর্বত নামলো ব্যথিত মায়ের। কণ্ঠে কষ্টের রাগ ফুটিয়ে হালিমা খাতুন বললেন,
“দাও, তো। ফোনটা দাও তারে। বকে নেই কতক্ষণ। এমন কাজ কেন করে সে!”
মাহতাব মৃদু হেসে বললো,
“আচ্ছা, থাকুক। আর বকাঝকার প্রয়োজন নেই। ঠিকমতো এসেছে যে, এটাই শোকর আলহামদুলিল্লাহ। এমনিতে আসতে কোনো সমস্যা হয়নি। রাস্তায় জ্যামে পড়ায় আর ঠিকানা খুঁজে খুঁজে আসায় একটু দেরি হয়েছে। নিশ্চিন্তে থাকুন, মামী। আমার এখানেই থাকতে পারবে সে।”
“আচ্ছা, বাবা। দেখেশুনে শাসনে রাইখো। বড় ভাই তো তুমি।”
“জ্বি, ইনশাআল্লাহ।”
কল কেটে দিলো মাহতাব। বুকের ভেতর থেকে ভারি নিশ্বাস ফেলে হালিমা খাতুন কাজের দিকে অগ্রসর হলেন এবার। সকাল থেকে খাওয়া নাওয়া কিছুই হয়নি এ পর্যন্ত। সবটা জুড়েই দুশ্চিন্তার বিস্তার হয়ে ছিলো। মনের ধূসর মেঘটা দূর হয়েছে এবার। রবের শুকরিয়া আদায়ে মেতেছে মন।
আজ থেকেই যেন ঘরটায় এলে কেমন ফাঁকা ফাঁকা অনুভূত হতে লাগলো মৌসুমীর। কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে এলো দাদাজানের কাছে, কিছুক্ষণ কাটালো শ্বাশুড়ির কাছে। পরবর্তীতে এসে বই নিয়ে বসলো টেবিলে। বই খুলছে, চোখ বুলাচ্ছে, পাতা উল্টাচ্ছে কিন্তু পড়া হচ্ছে না। চোখের আন্তঃদৃষ্টিতে ভাসছে আজমাইন, বসে আছে মন কুঠুরিতে। ভাবনায় হয়ে আছে বিলীন, শূন্যতার ব্যাথা জমেছে অনুভূতিতে। তার দুষ্টু রাজার বড্ড অভাব এই ঘরখানাতে। তার প্রাণপ্রিয় বরটা আর নেই সকাল বিকেল দুষ্টুমি করার জন্য। নেই, মারধর করা কিংবা আদরের জন্যই। প্রেম গাঢ় হওয়ার সময়েই বরের দূরত্ব অনুভব করতে হলো। বড়মাকেও আর দিনে ক্ষণে চেঁচামেচি করতে হবে না। একপ্রকার শান্ত নিরিবিলি হয়ে গেলো ভিটেবাড়ি। প্রথমে রোজার বিদায়ে সদস্য কমে যাওয়ার প্রভাব, তারপর জেঠুর বিদেশ গমনে, এখন আজমাইনেরও তীব্র অভাব। সবাই যেন শুধু দূরে দূরে চলে যাচ্ছে। নিস্তব্ধতায় ঘিরে যাচ্ছে উঠুন বাড়ি। এখন শুধু তাদের ফেরার অপেক্ষা তাড়াতাড়ি।

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ২৯
(নূর নাফিসা)
.
.
আজমাইনের তৈরি করে রাখা জমিতে লালশাক আর ধনেপাতার বীজ বুনে দিয়েছে মোয়াজ্জেম আলী। নিজের জমিজমাতেও আবাদ করছেন, পাশাপাশি ভাইয়ের জমিও দেখছেন। সারপদার্থ দিতে হলে হালিমা খাতুন টাকা দিয়ে দিচ্ছেন, মোয়াজ্জেম আলী বাজার থেকে এনে ছিটিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিদিন বিকেলে মৌসুমীকে সাথে নিয়ে ফসলের জমি দেখতে যান হালিমা খাতুন। বাড়ির পাশের জমিতে লাগানো বিভিন্ন শাকসবজি গাছে পুকুর থেকে পানি দিচ্ছেন। আগাছা পরিষ্কার করে টুকটাক পরিচর্যাও করছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একদিন এসে মরিয়মের সাথে ঘুরে যাচ্ছে রোজা। দেখে যাচ্ছে দাদাজানকে, দেখে যাচ্ছে বাড়ির সবাইকে। সিয়াম তো স্কুলে চলাচলের পথে প্রায়ই উঁকি দেয় ফুপুর বাড়িতে। তার মাধ্যমেও খবরাখবর রাখা হচ্ছে।
বাড়ির নিকটবর্তী পাশটা বাদ দিয়ে সারামাঠ ছেয়ে আছে হলুদের আবরণে। প্রতি জমিতেই আবাদ হয়েছে সরষে। ফুলে ফুলে এক পুষ্পরাজ্য হয়েছে আছে সোনার মাঠ। যেন হলদে রঙের এক চাদরে ঢেকে আছে প্রকৃতি। কিছুদিন পরপর এই মাঠের ভিন্ন ভিন্ন রঙ দেখতেও চোখ জুড়িয়ে যায়। মনটা ভরে যায় সৌন্দর্যের মুগ্ধতায়। ফলাদি ভালো হলে পেটও ভরে, হাসি ফুটে ওই খেটে-খাওয়া মানুষের চোখেমুখে। প্রাপ্তি বলে, “তোরা পেয়েছিস। জয় অর্জন করেছিস ঘামযুদ্ধের ময়দানে।”
পরীক্ষা রেখেও মৌসুমী যায় জয়ের নিরব ধ্বনিতে মৌ মৌ করা ময়দানে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। সঙ্গীসাথীদের সাথে উপভোগ করে কখনো ভোরের কুয়াশা। আইল ধরে হেঁটে পা ভেজায় ভেজা ঘাসের পরশে। কুয়াশার ভিড়ে মিলিয়ে দিতে উড়িয়ে দেয় মুখ থেকে নির্গত তপ্ত ধোঁয়া। এসবই তাদের নিত্যকার খেলা। আবার কখনো নামে দুপুরের চাঙা রোদে দেহমনকে জাগ্রত করতে। কখনোবা উপভোগে নামে বিকেলের মমতাভরা স্নিগ্ধ সৌন্দর্যকে। চকচকে রোদ যখন হারিয়ে ফেলে তার তপ্ততাকে, হালকা কুয়াশার মাঝে টকটকে বৃত্তাকার এক কুসুম হয়ে ফোটে। কুয়াশাও ঘন হতে থাকে, কুসুম আলো নিভে যাওয়ার সাথে সাথে। আবার সেই নিজেকে চাদরে গুটিয়ে নেওয়া ঠান্ডা সন্ধ্যা রজনী! ইশ! সারাটা বছর অপেক্ষায় কেটে যায় এই সময়টুকু উপভোগের জন্য। সময় এসে ধরা দিলেই আবার বসন্ত গানের অপেক্ষায় হয় বসতে। একেকটা ঋতু এভাবেই অপেক্ষায় রেখে রেখে বয়ে যায় তার জীবনের গতিতে।
রোজার পরীক্ষাও শীঘ্রই শুরু হতে যাচ্ছে। তাই এখন অবসর সময়ের পুরোটুকুই বলতে গেলে বইয়ের পেছনে কাটছে। মরিয়মও ভালো যত্ন নিচ্ছে। রোজ গরুর দুধ কিনে নিচ্ছে পাশের বাড়ি থেকে, মুরগির ডিম পাওয়া যাচ্ছে নিজ খোঁয়াড় থেকে, আবারও মুখরোচক বিভিন্ন খাবারই তৈরি করে রাখছে। যত্ন-আত্তি একদমই কম হচ্ছ না। বেশি পড়তে দেখলেও উঠুনে একটু ঘুরাফেরা করে আসতে বলে। ডেকে ডেকে ঘরের বাইরে সিড়িতে বসে মাথায় তেল লাগিয়ে দেয়। মাথা ঠান্ডা থাকলে পড়াশোনাতেও ভালো মনযোগ আসবে বলে ধারণা তার। এদিকে মাহতাবের সাথেও প্রতি সপ্তাহে চিঠির আদানপ্রদান চলছে রোজার।
রোজা মাঝে মাঝে ঘরের বাইরে বের হলেও কদিন যাবত সাইদুরের বউটাকে একদমই দেখছে না। বাসায় নেই নাকি? ফুপুর সাথে সেদিনও চাচী ঝগড়া লাগলো, তাই চাচীও কেমন মুখ ভেঙ্গিয়ে চলে রোজাকে দেখলে। কিন্তু সপ্তাহ খানেক যাবত যেন চাচীর ভাবভঙ্গিটাও একটু মলিন মলিন দেখায়। পাড়াপড়শির সাথেও গল্পে জমতে দেখা যায় না। সাইদুরের বউ সম্পর্কে ফুপুর কাছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছেন,
“নাইওর নাকি গেছে বাপের বাড়ি।”
তার ঠিক দুদিন পরেই রটারটি হয়ে গেলো, সাইদুরের বউ বাপের বাড়ি গেছে ঠিকই মাসখানেক আগে। কিন্তু যাওয়ার পরপরই পালিয়ে গেছে অন্য ছেলের হাত ধরে। সাইদুর এবং তার মামা খোঁজ করে করে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টাও করেছে খুব। কিন্তু বউ আসেনি। গত সপ্তাহে ডিভোর্সও হয়ে গেলো। পাড়ার লোকে যেন হাসছে সাইদুরের মায়ের উপর। ছেলের বউ নিয়ে যেই অহংকার করেছিলো পাড়ায় পাড়ায়! আজ যেন নিজের মুখে নিজেই চুনকালি মাখালো অহংকারের ফলাফলে। এদিকে রোজা বিকেলে বসেছিলো পড়তে। মরিয়ম হনহনিয়ে রুমে প্রবেশ করে বললো,
“আফরোজা, ওই ডিবা ডাবি গুলা কই? ডিবা ডাবি কই?”
রোজা কিঞ্চিৎ চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“ডিবা ডাবি? কিসের ডিবা ডাবি?”
“তোরে যে আইনা দিলাম বাজার থেকে? ওই ক্রিম গুলা কই?”
রোজা একটু ভীতি হয়ে উঠলো। সে যে এতোদিন ব্যবহার করেনি, তা না এখন ধরলেই বুঝে ফেলবে ফুপু! ক্রিমের কৌটা তো যেমন এনেছে, তেমনই রয়েছে! কি জবাব দিবে এবার? ওদিকে ড্রেসিং টেবিলে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে মরিয়ম। রোজা মিনমিনে গলায় বললো,
“ড্রয়ারে রেখেছি ফুপু। ওইগুলো দিয়ে কি করবে?”
“কাজ আছে।”
ক্রিমের সন্ধান দিয়ে বকা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে রইলো রোজা। ড্রয়ার খুলে নিজেই কৌটা গুলো সব আঁচলে তুলে নিলেন। বেরিয়ে যেতে গিয়েও থেমে রোজাকে কাজ সম্পর্কে জানাতে বললো,
“এইসব ফালায় দিতে যাইতাছি। তোর ফরসা হওয়ার দরকার নাই। তুই এমনি আছোস, ভালা আছোস। অন্যেরা যেমন খুশি তেমন মাখুক।”
“লোশনটা রেখে যাও। ওটা ভালো তো ঠান্ডার জন্য। চামড়া খসখসে হয় না।”
মরিয়ম আঁচলের কৌটা নেড়েচেড়ে দু-চার সেকেন্ড চিন্তা করে লোশনটা রেখে গেলেন। বাকিগুলো ফেলে দিয়ে এলেন ময়লার গর্তে। এদিকে রোজাও যেন পড়া রেখে চিন্তামগ্ন হয়ে রইলো! ফুপুর আবার কি হলো! মিনিটখানেক পরেই মরিয়ম এসে রোজার পাশে খাটে বসলো। নিজ থেকেই ঘটনা বলতে শুরু করলো,
“ওই বেডি, হুহ্! ওই বেডি দুনিয়ার চালবাজ! পোলার বউ নাকি নাইওর গেছে! শহরের রাজকন্যা আনছে একেবারে! পরী, পরী আনছে। কি ফুটানিরে, বাবা! এইবার কি হইলো?”
“কি হয়েছে ফুপু?”
“ভাইজ্ঞা গেছে, ওই ছেমড়ি প্রেমিকের সাথে ভাগছে নাইওর গিয়া। এইজন্যই মাসখানেক ধইরা মুখ বন্ধ হইয়া রইছে। কারো সাথে আড্ডা দেয় না। অন্যের বদনাম কয় না। এক্কেবারে হুজুর। ভাগাইয়া ছেমড়িরেই নাকি আবার গেছে আনতে! কো, কারবার! কোনোভাবেই আনতে না পাইরা গত সপ্তায় ছাড়াছাড়ি করলো।”
“কি বলো! সাইদুর ভাইয়ের সাথেও না প্রেমের বিয়েই হলো শুনলাম!”
“আরে হো। চরিত্রে দোষ। দুই চারটা প্রেমিক একসাথে নিয়াও ঘুরতে পারে ওইসব ছেমড়িরা। এখন? এখন ওই বড় বড় লেকচার ওয়ালা মুখ কই গেছে? মানুষ শুনতাছে, হাসতাছে না? আরও শুনবো, আরও হাসবো। তার কথা তারেই ফিরায়া দিয়া যাইবো।”
রোজা এতোক্ষণে পুরোপুরি উপলব্ধি করলো তার ক্রিম ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার কারণ। সেদিক থেকে হাসি পেলেও হাসলো না। মরিয়মের তিরস্কৃত কথার প্রেক্ষিতে বললো,
“তোমার কি এখন খুব ভালো লাগছে? খুশি হয়ে যাচ্ছো তাদের লজ্জাকর অবস্থা দেখে? এমনটা করো না কিন্তু। আল্লাহ নারাজ হয়ে যাবেন। অন্যের দুঃখে হাসতে নেই। যা হওয়ার হয়েছে, বাইরের লোকের কাছে কিন্তু এসব নিয়ে আলোচনা করতেও যেয়ো না।”
“আমার আলোচনা করা লাগবো? আমিই তো বাইরের মুখে শুনলাম।”
“তবুও কারো আলোচনা সমালোচনায় সংযুক্ত হয়ে যেয়ো না। দ্বন্দ্বে গেলেও ওসব তুলে কষ্ট দিয়ো না। কারো দুঃসময়ে হাসলে সৃষ্টিকর্তা তোমার উপর নারাজ হয়ে তোমারও এরচেয়ে বড় দুঃসময় ঘনিয়ে দিতে পারে।”
“আরে, না না। আমি হাসি না। কারো কাছে গিবতের ইচ্ছাও নাই। তা-ও বইলা ফেলি পরিস্থিতির কারণে। বলি তো শুধু ওই বেডির মুখের কারণে। নইলে ভাবতে গেলে খারাপই লাগে। সাইদুর পোলাটা তো ভালা। পোলার কপাল পুড়লো অসৎ নারীতে আসক্ত হইয়া। যাক গে, পোলা মানুষই। ভালো খুঁইজ্যা বিয়া কইরা নিবো নে আরেকটা।”
“হুম, সেটাই।”
“শুন, মা। একটা কথা বলি।”
রোজা লেখায় মনযোগ দিয়ে বললো,
“হুম, বল।”
“তুই কিন্তু কলেজ গিয়া পোলা মানুষের লগে কথাবার্তা বলিস না। পোলারাও কিন্তু এমন হয়। তুই চাইবি না, তাও জালে আটকায় ফেলবো।”
“তুমি নিশ্চিন্তে থাকো ফুপু। আমার কোনো ছেলে বন্ধু নেই।”
“হো, না থাকাই ভালা। আর বেশি তো নাই পড়াশোনার। তাই না?”
“হুম।”
“বাচ্চাকাচ্চার কথা চিন্তা করিস, হ্যাঁ মা? আল্লাহ ক’দিন দেহের শক্তি সামর্থ্য রাখছে, কে জানে! যদি দেখে যেতে পারি দুয়েকজন নাতিনাতনি।”
রোজা খাতায় লিখতে মনযোগী থেকেই ফুপুর তীব্র ইচ্ছাকে খুশি রাখতে মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
“পরীক্ষাটা শেষ হোক ফুপু।”
“আচ্ছা, পড় মনযোগ দিয়া। দে পরীক্ষা ভালোয় ভালোয়।”

চলবে।