শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
447

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-২৩

আলতার শরীর যথেষ্ট ভালো হয়েছে। ভয় আছে এখনো তার সুস্থতা নিয়ে। তাকে সবসময় ঠান্ডা অবস্থান থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কথা ছিল দুদিন রেখে নাম কাটবে কিন্তু সরকারি হাসপাতালে তা হলো না। শরত যেদিন চলে গেল সেদিন রেখে পরেরদিনই ছাড়ার কথা থাকলেও ছাড়লো না। শিশির তার হোস্টেলে চলে গিয়েছিল রাতটা থাকতে। আলতার অবস্থা মোটামুটি ভালো বলেই সে গিয়েছে। নকশিও জোর করছিল হোস্টেল কাছে সেখানেই গিয়ে থাকুক। প্রয়োজনে অবশ্যই সে ফোন করবে। নকশি তার মোবাইলটা আনেনি তাই শিশির, আওলাদের ফোনেই নিজের নাম্বারটা তুলে দিয়ে গেছে। শিশির চলে যেতেই নকশি বসল আলতার বিছানায় তার মাথার কাছটাতে। আওলাদ দাঁড়িয়ে ছিল কেবিনের দক্ষিণ দিকে দরজা বরাবর। আলতা আছে গভীর ঘুমে এখন কথা বললেও ঠিকঠাক টের পাবে না হয়ত । তবুও খুব সতর্কতার সাথে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে নকশি কথা বলল, “আপনার বাড়ি যাওয়া দরকার ছিল। আপনার স্ত্রী -সন্তানরা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে , চিন্তাও করছে আপনার জন্য।”

নকশির কথা শুনতেই আওলাদ বুঝতে পারলো নকশি তার খোঁজখবর জানে। অথচ কি আশ্চর্যজনক কথা সে এত খোঁজ করেও কখনো নকশি সমন্ধে জানতে পারেনি।
“আমি বাড়িতে জানাইছি চিন্তা করবো না।” কেমন যেন লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল আওলাদ। নিজেরা কোনভাবেই সময়ে তালাক না নিলেও তাদের সম্পর্কটা এখন আর স্বামী স্ত্রীর মত নেই। তবুও সন্তানের কথা জানার পর আওলাদ মন স্থির করে ফেলেছে সে তাদের নিজের সাথে নিতে চাইবে। আওলাদ তো নকশিকে এত বছর খোঁজ করেছে হয়ত তার খোঁজ করায় অনেক ত্রুটি ছিল যার ফল স্বরূপ সে এত কাছে থেকেও তাদের পায়নি। আর এখন যখন মেয়ের কথা জানলো তখন আর মন মানছেই না তাদের আলাদা হওয়ার কথা। এক মন তো বলছে নকশি আর মেয়ের জন্য সব ছেড়ে দিতে পারবে আরেক মন বলছে কাউকেই সে অবহেলা করবে না। ঘুমন্ত একদমই নড়াচড়া করছে না বলে কেমন যেন সন্দেহ হলো নকশির। সে খুব ধীরে একটা হাত আলতার নাকের কাছে ধরল। তা দেখে চিন্তিত স্বরে আওলাদ বলল, “কি হইছে?”

“কিছু না” মুখে কিছু না বললেও নকশির মন অস্থির রইলো। ভোরের আশায়, আলতার জেগে ওঠার আশায় আর আওলাদ সম্পর্কে জানার পর মেয়ের মনোভাব কি তা দেখার আশায়। নকশি দেখলো আওলাদ এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তাই তাকে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বলল, “বসেন এখানে।”
বিনাবাক্য ব্যয়ে সে সত্যিই বসলো চেয়ারে।
রাতটা দুজনের অর্ধ ঘুম অর্ধ জাগরণেই কেটে গেল। ভোর হতেই শিশির হল থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুটা সময় ব্যস্ত পায়ে হাটাহাটি করল ফুটপাত ধরে। তারপরই ছুটল হাসপাতালের দিকে। হোটেল থেকে তিন জনের জন্য নাশতা কিনে হাসপাতালে ঢুকতেই দেখলো আওলাদ বের হচ্ছে।

“কোথাও যাচ্ছেন?”

“হ নাশতা আনতে যাই। তুমি যাও ওগো কাছে।”

শিশির হাত উঁচিয়ে পলিথিনের প্যাকেটটা দেখালো, “নাশতা আমি নিয়ে আসছি।”

“তুমি আবার কষ্ট করলা ক্যান বাবা।”

“আসেন ভেতরে। কষ্ট বলছেন কেন এ কাজটা তো আমি বা ভাই থাকলে ভাই করত।এখন আপনি আছেন তো..” কথা শেষ না করেই থেমে গেল শিশির। সে এমন কথা কেন বলছে! আওলাদ নির্লিপ্ত আর বেজায় অসুখী চোখে তাকিয়ে আছে শিশিরের দিকে। লোকটা কি কষ্ট পেল! খারাপ লাগল শিশিরের সে কেন এমন রূঢ় হচ্ছে। সত্যি বলতে লোকটার উপস্থিতি তার প্রথমে ভালো লেগেছিল এই ভেবে, এত বছর পর আলতা তার বাবাকে পেল। কিন্তু পরশু রাত থেকে খুব বিরক্ত লাগছে লোকটাকে। যখন টের পেল লোকটা দ্বিতীয় বিয়ে করেছে এবং সন্তান সন্ততিও আছে। শিশিরের পাশাপাশি হেটে কেবিনে গেল আওলাদ। আজ আলতাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছে কিন্তু কখন তা এখনও নিশ্চিত জানে না। শিশিরকে দেখতেই নকশি বলল, “আব্বা আজকে নাম কেটে দিবে বলে গেছে ডাক্তার।তুমি কি আজকে ক্লাস করবে?”

“না ফুপুআম্মা আমি আজকে ক্লাসেও যাব না আর টিউশনির ছুটি এখনও কালকে দিন বাকি।”

“আচ্ছা তাহলে কষ্ট করে একটু খোঁজ নিও কোন বাসে বাড়ি যাওয়া যাবে আর টিকিট সংক্রান্ত ব্যাপারটাও একটু দেখো।”

“সব দেখব আগে এখানে আসেন চেয়ারে। নাশতা নিয়ে আসছি খাব সবাই। আলতা কি সজাগ হয়েছে একবারও।”
“হ্যাঁ ও শেষ রাতে অনেকক্ষণ জেগেছিল তাই এখন আবার ঘুমাচ্ছে। আর,,, ” থেমে নকশি আওলাদের দিকে তাকালো। আওলাদও পূর্ণ দৃষ্টিতে নকশির দিকে তাকিয়েছিল।

“আর কি ফুপুআম্মা!”

“উনাকে চেয়ারে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছে। কিন্তু কোন প্রশ্ন করেনি কেমন যেন আবছা অন্ধকারে চুপচাপ তাকিয়েছিল। আমি জেগে যাওয়ার পর দেখলাম সে কেমন করে দেখছে। যখন কথা বলতে চাইলাম বলল কিছু শুনতে চায় না। আমার চিন্তা হচ্ছে সে কি কোন প্রকার ট্রমায় ভুগবে এটা নিয়ে!”

আওলাদের মিইয়ে যাওয়া মুখটা পাণ্ডুর মত হয়ে গেল। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল শেষ রাতে। তারপর যে এমন কিছু হয়েছে তা নকশি একবারও বলেনি অথচ এই ছেলেটা আসতেই কেমন নিজে থেকে সব বলছে৷ অথচ বিয়ের পর পর নকশির সব কথা এই অশিক্ষিত মানুষটার সাথেই ছিল। বিদেশে যাওয়ার পরও নকশি কত গো ধরত কথা বলা চালিয়ে যেতে শুধু তার মায়ের কারণে নকশির অনর্গল বলতে চাওয়া কথাগুলো শুনতে পারেনি। কষ্ট হতো খুব তার কিন্তু তখন মায়ের ওপর কথা বলার সাহস ছিল না। মা ভক্ত ছেলে সে আর তাইতো বউকে ভালোবাসলেও প্রকাশ করার ক্ষমতা ছিল না। এটাই তার দোষ ছিল যার ফলে বউ হারালো, সন্তান সংবাদ জানতেই পারলো না। শিশিরের আনা নাশতা খেয়ে নিল তিনজনই। আলতার জন্য খাবার হাসপাতাল থেকেই দিয়েছে। খাওয়া শেষে আওলাদ তার পকেটে থাকা টাকা গুলো বের করে নকশির দিকে এগিয়ে দিল।

“এগুলো কি?”

“এইখানে কিছু টাকা আছে। হাসপাতালের খরচটা দিতে চাইতাছি না কইরো না।”

নকশি তৎক্ষনাৎ না করতে গিয়েও থামলো। এই মুহুর্তে তার মন বলছে মুখের ওপর ফিরিয়ে দিতে টাকাগুলি৷ কিন্তু শিশিরের সামনে লোকটাকে অপমান করার কোন মানে হয় না। সে কঠিন মুখে কিছু বলতে গিয়েও বলল না৷

“টাকা লাগবে না। ভাই আর শরত অনেকগুলো টাকা জোগাড় করেছেন। তা দিয়েই হয়ে যাবে এখন।”

“আমি জানি তোমার ভাতিজা দিয়ে গেছে টাকা পয়সা। কিন্তু আমার মাইয়ার জন্য আমি দিতে চাই। এতগুলা বছর আমি আমার সন্তানের মুখটা দ্যাখতে পারি নাই। অহন পাইয়াও আর পারমু কিনা জানি না। তুমি আমারে এট্টুক করা থাইকা বঞ্চিত কইরো না।” কথাটা বলতে বলতেই চোখ ছলছল করছে আওলাদের। শিশিরের মনে হলো লোকটা খুব অসহায় বোধ করছে৷ তার অস্বস্তি হচ্ছে প্রায় তার বাবার বয়সী একটা লোক এভাবে তার সামনে আকুতির স্বরে কাঁদছে। বেরিয়ে যেতে চাইল সে কেবিন থেকে সেই মুহূর্তেই দেখলা আলতা জেগে আছে। তারমানে সেও শুনলো কথাগুলো। পরিস্থিতি বিগড়ে না যায় তা ভেবেই শিশির বলল, “এখন কেমন লাগছে তোর?” কথাটা বলতেই নকশি আর আওলাদের দৃষ্টি ফিরল মেয়ের দিকে। কেমন বিষ্ময়ে চেয়ে আছে আলতা সবার দিকে। আওলাদ শার্টের হাতের কোণায় চোখ মুছল। নকশি মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত রাখল, “কেমন লাগছে তোর এখন?”

“ভালো।” খুব একটা স্পষ্ট হলো না আলতার কথাটা। নকশি আবারও জিজ্ঞেস করলো, “বসিয়ে দেব, নাশতা করতে হবে তো।”

“দাও।”

নকশি খুব নরম হাতে ধরে আলতাকে বসালো। মাথার নিচে ছিল যে বালিশটা সেটাই উঠিয়ে পিঠের পেছনে দিল শিশির । নকশি গ্লাসে পানি ঢেলে আলতার দিকে এগিয়ে দিচ্ছিল। তার হাত থেমে গেল আলতার কথায়, “ইনি আমার আব্বা?”

আওলাদের বিষন্ন মুখটা মুহূর্তেই আনন্দে ঝলমল করে উঠলো। মেয়ে তাকে আব্বা বলেছে। নকশি মাথা নেড়ে সায় দিল ‘হ্যাঁ’।

আলতা আর কিছু না বলে চুপচাপ চেয়ে রইলো বাবার দিকে। কিছুটা সময় কেবিনটাতে নিরবতার হাওয়া বইলো। অনেকটা সময় নিয়েই আলতা বলল, “তোমরা আলাদা হয়েছিলা কি জন্য?”

মেয়ের মুখের কথাটা শুনে বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার কিছু একটা নকশির অন্তর চিঁড়ে দিল৷ পুরনো ঠিক প্রায় ষোলো বছর আগের একটা ক্ষততে হঠাৎ আঁচড় পড়লো যেন! গলায় কিছু আটকে গেল আওলাদেরও। বিচ্ছিদের কারণটা মেয়েকে কি করে বলবে? শিশিরের মনে হচ্ছিল এবার তার বেরিয়ে পড়া উচিত তাই সে পা বাড়াচ্ছিল। নকশি থামিয়ে দিল, “কোথাও যেতে হবে না তোমাকে শিশির৷ এখানেই থাকো। আমার সাথে যা ঘটেছিল তা ঘটে গেছে। তুমি, তোমরা জানলে তাতে অন্যায় কিছু হয়ে যাবে না।”

আওলাদ মাথা নিচু করে রাখলো। নকশি বলা শুরু করলো, “আলতার দাদী মানে উনার মা আমাকে পছন্দ করতেন না খুব একটা। আমার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আমি আলতার চেয়ে কিছুটা বড় ছিলাম। মানে বয়সটা ষোলো শেষের দিক। মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হতেই বিয়ে হয়েছিল আর গ্রামে তখন এত ছোট বয়সে খুব একটা মেট্রিক পরীক্ষা কেউ দিত না। পড়াশোনা শুরুই করতো দেরি করে কিন্তু আমার এলাকায় আমিই তাড়াতাড়ি পড়াশোনা শুরু করেছি। বিয়ে হয়ে যাওয়াতে আমি ভয় পাইনি ভেবেছি আমার স্বামীর অনুমতি নিয়ে আবার পড়বো। কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য আলতার বড় চাচার ছেলেকে বলেছিলাম ব্যবস্থা করে দিতে। আলতার দাদী কোনভাবেই রাজী ছিল না৷ তার বাবা তখন বিদেশে, তিনি একবার আমার কথায় সম্মত হলে আরেকবার তার মায়ের কথা মেনে নিতেন৷ আর এমন করে দুদিক সামলানো উনার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি এরই মাঝে আবার উনার খালা মানে আলতার দাদীর এক বোন নিজের মেয়ে বিয়ে দিতে চাইতেন উনার কাছে। সহজ ষড়যন্ত্র ফাঁদ পেতে আলতার দাদী আমাকে দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। কিছুটা সফল তো হয়েও গিয়েছিলেন বাড়িতে সালিশ ডেকেছেন এবং উনার আপন ভাতিজাকে জড়িয়ে আমার চরিত্রে কালি লেপনের কাজ করতে চেয়েছিলেন।” শেষের কথাটা বলার সময় নকশি আওলাদকে দেখিয়ে বলল। মায়ের মুখে এইটুকু শুনেই আর্তনাদ করে উঠলো আলতা। দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরলো সে। আওলাদ মাথা নিচু করে আছে। বলতে নেই, এবার সে লজ্জায় চোখের পানিটুকু আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। নিজেরই কন্যার সামনে তার স্ত্রীর সাথে ঘটে যাওয়া বর্বর এক অত্যাচারের ঘটনা শুনতে তার মন মাটির সাথে মিশে যাওয়ার ইশারা দিচ্ছে। এত লজ্জা, এত অক্ষমতা তার! সে পারেনি নিজের মায়ের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে স্ত্রীকে রক্ষা করতে। আলতা আর শুনতে চাইছে না তার মায়ের সাথে ঘটে যাওয়া অতীত কিন্তু নকশি থামলো না৷ সে বলতে থাকল সেদিন কিভাবে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল আর পথিমধ্যে গাড়ির এক্সিডেন্ট, আহসানুল্লাহর সাহায্য করা। নকশির বাপের বাড়িতে খোঁজ নেওয়া থেকে নকশির গর্ভাবস্থার কথা জেনে কেমন করে সেই বাড়ির প্রতিটি সদস্য তাকে আগলে রেখেছে। এতগুলো বছর কতোটা যত্নে বড় হয়েছে তার মেয়ে সবটাই বলল নকশি। বলার উদ্দেশ্য ছিল আওলাদকে শোনানো। সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলো আওলাদ। এরই মাঝে ডাক্তার এসে শেষবারের মত চেকাপ করল আলতার। নাম কেটে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থাও হলো৷ পরবর্তী চেকাপের ডেট দশ দিন পরে দেওয়া হল। আলতার ছুটোছুটির প্রয়োজন পরেনি একা শিশিরই করলো সবটা। আওলাদ দু হাত জোর করে নকশির কাছে ক্ষমা চাইলো, মেয়ের কাছেও ক্ষমা চেয়েছিল৷ আলতা কি বলবে কিছু বুঝতে পারছিল না৷ জন্মের পর থেকে জেনে এসেছে তার বাবা নেই। থাকলেও তাকে আর তার মাকে আপন করেনি তাই খুব একটা বাবা নিয়ে তার মনে ভালমন্দ কোন অনুভূতি ছিল না। বাবার আদর বলতে সে আহসানুল্লাহর আহ্লাদকেই বোঝে৷ আপন বলতেও সে মাস্টারবাড়ির মানুষগুলোকেই ভাবে৷ এমন হঠাৎ কোথা থেকে একজন এলো বাবা হয়ে তাতেই কি সে বাবা বলে মেনে নেবে? কক্ষনো না! কিন্তু মুখে কিছু বলল না সে। আওলাদ বলল বাড়ি গিয়েও সে আলতাকে দেখতে যাবে নকশি কি আপত্তি করবে? নকশি সরাসরি বলে দিল সে কিছুতেই আপত্তি করবে না। আলতা বড় হয়েছে সে যা ভাল বুঝবে তাই হবে। শিশির খরচের পাট চুকিয়ে খোঁজ নিলো আধ ঘন্টা পর বাস আছে হাসপাতালের সামনে থেকেই৷ বেশি কিছু সাথে আনেনি তারা তবুও তিন দিনে মগ, বালতি, বক্স, চাকু সব মিলিয়ে অনেক কিছুই কেনা হয়েছিল। শিশির হাতে হাতে সব গুছিয়ে দিচ্ছিলো। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো। সে একটু সাইডে দাঁড়িয়ে ফোন তুলল, “হ্যালো সোহা!”

নামটা শুনতেই আলতা কেমন বক্র চোখে তাকালো শিশিরের দিকে৷ শিশির খেয়াল করেনি সে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। নকশি জিনিস পত্র গুছিয়ে নিতে নিতেই বলল, “আব্বা দরকারি হলে দেখা করে আসো আমি পারব গোছাতে।”

“লাগবে না ফুপুআম্মা। সোহা আমার ব্যাচমেট, লাইব্রেরিতে এসেছে তাই বলছিল আমিও ফ্রী থাকলে যেন যাই।”

শিশির খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল কিন্তু আলতার দৃষ্টি তা স্বাভাবিক দেখছে না। সে কেমন গুমোট হয়ে আঁড়চোখে দেখছে শিশিরকে৷ সকল গোছগাছ শেষ হতেই তারা বেরিয়ে পড়লো হাসপাতাল থেকে। তিন মিনিটের পথ হাটলেই বাসস্ট্যান্ড। সেখানে গিয়ে শিশির সবাইকে সিটে বসিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো। আলতা বসেছে জানালার পাশের সিটটায়। তার পাশে নকশি আর পেছনের সিটে বসেছে আওলাদ। শিশির দাঁড়িয়ে আছে বাস ছাড়ার অপেক্ষায় আর আলতা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে অন্যমনস্কভাবে। ঠিক সময়ে বাস চলতে শুরু করলো ঠিক সেই মুহুর্তে কানে এলো একটা চিকন মেয়ে কন্ঠ, “শিশির।”

আলতা চকিতে ফিরে তাকালো জানালা দিয়ে পেছনে। শিশিরের খুব কাছে এসে দাঁড়ালো এক লম্বা, ফর্সা সুন্দরী শহুরে মেয়ে। আলতার কিশোরী মন ফিচেল এক রহস্যময়ী হাসি হাসলো আর তার চোখ জমা করল শ্রাবণের বার্তাহীন অমোঘ বর্ষনের বারিধারা।

চলবে

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-২৪

“অলি এত অধৈর্য্য হলে কি করে চলবে বলো?”

“তাহলে কি আমি ঘরে বসে থাকব সারাজীবন?”

“সারাজীবন কেন ঘরে বসে থাকবে। মাত্র শিউলির বিয়ে হলো আজ পাঁচ দিন৷ বেশি না আমাকে দুটো মাস সময় দাও। একেবারে খালি হাতে তো তোমাকে আনতে পারবো না আমি। আচ্ছা তোমার কিছু করতে হবে না আমি নিজেই বাড়িতে কথা বলে তোমাদের বাড়িতে মা, কাকা, কাকীকে পাঠাচ্ছি।”

“আগামী সপ্তাহে পাঠিও।”

সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত; অলিদের বাড়ির পেছনের কাঠবাগানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে শরত। গাছের আড়ালে কিছুটা লুকিয়েই দাঁড়িয়েছে শরত আর এটাই তাকে খুব বাজে অনুভূতি দিচ্ছে। সে অলিকে ভালোবাসার পর সরাসরিই কথাটা জানাতে পারবে না বলেই কখনো বলেনি। শিশির অনেকবার বলেছিল ফোন নম্বর জোগাড় করে দেই মেসেজে জানাও, চিরকুটে লিখে দাও। শরত সেসবে পাত্তা দেয়নি৷ তার ইচ্ছে ছিল নিজেই কোন একদিন পরিবার পাঠিয়ে দিবে কিন্তু সেটা অবশ্যই আরো অনেক পরে করতো যদি ততদিনেও অলি অবিবাহিত থাকতো। সে প্রেমের নামে লুকোচুরি খেলায় কখনোই আগ্রহী ছিল না কিন্তু শিশিরটা যেতে যেতে তার অনুভূতিটা অলিকে পৌছে দিয়ে গ্যাড়াকলে ফেলে গেল। অলিও মুখের ওপর বলে বসল শরত যেন নিজে বলে ভালোবাসার কথা। তারপর….. তারপর কি করে যে কেটে গেল এই নয় মাস সম্পর্কে টের পাওয়া গেল না তবে শরত টের পেত অলি তাকে অন্যরকমভাবে চায়। অন্য প্রেমিকদের মত খুব কাছে, খুব পাগলামিতে আর ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শেও। কিন্তু শরতের মন বারংবার বাঁধা দিয়েছে তাকে। হাতে হাত রাখা আর কপালের চুমোর বাইরে আগানো তার জন্য বড় একটা চ্যালেন্জের মত লাগত। সে ভাবতো যে আমার তাকে কেন আমার না করেই অত মাখবো আমি! আজ অলি শরতকে দেখা করতে বলেছে। শরত বলেছিল ফোনেই বলো দেখা করাটা ভালো দেখায় না। প্রেমিক মন তার সে নিজেও প্রিয় মানুষটাকে দেখতে চায় কিন্তু এই দেখা করাটা যদি কখনো প্রিয় মানুষের বদনামের কারণ হয়! এই একটা ভয়েই সে ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখে তবুও বিগত কয়েক মাসে অলির ইশারায় হোক বা চোখের তৃষ্ণায় বার কয়েক দেখা করেছে এলাকা থেকে দূরে। কিন্তু আজ অলি বলে দিল বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না কিন্তু দেখা করাটাও জরুরি। সে কারণেই বাধ্য হয়ে ছুটে আসা। আর আসতেই জানা গেল অলির বাবার কাছে ভালো এক বিয়ের প্রপোজাল এসেছে। শরত আগেও বলেছিল অলিকে তার একটু সময় লাগবে শুধু শিউলির বিয়ের জন্য। বোনটাকে ভালোয় ভালোয় পাত্রস্থ করতে পারলে তার চিন্তা কমবে। অলিও তখন তার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়েছিল৷ আজ হঠাৎ করে বিয়ের কথা তুললে কি করে হবে! তবুও আশ্বস্ত করলো সে করবে কিছু একটা। কথা শেষ করে শরত অলিকে বাড়ি যেতে বলতেই অলি বলল, “এভাবেই চলে যাবো! একটু আদর করবে না?”

“সন্ধ্যে হয়ে আসছে অলি। এমনিতেই ভয় হচ্ছে কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে?”

“আজাইরা ঢং যত্তসব। কেউ দেখবে বলে প্রেমিকাকে একটু আদর করার সাহস দেখাবে না! এত ভীতু ছেলে আমি আগে কখনো দেখিনি তোমার চেয়ে তো শিশির স্মার্ট অন্তত কোন কিছুর পরোয়া না করে প্রেমিকার ঠোঁট ছুয়ে দেয়।” অলির মুখের কথা শুনে চমকে গেল শরত। তার বুঝতেও একটু সময় লাগল অলি তারই ভাইয়ের কথা বলছে! যতক্ষণে বুঝতে পারলো ততক্ষণে অলি মুখ ফুলিয়ে চলে গেছে। জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়নি শিশিরের প্রেমিকা কে? হাসিও পেলো তার অলির আচরণে। মেয়েটা দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে। বিয়েটা এবার করতেই হবে। ঢাকা থেকে যে কারণে তাকে ফিরতে হয়েছিল সে কাজটাও ঠিকঠাক করা হয়নি। দোকানের ছেলেটা অভাবের তাড়নায় চুরি করছিলো। শরতের কাছ থেকে যা বেতন পায় তা দিয়ে ভালোই চলত কিন্তু ছেলেটার আগে থেকেই অনেক ঋণ ছিল। আর পাওনাদাররা খুব করে এবার ধরছিল তাকে৷ কোন উপায় না দেখে চুরির সিদ্ধান্ত নেয়। অভাবে স্বভাব নষ্ট এমন অবস্থা। পুলিশে না দিয়ে নিজেরাই বিচার ব্যবস্থা করেছে। শরত শান্ত স্বভাবের হলেও তার চোখ রাঙানি কমবেশি সবাই ভয় পায়৷ তাই বিচার বলতে তার চোখ রাঙানি আর ভবিষ্যতে এমন কাজে না দেখার কথা বলেছে৷ অন্যথা হুমকি তো আছেই সে কি করতে পারবে তা আর বলার দরকার নেই। ছেলেটাও পা জড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছে। অনেকেই বলেছে ছেড়ে দিয়ে ভুল করেছো। সত্যি বলতে শরতেরও ইচ্ছে হয়েছে তাকে একরকম শাস্তি দেওয়ার কিন্তু তার অবস্থার কথা বিবেচনা করেই প্রথম দফায় ছাড় দিয়েছে। এবার তাকে একাই দোকানটায় নজর রাখতে হবে৷ সন্ধ্যে মিলিয়ে গেছে আরো আগেই৷ সে কাঠবাগান থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছিলো অমনি একটা অটো দেখা গেল বাস স্ট্যান্ডের দিক থেকে আসছে। সে রাস্তার এক পাশ হয়ে এগোচ্ছিলো হঠাৎ কানে এলো, “শরত না! অটো থামান তো।”

শরত ফিরে তাকালো অটো থামতে দেখে। নকশি ডাকলো, “বাড়ি যাচ্ছো।”

“ফুপুআম্মা আপনারা! শিশির তো আমাকে বলল আপনারা কাল আসবেন।”

“ও ভুলে গেছে হয়ত পরে আবার জানাতে। সকালেই নাম কেটে দিয়েছে তাই সকালেই রওনা দিয়েছিলাম।”

চার সিটের অটোর এক সিট খালিই ছিল। শরত অটোতে উঠে উল্টোদিকে আওলাদের পাশে বসলো। শরত এবার আলতাকে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন লাগছে তোর এখন?”

“ভালো।”
এক শব্দেই জবাব দিয়ে চুপ রইলো আলতা। অন্ধকার মাটির পথ ধরে অটো এগিয়ে চলছে বাড়ির পথে৷ চারজন মানুষই চুপ হয়ে রইল। বাড়ির সামনে অটো থামলে আওলাদ ভাড়া বের করতে শরত থামিয়ে দিল। জোর করে অটো ভাড়া দিয়ে নিজেই ব্যাগপত্র তুলে বাড়ি ঢুকলো। আহসানুল্লাহ দোকানে ছিল বাড়িতে শিফা, জয়তুন আর শিউলি ছিল। জামাইর সাথে সে আজই এসেছে বাপের বাড়ি বৌ ভাতের পর। আলতাকে দেখে বাড়িতে হৈ চৈ পড়ে গেল। তাদের হৈ চৈ একটু পর পাড়ার মানুষও যোগ দিল। যারা যারা শুনেছে আলতাকে নিয়ে এসেছে তারাই এসে উঠছে মাস্টার বাড়িতে আলতাকে দেখতে। এলাকা জুড়ে অনেক আগেই রটে গিয়েছিল আলতার সাথে হওয়া দূর্ঘটনার কথা। অনেকে আবার ঘটনার উল্টো বর্ণনাই জানে। আহসানুল্লাহও ফোন পেয়ে আজ তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে বাড়ি এসেছে। আসার পথে ভাগ্নির পছন্দমত গরম গরম জিলাপি কিনে এনেছে। মানুষজনের ভীড় কমলো রাত প্রায় দশটা পার করে। বাড়ি খালি হতেই শিফা নিজের ঘরে খাবার বাড়লো আলতা, নকশি আর আওলাদের জন্য। আলতাকে খাইয়ে দিয়ে নকশি খাওয়ার জন্য বসতেই আহসানুল্লাহ বললেন, “নকশি!”

“জ্বী ভাই?”

“আওলাদকে খেতে ডাক। সে আলতার পাশে আছে ডেকে নিয়ে আয়।”

নকশিও কথামত আওলাদকে ডাকলো খেতে। কিন্তু আওলাদ নিজে এসে আহসানুল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আহসান ভাই আমি খামু না। বাড়ি যাইতে হইবো এহন।”

“খেয়ে চলে যেও।”

“না, ভাই আর দেরি করা সম্ভব না। আমি যাই আর… ” থেমে গিয়ে নকশির দিকে তাকালো আওলাদ। আহসানুল্লাহ বুঝতে পারলো সে নকশিকে কিছু বলতে চায়। নকশি মাদুরের ওপর তরকারির বাটি সাজাচ্ছিল। আহসানুল্লাহ আবার নকশিকে বলল, “ও বোধহয় তোকে কিছু বলতে চায় শুনে আয়।” নকশি আচ্ছা বলে উঠতে গেলে আওলাদ বলল, “এইখানেই বলি, আমি যদি আলতারে দেখতে আসি আপনারা আপত্তি করবেন?”

ভীষণরকম বিনীতভাবে যেন আবেদন জানালো আওলাদ। নকশি একবারো চোখ তুলে তাকালো না আওলাদের দিকে। আওলাদ বারবার তাকাচ্ছে আহসানুল্লাহ আর নকশির দিকে। হাসপাতালে তিনটা দিন কাটিয়ে আওলাদের এতটুকু জানা হয়ে গেছে, তার স্ত্রী, কন্যার জীবনে একমাত্র অভিভাবক এই আহসানুল্লাহ ভাই। সে নকশির আপন ভাইদের চেয়েও আপন হয়ে ছিল তার পাশে এটা বুঝতে বাকি নেই তার।। আর সেকারণেই হয়ত আওলাদ অনুমতিটা শুধু নকশি নয় আহসানুল্লার কাছে চাইছে। আহসানই প্রথমে বলল, “নকশি আর আলতার আপত্তি না থাকলে আমারও নেই। কিন্তু তাদের ইচ্ছের বাইরে কিছু হবে না।”

নকশিও জবাব দিয়ে দিল তারও আপত্তি নেই। আলতাকে চাইলেই এসে দেখে যেতে পারে৷ এ কথার পর আওলাদের বিবর্ণ মুখটা বৈদ্যুতিক আলোর মাঝে অনেক বেশি আলোকিত মনে হলো৷ আওলাদ বিদায় নিয়ে চলে গেল। রাতের খাওয়া শেষে নকশি ঘরে গিয়ে আলতার পাশে শুয়ে পড়লো। মিনিট কয়েক গড়াতেই সে টের পেল আলতা ঘুমায়নি তবুও চোখ মুখ বুঁজে আছে।

“কি হয়েছে, ঘুমাচ্ছিস না কেন?”

মা টের পেয়ে গেছে সে ঘুমায়নি। আর তাই দূর্বল দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। নকশি হতবাক হয়ে মেয়ের চিবুক টেনে জিজ্ঞেস করলো, “কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে আলতা! তোর কি খারাপ লাগছে সোনা?”

আলতা বলল না শুধু মাকে জড়িয়ে কিছুটা সময় ফুপিয়ে আবার চুপ হয়ে গেল। রাত বাড়তে থাকলো, থেকে থেকে নিশাচরের ডানা ঝাপটানো আওয়াজ শোনা গেল। শীত জমে পাতার ফাঁকে কুয়াশা ঘাপটি মেরে রইলো ভোরের অপেক্ষায়। কিশোরী আলতা অনেকটা সময় চোখ বুঁজে মনে করলো বাবার চেহারা। বাবা মানুষটাকে দেখার পর থেকেই তার মায়া মায়া লাগছিল। কিন্তু তার জীবনে কেটে যাওয়া পনেরোটি বছরে সে মাকে যে কষ্ট সয়ে তাকে বড় করতে দেখেছে তা ভাবলেই আর থাকে না মায়াটা। তারওপর মনটা ভার সকালের ওই মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই। শহুরে সুন্দরী মেয়ে শিশির ভাইয়ের পাশে। মেয়েটা কে ছিল!

সকাল হতেই নকশি তাড়াহুড়ায় রান্না শেষ করে মেয়েকে মুখ হাত ধুইয়ে দিল। নাশতা রেডি করে আলতার পড়ার টেবিলটা ওপর ঢেকে রাখলো। মেয়েটা আরও পরে খাবে বলছে কিন্তু নকশির তো হাতে সময় নেই। গত পাঁচ ছয়টা দিনে সে স্কুল কামাই দিয়েছে তারওপর মাত্র তো কিছু টাকার কয়টা টিউশনি করে সেগুলোও যদি আর না থাকে তাহলে বিপদে পড়তে হবে। অনেকটা ঝড়ের বেগেই সে সব কাজ শেষ করে বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে। বের হওয়ার আগে শিফা আর জয়তুনকেও বলে গেল যেন একটু খেয়াল রাখে মেয়েটার। ভয়ে ভয়েই প্রথম টিউশনিটাতে গিয়ে উপস্থিত হয় নকশি। আলতার সাথে হওয়া ঘটনাটা গ্রামের প্রায় সবাই জানে তাই নকশি যা ভয় পাচ্ছিল তার কিছুই হয়নি। বরং সবাই খুব আফসোস করতে লাগল। টিউশনি শেষে স্কুলে গেলে সেখানেও একইরকম আচরণ পেয়ে শুকরিয়া আদায় করলো ওপরওয়ালার। স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথে দেখা হলো জহিরের সাথে। দীর্ঘ সময়ের চেনা জানায় জহির একমাত্র ব্যক্তি যে নকশির জন্য আজও পথ চেয়ে আছে। এই পথ চাওয়া ভিন্ন, জহির কখনোই চায়নি নকশি তাকে পছন্দ করবেই। সে নিজের পছন্দে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। আলতাকেসহই সে নকশির সাথে সুন্দর একটা সংসার তৈরি করতে চেয়েছে। নকশি সন্তানকে নিয়ে অন্য কারো সংসারে ঢুকবে না তার সংসার মেয়ে নিয়েই সাফ জানিয়েছিল। তারপর আর জহির কখনোই পথ আগলে দাঁড়ায়নি নকশির। কখনো মনের ভেতর কি চলে তা প্রকাশ করেনি। তবে দূর থেকেও চোখাচোখি হলে আন্তরিকার হাসি দিয়ে হাল হাকীকত জেনে নিয়েছে। আজও তেমনই হাসিমুখে আলতার খবর জেনে নিল৷ জহির শুনেছে আলতার বাবার কথা আহসানুল্লাহর মুখে। তার মন বলল একটাবার জেনে নিক নকশি কি ফিরে যাবে স্বামীর ঘরে! পরক্ষণেই মনে হলো এ প্রশ্ন অযাচিত। তার কোন অধিকার নেই এমন কোন প্রশ্ন করার। সে আর কথা বাড়ালো না নকশিকেও আটকালো না৷ শুধু বলল সে একটাবার আলতাকে দেখতে যাবে যদি নকশি কিছু মনে না করে। নকশিও হাসিমুখে জানালো কিছুই মনে করবে না সে।

চলবে

ধারাবাহিক গল্প
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
পর্ব-২৫

আলতার শরীর বেশ ঝরঝরে হয়ে উঠেছে এক সপ্তাহে। এখন প্রায়ই শিশির ফোন দিয়ে সরাসরি আলতার খোঁজ নেয়। গত ন’মাসে যা দ্বিধা ছিল তা যেন কেটে গেছে কিন্তু আলতা তার সাথে কথা বলে না। সে পাল্টা জিজ্ঞেসও করে না কাউকে শিশির ভাই কেমন আছে? তার মন ভালো আছে আবার ভালোও নেই। তার বাবা এই এক সপ্তাহে দু বার এসে দেখে গেছেন তার মধ্যে প্রথম যেদিন এলেন খুব জ্বর ছিল। সে একবারও আব্বা কিংবা বাবা বলে ডাকেনি আওলাদকে কিন্তু মন চাইছিলো। মায়ের দিকে তাকালে কষ্ট হয় বলেই ডাকেনি বোধহয়। কিন্তু বাবা আসে এতেই ভালো লাগে কেমন যেন মায়া মায়া লাগে। এজন্য মন খুবই ভালো। কিন্তু মন ভালো নেই শরত ভাইয়ের কথা ভেবে। অলি আপা নাকি এ সপ্তাহে তাদের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠানোর কথা বলেছিল। অথচ শুক্রবার যখন শরত ভাই পাঠাবে বলে জানালো তখন অলি আপা বলল কোন দরকার নেই। এরপর কি হলো কেউ জানেনা৷ দু দিন পর কাল জানালো বিয়ে ঠিক তার। ছেলের পারিবারিক অবস্থা খুবই ভালো। অলি আপার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো শরত ভাই অনেকটা সময়। তারপর বলল অলি আপার সাথে দেখা করবে। বাড়ি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বেরিয়ে গেল। মধ্যরাতে বাড়ি ফিরে চুপচাপ নিজের ঘরে বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে রইলো কত বেলা হলো তবুও উঠছে না বিছানা ছেড়ে। আলতা আজ থেকে স্কুলে যাবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু বাড়ির থমথমে পরিস্থিতিতে তার আজও স্কুলে যাওয়ার মন রইলো না। মামা বাড়ির অবস্থা বুঝে বড় মামীকে বলে গেল আজ যেন শরত ভাইকে কেউ কোন প্রশ্ন না করে। তাই হলো সারাদিন কেউ কিছু বলেনি। দুপুরের দিকে বিছানা ছেড়ে গোসল সেড়ে নিজেই মায়ের কাছে ভাত চাইলো শরত। তার চোখমুখ দেখে বিশেষ কিছু মনে হয়নি তবুও ভেতরে চাপা একটা দুঃখ যে তার আছে তাতো কারো অজানা নয়। শিউলি শুক্রবারেই চলে গিয়েছিল আজ বারবার ফোন করে ভাইয়ের জন্য কাঁদছে৷ বিয়ের পর শিউলির এত পরিবর্তন যা সবারই চোখে লাগছে। সে আগে এত মা, ভাই বা অন্য কারো প্রতি এত মায়া দেখাতো না। কিন্তু আজকাল শুধু মা, ভাই নয় বাড়ির সকলের জন্যই যেন অনেক হচ্ছে। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে শরত বাড়ি থেকে বের হলো তখন জয়তুন গেল শিফার কাছে। সে কাঁদতে কাঁদতে শিফাকে বলল কিছু একটা কর৷ শিফাও একটু চিন্তিত কাল রাতে আহসানুল্লাহ খুব অস্থির হয়ে উঠেছিল ঘুমায়নি অর্ধরাত পর্যন্ত। শিফা খুব করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে বার বার আদরে, আহ্লাদে জড়িয়ে বারংবার বুঝিয়েছে শরতের জন্য নিশ্চয়ই ভালো কিছু অপেক্ষা করছে৷ কিন্তু আহসানের মন মানেনি৷ তার এক ভাবনা শরত ইন্ট্রোভার্ট সে তার কষ্টগুলো ভেতরেই চেপে রাখবে৷ আর এমনটা করলে কোন অঘটন হওয়া অসম্ভব কিছু নয়৷ শরত যখন বাড়ি ফিরলো তখন যেন আহসানুল্লাহর মনের যন্ত্রণা শিথিল হলো৷ সে স্বস্তি পেলো ভাতিজাটাকে ফিরতে দেখে। তাই আজ আহসানুল্লাহ বাড়ি ফিরতেই শিফা বলল, “একটু কথা বলে দেখবেন?”

মাত্রই দোকান থেকে ফিরে মুখ হাত ধুয়ে এসেছে আহসানুল্লাহ। গামছায় হাত মুছতে মুছতে শিফার কথাটা শুনলো। সে বুঝতে পেরেছে শিফা কি বলছে কিন্তু জবাব দিলো না। শিফা উদগ্রীব কণ্ঠে আবার বলল, “ভয় পায় ভাবী শরতকে নিয়া।”

“ভয় পাওয়ার কিছু নাই। মেয়েটা লোভী তা শরত বুঝতে পারলেই তার কষ্ট কমে যাইবো।”

খাওয়ার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল আহসানুল্লাহ। শিফার ভালো লাগলো না জবাবটা৷ সে মাদুর বিছিয়ে খাবারের বাটিগুলো সামনে এগিয়ে দিলো৷ আরো একবার বলল, “তবুও আপনি একটু কথা বলেন শরতের সাথে। ওর বন্ধু বান্ধব কেউ নাই তেমন। কথাবার্তা কিছু বললে হয়ত ঠিক চাপা কষ্টটা বের হবে।”

“তোমার কি মনে হয় শিফা ও কি আমায় বন্ধুর মত ভেবে তার কথাগুলো বলবো!”

” মনের কথা না বলুক সমস্যা কিছু জিজ্ঞেস করে দেখেন৷ মেয়েটা এমন করলো ক্যান? এখনো মেয়ের বিয়ে হয়নি আপনি অলির বাবার সাথে কথা বলেন।”

“আমি সকালেই বলছি। যতটুকু বুঝলাম মেয়ে রাজী বিয়েতে। আর যেখানে মেয়ে শরতের কথা না স্বীকার করে উল্টো প্রস্তাব আসা বিয়েতে রাজী হয়ে গেছে সেখানে আর যাওয়ার কোন মানেই হয় না।”

শিফা প্রচণ্ডরকম এক চাপা ক্রোধ টের পেল আহসানের কথায়। এরপর আর কথা চলে না বলে শিফা চুপচাপ খাবার বেড়ে দিল।

ডাইনিংয়ের খাওয়া পর্ব অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে৷ শিশিরের আজ মনটা ভালো নেই বলে খেতে এলো না। হোস্টেলের খাওয়া মানে টাইম টু টাইম৷ কিন্তু ইদানীং খাওয়ায় খুব অনীহা দেখা দিচ্ছে বলে প্রায়ই খাওয়া মিস করছে সে। আজও সন্ধ্যার টিউশনি শেষ করে সোহার সাথে একটু বসুন্ধরায় গিয়েছিল৷ গার্লস হোস্টেলের মত তাদের হোস্টেলে নিয়মকানুনে খুব বেশি কঠোরতা না থাকায় সে অতি বিলম্ব করেও হোস্টেলে এমনকি নিজের রুমে এসে ঢুকতে পেরেছে। কিন্তু এখন আর মন টিকছে না রুমে। হোস্টেলের উত্তর দক্ষিণ দিকে বাগান আছে বড়সড়। সেখানেই একটু খোলা হাওয়ায় হাঁটতে পারলো ভালো লাগতো কিন্তু না বিছানা ছেড়ে উঠতেই আলসেমি লাগছে। শিশির টের পাচ্ছে তার পেটে খিদেটাও বেড়ে যাচ্ছে। অন্যান্য সময় ঘরে তার ছোট দুটো বক্সে বিস্কিট আর মোয়া,নাড়ু অথবা চানাচুর থাকতোই। প্রতি মাসেই টুকটাক শুকনো খাবার কিনে রাখা হতো তার রাত জেগে পড়ার জন্য কিন্তু এ সপ্তাহে বাড়ি থাকবে বলে শেষ হওয়ার পর আর কিছুই কিনে রাখেনি। ভেবেছিল বাড়ি থেকে ফেরার সময় মা নিশ্চিত অনেক কিছু দিয়ে দিবে কিন্তু পরিস্থিতি এত বিগড়ে গিয়েছিল সেসবের সময় পাওয়া যায়নি। এক গ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় আবার শুয়ে পড়লো শিশির। রুমমেটটা তার আজও আসেনি তার মানে নিশ্চয়ই কোন বন্ধু বান্ধবের সাথে থাকবে। প্রায়ই এমন করে ছেলেটা মাসে দশ বারোদিন বিভিন্ন ফেস্টিভ্যাল, অকেশন এটা ওটার চক্কর লেগেই থাকে। এতে অবশ্য ছেলেটার রেজাল্ট কখনো খারাপ হতে দেখেনি শিশির। কি করে পারে কে জানে! এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লো সে। সকালে ঘুমটা আবার খিদের জন্যই খুব ভোরে ভেঙে গেল৷ হলের পেছন দিকে বড় বড় দুটো জারুল গাছ আছে সেখানে বসেই বোধহয় একটা কাক তারস্বরে কা কা করেই যাচ্ছে। শিশির দূর্বল পায়ে বিছানা ছেড়ে বাথরুমের দিকে গেল। সকাল হতেই লাইন পড়ে গেছে বাথরুমের জন্য। পেটে খিদে এবং প্রকৃতির চাপ দুটোতে মিলেমিশে তার খুব বাজে অবস্থা। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে একবার মনে হচ্ছে ভেতরের মানুষটাকে টেনে বের করে সে ঢুকে পরুক৷ আবার মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাতেই কাজ সারুক। কি বিতিকিচ্ছিরি একটা কান্ড এই সকাল সকাল! চোখ মুখ যখন লাল হয়ে যাওয়ার উপক্রম ঠিক তখন বেরিয়ে এসেছে ভেতরের মানুষটি। শিশির শুনতে পেল পেছন থেকে কেউ একজন বলছে শিশির একটু পরে যাও আমার জরুরি…..

নাহ, শিশির আর শোনেনি। সে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল৷ মিনিট সাতেক সময় পার করে যখন শিশির বের হলো তখন সেই ডেকে ওঠা মানুষটির অবস্থা খুব করুণ। কিন্তু শিশিরেরইবা কি করার ছিল! স্যরি ভাইয়া আমারও জরুরি অবস্থা ছিল।

আজ আর স্কুল কামাই দেওয়ার কারণ নেই। সবে মাত্র দশম শ্রেণিতে উঠেছে। বই নতুন না হলেও পড়া ঠিকই নতুন আছে। সকালের নাশতা সেরে আলতা যখন স্কুলের পোশাক পরছিল তখন শিফা ডাকলো আলতাকে। নকশি আরো আগেই টিউশনিতে গেছে।

“মামী ডাকছিলা?”

“ডাকছিলা কি? তোরে কতবার বলছে শুদ্ধ করে কথা বলবি।!”

“তুমিও তো অশুদ্ধ, শুদ্ধ মিলিয়ে কথা বলো।” বলেই মুখ বাঁকালো আলতা।

“আমরা বলি বলে তুইও বলবি? একদম দিবো মাইর। তোরা উন্নত পড়াশোনা করিস সব উন্নত থাকবে। আমাদের সাথে জোড়া দিবি ক্যান?”

আলতা আর নকশির কথার ফাঁকে দেখলো শরত বের হচ্ছে তাদের ঘর থেকে৷ মুখটা পাংশুটে, বিবর্ণ লাগছে। মাথার চুলগুলোও আজ অগোছালো আর এমন অগোছালো শরতকে আগে কেউ দেখেনি৷ শরত বরাবরই পরিপাটি ধরনের মানুষ যে নিজেকে না শুধু তার আশপাশটাও গুছিয়ে রাখে৷ আলতার খারাপ লাগছে এই শরত ভাইকে দেখে৷ শিফা শরতকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো নাশতা করেছে কিনা৷ সে বলল দোকানেই বসে করবে৷ জয়তুন আজ খুব সকালেই বাপের বাড়ি গেছে৷ কে যেন বলেছে কোন কবিরাজ মেয়ের মন বশ করার তাবিজ দেয় আর সেও বিশ্বাস করে চলে গেছে সেদিকে। আলতা কিছু সময় পর আবার জিজ্ঞেস করলো, “মামী ডাকলে কেন বললা না!”

“হ্যাঁ শোন, তোর একা স্কুলে যাওয়া লাগবে না তোর মামা যাবে দোকানে একটুপর তাঁর সাথেই যাবি।”

“মামা নিয়ে যাবে!”
উচ্ছ্বসিত হলো আলতা। তার মানসিক অবস্থা এখনো ঠিক হয়নি। সে নিজেও একা যেতে চাচ্ছিলো না বলে মাকে বলেছিলো। নকশি নিতে আসবে বলেও গেছে। কিন্তু মামা নিয়ে যাবে শুনে একটু বেশিই যেন স্বস্তি পেলো আলতা। যথাসময়েই আহসানুল্লাহ আর আলতা বের হলো স্কুলের উদ্দেশ্যে আর তখনি নকশি এসে উপস্থিত হলো বাড়িতে।

“তুই! ”

“হ্যা, আলতাকে নিতে আসছি স্কুলে যাবে।”

নকশির কথা শুনে আহসান তাকালো আলতার দিকে, “মা তোকে নিয়ে যাবে আগেই বলেছিলো?”

জ্বিভ কামড়ালো আলতা। বলল, “হ্যা”

” জ্ঞান বুদ্ধি কিছু হয়নি তোর? মামী যখন বলল আমি নিয়ে যাবো তখন বলতে পারিসনি কথাটা। তাহলে তো ফোন করে অন্তত বলে দিতাম নকশিকে উল্টোপথে আসিস না আমি পৌঁছে দেব।” শান্ত স্বরেই রাগ দেখালো আহসানুল্লাহ।

আলতা মায়ের সাথেই স্কুলে পৌঁছুলো। ক্লাসে ঢুকতেই ক্লাসের প্রায় বেশিরভাগ মেয়ে সহপাঠীরা এসে তাকে ঘিরে ধরলো। কেউ কেউ তার হাত দেখে আঁতকে উঠলো। কালসিটে চিহ্ন এখনো স্পষ্ট ফর্সা হাতের কব্জিতে৷ সবাই তার শরীরের খোঁজ নিলেও বেশি কৌতূহলী হয়ে রইলো তার সাথে ঘটেছিলো কি তা জানতে। এরই মাঝে ঘন্টা পড়ে যাওয়া সবাই নিজ নিজ আসনে চলে গেল। আলতা লক্ষ্য করেছে ক্লাসের প্রায় সবাই তার কাছে এসে খোঁজ নিলেও একমাত্র অতশী তার জায়গা থেকে একটুও নড়েনি৷ এমনকি দূর থেকেও একবার জিজ্ঞেস করেনি, আলতা কেমন আছিস? তবে আঁড়চোখে তাকে দেখেছে কয়েকবার। আলতা আজ বসেছে একদম প্রথম বেঞ্চে আর অতশী পেছনে। প্রথম দুটো ক্লাস উসখুস করতে করতে শেষ করে তৃতীয় ক্লাসে আর বসা হলো না। অতশীর পাশে বসা মেয়েটাকে একটু বলে কয়ে নিজের সিটে পাঠিয়ে আলতা এসে বসলো তার পাশে।

“কি হয়েছে তোর?”

আলতার প্রশ্নে চোখ তুলে তাকালো অতশী। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণরকম খারাপ লাগছে তার। অতশী চুপ বলে আলতা আবার জিজ্ঞেস করলো, “আমার সাথে কথা বলবি না?”

“তুই বলবি আমার সাথে?” অতশী পাল্টা প্রশ্ন করলো।

“কেন বলব না?” অবাক হলো আলতা।

“অলি আপা যা করলো তারপর তোর রাগ হবে না আমার ওপর? তোর মামাতো ভাইকে রেখে…”

আলতা থামিয়ে দিল অতশীকে।

“অলি আপা আর শরত ভাইয়ের প্রেম কবে থেকে?”

আলতার প্রশ্নে অতশী বিষ্ময়ে তাকালো। আলতা আবারও একই প্রশ্ন করলে অতশী বলল, “গত বছর থেকে।”

“তোর আর আমার বন্ধুত্ব কবে থেকে?”

“ক্লাস সিক্স থেকে। কিন্তু…. ”

“কিন্তু কি আবার! আমি আর তুই তাদের দিয়ে পরিচিত না৷ আর অলি আপা কি করছে কেন করছে তাও আমি জানি না। শুধু বলব শরত ভাই অনেক ভালো মানুষ৷ ভাইকে বিয়ে করলে অনেক সুখে থাকত তারা।”

আলতার মন ভার হয়ে রইলো। ক্লাসে শিক্ষক এসে গেছে বলে এর বেশি আর কথা হয়নি৷ কিন্তু টিফিনের ফাঁকে দুই বান্ধবীতে ঢের কথা হলো। তারই মাঝে অতশী বলল, অলি আপার যে প্রস্তাব আসছে সে ছেলের নিজের গাড়ি আছে আবার দোতলা বাড়িও আছে রাজশাহীতে৷ দেখতে ভালোই কিন্তু শরত ভাইয়ের মত অত সুন্দর আর লম্বা চওড়া না। অলি আপা শুধু গাড়ির লোভে শরত ভাইকে ঠকালো।

‘ঠকালো’ কথাটা শুনে চমকে গেল আলতা।

“অলি আপার বিয়েটা কি তার আব্বা জেদ করায় ওই পাত্রের সাথে হচ্ছে না!”

অতশীর সহজ স্বীকারোক্তি, “জ্যাঠা তো কোন জেদই ধরে নাই। প্রস্তাব আসছে পাত্র-পাত্রী দেখাদেখি করে দু পক্ষেরই পছন্দ হওয়ায় কথা আগাইছে৷ অলি আপা তো শরত ভাইয়ের সাথে প্রেম আছে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করায় মিথ্যে বলছে। শরত ভাই নাকি তার পিছে ঘুরে সে পাত্তা দেয়নি।” অতশীর কথা শুনে জমে গেল আলতা। সে জানে পেছনের দিনগুলোতে শান্ত, সরল শরত ভাই কি পরিমাণ হাস্যমুখ আর কিছুটা চঞ্চল হয়েছিলো। সবটাই তো প্রেমের কারণে৷ আর অলি আপার কি খারাপ লাগে না শরত ভাইয়ের জন্য! আলতার নিজেরই মনটা খারাপ হয়ে গেল সব শুনে। সে তার এইটুকুনি বয়সেই তিন রকমের ভালোবাসা দেখে ফেলল। শান্ত দিঘির জলের মত শরত ভাই ভালোবাসায় উজানের ঢেউয়ের মত তিরতিরিয়ে বইতে শুরু করেছিলো। সুন্দরী অলি আপা ভালোবাসতে গিয়ে জাগতিক বিষয়ের মোহে বদলে গেল। আর শাওন! শাওন তাকে ভালোবাসে বলে জোর করে অত্যাচার করতে চাইলো। তাকে সেদিন বিয়ে বাড়িতে কোন এক বাচ্চাকে দিয়ে তাকে ডেকে আনলো। বাচ্চাটাও তো মিথ্যে বলল তাকে৷ ‘মামা ডাকছে তাকে’ এটা শুনেই সে প্যান্ডেল থেকে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল৷ তারপর কেউ হঠাৎ পেছন থেকে মুখ চেপে বাড়ির পেছনে টেনে নিল৷ এরপর একে একে হাত, পা আর মুখটাও বেঁধে দিলো৷ খোলা চোখ দুটো দিয়ে সে শুধু দেখলো শাওনের মুখটা। তার পেছনেও আরো কেউ আছে বোঝা যাচ্ছিল কিন্তু তাদের মুখ দেখতে পায়নি সে। এরপর কত চিৎকার করলো সে কত চেষ্টা করলো একটু নিজেকে মুক্ত করতে কিন্তু কিছু হলো না। শুধু কানে এলো শাওনের কণ্ঠস্বর, “তোকে ভালোবাসি আমি কিন্তু শিশির কু*ত্তার বা’চ্চাটার জন্য তোর কাছেও ঘেঁষতে পারমু না। তাই আজকাই এমন ব্যবস্থা করমু যে শিশির তো দূর কেউই তোর কাছে আসবো না।” শাওনের বলা প্রত্যেকটা কথাটা আচমকাই আলতার মন মস্তিষ্কে বাজতে লাগলো। কি বীভৎস ছিল সেই ক্ষণ! মনে হয়েছিল এই শেষ আর কখনো সে মাকে দেখবে না। আর মামার কাছে ফিরে আসা হবে না। আলতার ফর্সা মুখ লালচে হয়ে এলো তার চোখে জল টলমল। অতশী খেয়াল করলো আলতার চেহারার পরিবর্তন সে দু হাতে জড়িয়ে ধরলো।

“কি হলো তোর?”

আলতা কথা বলতে পারছে না। তার হাত-পা কাঁপছে অস্বাভাবিকভাবে। অতশী এবার ভয় পেয়ে একজন সহপাঠীকে ডেকে বলল নকশি মেডামকে ডাকো আলতা কেমন যেন করছে।

আজকে শিশিরের ক্লাস নেই৷ লাইব্রেরিতে ঢুকে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করে লাঞ্চ করতে গেল। লাঞ্চ শেষ করতেই মনে হলো আলতাকে ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়ার আজ এগারো দিন৷ কথা ছিল দশ দিন পর আবার আসবে চেকাপের জন্য অথচ কাল আসেনি৷ আম্মাও বলল ফুপুআম্মার সমস্যা বলে আসেনি শুক্রবার আসবে। এটা তো ঠিক না সময়মত রোগীর চিকিৎসা না হলে পরে রোগ বিগড়ে যেতে পারে৷ ফোনটা হাতে নিলো নকশিকে ফোন করতে তখনই সোহার কলটা এলো।
শিশির হ্যালো বলার আগেই সোহা বলল, “কাল আমার বার্থ ডে শিশির। আমি ফ্রেন্ডসদের নিয়ে একটু চিল করবো ভেবেছি তুমি প্লিজ কাল টিউশনি রেখো না।”

“কাল তো একটাই টিউশনি আছে মিস দেওয়া যাবে না সোহা।”

“এমন করো কেন সবসময়! আমার সব ফ্রেন্ড আমার মন রাখার চেষ্টা করে একমাত্র তুমিই সবসময় এড়িয়ে যাও।”

“ইচ্ছে করে এড়াই না। আমার কাছে বন্ধুরা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কালকের টিউশনিটাও মিস দেওয়া যাবে না।”

“আচ্ছা ঠিকাছে, তোমার টিউশনি কয়টায়?”

“সন্ধ্যে সাতটায়।”

“ওকে দ্যান!”

“কি?”

” ঠিক চারটায় বসুন্ধরায় থাকবে। সন্ধ্যে সাতটায় অনুর গাড়িতে করে তোমাকে টিউশনিতে ছেড়ে আসা হবে। আর কিচ্ছু শুনবো না….” খুব জেদমাখায় গলায় কথাটা বলে সোহা ফোন কেটে দিল৷ শিশিরের হাসি পেল এই মেয়েটা সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি করে৷ শিশির নকশিকে ফোন দিলো আরো কিছুক্ষণ পরে। কিন্তু ফোন তুলল না কেউ। রাতে নকশি নিজেই ফোন করে বলল, কাল সে আলতাকে নিয়ে ঢাকায় আসছে ডাক্তার দেখাতে। শিশির কি একটু থাকতে পারবে বিকেলে?
শিশির জানালো সে থাকবে।

চলবে