শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-১০+১১+১২

0
421

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

১০.
শীতের রাতের শেষ প্রহর, কুয়াশার চাদরে ঢাকা গ্রামের পথঘাট। হাড়কাঁপানো শীত বুঝি এ সময়টাতেই বোঝে মানুষ! লেপের উষ্ণ ওম ছেড়ে বাইরে বের হওয়ার মত নির্বুদ্ধিতা ক’জন করে আর করতে চায়? শিশিরও চায়নি এ বেলায় ভাইয়ের সাধের ঘুম নষ্ট করে তাকে শুভ্রধোয়ার মত কুয়াশা ঘেরা পথে ডেকে আনতে৷ নিতান্তই বাধ্য হয়ে ডাকা আর তা শরতও বুঝে গেল। সে নিঃশব্দে উষ্ণ বালাপোশ ছেড়ে উলের মোটা সোয়োটার গায়ে দিয়ে মাফলার জড়িয়ে নিলো গলায়। লুঙ্গি পরে ঘুমায় সে রাতের বেলায় তা বদলে প্যান্ট পরলো। শরত কখনোই মাফলার দিয়ে কিংবা মাংকি ক্যাপে মাথা ঢাকতে পারে না। কিন্তু এই ভোরে কনকনে ঠান্ডা আর কুয়াশায় মাথা জমে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাধ্য হয়েই গলার মাফলার পেঁচিয়ে কুয়াশা থেকে মাথা বাঁচাতে কালো ক্যাপটা বের করলো তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে। মনে পড়ে গত শীতের আগে কেনা এই ক্যাপটা অলির পছন্দের। ক্যাপটা হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড মৌন কল্পনায় বিভোর থেকে আবার চুপচাপ ফোন আর মানিব্যাগটা পকেটে ঢুকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো টর্চটা কোথায় আছে। টেবিলের ড্রয়ারেই পাওয়া গেল সেটা। তারপর অতি সন্তর্পণে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দিলো। সামনের দরজা দিয়ে বের হতে গেলেই মা টের পেয়ে যাবেন। সামনের দরজাটা লোহার হলেও জং ধরায় ক্যাড়ক্যাড় করে শব্দ করে খুলতে লাগাতে গেলেই। তাি এই পেছন পন্থায় বাড়ি ছাড়লো শরত। বাড়ির মূল গেইটের তালা খুলে বেরোবার সময় একটু শব্দ হলেও ঘরের ভেতরে ঘুমে মগ্ন কারো ঘুম ভাঙার কথা নয়। বাড়ি থেকে রেলস্টেশন মানে অনেকটা পথ৷ বাজার পথে গেলে এই রাতে অটোতে কমপক্ষে বিশ মিনিট লাগবে কিন্তু অটো পাবে কোথায়! আর যদি ঘুর পথে পাশের গ্রাম হয়ে ক্ষেত-খামার দিয়ে যায় তখনও ঝামেলা নদী পার হতে হবে। এ রাতে মাঝি পাবে কোথায় নৌকা তো ঘাটেই আছে এ পাড়ে ও পাড়ে দু দিকেই। অনেক ভেবে গ্রামের ভেতর দিয়েই গেল শরত। পাক্কা পনেরো মিনিট পর নদীর পাড়ে এসে মনে হলো এত বড় ভুলটা না করলেও হতো৷ উত্তরে হাওয়া আর কুয়াশার দাপট গরম কাপড় ভেদ করেই শরীরকে অবশ করে দিচ্ছে। নৌকা বাওয়া তার মত আনাড়ি মানুষের পক্ষে একদমই বোধহয় সম্ভব নয়। এদিকে ফোনটা আবারও বেজে চলছে। ফোন বের করে ধরতেই বলল, “ভাই তুমি না হয় এসো না একটু কষ্ট করে সিরাজ ভাইকে ফোন দিয়ে শুধু অটো নিয়প আসতে বলো। মেয়েগুলোকে পাঠিয়ে দেই আমি হেঁটে চলে আসব পরে।”

“মেয়েগুলো!” আঁতকে উঠেছে শরত।

“মেয়েগুলো মানে কি শিশির।”

“ভাই আলতারা আসবে বলেছি না!”

শরত জানত আলতা আসবে এ সপ্তাহে আর তাকে তার বাবা আনবে কিন্তু শিশিরের কথা শুনে মনে হলো আলতা ছাড়া আরও কেউ আছে তার সাথে। প্রচণ্ড শীতের মাঝেও তার আচমকা অস্থিরতায় গা গরম হয়ে গেল। দ্রুত নৌকায় চড়ে আশপাশে একবার তাকালো। মাঝি তো দূর আসার পথে দু চারটে শেয়ালের ডাক শুনলেও সেগুলো চোখে পড়লো না। নদীর তীর জুড়ে কাশফুলের মেলায় কোথাও কোন জন্তু আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে বাঁধা নৌকার ছইয়ে খুঁজে দেখলো বৈঠা আছে কিনা। সামনেই পেয়ে গেল সেটা আর নৌকা কার শরত জানে সকালে তাকে জানিয়ে দিলেই হবে। খুঁটি থেকে নৌকা ছাড়িয়ে বাওয়া শুরু করতেই টের পেল সে আপাত শান্ত নদীটাতেই নৌকা বাইতে তার জান লেগে যাবে। যেখানে মাঝি এই নীরব, না অতি চওড়া নদীটা পার করতে সাত আট মিনিট লাগায় শরতের লাগলো বিশ মিনিট। তার মাঝে শিশির আরো একবার কল করেছিলো শরত শুধু বলেছে সে নদী পার হচ্ছে ব্যস, শিশির আর অপেক্ষা করেনি স্টেশনে। তিন তিনটি যুবতী মেয়েকে সাথে নিয়েই গ্রামের পথে ঢুকলো। উদ্দেশ্য শরতকে যেন নৌকা বেয়ে আবারও পথ না চলতে হয় এদিকটায়। শরত নদী পার হয়ে দেখলো তার ভাই দু হাতে দু ব্যাগ কাঁধেও ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার ওপর শাল গায়ে যেটা তার নিজের নয় বলে দেখাই যাচ্ছে। আর শরতও বৈঠার সাথে ধস্তাধস্তি চালিয়ে নদী পার হতে গিয়ে গা গরম হয়ে ঘেমে যাবার জোগাড়। সে নৌকা থেকে না নেমে বৈঠা দিয়েই কোনমতে নৌকাটা আটকে রাখার চেষ্টায় বলল, “দ্রুত উঠে পড় তোরা।”

শিশির এগিয়ে এলো প্রথমে। নৌকার কোণায় পা রেখে একে একে তিনটা ব্যাগই রেখে ঠেলে সামনের দিকে রেখে সোহাদের ডাকলো। শরত তখনও মেয়ে তিনটির দিকে ঠিকঠাক তাকায়নি। আঁধার ফিকে হয়ে গেছে তবুও কুয়াশায় সবটা আবছা। প্রথমে আলতা তারপর অনু এবং সবশেষে সোহা এসে উঠলো নৌকায়। আলতার উঠতে সমস্যা হয় না। অনুও অনেকটা শক্ত পুরুষদের মত না টলেই উঠে গেছে একমাত্র সোহা-ই নৌকায় পা রাখতেই তার পা হড়কায়। পড়ি পড়ি করেও শিশিরের বাহু ধরে সামলে নিলো নিজেকে। আধো ফ্যাকাশে আঁধারেই বুঝি আলতার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে দেখলো ঘটনাটুকু তাতেই ভেতরের মন নামক অদৃশ্য বস্তুটা জ্বলে উঠলো। ভাগ্যিস শীত বলে নদীর পানি কম আর পানির ঢেউয়ের স্তব্ধতা ছিল তাই কাদামাটিতে মাখামাখি হয়নি পা কারোই নৌকায় উঠতে গিয়ে। শিশির নৌকাটা টেনে অনেকটা সামনে রেখেছিল তাই কাদাটুকু তার পায়েই বিদ্যমান৷ সে এবার নৌকাটা পানির দিকে ঠেলে উঠে বসলো। সে উঠতেই শরত নিজের পরনের সোয়েটার খুলে ধরিয়ে দিল শিশিরকে। শিশির নিতে না চাইলে ধমকে উঠলো, “শীতে কি অবস্থা টের পাচ্ছিস? চুপচাপ গায়ে দে এটা আমার নিচেও আরেকটা ভারী লং হ্যান্ড গেঞ্জি আছে।”

শিশির তৎক্ষনাৎ নিয়ে গায়ে দিলো সোয়েটারটা। আলতা নির্বিকার বসে ছিলো নৌকায় অনুরও তেমন ভাবের পরিবর্তন নেই তবে সোহার ছটফটিয়ে ওঠা টের পাচ্ছিলো সবাই। তার মনের অবস্থা তখন চঞ্চল। ঘোর কুয়াশায় মাখামাখি ভোরের পূর্বাভাস, পাশেই পছন্দের পুরুষ আর তার অব্যক্ত অনুভূতির অস্থিরতা সব মিলিয়ে তার তখন নেচে ওঠার মত অবস্থা। হীম শীতল নদীর জলেও হাত ডুবাতে সে কাঁপছিলো না, ভয় পাচ্ছিলো না। কখনো পানি ছুয়ে দেখছে, ঠোঁটে মুচকি হাসে সেই হাসিতে তার চোখও হাসছে অথচ এই হাসির সাক্ষী কেউ হতে পারছে না৷ নৌকা এবার শিশির বাইছে শরতের সাথে। ভাইয়ের অবস্থা যে নাকাল সে আগেই বুঝতে পেরেছে৷ দু ভাই মিলে তাল মিলিয়ে বৈঠা ধরায় অল্প সময়ে পাড়ে এসে ভীড়লো তারা। এবার একটা নৌকা বেঁধে প্রথমে শরত নেমে মেয়েদের নামতে বলল। তারপরই এগিয়ে ব্যাগ দুটো নিজের হাতে নিতেই শিশির বলল, “ভাই আমি নিতে পারব।”

ব্যাগ দুটো মূলত আলতা আর সোহার। অনুর ব্যাগপ্যাক ছোট এবং সেটা তার কাঁধেই তাই সেটা কাউকেই দেয়নি সে। শিশির আপত্তি করায় শরত একটা নিলো অন্যটা শিশির। শরত হাতের টর্চ জ্বালিয়ে সরিষা ক্ষেতের আইল দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো তার পেছনে আলতা তার পেছনে অনু আর অনুর পেছনে সোহা। শিশিরের প্রায় পাশাপাশি হয়ে আসছে সোহা তাও যেন নজর এড়ায় না আলতার। বুকের ভেতরটা কি আবারও ফুলে ফেঁপে উঠছে! এবার বুঝি চোখ দুটিও আদ্র হবার উপক্রম। পাঁচজনের ছোটখাটো একটা দল যখন বাড়ির গেইটে এসে উপস্থিত তখন কানে এলো দূর থেকে ভেসে আজানের সুর। শরত গেইটের তালা খুলে সবাইকে ভেতরে যেতে বলে সে নামাজের জন্য চলে যাচ্ছিলো শিশির তাকে থামিয়ে আবার সোয়েটার ধরিয়ে দিল। সে তো এখনি ঘরে ঢুকে লকম্বলের তলায় ঢুকবে কিন্তু ভাই এই শীতে নামাজে যাবে। শরতও বিনা বাক্যে সোয়েটার গায়ে দিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় নিজের ঘরের চাবি দিয়ে বলল, “কাকীকে ডেকে ওদের ঘরে দিয়ে তুই আমার ঘরে শুয়ে পড়।”

রাতভর ছটফট করেছে নকশি তবুও চোখের পাতা দুটি অল্প সময়ের জন্যও বন্ধ রাখতে পারেনি। আজ রাতটার অস্থিরতা তাকে প্রায় অসুস্থ করে তুলেছিলো পুরনো স্মৃতির ভাঁজে ডুবে। মনে পড়ে যায় আলতা গর্ভে থাকা অবস্থায় প্রথম চারটা মাস সে এমনই করে রাত জেগেছে। অস্থিরতায়, অসুস্থতায় তখন বারবার ভেবেছে আওলাদ চলে আসুক তার কাছে যে করেই হোক। তখন সে কত কত নির্ঘুম রাত নিঝুম মাস্টার বাড়ির উঠোনে হেঁটে হেঁটে পার করেছে। কখনো কখনো জয়তুন রাতে জেগে বাথরুমে গেলে তাকে দেখে বকাবকি করতেন। সবসময় বলতেন, “পোয়াতি মানুষ রাত বিরাতে একা বাইর হইসনা। খারাপ লাগলেও দোয়া দরুদ পইড়া ঘরেই পইরা থাকবি। কওন যায় না কোন সময় কিসে আছর করবো তাইলে কিন্তু পেডেরটা (পেটেরটা) টিকবো না। কত কিছুর বদনজর লাগে আর যদি তেনাগো(ভূত প্রেতের) নজর পড়ে বইন তাইলে কিন্তু তোরও ক্ষতি হইব।”

তখন সে নিজের পাশে আওলাদকে পাওয়ার জন্য অস্থির হতো। তার একলা জীবনে ভরসার একটা হাত পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছটফট করতো। আজও করেছে ছটফট আজও গর্ভে একটা শিশু তবে আজকের অস্থিরতা, কাতরতা কোন ভরসার হাত কিংবা মাথার ছাঁদের কথা ভেবে নয় আজকে শুধুই তার প্রথম সব্তানের কথা ভেবে। নকশি ঘুমায়নি তার সাথে ঘুমায়নি জহিরও৷ রাতভর কখনো মাথায় হাত বুলিয়েছে, কখনে পানি খাইয়েছে কখনোবা হাড়কাঁপানো শীতে উষ্ণ বালাপোশ ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে ঘরের সামনের বারান্দায় পায়চারী করেছে। একটুও বিরক্ত না হয়ে রাত পার করে ভোরেই বেরিয়ে গেছে মাস্টার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আলতার আজ সকালে আসার কথা তারা পৌঁছুতে আর কতক্ষণ সে কথাটাই জানতে এসেছে আহসানের কাছে। আলতার ফোনে কয়েকবার কল দিয়েও তাকে পায়নি বলে আবার মনে মনে ভাবছিলো আলতা যদি তার বাড়ি না যেতে চায়! মনের ভাবনায় সে যুক্তি মিলিয়েছিল বিয়ের রাতের কথা ভেবেই। মেয়েটা তার মায়ের সুখের কথা ভেবে তাদের বিয়েটা দিলেও মনের ভেতর চাপা যন্ত্রণার জন্যই সে রাতে গ্রাম ছেড়েছিল। জহিরের মন বুদ্ধিসম্পন্ন বলেই সে ভেবে রেখেছে আলতা এলে নিজে এসে বাড়ি নিয়ে যাবে। কিশোরী মেয়ে তার ভাবাবেগ যথেষ্ট কাঁচা সে সবটাই মন থেকে ভেবে কষ্ট পাবে তা যেন বুঝতে সমস্যা হয় না জহিরের। শিশিরদের বাড়িতে ঢুকেই জহিরের দেখা হলো প্রথমে শিফার সাথে। সে সালাম দিয়ে আলতার কথা জিজ্ঞেস করতেই শিফা বলল, আজানের সময় এসেছে শীতে কাঁপতে কাঁপতে তাই এসে সাথে সাথেই ঘুম দিয়েছে এখনো ওঠেনি। তারমানে আধঘন্টার মত হবে ঘুমিয়েছে এখনো চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা ভোর হলেও বোঝার উপায় নেই যেন। কিন্তু নকশি তো অস্থির হয়ে আছে সে কথা শিফাকে বলতেই শিফা বলল, “ফোন করেন আমি কথা বলি।”

জহির তাই করলো; শিফা কথা বলে জানালো মেয়েটা মাত্রই ঘুমিয়েছে। এখন উঠলে শরীরটা না আবার খারাপ করে! এরপর আর কথা থাকে না। নকশি নিজের মনকে বুঝিয়ে নিলো ভাবীকেও বলল, আলতা ওঠলেই যেন তাকে পাঠিয়ে দেয়। শিফা আশ্বস্ত করলো সে পাঠাবে প্রয়োজনে নিজেই নিয়ে যাবে ও বাড়ি। মাত্র তো কয়েকটা বাড়ি পরেই জহিরের বাড়ি।

সকাল দশটার ওপার ঘড়ির কাটা তখন সূর্যটা একটু জোর দেখিয়েই শীতকুয়াশাকে দূর করলো। কাঁচরঙা রোদ্দুরে তখনও তেজ তেমন নেই তবুও শীত বুড়িকে হালকা উষ্ণ করতে বদ্ধপরিকর। দরজা জানালা বন্ধ থাকায় জানালার ফাঁক গলে একটু খানি সূর্যরশ্নি সরু হয়ে পড়েছে আলতার আলতারঙা মুখটাতে। সারা শরীরের কম্বলের উষ্ণতা ঘুমটাকে কিছুতেই পাতলা হতে দিতে চাইলো না। কিন্তু শিশির তো আর শীতমহলে উষ্ণতা নয় বরং শীতের রাতের হিম হয়েই আলতাকে জ্বা*লিয়ে খেতে সদা প্রস্তুত। সোহা, অনু তখনো গাড় ঘুমে যকন শিশির জোরে হাঁক ছেড়ে আলতার নাম ধরে ডাকছে। আলতা ডাক শুনেও ওঠার প্রয়াস দেখায় না অথচ শিশিরের ডাক বন্ধ হবার নামটি নেই। কিন্তু তার চেঁচামেচিতে অনুর চমৎকার ঘুমটা ভেঙে চুর*মার হয়ে যাওয়ায় সে তার স্বভাবসুলভ আচরণে গালি দিয়ে বসলো, “শা*লা শিশির চুপ কর বা* একটু শান্তিতে ঘুমাতে দে।”

ভোরের ফকফকা সকালটা মুহূর্তেই ছাইরঙা মেঘে অন্ধকাট হয়ে গেছে শিশিরের। পাশেই যে তার পিতৃ মহোদয় দাঁড়িয়ে আছেন কড়া নজরে তাকিয়ে।

চলবে

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

১১.
ব্লু জিন্স এর ওপর সাদা কটন হাফ স্লিভ লং কূর্তি তার ওপর হুডি পরা অনু পায়ে তার সাদার মধ্যে কেডস । বা হাতে ব্রাশ করতে করতে সে শিশিরদের উঠোন ছেড়ে এবার গেইটের কাছে গেল। চোখ জোড়া বিষ্ময়ে অভিভূত কুয়াশায় বাড়ির পাশের পথটা এখনো হালকা ঢেকে আছে। ঘড়িতে তখন দশটা বেজে গেছে বাড়িতে সকলেই তখন শিফার বাইরের চুলায়৷ আগে যেটা নকশির ছিল সেখানে বসে ভাপা পিঠা খাচ্ছে। একমাত্র অনুই সবার পেছনে পড়েছে তার কারণ অবশ্য সে অনেকটা সময় আহসানুল্লাহর সাথে গল্প করেছে। সকালে যখন শিশির ডাকাডাকি করলো আলতাকে তখন অনু ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় তার স্বভাবসুলভ আচরণে কিছু অসংগত শব্দ উচ্চারণ করেছিল। যা বাড়ির বড়রা প্রত্যেকেই শুনেছে এবং শিশির তার পাশে বাবাও শুনেছে বলে ভয়ে, লজ্জায় প্রায় কুঁকড়ে গিয়েছিল। কিন্তু মিনিট কয়েকের মাঝেই অনু যখন ঘর ছেড়ে বের হলো তখন সে অতি নম্রতায় সালাম দিয়েছিল আহসানকে। আহসানুল্লাহ এক পলক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। শিশিরে মেয়ে বান্ধবীরা আসবে জানতো কিন্তু তাদের পোশাক পরিচ্ছদ এমন হবে তা তার ধারণার মধ্যে ছিলো না। যদিও মেয়েটি একদম অশালীন কোন পোশাক পরেনি তবুও পরিবেশ অনুযায়ী এ গ্রামে জিন্স পরা মেয়ে দেখলে সকলেই নাক কুঁচকাবে সুযোগ পেলে কথা রটাবে। আহসান আর সেখানে দাঁড়াতে চাচ্ছিলো না কিন্তু অনু নিজেই ডাকলো, “আঙ্কেল আপনি নাকি ঢাবিতে পড়েছিলেন?”

আহসান থামল; তার পড়াশোনা তার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কথা উঠলেই সে নস্টালজিক হয়ে পড়ে। স্মৃতি হাতড়ে দূর্বল হয় কত কি যে সেই পড়াশোনায় ফেলে এসেছে! অনুর এই এক প্রশ্নই তাদের আলাপের কারণ হলো। কয়েক মিনিটের মাঝেই দেখা গেল অনু চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে এসেই বসে পড়লো শিশিরদের বারান্দায়। জোর করেই আহসানকে বসালো সে ভার্সিটি সম্পর্কে জানবে বলে তাদের পড়াশোনা কালীন সময়কার কথা। বাড়িতে তখন শিফার পিঠা বানানোর আয়োজন চলছিল। আলতা ঘুম থেকে উঠে মুখ হাত ধুয়ে গিয়ে বসলো চুলার পাশে। শিফা প্রথম পিঠা চুলা থেকে নামিয়েই আলতাকে দিয়ে বলল, মামাকে দিয়ে আয়।

আলতাও মামীর কথামতো লক্ষ্মী মেয়ের হয়ে প্রথমে মামাকে পিঠা দিয়ে শরত ভাইকে ডেকে আনলো। শিশির নিজেই ততক্ষণে কয়েকটা জলচৌকি পেতে দিলো উনুনের কাছেই। একে একে সেখানে শিশির, সোহা, শরত আর আলতা এসে বসলো পিঠা খেতে। এভাবে রান্নাঘরে বসে একসাথে সবাই মিলে পিঠা খাওয়ার আয়োজন ভীষণ উপভোগ করছে সোহা। তখনও অবশ্য অনুর কথা শেষ হয়নি। আহসান পিঠা খাওয়ার কথা বললে সে কিছু না বলে খুব স্বাভাবিক ভাবে আহসানুল্লাহর প্লেট থেকেই ভেঙে নিয়ে মুখে দিলো। অবাক হয়ে দৃশ্যটুকু দেখলো আহসান তার মনে হলো মেয়েটি পোশাক পরিচ্ছদ কিংবা আচরণে যতখানি উশৃংখল তার মনটা তত নয়। মেয়েটার মধ্যে মেকি, নকল কিছুই নেই না কোন রাখঢাক। অল্প সময়েই আহসানের মনে এই মেয়েটা জায়গা করে নিয়েছে মেয়ের মত করে। আর তাদের কথাবার্তার মাঝেই অনু ব্রাশ না করেই পিঠা খেয়ে ফেলেছে তাই এখন সে ব্রাশ নিয়ে বেরিয়েছে। নিজের বাড়িতে বদ্ধ ঘর, আধুনিক বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয়না দেখতে দেখতে ব্রাশ করা মেয়েটা প্রকৃতির সাথে মিশতে পেরে খুব বেশিই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।

সকালের পিঠা পর্ব শেষ হওয়ার পর শরত আর আহসানুল্লাহ দোকানে চলে গেছে। শিশিরও বেরিয়ে পড়েছে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। বাড়িতে ছিল শুধু পাঁচজন জয়তুন, শিফা আর আলতারা। শিফা কয়েকবার আলতাকে খেয়াল করলো মেয়েটার পরিবর্তন চোখে পড়ার মত। ছোট্ট থেকে আলতা ছিল একদম চঞ্চল, অবাধ্য আর ছটফটে অনেকটা চড়ুই পাখির মত। ফুড়ুৎ করে এদিক ওদিক ছোটা, সুযোগ পেলেই মার্বেল খেলতে বেরিয়ে পড়া সবাইকে বিরক্ত করা এসবেই তার স্বস্তি ছিল। তারপর হুট করেই একদিন মায়ের বিয়ে নিয়ে একটা ভাবনা মাথায় ঢুকলো এরপরই মেয়েটা শান্তশিষ্ট আর কেমন পরিণত হয়ে গেছে মনে হলো। কিন্তু এবার তো এসে আরো বেশি চুপ লাগছে মেয়েটাকে। কষ্ট হচ্ছে শিফার আলতাকে এভাবে দেখতে তাকে তো সেই ছটফটে আলতা হিসেবে দেখতেই ভালো লাগে শিফার যে আলতার শিশিরের হাতে মা*র খেয়ে এসে নাক মুখ ফুলিয়ে মামার কাছে নালিশ করতো। শিশিরকে তার বাবা কিংবা শরতের হাতে ধো*লাই করবে বলে বিড়বিড় করে পণ করতো আর মামীকে বলতো, ” মামী তুমি আজকে একটুও ধরবে না শিশির ভাইকে। কাকের বড় ভাই শিশির ভাই মা*রুক মামা তাকে।”

কতশত অভিযোগ করে শিশিরকে মা*র খাওয়াতে উঠে পড়ে লাগত একসময়। আলতার মুখের দিকে তাকালেই শিফার বুকটা ভারী হয়ে আসে। জহির ভোরে এসে বলে গেছে নকশির শরীরটা ভালো না তারওপর মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে আছে। সে নিজেও কলে কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পেরেছে নকশির অবস্থা তাই ভাবছে কিছু একটা বলে আলতাকে জহিরের বাড়ি এখনই পাঠাতে হবে। শিফার মনে হলো কথাটা সে গুছিয়ে বলতে পারবে না সে জয়তুনকে বলল, “ভাবী আলতারে ওই বাড়ি যাইতে বলা দরকার না! নকশি রাতভর ঘুমায় নাই ওর জন্য অপেক্ষা করছে।”

“হ গো শিফা আমিও ভাবতেছি কখন যাইব মাইয়াডা। আলতার মুখটা দেখছোস রঙটা কিমুন জানি হইছে আর মুখটাতেও আনন্দের ছাপ নাই। মা মাইয়া জীবনেও এতডা দিন কেউ কাউরে ছাইড়া থাহে নাই।”

“ভাবী আপনি বইলা দেখেন ও যায় কিনা!”

জয়তুন শুনেই এগিয়ে গেল আলতার দিকে। উঠোনের যেখানটাতে শিউলি গাছ সেখানে বসে ছিলো আলতা, সোহা আর অনু৷ তিন জনেই মাটিতে নেতিয়ে পড়া শিউলি কুড়াচ্ছে। ভোরে উঠে শিশিরে সিক্ত শিউলি কুড়ানো আলতার খুব পছন্দ কিন্তু আজ তো ভোর কেটেছে ঘুমের রাজ্যে তাই এখনই তার এগুলোকে দেখে তুলতে ইচ্ছে হলো। তাকে দেখেই বাকি দুজনও বসে গেছে যদিও অনুর এসবে আবেগ নেই খুব একটা কিন্তু শিশির না আসা অব্ধি তাদের পক্ষে বাইরে বের হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সোহা খুব উপভোগ করছে বিষয়টা সে অতি উৎসাহ নিয়ে তুলছে ফুলগুলো যেমনটা আলতা করছে। জয়তুন এগিয়ে গেলেন তাদের দিকে মনযোগে তিনটি মেয়েকেই দেখলেন। অনুকে তার বিশেষ পছন্দ নয় তার পোশাকআশাক আর ঠোঁটকাটা কথাবার্তার জন্য । তবে সোহাকে তার বেশ পছন্দ হয়েছে একদম কোমল, নরম মনের মেয়ে সেই সাথে কথাবার্তা আচরণ সবেতেই মিষ্টি মেয়েলি ব্যাপার আছে যা অনুর মধ্যে নেই। তারওপর সোহার ব্যবহারে বোঝা যায় না সে শহুরে কতটা পয়সাওয়ালা। মেয়েগুলোকে দেখতে দেখতেই আলতার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি ক্ষীণ স্বরে ডাকলেন, “আলতা।”

ফুল কুঁড়িয়ে হাতে তুলতে তুলতেই জবাব দিলো, “কি মামী?”

“মা’র কাছে যাবি না?”

থাম থামলো আলতার; সে মামীর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। হাতের সব ফুল ঝেড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। একটুখানি হেসে বলল, “হ্যা মামী যাবো তুমিও যাইবা?”

জয়তুন কি একটুখানি বুঝলো আলতার সংকোচ! উঠোনের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে শিফাও বুঝলো আলতার মন সে এগিয়ে এসে জা’য়ের উদ্দেশ্যে বলল, “চলেন ভাবী সবাই মিলেই যাই। পরে আলতা না হয় থাকব আমরা চলে আসব।”

‘আলতা না হয় থাকব’ কথাটা আলতার কেমন যেন লাগল। সে মায়ের কাছে থাকতে চায় কিন্তু কার বাড়ি গিয়ে থাকবে! জহির কাকার বাড়িতে সে ক”বার পা রেখেছে তাতেই সন্দেহ সেখানে গিয়ে থাকবে কি করে! আবার মনে হয় মায়ের এ সময়ে মায়ের সাথে দুটো রাত থাকতে না পারলে তারই যে কষ্ট লাগবে। সময় তো পেরিয়ে যাচ্ছে তার ছোট্ট জীবনটা থেকে। কদিন পর আর এই সুযোগটা নাও আসতে পারে! শিফার কথায় জয়তুন সহমত হলেন তাই সাথে করে সোহা আর অনুকেও নেওয়া হলো জহিরের বাড়িতে।

আওলাদের গরুর খামারে আজকাল উন্নতি দারুণ হচ্ছে । সে সুযোগ বুঝে সদরে কৃষি সমিতির মাধ্যমে এক ট্রেনিং সেন্টার থেকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণও নিচ্ছে। কাজ কর্মে শুধু মাছ চাষেই এখনো খুব একটা লাভ হচ্ছে না তার বাকি দিক গুলোতে উন্নতি চোখে পড়ার মত। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই খামারের দিকটা দেকেশুনে কর্মচারীদের বলল, পাঁচ কেজি দুধ একদম আলাদা করে দিতে। খামার থেকে বেরিয়ে বাড়ির পাশের সৈয়দের কাছে গেল ভালো গুড় মিঠাই এর জন্য। ভালো গুড় এর ব্যবস্থা করে বউকে পিঠার চাল যা গত কাল গুঁড়ো করে এনেছে বাজার থেকে সেগুলো ব্যাগে ভরে দিতে। বড় ছেলেটাকে ডেকে বলল, “গাছে ওঠ তোর আপার জন্য নারিকেল পাইরা দে নিয়া যামু।”

বড় ছেলেটা সাথে সাথে কয়েকটা নারকেল পারতেই আওলাদ নিজে দা নিয়ে বসল নারকেল ছিলতে। তার স্ত্রী চেয়ে চেয়ে শুধু দেখতে থাকলেন সবটা। একটু আগেই তার ছোট ছেলে এসে বলেছে, “আব্বায় তো ম্যালা দুধ আনছে খামার থাইকা আবার গুড়ও কিনছে সৈয়দ কাকার কাছে। এত্তাগুলান দেখছি আমি গুড়।”

সেই থেকেই সে রুষ্ট চোখে দেখে চলছেন স্বামীর কাজ কারবার। মনে মনে রোষানলে পুড়তে থাকলেও আপাতত কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। অনেক দিন আগে স্বামীর হাতে মার খেয়েছিলেন সৎ মেয়েকে দুটো কটু কথা শোনানোতে সেই থেকে আর বলেন না কিছু। কিন্তু এবার সে শুধু দেখছে আর হিসেব রাখছে একদিন সুযোগ করে এলাকার মাতব্বর, চেয়ারম্যান সব ডাকবেন৷ এভাবে যদি ওই এক মেয়েকেই দিতে থাকেন সব তার ছেলে দুটোর কি হবে তা ভেবেই সে ক্রোধে ফেটে পড়ে। আওলাদ আনন্দ চিত্তে পাঁচটা নারকেল ছিলে নিলেন। কোড়ানোর কথা ভেবেছিল পরে ভাবল এগুলো তো নিয়ে দিবে সেই শিফা ভাবীর কাছে সে কতটুকু বানাবে এখনই কি করে আন্দাজ করবে! তাই ঠিক করল ছিলেই নিবে সে আলতাকে বলে আসবে কষ্ট করে যেন মামীকে কুরিয়ে দেয় সে। চালের গুঁড়ো বড় এক ব্যাগ ভর্তি নিলো সাথে অন্য ব্যাগে গুড়, নারকেল নিলো। বাজারের মোড় থেকে অটো আনিয়েছে সেটাতে ব্যাগ দুটো ভরে অটোতে বসল। উচ্ছাসিত তার চোখমুখ আর মাত্র কিছুক্ষণ পরই মেয়ের সাথে দেখা হবে বলে। প্রথমে ভেবেছিল পিঠার এসব সামগ্রী সে নকশির বাড়ি দিয়ে আসবে মেয়ে নিশ্চয়ই তার কাছেই থাকবে। কিন্তু পরবর্তীতে কোন মতে জানতো পারলো নকশির গর্ভাবস্থার কথা। এসব তাকে করতে দেওয়া ঠিক হবে না ভেবেই সে সব একদম গুছিয়ে নিয়ে চলছে শিফার কাছে অনুরোধ করবে বলে। শিফা, আহসানরা তার মেয়েকে অবহেলা করে না তা সে জানে আর সেজন্যই এসব গুছিয়ে নিয়ে চলল মাস্টারবাড়ির উদ্দেশ্যে। চাইলেই বাড়ি এনে খাওয়াতে পারতে তার স্ত্রী বিনা বাক্য ব্যয়ে সব তৈরি করে দিত কিন্তু এখানে এসে মেয়েটা আদর, ভালোবাসায় মেশানো পিঠা পেতো না। পেতো ওই মহিলার মনে মনে বলা কিছু অভিশাপ মিশ্রিত পিঠা। তারচেয়ে বরং মেয়েটা যেখানে আদর পায়, ভালোবাসায় ডুবে থাকে সেখানেই থাকুক সে শুধু চোখের দেখায় সুখ নিবে। অটোতে বসে এসব কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ ভিজে এলে অশ্রুজলে৷ কেমন করে যেন মেয়েটা তার অন্য দুই সন্তানের থেকেও বেশি আদরের হয়ে গেল। অথচ এই মেয়েটার জন্ম, বেড়ে ওঠা কিছুই সে নিজ চোখে দেখেনি।

পৌষ শেষের শীতের রাত বড্ড কনকনে। আর এমন কনকনে একটা সম্পূর্ণ রাত নকশির কেটেছে নির্ঘুম, ক্লান্ত। আলতার জন্মের সময় তার শরীরটা ছিলো তখনো ছোট। বয়সের অপরিপক্কতা আর সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রেও তার শরীরটা ছিল রুগ্ন কিন্তু তবিও তখন এতখানি কাহিল মনে হয়নি যতোটা এই পরিপক্ব চৌত্রিশে এসে অনুভব করছে সে। এখন তো আরো শক্ত সামর্থ্য হওয়ার কথা ছিল অথচ হচ্ছে তার বিপরীত। এর মূল কারণই তার মানসিক দূর্বলতা, অস্থিরতা আর দুশ্চিন্তা৷ ডাক্তার বারংবার বুঝিয়ে বলেছে এমন করেই চলতে থাকলে গর্ভস্রাব হওয়ার সম্ভাবনা আছে৷ সব জেনেবুঝেও সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না তার প্রথম সন্তানকে ভেবে। তার কেবল মনে হয় মেয়েটা তার এতিম হয়ে গেল। এই গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সে তার ছোট্ট রাজকন্যাটাকে ফেলে দিয়েছে একাকীত্বের আস্তাবলে। হলদে মিঠে রোদ্দুরে পাটি বিছিয়ে ঘরের বারান্দায় বসে দৃষ্টি ফেলে রেখেছে সে বাড়ির মূল ফটকে। সকাল থেকে জহির জোর করে বার দুয়েক একটা বনরুটি আর দুধে চায়ের পাত্তি দিয়ে খাইয়েছে। সে কিছুতেই আজকাল দুধের ঘ্রাণ সহ্য করতে পারে না বলেই জহির রোজ এমনটা করে। আলতাকে নিয়ে শিফা, জয়তুন যখন জহিরের বাড়ি এসে দাঁড়ালো তখন জহির সবে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলো কোন কাজের উদ্দেশ্যে। আলতা তাকে দেখে সালাম দিতেই জহির এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত রাখলো, “এলি তবে! কেমন আছিস রে মা! তোর মায়ের শরীরটা ভালো না। তোর মা সেকি কান্নাকাটি তোর জন্য। ভেতরে যা সবাইকে নিয়ে আমি ফিরছি একটু পরে।” একা একাই কথাগুলো বলে জহির উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেল। আলতার সাথে সাথে বাকিরাও অবাক চোখে দেখলো সবটা৷ আলতার মনে হলো জহির কাকা নিজেও ভালো নেই। যে মানুষটা দেখলেই হেসে হেসে কথা বলত সে মানুষটার চোখেমুখে আজ বিমর্ষতা। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই নকশিকে দেখা গেলো ঘরের সামনে খোলা বারান্দায় দু হাতে মাথা চেপে চোখ বুঁজে মাদুরের ওপর বসে আছে। আলতা গিয়ে বসলো মায়ের গায়ে গা ঘেঁষে আলতো করে দু হাতে জড়িয়ে নিলো। আচমকা কারো জড়িয়ে ধরায় মাথা থেকে হাত সরিয়ে তাকাতে চাইলে আলতা আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে শক্ত করে ধরলো মাকে। চোখের পলকে নকশি ঢলে পড়লো মেয়ের বুকে ডুকরে উঠলো কান্না। আলতাও কাঁদছে মাকে ধরে। সবাই চুপচাপ দৃশ্যটুকু দেখলো জলে ভরে এলো শিফা আর জয়তুনের চোখ। কয়েক মিনিট মা মেয়ের কান্না চলল বিরতিহীন তারপরই জয়তুন গলা ছাড়লেন, ” কি গো নকশি আমরা কি ফেরত যামু?”

বড় ভাবীর কণ্ঠ কানে আসতেই নকশি আলতাকে ছেড়ে তাদের দিকে তাকালো। তড়িঘড়ি বসা থেকে উঠতে চাইলো ভাবীদের বসার জন্য পিঁড়ি আনবে বলে। শিফা তা বুঝতে পেরে বলল, “অস্থির হইসনা আমরা এইখানেই বসমু। আলতা যা দুইটা মোড়া আন মেয়ে দুইটারে বসতে দে।”

নকশি এবার খেয়াল করলো সোহা আর অনুকে। সে চোখমুখ মুছে ভাবীদের দিকে তাকালো। প্রশ্ন করতে চাইলে তার দরকার পড়লো না, “ওরা শিশিরের সাথে এক বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ে। ভালো বন্ধুত্ব তাই একসাথে বেড়াতে আসছে। আলতা চিনে তো ওগোরে।” আলতা ঘরে ঢুকে মোড়া খুঁজে পেলো না। সে হাঁক ছাড়লো, “আম্মা মোড়া নাই?”

নকশি জবাব দিলো, “মোড়া এই ঘরে না দ্যাখ পাশের ঘরে আছে চেয়ার, মোড়া।”

আলতা দুটো মোরা এনে সোহা, অনুকে বসতে দিলো। সে এসে পুনরায় মায়ের পাশে বসলো। নকশি মেয়েকে দু হাতে ছোট্ট বাচ্চাদের মত করে জড়িয়ে ধরলো৷ সবাই মিলে টুকটাক অনেক কথা বলল তারপর শিফাই তাড়া দিলো তার বাড়ি যাওয়া লাগবে। দুপুরের রান্না বাকি বাড়িতে মেহমান আছে সাথে ছেলেটাও আসছে৷ নকশি বলে উঠলো আজ আর যাওয়ার দরকার নেই৷ এ বাড়িতেই খাবে সবাই সে জহিরকে ফোন করতে ফোন নিলো। সাথে বলল, “ভাইকে, শরতকে বলে দিব এখানে আসতে আর আব্বাকেও বলব।”

সোহা ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালো নকশির দিকে। মানে শিশিরের বাবা আর শরত ভাইয়াকে বলবে আসতে তাহলে কেন বাদ! সোহার মুখ দেখেই আলতা তার মনের কথা বুঝে ফেলল সে কিছুটা বাঁকা সুরেই বলল, “আম্মা শিশির ভাইকেই আব্বা বলছে।”

সবাই একবার আলতার দিকে তাকিয়ে আবার তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সোহার দিকেও তাকালো। শিফা মানতে চাইছে না নকশির কথা। তার বাড়ির মেহমান এ বাড়ি এনে খাওয়ানোটা কেমন দেখায়! তার ওপর নকশির শরীর তো তারা জানে কেমন৷ শিফা দোনোমোনো করতে করতে দেখলো জহির ফিরেছে হাতে বাজারের ব্যাগ। তারা তো দেখেছে জহির খালি হাতে বেরিয়েছিল। দুপুর বারোটা ; মাথার ওপরের রোদ কড়া তবুও তাপ লাগছে না বলেই মনে হলো সোহার। সে ঘুম থেকে উঠে আর জ্যাকেট পরেনি। শালটা পেঁচিয়েছিল এখানে সেভাবেই এসেছে। কিন্তু অনু খুব হাঁসফাঁস করতে করতে তার হুডিটা খুলে ফেলল। আলতা একবার তাকালো তার দিকে। লম্বা টিংটিঙে মেয়েটার পরনে এখন জিন্স আর একটা হাপ স্লিভ কূর্তি। বুকের ওপর ওড়না নেই তবুও হুডিতে যেন খুব একটা খারাপ লাগেনি কিন্তু এখন তার লজ্জা লাগছে। বাড়িতে জহির কাকা আছে আবার যেকোনো সময় শরত ভাই, শিশির ভাই আর মামাও আসবেন। আলতা মাকে জিজ্ঞেস করে তাঁর একটা ওড়না এনে অনুর সামনে ধরলো। অনু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে বলল, “এখানে ওড়না ছাড়া দেখলে মানুষ খারাপ ভাববে অনু আপু।”

অনু কিছু না বলে ওড়না নিয়ে গলায় পেঁচিয়ে বুকের ওপর ফেলে রাখল। সোহা হাসলো তা দেখে অনু আজকাল আলতাকে স্নেহ করে খুব। সেবার আহসানমঞ্জিল যাবার পর আলতা কোন একভাবে অনুকে প্রভাবিত করেছিলো খুব।

জহিরের বাড়িতে উৎসবমুখর পরিবেশ হয়ে উঠলো আধঘন্টার মধ্যেই। শিফা, জয়তুন আর নকশি তিনজনে মিলেই রান্নার কাজে হাত দিলো। জহির বাজার থেকে ফেরার সময় মোয়া আর নিমকিও এনেছে সেগুলো দিয়ে আলতাকে বসিয়ে দিল বারান্দায় পাতা মাদুরে। তিনজনে বসে সেগুলো খাচ্ছে আর জহির তাদের পড়াশোনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। গল্পে গল্পে তারা জানতো পারলো জহিরও পড়াশোনা করেছে অনেক কিন্তু সে তার পরিবারে মা ছাড়া কেউ ছিলো না বলে কখনো দূরে কোথাও যেতে পারেনি চাকরির জন্য। তার মা নাকি ভিটেমাটি ছাড়তে রাজি ছিলেন না কিছুতেই।

আওলাদ যখন মাস্টার বাড়ি এসে পৌছুলো তখন দেখলো টিনের গেইটটাতে বড় তালা ঝুলছে। আওলাদ ভীষণ অবাক হলো তা দেখে, বাড়িতে তো শিশিরও এসেছে তাহলে তার মা বাবা কোথায় গেল! কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, “আহসানের বউ, ভাবীরা সব না জহিরের বাড়ি গেল। নকশিরে দেখবার গেছে মনে হয়। ”

আওলাদের একবার মনে হলো সে জিজ্ঞেস করে, নকশির কি শরীর খারাপ? পরে মনে হলো থাক, মহিলা আবার এদিক ওদিক ছড়ালে কথাটা শুনতে বাজে লাগবে। বাধ্য হয়েই শিশিরকে ফোন করে বলল, “বাবা তুমি আশেপাশে থাকলে একটু আসবা।”

শিশির বাড়ির কাছাকাছিই ছিলো। বাড়ির দিকেই আসছিলো সে তাই আওলাদকে অপেক্ষা করতে বলল। মিনিট পাঁচেকে ফিরেই সে দেখলো আওলাদ কত কি নিয়ে এসেছে। বাড়ির গেইটের চাবি আনতে যেতে হবে নকশিদের বাড়ি ভেবে সে বলল, চাচা আসেন ওই বাড়িই যাই আপনিতো আলতাকেও দেখবেন।”

আওলাদ তৎক্ষনাৎ মাথা নেড়ে বলল, “না বাবা। তুমি শুধু এইগুলা রাখার একটা ব্যবস্থা করো আমি আবার বিকালে আইসা দেইখা যামু আমার মাইয়ারে।”

শিশিরে খারাপ লাগলো। লোকটা কতখানি দূর থেকে এসেছে এখন আবার এভাবেই চলে যাবে! আর আওলাদ সে বাড়ি যাবে না তাও বেশ বুঝতে পেরে সে বলল, আপনি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করেন আমি আলতাকে ডেকে আনি আর চাবিটাও নিয়ে আসি।”

আওলাদের মুখে স্বস্তি ফিরলো, খুশি হয়েছে শিশিরের কথায় তা বোঝাই যাচ্ছে। আসলে সকল কাজ ফেলে এসেছে মেয়েটাকে দেখবে বলে। এখন আবার চলে গেলে সারাদিনও মন লাগতো না কাজে তারওপর সন্ধ্যায় আবার সব ছেড়ে এতখানি আসতে হতো। শিশির ছেলেটাকে তার খুব ভালো লাগে৷ মনে মনে দোয়া দেয় সবসময়, শরতের জন্যও দোয়া করেন। তার মেয়ের সেই বিপদে কত দৌঁড়ঝাপ করলো নিজেদের কাজ ফেলে! এমন ছেলে প্রত্যেকটা বাবা মায়ের হোক।

রোদ আর শরতের মেঘে আকাশ জুড়ে এক মন ভোলানো খেলায় আজকের দুপুরটা মেতে আছে যেন! জহির পুরনো এক লুডুর বই বের করে দিয়েছে মেয়ে তিনটিকে তারাও সে খেলায় জমে গেছে। শিশির এসে জহিরের বাড়িতে ঢুকতেই তার কানে এলো আলতার চেঁচানো গলা, ” আমার আবার ছক্কা উঠছে সোহা আপু শ্যাষ।”

শিশির উঠোনে দাঁড়িয়েই তাকালো আলতার দিকে। চেঁচিয়ে কথা বলছে, হাত নেড়ে নেড়ে অনুকে কিছু বলছে। আবহাওয়া গরম নয় তবুও এখান থেকেই শিশির স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আলতার গালের পাশ লালচে হয়ে আছে। এমনিতেই তো মেয়েটার গায়ের রঙ এত গোলাপি ফর্সা যে দেখলেই মনে হয় কেউ বুঝি মেরে লাল করে দিয়েছে। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সেদিকে এতোটাই মগ্ন হয়েছে শিশির তার পেছনে যে শরত দাঁড়িয়ে আছে টেরই পায়নি। তবে খেলায় মত্ত তরুণীদের মধ্যে অনু দেখলো শরতকে। সে খেয়াল করলো শরত কিছু একটা বলছে শিশিরকে অথচ সে ড্যাবড্যাব করে এদিকে তাকিয়ে আছে যেন কিছু শুনতেই পাচ্ছে না। অনুর পর এবার সোহা আর আলতাও দেখলো। সোহার ঠোঁটে মুচকি হাসি শিশির এখনো সরছে না বলে। আলতাও ঘটনা বুঝতে পেরে ফিক করে হেসে ফেলল। গেইটটা একেবারেই অল্প জায়গায় নয় তবুও শিশির গেইট যেভাবে ধরে দাঁড়িয়ে আছে তাতে শরত ঢুকতে পারবে না। এবার সে বেশ বিরক্তই হলো শিশিরের কান্ডে তাই কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু তার সুযোগ হওয়ার আগেই শোনা গেল অনুর গলা, “ওই শিশির স্ট্যাচু অফ শিশিরফোঁটা হইছিস ক্যান পিছনে তো শরৎচন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে।”

চলবে

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

১২.
ঝরঝরে পরিষ্কার দুপুর ; শীত শীত রাত-ভোর মাঝামাঝি এমন দুপুর বড্ড স্নিগ্ধ করে মনকে। আজকের দুপুরটা অনেক অনেক দিন পর আলতার কাছে বেশ আনন্দের, স্বতঃস্ফূর্ত লাগছে। সকালের সময়টা ভালো কেটেছে দুপুরটাও এখন বাবার সঙ্গে বসতে ভালো লাগছে খুব। শিশিরের সাথে একটু আগেই এসেছে সে বাবার সাথে দেখা করতে। প্রায় ত্রিশ মিনিট আগের ঘটনা, শিশির যখন জহিরের বাড়ি গেল তখন শরতও বাড়ি আসছিলো। আজ দোকান খোলেনি সকালেই সে দোকানের বিভিন্ন মাল কিনতে সদরে গিয়েছিলো। সবে মাল নিয়ে দোকানে ফিরেছিল অমনি নকশি কল করে বলল আজ তাদের বাড়ি যেতে। বাড়ির সকলে সেখানেই আছে। দোকানের কাজ গুছিয়ে দোকান বন্ধ করতে বেশি সময় লাগেনি। মনে মনে ঠিক করেছে আজ দিনটা ছুটিই থাক। তাই কর্মচারী ছেলেটিকে ছুটি দিয়ে নিজেও ফিরে এসেছে৷ বাড়ির গেইটে এসে ঢোকার পথে শিশিরকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ানো দেখে সে একবার ডাকলো কিন্তু শিশির বুঝি শুনতেই পায়নি। শরত পুনরায় ডাকতে উদ্যত হতেই দূর থেকে অনু চেঁচিয়ে বলল, “ওই শিশির স্ট্যাচু অফ শিশির ফোঁটা হইছিস ক্যান পিছনে তো শরৎচন্দ্র দাঁড়াইয়া আছে।”
কথাটা বলতে অনু লজ্জা না পেলেও তখন শরত, শিশির দু ভাই ঠিকই লজ্জা পেল। আলতা অবশ্য জোরে হাসতে গিয়েও হাসি আটকেছে। আর সোহা তার স্বভাবসুলভ নিঃশব্দ হাসি হেসেছিল। এরপর অনেকটা সময় অনুর দিকে একদমই তাকায়নি। শিশিরও নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চট করে বলে বসলো, “আওলাদ চাচা আসছে বাড়িতে চল” এটুকু বলেই আবার বলল, “তুই এগিয়ে যা আমি আম্মার থেকে বাড়ির চাবি নিয়ে আসি।”

আব্বা এসেছে শুনেই আলতা বেরিয়ে যাচ্ছিল পরে মনে হলো আম্মাকে বলে যাওয়া উচিত। সে নকশির ঘরের উত্তরের পেছন দিকটায় যেখানে রান্নাঘর সেদিকে যেতে পা বাড়ালে শিশির বাধ সাধলো, “তুই যা চাচা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে আমি বলে দিব ফুপুআম্মাকে।”

তারপরই আলতা এসেছে মিনিট খানেক পর শিশিরও চাবি নিয়ে হাজির। গেইট খুলে দিয়ে আওলাদের আনা ব্যাগভর্তি চাল, গুড়,নারকেল সব ঘরে নিয়ে রাখলো। তারপর আর সে কোথাও যায়নি উল্টো নিজের ঘরে ঢুকে নিজের কিছু জিনিসপত্র শরতের ঘরে রেখে এলো। যে কদিন এখানে আছে মেয়েগুলো যে তার ঘর দখলে রাখবে তাতো জানাই আছে।

আওলাদ মেয়েকে পাশে বসিয়ে তার খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ নিলেন প্রথমেই পরে কিছুটা সংকোচের সাথেই জানতে চাইলেন দু একদিনের জন্য তার গ্রামে যাবে কিনা! সংকোচ তার মূলত তার স্ত্রীর করা পূর্ব ঘটনার জন্যই। প্রথমবারও তো কত আহ্লাদ করে জোর গলায় আবদার করে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। কি লাভ হলো! তার স্ত্রীর মেয়েটাকে চক্ষুশূল ভেবে কটুকথা শোনালো। সে চেয়েও কথার বাণ রুখতে পারেনি। এরপর স্ত্রীকে মা*রধো*রও কম করেননি কিন্তু তাতে কি কথাগুলো তো আর ফিরে আসবে না। মনে অনেক সাধ নিজের ছেলেদের যেমন সাথে রেখেছেন তেমনই করে মেয়েটাকেও রাখতে। চোখের সামনে থাকবে, ভালমন্দ নিজে যা খাবে তাই খাওয়াবেন কিন্তু এই সাধ তার আর পূরণ হবার নয়। তাই আজ আর জোর খাটিয়ে কিছু বললেন না। আলতাও বাবাকে কষ্ট না দিয়ে যতটুকু সম্ভব বুঝ দিলো সে অল্প সময়ের জন্য এসেছে আর শহরের দুজন বান্ধবী এসেছে তাদের সাথেই থাকবে। এ আর বলেনি বান্ধবী দুটো তার নয়। কথায় কথায় আওলাদ জানতে পারলো আলতা টিউশনি করে সেখানে তখনই তার মাথায় আসমান ভে*ঙে পড়লো যেন। সাথে সাথে বলল, “তোর ট্যাকা পয়সা যা লাগবে আমারে বলতে বলছিনা! তুই টিউশুনি নিলি ক্যান রে মা!”

আলতা ক্ষীণ হেসে জবাব দিল, “টিউশনি করলে সময়টা ভালো কাটে আব্বা। টাকার দরকার পড়লে আমি নিজেই আপনারে ফোন দিব।”

আওলাদ আশ্বস্ত হতে পারলো না। সে আজও আলতার জন্য হাজার দুয়েক টাকা এনেছে। কারে কাছে জেনেছে এই গ্রামের পাশের গ্রামে মেলা হচ্ছে সেই কথা মাথায় রেখেই এক হাজার টাকা আর টুকটাক প্রয়োজনের জন্য এক হাজার বাড়িয়ে এনেছে সে। এমনিতে মাস শেষে ফোন করে আলতাকে তার খরচের টাকা পাঠায় শিশিরের কাছে। আজকের টাকাটা দেখে আলতা নিতে চাইলো না আওলাদ জোর করেই মেয়ের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ” কারো লগে যদি মেলায় যাওনের সুযোগ হয় যাইস। আমি নিয়া যাইতাম কিন্তু আমার তো ফারমের( খামার) তে বাইর হইতে সন্ধ্যা হেরপর বেলা গড়ায় তাত্তাড়ি। অহন দিন ছোট আইসা মেলায় নিয়া আবার তোরে দিয়া যাইতে অনেক রাইত হইব।”

আওলাদ কথা শেষ করার আগেই শিশির এসে দাঁড়িয়েছিল তাদের সামনে। হাতে তার এক কাচের পিরিচে সকালের ভাপা পিঠা অন্যহাতে এক গ্লাস পানি। মা বাড়ি নেই ঘরে কোথায় কি আছে তা সে জানে না৷ আর আজ বাড়িতে ভাত রান্না হয়নি তাই এই ভর দুপুরে আওলাদকে সে ভাত খাওয়ার কথা বলতে পারলো না। কিন্তু এ সময় একটা মানুষকে একদম না খাইয়ে পাঠাতে ইচ্ছে করলো না বলেই ঘরে থাকা পিঠা এনে দিল। কিন্তু আওলাদের কথা শুনে বলল, “চাচা মেলায় যাওয়া নিয়ে ভাবতে হবে না। মেহমান এসেছে ঢাকা থেকে তারাও যাবে আলতাও তাদের সাথেই যাবে।”

আওলাদ খুশি হলো শুনে। সে পিঠা খেতে চাইল না কিন্তু শিশিরের জোরাজুরিতে একটুখানি মুখে দিল। আলতার মুখে শুনলো আজ ও বাড়ি সবাই খাবে তাই আওলাদ ফিরে যাওয়ার জন্য উঠলো। শিশির আর আলতাও তার সাথেই বেরিয়ে পড়লো। আওলাদ বাজারের পথে চলে যেতেই বাড়ি উল্টো দিকে জহিরের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো তারা। মাথার ওপর রোদটা মোটামুটি তেজি আলতার গোলাপি মুখ আরও গোলাপি হলো সেই রোদে। পাশাপাশি হাটছে দুজন নিশ্চুপ, ক্লান্ত পথিকের মত। পৌষের বেলায় উষ্ণ ওম মাখা রোদে হাটতে হাঁটতে শিশিরের নজর নিবদ্ধ রইলো আলতার মুখে। তার দিকে না তাকিয়েও যেন সে বুঝতে পারছে শিশির ভাইয়ের এই চাহনি। অনুভব করছে ভেতর থেকে এক অবাধ্য কম্পন। ভয় নেই, ভীতি নেই যে মানুষটার পাশে থাকতে সে মানুষটার দৃষ্টিতেই সে আজ কাঁপছে কেন! আলতা ভেবে পায় না বছর কয়েক আগে যে মানুষটার অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ পেয়ে সে গুটিয়ে গিয়েছিল ভেতর থেকে সেই মানুষটার জন্যই এখন তার ভেতরের উথাল-পাতাল ঢেউ বয়। এ কেমন আজাব শুরু হয়েছে তার ছোট্ট জীবনটাতে! মায়ের দূরত্ব যখন তাকে বিষন্নতার এক অকূল পাথারে ফেলে দেয় ঠিক তখনি আবার এই মানুষটার উপস্থিতি তাকে টেনে হিঁচড়ে তুলে আনে মহাশূন্যে, হাওয়ায় ভাসিয়ে বিষাদের সাথে আড়ি করায় সেই মানুষটাতেই এখন আবার ভীত হয়ে উঠছে সে। এই আজব ভিন্ন অনুভূতিগুলো তার কিশোরী মনে বিস্তর প্রভাব ফেলছে দিনকে দিন। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে জহিরের বাড়ির সামনে এসে গেছে খেয়াল করেনি দুজনের কেউই। তারা ভেতরে ঢুকতেই সোহা ডেকে উঠলো, ” শিশির তোমাদের এদিকে নাকি পৌষমেলা বসেছে আমরা কি যেতে পারব?”

সোহার প্রশ্নটাতে কি যে মিষ্টতা ছিল জানে না আলতা। কিন্তু তার এই মিষ্টভাষিণী মেয়ের মিষ্টি প্রশ্নটা জঘন্যরকম তিক্ত লাগল৷ সোহা দেখতে ভীষণ সুন্দর তার মুখে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য দেখতে পায় আলতা। পুরো গ্রাম জুড়ে যেখানে কিশোরী আলতার রূপের কথা জনে জনে বলে, ঢাকায় পা দিতেই হোস্টেল ভর্তি নারী, মেয়েরা তার গায়ের রঙ, তীক্ষ্ণ নাসিকা আর টানা চোখদুটোতে হিংসায় জ্ব*লে সেখানে আলতা আজ সোহার উজ্জ্বল অথচ অল্প পর্সা মুখশ্রীতে হিং*সায় পোড়ে। ক্ষণে ক্ষণে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে শিশিরকে। শিশিরের দৃষ্টি ঠিক কেমন থাকে সোহার প্রতি! আর তার মনে বিদঘুটে যে সন্দেহ ঘুরপাক খায় তার আশি শতাংশ গাঢ় হয়েছে সোহা আর অনুর মধ্যে তফাৎ সম্মোধন। তার সন্দেহী মন যুক্তি খাটায় শিশির অনুকে ‘তুই’ বলে সম্মোধন করে তার কারণ একটাই তারা খুব ভাল বন্ধু। অথচ সোহাকে সর্বদা ‘তুমি’ আর ভিন্ন স্বরেই সম্মোধন করে৷ এটা হতে পারে তাদের মধ্যকার গভীর কোন অনুভূতির কারণে। তার ছোট্ট মনে যেটুকু পারে সেটুকুই ভাবে। অথচ তার জানাই হলো না কখনও শিশির ভাইয়ের মনটা তাকে কতোটা ভালোবাসায় আগলে নিয়েছে মনের কুঠুরিতে।

সোহার কথার জবাব শিশির দেওয়ার আগেই শিফা বলে উঠলো, “অবশ্যই যাবে তোমরা দরকার পড়লে শরত নিয়ে যাবে।”

চাচীর কথা শুনে চকিতে তাকালো শরত চাচীর দিকে। সে কেন যাবে তাদের নিয়ে! শিশির আলতা ততক্ষণে ঘরের বারান্দায় এসে বসেছে মাদুরে। সেই আসার পর এখানে মাদুর পেতেছে সোহা, অনু এখনো সেখানেই বসা সাথে যুক্ত হয়েছে শিফা আর জহিরও। জয়তুন অবশ্য রান্নাঘরে রুই মাছ ভাজছে। নকশির ক্লান্ত লাগছে বলে একটুর জন্য সে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। শিশির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাই গেলে তো ভালো হয় নয়ত তিন তিনটা মেয়ে নিয়ে আমার মেলায় যেতে ভয় লাগত।”

শিশিরের কথাটাতে টিপ্পনী ছিল বুঝতে পেরে তেতে উঠলো অনু। সোহা শুধু নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে৷ কিন্তু তাদের দিকে পাত্তা না দিয়ে শরত বলল, “আমি যাব না কাকী শিশিরই পারবে তাদের নিয়ে যেতে। আর দূরে কোথাও তো না।”

অনু ফটাফট বলে বসলো, “আমাদের ভয় পাও নাকি শরৎচন্দ্র! নিশ্চিন্ত থাকো ব্রো আর যাইহোক আমরা তিনজন তোমার ইজ্জত লু*টবো না।”

অনুর হুটহাট লাগামহীন কথাবার্তায় এ নিয়ে প্রায় কয়েকবার লজ্জায় পড়লো শরত, শিশির আর তার চারপাশের মানুষজন। শিফা তো কথা শুনে জিভ কামড়ে ধরলো। জহিরও পাশেই ছিল তার ব্যপারটা পছন্দ হয়নি অন্তত আলতা সামনে আছে তাই৷ মেয়েটা এসব শুনে কি শিখবে এইটুকু বয়সে! সে নিজে বসা থেকে উঠে আলতাকে বলল, “আলতা মা তোর আম্মার খারাপ লাগছে একটু যা তো ঘরে। তুই পাশে থাকলে তার একটু ভাল লাগব।”

আলতা উঠে গেল, শিফা আর জহিরও চলে গেছে। শিশিরের চেহারা দেখে কিছু আন্দাজ করা যাচ্ছে না সে কি রেগে আছে নাকি না! তবে শরত চোখ, মুখ শক্ত করে তাকিয়েছে অনুর দিকে। তা দেখে সোহা বেশ ঘাবড়ালো কিন্তু যার উদ্দেশ্যে শরতের মুখের ভাব পরিবর্তন হয়েছে তার এ ব্যাপারে কোন হেলদোল নেই। সে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “তোমাদের একেকজনের ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি কাউকে খু* ন করেছি। এমন রিয়াকশন দিচ্ছো যা দেখে জীবিত হয়েও মর*ণ মর*ণ ফিলিংস আসছে আমার।”

“এসব কি ধরণের কথাবার্তা তোর? এটা কি শহর পেয়েছিস অনু? এখানে সবাই কনজার্ভেটিভ মাইন্ডেড। কিছু জিনিসের লিমিটস আছে এখানে। তুই তো এতোটাও অবুঝ না।”

শিশিরের গলায় অপ্রকাশিত একটা শাষণ স্পষ্ট টের পেল অনু। তার এই প্রথম মনে হলো তার আচরণ ঠিক নেই। সে শরতের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যরি বুঝতে পারিনি।”

শরত সে কথা শুনলো না উঠে চলে গেল বাড়ির বাইরে। শিশির আর সোহা একদমই চুপচাপ বসে রইলো আগের জায়গায়।

“আম্মা তোমার কি কিছু লাগব?” মায়ের সিথান বরাবর বসে বড্ড আলতো স্বরে প্রশ্ন করল আলতা। নকশি শুয়ে ছিল চোখের ওপর হাত ফেলে। আলতার কথা কানে যেতেই সে উঠে বসলো। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “কেমন আছিস তুই? ”

আলতা মায়ের ডান হাতটা ধরে একটু হেসে বলল, আমি ভালো আছি আম্মা তুমি কেমন আছো? তোমার শরীরটা এমন লাগে ক্যান আম্মা! তুমি অনেক কালো হয়ে গেছো আর এই যে গলার হাড়গোড় সব দেখা যাইতেছে।”

ঘরের উত্তর দিকে একটা জানালা আছে। সেটা খোলা থাকায় ভর দুপুরের উজ্জ্বল রোদের আলোয় ঘরটা আলোকিত। নকশি মেয়ের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। তার হাত ধরে রাখা আলতার হাতটা তুলে গাঢ় এক চুমু খেয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে রাখলো কিছু সময়। তারপরই হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো নকশি। অকস্মাৎ মায়ের এমন কান্নায় ভড়কে গেল আলতা। মাকে এবার এক হাতে জড়িয়ে ধরতেই মায়ের গলা শোনা গেল, “আমি খুব খা*রাপ মা তাই নারে! আমি তোকে একলা করে দিলাম এজন্যই তুই আমায় ছেড়ে গেলি। আমি স্বার্থপর হয়ে গেলাম আলতা মা আমার আমি তোকে এতিম করে দিলাম। আমার বুকটা খালি করে দিলাম আমি তোকে ঢাকায় যেতে দিয়ে।”

একের পর এক অস্পষ্ট উচ্চারণে নকশি কত কি বলে চলছে। কান্না আর আর্তনাদে ঘর জুড়ে এক শোকসভা তৈরি হয়ে গেল। আলতাও মায়ের আহাজারিতে কান্নাকাটি শুরু করলো আর এ সবটাই দরজার বাইরে থেকে শুনলো জহির, বারান্দা থেকে শুনলো শিশির, সোহা অনু আর শরত। রান্নাঘর থেকে শুনলো জয়তুন আর শিফাও। প্রত্যেকটা মানুষের হৃদয় তাদের সেই কান্নার সাক্ষী হয়ে অনেকটা সময় বিষাদে জর্জরিত রইলো। দুপুর ঘন হয়েছে, খাওয়ার সময় হয়েছে অনেক আগেই। মা মেয়ের এই বেদনার সমবেশের সমাপ্তি টানতেই জয়তুন এলেন নকশির ঘরে। তার অতি পুরনো রাগী স্বরে ধমকে উঠলেন নকশিকে, “আক্কেল জ্ঞান কিছু হয় নাই তোর এহনও? এই যে কান্দাকাটি করতাছোস পেডেরটার (পেটেরটা) যে ক্ষতি হইবো সে খেয়াল আছে আর এই যে তোর বড় মাইয়াডাও তো দু দিন পরে শহরে যাইবো গা অর কি মন টিকবো পড়ালেহায়!”

নকশিকে কথাগুলো বলেই আবার আলতাকে ধমকে উঠলেন, “আর তুই কি বড় হইতাছোস না আলতা। তোর আম্মার এই শরীলে তুই একটু বুঝাবি না তারে! তুই এতিম হবি ক্যান তোর আব্বা, আম্মা মামা-মামী, জহির কাকা, শরত ভাই, শিশির ভাই আবার নতুন আরেকটা ভাই বোন হইবো। তুই একলা কেমনে আলতা তোর আম্মারে বুঝা তো। হেয় কি মই*রা যাইবো যে তোরে এতিম কইয়া ম*রা কান্দোন কানতাছে?”

জয়তুনের কথার ধাচ বরাবরই রুক্ষ অথচ তার মনটা ভীষণ কোমল। সে নকশি আর আলতাকে বকে ধমকেই কান্না থামালো যেন নরম সুরে কথা বলা তার স্বভাবে কিছুতেই যায় না। মা মেয়ের কান্নার পর্ব শেষ হতেই শিফা তাড়া দিলেন সবাইকে মুখ হাত ধুয়ে খেতে বসতে। এ বাড়িতে ডাইনিংটেবিল আছে তবুও সবাই একসাথে নিচে বসে খেতে চাইলো। নকশি বলেছিলো, সোহা আর অনু টেবিলে দিতে অনু মুখের ওপর বলে দিলো তাকে মেহমানের মত ট্রিট করলে এখানেই থাকবে না আর। সোহা অবশ্য অনুর মত না বললেও নিচু স্বরে বলেছিলো, আমাদের সাথে এমন পর পর আচরণ করলে খুব কষ্ট পাবো।”

খুশি হয়েছে সবাই তাদের কথা শুনে। মেঝেতে মাদুর পেতে একে একে প্রত্যেকে পাশাপাশি বসে খাওয়ার পর্ব সেড়ে নিলো। তারপর কিছুটা সময় মহিলারা এ বাড়িতেই রেস্ট নিয়ে তবে বাড়ি ফিরলো। শিশির, আহসান আর শরত আগেই বাড়ি গিয়েছে তবে পরে শিফা, জয়তুন যাওয়ার সময় জহির বলে দিলো আলতা এ বাড়িই থাকুক দুটো দিন। আলতা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে অস্বস্তিবোধ করছিলো। মনটা চাইছিলো মায়ের পাশে, মায়ের কাছেই থাকতে কিন্তু যতবার মনে পড়ে এ বাড়িটা তার বাবার নয়, তার আহসান মামারও নয় তখনি অন্তর জ্বলে ওঠে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে এই জ্বালাপোড়া কষ্ট নিয়েই মনস্থির করে এখানে আজ রাতটা থাকবে বলে। রোদ শেষের বিকেলটুকু রক্তিম হয়ে কুয়াশার আড়ালে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতেই নকশি একটা শাল নিয়ে আলতাকে ডাকলো। সবাই চলে যাওয়ার পরপরই নকশি তাকে খুব জোর করেই নিজের পাশে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়েছে। আলতাও নিঃশব্দে মায়ের কোমর জড়িয়ে শুয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন সন্ধ্যে নামার মুখে বাইরের শীতের তীব্রতা আন্দাজ করে নকশি তাকে শাল দিয়ে ঢেকে আলতো স্পর্শে ডাকতে লাগল। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই তো শিফা ফোন করে বলল, আলতাকে পাঠিয়ে দে জলদি সন্ধ্যার পর সবাই মিলে মেলায় যাব। তোর এখন বাইরে বাইর হওয়া ঠিক না তা না হইলে তোকেও যাইতে বলতাম।”

নকশি জিজ্ঞেস করলো আর কে কে যাচ্ছে তখন নকশি হাসতে হাসতে বলল, শরতটা দিল ঝা*মেলা বাঁধিয়ে। হুট করেই বলছে আম্মা আর কাকীকেও নিয়া যাব। বুঝছিস তো ঘটনা ওই যে, মেয়ে গুলার সাথে যাইতে বলছি সে যাইব না এইজন্যই এমন বুদ্ধি বের করছে।”

নকশি আবারও হাসলো, “সত্যিই শরতটা একদম ভিন্ন৷ আজকালকার ছেলেরা যেখানে মেয়ে দেখলেই গা ঘেঁষে থাকতে চায়, সুযোগ খোঁজে কথা বলার সেখানে এই ছেলেটা মেয়েদের ব্যাপারে সতর্ক থাকে। অলি মেয়েটা সত্যিই তাকে পায়ে ঠেলে ভুল করেছে।”

নকশির এ কথার পিঠে শিফা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।

ঘুমঘুম চোখে আলতা জামাকাপড় বদলেছে। চুল আঁচড়ানোর একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না বলে সে এমনিতেই ওড়না টেনে মাথায় দিচ্ছিলো তা দেখে নকশি ডেকে বলল, “আয়নার সামনে দ্যাখ চিরুনি আছে নিয়ে এখানে আয়।”

চলবে