শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
416

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

১৩.
সরিষা আর কলাই ক্ষেতের মাঝখানের আইল দিয়ে হেঁটে চলছে শিশিররা। প্রত্যেকেই শীতের তোপে গা কাঁপিয়ে কুয়শা সরিয়ে এগিয়ে চলছে মেলার দিকে। সারি বেঁধে চলতে চলতে নিজেদের মধ্যে আবার চলছে নানারকম কথাবার্তা। মেলায় যাওয়ার জন্য শুধু যুবক-যুবতী নয় শরতের চাপে পড়ে বড়দেরও আসতে হয়েছে। আহসানুল্লাহ অবশ্য শরতের একবার বলাতেই তৈরি হয়েছে জোর করতে হয়েছে জয়তুন আর শিফাকে। জহিরের বাড়ি থেকে ফিরেই সবাই একটু আধটু বিছানায় গড়িয়েছিল শুধু শিশির বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। সন্ধ্যাকালে বাড়ি ফিরে সোহা আর অনুকে তাড়া দিলে অনু বলল শরতকেও নিবে সাথে। শিশির ভেবেছিল ভাইকে বলবে তবে জোরাজুরি করবে না সে৷ কিন্তু তার আর কিছু করতে হয়নি অনু নিজেই গিয়ে জয়তুনকে বলল, চাচী শরৎ ভাইয়াকেও বলেন আমাদের সাথে যেতে। শিশিরের ওপর ভরসা নেই আমাদের খেয়াল রাখবে না সে।”

সোহা মিটিমিটি হেসেছে শুধু অনুর কথা শুনে। যে টোনে সে কথা বলছো তা অবিশ্বাস্য ছিলো। এত নরম আর বিনয়ী সুরে অনু এর আগে কখনো কথা বলেছে বলে মনে পড়লো না তার। শরত তখন ঘরেই ছিল মায়ের কাছের অনুর বলা কথা শুনে সে বিড়বিড় করে উঠলো, “আল্লাহ্! চরম নাটকবাজ মেয়ে তো এটা।”

জয়তুন এসে একবার বলাতেই শরত দ্বিরুক্তি করলো না তবে সেও বলে বসল, “আম্মা আপনি আর কাকীও তৈরি হোন। বাড়ির সবাই একসাথে যাব।”

মাগরিব শেষে একসাথে বেরিয়েছে সবাই। নকশি বাড়ি থেকে বের হবে না বলে জহিরকেও আর বলা হয়নি যাওয়ার কথা। বাড়ি থেকে বেশি দূর নয় বলেই সবাই রাস্তা ছেড়ে ক্ষেত পেরিয়ে যাচ্ছে। আকাশ জুড়ে নক্ষত্রের জ্বলজ্বলে আলো থাকলেও আজ চাঁদহীন আকাশ বলেই হয়ত চারদিকে অন্ধকারে ঢাকা। আইল দিয়ে চলার সময় সবার প্রথমে আহসান চলছে তার পেছনে শিফা তারপরই জয়তুন। তাদের থেকে দু কদম পেছনেই আছে শিশির আলোহীন পথে তার বা হাতের মুঠোয় আছে আলতার হাত। আলতা তার পেছন পেছন চলছে যার ফলে শিশিরকে একটু বাঁকা হয়েই আগাতে হচ্ছে সামনে। আলতার পেছনে অনু তার থেকেও পেছনে পরে আছে সোহা। বেচারি দু জোড়া জুতো এনেছে আসার সময় কিন্তু তার দুঃখ দু’জোড়া জুতোই উঁচু। সমান হিলের জুতো ছাড়া ক্ষেতের চিকন আইল দিয়ে চলতে সে হিমশিম খাচ্ছে খুব। কখনো এদিক তো কখনো ওদিক হেলে পড়ছে হাঁটতে হাঁটতে। শীতের রাতে এমনিতেই হাত পা জমে একাকার হয়ে আছে তারওপর আইল জুড়ে ঘাসে ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দু পা ছুঁয়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে তাকে। তার পেছনেই আছে শরত তার হাতেও আহসানুল্লাহর মত বড় টর্চবাতি। সে চলতে চলতে খেয়াল করেছে সোহার সেই নড়বড়ে চলন। মনে মনে একটুখানি হতাশ হলো সে। শহুরে মেয়েরা শহুরে ফ্যাশন সেন্স নিয়ে গ্রামে কেন আসে! বুঝে পায় না সে। চলতে চলতেই তার মনে হচ্ছিলো এই মেয়েটা যেকোন মুহূর্তে পড়ে গিয়ে একটা হুলস্থুল কান্ড ঘটাবে। মন বলছিল একটু সতর্ক করতে পরমুহূর্তেই বাড়াবাড়ি ভেবে আর সে কিছু বলল না। মেলার প্রায় কাছাকাছিই চলে এসেছে তারা। সরিষার ক্ষেত ফেলে এসেছে পেছনে এখন তারা আছে কাঁচা মাটির রাস্তায়। দু’ধারে বাঁশঝাড় আর থেকে থেকে দু একটা বাড়ি। অথচ কোথাও আলোর রেশটুকু নেই সেদিকে। আহসানুল্লাহ চলতে চলতেই অনেক কথা বলে চলছিল শিফাকে। বলছিলো কথা তাদের শৈশবের কিছু স্মৃতি হুট করেই তার সামনে দিয়ে কিছু একটা দৌঁড়ে গেল। পা থেমে গেল আহসানের থামল বাকিরাও। জয়তুন চোখে আজকাল একটু কমই দেখে কিন্তু শিফা স্পষ্ট দেখলো কালো কোন এক চতুষ্পদ জন্তু ছুটে গেছে সামনে দিয়ে। সে কিছুটা আঁতকে উঠেই বলল, “ওটা কি গো!”

সবাই থমকে গেল ; সোহা ছিল একদম পেছনের দিকে সে শুনতেই ভয়ে শিউরে উঠলো। আহসানুল্লাহ হেসে বলল, শিয়াল ছিলো এত ভয় পাচ্ছো কেন আসো।”

আলতা মোটেও ভয় পায়নি। তার এসব কুকুর, শেয়ালে কখনোই ভয় হয়নি। ছোট থেকেই কতশত শেয়াল দেখেছে তার তো শেয়াল দৌঁড়ানোর অভিজ্ঞতাও আছে। তবুও শিশির একটু কেমন যেন চমকালো তাকে নিয়ে। মুঠোয় রাখা হাতটা আরেকটুখানি শক্ত করে ধরল, ফিসফিসিয়ে বলল, “ভয় পাস না”

আলতাও তেমনই ফিসফিসিয়ে বলল, “আমি শেয়াল ভয় পাই না।”

“ওহহো আমিই ভুলে গেছি। তুই আবার শেয়াল ভয় পাবি কেন শেয়াল নিজেই তোকে দেখলে ভয়ে মা*রা যায়।”

অনু বিষ্মিত গলায় বলল, সত্যি!

জয়তুন এ কথা শুনে জোরে হেসে ফেলল। সেও শিশিরের সাথে তাল মিলিয়ে বলল, “হ এই কথা সত্যি। আলতায় তো আরো ছোট থাকতে একবার আমাগো বাড়ির পিছের ক্ষেতে শিয়ালরে পিডাইতে জিংলা(বাঁশের কঞ্চি) লইয়া দৌঁড়াইছে। হেই বার নকশির হাতে ওই জিংলার বারি হে নিজেই খাইছিল।”

হা হা করে হাসির শব্দ অন্ধকার পথে ঝংকার তুলল। প্রত্যেকেই হাসছে খুব আর আলতা লজ্জায় লাল হয়ে উঠছিল। ইশ, কেমন কথা বলছে তারা এখন সে বড় হয়েছে না। এভাবে তার মা*র খাওয়ার গল্প বললে সে লজ্জা পায় না বুঝি! হাসি, গল্পে পথ ফুরিয়ে এলো। এখন একটু সামনেই চোখে পড়ছে ছোট ছোট খন্ড আলো আর মাইকের উচু সাউন্ডে চলা বিভিন্ন এনাউন্সমেন্ট। আর মাত্র দু মিনিটের পথ আর ঠিক সে মুহূর্তেই ঝোপ থেকে কিছু একটা বেরিয়ে দৌঁড়ে গেল সোহার সামনে দিয়ে। সে ভয়ে চিৎকার করে পাশে থাকা শরতের কালো রঙের জ্যাকেটসহ শার্ট খামচে ধরলো। তার চিৎকারে সকলের পা থেমে গেল। আহসান পিছু ফিরে তার টর্চের আলো ফেলতেই অস্বস্তি বোধ করে আবার আলো অন্যদিকে ফেলল। ততক্ষণে প্রত্যেকেই ঘুরে তাকিয়েছে পেছনে। শরত অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে এক মুহূর্ত তারপরই নিজের হাতের টর্চের আলো পথের একপাশে ফেলে বলল, শেয়াল ছিল ওটা ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

সোহা তার হাত এখনো সরায়নি। সে আগের মতোই শরতের পেটের দিকের জ্যাকেটসহ শার্ট খামছে ধরে আছে। শরত টের পাচ্ছে মেয়েটা কাঁপছে খুব। বোঝাই যাচ্ছে ভয়টা সে বেশিই পেয়েছে। আহসানুল্লাহ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শিফাকে বলল, “তুমি আর ভাবী আমার সাথে আসো ওরা গিয়ে ঘুরে দেখুক মেলা। আমি তোমাদের মিষ্টির দোকানে ঘুরিয়ে আনি।”

অনু মিনিট খানেক সময় একদমই চুপ ছিল। সে ভীতু নয় তবুও এমন আঁধার ঘেরা পথে কোন জন্তুর উপস্থিতি তাকেও শিউড়ে দিয়েছে। তবে সে সামলে নিতে সক্ষম কিন্তু সোহা তা পারবে না সে জানে। মেয়েটার ভয় কাটাতেই সে মজা করে উঠলো, “শরৎচন্দ্রের শার্ট কি তোর নিজস্ব সম্পত্তি পাইছিস! যেভাবে ধরছিস বেচারার জ্যাকেটটা উপরে না থাকলে নিশ্চয়ই এটা ছিঁ*ড়ে যেত এখন।”

সোহা লম্বা লম্বা শ্বাস নিলো। ছেড়ে দিল শরতের জ্যাকেটটা তবে এবার ভয়ের সাথে লজ্জায় পড়ে গেল ভীষণ। কি বাজে একটা ব্যাপার ঘটালো সে! শিশিরও অস্বস্তি কাটাতে বলল, ভয় পাস না আর চলে এসেছি মেলায়। যাওয়ার সময় আমরা মেইনরোডে গাড়ি দিয়ে যাব।”

সোহা নিজেকে ধাতস্থ করতে একটু সময় নিলো তারপর ক্ষীণ স্বরে শরতকে উদ্দেশ্য করে বলল, “স্যরি ভাইয়া আমি আসলে বুঝতে…”

“হু, বুঝতে পেরেছি সংকোচ করতে হবে না। চলো”

রাত যত বাড়ে মেলায় ভীড়ও তত বাড়তে থাকে। এজন্যই আহসানুল্লাহ মাগরিবের পর তাড়া দিয়েছিল বের হতে। কিন্তু মহিলাদের নিয়ে কি আর কোথাও সময় মেপে যাওয়া সম্ভব! যেখানে এশারের পর বাড়ি ফেরার কথা ছিল সেখানে এশারের আজান পড়লো মেলায় পৌঁছুতেই। জয়তুন মেলায় পা দিয়েই বলল, “চল ফিরা যাই। এত্তো মানুষের ভিতর ক্যামনে ঘুরমু শরীলে শরীল ঠেকে। তারচেয়ে ভালা ছিল বাড়িতে থাকা।”

শিফাও সহমত প্রকাশ করলো। বিয়ের প্রায় পঁচিশ ছর হতে চলল আর তার মেলায় শেষবার আসারও সময় হলো পঁচিশ। বিয়ের বছরেই সে এসেছিল আহসানের সাথে তারপর আর কখনো সাধও জাগেনি আর আসাও হয়নি। কিন্তু আজ এসে তার এত ভীড় আসলেই ভালো লাগছে না। আহসানুল্লাহ নিজের মত করে তাদের ঘুরিয়ে দেখাতে চাইলে দুজন মহিলাই ভীষণ আপত্তি তুলল৷ মনে মনে সে শরতকে ব*কলো কিছুক্ষণ, ফাজিল ছোকড়া মা-চাচীরে মেলা দেখাবি বলে আমার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিলি। দুইজনের একজনও ঘুরবে না আর আমাকেও একটু ঘরে দেখতে দিবে না। এর চেয়ে ভালো ছিল বাড়িতে এখন লেপের তলায় শুয়ে আরাম করতাম।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহসান তার ভাবী আর স্ত্রীকে নিয়ে ময়রার দোকানে গেল। পছন্দসই কিছু মিষ্টি, নিমকি নিজেদের জন্য কিনে সে শরতকে ফোন দিল। শরত ফোন তুলে কিছু বলার আগেই আহসান বলল, “আমি তোর আম্মা আর চাচীরে নিয়া বাড়ি চলে যাচ্ছি। শিশিরে ভরসা নাই বাবা তুই একটু খেয়াল রাখিস মেয়েগুলোর। সাবধানে নিয়ে ফিরে আসিস পরের মেয়ে বুঝিসই তো!”

শরত বলল, “কাকা আপনারা এখনই চলে যাবেন মাত্রই না এলাম!”

“আর বলিস না তোর মা-চাচীরে এনেই তো দিলি ঝা*মেলা বাঁধিয়ে এরা কি ভীড়বাট্টায় থাকতে পারে?”

শরত বুঝলো ব্যাপারটা। তারই আসলে ভুল হয়েছে সে জানে আম্মা আর চাচী দুজনই এখানে এসে কমফোর্ট হবে না তবুও তখন মনে হচ্ছিলো শিশিরের বান্ধবীদের সাথে তার আসাটা অস্বস্তিকর হবে না বড়রা থাকলে। কিন্তু এখন তো সেই সমস্যায়ই পড়তে হবে দেখছি!

আহসান ফোনের ওপাশ থেকে আবার ডাকলেন, “কিরে আমার কথা শুনছিস তুই শরত?”

মাইকের আওয়াজ, গান-বাজনা আর লটারির গেম কথা কিছুর শোরগোলে হয়ত শরত কিছুই শুনতে পাচ্ছে না ভাবছিলো আহসান। তখনই শরত জবাব দিলো, জ্বী কাকা শুনেছি।

“খেয়াল রাখিস কিন্তু ওদের। আর ফেরার সময় অটো দিয়ে ফিরিস।”

না চাইতেও দ্বায়িত্ব কাঁধে নিতেই হলো। সে ছোট্ট করে জবাব দিলো, জ্বী কাকা খেয়াল রাখব আমি সাথে সাথেই আছি তাদের।”

ফোন রেখে শরত তাকালো আলতাদের দিকে। আলতা আর অনু পাশাপাশি হাঁটছে শিশির তাদের দুজনের পেছনে৷ তার পেছনে সোহা আর সেখানে শরত নিজেও। আপনাআপনিই একটা দীর্ঘশ্বাস ছিটকে এলো ভেতর থেকে তার। মনে পড়লো বছর দুই আগের এক রাতের ঘটনা। এখানটাতেই মেলা বসেছিল সেবারও। সে মেলায় আসা খুব একটা পছন্দ করে না অথচ অলি নাকি বের হওয়ার সুযোগ পায় না। তার জোরাজুরিতেই এক রাতে আসতে হয়েছিল এখানটায়। প্রেমিকা নিয়ে রাত বিরাতে ঘুরতে বের হওয়া, মেলায় যাওয়া এসব তার পছন্দের বিপরীত। তবুও সেদিন প্রেমিকার শখ পূরণ করতে আঁধার মাখা রাস্তায় হাঁটতে হয়েছিল। অলি বোরকা, নিকাবে নিজেকে ঢেকে শরতের বাহু চেপে হেঁটেছিল সেই পথে। শীতের তীব্রতায় প্রেমিকার স্পর্শের উষ্ণতা তাকে পাগল করেনি বরং করেছিলো লজ্জিত। মেয়েটাকে সে ভালোবাসলেও বিবাহ বহির্ভূত স্পর্শ তার মনকে কখনোই নাড়া দিত না বলেই সেদিন প্রেমিকার সেকি অভিযোগ! আজও মনে পড়ে যায় পুরনো সব স্মৃতি যা ছিল আকাঙ্ক্ষিত যা হয়ে গেছে আজ অযাচিত।

“আসুন না শরত ভাইয়া সবাই নাগরদোলায় চড়বো।”

সোহার আকস্মিক ডাকে ভাবনায় বিভোর থাকা শরত চমকে উঠেছে। চারপাশে ঝলমলে আলোয় শরতের চমকে ওঠা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে সোহা। সে অবাক হলো ভীষণ তবে কিছু জানার আগ্রহ প্রকাশ করলো না। নাগরদোলার প্রথম খোপে অনু বসেই চেঁচিয়ে বলল, আমি একা বসব প্লিজ আমি একা বসবো ইয়াহু ইটস এডভেঞ্চার টাইম।”

অনুর চেঁচানো দেখে শিশির বলল, “যা তুই একাই ম*র।”

পরবর্তী খাপে আলতা বসতেই শিশির বলল, “সোহা এবার তুমি বসো।”

আলতা আতঙ্কিত চোখে তাকালো সোহার দিকে। সোহারও একই অবস্থা মানে তারা দুজন দুজনকে ভরসা করে বসতে পারছে না। তাদের শখ থাকলেও একজন শক্ত মানুষ পাশে চাচ্ছে। তাদের মনের কথা যেন অনুর নখদর্পনে। অনুই আবার বলল, “আরররররেহ তোদের এই ঢং, কুয়ারাতে এখানেই রাত পেরিয়ে যাবে বাল। এ্যাই শিশির তুই বস আলতার সাথে শরৎচন্দ্র একটু কষ্ট করে সোহার সাথে বসো প্লিজ। এটা খুব ভী*তু মেয়ে পরে না আবার হার্ট অ্যাটাক করে বসে।”

অনুর কথা শুনে অন্যরা কিছু ভাবার আগেই সোহা বিড়বিড় করে উঠলো, নননাহ আমি শিশিরের সাথে বসবো।”

চলবে

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

১৪.
নাগরদোলা ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগলো। প্রথমে অনু উপরের দিকে উঠতে চেঁচিয়ে উঠলো, ইয়াহু…… সেলফি তুলবো!

অনুর স্বাভাবিকতা দেখেই আলতার ভয় কেটে গেল। এমনিতেও সে ভয় পায় বলতে শুধু নিচের দিকে নামার সময়টাতেই পায়। অনুর পরের ধাপে আলতা শিশির তার পরেরটাতে বসেছিল সোহা আর শরত। একদমই অনিচ্ছায় অনুর টিপ্পনীমূলক দু চার কথার পর না বসে পারেনি সে। মনে মনে অবশ্য এ নিয়ে অনুকে সে একদফা বকাবকি করেছে কিন্তু সেগুলো সরাসরি বলার মত কোন প্রবৃত্তি তার নেই বলেই। তার নিজের খুব আফসোস হয়েছে আজ ঠোঁটকাটা স্বভাবের হতে পারে না বলে। চরকি ঘুরা শুরু হতেই বাঁধলো ঝা*মেলাটা। সোহা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। চড়কি যত ওপরে উঠছে ততোই চোখ মুখ শক্ত হচ্ছে সোহার আর নামার সময় নিজের অজান্তেই সে শরতের হাটুর ওপর রাখা হাতটা শক্ত করে ধরে বিড়বিড় করতে লাগলো। অন্যান্য মেয়েদের মত সে চিৎকার করেনি ঠিকই কিন্তু তার সকল ভয় যেন হাতের মুষ্টিতেই প্রকাশ পাচ্ছিলো। অবাক হয়ে তাকালো শরত তার দিকে, মেয়েটি চোখ বুঁজে কপাল কুঁচকে তার হাতটাকে এত শক্ত করে চেপে ধরেছে! যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে তার মুষ্টিতে। অনুর আওয়াজ কানে এলো তাদের, “চাচা থামাবেন না আরো কিছুক্ষণ আরো কিছুক্ষণ ঘুরান ডবল টাকা দেব।” হৈ চৈ শুধু অনুরই শোনা যাচ্ছে। মেয়েটা কিছুতেই যেন ভয় পায় না। সব কিছুতেই একটা উপভোগ্য ব্যাপার খুঁজে বেড়ায় সে। মেলার প্রায় অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে নাগরদোলার সামনে শুধু মাত্র অনুর চেঁচিয়ে বলা কথাগুলো বুঝতে পেরেই। তারা বোধহয় এই প্রথম এমন কোন মেয়ে দেখলো। এদিকে আলতা মিনিট কয়েক পরেই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। তার প্রথমে ভালো লাগলেও এবার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে কিছু বলতেও পারছিলো না কিন্তু শিশির বুঝতে পারলো আলতার হাত নিঃসাড় হয়ে আছে। সে আলতার হাত চেপে বলল, “চোখ বন্ধ রাখ নিজেকে রিল্যাক্স রাখ আমরা এখনই নেমে যাব।”

কথাটা বলেই শিশির আলতার হাতে শক্ত করে ধরলো। এতেই বুঝি নিঃশ্বাসে দৃঢ়তা ফিরলো আলতার; ভরসা বুঝি একেই বলে!

রাত বাড়ছে সেই সাথে বাড়ছে শীত। হু হু করে তাপমাত্রা নিচে নামছে বলে মধ্যবয়স্ক শরীরটাতে বার্ধ্যকের আচরণ পাচ্ছিলো আহসানুল্লাহ। মেলায় অনেক মানুষের ভীড়ে ঘুরতে যতোটা উষ্ণতা ছিল শরীরে তা বাড়ি ফেরার পর যেন একদমই কমে গেছে। শিফা ঘরে ফিরে বোরকা খুলে প্রথমেই রান্নাঘরে ঢুকলো। চায়ের পানি বসিয়ে সব মশলা পাতি ঘেঁটে লবঙ্গ, দারুচিনি আর এলাচ নিলো কয়েকটা। তারপর মনে পড়েছে এমনভাবে বলে উঠলো, “আল্লাহ! রাতের খাবারে কি করি এখন আমি তো মাছ, গোশ কিছুই নামাই নাই ফ্রিজ থাইকা।”

আহসান শুনলেন কথাটা তিনি মনে মনে বললেন, বোকা মহিলা সারাটা জীবন বোকার মত কথা বলল। এখন কিছু বললেই দোষ দিবে ফ্রিজ কিনে দিছিলেন কি জন্য নইলে সব গোছানোই থাকত।”

তবুও ভাবলেন বোকা স্ত্রী যতক্ষণে মাথায় বুদ্ধি আনবে ততক্ষণে তিনি সহযোগিতা করলে রান্না শেষ হয়ে যাবে। তাই এবার গলা ছেড়ে ডাকলেন, “শিফা এখানে একটু আসো তো।”

শিফা চা হয়ে এলে তা কাপে ঢেলে পরেই শোবার ঘরে এলেন। আহসান তখন লেপ মুড়ি দিয়ে চোখে চশমা এঁটে মোবাইলে কিছু দেখছিলেন। স্ত্রীর উপস্থিতি টের পেয়ে মোবাইল ছেড়ে উঠে বসলেন, কি গো তিন কাপে চা কেন?”

“আপনি একাই খাবেন নাকি শীত আপনার একারই লাগে শুধু!”

শিফার কথাটাতে কৌতুক ছিল যেন, আহসানুল্লাহ শব্দ করে হেসে ফেলল। তারপরই বলল, ভুল হয়ে গেছে গো যাও ভাবীকে ডেকে আনো।

জয়তুনকে ডেকে আবার ঘরে ঢুকলো শিফা। আহসান চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ” ঘরে সবজি কিছু আছে?”

শিফা ভ্রু কুঁচকে বলল, ” হ্যা সবজি আলু, টমেটো, ফুলকপি, আছে আর সকালে মাচার শিমগুলো পাড়লাম সেগুলো আছে।”

“ডিম আছে?”

শিফা এবার বিষ্মিত নজরে তাকালো স্বামীর মুখে। জয়তুনও ততক্ষণে ঘরে ঢুকে গেছে। তাকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে শিফা বলল, “কি খেতে চাইছো বলোতো।”

“খেতে না রান্না করতে চাইছি।”

স্ত্রী আর ভাবী দুজনের মুখ তার কথা শুনেই হা হয়ে গেছে। শিফা অবাক হয়ে বলল, তুমি রান্না করবে!

নাগরদোলা থেকে নেমে শিশির মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলল, “ফুচকা খাবি তোরা? না মানে মেয়েমানুষ তো আবার যেখানে যায় সেখানেই এগুলা গিলে।”

শিশিরের কথা শুনে অনু প্রতিবাদ করে উঠলো, “কি বলতে চাইছিস তুই? আমাকে কতদিন দেখেছিস ওসব গু*গোব*র খেতে!”

অনুর মুখের কথা শুনেই সোহা আর আলতা দুজনেরই মুখ বিকৃত হয়ে গেল। ইশ, তাদের এত প্রিয় খাবারটা নিয়ে এসব কি বলল অনু! দুজনেরই এই মুহুর্তে আর ফুচকার প্রতি লোভটা কাজ করলো না অথচ কত প্রিয় তাদের। শরত অন্যমনস্ক হয়ে তাদের সাথে সাথে চলছে কোন কথা বলছে না। কথা অবশ্য আলতাও বলছিলো না আর সোহা অল্পস্বল্প জবাব দিচ্ছিলো সেই সাথে আড়চোখে দেখছিল শরতকে। এই মানুষটাকে এক পলক দেখতেই সে গত কয়েক মাস নাকি বছর হয়ে এলো কত যে পাগলামি করেছে তা অনু ছাড়া আর কেউ জানে না। তার সেসব পাগলামির কথা শিশিরও সবটা জানে না। সে জানলে হয়ত তাকে এভাবে গ্রামে আসার ব্যাপারটাতে সায় দিতো না। শিশিরের সাথে পরিচয় ইউনিভার্সিটি জীবনের শুরু থেকেই অথচ তার সৌহার্দ্যতা আর আন্তরিকতার কাছে সোহা কখনো ক্লোজ বন্ধুও হতে পারেনি আবার দূরেরও নয়। তার কারণ সোহার নিজেরই অন্তর্মুখী স্বভাব। আবার অনুর সাথেও শিশিরের পরিচয়ের সময়টা একই অথচ তাদের বন্ধুত্ব তার চেয়েও গভীর ঘনিষ্ঠ একে অন্যের সাথে যার দরুন দুজনে তুই তোকারিতে আছে৷ এদিকে সোহার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী একমাত্র অনুই আছে কলেজ জীবন থেকে৷ সময়ের বেড়াজালে বন্দী হয়ে তারা তিনজন কতো ভালো বন্ধু তা শুধু তারাই জানে। দুটো মেয়ে একটা ছেলে ফ্রেন্ডের সাথে তার গ্রামে বেড়াতে যাবে ব্যাপারটা সোহার পরিবার সহজভাবে নেয় না অথচ শিশিরের প্রতি সকলের আস্থা এতবেশি জমেছে যার ফলে বিনা সন্দেহে মেয়েকে আসতে দিয়েছেন সোহার মা যদিও তার বাবা কিছুটা নারাজ। এই যে সোহা খুব করে বলে এই গ্রামে এসেছে চারটা দিন থাকতে তার পেছনে শুধু বন্ধুর বাড়ি দেখতে আসা নয় বরং শরতকে খুব কাছ থেকে দেখার এবং তার সামনে নিজের অনুভূতির প্রকাশ করাটাই মূল উদ্দেশ্য ছিল৷ এখানে আসার পর ভাগ্যও খুব সদয় হয়ে সুযোগ দিচ্ছে সেই সাথে অনুরও হাত আছে। শরতকে দেখতে দেখতেই কত কি ভেবে ভাবনায় বিভোর হয়ে সোহা খেয়ালই করেনি কখন যে পিছিয়ে গেছে সবার থেকে। ভীড়ের মাঝে যখন তার খেয়াল হলো তখন আশেপাশে পরিচিত মুখগুলোকে দেখতে পেল না। আতঙ্কিত মুখে সে এদিক ওদিক তাকালো। চারপাশে পুরুষের ভীড়ে মাঝে মধ্যে কয়েকজন বোরকা পরা কিংবা শাল চাদর আর ওড়নায় গা ঢাকা কয়েকজন নারী বা মেয়ে। কিন্তু তাতে আলতা আর অনুর মুখটা খুঁজে পেলো না সে। গলায় ঝুলানো ছোট্ট তার ব্যাগটাতে ফোন আর টাকা পয়সা আছে। দ্রুত সে ফোন বের করে শিশিরকে কল দিলো কিন্তু ব্যস্ত দেখাচ্ছে। এবার অনুকে দিলো সে কল রিসিভ করল কিন্তু ওপাশ থেকে যাই বলল কিচ্ছু বোঝা গেল না। দিশেহারা হয়ে সে এদিক ওদিক তাকাতেই মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো শরত। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো তার এই লোক সমাগমে আর এখন শরতকে দেখে যেন নিঃশ্বাস ফিরে এলো । শরত খেয়াল করলো মেয়েটির চোখ মুখের অবস্থা একদমই ভালো নয়। চোখ লাল হয়ে জলে টইটম্বুর, নাকের পাটা ফুলে ওঠছে, ঠোঁট দুটোও চেপে রেখেছে যেন কান্না আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। মাত্র মিনিট পাঁচেক আগেই তারা বিভিন্ন ভাজাভুজি খাবারের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তখনই অনু বলল, “সোহা কোথায়?”

শরত আর শিশির দুজনেই খেয়াল করলো পাশে নেই মেয়েটা। অথচ বেশি ভীড় যেখানটায় ছিল সেখানে মেয়েটা তাদের পাশ ঘেঁষেই হাঁটছিল এত দ্রুত হারিয়ে ফেলল কি করে! শরত নিজেই তখন বলল, “তুই ওদের নিয়ে এদিকটায় থাক আমি দেখছি।”

শরত যে পথে এসেছিল সে পথেই ফিরে এসে পেয়ে গেল সোহাকে। শক্ত মুখে কিছু বলতে গিয়েও তার মুখ দেখে আর বলা হলো না। হয়ত বললেই আটকে রাখা কান্নাটা ছিটকে বেরুবে। সে যতোটা সম্ভব শীতল গলায় বলল, “দাঁড়িয়েছিলে কেন?”

“স্যরি আমি খেয়াল করতে পারিনি।”

“চলো।”

এত অল্প শব্দে কথা বলে শরত যা শুনে বুঝতেই যেন পারে না সোহা। মন বলে লোকটা আরো দু চার কথা বলুক ভেতরে চেপে রাখা কান্নাটা সে এখন বের করে দেবে। কিন্তু না এই লোক তা করবে না। এবার আর বেখেয়ালি হওয়া গেল না। পায়ে পা মিলিয়ে শরতের সাথে এগিয়ে গেল যেখানটায় শিশিররা ছিল। রাত তখন সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। আলতা মোবাইল ফোনটি সাথে আনেনি তাই শরতের ফোনেই নকশি কল দিল। সে রিসিভ করে বলে দিল, “ফুপুআম্মা এখনও আমরা মেলায় আছি। বাড়ি ফিরতে আরও একটু সময় লাগবে। আলতা আজ আমাদের বাড়িই থাকবে না হয় শিশিরের বন্ধুদের সাথে!”

নকশি মুখে বলল, আচ্ছা, কিন্তু মন বলল, মাত্র তো আর তিনটে রাত তারপরই চলে যাবে। মন খারাপ নিয়েই শুয়ে পড়লো নকশি। আলতা উৎসুক হয়ে শরতের সাথে মায়ের কথোপকথন শুনছিলো। ওদিকে সোহা আর অনু চুড়ির দোকানে ঢুকলো। মেলা মানেই হাজাররকম মিষ্টি মন্ডা, হরেকরকম খেলনাপাতি, আর রঙবেরঙে সাজের জিনিস। অনুর খুব একটা আগ্রহ হলো না চুড়ি কেনা তবে সোহাকে সে বেছে বেছে অনেক গুলো কিনে দিল। শিশির তাদেরই আশপাশে থাকছে নজর রাখছে। শরতকে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে দেখেই আলতা প্রশ্ন করলো, “আম্মা কি বলল শরত ভাই?”

“বাড়ি ফেরার কথা জানতে চাইলো। বলে দিয়েছি আজ আর ও বাড়ি যাবি না।”

আলতার মুখটা চুপসে গেল শরতের কথা শুনে। সে ভাবছিল ফেরার পথে বলবে একটু এগিয়ে দিতে সে আজ মায়ের কাছে ঘুমাবে কিন্তু এখন এটা বলা ভালো লাগবে না। শরত তাড়া দিলো আলতাকে, তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন কি কিনবি কিনে নে। ফিরতে হবে তো রাত অনেক হলো।”

সোহা ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো শরতের দিকে। মনে মনে বলল, “আমাকেও কিছু কিনে দাও না শরতবাবু। সেই যে কবে থেকে ভিক্ষুকের মত তোমার পানে হা করে আছি একটু দাও না কিছু দয়া করে!”

পাগল মন বহু কথামালা বিছিয়ে দেয় শরতের পথে শুধু মুখটা তা উচ্চারণ করতে জানে না। শিশির আর শরত দুজনেই সবাইকে কিছু না কিছু খাওয়ার কথা বলল। কিন্তু মেয়েরা হাওয়াই মিঠাই আর জিলাপি ছাড়া কিছুই খেলো না। সোহা বেছে বেছে মেলা থেকে সস্তার অনেক সাজগোজের জিনিস কিনল। তা দেখে হা হা হি হি করে কত কি বলে ক্ষেপাতে লাগল অনু। শরতের নাম নিয়েই ছিল প্রত্যেকটা কথার খোঁচা। সোহা শুধু লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। আর তাদের ফিসফাস আর উচ্চরবে হাসিতে গা জ্বলছিল আলতার। সে অস্পষ্ট হাসি মজার কথাগুলোর মূল কেন্দ্রবিন্দু শিশিরকে ভেবেই অগ্নিরাঙা হয়ে উঠেছে পুরোটা সময়। শিশির অবশ্য খুব একটা পাত্তা কাউকেই দিচ্ছিলো না বলে ভাব করল শুধু শরতই মেলা জুড়ে রয়ে গেল নির্লিপ্ত। তার মনের আনাচকানাচে পুরনো ঘা একটু একটু করে আবারও কাঁচা হয়ে উঠছিল। স্মৃতি মানুষকে জী*বন্ত মরণ দিতে সদা প্রস্তুত আজ তা হাড়ে হাড়ে টের পেল শরত। কলেজের কোন এক বন্ধু তাকে মজার ছলে বলেছিল, প্রেমের স্বাদ বড়ই বি*দঘুটে বন্ধু। প্রেম ফুরাবে অথবা হারাবে কিন্তু তার স্মৃতি ক্ষণে ক্ষণে তোমাকে ম*র*ণ স্বাদ দিতেই থাকবে।”

শরত সেদিন অর্থহীন হাসিতে জানতে চেয়েছিল, “তবে মুক্তি কিসে!”

“নতুন স্বাদ পেলে পুরনো স্বাদ ফিকে হতে হতে হা*রিয়ে যাবে।”

শরতের মুখে তখন শরত শেষের শুষ্ক হাসি ভেসে উঠেছিলো। মনে মনে বলছিল, এক ম*রণ থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে দ্বিতীয় ম*র*ণে ঝাপ দিতে বলছিস!”

“ভাই! আরো দেরি করব?”

শিশির প্রশ্ন করলো শরতকে।

“ওদের ঘোরাঘুরি, কেনাকাটা হলো?”

“এ্যাই তোরা আরও কিছুক্ষণ থাকবি?” শিশির মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলল।

আলতা মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। অনু বলল, এবার ফিরতে চাই।

সোহাও বলল, হাত-পা জমে গেছে আমার এবার লেপ চাই।

“তো কি তোকে এখানে এনে দিবে লেপ!”

অনু মুখ বাঁকিয়ে বলল। তারা কিনবে না কিনবে না করেও অনেক কিছু কিনল। শরত বলল, “বড় অটো নিলে পেছনে চার সামনে এক পাঁচজন হয়ে যাবে।”

শরতই অটো ডেকে নিলো। শরত নিজেই সামনে বসে শিশিরকে বলল, পেছনে বোস তুই।

সোহা আর অনু পাশাপাশি বসতেই উল্টো দিকের সিটে উঠে বসলো আলতা। শিশিরও সময় ব্যয় না করে আলতার পাশে বসল। অটোর পেছনের সিটে কোথাও বাতি নেই, রাস্তাঘাটও আঁধারে ঢাকা সেই সাথে কুয়াশার ঘোলাটেভাব। মোটা উলের শীতপোশাক ভেদ করেই শীত যেন তার ধারালো কামড় বসাচ্ছে সকলের গায়ে। শিশির অনুভব করলো আলতার গা কাঁপুনি। এই অন্ধকারে কেউ কি দেখে ফেলবে তার ঘনিষ্ঠতা! মন জানান দিলো, ভয় নেই কেউ দেখবে না। সাথে সাথেই শিশির হাত বাড়িয়ে বাহুর মাঝে জড়িয়ে নিলো আলতাকে। শিরশিরে শীতের কাঁপন এবার বহুগুণ বেড়ে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে দেওয়ার জো হলো যেন আলতার। এই বাহুবন্ধনী তাকে শীত থেকে রক্ষা করার বদলে লজ্জায় আড়ষ্ট করে তুলল ঘন অন্ধকার অটোতেও। কানের পাশ ছুঁয়ে বেরিয়ে যাওয়া হাওয়ারাও এবার পণ করলো ছুঁয়ে ছুয়ে যাওয়ার।

চলবে

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

১৫.

ধোঁয়া ওঠা সবজি খিচুড়ি সাথে ডিম ভুনা। বাড়িতে ফিরে সবাই দেখলো বাইরের রান্নাঘরেই বসে আছে বাড়ির তিনজন মুরুব্বি। আর সবচেয়ে বিষ্ময়ের কথা ডিম ভুনা কড়াইতে নাড়াচাড়া করছেন। আলতা উঠোনে দাঁড়িয়েই চেঁচিয়ে বলল, “মামা রান্না করতেছে?”

“আজ আঙ্কেল রান্না করেছেন! মেন্যু নিশ্চয়ই দারুণ কিছু হতে চলেছে।” সোৎসাহে বলে উঠলো অনু। বাকিদেরও মুখ উজ্জ্বল আর তাতেই টিপ্পনী কাটলো শিফা, “হু আল্লাহই জানেন কি খাওয়াবেন। একটু লবণ চাখতে দিলো না, মশলাপাতিও ঠিকঠাক দিল কিনা কে জানে! এ জীবনে তো আগে কখনো এক হাঁড়ি পানিও গরম করতে দেখিনি!”

জয়তুন ধমকালেন, আহ্ শিফা তুই এমনে কস ক্যা? আহসান ভালোই রানছে দেখিস। ওয় তো কলেজে পড়ত সময় মেসে থাকতেও নাকি বন্ধু গো লগে মিললা কি কি রাইন্দা পিকনিক করছে।”

শিফা রান্নাঘরের জিনিসপত্র গুছিয়ে সবাইকে তাড়া দিলেন, “যাও সবাই মুখ হাত ধুয়ে নাও খাবার বাড়তেছি।”

শিশিরদের ঘরে সবাই একসাথে বসেই খাওয়া শেষ করলে শরত বেরিয়ে গেল। জয়তুন অবশ্য আরো কিছু সময় বসে কথা বললেন আহসানের সাথে কোন এক ঘটক নাকি ভীষণ সুন্দর এক মেয়ের খোঁজ এনেছেন। আহসানদের শোবার ঘরে কথাগুলো হলেও কিছুটা কানে এসেছিল আলতা আর অনুর। অনু একবার আলতার দিকে তাকিয়ে আবার সোহার সামনে গিয়ে বসলো।

“কিরে কিছু বলবি?”
সোহা প্রশ্ন করলো। সে এখন বসে বসে ঝুমকাগুলো দেখছিল কারটা বেশি সুন্দর সেজন্য৷ মেলায় যখন শরত আলতাকে বলল, “কিছু কিনবি না দ্যাখ কি নিবি তোর জন্য নে শিউলির জন্যও দেখিস।”

তখনই অনু বলেছিল, বাহ্ শরৎচন্দ্র শুধু বোনদেরই দিবে সাথে দুজন মেহমানও তো আছে।”

অনু ঠোঁটকাটা স্বভাবের যা মুখে আসে বলে দেয়। কিন্তু এতে তার আশপাশের লোকগুলো ভীষণ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে তা কি সে বোঝে না নাকি ইচ্ছে করেই করে তা জানে না শিশির। তবে তার এ বিষয়ে আজ বিব্রতবোধ হয়নি বরং তার ভাইয়ের মুখটা দেখে খুব হাসি পেয়েছিল। তার মনে পড়ে অলিকে যেদিন সে ভাইয়ের হয়ে প্রপোজ করেছে তার দিন কয়েক পর এক রাতেই অলি ফোন করে শরতের প্রপোজের বর্ণনা দিয়ে বলেছিল ভাই মুখটা কেমন ছিল! অনুর কথার রেশ কেটে ওঠার আগেই শরত বলেছিল ‘তোমরাও নাও।’

অনু আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল তখন সোহা তার হাত চেপে বারণ করেছে। তারা ঝুমকার দোকানের সামনাসামনি থাকায় সোহা ঝুমকাই দেখাল আলতাকে। আলতা আগেও কত কি কিনেছে শরত ভাই, মামা আর শিশির ভাইয়ের টাকায় তাই তার একটুও সংকোচ হচ্ছিলো না। বরং উচ্ছ্বসিত হয়েই সে ঝুমকা পছন্দ করেছিল। সেই ঝুমকা থেকেই এক জোড়া শিউলি, একজোড়া আলতার বাকি দু জোড়া সোহা, অনুর। অনু বিরক্তির সাথে সোহার হাত থেকে ঝুমকাগুলো সরিয়ে বলল, “তুই আজাইরা স্বপ্ন দেখেই দিন পার কর ওদিকে শরৎচন্দ্রের মা তার বিয়ে ঠিক করে ফেলছে।”

“কি!”

কথাটা বলেই সোহা কান্না কান্না মুখ করেছে। আলতা ততক্ষণে রুমে ঢুকেছে কিন্তু তাদের কথাটা ঠিকঠাক ধরতে পারেনি। তার মনে হলো এরা কোন গোপন আলোচনা করছে তাই সে ঘর থেকে আবারও বের হলো আর তাতেই মুখোমুখি হলো শিশিরের। বাইরে হাড়কাঁপানো শীত অথচ শিশিরের চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে তার গলা, খোলা বুক সব ভিজে যাচ্ছে। এই তীব্র শীতেও হঠাৎ যেন এক ঝটকা খেলে শরীর অস্বাভাবিক গরম হয়ে গেল আলতার। বিশেষ করে তার গাল আর কান দুটো থেকে যেন গরমে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এতো শীতেও শিশিরের এই হাল দেখে আলতার পরিবর্তন তা চোখ এড়ায়নি শিশিরের। সে কেমন হঠাৎ কৈফিয়তের স্বরে বলল, ” আজ দিনে গোসল করা হয়নি আর জানিসই তো গোসল ছাড়া আমার ঘুম হয় না তাই এখন মাথা ধুয়ে গা হাত পা মুছে নিলাম।”

শিশির এক হাতে শরীর মুছতে মুছতে অন্য হাতে পরার কাপড় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল শরতের ঘরের দিকে। এবার তাকে শরত ভাইয়ের সাথেই থাকতে হবে।

দেখতে দেখেই দু দিন কেটে গেছে গ্রামে আসার। সময়টা সকলেই দারুণ অনন্দে কেটেছে, কেটেছে প্রকৃতির শীতের প্রতিটি সৌন্দর্য উপভোগ করে। কিন্তু আলতার সময় কম তাকে নকশির সাথে সময় কাটাতে হবে যতটা সম্ভব। তাই আজ ভোরে ওঠেই সে চলে গেছে জহিরদের বাড়ি। নাশতাটা সে মায়ের সাথে করবে বলেই ঠিক করেছে৷ সকাল সকাল তাকে দেখেই এক গাল হেসে জহির জিজ্ঞেস করলো, নাশতায় কি খাবি আলতা বলতো? তোর আম্মাকে দিয়ে তা-ই রান্না করাবো। এমনিতপ প্রত্যেকদিন শুধু রুটি আর সবজি দেয়।”

“আজকে আমি নাশতা বানাই কাকা?”

আলতাও হেসে হেসে বলল কথাটা৷ রাত থেকে নকশির শরীরটা আজ ভীষণ ভালো লাগছিল তাই আজ ভোরে উঠেই সে চিতুই পিঠার জন্য চালের গুঁড়ো গুলে রেখেছে। আলতা আর জহিরের কথায় পাত্তা না দিয়ে সে চুলো জ্বালিয়ে পিঠার তাওয়া বসালো। সরিষা আর শুটকির ভর্তাও সে শিল পাটায় বেঁটে রেখেছে। জহির মাংস এনে বলেছিল আলতা যে কদিন থাকে ভালোমন্দ রান্না করতে সেই মাংস থেকেই কিছুটা কষাবে বলে নিলো। দুই মুখো চুলায় একটায় মাংস অন্যটায় পিঠা হচ্ছে। জহিরের কাজ আছে বলে সে আপাতত ভর্তা দিয়ে পিঠা খেয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় আলতার জন্য কি নিয়ে আসবে তা জিজ্ঞেস করতেও ভুললো না সে। আলতা খুশি হলো খুব জহির কাকার এই স্নেহে। তিনি আগেও খুব স্নেহ করতেন কিন্তু এবার তার মধ্যে একটা দ্বিধা ছিল জহির কাকার সাথে কথা বলতে। কিন্তু এখন আর তা রইলো না। সকালের নাশতা শেষ করে আলতা বসলো মায়ের সাথে তাঁর শোবার ঘরে। নকশি ভালো করে অনেকটা সময় নিয়ে মেয়ের মুখ দেখলো। আজ হঠাৎই সে আলতার চেহারায় কৈশোর পেরোনো ছাপ দেখতে পেল। বুকটা আচমকাই চমকে উঠলো তা দেখে। নিজের কিশোরী মেয়ের মুখে এমন দ্বায়িত্ব আর নিঃসঙ্গতার ছাপ দেখে নকশির কলিজা মু*চড়ে উঠছে। নিজের কৈশোর আর যৌবনের যে বাস্তব নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্ব সে ভোগ করে এসেছে তার মেয়েও কি তাই ভোগ করছে! যে মেয়ের জন্য সে জীবনের রঙিন সময়টাতেই নিজের জীবন সাজালো না অথচ এখন এসে তার এই নতুন জীবন কি মেয়ের জন্য অভিশাপ হয়ে গেল!

নকশির মনোভাবনা বুঝতে একটুও দেরি হয়নি আলতার। সে মাকে তার ভাবনা থেকে বের করে আনতেই কথা শুরু করলো, “আম্মা বাবুটা হইতে আর কতদিন বাকি?”

নকশি তৎক্ষনাৎ ভাবনা থেকে ছিটকে গেল। জবাব দিল, এখনও আরও ছয় মাসের মতন দেরি।

“আচ্ছা আম্মা ভাই হবে নাকি বোন তা কবে জানা যাবে?”

“তুই কি চাস?”

” ভাই, বোন যাই হোক আমি খুশি। যদি ভাই হয় তাহলে আমি তার জন্য ঢাকা থেকে অন্নেকগুলা গাড়ি, ব্যাট বল নিয়া আসব। আর যদি বোন হয় তাহলে অনেক সুন্দর সুন্দর জামা আর সাজুনিগুজনি নিয়া আসব। আম্মা জানো, ঢাকার মার্কেটগুলা অনেক বড় আর অনেক সুন্দর সুন্দর পোশাক, মেকাপ আর রাস্তার ধারেই ঝুপড়িতে কইরা কাচের চুড়ি পাওয়া যায়।”

কথা বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ছিলো আলতা। নকশির রুদ্ধ হয়ে আসা নিঃশ্বাসটা এবার সতেজ হতে লাগলো। মেয়েটা তবে তার এই অনাগত সন্তানকে স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছে!”

সারা সকাল, দুপুর আলতা তার মায়ের কাছেই রইলো। দুপুরের পর শিফা এক বড় ঢাকনাওয়ালা বাটি ভরে নকশির জন্য মেলা থেকে আনা নিমকি আর মিষ্টি পাঠালো শিশিরকে দিয়ে। তখন শিশির বলল, সোহারা বিকেলে শাড়ি পরে ঘুরতে যাবে নদীর দিকে তোকেও তৈরি থাকতে বলেছে।”

আলতা আর নকশি পাশাপাশি বসা ছিল। শিশির কথাটা আলতা বললেও সে যেন নকশিকে শোনাচ্ছিলো অনুমতি চাওয়ার মত করে। নকশি শুনে হ্যাঁ, না কিছুই বলেনি তা দেখে শিশিরের একটু মন কেমন করল। সে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরপরই নকশি বলল, “আমার একটা ভালো শাড়ি আছে তোকে পরিয়ে দিব কিন্তু ব্লাউজ তো ঠিকঠাক গায়ে আসবে না তোর।”

নকশির কথা শেষ হওয়ার আগেই আলতার হাতে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠলো। সেদিকে তাকাতেই দেখলো শিশিরের মেসেজ, ” শাড়ি পরে চুলে বেণী করে আসবি।”

চলবে