#মায়ার_বাঁধ
অহমিকা মুনতাহাজ নিশি
০১.
পুষ্পে পুষ্পে সজ্জিত কক্ষটির শোভিত বিছানার মধ্যিখান বরাবর গুটিশুটি মে’রে বসে আছে নীরা। দুরুদুরু বক্ষে সৃষ্ট হচ্ছে মৃদু কম্পন। নরম, তুলতুলে তরতাজা দেহখানা ক্রমেই শীতল থেকে শীতলতায় ছেয়ে পড়ছে। মনটাকে স্থির রাখার আশায় সে তার ঘন পল্লব বিশিষ্ট ডাগর ডাগর অক্ষিযুগল দ্বারা কক্ষটির আনাচে কানাচে দৃষ্টি রাখল। সুবিশাল কক্ষটির সুনিপুণ সজ্জা নিখুঁত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। জানালার চওড়া জায়গা থেকে শুরু করে কক্ষের মধ্যভাগ অব্দি ঘি’য়ের প্রদীপ জ্বলন্ত। কক্ষের সিংহভাগ জুড়ে রজনীগন্ধা,গোলাপ ও গাঁদা ফুলের সমারোহ। সেসব পুষ্প হতে আগত সুঘ্রাণে সুরভিত গোটা কক্ষ। সূচনাতে মুগ্ধতা কাজ করলেও পরক্ষণেই বিশেষ কিছু চিন্তা মস্তিষ্কে হানা দিতেই নিজে থেকে পুনরায় গুটিয়ে পড়লো নীরা৷ দৃষ্টি নামিয়ে পূর্বের ন্যায় ঘাপটি মে’রে বসে রইল। অপেক্ষা কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। হয়তো খুব শীঘ্রই দেখা মিলবে তার। কী হবে তারপর?
সময়টা হচ্ছে তৃতীয় প্রহরের শুরুর দিক অর্থাৎ রাত বারোটা বেজে পনের মিনিট–
দরজার কর্কশ শব্দে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে নীরা। সেই দু’ঘন্টা যাবৎ অপেক্ষা করতে করতে কখন যেন চোখ লেগে এসেছিল তার। আতঙ্কিত মন নিয়ে ঘুম গাঢ় হতে পারেনি যার ফলে অল্প স্বল্প আওয়াজেই জেগে গেছে তার মস্তিষ্ক। দরজায় দৃষ্টি রাখার মতো সা’হ’স সঞ্চারে ব্যর্থ হলো সে। শাড়ির আঁচল খামচে, দন্ত দ্বারা ওষ্ঠ পিষে ধরে সেভাবেই শক্ত ভঙ্গিমায় বসে রইল। দৃষ্টি তার কোলের ওপর নামানো। চিবুক ছুয়েছে গলদেশ। নিজের শরীরের কম্পন নিজেই উপলব্ধি করতে পারছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। হিম হয়ে আসছে সর্বাঙ্গ। স্মরণ করছে ওপর ওয়ালাকে।
——–🍂
দরজায় ছিটকিনি টেনে ভেতরমুখী হয়ে দাড়াল তুরান। বেশিক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, অগত্যা ঠেস দিল দরজায়। প্রগাঢ় দৃষ্টি ফেলে নিখুঁত পর্যবেক্ষণে নেমে পড়ল বিছানায় গুটিশুটি মে’রে বসে থাকা রমনীতে। ভারী লেহেঙ্গা আর কারুকার্যপূর্ণ ওড়নার আড়ালে আবৃত রমনীর তেমন কিছুই ঠাওর করতে পারল না সে। চোখে মুখে ফুটিয়ে তুলল অজস্র বিরক্তি। দরজার ঠেস থেকে নিজেকে মুক্ত করে টালমাটাল পায়ে এগিয়ে গেল বিছানার নিকটে। অধৈর্য ভঙ্গিতে ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। একেবারে নীরার সম্মুখে।
কাঙ্ক্ষিত মানুষটির উপস্থিতি সন্নিকটে অনুভব করে দ্বিগুণ গুটিয়ে গেল নীরা। কিন্তু তার কী এখন গুটিয়ে থাকার সময়? গুরুজনেরা কতশত নিয়ম বলে গেছে। সেগুলো তো পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পালন করতে হবে তাকে। কিন্তু সে? সে তো ভ’য়েই শে’ষ। নীরা নড়েচড়ে বসল। অতী চেষ্টায় বক্ষে কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চার করে যখনই বিছানা থেকে নামতে গেল বাঁধ সাধল তুরান। চেপে ধরল নীরার হাত। নীরা ভড়কায়। আচমকা চোখে চোখ মেলে দুজনের। রক্তরঙা চোখ জোড়ায় হারিয়ে যায় যেন নীরা। তেমনই তুরানও হারায় নীরার সুনিপুণ অক্ষিপটে।
জানালা থেকে আগত দমকা হাওয়ায় নীরার ঘোমটা সরে যায়। বেবি হেয়ারগুলো অবাধ্যতা করে উড়ছে কপাল জুড়ে। তুরান তার এক হাত নীরার ডান গালে রাখে। ধীর স্থির ভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা স্লাইড করতে থাকে নীরার ওষ্ঠে। নীরা ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে ওঠে। দৃষ্টি খিঁচে বদ্ধ করে ফেলে। খাঁমচে ধরে তুরানের হাতের কব্জি। তার সর্বাঙ্গের সঙ্গে অধর জোড়াও কাঁপছে ক্রমাগত। সেই কম্পন যেন দ্বিগুণ টানছে তুরানকে।
সহসা কী যে হলো সুন্দর, মোহনীয় মুহূর্তটা বিষাদে পূর্ণতা পেল। সব মোহ মায়া ভুলে নীরাকে এক ঝটকায় বিছানা ফেলে দিল তুরান। নিজেও নেমে দাড়াল। নীরা ছিটকে গিয়ে পড়ল টি-টেবিলের ওপর। টেবিলের কোণে লেগে কপাল ততক্ষণাৎ ফুলে উঠল। পায়ে বিঁধল কাঁটার মতো কিছু। কাঁটাই হবে হয়তো। এতো এতো ফুলের মাঝে কোথায় হয়তো লুকিয়ে থেকে গেছে ওটা। পা থেকে ঝরছে রক্ত। ফুলের বাসর সজ্জা মূহুর্তে পরিণত হলো কণ্টক সজ্জায়।
নীরা সেভাবেই অবিশ্বাস্য, ব্যথাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তুরানের দিকে। চোখে তার অশ্রু টলমল। তুরান পাত্তা দিল না। সে টলছে। নিভু নিভু চাহনিতে চোখ টেনে টেনে নীরাকে দেখছে। পরপরই আঙুল তুলে মাতাল কন্ঠে বলল,
-“হেই ইডিয়েট গার্ল। অশিক্ষিত, গাইয়া মেয়ে। টাকার জন্য আমার পিছু নিয়েছ তাই তো। লোভী,আনকালচার। আই হেইট ভিলেজ। আই হেইট ভিলেজ গার্ল। আই হেইট ইউ…”
আরও কিছু কথা বাকি রেখেই বিছানায় ঢলে পড়ে তুরান। এতক্ষণে নীরা বুঝতে পেরেছে তুরান ড্রিংক করেছে। কথা গুলো বলতে তার বড্ড বেগ পেতে হয়েছে। নীরা সোজা হয়ে দাড়ায়। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায় তুরানের দিকে। তুরান ততক্ষণে অচে’তন৷ ঘুম নাকি বেহুঁ’শ বোঝা দায়। নীরা সন্তর্পণে নিজের চক্ষু হাতের উল্টো পিঠ দ্বারা মুছে নেয়। তুরানের নিস্তেজ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে নিরেট, দৃঢ় কন্ঠে বলে,
“গ্রামের মেয়ে হতে পারি কিন্তু গাইয়া নই, লোভী নই, আনকালচার নই, অশিক্ষিতও নই। আই এ্যাম এ্যান এডুকেটেড গার্ল।”
——–🍂
রাতটা একাকী বিষন্নতায় পাড় করে নীরা। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে বিছানার কাছে গিয়ে জ্ঞানহীন তুরানের পায়ের জুতো খুলে দেয়। টেনে সোজা করে বালিশে মাথা রেখে শুয়িয়ে দেয়। শত হোক তুরান তার স্বামী। স্বামীর যত্ন নেওয়া প্রতিটি স্ত্রীর দ্বায়িত্ব। স্ত্রী হিসেবে তার যতটুকু করার সে করবে বাকিটা ওপর ওয়ালা যা চান তাই না হয় হোক।
প্রথম রাতেই স্বামীর দেওয়া আঘাত পাওয়া মেয়েটির মনে এই মুহুর্তে ঠিক কী চলছে তা বলে বোঝানোর মতো নয়। নীরার কতশত স্বপ্ন তুরান এক নিমেষেই সব ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। এমন যেন মনে হয়, সাজানো তাসের ঘর হাওয়ায় হেলে পড়েছে। নীরাকে পারবে সেই ঘর পুনরায় সোজা করতে? শ্বাশুড়িকে দেওয়া কথা রাখতে? তুরানের যোগ্য স্ত্রী হয়ে উঠতে?
ফ্লোর থেকে গুটিশুটি পায়ে উঠে দাড়াল নীরা। সারাটা রাত এই ফ্লোরে বসেই কাটিয়ে দিয়েছে। একটু আগেই ফজরের আজান দিল। এখন ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়বে সে।
কিছু হোক বা না হোক সকলে জানে গতরাতটা তাদের বাসর রাত ছিল। সকলের প্রশ্নের সম্মুখীন যাতে না হতে হয় সেজন্য নীরা শুরুতে শাওয়ার নিয়ে নিল। গতকাল তার শ্বাশুড়ি তাকে একটা লাল রঙা সুতির শাড়ি দিয়ে গিয়েছিল শাওয়ার শেষে ওটাই পড়ল সে। অতঃপর নামাজ পড়ে নিল।
ঘড়ির কাটায় সবে ভোর সাড়ে পাঁচটা। এত সকালে নিচে যাওয়াটা কী ঠিক হবে? তবে গ্রামে থাকাকালীন তো এই সময়ে সকলে জেগে যেত কিন্তু শহরের বিষয় ভিন্ন। নীরা বুদ্ধিমতি মেয়ে সবকিছু বিবেচনা করে সেভাবেই চলে। তার এই বিবেচনাবোধ দেখেই তো তার শ্বাশুড়ি তার প্রতি মুগ্ধ হয়েছিল। বিছানায় চোখ পড়ল নীরার। তুরান কী সুন্দর বাচ্চাদের মতো করে ঘুমিয়ে। নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই সুন্দর মানুষটা কী তার হতে পারত না? অগত্যা বেলকনিতে চলে গেল নীরা। কাল থেকে মন আনচান করছিল বেলকনিটা ঘুরে দেখার জন্য কিন্তু সুযোগ হয়ে ওঠে নি। বেলকনিটার মূল আকর্ষণ হচ্ছে বাহারি ফুলের গাছ গুলো। প্রতিটি গাছে তরতাজা ফুল ফুটে আছে। ভোরের মিষ্টি আলোয় আচ্ছাদিত হয়ে তারা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। নীরার মন নেচে উঠল। হাঁটু ভেঙে নিচে বসে পড়ল। ফুলের সঙ্গে মেতে উঠল খোশগল্পে। মুহুর্তেই এক প্রাণবন্ত, বাচ্চা নীরার দেখা মিলল। ঠিক তখনই কেউ কড়া নাড়ল দরজায়। নীরা চমকে উঠল। তড়িঘড়ি করে উঠে আসলো ভেতরে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল আটটা বেজে চার মিনিট। নীরা জ্বিভে কামড় বসায়। এত বেলা কখন হলো? সে তো ভেবেছিল সাতটা বাজলেই বাহিরে বের হবে। ইস এখন কী হবে কে জানে?
মাথায় সুন্দর করে ঘোমটা টেনে নীরা গিয়ে দরজা খুলে দিল। আর তখনই ওপাশ থেকে ভেসে এলো…….
চলবে,___