#মায়ার_বাঁধন 🍂
০২.
দরজা খুলে এক অল্প বয়সী মেয়েকে সম্মুখে আবিষ্কার করে নীরা। নীরাকে দেখে মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলে,
-“ছোট ভাবি, আপনাকে চাচিআম্মু ডাকছে। চলুন আমার সঙ্গে।”
নীরা মাথা নেড়ে সম্মত হলো। ঘরের দরজা টেনে দিয়ে রওনা হলো মেয়েটির সঙ্গে। মেয়েটি যেতে যেতে তার পরিচয় জানাল। গতকাল বিয়ে বাড়িতে অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে কিন্তু সেভাবে কাউকেই মনে নেই নীরার। এই মেয়েটি হলো তুরানের চাচাতো বোন। নাম হিয়া। এবারে ক্লাস নাইনে পড়ে। চাচি আম্মু বলতে সে নীরার শ্বাশুড়িকে বুঝিয়েছে। আলাপ আলোচনা করতে করতে তারা উপস্থিত হয় কিচেন রুমে যেখানে নীরার শ্বাশুড়ি,বড় জা সহ আরও বেশ কয়েকজন অপরিচিত মুখ দেখা যাচ্ছে।
নীরা সেখানে উপস্থিত হতেই তার শ্বাশুড়ি জাহানারা চৌধুরী এগিয়ে এলেন। মিষ্টি মুখে বললেন,
-“এসো মা এসো। আজ তোমাদের বউ ভাত কিছু নিয়ম কানুন আছে এজন্যই ডেকে পাঠালাম। অসুবিধা হয়নি তো?”
নীরা মৃদু হাসল। ধীরে সুস্থে বলল,
-“না না অসুবিধা কেন হবে? আমি এমনিতেই আরও আগে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু কখন যে সময় পেড়িয়ে গেল বুঝতেই পারি নি।”
এরই মধ্যে নীরার বড় জা রিনা ফোড়ন কেটে উঠল। মুখভঙ্গি বিকৃত করে বলল,
-“হুম হবে না বরের সঙ্গে লেপ্টে থাকলে তো এমনটা হবেই। সময় জ্ঞান হুঁশ থাকবে কী করে। তা বর তো দেখছি ভালোই সোহাগ করেছে। কপাল ফুলে আছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। আচ্ছা এক রাতেই বশে নিয়ে নিলে আমার দেবরটাকে। নয়তো যে ছেলে গ্রামের মেয়ে বিয়ে করতে রাজিই ছিল না সে কিনা দিব্বি বাসর সেরে নিল। অদ্ভুত!”
রিনার ব্যবহারে উপস্থিত সকলে বিরক্ত। লজ্জায় পড়ে হিয়ার মা হেলেনা চৌধুরী তড়িঘড়ি করে চোখ গরম করে মেয়েকে বললেন,
-“হিয়া, বড়দের মধ্যে তোমার কী কাজ যাও গিয়ে টিয়াকে ঘুম থেকে তোলো।”
হিয়া মাথা নত করে ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেল। হিয়া চলে যেতেই জাহানারা চৌধুরী রিনাকে ধমকে উঠলেন। বললেন,
-“বড় বউ মা, দিনকে দিন অসভ্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুমি। এমন চলতে থাকলে তরিককে জানাতে বাধ্য হব আমি। আপাততঃ এখান থেকে যাও এখানে তোমাকে আর প্রয়োজন নেই।”
রিনা সকলের অগোচরে জাহানারা চৌধুরীর উদ্দেশ্যে মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল। কায়দা করে হেলেদুলে নীরাকে দিয়ে গেল এক ধাক্কা। নীরা পড়তে পড়তে আবার সামলে নেয় নিজেকে। রিনা চলে গেলে হেলেনা চৌধুরী এগিয়ে আসে নীরার নিকট। আবদারের স্বরে বলেন,
-“তুমি কিছু মনে কর না ছোট বউ। বড় বউ বরাবরই এমন ঠোঁটকাটা। ওর থেকে একটু সামলে চল।”
জাহানারা চৌধুরী তেঁতে আছেন। সকাল সকাল রিনার কান্ড তার একদম পছন্দ হয়নি। কড়াইতে তেল দিতে দিতে তিনি হেলেনা চৌধুরীকে ধমকের সুরে বললেন,
-“আর কত ওর দোষ ঢাকবি ছোটো? সকলের আস্কারায় মাথায় চড়ে বসেছে। লঘু-গুরু জ্ঞান টুকুও নেই।”
জাহানারা চৌধুরীর কথায় সেখানে উপস্থিত আরও তিনজন মহিলা সম্মত হলেন। সকলে নিজেদের মতো রিনার নিন্দা করতে ব্যস্ত। এদের মধ্যে নিরব দর্শক নীরা। লজ্জা, বিষন্নতা,আড়ষ্টতায় পরিপূর্ণ সে। সংকোচে মুখ দিয়ে ‘রা’ শব্দটিও করছে না। জাহানারা চৌধুরী হেলেনা চৌধুরীর নিকট রান্নাবান্না বুঝিয়ে দিয়ে এগিয়ে এলেন নীরার নিকট। নীরাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। আস্তে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তোমার কী খুব অসুবিধা হচ্ছে ছোট বউ মা? হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে? তুমি তাহলে ঘরে যাও আমি ঔষধ পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
নীরা লজ্জায় এবার বোধহয় ম’রেই যাবে। হয়েছি কী আর এরা ভাবছে কী। নীরা তবুও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না। শুধু মাত্র মাথা নেড়ে বোঝালো,’তার কিছু লাগবে না। সে ঠিক আছে।’
জাহানারা চৌধুরী স্বস্তি পেলেন না। নতুন বউ সবটা তাকে খুলে বলতে পারছে না এটা তিনি বুঝতে পারছেন। তাই নীরাকে নিয়ে কোনো রকমে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। অতঃপর এক মগ ধোঁয়া ওঠা কফি ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-“তুমি বরং এটা নিয়ে তুরানকে দাও বউ মা। ছেলেটা সকাল হলে গরম কফি তার চাই। নয়তো চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে। এতদিন এই দ্বায়িত্ব আমার ছিল এখন থেকে তোমার হলো। যাও স্বামী সেবা করো গিয়ে। আর হ্যাঁ এখন আর নিচে আসতে হবে না তোমাকে। একেবারে সেজেগুজে স্টেজে নিয়ে যাব। এখন বরং একটু রেস্ট করে নাও। সারাদিনে কখন ছাড়া পাবে বলা মুশকিল।”
নীরা ইতস্তত করছে। আবার শ্বাশুড়ির মুখের ওপর কিছু বলতেও পারছে না। নীরাকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জাহানারা চৌধুরীর খটকা লাগল। একপ্রকার জোর করেই নীরার হাতে কফির মগটা ধরিয়ে দিল সে। তড়িঘড়ি পায়ে সরে গেলেন হেঁশেলে। অগত্যা উপায়ন্তর না পেয়ে ফ্যাকাশে মুখে অগ্রসর হলো নীরা ঘরের দিকে।
———-🍂
পায়ের ক্ষ’ত ততটা গভীর না হলেও ব্যথায় টনটন করছে। কাঁ’টার আ’ঘাত বড্ড য’ন্ত্রণার। কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়ে রক্ত বন্ধ হলেও ব্যথায় সর্বাঙ্গ অসার হয়ে আসছে নীরার। সিঁড়ি টুকু পার হতে বড্ড বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। এক হাতে কফির মগ তো আরেক হাতে শাড়ির কুচি ধরে ওপরে উঠছে সে। মাঝেমধ্যে পায়ের ব্যথায় কাতর হয়ে মনোযোগ ঘুরে মগ থেকে কফি ছিটকে হাতে পড়ছে। গরম কফির আঁচে হাতটাও জ্বলে উঠছে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিচ্ছে সে। পথিমধ্যে পুনরায় দেখা মেলে হিয়ার সঙ্গে। হিয়াকে দেখে এবারে নীরা থমকে দাড়ায়। একটু আগে মেয়েটার গায়ের রঙ কতটা উজ্জ্বল দেখতে লাগছিল, চুলগুলো ছিল স্ট্রেইট আর এখন এতটা শ্যামাঙ্গি কী করে হলো? স্ট্রেইট চুলগুলোও বেশ কোঁকড়া দিয়ে গেছে। চোখে লাগার মতো অবস্থা। নীরার ভাবুক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ছুট্টে আসে হিয়া। একেবারে নীরার সম্মুখে এসে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,
-“হাই নতুন ভাবি। আমি টিয়া। তোমার কিউট, সুইট ননদীনি।”
নীরার চোখ খুলে আসার উপক্রম। এটা টিয়া মানে? তখনই পেছনে থেকে হিয়াও এসে পড়ে। ওদের কাছে দাড়ায়। নীরা দুজনকে গোল গোল চোখে দেখছে। হিয়া,টিয়া নীরার অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পারে। তাই তারা দুজনেই একত্রে হেসে ওঠে। পরক্ষণে হিয়া বলে,
-“নতুন ভাবি, আমরা টুইনস। আমি হিয়া আর ও হলো টিয়া।”
নীরা এতক্ষণে বোধগম্য হয় ব্যাপারখানা। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চমৎকার হাসে। নীরার চিরল দাঁতের হাসিতে মুগ্ধ হয় হিয়া,টিয়া। একত্রে বলে ওঠে,
-“ওহ, সো সুইট।”
নীরা পুনরায় হাসে। ওদের উদ্দেশ্যে বলে,
-“বথ অফ ইউ।”
হিয়া,টিয়াকে বিদায় জানিয়ে নীরা নিজের গন্তব্যে এগোয়। তবে যতই এগোচ্ছে তার বক্ষের ধুকপুকানি বেড়েই চলেছে। কী হবে এখন আবার? রাতে যা হলো তাই বা কম কিসে। এখন আবার কিছু হলে নীরার মনটা পুনরায় ভেঙে পড়বে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হাঁটতে লাগল সে।
———-🍂
সবেই আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়ল তুরান। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। সৎবিৎ ফিরে পেতে বেশ সময় নিল। সহসা গতকালের ঘটনা মনে পড়তেই তড়িৎ গতিতে আশেপাশে নজর বুলাল সে। নিজের ঘরটাকে নিজেরই চিন্তে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এত সুন্দর সজ্জা এর আগে কখনো তার ঘরে করা হয়নি। তবে এক রাতের ব্যবধানে ফুলগুলো কেমন নেতিয়ে পড়েছে। তুরান মনে করার চেষ্টা করছে গতরাতের কথা কিন্তু ফলাফল শূন্য। ধেয়ে-পেয়ে সেই বারে যাবার আগ মূহুর্তের স্মৃতি মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে। সে বিয়ে করতে চায়নি। তার মা তাকে কসম দিয়ে গ্রামে নিয়ে যায় তারপর জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। সে তার বউয়ের মুখদর্শন পর্যন্ত করে নি। রেগেমেগে ওখান থেকে একাই গাড়ি ড্রাইভ করে চলে আসে। অতঃপর ঢুকে যায় বারে৷ ইচ্ছে মতো ম’দ্যপান করে। শেষমেশ কখন,কীভাবে বাড়ি ফেরে, তারপর কী হয় কিছুই তার মনে নেই। অধৈর্য ভঙ্গিতে যখন নিজেকে নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত তুরান ঠিক তখনই দরজার শব্দে সেদিক পানে দৃষ্টি ফেলে সে। তার কুঞ্চিত ভ্রু দ্বিগুণ কুঞ্চিত হয়। এতো এক অপরিচিত রমনী। সে এখানে, এভাবে তার ঘরে কেন? কে সে?
চলবে,
অহমিকা মুনতাহাজ নিশি