হৃদয় নিবাসে তুই পর্ব-২১

0
414

হৃদয় নিবাসে তুই
পর্ব-২১
লেখনীতেঃভূমি

ছাদের দরজার কোণে দাঁড়িয়ে এতক্ষনকার রক্তিম, রায়মান আর অদ্রিজার সবগুলো কথা শুনলেন অদ্রিজার মা।মুখেচোখে তীব্র থমথমে ভাব নিয়েই রক্তিমের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।এই ছেলেটার উপর প্রথম থেকেই সন্দেহ জম্মেছিল তার।অদ্রিজার যেদিন বিয়ে হয়েছিল ঠিক সেইদিন থেকে।নিজের স্ত্রীর মা হিসেবে রক্তিমের উচিত উনাকে মা ডাকা।কিন্তু না।সে আন্টি ডাকে।অন্যান্য পরিবারের জামাইদের সাথে যে রকম সম্পর্ক থাকে তার বিন্দুমাত্র সম্পর্কও রক্তিম কিংবা তার পরিবারের সাথে তাদের গড়ে উঠেনি।সেদিনকার অ্যালকোহলের গন্ধ, টলে টলে হাঁটা আজকের কথাগুলো শুনেই পরিষ্কার হয়ে গেল সবটা।অদ্রিজার মা থমথমে মুখ নিয়েই ছাদের দরজা থেকে সরে এসে ছাদের মেঝেতে এসে দাঁড়ালেন।অদ্রিজার হতাশ হওয়া মুখের দিকে কিছুটা সময় তাকিয়েই সামনে এগিয়ে গেলেন।মেয়ের ডান হাতটা টেনে ধরেই ভারি হাত দিয়ে বসিয়ে দিলেন এক চড়।অদ্রিজা আকস্মিক চড় সামলাতে না পেরেই কিছুটা সরে গেল।মুহুর্তেই নিজের হাতটা ডান গালে গিয়ে স্থির হলো।মায়ের দিকে তাকিযেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সে।চোখজোড়া টলমলিয়ে উঠল মুহুর্তেই।কাঁপা কন্ঠেই বলল,

‘ আ্ আম্ আম্মু।’

অদ্রিজার মায়ের মুখের কঠিন থমথমে ভাবটা কমল না।এটুকুও পরিবর্তন ঘটল না তার মুখের চাহনির। অদ্রিজার দিকে ক্ষ্রিপ্ত চাহনিতে তাকিয়েই বলে উঠলেন তিনি,

‘ এমন একটা ছেলেকে নিজের জন্য পছন্দ করেছিস তুই অদ্রি?এমন একটা ছেলেকে?মেয়েদের জীবন নষ্ট করে বেড়ানো যার অভ্যাস তুই তাকেই বিয়ে করেছিস?তোর চাচু তোর উপর বিশ্বাস করে তোর কথামতো বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিয়েছিল অদ্রি।আমিও তোকে বিশ্বাস করেছিলাম অদ্রি।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিশ্বাস করাটা উচিত হয়নি তোকে অদ্রি।’

অদ্রি সেভাবেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।বিধ্বস্ত চাহনি নিয়ে মায়ের দিকে তাকাতেই চোখের জলগুলোর বাঁধ ভাঙ্গল।মৃদু গলায় বলল,

‘ ভুল ভাবছো আম্মু।’

অদ্রিজার মায়ের চাহনি এবার আরও ক্ষ্রিপ্ত হলে।মেয়ের আরেক গালে হাত দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আবারো চড় মারলেন।কড়া গলায় বলে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে,

‘ লজ্জ্বা করছে না তোর?আবার মুখে মুখে কথা বলছিস তুই কোন সাহসে?একটা মাতাল, মেয়েবাজ ছেলেকে বিয়ে করেছিস?আমার তোর উপর বিশ্বাস করাই উচিত হয়নি অদ্রি।আর এসব নিয়ে ভুল ভাবার তো প্রশ্নই আসছে না।ওকে আমি সেইদিনই ড্রাংক অবস্থায় দেখেছি।আর রায়মানের কথা অনুযায়ী ও সারাক্ষণই মদে ডুবে থাকে বুঝা যাচ্ছে।আর রাইমা?রাইমার জীবনটাও ও নষ্ট করেছে।তাও বলবি ভুল ভাবছি?তুই তাও ঐ ছেলেটার সাথে থাকতে চাইছিস কি করে?ঐ ছেলেটার পক্ষ নিয়ে ওর কলার থেকে রায়মানের হাত ছাড়াতে উঠে পড়ে লেগেছিস।আবার আমার হাজব্যান্ড আমার হাজব্যান্ড করছিস?লজ্জ্বা লাগছে না?’

এতক্ষন মায়ের সবগুলো কথা চুপচাপ হয়ে শুনলেও এবার আর চুপ থাকতে পারল না অদ্রিজা।চোখমুখে দেখা গেল বিভৎস এক চাহনি।মায়ের কথাগুলোর একটা কথাও যে তার ভালো লাগেনি তা তার সেই চাহনিতে স্পষ্ট।অদ্রিজা বার কয়েক নিঃশ্বাস নিয়ে সেই চাহনি নিয়ে বলে উঠল,

‘ তুমি শুনোনি আম্মু? রাইমা আপু নিজেই বললেন যে উনি কখনো রাইমা আপুকে ভালোবাসেননি।ভালোবাসি ও বলেন নি।ভালবাসাটা রাইমা আপুর পক্ষ থেকে ছিল আম্মু।একটা ছেলেকে ভালোবেসে তাকে না পাওয়ার বেদনায় যদি রাইমা আপু ট্রমায় চলে যান তাহলে রক্তিমের কি দোষ?রাইমা আপুর প্রতি উনার কোন ফিলিংস নেই জেনেও যদি রাইমা আপুকে উনি ভালোবাসি বলতেন এটা কি ঠকানো হয়ে যেত না আম্মু?আর ঐ যে রাইমা আপুর বেস্টফ্রেন্ড তানিশা?তার সাথে রিলেশনে গিয়েছে এটা রাইমা আপু, রায়মান ভাইয়ার ভুল ধারণা।তানিশাকে ও ঠকায়নি রক্তিম।তানিশাকেও ভালোবাসি বলেনি।কি রাইমা আপু?রক্তিম কোনদিনও বলেছিল তানিশাকে উনি ভালোবাসেন?আর তুমি যে অত্রিসহ বাকিদের বলেছিলে রক্তিম জঘন্যতম খারাপ লোক, তোমার প্রাক্তন।কেন বলেছিলে?’

অদ্রিজা রাইমার দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন ছুড়ল।আকস্মিক প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই ভ্রু কুঁচকাল রাইমা।মৃদু গলায় বলল,

‘ আমি রক্তিমকে প্রাক্তন কখনোই বলি না অদ্রি।অত্রি ভুল ভেবেই তোকে সেইদিন প্রাক্তন বলেছিল।আমি বলিনি।আর জঘন্যতম খারাপ তো রক্তিম আমার কাছে চিরকালই ছিল অদ্রি।এক সমুদ্র ভালোবাসার পরও ও আমায় কোনদিন এটুকুও ভালোবাসা দেয় নি।এটুকুও না।তাতে এখন আর আমার আপসোস নেই।তবে ঐ সময়টুকু আমি রক্তিমকে বেশ করে চেয়েছিলাম। রক্তিমকে না পেলে যেন জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে এমন বোধ হয়েছিল আমার।নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হতো।দোষটা আমারই ছিল।আমারই।কারণ ভালোটা আমিই বেসেছিলাম।’

অদ্রিজা ছোটশ্বাস ফেলল।হৃদয়ের ভেতর জেগে উঠল তীব্র বেদনা। সেও যে এই মুহুর্তে রাইমার মতোই অবস্থায় দাঁড়িয়ে তা বুঝে উঠেই ভীষণ কান্না পেল তার।রাইমার মতো এই মানুষটাকে এখন তারও পৃথিবীর জঘন্যতম মানুষ বলে বোধ হয়।এই মানুষটাকে সেও এক সমুদ্রসমান ভালোবাসে।কিন্তু সে মানুষটা বুঝেও বারবার সেই ভালোবাসা প্রত্যাখান করেছে।বিনিময়ে ফেরত দিয়েছে অপমান আর অবহেলা।অদ্রিজা চোখের পানিগুলো মুঁছে নিয়েই মায়ের দিকে হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে তাকাল।মায়ের ক্ষ্রিপ্ত চাহনির বিন্দুমাত্র হেরফের হতে না দেখেই অসহায় কন্ঠে বলে উঠল,

‘ আম্মু?প্লিজ!উনার সাথে ডিভোর্সের কথা বলো না প্লিজ।’

অদ্রিজার মা তার অসহায় ভাবে বলা কথাগুলোর এটুকুও গুরুত্ব দিল না।স্পষ্টভাবে বলে বসলেন,

‘ ঐ ছেলেটাকে আমি মানব না তোর স্বামী হিসেবে।আমি চাই না একটা মাতালের সাথে তুই সংসার কর অদ্রি।আজ যদি ঐ ছেলেটার সাথে তোর ছাড়াছাড়ি না হয় তো তুই জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে খুব পস্তাবি অদ্রি।আমি চাই না তুই জীবনের কোন সময় কষ্ট পাস।আমি তোদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করব।খুব শীঘ্রই।’

অদ্রিজার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল যেন মুহুর্তেই।মাথা ফাঁকাফাঁকা লাগল। ঝাপসা চোখজোড়া নিয়ে একবার মায়ের দিকে তো একবার রক্তিমের দিকে তাকাল সে।রক্তিমের মুখে তখন বিশ্বজয়ী হাসি।যেন এটাই চেয়েছিল সে, এটা হলেই সে মহাখুশি।অদ্রিজা হতাশ হলো।নিজের ভেতরটা কেমন ঘোলা হয়ে উঠল তার।হাত পা কাঁপছে।একমুহুর্তও যেন সেখানে দাঁড়ানোর শক্তি পেল না সে।ধপ করে ছাদের খসখসে মেঝেতে বসে পড়ল।তা দেখেই রক্তিম এগিয়ে আসল। অদ্রিজার মায়ের কাছাকাছি দাঁড়িয়েই মুচকি হেসে বলল,

‘ ডিভোর্সটা ছয়মাসের মধ্যে হয়ে যাবে আন্টি।এপ্লাই অনেক আগে করা আছে।’

অদ্রিজার মা অবাক হলো রক্তিমের কথা শুনে।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে তীক্ষ্ণ চাহনিতে রক্তিমের দিকে তাকাতেই রক্তিম আবারও বলল,

‘ আপনি সত্যিই বলেছেন আন্টি।অদ্রিজাকে কোন এক সময খুব করে পস্তাতে হবে যদি ও আমার সাথেই থাকে।আমিও চাই না ও কোনসময় কষ্ট পাক।ওর জন্য আমার থেকেও হাজারগুণ ভালো একজনকে বেঁছে নিবেন প্লিজ।যত দ্রুত সম্ভব ওর জীবনটা অন্য কারোর সাথে বেঁধে দিন আন্টি।আমি বা আমাদের বিয়েটা তাতে কোন প্রভাব ফেলবে না।কোন বাঁধাই দেবে না।’

অদ্রিজা রাগে হিংস্র চাহনিতে তাকাল রক্তিমের দিকে।এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো মাকে বিয়ের পেছনের রহস্যটা বলে দেওয়া উচিত।কিন্তু পরক্ষনেই আবার চুপ হয়ে গেল।মায়ের উপরের অভিমানটা রক্তিমের উপর গিয়ে ভীড় করল।জম্মাল সমুদ্র সমান ক্ষোভ।যখন তাকে তার জীবন থেকে তাড়ানোর এতই তাড়া তবে বিয়েটা কেন করেছিল?কেন তার মনে ভালোবাসার অনুভূতির জম্ম দিল?কেন? অদ্রিজা রাগে কাঁপতে লাগল।গালজোড়ায় তার মায়ের আঙ্গুলের স্পষ্ট লালচে ছাপ।চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে আছে।সেই লাল টকটকে চোখজোড়া দিয়েই অনবরত গড়িয়ে চলছে নোনতা পানি।বিধ্বস্ত অবস্থায় তুলতুলে লতানো শরীরটা নিয়ে সেভাবেই পড়ে রইল ছাদের মেঝেতে। রক্তিম হালকা হাসল।অন্যদিনকার মতো অতোটা চাঞ্চল্যকর ছিল না হাসি টা।হয়তো কিছুটা বেদনাও মিশ্রিত ছিল।অদ্রিজার সামনে এসেই হাঁটু গেড়ে বসল সে।অদ্রিজার গালের লালচে ছাপ গুলোতে আলতোভাবে হাত বুলিয়েই ফিসফিসিয়ে শান্ত গলায় বলল,

‘ আ’ম স্যরি অদ্রিজা।অ’ম এক্সট্রেমলি স্যরি অদ্রিজা।আমার প্রতি কেন এতটা বিশ্বাস আপনার?কেন এত বিশ্বাস করেন?ভালোবাসেন?আমার সাথে পথ চলা অনেক কাছের মানুষও আমায় এতটুকু বিশ্বাস করে নি অদ্রিজা। অথচ আপনি আমায় ঘৃণা করেও বিশ্বাস করছেন?রাইমা আর তানিশাকে আমি ঠকায়নি তা আপনি যতটুকু বিশ্বাস করলেন আমার কাছের বন্ধুটাও ততটুকু করে নি অদ্রিজা।ভালোবাসেন আমায়?আপনি আমায় ভালোবাসলে আমি রাইমা কিংবা তানিশার মতো আপনাকে বলব না, আপনাকে নিয়ে আমার কোন ফিলিংস নেই। তবে আমি আপনাকে আমার জীবনেও জড়াতে পারব না অদ্রিজা।আমি আবারও একটা নারীকে ফিরিয়ে দিচ্ছি।আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি অদ্রিজা।ভালো থাকবেন।এই অসহায় মানুষটি আপনার জীবনের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে।তার জন্য ক্ষমা করে দেবেন আমায় অদ্রিজা।সে রাতটাকে ভুলে যাবেন প্লিজ!নতুন করে জীবনটাকে শুরু করবেন।নতুন ভাবে বাঁচবেন।আমি আর কখনো আপনার সামনে আসব না, দেখা করব না।আমায় ভুলতে সহজ হবে তাহলে আপনার। বলুন?’

অদ্রিজা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল রক্তিমের দিকে।রক্তিমের শান্ত গলায় বলা কথাগুলো শুনেই ভেতরে অনুভূত হলো অন্য রকম বেদনা।সঙ্গে সঙ্গে তপ্তশ্বাস ফেলল সে।রক্তিমের বলা কথাগুলোতে লুকোনো বিরহ অনুভব করেই ভ্রু কুঁচকাল। কয়েক সেকেন্ড সেভাবে তাকিয়েই মৃদু গলায় বলল,

‘ আপনি ফিরিয়ে দিলেও আমি আপনাকে ছাড়ব না রক্তিম। ভুলব ও না।’

‘ ছাড়তে বাধ্য আপনি অদ্রিজা।’

কথাটা গম্ভীর কন্ঠে বলেই রক্তিম পা বাড়াল।অদ্রিজা সরু চাহনিতে চেয়ে রইল সেদিকে।সত্যিই কি ছাড়তে বাধ্য সে?কোন একদিন রক্তিম নামক মানুষটার প্রতি সদ্য জম্মানো অনুভূতিগুলো কি সে ভুলে বসবে?কোন একদিন রক্তিম নামক আস্ত মানুষটা কি কেবলই তার স্মৃতির পাতায় থাকবে?না!রক্তিমকে বলবে সে,তার কতটুকু অনুভূতি তাকে ঘিরে আছে।কতটুকু অস্থিরতা কাজ করে তার ভেতর রক্তিমের অনুপস্থিতিতে। কতটুকু অভিমান হয়। সবটাই বলবে সে রক্তিমকে।যদি রক্তিম কাছে টেনে নেয়।যদি রক্তিম ও বলে, সেও তাকে ভালোবাসে?অদ্রিজা কেঁপে উঠল এসব ভেবেই।নিজের মায়ের কথা মনে পড়তেই শিউরে উঠল।কি হবে রক্তিমকে ভালোবেসে? রক্তিমের সাথে তো একসাথে থাকা হবে না।তার মা যখন বলেছে তখন নিশ্চয় রক্তিম আর অদ্রিজার ছাড়াছাড়িটা হয়ে যাবে।মায়ের কঠিন নির্দেশনা সম্পর্কে তার অনেক আগে থেকেই ধারণা আছে।এই কঠিন নির্দেশনাও ভাঙ্গা যেত যদি রক্তিম তাকে ভালোবাসত।কিন্তু মায়ের আদেশ না মেনে কার কাছেই বা যাবে সে?রক্তিম তো নিজেই এই সম্পর্ক ভাঙ্গার দায়িত্ব নিয়েছে।।টলমলে চাহনিতে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটা লোকের দিকে তাকাল অদ্রিজা।মাথাটা ঘুরিয়ে উঠল যেন একমুহুর্তের জন্য।ঝাপসা হয়ে আসল দৃষ্টি।মস্তিষ্ক কেবল একটা কথায় ভাবতে লাগল, তার মা যখন বলেছে ছাড়াছাড়ি হবে তখন ছাড়াছাড়ি হয়েই যাবে।শরীরটা নেতিয়ে আসল এবার।বুঝতে পারল ধীরে ধীরে সে জ্ঞান হারাচ্ছে।

.

জ্ঞান ফেরার পর যখন চোখ খুলল অদ্রিজা তখন বিকাল।আকাশে সূর্য ডুবুডুবু।জ্ঞান ফেরার পর থেকেই রক্তিমকে হাজার বার কল দিয়েছে সে।নিজের নাম্বার থেকে কল ডুকছে না দেখেই অত্রিয়ার মোবাইল থেকে কল দিল।প্রথমবার রিসিভড করেই গম্ভীর গলায় ওপাশ থেকে পুরুষালি গলায় বলল কেউ,”হ্যালো।” এরপর যখন অদ্রিজা কথা বলল তখন সাথে সাথেই কল কেটে গেল।তারপর আর কল ডুকে নি রক্তিমের নাম্বারে।রক্তিমের ব্লকলিস্টে তার নাম্বার বুঝতে পেরেই মাথা চেপে ধরল সে।রক্তিমের থেকে শেষ জবাবটা নিতেই হবে তাকে।শেষবারের জন্য হলেও একবার রক্তিমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। জিজ্ঞেস করতে হবে, কিসের এত বাঁধা তাকে গ্রহণ করতে? কিসের এত বাঁধা তাকে ভালোবাসতে?অদ্রিজা বুঝল না।সিদ্ধান্ত নিল রক্তিমের কাছে যাবে।কিন্তু রক্তিমের বাবার বাসার ঠিকানা জানলেও রক্তিমের বাসার ঠিকানা যে তার জানা নেই।অদ্রিজা বার কয়েক নিঃশ্বাস নিল। নেহাকে কল দিয়েই আসতে বলল দ্রুত।আধঘন্টার মধ্যে নেহা চলেও আসল।অদ্রিজা এলোমেলো চুল, অগোছাল সাঁজ নিয়ে সেভাবেই নেহার সাথে বের হলো।নেহা বুঝল অদ্রিজার অবস্থাটা।দিহান আর অদ্রিজাকে নিয়ে মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্ন থাকলেও অদ্রিজাকে দুই হাতে আগলে নিল সে।লতানো শরীরেটাকে রিক্সায় নিজের সাথে আঁকড়ে ধরেই অন্যদিকে তাকাল।ভালোবাসা গুলো বড্ড অদ্ভুত!আত্নসম্মানের জন্য কখনো মাথা না নোওয়ানো মেয়েটাও আজ ভালোবাসার জন্য নেতিয়ে আছে কেমন।কেমন বিধ্বস্ত বেশ!প্রখর আত্নসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা মেয়েটাও ভালোবাসার জন্য পাগলামি করে।সত্যিই অদ্ভুত!

.

রক্তিমদের বাসার সামনে এসেই বার কয়েক কলিংবেল বাঁজাতে দরজা খুলল রক্তিমের সুইটহার্ট।সাদা পাকা চুল, কুচকানো চামড়ায় ভিন্ন রকম সুন্দর বোধ হলো সুইটহার্টকে।অদ্রিজা হালকা হাসল।সাদা মসৃন শাড়ি পরিহিত সুইটহার্টের দিকে তাকিয়েই বলে বসল,

‘ কেমন আছো সুইটহার্ট?’

সুইটহার্ট চমকে তাকাল।ভালোভাবে অদ্রিজাকে পরখ করল।স্পষ্ট মনে আছে এই মেয়েটির নাম অদ্রি। তার জম্মদিনে এই মেয়েটি তাকে তুমি কিংবা সুইটহার্ট সম্বোধন করে নি তাও মনে আছে।তাকে সুইটহার্ট কেবল রক্তিমই ডাকে। তাই আরো বেশি চমকাল।চোখেমুখে বিস্ময় নিয়েই বলে উঠল,

‘ নেহা?অদ্রি?আমায় সুইটহার্ট কেন ডাকছো অদ্রি?’

অদ্রিজা মুচকি হাসল।রক্তিমের মতোই চোখ টিপে বাঁকা হেসে বলল,

‘ তুমিই তো আমার সুইটহার্ট। একমাত্র কলিজা। ‘

সুইটহার্ট হালকা হাসল।অদ্রিজা যে ফ্লার্ট করছে তা বুঝেই ঠোঁট টিপে হাসল। দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়েই বলল,

‘ ভেতরে আসো। হঠাৎ আমার কাছে?কি মনে করে?’

নেহা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল কেবল।অদ্রিজা আগের মতোই হেসে বলল,

‘ তোমার প্রেমিক আমায় ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে এসেছে।তাকে খুঁজতে এসেছি।তার গর্হিত অপরাধের শাস্তি পেতেই হবে তাকে।তার অপরাধের স্বীকারোক্তিও দিতে হবে।’

সুইটহার্ট ব্রু জোড়া কুঁচকে নিল।দ্বিধান্বিত চাহনিতে তাকিয়েই বলল,

‘ দাদুভাইয়ের কথা বলছো তুমি?’

অদ্রিজা ঠোঁট চেপে হাসল।বলল,

‘ হ্যাঁ।হ্যাঁ।তার কথায় বলছি।কোথায় সে?’

‘ ও একটু ঘুমিয়েছে। এখন না কথা বললেই কি নয়?দাদুভাই আজ অনেক বেশিই আঘাত পেয়েছে বোধ হয় কারো থেকে।কান্নাও করেছিল বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে।আমি ওকে অনেক কষ্টেই ঘুম পাড়িয়েছি।জানি না কি হয়েছে।বড় হওয়ার পর আমি দাদুভাইকে কখনো কাঁদতে দেখিনি। কিন্তু আজ কেঁদেছে ও।নিশ্চয় কিছু ঘটেছে।ঘুম থেকে উঠলে জানতে পারব।’

অদ্রিজা কপাল কুঁচকাল। বলল,

‘ উনি কেঁদেছেন?কেন?’

‘ সেটা তো তখন বলে নি।ঘুম থেকে উঠলে বলবে নিশ্চয়।’

অদ্রিজা মৃদু শ্বাস ফেলেই ঠোঁট ভেজাল।বলল,

‘ উনার সাথে একবার কথা বলব সুইহার্ট।শুধু একবার।একটা কথা জানতে চেয়েই আমি চলে যাব।আর কোনদিনই আসব না আমি উনার কাছে।উনার রুমটা দেখিয়ে দেবে? একবার কথা বলে চলে যাব আমি।’

সুইটহার্ট হালকা হাসল।রক্তিমের রুমটা দেখিয়ে দিয়েই সোফায় গিয়ে বসল।নেহাও তার পাশে গিয়ে বসল।আর অদ্রিজা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল রুমটার দিকে। দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কাঁপা হাতে দরজা ঠেলেই বিছানায় পড়ে থাকা নিষ্পাপ মুখটা চোখে পড়ল।বালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।অদ্রিজা এগিয়ে গেল।বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েই হাঁটু ঘেষে বসল।ঘন পাঁপড়ি ওয়ালা চোখজোড়া আর ঘুমন্ত চেহারাটা দেখে নিয়েই হাতটা এগিয়ে দিল রক্তিমের ঘুমন্ত মুখে।আঙ্গুল দিয়ে বুলিয়ে দিয়ে কপালে ঠোঁটজোড়া ছোঁয়াতে রক্তিম নড়ে উঠল।চোখজোড়া বন্ধ রেখে ঘুম জড়ানো কন্ঠেই করুণ স্বরে বলল,

‘ সুইটহার্ট মাথা ব্যাথাটা কমেনি এখনো।ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে মাথাটা।ডক্টরকে একটা কল দিবে প্লিজ?’

অদ্রিজা ভ্রু কুঁচকাল।বার কয়েক ঢোক গিলে রক্তিমের থেকে সরল।কিছু বুঝে না উঠেই রক্তিমের দিকে তাকিয়ে থাকতেই রক্তিম আারও নড়েচড়ে উঠল।হাতজোড়া দিয়ে মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরেই এপাশ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে উঠে বসল।চোখ মেলে অদ্রিজাকে দেখেই চমকে গেল সে।বিস্ময় নিয়েই বলে উঠল,

‘ আপনি?এখানে?’

অদ্রিজা মাথা তুলে চাইল।শুকনো ঢোক গিলেই কঠিন কন্ঠে বলল,

‘ আপনার আমার সম্পর্ক তো শেষ হয়েই যাবে রক্তিম।আপনি নিজেই সে দায়িত্ব নিয়েছেন বলে কথা।একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন?এরপর আর কিছু জানতে চাইব না আমি। উত্তর দিবেন?’

রক্তিম সোজা হয়ে বসল।গম্ভীর গলায় শুধাল,

‘ বলুন।’

অদ্রিজা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজাল। মৃদু গলায় বলে উঠল,

‘ আপনিই তো বলেছেন অন্যদের মতো আমায় আপনি এটা বলবেন না যে, আমার প্রতি আপনার কোন ফিলিংস নেই?তার মানে আমায় নিয়ে আপনার ফিলিংস আছে রক্তিম?তাহলে কেন আমায় দূরে রাখতে চান?কেন সম্পর্কটা ভাঙ্গতেই চান আপনি?’

রক্তিম ছোট্ট শ্বাস ফেলল। কঠিন কন্ঠে বলল,

‘ উত্তরটা শুনেই বেরিয়ে যাবেন এই বাসা থেকে।আমি আপনাকে বলেছিলাম না সুইটহার্টকে আমার- আপনার বিষয়ে আমি কিছু বলিনি।তাও কেন এসেছেন আপনি?সুইটহার্টের মনে নিশ্চয় এখন অনেক প্রশ্ন খেলছে।বারবার বেহায়ার মতো একটা ছেলেকে ভালোবাসেন তা বুঝাতে কেন চাইছেন আপনি?নিজের আত্নসম্মান বলতে কি কিছু নেই আপনার অদ্রিজা?একটা ছেলে আপনাকে দূরে সরাতে চাইছে, আপনার সাথে সম্পর্কটা রাখতে চাইছে না তবুও আপনি তার পেছনেই পড়ে আছেন।তার কথা শুনেই আবেগে আপ্লুত হয়ে যাচ্ছেন।কেন?’

অদ্রিজা অস্ফুট স্বরেই বলল,

‘ কারণ ভালোবাসি।’

রক্তিম তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল,

‘ এই কারনেই আমি আপনার সাথে সম্পর্কটা রাখতে চাইছি না অদ্রিজা।তখন আপনার সেই বিধ্বস্ত চাহনি দেখে আবেগে ভেসে গিয়েই হয়তো বলেছিলাম ঐ কথাটা।তাছাড়া একটা মানুষের প্রতি সামান্য ফিলিংস জম্মালেই ভালোবাসা হয়ে যায় না।আমি তখন আপনার সেই অবস্খা দেখে সহানুভূতি দেখিয়ে কথাটা বলেছিলাম।পেয়ে গেছেন উত্তর?এবার চলে যান।বেহায়ার মতো আর কোনদিন আমার সামনে আসবেন না অদ্রিজা।’

অদ্রিজা কাঁটকাঁট চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইল।সত্যিই কি তখনকার কথা গুলো কেবল সহানুভূতি ছিল?কেবল?হয়তো।রক্তিম তাকে ভালোবাসবেই বা কেন? সে ও তো কেবল শর্ত মানার জন্যই বিয়েটা করেছিল।অদ্রিজা তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল।রক্তিমকে আর কখনো মনে করবে না এমনটাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল।তীব্র ঘৃণা নিয়ে পা এগিয়ে বেরিয়ে আসল সেখান থেকে।রক্তিমের দিকে একবারও ঘুরে তাকাল না।তাকানো কি আদৌ উচিত?যে মানুষটার সাথে থাকার জন্য তার এত আকুতি সেই মানুষটাই বারবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।এবার কি নিজের আত্নসম্মানটাকে জয় করার পালা না?আর কত বেহায়া সাজবে এই মানুষটার কাছে?মানুষটা তো ভালোবাসে নি তাকে!

চলবে…..