হৃদয় নিবাসে তুই পর্ব-৩০

0
410

হৃদয় নিবাসে তুই
পর্ব-৩০
লেখনীতেঃভূমি

আয়নায় স্পষ্ট হয়ে ফুটল লাবণ্যময়ী শরীরটার প্রতিবিম্ব।মোমের মতো সাদা ধবধবে কোমল শরীরটায় আজ গাঢ় সবুজ রংয়ের শাড়ি মোড়ানো।সদ্য ভেজা লম্বা চুলগুলো কাঁধের একপাশ দিয়ে এনে সামনে রাখা।কোমড় পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পানির ঝাপটায় শাড়ির একাংশ ভিজিয়ে তুলল মুহুর্তেই সেই ভেজা চুল।পেটের দিকে আঁচলটা ভিজে গিয়েই লেপ্টে বসল কোমল ত্বকে।অদ্রিজা ভ্রু কুঁচকে চাইল।চুলগুলো তৎক্ষনাৎ হাত দিয়ে সরিয়ে পেঁছনে ফেলেই পেটের আঁচলটা তুলে ঝাড়া দিতেই কেউ একজন নিঃশব্দে হাসল।অদ্রিজা বুঝল না।হাত দিয়ে আঁচলটা হালকা ঝেড়েই তোয়ালে নিয়ে ভেজা চুলগুলো মুঁছড়ে নিবে ঠিক তখনই কেউ এসে তার পেছনে দাঁড়াল।হাতজোড়া বুকে ভাজ করেই মোহনীয় চাহনিতে তাকিয়ে রইল সামনের লাবন্যময়ী মেয়েটির দিকে।ভেজা কালো চুলে চোখমুখে স্নিগ্ধতার আভাস যেন তার ভেতরটা মাতাল করে তুলল মুহুর্তেই।ফর্সা দুধে আলতা সাদা রংয়ের মুখশ্রীতে ঘন পাঁপড়ি ওয়ালা কালো চোখ।চিকন পাতলা খয়েরী ঠোঁটে আদ্র ভাব।রক্তিম মৃদু হাসল।অদ্রিজার হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে নিয়েই ঘোর লাগানো কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

‘ এভাবে নিজের রূপে ঘায়েল করার বুদ্ধিটা কিন্তু চমৎকার আপনার!একটা মানুষকে এভাবে কন্ট্রোললেস করে দেওয়ার প্ল্যান কিন্তু একেবারেই করা উচিত হয়নি আপনার।’

অদ্রিজা চমকে তাকাল।কথাগুলো শুনেই পেছন ফিরে রক্তিমের চোখের দিকে তাকাতে গিয়েই নড়েচড়ে উঠল ভেতরটা।চোখাচোখি চোখ রাখতে না পেরে অস্বস্তিতে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল সে।কন্ঠটা কঠিন রাখার চেষ্টা করেই ঠোঁট চেপে বলে উঠল,

‘ আশ্চর্য!একটা মেয়ে রুমের ভেতর কি করছে না করছে না জেনে, নক না করেই ভেতরে ডুকে গেলেন কেন?অদ্ভুত!’

রক্তিম গা জ্বালানো হাসি হাসল।মৃদু শ্বাস ফেলেই চোখ টিপে বলল,

‘ রুমের ভেতর অতিশয় লাবণ্যময়ী, রূপবতী কেউ থাকলে তাকে দেখার লোভ সংবরন করা বড্ড দায়। ধরে নিন আমিও সেই কারণেই নক না করে ডুকে পড়লাম।তাছাড়া অন্য কারো রুমে তো ডুকিনি।তাই না?’

অদ্রিজা রাগল।রাগে হাঁসফাঁস করেই তীর্যক চাহনিতে তাকিয়ে রইল রক্তিমের দিকে। বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘ ফ্লার্টিং করবেন না একদম!’

রক্তিম আওয়াজ করে হাসল।ফর্সা ধবধবে রং, খাড়া নাক, বড়বড় চোখ আর খোঁচা দাড়িওয়ালা মুখে সেই হাসিটা চমৎকার মানাল।ট্যারাব্যাঁকা দাঁত গুলো অবাক রকম সুন্দর!অদ্রিজা আড়চোখে সেই হাসিটা পরখ করতেই ধরা খেয়ে বসল রক্তিমের চোখের দৃষ্টিতে। মুহুর্তেই দৃষ্টি সরিয়ে ইতস্থত বোধ করে এদিক ওদিক তাকাল।মৃদু শ্বাস ফেলে কিছু বলবে তার আগেই রক্তিম বলে উঠল,

‘ উহ!আমি জানি আমার হাসিটা মেয়েদের ভীষণ প্রিয়।আপনি চাইলে সরাসরিই তাকিয়ে থাকতে পারেন অদ্রিজা।নো প্রবলেম।’

অদ্রিজা চোখ বড়বড় করে চাইল।চোখেমুখে ফুটে উঠল তীব্র হতাশা।এইভাবে ধরা খেয়ে বসবে জানলে তাকাতই না সে রক্তিমের হাসির দিকে।ইশশ!অদ্রিজা চোখজোড়া একবার বন্ধ করেই আবার খুলল। বার কয়েক নিঃশ্বাস ফেলেই বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘ আমি কেন তাকাতে যাব?আশ্চর্য! ‘

রক্তিম মুচকি হাসল।অদ্রিজাকে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ঝুকে দাঁড়াল।থুতনিটা অদ্রিজার কাঁধে রেখেই আয়নায় পরখ করল অদ্রিজা নামক রমণীটিকে।সৌন্দর্যে নুইয়ে থাকা রমণীটির চোখেমুখে মিশ্র রকম অনুভূতির প্রতিচ্ছবি।সেই অনুভূতিতে যেমন রাগ, তেমনই লজ্জ্বা, আবার তেমনই বিরক্তি উপস্থিত।কৈাতুহল ও আছে বোধ হয়।ঠোঁট চেপে হেসেই অদ্রিজার ভেজা চুলে নাক ডুবাল রক্তিম।চোখমুখ সেই ভেজা চুলের ধাপটে ভিজে উঠতেই নেশাময় হয়ে উঠল তার ভেতরটা।ঠোঁট দিয়ে অদ্রিজার কাঁধে স্লাইড করতে করতেই নাক ঘষল।শ্বাস প্রশ্বাস গুলো উষ্ণ ছোঁয়া উপছে দিল অদ্রিজার পাতলা চামড়ার উপর।সেই ছোঁয়া, স্পর্ষ, শ্বাস প্রশ্বাসের তাড়নায় ভীষণরকম কেঁপে উঠল অদ্রিজা।পুরুষটাকে ফিরিয়ে না দিতে পেরেই ব্যর্থ মন ক্ষনে ক্ষনে শিউরে উঠল।হাত জোড়া খামচে নিল শাড়ির আঁচল।পায়ের আঙ্গুল গুলো খামচে ধরলো ফ্লোর।পুরো শরীর অদ্ভুত শিহরনে কাঁপতে লাগল। রক্তিম মুচকি হাসল। ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ এত সহজেই নুঁইয়ে যাচ্ছেন? লজ্জ্বায় লাল হয়ে যাচ্ছেন?উফফস!আমি তো এবার সত্যিই কন্ট্রোল করতে পারব না নিজেকে।’

অদ্রিজা চমকাল।আয়নায় তাকিয়ে পরখ করল লজ্জ্বায় লাল হয়ে উঠেছে তার মুখ চোখ। চোখেমুখে রাগ ক্ষোভের সেই রেশ না দেখেই হতাশ হলো সে।মুখ চেখে কঠিন কঠিন ভাব এনেই দাঁতে দাঁত চেপেই জড়ানো গলায় বলে উঠল,

‘ ক্ কি হচ্ছে কি এসব?ছাড়ুন আমায় রক্তিম।আমি আপনাকে নিষেধ করেছিলাম এভাবে অনুমতি না নিয়ে আমাকে ছুঁতে।’

অদ্রিজার সেই কথাকে বিন্দুমাত্রও পাত্তা দিল বলে মনে হলো না রক্তিম।মুখে তার বাঁকা হাসি স্থির।আয়নায় সেই বাঁকা হাসিটা দেখেই শরীর জ্বলে উঠল অদ্রিজার।চোখে মুখে তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে থাকার মাঝেই রক্তিম আয়নায় তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়েই ঠোঁট কাঁমড়ে অদ্ভুত রকম হাসল।হাতজোড়া অদ্রিজার ভেজা চুলের ধাপটে ভিজে উঠা আদ্র শাড়ির ভাজে ডুকিয়েই পেটের ভেজা পাতলা চামড়ায় ছুঁয়ে দিতেই অদ্রিজার শরীরের কম্পন আকস্মিক ভাবে বাড়ল।তার ছোট্ট কোমল শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছুঁয়ে গেল শীতল চামড়ায় উষ্ণ হাতের সেই ছোঁয়া।দাঁতে দাঁতে চেপে চোখজোড়া বন্ধ করেই রক্তিমের হাতজোড়া নিজের হাতজোড়া দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল সে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস আর বুকের ভেতর দ্বিগুণ স্পন্দনে কেঁপে উঠা হৃদপিন্ডকে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়েই রক্তিমের হাতজোড়া ছাড়িয়ে দ্রুত সরে দাঁড়াল।যুদ্ধ থেকে লড়ে আসা সৈনিকের ন্যায় চোখেমুখে তীব্র ক্লান্তি ফুটিয়েই চোখ ছোট ছোট করে চাইল রক্তিমের দিকে।রক্তিমের মুখে তখনও দুষ্টুমিমাখা হাসির রেশ।অদ্রিজা সেই হাসি দেখে চটাফট কঠিন কন্ঠে কিছু বলে উঠতে পারল না।হাত পা এখন ও মৃদু কাঁপছে।হৃদপিন্ডের স্পন্দন এখনও দ্রুত গতিতে চলছে।রক্ত গুলো এখনও দ্বিগুণ বেগে শিরায় উপশিরায় বয়ে চলছে।নিজেকে স্থির করার চেষ্টায় বেশ কিছুটা সময় চুপ রইল অদ্রিজা।রক্তিম মুখে হাসির রেশটা দ্বিগুণ করেই বলে উঠল,

‘ এটুকুতেই আমার কাছে হার মেনে গেলেন?লজ্জ্বায় লাল হয়ে বুঝিয়ে দিলেন আপনি আমায় ভালোবাসেন?চমৎকার!এমনটা জানলে আরো আগেই এসব টেকনিক খাটাতাম।সুন্দর না? ‘

অদ্রিজা মিনমিনিয়ে চাইল।জোরে জোরে শ্বাস ফেলেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘ সমস্যা কি আপনার?সকাল সকাল আমার সাথে কি শুরু করে দিয়েছেন?আপনার কাছে তো এক মুহুর্তও নিরাপদ থাকব বলে বোধ হচ্ছে না। আমি এক্ষুনিই আম্মুদের কাছে যাব।’

‘ সুইটহার্ট বলে দিয়েছে আপনি এখানে থাকবেন।সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি ডিসাইড করেছি আমার ওয়াইফ আমার সাথে থাকবে।এবার আমি শতবার চান নয়তো হাজার বার চান এখানে থেকে পালানো আপনার জন্য রিস্কি।আমার থেকে পালানো আপনার জন্য আরো রিস্কি! চরম রকম ডেঞ্জারাস।মাইন্ড ইট!’

অদ্রিজা কপাল কুঁচকাল।রক্তিমের কথা গুলো শুনেই বিরক্তে রি রি করে উঠল শরীর মন।হাতজোড়া মাথায় নিয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল পেঁচিয়েই রক্তিমের দিকে তাকাল সে।তাচ্ছিল্য নিয়ে কৃত্রিম হেসেই বলে উঠল,

‘পালাব কেন আমি? আমি কি আসামী?আমি সসম্মানে এই বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে যাব।আজই!কি করবেন?’

‘আগে গিয়ে তো দেখান। তারপর না হয় বুঝা যাবে কি করা যায়, কি করা উচিত।তবে যাই করি, শাস্তিটা আপনার জন্য খুব একটা ভালো হবে না অদ্রিজা।’

কথাটা বলেই ঠোঁট টেনে হেসে বেরিয়ে গেল রক্তিম। অদ্রিজা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।চোখমুখ কুঁচকে রক্তিমের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থেকে বিরক্তি নিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ল।ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা ধপ করে লাগাতে নিতেই রক্তিমের মুখটা আবারও ভেসে উঠল মুখের সামনে।মুখে চমৎকার হাসি ফুটিয়েই হালকা ঝুকে চোখ টিপে বলল,

‘ ভয় নেই!শাস্তিগুলো আজকের মতোই হবে।আজকের শাস্তিটা কি জন্য দেওয়া হলো জানেন?সকাল সকাল শাড়ি পরে নিজের সৌন্দর্যে বিমোহিত করার ফাঁদ পাতার জন্য এই শাস্তি।পরবর্তীতেও ভুল করবেন তো এমন শাস্তি গুলোই কপালে আছে ভেবে নিবেন।আর ভদ্র মেয়ে হয়ে থাকলে তো নো প্রবলেম।’

অদ্রিজা বিরক্তে চোখ মুখ লাল করল। রক্তিমের কথা গুলোতে চরম বিরক্তি দেখিয়েই মুখের উপর আওয়াজ করে দরজা লাগাল।রাগে ফোঁসফাসঁ করে দরজা লাগিয়ে হেলান দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসল রক্তিমের হাসির আওয়াজ!অদ্ভুত!এই লোকটা এত কেন হাসে? এত কেন হাসিখুশি!

.

পার্কে তরতাজা রোদ।কাঠের বেঞ্চিগুলোর একপাশে নেহা। অন্যপাশে দিহান বসা।দিহানের হাতে সাদা কাগজের উপস্থিতি স্পষ্ট।নেহা ভ্রু কুঁচকে সেই কাগজগুলোর দিকে তাকাল।খিলখিলিয়ে হেসেই প্রশ্ন ছুড়ল দ্রুত,

‘ কিরে? কিসের কাগজ ওসব?’

দিহান মাথা তুলে চাইল।মাথার উপর সূর্যের তীর্যক রোদে ঘেমে একাকার হয়ে উঠল পরনের চেইকের শার্টটা।একহাতের তালুতে কপালের ঘামটা মুঁছে নিয়েই ম্লান হাসল দিহান।মৃদু গলায় বলল,

‘ শিট।’

নেহা হাসল।ঠোঁট উল্টে বলল,

‘ আমি আরো ভাবলাম তুই আমার জন্য প্রেমপত্র নিয়ে হাজির হয়েছিস কিনা।ভয় পেয়ে যদি আমার প্রাপ্য প্রেমপত্র আমার হাত পর্যন্ত না পৌঁছে দিস তাই চটফট জিজ্ঞেস করে বসলাম কিন্তু ওটা তো প্রেমপত্র নয় আমার শত্রু পড়ালেখার পত্র।চরম রকম ডস খেলাম!’

দিহান হাসল।রোদের উত্তাপে মুখচোখ কালো করেই বলল,

‘ প্রেমপত্র দেওয়ার সাহস আছে আমার।সময় আসলে ঠিক দিয়ে দিব।’

নেহা ক্লান্ত গলায় বলল,

‘ অপেক্ষায় রইলাম সেইদিনের যেইদিন তুই প্রেমপত্র গুঁজে দিবি আমার হাতে।হাতে হাত ছুঁয়ে বলে দিবি ভালোবাসি।আমি সেইদিনের অপেক্ষায় আছি।খুব বাজে ভাবে অপেক্ষা করছি সেই দিনটার জন্য।তাত্তাড়ি বলে ফেল তো বেইব!’

দিহান ফিক করে হাসল।এই মেয়েটাকে বুঝে উঠা দায়।এই সিরিয়াস আবার এই মজা।এই মনে হয় তার কথায় হাজারটা দুঃখ আবার এই মনে হয় তার কথার মতো প্রানোচ্ছ্বল কথা আর হতেই পারে না।দিহান হেসেই নেহার দিকে চাইল।চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বলে উঠল,

‘ এত কিসের তাড়া?তাড়াহুড়ো করে কোনকিছু করা ভালে নয়।জানিস না?’

নেহা খিলখিলিয়ে হাসল।দিহানের দিকে তাকিয়েই চোখ টিপে বলণ,

‘ ধুররর!তুই জানিস না?শুভ কাজে দেরি করতে নেই?’

দিহান আওয়াজ করে হেসে উঠল এবার।সঙ্গে হাসল নেহাও।পার্কের উজ্জ্বল উত্তপ্ত রোদে কাঠের বেঞ্চিতে একজোড়া ভালোবাসার মানুষ হৃদয় থেকে হেসে উঠল।দুইজন দুইজনের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে।এর থেকে ভালো দৃশ্য আছে কি আর?

চলবে….