হৃদয় নিবাসে তুই পর্ব-৩৮ অন্তিম পর্ব

0
667

হৃদয় নিবাসে তুই
অন্তিম পর্ব
লেখনীতেঃভূমি

‘ বেবিটা আপনার ওয়াইফের অসতর্কতা বশত চলাফেরার জন্য অল্পের জন্য নিজের অস্তিত্ব হারায়নি মিঃ রক্তিম মাহমুদ।তবে একেবারেই যে বেবিটাকে নিয়ে ভয় কেঁটে গিয়েছে তা একদমই নয়।উনার পেট ব্যাথা সহ আরও বিভিন্ন প্রবলেম হতে পারে প্র্যাগনেন্সির সময়টাতে।বাচ্চাটা মিসক্যারেজও হতে পারে।উনাকে সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে বলবেন।আর হ্যাঁ, নিয়মিত ঔষুধ আর একদমই রেস্টে থাকতে বলবেন।আশা করি নিজেদের ভবিষ্যৎ বেবির কথা ভেবে এইটুকু অবশ্যই মেনে চলবেন।রাইট?’

রক্তিম হালকা হাসার চেষ্টা করল।নিজের সামনেই কম বয়সী যুবতী ডক্টর।হাতে রিপোর্ট।দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ রেখে রিপোর্ট গুলোর দিকেই চেয়ে আছে সেই যুবতী ডক্টর।কন্ঠেও তার তীক্ষ্ণতার তেজ স্পষ্ট।রক্তিম চোখ তুলে তাকিয়ে কিছু বলতে নিতেই সামনের সুন্দরী ডক্টর আবার ও বলে উঠল,

‘ যদি এরপরও এমন কিছু হয় তাহলে সত্যিই বেবিটা মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে মিঃ রক্তিম।ইভেন এবারও বেবিটা মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ পার্সেন ছিল।আমি মনে করি, এরপর থেকে একটু সাবধানে চলাফেরা করবে আপনার ওয়াইফ?আর যদি তা না হয় তো আপনারা আপনাদের অনাগত সন্তানকে হারাবেন।তাছাড়া বিভিন্ন প্রবলেমও হতে পারে।উনি যতোটা হালকা ভাবে আঘাত পেয়েছেন বলছেন বিষয়টা অতোটাও হালকা নয়।আমার মনে হয় না।আপনাদের খেয়াল রাখা উচিত ছিল।প্র্যাগনেন্সির এই কয়টা মাস একটু সতর্কতা নিয়ে চলা উচিত ছিল।আমি জানি না উনার প্র্যাগনেন্সি জার্নিটা কেমন কাঁটবে।তবে বেশ ভালো কাঁটবে না এটুকু বলতে পারি।তবে সতর্ক হয়ে চললে আশা করি কিছু হবে না।’

রক্তিমের মুখ গম্ভীর হলো।ঠোঁট চেপে জোরে শ্বাস ফেলেই বলে উঠল,

‘ হ্যাঁ।এরপর আর অসতর্কতা নিয়ে চলাফেরা করবে না।আমি দিব না।’

কথাটা বলেই উঠে দাঁড়াল।মুচকি হেসে ডক্টরের কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেই অদ্রিজার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল।মিনিট দুইয়ের মধ্যে পৌঁছালও অদ্রিজার কাছে।বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।চোখজোড়া বন্ধ।রক্তিম মৃদু হাসল সেই বন্ধ চোখজোড়া আর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়েই।হাতজোড়া অদ্রিজার কপালের কাছে নিয়েই ছোট ছোট চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়েই সামনের চেয়ারটায় বসল।অদ্রিজার হাতটা দুইহাতে মুঠোবন্দি করে নিয়েই চোখজোড়া বন্ধ করে সিক্ত কন্ঠে বলে উঠল,

‘ ভালোবাসি তোমায় অদ্রি।কখনো বলতে পারব কিনা এই সাংঘাতিক কথাটা জানি না।তবে ভালোবাসি।তুমি কেন বুঝো না?ভালোবাসাটা মুখে স্বীকার করতে হবে কেন।আমার কোনকিছু দেখেই কি বুঝে উঠো না আমি তোমায় ভালোবাসি?কেন বুঝো না।কেন এই যুবকটিকে এখন আর “ভালোবাসি ” বলো না?হ্যাঁ ভুল করেছিলাম। ভুলটা তো আমি করিনি ইচ্ছে করে।সৃষ্টিকর্তা আমার সাথে যেমনটা করেছিল আমার যে এইছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।আমি চেয়েছিলাম তুমি ভালো থাকো।তুমি সুন্দর জীবন লিড করো।কে জানত তোমার সাথেই আমার জীবন জড়িয়ে যাবে।তাও প্রথম রাতে এমন কিছু ঘটে যাবে নেশার ঘোরে । তখন কেবল মনে হতো নেশার ঘোরে ঐ কাজটা আমার চরম অন্যায় হয়ে গিয়েছে যেখানে সারাজীবন আমি তোমার পাশে থাকতেই পারব না সেখানে এমন কিছু করার অধিকার কি আমার ছিল?ছিল না।তবুও আমি এই অনাধিকার চর্চা করে ফেলেছিলাম।আর এই অনাধিকার যাতে আবার না ঘটে তাই তোমাকে বারংবার দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।তোমার জীবনের সাথে আমার জীবন না জড়াক এটা বারংবার চেয়েছি তখন।কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমার সেই চাওয়া পূর্ণ করল না অদ্রি।তোমার জীবনের সাথে আমার জীবনটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দিয়েছেন উনি।আমি চাইলেও তোমার থেকে আলাদা হতে পারিনি। ভালোবাসি।ভালোবাসি তোমায়।প্লিজ আমার অন্তরের এই কথাটা বুঝে নিও।প্লিজ!’

কথাগুলো বলা শেষ করতেই অদ্রিজা চোখজোড়া খুলল।সচল মস্তিষ্কে এতক্ষনকার কথাগুলো আরো একবার ভেবে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চাপল।শরীরটা অল্প ক্লান্ত।তবে কথা বলতে পারবে। ঠোঁট জোড়া টেনেই মৃদু গলায় বলে উঠল সে,

‘ ক্ কি?আবার বলুন।ভালোবাসেন আমায়?’

রক্তিম চোখ তুলে চাইল।চোখজোড়ার দৃষ্টি মুহুর্তেই অপ্রস্তুত হলো।কি বলবে বুঝে না উঠেই অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে থাকার মাঝেই অদ্রিজা আবারও বলে উঠল,

‘ কি হলো বলুন!ভালোবাসেন?বললে আপনাকে অদ্রি ডাকার অনুমতি দিয়ে দিব।প্রমিজ!’

রক্তিম হালকা হাসল।ঠোঁট টেনে মৃদু গলায় বলল,

‘ হ্যাঁ, ভালোবাসি।খুব আগে থেকেই ভালোবাসি।আরো বছর এক আগে।রায়মানের সাথে সেইবার ওর পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমার প্রথম যাওয়া।ওহ হ্যাঁ, রায়মানের সাথে আমার কোনকালেই কোন সমস্যা ছিল না অদ্রিজা।কেবল সাময়িক ভুল বুঝাবুঝি ছিল রিমুর ফিলিংসটা নিয়ে।কিন্তু যখন ও আমার ব্রেইন টিউমারের কথা জানতে পেরেছিল তারপর থেকে সব মিটে গিয়েছিল।আপনার মায়ের সামনে রায়মানের ঐ ব্যবহারটা নাটক ছিল।রিমু ভালোবাসত আমায় ঠিকই, কিন্তু তাই বলে রায়মান অতোটাও জঘন্য বিহেভ আমার সাথে করবে না এটুকুও বুঝলেন না আপনারা।যায় হোক, আমি সেইবার আপনাদের পরিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম মূলত অত্রিয়াকে দেখার জন্য। রায়মান বলেছিল ওর দিকে কোন এক পিচ্চি মেয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে আর ও সেটা নিয়ে মজা নেয়।ব্যস!সেই মজার কাহিনী নিজ চোখে দেখার জন্য রায়মানের হাজার অনুরোধে অবশেষে হাজির হলাম সেখানে।ঠিক সেখানেই ঘটে গেল বিপত্তি!আপনি নামক রমণীকে দেখে সেখানেই তব্দা খেয়ে গেলাম।না, ঠিক তখন থেকে আমি আপনাকে ভালোবাসিনি।তখন শুধু ভালো লাগাই ছিল বোধ হয়।আমি আপনাকে ফলো করতাম।আপনার চলাফেরা, কথাবার্তা সবটাই ভালো লাগত।জানি না তখন ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল কিনা।তবে বিষয়টা জট পাঁকাল অন্য জায়গায়।আপনার প্রতি ভালো লাগা বা ভালোবাসা যায় হোক, তার খোঁজই কোনভাবে মিস্টার মাহমুদ জেনে গিয়েছিল।আর ভেবেছিল আপনার সাথে আমার বিয়েটা দিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধাণ হয়ে যাবে।আমার অতি খারাপ রূপ তার কাছে ভালো হয়ে যাবে বোধ হয়।কিন্তু তিনি জানতেনই তার ছেলের ব্রেইন টিউমার। তিনি অজান্তেই যে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে ফেলছেন বুঝেই উঠেননি।আর আমি বিয়েটা করেছিলাম পিচ্চিগুলোর কথা ভেবে।ওদের জন্য ওই এরিয়াটা প্রয়োজন ছিল। আর ঐ এরিয়াটা মিস্টার মাহমুদের আন্ডারে। তাই উনার শর্ত অনুযায়ী বিয়েটা করা।ভেবেছিলাম বিয়েটাই তো।ডিভোর্স হয়ে গেলেই সবটা শেষ।আপনার জীবনও নষ্ট হবে না।কিন্তু বিয়ের প্রথম রাতেই নেশার ঘোরে যা হয়েছিল তার জন্য আমি প্রতিমুহুর্তেই ভুগেছি।প্রতি মুহুর্তেই অপরাধবোধে ভুগেছি।আপনাকে আমার থেকে দূরে সরানোর শত চেষ্টা চালালাম।কিন্তু পারলাম আর কোথায়?বাবা হবো কথাটা শুনেই আমার মন ঘুরে গেল। অনেক চেয়েও আপনার থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারিনি আমি।সেই বাবা হওয়ার কথা ভেবেই আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম।খুশিতে মাথা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল আমার।সেইদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আপনাকে এত সহজে ছাড়া যাবে না।’

‘ নয়তো ছেড়ে দিতেন?শুধুমাত্র বাবা হওয়ার আনন্দে টিকে আছে সম্পর্কটা?’

রক্তিম চোখ বন্ধ করল।তীব্র বিষাদ নিয়েই বলে উঠল,

‘ হ্যাঁ, ছেড়ে দিতাম।কারণ তখন আমার জীবনটা অনিশ্চিত ছিল।চাই নি এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে আপনার জীবন জড়িয়ে যাক।আপনি কষ্ট পান।তাই তো দিহানকে বলেছিলাম আপনাকে আগলে নিতে।দিহান আপনাকে ভালোবাসত।সেই হিসেবে সে আপনাকে খুব ভালো রাখতে পারত।এই কথাটাই মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিল তখন।কেবল আপনাকে কষ্ট না দেওয়ার জন্যই আপনাকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’

অদ্রিজার মুখ চোখ ও এবার গম্ভীর হলো।কন্ঠটা চরম রকম গম্ভীর করেই বলে উঠল,

‘ ঠিকাছে!মানলাম।’

রক্তিম হালকা হাসল।অদ্রিজার হাতটা দুই হাত দিয়ে সেভাবেই ধরে রেখে বলে উঠল,

‘ ভালোবাসি।তখন থেকে কিংবা এখন থেকে।কবে ভালোবাসার শুরু হয়েছিল জানি না। তবে এইটুকু জানি, ভালোবাসি অদ্রিজা।’

অদ্রিজা মুখ ফুলাল।গম্ভীর স্বরে বলল,

‘ ঠিকাছে।আপনাকে অদ্রি ডাকার অনুমতি দিয়ে দিলাম।’

রক্তিম হাসল।চোখ জোড়া সরু করেই অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে থেকেই অদ্রিজার হাতে চুমু দিল।মুচকি হেসেই বলে উঠল,

‘ আপনি বললেন না তো!ভালোবাসেন আমায়?

অদ্রিজার সাদা ধবধবে মুখ এবার লাল হলো।কি বলবে না বলবে স্থির করতে পারল না।চোখজোড়া বন্ধ করে নিল টুপ করেই।রক্তিমের বলা কথাটি শুনতেই পাইনি এমন একটা ভাব করেই চোখজোড়া বন্ধ রেখেই বলে উঠল,

‘ আমার ঘুম পাচ্ছে।ঘুমাব একটু।যান প্লিজ।’

.

নেহা একপাশেই পার্কের বেঞ্চিতে বসা।দিহান দাঁড়িয়ে আছে বুকে হাত গুঁজে। দুপুরের তরতাজা রোদে ঘেমে চুপসানো মুখ নিয়ে নেহার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।ফুচকাওয়ালা থেকে দুই প্লেট ফুসকা নিয়েই বেঞ্চের অন্য পাশে গিয়ে বসল।ফুসকার একটা প্লেট নেহার হাতে দিয়ে অন্য প্লেটটা বেঞ্চেরই এককোণায় রাখল।কপাল কুঁচকেই বলে উঠল,

‘ এই রোদে এভাবে ফুসকা খেতে মজা আছে?আমি খাব না।’

নেহা ঘাড় ঘুরাল।দিহানের ফুসকার প্লেটটা দিহানের হাতে ধরিয়ে দিয়েই বলে উঠল,

‘ না খেলে তোর সাথে কথা নেই।এরপর থেকে আর কোন কথা বলবি না আমার সাথে। যা ফুট!’

দিহান চোখ নামিয়ে নেহার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।এই গরমে চরম বিরক্তি নিয়েই প্লেট থেকে একটা ফুসকা মুখে ফুরল।ভরা গলায় বলল,

‘ শান্তি এবার?খেয়েছি।’

‘ মাত্র একটা।এটা কোন খাওয়ার নমুনা হলো?সবগুলো খাবি।’

দিহান কড়া চোখে চাইল এবার।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ তোকে খেতে দিচ্ছি এটাই অনেক।এই গরমে এগুলো খেয়ে পরে অসুস্থ হয়ে যাবি।সেইদিক দিয়ে তোকে খাওয়ার অনুমতি দিয়েছি এটা তো তোর ভাগ্য!’

নেহা ভ্রু কুঁচকাল।বলে উঠল,

‘ ওমাহ!আমি অসুস্থ হলে হবো।তোর কি? তুই অনুমতি দেওয়ার কে?আশ্চর্য!’

দিহান কিছু বলল না।মুখ ভার করে অন্যদিকে ফিরে রইল।মাথার উপর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা সূর্যের উত্তপ্ত রোদকে এক মুহুর্তেই সরিয়ে দিতে মন চাইল।কিন্তু সম্ভব নয়।বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে বসে থাকার মাঝেই নেহা তার সামনে এসে দাঁড়াল।মুখে ফুসকা ফুরতে ফুরতেই বলে উঠল,

‘ ভালোবাসিস আমায় দিহান?আমার কথাতে ফুসকাটা খেয়ে নিলি যে?তুই তো এসব বাইরের জিনিস খাস না।’

দিহান মুখ তুলে চাইল। মৃদু গলায় বলল,

‘ হঠাৎ এমন প্রশ্ন?’

‘ মনে হলো।’

দিহান হালকা হাসল।ঠোঁট চওড়া করে বলল,

‘ মনে হলো যখন তখন হয়তো ভালোবাসি।একটা মানুষ মুখে ভালোবাসি বলে বুঝাতে পারা, আর কাজে ভালোবাসি বুঝাতে পারা এই দুটোর মধ্যে দ্বিতীয়টাই উত্তম।তাই না?’

নেহা মুচকি হাসল।কিছু বলল না।দিহানের দিকে ফিরে আর একটাও কথা না বলে দ্রুত পেছন ফিরল।আনন্দে ধুকবুক করা হৃদয়টা জোর করে আবদ্ধ রেখেই ফুসকার প্লেটটা নিয়ে ফুসকাওয়ালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।প্লেটটা সেখানেই রেখে আড়চোখে চাইল দিহানের দিকে।মুখে চাপা হাসি যুবকটির।তবে কি সত্যিই! নিজের হাতে চিমটি দিতেই হৃদপিন্ডের হৃদস্পন্দটা দ্বিগুণ হলো নেহার।সত্যিই দিহান ভালোবাসে তাকে!

.

হসপিটালে রায়মান যখন অদ্রিজাকে একবার দেখেই বেরিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই পিচ্চি দেখতে অত্রিয়া নামক মেয়েটির আগমণ ঘটল।রায়মানের মুখোমুখি দাঁড়িয়েই কোমড়ে হাত গুঁজল সে।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ আপনি! এখানেও!সব জায়গায় এমন আপনি আপনি ময় হয়ে যাচ্ছে কেন!আজব!’

রায়মান গভীর চোখে চাইল অত্রিয়ার দিকে।মুখ ভার করেই বলে ফেলল,

‘ ভালো টালো বাসলে যা হয় আরকি।বোধ হয় আমাকে ভালোবাসো তুমি।তাই তো তোমার সবকিছু আমিময় হয়ে যাচ্ছে। তাই না?’

অত্রিয়া ঠোঁট উল্টিয়েই বলল,

‘ মোটেই না।আপনার মতো কাউকে আমি কেন ভালোবাসব।পাগলা কুকুরে কাঁমড় দিয়েছে আমাকে?আজব!’

‘ সেটাই তো।ভালোই যদি না বাসো তবে এভাবে বারবার আমার সামনে এসে পড়ছো কেন?হুটহাট আমার পথ আটকে দাঁড়াচ্ছো কেন?মুখ ফুলিয়ে আগ বাড়িয়ে কথাই বা বলছো কেন?সত্যিই কি ভালো টালো বাসো না?’

অত্রিয়া মুখ তুলে চাইল।ভ্রু কুঁচকে নিয়েই বলে উঠল,

‘ হোয়াট ইজ ভালো টালো বাসা?আই মিন, হোয়াট ইজ টালো?’

রায়মান হতাশ হলো।বুকে এক সাগর দুঃখ নিয়েই মুখ কালো করল।কেন এই পিচ্চি মেয়ের প্রেমে পড়তে গেল?কেন!এখন জীবনটাই বরবাদ।শুধু বরবাদ নয়।চরম রকম বরবাদ!এই মেয়ে তাকে জ্বালাবে।প্রচুর জ্বালাবে।কথা গুলো ভেবেই ভারী নিঃশ্বাস ফেলল।মুখ ভার করে বলল,

‘ ভালো টালো বাসা মিন, তোমার প্রতি আমার যে ফিলিংসটা আছে সেটা।এন্ড মে বি তোমার ও আমার প্রতি এই ফিলিংসটা আছে।রাইট?’

অত্রিয়া চকচকে চোখে চাইল এবার।অবিশ্বাস্য কন্ঠেই বলে উঠল,

‘ মানে, আপনি আমায় ভালোবাসেন?রিয়েলি!শ্যামপুরুষ অত্রিয়াকে ভালোবাসে এই খবরটাতো আপুকে এক্ষুনিই দেওয়া উচিত!’

রায়মান ভ্রু বাঁকিয়েই বলল,

‘ তুমি না এতক্ষন ভালো টালো বাসা বুঝছিলে না?এক ধাক্কায় সব ক্লিয়ার?কি ব্রিলিয়্যান্ট!’

অত্রিয়া পাত্তাই দিল না আর রায়মানের কথাগুলোকে।মোবাইল বের করে অদ্রিজাকে কল করতে ব্যস্ত হয়েই খিলখিলিয়ে হেসে বলে উঠল,

‘ ধুররর!আপনি আসলেই বোকা।আমার সতেরো বছর।ভালো টালো বাসা আমি বুঝব না?ওটা তো জাস্ট মজা করছিলাম।আপনি বুঝলেনই না।’

রায়মান আরেক ধাপ হতাশ হয়ে মুখচোখ কালো করল।এই মেয়েকে যতোটা পিচ্চি সে ভেবেছে ততোটাও পিচ্চি নয় এই মেয়ে।আস্ত এক বিচ্ছু!

.

‘ আপনি জানেন আমি কতোটা ভয় পেয়েছিলাম?কোন ধারণা আছে আপনার।যদি আমার বেবিটা আর না থাকত?আমার এত স্বপ্ন, কল্পনা সব যদি ভেস্তে যেত?ভেবেই কলিজা কাঁপছিল আমার!’

অদ্রিজা আধশোয়া হয়ে বসে রইল।রক্তিমের কথাগুলো শুনেই চোখ বড় বড় করে চাইল।পাশে থাকা পানির গ্লাসটা থেকে পানিটা ঢগঢগ করে খেয়ে নিয়েই হালকা হেসে বলল,

‘স্বাভাবিক তো!প্রত্যেক বাবারই তার সন্তানকে নিয়ে চিন্তা হয়।এর বাইরে অস্বাভাবিক কিছু তো করে বসেননি আপনি।তাই না জানারও বিষয় না এটা।আর হ্যাঁ, স্যরি।আমার আরেকটু সতর্ক হয়ে চলা উচিত ছিল।’

রক্তিম হালকা হাসল।রুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়েই পর্দাটা টেনে দিতে দিতে মুখ ফুলিয়ে জোরে শ্বাস ফেলেই অদ্রিজার দিকে তাকাল।তারপর বিছানার পাশের টেবিলের ড্রয়ারটা থেকে ঔষুধ নিয়ে এগিয়ে দিল অদ্রিজার দিকে।মুচকি হেসেই বলল,

‘ এবার থেকে আপনার সমস্ত কিছুর খেয়াল আমি রাখব।কেবলই নিজের সন্তানের সেফটির জন্য।আর কিছু না।কিছু ভাববেন ও না।’

অদ্রিজা ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়েই বলল,

‘ আর কি মনে করব?কি ভাবব মিঃ রক্তিম মাহমুদ?আপনি আমায় ভালোবাসেন তা তো আমি অনেক আগ থেকেই জানি।সুইটহার্ট বলে দিয়েছিল।’

রক্তিম অবাক হলো।সুইটহার্ট তার থেকে কিছু লুকিয়ে গেছে ভাবতেই পারল না।রুম থেকে বের হয়ে গিয়েই আবার কিছুটা সময় পর রুমে ডুকল।অদ্রিজার চোখমুখের দিকে দৃষ্টি ফেলেই বলে উঠল,

‘ আপনি খুবই অভদ্র অদ্রিজা।আমি আপনাকে এমনটা ভাবিই নি।সুইটহার্টের থেকে কথা হাতিয়ে নিয়ে আমাকে জ্বালাতে চাইছিলেন!আসলেই বিপদজনক মহিলা আপনি!’

অদ্রিজা খিলখিলিয়ে হাসল।ঠিক তখনই সুইটহার্ট এসে দাঁড়াল।হাতের ছোট প্লেটটায় কেঁটে রাখা ফল।অদ্রিজার দিকে এগিয়ে দিয়েই হালকা হেসে বলল,

‘ এটা কি করলে অদ্রি?জান তো এবার আমায় ভুল বুঝল।’

‘ ধুরর!তোমার জান তোমাকে বুঝে।তুমি শুধু শুধু চাপ নিচ্ছো।’

রক্তিম হাসল।সুইটহার্টে কাঁধে হাত দিয়েই মুচকি হেসে বলল,

‘ ইয়েস!তোমার জান তোমাকে ভুল বুঝতেই পারে না সুইটহার্ট।’

সুইটহার্ট হালকা হাসল ফলের প্লেটটা অদ্রিজার হাতে ধরিয়ে দিয়েই যেতে যেতে বলল,

‘ চটজলদি খেয়ে নাও অদ্রি।না বললে কিন্তু শুনব না।’

অদ্রিজা মুখ ফুলিয়ে তাকাল।রক্তিম মৃদু হেসেই তার কাছে এসে বসল। কন্ঠ পিচেল করে বলল,

‘ আপনি কিন্তু বললেন না অদ্রিজা।ভালোবাসেন আমায়?’

অদ্রিজার মুখচোখ আবারও লাল হলো লজ্জ্বায়।নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল।আগের বার যেমন এত সহজেই ‘ ভালোবাসি ‘ কথাটা উচ্চারণ করতে পেরেছিল এবার বিষয়টা ততটাই জটিল!কন্ঠ ভীষণ ভারী। সেই ভারী কন্ঠেই এই ছোট্ট ‘ভালোবাসি ‘ শব্দটি বের হওয়াটা যেন অনেক বেশি কষ্টকর।চোখজোড়া বন্ধ রেখেই জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল সে।বার কয়েক ঢোক গিলেই চোখজোড়া সেভাবে বন্ধ রেখে মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ ভালোবাসি।আমিও ভালোবাসি। ‘

রক্তিম এবার বাঁকা হাসল।অদ্রিজার কপালে ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দিয়েই ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ আজ শতবার ভালোবাসি বলতেও আমার জড়তা কাজ করবে না।ভালোবাসি অদ্রি।আমার হৃদয়ের ভেতর থাকা সেই রমণী, তুমি, তুমি নামক মেয়েটিকে বড্ড ভালোবাসি।আমার হৃদয় নিবাসে যে তুমিই অদ্রি।ভালোবাসি।’

সমাপ্ত….❤️❤️