হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব-৪৮+৪৯

0
558

#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৮
স্তব্ধ,বিমুঢ় আর ভয়মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা শামিম সাহেবকে দেখে জায়ানের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।তারপর ডা.হোসনে আরা রোজিকে ধীর আওয়াজে বলে উঠে,’ খেলা তো পুরো জমে যাচ্ছে আন্টি।’
‘ তা দেরি কিসের?চলো যাওয়া যাক।’
‘ হ্যা,চলুন আন্টি।’

জায়ান ডা.রোজিকে নিয়ে এগিয়ে গেল সবার মাঝে।রোজি সালাম জানালেন।সবাই সালামের জবাব নিলেন।নিহান সাহেব বলে উঠলেন,’ জায়ান কে উনি?উনাকে চিনলাম না তো বাবা।’

জায়ান ডা. রোজিকে বসতে বলে নিজেও সোফায় আয়েশ করে বসল।বলল,’ বোসো সবাই।তারপর পরিচয় করাচ্ছি।’

সবাই বসল জায়ানের কথায়।জায়ান নিজের হাতের আঙুলগুলো নড়াচড়া করে দেখতে দেখতে হঠাৎই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শামিম সাহেবের দিকে।শামিম সাহেব যেন ভড়কে গেলেন এতে।জায়ানের ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভয়ে র’ক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে উনার।জায়ান বাঁকা হাসল তার এই অবস্থা দেখে।পরক্ষনেই বলে,’ ফুপা আন্টিকে খুব ভালোভাবে চেনেন।কি বলেন ফুপা?চিনেন তো?’

মিথিলা স্বামির দিকে তাকালেন।স্বামির ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখেই বুঝে নিলেন।কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে।
শামিম সাহেব জায়ানের কথা শুনে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘ এ…এসব তুই ক..কি বলছিস বাবা? আমি একে চিনিনা।’
‘ সত্যি চিনো নাহ?’
‘ নাহ!’

নিহান সাহেব ছেলের হোয়ালিপনায় বিরক্ত হয়ে গেলেন।বললেন,’ হচ্ছেটা কি জায়ান?সোজাসাপ্টাভাবে উনার পরিচয় করিয়ে দিলেই তো হয়? এতো হোয়ালি করছ কেন?’

জায়ান শামিম সাহেবের দিকেই তাকিয়ে।সেই অবস্থাতেই দাঁত খিঁচিয়ে বলে,’ বাইশ বছর ধরে তো তোমরা হোয়ালিপনার মাঝেই ছিলে বাবা।আজ আমি নাহয় একটু হোয়ালি করলাম।এতে ক্ষতি কি?’

সাথি বেগম চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,’ তুই এসব কি রকম কথাবার্তা বলছিস বাবা?’
‘ এখনই সব জানতে পারবে মা।আজ আর কোনো লুকোচুরি হবে না।সব সত্য আজ সবার সামনে বেড়িয়ে আসবে।’

জায়ান দৃষ্টি তাক করল আরাবীর দিক।মেয়েটা তাকিয়ে ওর দিকে।ওই দৃষ্টিজোড়ায় কি অসীম প্রেম তার জন্যে।এক আকাশসম ভালোবাসা দেখতে পায় জায়ান আরাবীর ওই চোখজোড়ার দিকে তাকালে।ওই আদুরে মুখশ্রীর মায়া মায়া চাহনী দেখলেই মনটা জুড়িয়ে যায় জায়ানের।জায়ান একপা দুপা করে এগিয়ে যায় আরাবীর কাছে।আরাবী প্রশ্নোসূচক চোখে তাকিয়ে আছে।জায়ান আরাবীর নরম হাতজোড়া নিজের শক্তপোক্ত হাতজোড়া দিয়ে আঁকড়ে ধরল।তারপর নরম কণ্ঠে বলে উঠল,’ আমার স্ট্রং গার্ল তুমি তাই নাহ বলো?’

আরাবী কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল জায়ানের দিকে।পরক্ষণে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল।জায়ান হালকা হেসে বলে,’ আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে।’

জায়ানের হঠাৎ এইসব কথাবার্তায় আরাবীর কেমন যেন লাগছে।তাই জিজ্ঞেস করল,’ কিন্তু হয়েছে কি?আমাকে বলবেন আপনি?’
‘ এখনই সব জানবে।তুমি কোনোভাবেই ভেঙে পরবে না।সাহস রাখবে মনে।ভরসা রাখবে নিজের উপর।আমার উপর।আমি আছি তো তোমার জন্যে।আমার শেষ নিশ্বাস অব্দিই থাকব।’

আরাবী চুপচাপ জায়ানের কথাগুলো শুনল।তার মনটা কু ডাকছে।কি এমন করতে চলেছে জায়ান?যার জন্যে লোকটা ওকে এসব কথা বলছে।জায়ান আরাবীর হাত ধরে নিয়ে সেইভাবেই এগিয়ে গেল ডা.রোজির কাছে।তারপর হাসি মুখে বলে,’ আন্টি এইটাই হলো আরাবী।আমার স্ত্রী।’

ডা.রোজি ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন আরাবীর দিকে।এই মেয়েটাকেই কিনা? মা’রার জন্যে পাঠিয়ে দিয়ছিল ও অন্যের হাতে দিয়ে।মেয়েটার মায়াভরা মুখশ্রীটা দেখেই অনুশোচনাগুলো যেন কিলবিল করে আঁকড়ে ধরল উনার হৃদপিণ্ডটা।তিনি আরাবীর একহাত ধরে সেই হাতের উপর উনার কপালটা ঠেকিয়ে কেঁদে উঠলেন।কান্নারত কণ্ঠে বলতে লাগলেন,’ আমায় ক্ষমা করে দেও মা।আমায় ক্ষমা করে দেও।তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করেছি আমি।আমায় ক্ষমা করে দেও।বিগত বাইশটা বছর আমি অনুশোচনায় প্রতি মুহূর্ত দগ্ধ হয়েছি।তিলে তিলে যা আমায় ভীতর থেকে শেষ করে দিচ্ছিল।তুমি আমায় মাফ করো মা।অনেক জঘ’ন্য অন্যায় কাজ করেছি আমি।’

আরাবী দ্রুত উনার হাতের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল।তারপর ডা.রোজির বাহু ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বলে,’ এসব কি বলছেন আপনি আন্টি।কিসের ক্ষমা চাইছেন আপনি।আমি তো আপনাকে চিনিই না।তাহলে আমার সাথে অন্যা’য় করলেনই বা কিভাবে?’

ডা.রোজি চোখ মুছলেন।আরাবীর কথায় জবাব না দিয়ে এগিয়ে গেল শামিম সাহেবের দিকে।তিনি বিষ্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।এ কি হচ্ছে?কিসব দেখছেন উনি?আর রোজি-ই বা আরাবীর কাছে এইভাবে মাফ চাইছে কেন?তবে কি সেদিন ওই বাচ্চাটাকে রোজি মা’রেনি?আর…আর সেই বাচ্চাটাই কি এখনকার আরাবী?কিন্তু কিভাবে সম্ভব?কিভাবে?এটা হবার নয়।বাচ্চাটা মা’রা গিয়েছে।এ হতে পারে না।ওনার ভাবনার মাঝেই রোজি এসে উনার সামনে উপস্থিত হন।শামিম সাহেব ভড়কে গেলেন।তা দেখে রোজি হাসলেন।ঠান্ডা গলায় বলে উঠেন,’ কেমন আছিস রাশেদ?’

শামিম সাহেব চমকে উঠলেন।জায়ান ভ্রু উচিয়ে বলে উঠল,’ আরে আন্টি শুধু রাশেদ বললে তো হবে না।পুরো নামটা বলবেন নাহ?আচ্ছা আমি বলে দিচ্ছি।মি.রাশেদুল শামিম শেখ।কি ঠিক বলছি তো ফুপা?’

শামিম ভয়ার্ত গলায় বলেন,’ কি হচ্ছে কি এসব?তোমরা এমন করছ কেন আমার সাথে?’

জায়ান রাগি গলায় বলে, ‘ আমরা কোথায় করলাম ফুপা?করেছ তো তুমি।নিজের স্ত্রীর মৃ’ত্যুতে উল্লাস করেছ।নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে মা’রার জন্যে অন্যকে মোটা অংকের টাকা দিয়েছ।যাতে তোমার কুকীর্তি সম্পর্কে কেউ না জানে।’

ভয়ে বুকটা ধরাস করে উঠল শামিমের।এই সত্য জায়ান জানল কিভাবে?হঠাৎ ডা.রোজির দিকে নজর যেতেই বুঝলেন।রোজিই আছে যে জায়ানকে সব বলে দিয়েছে।শামিমের মাথায় ধপ করে রাগ উঠে গেল।তারপর এতো বছরের পরিকল্পনা সব ভেস্তে গেল।বাইশটা বছর ধরে যেই সত্যকে তিনি ধাপাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন আজ তা সবার সামনে বেড়িয়েই আসল।শামিম রেগে তেড়েমেড়ে এগিয়ে গেল রোজির কাছে।রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে বলেন,’ তুই এমন কিভাবে করলি আমার সাথে?তোকে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিলাম না আমি? তার জন্যে মোটা অংকের টাকাও দিয়েছিলাম তোকে।তাহলে কেন আমার সাথে বেঈমানী করলি বল?কেন করলি?আজ তো তোকে মেরে ফেলব আমি।’

শামিম রোজির গলা চেপে ধরল।ইফতি আর ফাহিম এসে দ্রুত রোজিকে ছাড়িয়ে আনল শামিমের কাছ থেকে।জায়ান রেগে ফোঁস ফোঁস করতে এগিয়ে গেল শামিমের দিকে।তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চড় লাগাল শামিমের গালে।হুংকার ছুড়ে বলে,’ তোর সাহস কিভাবে হলো এটা করার?তুই আমার বাড়িতে থেকেই আমার মানুষদের মারার চেষ্টা করিস।’

জায়ানের এমন ব্যবহারে সবাই অবাক।শামিম সম্পর্কে ওর ফুপা হয়।সেই ফুপার সাথে এমন বেয়াদবি আচরণ নিশ্চয়ই শোভা পায় না।নিহান সাহেব ছেলের এমন আচরণগুলো অবাক হয়ে দেখছেন।তবে তিনি এটুকু জানেন তার ছেলে অন্যায়ভাবে কোনোদিন কারো সাথে এমন বিহেইভ করতে পারেন নাহ।আর গুরুজনদের তো একেবারে না-ই।এর পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারন আছে।এদিকে মিথিলা স্বামির সাথে জায়ানের এমন ব্যবহার দেখে তেতে উঠে বলেন,’ বড় ভাইয়া এসব হচ্ছে টা কি?তোমার সামনে তোমার ছেলে আমার স্বামির সাথে এমন বেয়াদবি করছে। আর তুমি কিছু বলছ না কেন?’

নিহান সাহেব তাকালেন না অব্দি মিথিলার দিকে।তিনি জায়ানের উদ্দেশ্যে বেশ শান্তভাবেই বলে উঠেন,’ জায়ান সবাইকে সবটা খুলে বল।কেন তুমি এমন করছ?আর শামিমই বা কি করেছে?আর কিসের সত্যির কথা বলছ তুমি? সবটা বলো।’

#চলবে___________

#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৯
‘ ফুপা ওরফে রাশেদুল শামিম শেখই হলো আরাবীর জন্মদাতা পিতা।’

জায়ানের ঠান্ডা কণ্ঠে বলা এই এক বাক্যের শব্দটা যেন পুরো সাখাওয়াত বাড়িতে বজ্রপাত ঘটাল।প্রচন্ডরকম ছটকা খেলেন সবাই।এযে মোটেও আশা করেননি কেউ।আরাবী মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে।জায়ানের বলা বাক্যটি তার বুকে তীব্র ঝড় তুলে দিচ্ছে।এই লোকটা কিভাবে ওর বাবা হতে পারে?কিভাবে?আরাবী কাঁপা কণ্ঠে বলে,’ এ..এসব আপনি কি বলছেন জায়ান? উনি আমার…মানে আমার বা..বাবা কিভাবে?’

জায়ান শক্ত কণ্ঠে বলে উঠে,’ এই সত্যিটাই তোমাকে মানতে হবে আরাবী।কষ্ট হলেও মানতে হবে।এই জঘ’ন্য নিকৃষ্টতম মানুষটাই হলো তোমার আসল জন্মদাতা।’

নিহান সাহেব বলেন,’ কিন্তু শামিম কিভাবে আরাবীর বাবা হবে? শামিম তো আমেরিকায় থাকে।মানে কিভাবে কি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।তুমি সবাইকে সবটা পরিষ্কারভাবে বলো জায়ান।’

মিথিলা চেঁচিয়ে উঠলেন আকষ্মিক,’ থামো তোমরা।কি শুরু করলে তোমরা হ্যা? এই জায়ান যা বলছে সব মিথ্যে।সব মিথ্যে।সব এই মেয়েটার ষড়যন্ত্র।’

শেষ কথাটা আরাবীকে উদ্দেশ্য করে বলল মিথিলা।জায়ান মিথিলার কথায় তাচ্ছিল্যভরা হাসল।তারপর একটা কাগজ বের করে সবার সামনে তুলে ধরে বলে,’ এই হলো ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট। যা ফুপা দেশের আসার পরের দিনই আমি খুব সাবধানে করিয়ে নিয়েছি।কি বলেন তো প্রমান ছাড়া তো আবার কেউ কোন কিছুতে বিশ্বাস করে না।’

আরাবী হাত এগিয়ে দিল ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টটা চাইলো।জায়ান আরাবীকে সেটা দিল।আরাবী পুরো রিপোর্টটা ভালোভাবে পরল।যেখানে স্পষ্ট তার আর শামিমের ডিএনএ মেচ হয়েছে লিখা আছে।’

রিপোর্টটা পরে আরাবী জায়ানের উদ্দেশ্যে বলে,’এই লোকটা আবার বাবা হলে।আমার মা কোথায় জায়ান?’

‘ মা আর এই দুনিয়াতে নেই আরাবী।’

কথাটা শুনে দুকদম পিছিয়ে গেল আরাবী।বহু কষ্টে বলে,’ কি..কিভাবে হলো এসব?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল জায়ান।আর হোয়ালি না করে একে একে অতীতের সবকিছু খুলে বলল সবাইকে।সব শুনে ধপ করে সোফায় বসে পরল আরাবী।আলিফা আরাবীকে দুহাতে আঁকড়ে ধরল।ডা.হোসনে আরা রোজি আরাবীর কাছে গিয়ে অপরাধি কণ্ঠে বলে,’ আমায় ক্ষমা করে দিও আরাবী।আমি কিভাবে যেন এই পাপ কাজটা করে ফেললাম।আমায় মাফ করে দিও।’

আরাবী চোখ বন্ধ করে বড় নিশ্বাস নিলো।তারপর দৃষ্টি তাক করল ডা.রোজির দিকে।শান্ত গলায় বলে,’ নিজেকে আর দোষারোপ করবেন না আন্টি।এই দুনিয়ায় সবাই টাকার পাগল।টাকার বিনিময়ে মানুষ মানুষ’কে মে’রে ফেলে।তাতে ওদের বিন্দুমাত্র আফসোস হয় না।আর আপনি তো তাও নিজের পাপ বুঝতে পেরেছেন।অনুশোচনায় ভুগেছেন।আমি বেঁচে আছি জেনেও ওই নি’কৃষ্ট লোকটাকে কিছু জানান নি।নাহলে যে ওই লোকটা আমাকেও মেরে ফেলত।আমি তো আরও আপনার কাছে ঋণি হয়ে গেলাম।’

আরাবী এইবার জায়ানকে বলে,’ ওই লোকটাকে জিজ্ঞেস করুন জায়ান।এই লোকটা কেন করল এসব আমার মায়ের সাথে?কেন আমাকে ম’রার জন্যে ফেলে এসেছিল ময়লার আবর্জনার স্তুপে?’

জায়ান রাগি গলায় শামিমকে বলে,’ শুনেছেন? ও কি বলল?কেন করেছিলেন এসব? আর হ্যা? অবশ্যই মিথ্যা কথা বলবেন নাহ।সবাই এখন আপনার আসল রূপ দেখে নিয়েছে।’

শামিম চুপ করে আছে।আহানার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরছে।নিজের বাবার এমন জ’ঘন্য রূপ যে এভাবে ও জানতে পারবে ভাবেনি কোনদিন।আহানা একপা একপা করে শামিম সাহেবের কাছে যায়।শামিম ওকে দেখেই আঁতকে উঠেন।মেয়ের চোখের অশ্রু যে উনি দেখতে পারেন না।শামিম অস্থির হয়ে বলেন,’ মা তুই কাঁদছিস কেন?’
‘ এখনও বলবে আমি কাঁদছি কেন?আমার বাবা যে এতো বড় একজন অপরাধি এসব জেনেও কি আমায় কষ্ট পেতে তুমি বারণ করছ?’
‘ ওরা মিথ্যে বলছে মা।তুই তো জানি…’

শামিমকে থামিয়ে দিল আহানা।ধরা গলায় বলে,’ আর মিথ্যে বলো না বাবা।দয়া করে সবাইকে সবটা বলে দেও। কেন তুমি এমন করেছ?কেন এইভাবে একজন মানুষের জীবনটা ধ্বং’স করে দিলে?’

শামিম মেয়ের চোখে জল দেখে আর কোন কথা বাড়ালেন না।সোফায় বসে পরলেন।বাইশ বছর পর যেহেতু অতীত সবার সামনে এসে পরেছে তাহলে আর লুকিয়ে লাভ নেই।শামিন বলতে শুরু করলেন,’ তখন আহানা সবে জন্ম নিয়েছে।মিথিলা আর আমার সংসার বেশ সুখেরই ছিল।হঠাৎ একদিন বাংলাদেশ থেকে ফোন আসে বাবা না-কি খুব অসুস্থ।আমায় দেখতে চান।আহানা যেহেতু ছোটো আর মিথিলাও অসুস্থ তাই ওদের ছাড়া আমি একাই বাংলাদেশে আসলাম।বাংলাদেশে এসে বাবাকে সুস্থ্য করার জন্যে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করতে লাগলাম।এভাবে একজন হার্ট সার্জনের সাথে দেখা হলো আমার।সে আর কেউ না আরাবীর মা মানে ইরা ছিল।বাবার চিকিৎসা সূত্রে আমাদের সম্পর্ক বেশ ভালোভাবে জমে গেল।একসময় বেশ গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এরপরেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম।এদিকে মিথিলার সাথে যোগাযোগ হলেই সে জিজ্ঞেস করত আমি কবে ফিরব।আমি ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কারন দিয়ে দিতাম।মিথিলার জন্যে আমার খারাপ লাগত।হাজার হোক ওকে ভালোবাসি তো।কিন্তু আরেকদিকে ইরার বাবার বিশাল সম্পত্তির লোভটাও সামলাতে পারেনি।ইরা ছিল বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।ওকে বিয়ে করলেই ওই সব সম্পত্তির মালিক আমি হবো।এর মাঝে বাবা সুস্থ্য হলো বাবাকে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম।বাবা বলল ছেলে মানুষ তিন চারটা বিয়ে করলেই বা সমস্যা কোথায়?যেই ভাবা সেই কাজ আমি বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে গেলাম ইরার বাসায়।কিন্তু ওর বাবা সম্পর্কটায় মত দিলেন না সাথে সাথে।তিনি কিছুদিন সময় চাইলেন। অনেক রাগ লাগছিল আমার।কিন্তু ইরার জন্যে আমায় ভালো সাজার অভিনয় সাজিয়ে যেতে হলো।কিন্তু কে জানত এইটাই আমার জন্যে কাল হবে?ইরার বাবা লোক লাগিয়ে আমার খোজখবর নিয়ে জানতে পারলেন আমি বিবাহিত।ইরা সেসব শুনে অনেক ভেঙে পরেছিল।আমি আবারও ওকে মিথ্যে বললাম।বললাম ওর বাবা আমায় পছন্দ করেননা।ওর বিয়ে যাতে আমার সাথে না হয় এই জন্যেই তিনি ওকে এসব মিথ্যে কথা বলেছে।আরও অনেক মিথ্যে অজুহাত দিলাম।ইরা আমার প্রেমে এতোই অন্ধ ছিলো যে আমার এইসব মিথ্যেকে বিশ্বাস করে নিলো।ওকে বললাম চলো পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি।কারন বাবা যেমনই হোক সন্তানকে তো আর ফেলে দিতে পারেননা।তাই বিয়ে একবার করে নিলে আজ হোক বা কাল মেনে নিবেনই।ইরাও আমার কথায় সম্মতি দিয়ে পালিয়ে গেল আমার সাথে।বিয়ে করে নিলাম আমরা।তারপর যখন ইরার বাবার কাছে গেলাম।তিনি ইরাকে ত্যাজ্য সন্তান করে দিলেন তাড়িয়ে দিলেন ওকে।এভাবে কেটে গেল কয়েকদিন।অনেক প্ল্যান সাজাতে লাগলাম কিভাবে ইরার বাবাকে হাত করব।এর মাধ্যেই ইরা একদিন আমায় জানাল ও মা হতে চলেছে।এটা আমি চাইনি সন্তানটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।তবে বাবা আমায় বুদ্ধি দিল এই সুযোগটা হাত ছাড়া করতে না।মেয়ের ঘরের নাতি-নাতনি হওয়ার সংবাদ পেলে ইরার বাবা আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারবে না।আমিও তাই সেই কথা শুনে ইরাকে নিয়ে ওর বাবার কাছে গেলাম।স্বভাবমতো তাই হলো মেয়েকে দেখে ইরার বাবা আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেননি।সময় ভালোই কাটছিল কিন্তু ইরার বাবা তখনও আমায় পছন্দ করতেন না।শুধু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিতেন।একদিন মিথিলার সাথে কথা হয় আমার।আহানার অবস্থা নাকি অনেক খারাপ।আই সি ইউ তে ভর্তি।মেয়ের আমার এই অবস্থার কথা শুনে আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি।ইরাকে ভুলভাল বুঝিয়ে দিয়ে আমি চলে যাই আমেরিকা।এইটাই সর্বনাশ হয়ে দাঁড়াল আমার জন্যে।আমার অনুপস্থিতিতে ইরার বাবা আমার সকল বিরুদ্ধে সকল প্রমান একসাথে করে ইরাকে সব বলে দেয়।আহানা সুস্থ্য হতেই আমি আবার দেশে ফিরে আসি।তখন ইরার গর্ভাবস্থার শেষ মাস চলছিল।আমি আসতেই আমার সাথে ওর তুখোর ঝগড়া লাগল।আমি এতোসব সহ্য করতে না পেরে ওর গায়ে হাতও তুললাম।মারধোর করলাম ওকে।তারপর বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে গেলাম।ইরার বাবা সেদিন বাড়ি ছিলেন না।ব্যবসার কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন।সেদিনই ইরার পেইন উঠে বাড়ির কাজের মেয়েটা ইরাকে নিয়ে হস্পিটাল যায়।আমি বাড়ি এসে সেটা জানতে পারি।আর তখনই হাসপাতাল পৌছাই।হাসপাতালে এসেই রোজির সাথে আমার দেখা হয়।ওর থেকে জানতে পারি ইরা আর নেই।আর এদিকে ইরার বাবাও ইরাকে সম্মত্তি লিখে দেয়নি তখনও।তাই আমিও সম্মত্তি পেতাম নাহ।তাই রোজিকে টাকা দিয়ে ওর মুখ বন্ধ রাখতে বললাম বাচ্চাটা সন্তান বেঁচে আছে।বাচ্চাটাকে মে’রে ফেলতে বলে আমি চলে যাই ইরার লাশ নিয়ে।বাড়িতে ইরার লাশ নিয়ে যাই সাথে একটা ম’রা বাচ্চার ব্যবস্থা করে নিয়ে যাই।ইরার বাবাকে জানানো হয়।তিনি দ্রুত ছুটে আসেন।ইরাকে দাফন করা হয়।ইরার বাবা সম্পূর্ণ দোষ চাপালেন আমার উপর। আমি নাকি ইরাকে মেরেছি।পুলিশ কেইস ও করেন।কিন্তু উপযুক্ত প্রমান না পাওয়ায় ওরা আমার কিছুই করতে পারেন নাহ।আমারও ফিরার সময় হয়ে যাচ্ছিল।এখানে থেকেই বা কি লাভ?কিছুই তো পায়নি। এর কয়েকদিন পরেই আমি আমেরিকা চলে যাই।পরে বহুদিন পর জানতে পারি ইরার মা একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা সহ্য করতে না পেরে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর কয়েকদিন পরেই নাকি মারা যান।ইরার বাবাও একা হয়ে পরেন।তার বছর খানিক পর তিনিও মারা যান।আমি আবার ফিরে আসি সম্পত্তির জন্যে। কিন্তু সেবারও আমায় শূন্য হাতে ফিরতে হয়।কারন ইরার বাবা তার সকল সম্মতি বিক্রি করে স্কুল, হাসপাতাল,এতিমখানা তৈরি করে গিয়েছে ইরার নামে।বাদ বাকি টাকা অন্যান্য এতিমখানায় দান করে দিয়েছেন।সেবারও আমার হতাশ হয়ে ফিরতে হয়।আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।কিছুই করতে পারিনি।ভেবেছিলাম এইসব অতীতের সত্য কোনদিন কেউ জানতে পারবে না।কিন্তু…কিন্তু জায়ান তুই?তুই তা হতে দিলি না।দিলিনা আর লুকায়িত অতীতকে লুকিয়ে রাখতে।আমায় অন্ধকার গর্তের থেকে টেনেটুনে বের করেই আনলি।

#চলবে__________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।