অন্তর দহন পর্ব-২০+২১

0
409

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব___২০

স্পন্দনের সামনে এসে সৈয়দ আশরাফ অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে।স্পন্দন হেসে বললো,

__ছোট আব্বু চন্দ্রকে এ বাড়িতে আমি নিজে নিয়ে আসবো। আপনি চিন্তা করবেন না।তবে আমি কিন্তু চন্দ্রকে শুধু বেড়াতে পাঠাবো। আজীবন থাকার জন্য নয়।

সৈয়দ আশরাফ কেঁদে ফেললেন।স্পন্দন এগিয়ে এসে বললো,

__কি হয়েছে ছোট আব্বু?

__আমাকে ক্ষমা করে দিও স্পন্দন। আমি জানতাম না আমার ভাই তোমার সাথে এতোকিছু করেছে।

__এভাবে বলতে নেই বড় আব্বু। আমি জানি তাতে ওনার কোনো দোষ নেই।হয়তো টাকা আর মান সম্মান ক্ষুন্ন হবে ভেবেই এসব করেছেন।

__কিন্তু তোমার উপর আমিও কম মানসিক চাপ দেইনি স্পন্দন। আমি বারবার তোমার দূর্বল জায়গায় আঘাত করেছি। চন্দ্রকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছি।

__আপনি আঘাত করেছেন আপনার জায়গা থেকে। আপনি চন্দ্রের বাবা।মেয়ের জন্য চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক।

__আমার তোমার প্রতি বিশ্বাস রাখার দরকার ছিলো স্পন্দন।

__হবার তো অনেক কিছুই ছিলো ছোট আব্বু। আবার অনেক কিছুই হবার ছিলো না।তাই এসব নিয়ে আর কথা না বাড়ানোই ভালো।

__মনে কিছু রেখো না স্পন্দন।

__আমি কিছুই মনে রাখিনি ছোট আব্বু।

সৈয়দ আশরাফ জড়িয়ে ধরলেন স্পন্দনকে। বললেন,

__আমার চন্দ্র যেমন আমার মেয়ে। তেমন তুমি ও আমার ছেলে স্পন্দন।বাবা মা যেমন সন্তানকে ক্ষমা করে দেয়। তেমন সন্তানদের ও বাবা মায়ের করা ভুলকে ক্ষমা করে দিয়ে বুকে টেনে নিতে হয় স্পন্দন।

__জ্বী ছোট আব্বু। আপনার কথা আমি রাখবো।

স্পন্দন ও বাড়ি থেকে এসে থেকেই দেখছে চন্দ্র মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। কথা বলতে গিয়ে ও কোনো লাভ হয়নি। চন্দ্র মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।উপায় না দেখে স্পন্দন মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

__চন্দ্র এমন ক্ষেপে আছে কেনো মা?

__সবাই মিলে ছুটিতে গ্রামে যেতে চাইছে।

__তো?

__তাই তোর বউ মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।

__কেনো?

__এই শরীর নিয়ে সে গ্রামে যেতে চায়।

__অসম্ভব মা। এখন ওর কোথাও যাওয়া চলবেনা। কয়েক দিন ধরে পড়াশোনা মাথায় উঠিয়ে বসে আছে চন্দ্র।

__আমাকে এসব না বলে নিজের বউকে গিয়ে বল। আমি না করেছি দেখে আমার সাথেও কথা বলছেনা।

__আচ্ছা দেখছি আমি কি করা যায়।

স্পন্দন রুমে এসে চন্দ্রের পাশে বসে বললো,

__কে খবরটা দিলো তোমাকে চন্দ্র?চুপ করে থাকবে না চন্দ্র। উত্তর দিতে বলেছি আমি।

__রোহান ভাইয়া বড় আম্মুর ফোনে ফোন দিয়েছিলো।বলেছে এবারের ছুটিটা সবাই মিলে গ্রামে গিয়ে থাকবে। পিকনিক করবে। মজা করবে সবাই মিলে ওখানে গিয়ে।

__তোমার যে শরীর খারাপ চন্দ্র। সেদিকে কি খেয়াল আছে তোমার?

চন্দ্র চুপ করে আছে দেখে স্পন্দন আবার বললো,

__ওদের সাথে যেতে ইচ্ছে করছে?

চন্দ্র উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।

__আচ্ছা তাহলে তুমি যাবে ওদের সাথে। কিন্তু আমি যাবো না। আমার অফিসের কাজে আমাকে ছুটোছুটি করতে হবে। তোমার জন্য তো কয়েক দিন ঠিকমতো কাজ করতেই পারিনি।

__আপনি না গেলে নাই। আমি যাবো।

__আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে?

__সে আর এমন কি বড় ব্যাপার?

__আচ্ছা বেশ যেও তবে।তা কবে যাবে সবাই?

__কাল সকালে।

__আচ্ছা আমি রেহানাকে বলে দিবো ফোন করে। কিন্তু তুমি ঠিক করে বলছো তো তুমি থাকতে পারবে?

__পারবো।

__কান্নাকাটি করবে না তো?বলবে না তো স্পন্দন তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।এখন ই চলে আসো। তখন কিন্তু তুমি কেঁদে কেঁদে সাগর বানিয়ে ফেললেও আমি তোমার কাছে আসবো না।

__আচ্ছা বলবো না।

স্পন্দন উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।এই পাগলীকে বুঝিয়ে লাভ নেই।এ যে ঘাড়ত্যাড়া তাতে যেতে চেয়েছে মানে যাবেই।স্পন্দনের বলা কোনো কথাই যে এখন ওর কানে ঢুকছে না তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো স্পন্দন।

পরদিন সকাল বেলা,,,,,

সবাই হৈ হুল্লোড় করতে করতে গাড়িতে উঠলো। চন্দ্রের দিকে বারবার অসহায় হয়ে তাকাচ্ছে স্পন্দন। চন্দ্রকে একা যেতে দিতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। কিন্তু কিছু করার নেই। চন্দ্রের জেদের কাছে হার মেনে স্পন্দনকে যেতে দিতে হলো চন্দ্রকে।স্পন্দনকে রেখে গাড়ি যত দূরে যাচ্ছে চন্দ্রের নিঃশ্বাস তত ভারী হয়ে আসছে।ওর কেবল মনে হচ্ছে স্পন্দন অনেক দূরে চলে গেছে। চাইলেও আর ছুঁতে পারবে না এখন।সবার সাথে থেকেও নিজেকে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে চন্দ্রর।

__কি হয়েছে চন্দ্র?এমন ছটফট করছিস কেনো?

__কিছু হয়নি মিতু আপু। গাড়িতে এতো দূরে যাবো তাই একটু অস্বস্তি হচ্ছে।

__স্পন্দন ভাইয়ার জন্য মন কেমন করছে?

চন্দ্র মুখ লুকিয়ে নিলো মিতুর বুকে।তা দেখে মিতু বললো,

__পাগলী মেয়ে একটা।জানিস যখন ওকে ছেড়ে থাকতে পারবি না তখন আসলি কনো?

__তখন তো ভেবেছিলাম তোমরা সবাই আমাকে রেখে কতো মজা করবে। আমি সবকিছু মিস্ করবো।তাই মেনে নিতে পারছিলাম না।উনিও তো আমার কথা ভাবেন নি। আমাকে একা পাঠিয়ে দিয়েছে।

__বাব্বাহ চন্দ্র এতো অভিমান?আগে তো জানতাম না আমার চন্দ্র এতো অভিমান করতে পারে।

__খেপাবে না আপু। আমার মন কেমন করছে।

__এর মানে কি জানিস চন্দ্র?

__কি?

__এটাই হলো ভালোবাসা।এই যে তোর এখন মনে চাইছে স্পন্দন আমার সামনে থাকলে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতাম শক্ত করে।কি ঠিক না?

চন্দ্র লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিলো।বললো,

__জিজুর কাছে থেকে যে জবরদস্ত প্রেমের পিএইচডি করেছো এই কদিনে তা বেশ বুঝতে পারছি আপু।

মিতু চন্দ্রের কথায় কিছু না বলে বললো,

__রেহান? আমাদের আর পৌঁছাতে কত সময় লাগবে?

__আধ ঘন্টা পরে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় ঢুকবো আপু।

__তাহলে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে গাড়িটা একটু থামা। এভাবে বসে থাকতে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে সবার।

পাঁচ মিনিট পরে রেহান গাড়ি থামিয়ে সবাইকে চা নাস্তা করে নিতে বললো।সবাই হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে চা নাস্তা খেতে আরম্ভ করলো। চন্দ্র হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে দৃষ্টি থামিয়ে দিলো।সেদিকে দৃষ্টি অনুসরণ করে মিতু বললো,

__ওভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি দেখছিস চন্দ্র?

__তোমরা একটু বসো। আমি এখনি আসছি।

মিতু পেছনে থেকে ডাকলেও চন্দ্র না থেমে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলো। এদিকে ওদিকে দৃষ্টি দিয়ে কিছু খুঁজতে লাগলো। এরপর কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা না পেয়ে হতাশ হয়ে ভেতরে এসে বসতেই মিতু আবার বললো,

__তোর কি হয়েছে রে চন্দ্র? এমন অদ্ভুত বিহ্যাভ করছিস কেনো?মনে হচ্ছে তুই শুধু এখানেই আছিস আর মন পড়ে আছে অন্য কোথাও।

__তেমন কিছু নয় আপু।মনে হলো স্পন্দনকে দেখলাম রেস্টুরেন্টের বাইরে।তাই,,,,

__বুঝেছি।তোর মাথায় বসে স্পন্দন নেত্তো করছে।তাই এমন পাগলামী করছিস।

এই কথা শুনে সবাই হেসে উঠল একসাথে।দিপ্ত বললো,

__যেমন অন্তু ভাবী আমাদের রেহান ভাইয়ের মাথায় উঠে নেত্তো করে। ঠিক তেমনি আজকাল আমাদের
চন্দ্র আপুর মাথায়ও স্পন্দন ভাইয়া নেত্তো করছে।

__দিপ্ত ভালো হবেনা বলছি কিন্তু। ছোট মানুষ হয়ে বড়দের সামনে এসব বলিস লজ্জা করে না?

সিঁথি বললো,

__কে ছোট?দিপ্ত?তোমরা কোন জগতে আছো হে মানব মানবী গনস্?কি জানো ঐ দিপ্ত সম্পর্কে?

__দেখ সিঁথি ভালো হচ্ছে না কিন্তু বলে দিচ্ছি।

__কি করবি তুই আমার দিপ্ত?তোমরা জানো গত সপ্তাহে একটা লাভ লেটার পেয়েছি দিপ্তর। আমার বান্ধবী কে দিয়েছিল।

সবাই হা করে তাকিয়ে আছে সিঁথির দিকে।রেহান বললো,

__ভাই দিপ্ত আমি আজ পর্যন্ত অন্তুকে ভালোবাসি বলতেই পারিনি।আর তুই চিঠি পর্যন্ত পৌঁছে গেছিস?

__ও বানিয়ে বানিয়ে বলছে ভাইয়া। বিশ্বাস করো আমি এমন করিনি।

সিঁথি এবার নিজের ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে দিপ্তর দিকে তাকিয়ে পড়া শুরু করলো,

__ওগো আমার স্বপ্নচারিনী প্রিয়া,
তোমাকে কতো ভালোবাসি জানে আমার হিয়া
যদি তুমি থাকো রাজি এ জীবন রাখবো বাজী।
তুমি যদি আসো কাছে, আমি বলে দিবো ভালোবাসি
তোমার বিরহে অন্তর কাঁদে, কাঁদে আমার চোখ।
তুমি কবে বলবে আমায়,ভালোবাসি শুধু তোমায়

ইতি,
তোমার প্রেমের পাগল দিপ্ত সোনা

চিঠি পড়ার পর সিঁথি আবার সেটা ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে দেখে হা হয়ে আছে সকলের মুখ।আর দিপ্তর অবস্থা নাজেহাল।এতোক্ষণে সবাই আকাশ থেকে নেমে এসেছে।দিপ্তর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভ্রু নাচাতেই দিপ্ত এক দৌড়ে রেস্টুরেন্টের থেকে বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। মনে মনে শ খানেক গা’লি দিতে লাগলো প্রিয়াকে।মনে মনে ভাবলো,

__এতো সুন্দর করে ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে কত কষ্ট করে রাত জেগে জেগে একটা চিঠি দিয়েছে।আর ছেমরি সেটা আবার সিঁথি কেই দিয়ে দিলো। আমার মান সম্মান তো গেছে এবার।এরা যে বাহিনী। আমাকে তো ছাড়বেই না বরং উঠতে বসতে কথা শোনাবে। মজা করবে। আমার বেড়ানোর আনন্দটাই মাটি।

#চলবে,,,,,

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব___২১

চন্দ্র রেস্টুরেন্টের থেকে বেরিয়ে আসার সময় ও চারিদিকে ঘুরে ঘুরে তাকালো।মনের খচখচানি কমছে না ওর। কিন্তু এবার গাড়িতে উঠার সময়েও আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগল চন্দ্র। এরপর মনের ভুল ভেবে গাড়িতে উঠে বসলো।গাড়ি চলছে আপন নিয়মে।সবাই মিলে দিপ্তকে নিয়ে মজা করতে করতে পৌঁছে গেছে কাঁচা রাস্তায়। সেখানে গিয়ে চন্দ্র জেদ ধরলো নেমে হেঁটে হেঁটে যাবে।বাধ্য হয়ে মিতু নিরা সিঁথি ও নামলো। চারপাশের চোখ জুড়িয়ে যাওয়া সৌন্দর্য দেখে চন্দ্র দুহাত মেলে বাতাসে দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।মিতু তা দেখে বললো,

__আমি ভীষণ মিস্ করছি সিঁথি।

__কাকে আপু?জিজুকে?

__হ্যাঁ।

মিতু চন্দ্রকে ইশারা করে দেখিয়ে হেসে দিয়ে বললো,

__এমন একটা জায়গায় আমার বরটা থাকলে আমাকে পেছন থেকে রোমান্টিক মুডে জড়িয়ে ধরতো।তাইনা চন্দ্র।

চন্দ্র আনমনে স্পন্দনের কথা ভাবছিলো। ওদের কথা শুনে বুঝতে না পেরে শুধু মাথা নাড়িয়ে বললো,

__হ্যাঁ একদম তাই।

__তা আর কি কি করতি চন্দ্র?

__বরের সাথে মানুষ যেমন করে তেমনি করতাম।

এবার সবাই খিলখিল করে হাসতে লাগলো। চন্দ্রের হুঁশ ফিরতেই লজ্জায় চোখ মুখ ঢেকে নিলো। কাঁচা রাস্তা বেয়ে দৌড়ে যেতে গিয়ে পা হরকে পড়ে গেলো।সাথে সাথেই সবাই দৌড়ে এসে ওকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিতে গিয়ে দেখে চন্দ্র দাঁড়াতে পারছেনা।চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।ব্যথায় কুকিয়ে উঠে কেঁদে ফেলেছে।সবাই মিলে অনেক কষ্টে ওকে ধরে ধরে বাড়িতে নিয়ে এলো।ওরা সবাই ছোট দাদা ভাইয়ের বাড়িতে উঠেছে।এনাদের ছেলে মেয়ে নেই। অনেক জায়গা জমি লোক দিয়ে দেখাশোনা করে।আর দাদা দাদি বয়স হয়েছে। তবুও অনেক কিছু করেছে ওদের যাওয়ার খবরে। চন্দ্রকে এমন খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে দেখেই দাদি ছুটে এলো।বললো,

__কি হয়েছে দিভাই?

__পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি দাদি।

__ওকে দক্ষিনের রুমটাতে নিয়ে যাও। আমি মলম নিয়ে আসছি । একবার মালিশ করে দিলেই ভালো লাগবে।

চন্দ্র কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কষ্ট হচ্ছে খুব।স্পন্দনের জন্য মন খারাপ করছে।আর তার উপর স্পন্দনকে ফোনেও পায়নি।মিতুর ফোন থেকে ফোন করেছিলো। এদিকে বাইরে সবাই মজা করছে।আর ও পা মচকে বসে আছে বিছানায়।দাদি এসে মালিশ করে দেওয়ায় বেশ ভালো লাগছে এখন। তবুও মনটা অশান্ত হয়ে আছে। হঠাৎ করেই কারেন্ট চলে গেছে। সন্ধ্যা নেমেছে বেশ কিছু সময় হলো।তাই অন্ধকার হয়ে আছে ঘর। চন্দ্র তাও চোখ খুললো না।মনে হলো পায়ে কেউ হাত দিচ্ছে। চন্দ্র সেটা অনুভব করতেই তাকিয়ে দেখে স্পন্দন ফোনের ফ্লাশ জ্বেলে ওর পা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। চন্দ্র বললো,

__আপনি? আপনি সত্যিই এসেছেন স্পন্দন?

__না এসে আর থাকতে দিলে কোথায় চন্দ্র?

__আপনি তো বলেই দিয়েছেন আসবেন না।

__তুমি তো বলেই খালাস চন্দ্র।এই যে একটু সময়ের জন্য একা ছেড়ে দিয়েছি তোমায়।আর তুমি পা মচকে বসে আছো।একটু কি দেখে শুনে চলতে পারো না চন্দ্র?

__বকছেন কেনো স্পন্দন? আমি বুঝতে পারিনি এমন হবে।

__তোমাকে নিয়ে আর পারিনা চন্দ্র। তোমার ছেলে মানুষি কবে বন্ধ হবে বলো তো?

__হবে না কখনো।

__সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।শহর থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকেই যেভাবে আমার জন্য মন খারাপ করে ছিলে আমি তো ভাবলাম কেঁদে ফেলবে বুঝি।

__আপনি কি করে জানলেন?

__চন্দ্র যেখানে নেই সেখানে যে স্পন্দন ও থাকতে পারে না চন্দ্র।তাইতো তোমাদের সাথে সাথেই আসছিলাম।আর মিতুকে ফোন দিয়ে তোমার কথা শুনছিলাম।

__তার মানে?তখন ঠিকই আমি আপনাকে দেখেছিলাম?

__হুম। এরপর একটু বেশি পেছনে থাকতে হয়েছে আমাকে। তুমি যেভাবে ঘুরে তাকাচ্ছিলে?

__আমার মন বলছিলো আপনি আসবেন।

__আর কিছু বলেনি তোমার মন?

চন্দ্র উত্তর দেওয়ার আগেই সবাই ঘরে এসে ঢুকে ভুত দেখার মত চমকে উঠলো। শুধু মিতু ছাড়া। একমাত্র ঐ জানতো স্পন্দন আসবে ওদের সাথে।

__ভাইয়া তুমি কখন এলে?

__এইতো মাত্র এলাম।

__এসেছো ভালো করেছো। বাইরে চলো।সবাই মিলে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলবো।

চন্দ্র অসহায় হয়ে বললো,

__আমাকে নিবে না তোমরা?

__ভাইয়া তোমার বউকে নিয়ে এসো।আমরা বাইরে আছি।

সবাই যেমন গতিতে এসেছিলো।তার দ্বিগুণ গতিতে ফিরে গেছে।জানে এরপর আর স্পন্দনের সামনে থাকাটা নিরাপদ নয়।স্পন্দন চন্দ্রের মুখের উপর ঝুঁকে এসে বললো,

__বাইরে যাবি চন্দ্র?

চন্দ্র মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বোঝালো।স্পন্দন চন্দ্রকে কোলে তুলে হাঁটতে লাগলো।স্পন্দন চন্দ্রকে দেখছে মুগ্ধ চোখে। বাইরের চাঁদে আলোয় সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে।

স্পন্দনকে দেখে রেহান বললো,

__একটা গান করো ভাইয়া প্লীজ। অনেক দিন তোমার কন্ঠ শুনতে ইচ্ছে করছে।

স্পন্দন চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে খালি গলায় গাইতে শুরু করলো,

__অনেক দূরে ঐ যে আকাশ নীল হল
আর তোমার সাথে আমার আঁখির মিল হল
কৃষ্ণচূড়ার মতন এমন অনুরাগে লাল
আর খেয়াল খুশির মযুরপঙ্খী
উড়িয়ে দিয়ে পাল।
আজ এ গান আমার দোল-দোলানো
প্রজাপতির পাখা
রামধনুকের সাতটি রঙের স্বপ্নে যেন মাখা
আজ ফাগুনে ঐ আগুন ছড়ায়
পলাশেরই ভাল।
বেশ লাগে এই সীমার বাঁধন ছাড়িয়ে যেতে।
তাই দুজনে চাই যে শুধু হারিয়ে যেতে।
আজ আলাপনে মিষ্টি সুরের।
আলিম্পনা এঁকে ফু
রিয়ে যাবে প্রহরগুলো তোমায় আমায় দেখে
কুহুর গানে দুঁহুর প্রাণে
সুর যে খোঁজে তাল,,,,,,,,,,,,

গান থেমে গেছে কিন্তু দুজনের চোখে চোখ এখনো আটকে আছে।সবাই হাত তালি দিয়ে উঠতেই চন্দ্র তাড়াতাড়ি করে চোখ সরিয়ে নিলো।স্পন্দন ও উঠে চলে গেলো ওখান থেকে। এরপর অনেক সময় খেলা আর মজা করে রুমে এলো।স্পন্দন চন্দ্রকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো,

__আমার আকাশের একটা চন্দ্র আর সেটা হলো তুমি।

চন্দ্র স্পন্দনের বুকে মাথা রেখে চুপ করে আছে।স্পন্দন আবার বললো,

__কি হলো চন্দ্র? এভাবে চুপচাপ করে আছো কেনো?

__আমাকে এতো ভালোবাসেন কেনো স্পন্দন?যদি আমি কোথাও হারিয়ে যাই?

__চুপ পাগলী। এভাবে বলতে নেই।স্পন্দন থাকতে চন্দ্র হারাবে না। কখনো না।

সকাল থেকেই চন্দ্র ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে।স্পন্দন তাকে বলেও শান্ত রাখতে পারছেনা। পায়ে ব্যথা নেই বলেই বাড়ি মাথায় করে রেখেছে চন্দ্র। সকালে নাস্তা খাওয়ার পর হরহর করে দু’বার বমি করেছে চন্দ্র।স্পন্দন ডাক্তার এনে দেখিয়েছে।ডাক্তার দু’টো টেস্ট করতে দিয়েছে।আর আপতত সামান্য মেডিসিন দিয়ে গেছে।স্পন্দনের কড়া হুঁ’শিয়ারি তলব হয়েছে চন্দ্রের উপর। চন্দ্র ভয়ে শুয়ে আছে।বিকালে স্পন্দন এসে চন্দ্রকে বললো,

__আমরা সকালেই শহরে যাচ্ছি চন্দ্র।সব গোসগাস
করে নেও।

__আমি ঠিক আছি স্পন্দন?এতো কেনো ভাবছেন?ওরা সবাই,,,,

__ওরা থাকবে চন্দ্র। আমি আর তুমি ফিরছি।

__কিন্তু কেনো স্পন্দন?

__আমি বলেছি তাই।এই নিয়ে আর প্রশ্ন নয় কোনো।

থমথমে মুখে স্পন্দনের কথা শুনেই চন্দ্র বুঝতে পারলো কিছু একটা গুরুতরভাবে ঘটেছে।না হলে স্পন্দন এমন করতো না।তাই আর জিদ না করেই পরদিন সকালে শহরে ফিরে এলো।বড় আম্মু বললো,

__কি হয়েছে চন্দ্র?এতো তাড়াতাড়ি করে ফিরে এলি?সব ঠিক আছে তো?

__হ্যাঁ বড় আম্মু ঠিক আছে সব।

চন্দ্র ঘরে চলে যেতেই স্পন্দনের মা বললো,

__কি হয়েছে স্পন্দন?

স্পন্দন মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর বললো,

__চন্দ্রের শরীর ভালো না মা।ডাক্তার ওর টেস্ট করতে দিয়েছিলো।মফশ্বলের রিপোর্ট তাই আমার ভালো লাগে নি। আমি চেয়েছি এখানে এনে বড় ডাক্তার দেখিয়ে ভালো চিকিৎসা করাব।

__ভয়ের কিছু নেই তো স্পন্দন?

__না না মা।ভয়ের কিছু নেই। তুমি চিন্তা করো না।

স্পন্দন রুমে গিয়ে দেখে চন্দ্র এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে।চোখ দুটো ভীষণ ক্লান্ত। আগে কখনো এমন ক্লান্ত থাকতো না। কয়েক দিন ধরে এমন হয়েছে ওর।স্পন্দন কাছে গিয়ে বললো,

__বেশি খারাপ লাগছে চন্দ্র?

চন্দ্র হেসে বললো,

__না তো। ক্লান্ত লাগছে তাই শুয়ে আছি।

__তাহলে একটু শুয়ে থাকো।আমি একটা ডাক্তারের এপোয়েন্ট নিয়ে আসছি।

__স্পন্দন?

__কিছু বলবে চন্দ্র?

__আমার কাছে আসেন।

স্পন্দন কাছে আসতেই চন্দ্র শক্ত করে জড়িয়ে ধরল স্পন্দনকে।স্পন্দন মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

__বেশি খারাপ লাগছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?

__কোথাও হচ্ছে না। আপনি যান।

স্পন্দন চন্দ্রের কপালে চুমু খেয়ে বাইরে চলে গেছে।স্পন্দনের মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। সবকিছু শূন্য লাগছে।এই চন্দ্র ছাড়া ওর জীবনের আর সবটুকু অন্ধকার আর বিষণ্ণতায় ভরা।স্পন্দনের বেঁচে থাকতে হলে চন্দ্রকে চাই।এসব ভাবতে ভাবতেই কখন রাস্তার মধ্যে এসে পড়েছে স্পন্দন তা খেয়াল ই করেনি। শুধু বিকট একটা শব্দ হলো আর স্পন্দন রাস্তায় চিটকে পড়ে গেছে।

#চলবে,,,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।হ্যাপি রিডিং।