অন্তর দহন পর্ব-২২+২৩

0
396

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব___২২

চন্দ্রের মনটা হঠাৎ করেই কেমন আনচান করছে।বড় আম্মুর কাছে গিয়ে বললো,

__তোমার ফোন থেকে স্পন্দনকে একটা ফোন দাও তো বড় আম্মু।

__এই নে ফোন। তুই দে।

চন্দ্র পরপর দুবার ফোন করলো । কিন্তু কেউ ধরলো না। তৃতীয় বারের মতো ফোন করতেই একজন অপরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো। চন্দ্র বললো,

__স্পন্দন?

__আমি স্পন্দন না।ফোনটা ওনার পকেটে ছিলো যার এক্সিডেন্ট হয়েছে কিছু সময় আগে।

চন্দ্র চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারছেনা। অনেক কষ্ট হচ্ছে ওর।কোনো রকম ঢোক গিলে বললো,

__স্পন্দন কোথায়?

__হাসপাতালেই আছে। আপনাকে ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। আপনি ওনার ফ্যামিলিকে একটু খবরটা দিয়ে দিবেন।

চন্দ্র ফোন রেখে হাঁটু গেড়ে বসে কেঁদে উঠলো।বড় আম্মু দৌড়ে এসে বললো,

__কি হয়েছে চন্দ্র?স্পন্দন কোথায়? কাঁদছিস কেনো? চন্দ্র?

__তোমার ছেলে হাসপাতালে বড় আম্মু। একজন বললো ও নাকি এক্সিডেন্ট করেছে।বড় আম্মু তোমার ছেলের কাছে নিয়ে চলো আমাকে এখনি। আমি ওকে দেখবো বড় আম্মু।

স্পন্দনের মা ও কাঁদছে। চন্দ্র পাগলের মতো কান্নাকাটি করছে।তাই উনি ওকে সামলাতে সামলাতেই বললো,

__নিয়ে যাবো চন্দ্র মা। আগে কোন হাসপাতালে আছে বল। আমি বললাম তো নিয়ে যাবো।

হাসপাতালের রিসেপশনে চন্দ্র আর স্পন্দনের খোঁজ করছে।তারা বললেন হ্যাঁ এসেছে একটা এক্সিডেন্ট এর রুগি। চতুর্থ তলায় ইমার্জেন্সি তে ভর্তি আছে।তার অবস্থা খুব ভালো নয়।শুনেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো দুজনের। তবুও ছুটতে ছুটতে চতুর্থ তলায় পৌঁছে দেখে অনেক গুলো অপরিচিত লোক এক জায়গায় বসে এক্সিডেন্ট নিয়ে কিছু আলোচনা করছে। চন্দ্র ছুটে গেলো তাদের দিকে।বললো,

__যে এক্সিডেন্ট করেছে সে কোথায়? আমি ফোন করেছিলাম।

একজন এগিয়ে এসে ফোনটা চন্দ্রকে দিয়ে বললো,

__আইসিউতে আছে ম্যাম। খুব বাজে ভাবে এক্সিডেন্ট করেছে। অনেক কষ্ট করে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় এখানে এনেছিলাম। অনেক ব্লাড বেরিয়ে গেছে।সেন্স ছিলো না।

চন্দ্র এবার ধপ করে বসে পড়লো।আর চিৎকার চেঁচামেচি করছেনা ও। কেমন যেনো পাথরের মতো বসে আছে।কারো দিকে তাকিয়ে দেখছে পর্যন্ত না।স্পন্দনের মা এগিয়ে গিয়ে একবার গ্লাস দিয়ে স্পন্দনকে দেখলো।কান্নায় বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। চন্দ্রের পাশে বসে চন্দ্রর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,

__তোর উপর অনেক দায়িত্ব চন্দ্র। আমার স্পন্দনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তোকে। আমি মা।আর মা হয়ে তোকে বলছি একটুও ভেঙে পড়বি না।তোর শুধু একটাই কথা মনে রাখতে হবে স্পন্দনের কিছু হবে না।ওকে যেভাবে হোক ভালো করে তুলতে হবে। আমাকে কথা দে চন্দ্র। আমার ছেলেটাকে তুই ভালো রাখবি। কথা দে চন্দ্র।

চন্দ্র ওর বড় আম্মুর অশ্রুশিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে বললো,

__তোমাকে কথা দিলাম বড় আম্মু। আমি থাকতে স্পন্দনের কিছু হবে না। তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিলাম বড় আম্মু।

বড় আম্মু চন্দ্রকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,

__আমার দোয়া সব সময় তোর সাথে থাকবে চন্দ্র।

আজ দু’দিন হয়ে গেছে।স্পন্দনকে এখনো আইসিইউতে রাখা হয়েছে।আর বারো ঘন্টা টাইম দিয়েছে ডাক্তার।এর মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে কোমায় চলে যেতে পারে স্পন্দন। চন্দ্রের কাছে এসে মিশাল বললো,

__ম্যাম?

__বলো মিশাল।

__স্যারের গাড়ির ইচ্ছে করে এক্সিডেন্ট করানো হয়েছে।

চন্দ্র বিস্মিত হয়ে বললো,

__খোঁজ নাও মিশাল কাজটা কে করেছে।

__জ্বী ম্যাম। আমি আমার লোকজন লাগিয়ে দিয়েছি। একবার যদি শুধু তার নাম জানতে পারি তবে আমি যে কি করবো তার সাথে তা ভাবতেও পারছিনা।

__খুব সাবধানে মিশাল।আর এখানে কড়া নিরাপত্তা রাখবে। তোমার স্যারকে বাঁচাতেই হবে কথাটা মাথায় রেখো।

__জ্বী ম্যাম। আপনি চিন্তা করবেন না আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করছি।

__তুমি এখন এসো মিশাল।

মিশাল চলে যেতেই চন্দ্র মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে থাকে,

__আমার জন্য। শুধুমাত্র আমার জন্যেই আজ এতো বড় বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে স্পন্দনকে। আজকে যদি আমার অসুস্থতার খবরে ও বিচলিত হয়ে বাইরে না যেতো তাহলে এতো বড় বিপদ হতো না।

__চন্দ্র?

__হ্যাঁ বড় আম্মু বলো।

__দুই দিন ধরে এভাবে আছিস চন্দ্র।বাড়ির সবাই তো আছে। তুই বরং বাড়িতে গিয়ে একটু রেস্ট নে মা।

__আমার স্পন্দন আমার নাম ধরে ডাকবে বড় আম্মু।আর যদি তাই না ডাকে তাহলে আমার ভালোবাসা মিথ্যা হয়ে যাবে বড় আম্মু।

__স্পন্দনের কিছুই হবেনা মা। আমি বললাম তো।ভয় পাস না চন্দ্র।

__আমিও জানি স্পন্দনের কিছুই হবে না। তবুও ওকে আজ আমাকে ডাকতেই হবে বড় আম্মু। না হলে আমি কোথাও যাবো না এখান থেকে।

স্পন্দনের মা জানে একবার যখন চন্দ্র যাবেনা বলেছে তখন কেউই ওকে নিতে পারবে না। চন্দ্র এক দৃষ্টিতে আইসিইউ রুমের গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে আছে স্পন্দনের দিকে। চন্দ্রের বাবা চন্দ্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

__চিন্তা করিস না চন্দ্র।স্পন্দন ঠিক হয়ে যাবে।

__ঠিক বলেছো আব্বু। আমার স্পন্দনের কিছুই হবে না আব্বু। আমার স্পন্দন আমাকে রেখে কোথাও যেতে পারে না আব্বু।

__হ্যাঁ মা।তোকে ছেড়ে তো ছেলেটা থাকতেই পারে না।দেখিস না আমাদের বাড়িতে পর্যন্ত তোকে একা যেতে দেয়নি।

__আব্বু? আমার স্পন্দনকে কেউ মে’রে ফেলতে চেয়েছিল।

__কি বলছিস তুই চন্দ্র?

__হ্যাঁ আব্বু।এক্সিডেন্টটা ইচ্ছা কৃত ভাবেই করা হয়েছে। আমি যদি একবার জানতে পারি যে কেনো আর কি কারণে এমন কে করেছে।তবে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না আব্বু।

__চিন্তা করিস না মা।সব ঠিক হয়ে যাবে।

স্পন্দনের একটু একটু জ্ঞান ফিরতে শুরু করেছে।তা দেখে নার্স ছুটে ডাক্তারকে ডেকে আনলো।ডাক্তার চেকাপ করে বললেন,

__পেসেন্টের বাড়ির লোকজনকে খবর দেন সিস্টার।

নার্স বাইরে এসে খবর দিতেই চন্দ্র ভেতরে গেলো। চন্দ্রের সাথে ওর আব্বু ও এলো।ডাক্তার বললেন,

__আপনার পেসেন্ট চিকিৎসার রেসপন্স করছে। অবস্থা ডেভেলপড করছে।একটু পরেই তাকে বেডে শিফট করে দেওয়া হবে। ভাগ্য ভালো আপনাদের। এমন রুগি স্টে খুব কম করে।

চন্দ্র চোখের পানিটা মুছে নিয়ে বললো,

__আমি কি স্পন্দনকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি?

__হ্যাঁ অবশ্যই পারেন।

__ধন্যবাদ ডাক্তার। আব্বু তুমি বাইরে গিয়ে সবাইকে বলো স্পন্দন ভালো আছে। কেউ যেনো টেনশন না করে।

__আচ্ছা চন্দ্র মা।

সবাই বাইরে যাওয়ার পর স্পন্দনের হাতটা ধরে বললো,

__কখন উঠবেন স্পন্দন?কখন আমাকে চন্দ্র বলে ডাকবেন?আমি যে তোমার অপেক্ষায় আছি আপনি বুঝেন না কেনো স্পন্দন?

__ম্যাম?উনাকে বেডে শিফট করবো। আপনি বাইরে আসুন।

নার্সের কথায় উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো চন্দ্র।বাইরে আসতেই বড় আম্মু এসে বললো,

__স্পন্দন ঠিক আছে তো চন্দ্র?

__জ্বী বড় আম্মু।স্পন্দন ঠিক আছে। তুমি চিন্তা করো না।

__স্পন্দনের অফিস থেকে কেউ একজন দেখা করতে এসেছে।

চন্দ্র কৌতুহল নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে দেখে একটা অপরিচিত মেয়ে দাঁড়িয়ে। চন্দ্র চিনতে না পেরে বললো,

__জ্বী বলুন কি জন্য এসেছেন?

__স্যার কেমন আছেন ম্যাম?

__আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছেন। আপনি কে?

__আমাকে চিনতে পারবেন না ম্যাম। আপনি আপনার স্বামীকে খুব ভালো বাসেন?

__হুম ভালোবাসি তাকে। ভীষণ অল্প হলেও তাকেই আমি ভালোবাসি।

__আপনার স্বামী?

__সেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।

__সত্যি তো?

__আপনি কে?আর আপনাকে আমি সত্যি মিথ্যে কইফিয়ত দিতে যাবো কেনো?

__সেও ঠিক বলেছেন।তবে আমি যতদূর জানি আপনার স্বামী আপনাকে ভালো বাসে না।

__মুখটা সামলে রাখুন মিস্। আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার স্বামী সম্পর্কে কথা বলছেন। ভবিষ্যতে এমন কিছু বললে আমি আপনাকে ছেড়ে কথা বলবো না।

__এতো ক্ষমতা?

__আমি মনে করি ভালোবাসার ক্ষমতা অনেক বেশি।যার কাছে আপনার মতো এমন কিছু লোকের ঠুনকো আঘাত কিছুই নয়।

__তবে দেখা হচ্ছে ম্যাম!

চন্দ্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেয়েটার দিকে। কেমন অদ্ভুত লাগছিল দেখতে মেয়েটাকে।

#চলবে,,,,,,

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব___২৩

চন্দ্র স্পন্দনের পাশে বসে আছে।স্পন্দন তাকিয়ে আছে চন্দ্রের দিকে। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে চন্দ্র বললো,

__এখন কেমন লাগছে স্পন্দন?

দূর্বল শরীর নিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে স্পন্দন বললো,

__এই যে চোখের সামনে তুমি আছো চন্দ্র। এখন বেশ ভালো লাগছে।

__সেদিন কি হয়েছিল স্পন্দন?

__আমি গাড়ি নিয়ে ডাক্তারের এপোয়েন্ট নিতে যাচ্ছিলাম। তোমার কথা মনে মনে ভাবছিলাম।বা পাশে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি ওভারটেক করতে একটু অন্যমনষ্ক ভাবে রাস্তার মাঝে চলে এসেছিলাম। হঠাৎ মনে হলো সামনে থেকে একটা ট্রাক আমার দিকে ছুটে আসছে তীব্র গতিতে। আমি ব্রেক ঘুরিয়ে পাশে যাওয়ার আগেই পাশে থাকা ট্রাকটা আমার গাড়িকে পাশে যাওয়ার থেকে আটকে দেয়। এরপর একটা বিকট শব্দ হয়। আমার আর কিছুই মনে নেই চন্দ্র।

__আপনার গাড়িটা জায়গায় পিষে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল স্পন্দন।তবে আপনার ভাগ্য ভালো যে সিটবেল্ট বাঁধা ছিলো। না হলে অনেক বড় বিপদ হয়ে যেতো।এখনো অবশ্য কম বিপদ যায়নি আপনার উপর দিয়ে। তবুও বেঁচে আছেন। আমার কাছে এর থেকে বড় খুশির খবর আর দ্বিতীয়টি নেই স্পন্দন।

__মিশালকে আসতে বলো চন্দ্র।

__আসছে। আমি ফোন করেছি আপনার ফোন থেকে।একটা কথা জানতে চাই স্পন্দন।

__বলো চন্দ্র।

__হৃদি আপুর কোনো ছবি আছে আপনার কাছে?

__না।সব পুড়িয়ে ফেলেছি। কিন্তু কেনো?

__তাকে দেখতে কেমন বলতে পারবেন?

স্পন্দনের কাছে বর্ণনা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়ে গেছে চন্দ্র।ওর জানা মতে হৃদি সু’ইসাইড করেছে।তাহলে তার ফিরে আসার কথা নয়।এমনকি এই জন্য স্পন্দন জেলেও ছিলো।সে যদি বেঁচে থাকতো তাহলে তো স্পন্দনকে মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতো।হয়তো আমিই ভুল ভাবছি। এমন কিছু তো সম্ভব নয় কখনো।

স্পন্দন চন্দ্রকে এতো গভীর চিন্তা করতে দেখে চন্দ্রের হাতের উপর হাতটা রেখে বললো,

__কি হয়েছে চন্দ্র?

__ক্ কিছু না স্পন্দন। আপনি একটু ঘুমান। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

স্পন্দনের শরীর তেমন ভালো না।তাই আর কথা না বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো। কিন্তু চন্দ্রের ভেতরে উথাল পাতাল ঝড় চলছে। অনেক গুলো প্রশ্ন ওর সামনে অথচ একটার ও উত্তর নেই ওর কাছে। এমন সময় নার্স এসে বললো,

__ম্যাম আপনাকে ডাক্তার বাবু ডাকছেন।

চন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে ওর আব্বু আর বড় আম্মু বসে আছে। ওনাদের দিকে তাকিয়ে চন্দ্র বললো,

__বড় আম্মু? তুমি ভেতরে গিয়ে বসো।স্পন্দন ঘুমাচ্ছে। আমি না আসা পর্যন্ত তুমি কাউকে ভেতরে আসতে দিবে না।আর না তুমি কোথাও যাবে।

__আচ্ছা চন্দ্র আমি বসে থাকবো ওর পাশে। তুই চিন্তা করিস না মা।

__আব্বু তুমি এখানে থাকবে।চোখ কান খোলা রাখবে।কে আসছে কে যাচ্ছে খেয়াল রাখবে।

__কিছু কি বুঝতে পারছিস চন্দ্র মা?

__অনেক কিছুই বুঝতে পারছি আব্বু।তবে সবকিছু এখনো ধোঁয়া ধোঁয়া আবছা। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস স্পন্দনের বেঁচে থাকা নিয়ে অনেক জনের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।তাই বারবার ওদের আঘাত আসতে থাকবে আব্বু। আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।

__আমি তোর সাথে আছি চন্দ্র।ভয় পাস না মা।

__বড় আম্মুকে কিছু বলো না। টেনশন করবেন উনি। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছি।

চন্দ্র করিডোর থেকে বেরিয়ে ডাক্তারের কেবিনে গিয়ে নক করলো।ডাক্তার ভেতরে ডেকে বসতে বললেন। এরপর স্পন্দনের রিপোর্ট গুলো বের করে টেবিলে রেখে শুকনো মুখে বললেন,

__দেখুন মিসেস্ স্পন্দন আমরা স্পন্দন মির্জার যে রিপোর্ট গুলো হাতে পেয়েছি তাতে কিছু ভয়ংকর কথা লেখা আছে। আমি চাইনা আপনার কাছে কোনোকিছু লুকিয়ে রাখতে। আমি চাই আপনি ও আপনার স্বামী সম্পর্কে সমস্ত বিষয়ে অবগত থাকুন।

__জ্বী বলুন আপনি কি পেয়েছেন রিপোর্টে?

__স্পন্দনের শরীরের আঘাত গুলোর মধ্যে সব থেকে বড় আঘাত ও মাথায় পেয়েছে।এতে ওর মাথার নার্ভ গুলো ক্ষতিগ্রস্ত।আর ওর যে নার্ভ গুলো এখনো আছে সেখানে ব্লাড জমে গেছে।

চন্দ্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে। চন্দ্র জানতো স্পন্দনের এই এক্সিডেন্টে ওর অনেক বড় আঘাত লেগেছে। কিন্তু এতটা আঘাত লেগেছে এটা বুঝতে পারে নি।তাই নিজেকে সামলাতে পারছে না চন্দ্র।

__আমি বলছি না যে এতে ওর বেঁচে থাকা বা সুস্থ থাকা সম্ভব নয়। আমি বলছি ওর জীবন সংশয় আছে এতে। আপনার এ বিষয়ে অবগত থাকতে হবে।ওর যে নার্ভ গুলোতে ব্লাড জমেছে সেখান থেকে ওর শারীরিক অবস্থার মাঝে মাঝেই অবনতি হবে। এগুলো আপনার খেয়াল রাখতে হবে।অন্তত ছয় মাস ওনাকে কোনো মেন্টাল প্রেসার দেওয়া যাবেনা।বড় আঘাত পেলে কিন্তু ভীষণ বড় বিপদ আসতে পারে মিসেস্ স্পন্দন।

ডাক্তারের বলা প্রতিটা কথাই চন্দ্রের মস্তিষ্কের ভেতরে মি’শাইলের মতো আঘাত করছে।ওর একটাই কাজ স্পন্দনকে বাঁচাতে হবে সেটা যেভাবেই হোক।বড় আম্মুকে এসব বললে উনি ভেঙে পড়বেন।বড় আব্বু জেলে।তাকেও খবর দেওয়া যাবেনা। চন্দ্রের এসব ভাবনার মধ্যে ডাক্তার বললেন,

__আমি জানি কথাগুলো শুনে আপনার উপর কতটা প্রভাব পড়ছে। কিন্তু ডাক্তার হিসেবে আমার দায়িত্ব আমার রুগির সমস্ত ডিটেইলস তার বাড়ির লোককে দেওয়া। আমি বুঝতে পারছি আপনার বয়স কম।স্বামীর এতো গুলো সমস্যা সম্পর্কে জানতে পেরে নিজেকে সামলে নিতে আপনার কষ্ট হচ্ছে মিসেস্ স্পন্দন। তবুও আমি বলতে বাধ্য। আমি ও নিরুপায়।তবে আমি আপনাকে এটুকু আশ্বাস দিতে পারি স্পন্দন মির্জার যেকোনো বিষয়ে আপনি আপনি আমাকে এসে বলবেন। আমি ওর ডাক্তার হিসেবে ওকে বাঁচিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।বাকিটা আল্লাহ পাক জানেন। আমার চিকিৎসার যতটুকু সাহায্য আপনাকে করা সম্ভব আমি তা করবো।

__আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো ডাক্তার বাবু। আমার স্বামীর জীবন সংশয় আছে এটা আপনি আর কাউকে বলবেন না।ওর মা বাবা বয়স্ক মানুষ।তারা সামলাতে পারবে না।

__আপনি যেমন বলবেন মিসেস্ স্পন্দন।আমি ঠিক তেমনি করবো।

__আর একটা কথা ডাক্তার বাবু।

__জ্বী বলেন।

__স্পন্দন যেনো নিজের এই সমস্যা গুলো সম্পর্কে জানতে না পারে। আপনি আমাকে কথা দেন যে ওকে কিছু বলবেন না।

__কিন্তু মিসেস্ স্পন্দন আমাকে তো এটা তাকে বলতেই হবে।

__প্লিজ ডাক্তার বাবু আমার দিকটা একটু ভাবুন। আমার স্বামীর এক্সিডেন্টটা ইচ্ছে করে করানো হয়েছে। আমার স্বামীকে মেরে ফেলতে এই হাসপাতাল পর্যন্ত লোক পৌঁছে গেছে। আমি কিভাবে এখনো তাকে দেখে রেখেছি তা আমি জানি। আপনার সহযোগিতা ছাড়া বাকিটা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।প্লিজ আমাকে সহায়তা করুন ডাক্তার বাবু।

__আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন মিসেস্ স্পন্দন। আমি পূর্ণ সহযোগিতা করবো আপনার স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখতে।

__ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করবো না ডাক্তার বাবু। আল্লাহর কাছে আপনার জন্য লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করি তিনি যেনো আপনার নেক হায়াত দান করেন। আমার স্বামীর জন্য দোয়া করবেন ডাক্তার বাবু।

__অবশ্যই করবো মিসেস্ স্পন্দন। আমি যতটুকু পারি আপনাকে সহায়তা করবো।

__এই খবরটা দয়া করে বাইরে না যায় ডাক্তার বাবু।

__আমি সেদিকে খেয়াল রাখবো মিসেস্ স্পন্দন।

__আমি এখন আসি ডাক্তার বাবু।

__জ্বী আসুন।

ডাক্তারের কেবিন থেকে এলোমেলো বিধ্বস্ত পায়ে বেরিয়ে এলো চন্দ্র। নিজের শরীর ও আগে থেকেই ভালো ছিলো না।তার উপর কয়েকদিন ধরে যেভাবে খাওয়া ঘুম নেই চন্দ্রের তাতে আরো ভেঙে পড়েছে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা এই সময়ে।তাই যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে চলেছে চন্দ্র। বাইরে এসে দেখে ওর মা আর মেঝো আব্বু আম্মু আসছে। চন্দ্রকে দেখেই ওনারা এগিয়ে এলেন। চন্দ্রের কাছে জানতে চাইলেন ডাক্তার কি বলেছে। চন্দ্র বললো,

__স্পন্দন ঠিক আছে। সমস্যা নেই।আমরা কয়েকদিন পরেই ওকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবো।

সবাই একসাথে বলে উঠল,

__আলহামদুলিল্লাহ।

চন্দ্রের মাথায় ওর মা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

__কয়েকদিন ধরে সমানে দৌড় ঝাঁপ করছিস চন্দ্র।তোর শরীরের দিকেও তো তাকানো যাচ্ছেনা মা।

__আমি ঠিক আছি আম্মু। আমার স্পন্দন সুস্থ হয়ে গেলে আমিও সুস্থ হয়ে যাবো।তোমরা আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না আম্মু।

ওর মা চোখটা মুছে নিয়ে বললো,

__আমার সেই দিনের এতোটুকু চন্দ্র। আজকে কতটা বড় হয়ে গেছে। নিজেকে সামলে স্বামী সংসার সামলাতে শিখে গেছে রে মেঝো আপা।

__আমাদের চন্দ্র লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে।ও পারে না এমন কোনো কাজ নেই ছোট। তুই চিন্তা করিস না ছোট।

__হুম মেঝো আপা।

__আমি বড় আম্মুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আম্মু। কিছু খাইয়ে দিও। আম্মুর প্রেসার আপ ডাউন করছে এতো টেনশনে।

__তুই একটু খাবি না চন্দ্র?

__আমি পরে খাবো মেঝো আম্মু।আসছি আমি।

চন্দ্র যাওয়ার সময় মিশালকে একটা টেক্সট করে দিলো। এরপর স্পন্দনর কেবিনে চলে গেলো।

#চলবে,,,,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।